কেউ আবার ‘সাম্প্রদায়িকতা’ কথাটিকে শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন, মনে হয়, ধর্মীয় মৌলবাদের প্রায় সমার্থক হিসেবে। (“কোনো ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া হয় যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধাচারণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্ৰস্তুত থাকে। এক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিবিশেষের ক্ষতিসাধন করার মানসিক প্রস্তুতি সেই ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় অথবা বিরুদ্ধতা থেকে সৃষ্ট নয়। ব্যক্তি বিশেষ এক্ষেত্রে গৌণ, মুখ্য হল সম্প্রদায়।”—বদরুদ্দিন উমর-এর সাম্প্রদায়িকতা’, নবপত্র প্রকাশন)
তবে এঁরা সবাই সচেতন যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদ–এ দুটির মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত কিছু পার্থক্য আছে। তাই সাধারণতঃ দুটিকে ভিন্ন ভাবেই ব্যবহার করা হয়। যেমন, ‘ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিপদ যে ক্রমবর্ধমান, এ বিষয়ে বোধহয় বিতর্কের অবকাশ নেই। …সাম্প্রদায়িকতাকে ইন্ধন জোগায় যে ধর্মীয় মৌলবাদ, তার প্রভাবও ক্রমবর্ধমান।” (‘সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদ’ শিরোনামের মুখবন্ধ; অনীক, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৯০)
অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে ‘সাম্প্রদায়িক’, ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বা ‘ধৰ্মসম্প্রদায়’ কথাগুলি ব্যবহার করেছেন তা তখন অপ্রচলিত কিন্তু আধুনিক পরিভাষার ‘মৌলবাদী’ ও ‘মৌলবাদের’ কাছাকাছি। (“… সম্প্রদায়ের নামে ব্যক্তিগত বা বিশেষ জনগত স্বভাবের বিকৃতি মানুষের পাপবুদ্ধিকে যত প্রশ্রয় দেয় এমন বৈজ্ঞানিক ভ্রান্তিতে কিংবা বৈষয়িক বিরোধেও না। সাম্প্রদায়িক দেবতা তখন বিদ্বেষবুদ্ধির, অহংকারের, অবজ্ঞাপরতার, মুঢ়তার দৃঢ় আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়; শ্ৰেয়ের নামাঙ্কিত পতাকা নিয়ে অশ্রেয় জগদব্যাপী অশান্তির প্রবর্তন করে-স্বয়ং দেবত্ব অবমানিত হয়ে মানুষকে অবমানিত ও পরস্পর-ব্যবহারে আতঙ্কিত করে রাখে। আমাদের দেশে এই দুর্যোগ আমাদের শক্তি ও সৌভাগ্যের মূলে আঘাত করছে।” কিংবা “ধৰ্মসম্প্রদায়েও যেমন সমাজেও তেমনি, কোনো এক পূর্বতনকালে যে সমস্ত মত ও প্রথা প্রচলিত ছিল সেগুলি পরবর্তীকালেও আপন অধিকার ছাড়তে চায় না।”—মানুষের ধর্ম, ১৯৩৩)
অন্যদিকে ‘মৌলজীবী’ বলে একটি অদ্ভুত শব্দও ব্যবহার করেছেন কেউ কেউ। প্রচলিত ‘মৌলবাদী’ শব্দটির অভিন্ন অর্থে ব্যবহার করলেও বুৎপত্তিগত অর্থে শব্দটি একটু খটােমটােই লাগে। (“…কী হিন্দু কী মুসলিম সমস্ত রকমের মৌলজীবীরা নানান ফাঁক ফোঁকর দিয়ে এই অসুস্থ কার্যপ্রবাহটা দাপটের সঙ্গে কায়েম করে চলেছে।” ইত্যাদি। সুজিত সেন-এর ‘সাম্প্রদায়িকতা : রাবীন্দ্ৰিক অভিজ্ঞান’; ‘সাম্প্রদায়িকতা : সমস্যা ও উত্তরণী’, ১৯৯১)
কিন্তু এরই পাশাপাশি এটিও সত্য যে মৌলবাদ-মৌলবাদী কথাগুলিও কিছু ব্যতিক্রমী পদ্ধতিতেই সৃষ্টি হয়েছে। অধ্যাত্মবাদ, পুঁজিবাদ, বিবর্তনবাদ, নারীবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সমাজবাদ, সাম্যবাদ, গান্ধীবাদ, মতবাদ, মার্কসবাদ ইত্যাদি শব্দগুচ্ছে সব সময়েই একটি বিশেষ্য শব্দের পরে ‘বাদ’ প্ৰত্যয় যোগ করে নতুনতর তাৎপর্যের নতুন শব্দ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু মৌলবাদে ‘মৌল’ একটি বিশেষণ। সেক্ষেত্রে ‘মূল্যবাদ’ ও ‘মূল্যবাদী’ কথাগুলি হয়তো প্রচলিত পদ্ধতিগত বিচারে সঠিক হত। তবু কোনভাবে একসময় মৌলবাদ-মৌলবাদী কথাগুলি এত ভালভাবে চালু হয়েছে যে, একে এখন পাল্টানোর প্রচেষ্টা না চালানোই ভাল। সব সময় আগেকার নিখুঁত হিসেব আর নিয়ম মেনে ভাষার বিকাশ ও নতুন শব্দের সৃষ্টি হতেই হবে এমন ‘মৌলবাদী’ ভাবনা না থাকাই মঙ্গল।
তৈরী যেভাবেই হােক না কেন মৌলবাদ-মৌলবাদী কথাগুলি এখন হরদম ব্যবহৃত হচ্ছে। নানা জনে নানা ভাবে তার প্রয়োগ করছেন, অনেক ক্ষেত্রেই একটি অস্পষ্ট বা সাধারণ ভাসা ভাসা অর্থে। তবে সবক্ষেত্রে উগ্ৰ গোড়া ধর্মান্ধ মানসিকতার সঙ্গে তাকে অবশ্যই যুক্ত করা হচ্ছে। কিন্তু আমেরিকার ফাণ্ডামেন্টালিজম-এর অন্যান্য দিকগুলি, –যেমন বিবর্তনবাদ ও কমুনিজম বিরোধিতা কিংবা হান্ধা আমোদপ্রমোদ পরিহার করা ও ধূমপান-মদ্যপান না করার মত আচার-আচরণ, তথা ভোগবাদ বিরোধিতা ইত্যাদিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফাণ্ডামেন্টালিজম-এর ভাবগত দিকটিই গ্রহণ করা হয়েছে। তবু আমেরিকায় সৃষ্টি হওয়া ফাণ্ডামেন্টালিজম ও ফাণ্ডামেন্টালিস্টদের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় এখানে রাখার চেষ্টা করা যায়।
২. ফান্ডামেন্টালিজম ও ফান্ডামেন্টালিস্টরা
বাংলা ‘মৌলবাদ’ কথাটি যে ইংরেজী ‘Fundamentalism’ (ফান্ডামেন্টালিজম)–এর অনুপ্রেরণায় সৃষ্টি (coin) করা হয়েছে তাতে প্রায় কোন সন্দেহ নেই। মৌলবাদ বা Fundamentalism বিগত শতাব্দীতে আমেরিকার প্রোটেস্টান্ট খৃস্টানগোষ্ঠীর মধ্যে উদ্ভূত হয়েছিল এবং খৃস্ট ধর্মের একটি অন্যতম ক্ষুদ্র উপ-গোষ্ঠী হিসেবে স্বাতন্ত্র লাভ করেছে। তবে মানসিকতাটি অতি ব্যাপক। মৌলবাদী বলতে সাধারণভাবে যা বোঝানো যায়। তার চরিত্র ও লক্ষণগুলি এই বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যেও ছিল বা আছে। কিন্তু শুধু মৌলবাদী বা খৃস্টীয় মৌলবাদী বলে Fundamentalist (ফান্ডামেন্টালিস্ট)-দের বোঝানো মুস্কিল, ‘ধৰ্মীয় মৌলবাদী’ বলে তো নয়ই। এই বিশেষ গোষ্ঠীকে বোঝাতে Fundamentalist কথাটিই ব্যবহার করা দরকার। এখনো খৃস্টানদের মধ্যে এঁদের অস্তিত্ব রয়েছে।