‘মার্কসবাদ সবসময়ই সকল আধুনিক ধর্ম ও গীর্জা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে, এবং প্রতিটি ধর্মীয় সংগঠনকে বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়ার হাতিয়ার, যা শোষণের ব্যবস্থা রক্ষায় এবং শ্রমজীবী শ্রেণীকে হতবুদ্ধি করার কাজে ব্যবহৃত হয়, হিসেবে গণ্য করেছে।
‘একই সাথে এঙ্গেলস সেসব লোকেরও নিন্দা করেছেন, যারা সোস্যালডেমোক্রাটদের চেয়েও বেশি বামপন্থা’ বা ‘বেশি বিপ্লবী’ হতে চায়, যারা ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার লক্ষ্যে শ্রমিকের রাজনৈতিক দলের কর্মসূচীতে নাস্তিক্যবাদের সুস্পষ্ট ঘোষণা অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। লন্ডন প্রবাসী ব্লাংকুইপাষ্ট্ৰী কমিউনিষ্টদের বিখ্যাত ঘোষণাপত্র সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ১৮৭৪ সালে এঙ্গেলস ধর্মের ব্যাপারে তাদের উচ্চনাদের যুদ্ধ ঘোষণাকে নিবুদ্ধিতা হিসেবে অভিহিত করেন এবং বলেন যে, এ ধরনের যুদ্ধ ঘোষণা ধর্ম সম্পর্কে আগ্রহ নতুন করে জাগিয়ে তোলার এবং এটিকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার সর্বোত্তম পন্থা। এঙ্গেলস ব্লাংকুইদের দোষারোপ করে বলেন, তারা বুঝতে পারে না যে, একমাত্র শ্রমজীবী জনগণের শ্রেণীসংগ্রামই প্রলেতারিয়েতের ব্যাপক অংশকে সচেতন বিপ্লবী সামাজিক অনুশীলনের মধ্যে টেনে এনে নিপীড়িত জনগণকে ধর্মের জোয়াল থেকে প্রকৃতপক্ষে মুক্ত করতে পারে; আর এর বিপরীতে, ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে শ্রমিকদের রাজনৈতিক দলের একটি রাজনৈতিক কাজ হিসেবে ঘোষণা করা নেহাত-ই নৈরাজ্যবাদী বুলি কপচানো … এঙ্গেলস জোর দিয়ে বলেছেন যে, ধর্মের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক যুদ্ধ ঘোষণার জুয়াখেলায় জড়িয়ে না ফেলে প্রলেতারিয়েতকে সংগঠিত করা ও শিক্ষাদান করার কাজটি ধৈৰ্য্যের সাথে সম্পাদন করার সামর্থ্য শ্রমিকদের রাজনৈতিক দলের থাকা উচিত।
‘আমরা ধর্মের বিরুদ্ধে লড়ব-এটা সকল বস্তুবাদের এবং সবশেষে মার্কসবাদের গোঁড়ার কথা। তবে মার্কসবাদ এমন কোন বস্তুবাদ নয়, যা গোঁড়াতেই থেমে গেছে। মার্কসবাদ আরো এগিয়ে যায়। মার্কসবাদ বলে ৪ ধর্মের বিরুদ্ধে কিভাবে লড়তে হয়, তা আমাদের জানতে হবে এবং এ জন্যে আমরা জনগণের মধ্যে বস্তুবাদী পন্থায় বিশ্বাস ও ধর্মের উৎস ব্যাখ্যা করব। ধর্মকে মোকাবিলা করার ব্যাপারটি বিমূর্ত তত্ত্ব প্রচারের মধ্যে সীমিত রাখা যায় না এবং এ কাজটিকে এ ধরনের প্রচারে সীমাবদ্ধ করা যাবে না। এটিকে শ্রেণী আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট অনুশীলনের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে হবে, যার লক্ষ্য ধর্মের সামাজিক মূলগুলোকে নির্মূল করা।’ (লেনিন, সংগৃহীত রচনাবলী, খণ্ড ১৬, ইংরেজি সংস্করণ, প্রোগ্রেস পাবলিশার্স, মস্কো, ১৯৭৩, পৃঃ ৪০৩, ৪০৪ ও ৪০৫, গুরুত্ব আরোপ লেনিনের। এখানে অনীক, মে, ১৯৯৫-এ প্রকাশিত সাদেক রশিদ-এর ‘প্ৰসঙ্গ ৪ তসলিমা নাসরিন’ থেকে সংগৃহীত, অনুবাদ তীরই।)
ধর্মের বিরুদ্ধে (এবং এইভাবে ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে) কিভাবে লড়তে হবে অবশ্যই তা আমাদের জানা দরকার। এক্ষেত্রে কোন সন্দেহ নেই যে, এই লড়াই করতে হবে জনসাধারণের মধ্যে থেকে, তাদের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক সংগ্রামের সাথী হয়ে। চীনের পূর্বোক্ত অভিজ্ঞতা যেমন এটিও জানায় যে, আসলে ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী শোষিত মানুষই, যাঁরাই মূলত ধর্ম ও ধর্মীয় মৌলবাদের দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এবং তাঁরা তা করবেন তাদের সামগ্রিক আন্দোলনের অংশ হিসেবেই। সচেতন ব্যক্তিদের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের সংগঠিত করে সঠিক দিশার সঙ্গে পরিচিত করা এবং তাঁদেরই হাতে নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়া। বর্তমান বিশ্বে এই ‘শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী’ মানুষের সঙ্গে বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছে উচ্চ মাইনের তথাকথিত শ্রমিক থেকে নানা স্তরের বুদ্ধিজীবীরাও। এদের মধ্যে সচেতনতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার আন্দোলন যেমন গড়ে ওঠে, তেমনি, ধর্মসহ প্রতিষ্ঠানিক বিভিন্ন কায়েমী স্বার্থের সঙ্গে তাদের কারো কারোর স্বাৰ্থও গাঁটছড়া বাধা। তবু এই স্তরের ব্যক্তিদের একটি বড় অংশই ধর্মের বিরুদ্ধে তথা ধর্মীয় মৌলবাদের মত নানা অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইতে সামিল হবেন। এবং ধর্মীয় মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধিতার বিরুদ্ধে লড়াইতে সাধারণ ধর্মবিশ্বাসীরাও অংশগ্রহণ করতে সক্ষম। ধর্মবিশ্বাসী মাত্রেই মৌলবাদী নন এবং তাঁদের অনেকেই মৌলবাদকে ঘূণাও করেন (যদিও ধর্ম তাদের অনেকের নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসের মত)। মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে এই ধরনের বিভিন্ন স্তরের মানুষই শরিক।
এঙ্গেলস যখন ধর্মের ব্যাপারে ‘উচ্চনাদের যুদ্ধ ঘোষণাকে নিবুদ্ধিতা হিসেবে অভিহিত করেন।’ তখন সাম্প্রতিক কালের হিন্দু-মুসলিম-খৃস্ট মৌলবাদীরা দূরের কথা, আমেরিকায় ফান্ডামেন্টালিস্টরাই সুসংগঠিত হয়ে ওঠেনি। একইভাবে মার্কসএঙ্গেলস-এর সময়ে ফ্যাসিবাদেরও উদ্ভব ঘটেনি, দেশে দেশে নয়া ফ্যাসিস্ট ধর্মীয় মৌলবাদের ক্রমবর্ধমান তাণ্ডবও দেখা যায়নি। তাই ধর্ম প্রসঙ্গে লড়াইয়ের জায়গাটা এখন শুধু ধর্মে আবদ্ধ নেই, তা একটি বিশেষ মাত্রা পেয়ে আরো হিংস্র, উগ্র, গোঁড়া ও অন্ধ মৌলবাদীদের ক্ষেত্রেও প্রসারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে নিজেদের নিছক ধর্মীয় কর্তৃত্বের জোয়াল থেমে মুক্ত করার দীর্ঘস্থায়ী ধৈর্যসাপেক্ষ প্রক্রিয়া নয়, মৌলবাদের বিরুদ্ধে দ্রুতগতির লড়াইও চালানো দরকার। কোন এক দূর বা অদূর ভবিষ্যতে ‘ধর্মের সামাজিক মূলগুলোকে নির্মূল করার’ মধ্য দিয়ে ধর্মের স্বাভাবিক বিলুপ্তি ঘটবে,-স্পষ্টতঃ তখন ধর্মীয় মৌলবাদের অস্তিত্বেরও কোন প্রশ্ন আসে না। কিন্তু এখনকার জঙ্গী মৌলবাদীদের রুখতে, বিশেষত ‘শ্রেণীসংগ্রামের’ বর্তমান বিভ্রান্তিকর পরিবেশে, মৌলবাদ প্রসঙ্গে বিশেষ কর্মসূচী নেওয়া দরকার। শ্রেণীসংগ্রাম তীব্রতর করা, সমমনস্ক ব্যক্তিদের সংগঠিত করা, শোষিত জনগণকে সংঘবদ্ধ করে। শিক্ষাদান করার কাজ আরো বিকশিত হওয়া যেমন উচিত, তেমনি প্ৰত্যক্ষভাবে শুধু ধর্মের প্রসঙ্গে প্রচার অ্যাগের চেয়ে, (অন্তত মার্কস-এঙ্গেলস-এর আমলের চেয়ে) অনেক বেশি গুরুত্ব পাওয়া দরকার।