মার্কসীয় দর্শনকে সামনে রেখে (তা সে যত আলগাভাবেই ঝুলিয়ে রাখা হোক না কেন), ‘বামপন্থী’দের একটি বড় অংশ অন্যদিকে ধর্ম সম্পর্কে যে হাস্যকর অবস্থান গ্রহণ করেন তাতে পরোক্ষে ধর্মজীবীদের হাতই শক্ত হয়। মার্কসবাদ, বস্তুবাদী দর্শন ইত্যাদির কথা বলেও যখন দেখা যায়। এইসব বামপন্থীরা পাড়ার দুর্গাপূজা-কালীপূজার পৃষ্ঠপোষকতা করেন (যুক্তি?—জনসংযোগ), ঠনঠনিয়া বা দক্ষিণেশ্বরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কপালে মাথা ঠোকেন (যুক্তি?-অভ্যাস), জ্যোতিষ আর কুষ্ঠিবিচার কিংবা শ্ৰাদ্ধ ও ধর্মীয় আচার মেনে বিয়ে করেন (যুক্তি?—জ্যোতিষে কিছু বিজ্ঞান আছে এবং শ্ৰাদ্ধ ইত্যাদি দেশীয় ঐতিহ্য) ইত্যাদি,-তখন অন্য মানুষদের কাছে ধর্মের (এবং ধর্মীয় মৌলবাদীদেরও) গ্রহণযোগ্যতাই বাড়ে। সাম্প্রতিক ভারতে বন্যার মত ছড়িয়ে পড়া ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদী দাপটের পেছনে স্থানীয় বামপন্থী আন্দোলনের (নিকট অতীতেও যার বৈজ্ঞানিক অবস্থান ছিল এবং এখনো সংখ্যালঘু কিছুজনের মধ্যে আছেই)। চরম বিচ্যুতি ও শূন্যতা বেশ কিছুটা ভূমিকা পালন করেছেই।
জনগণের আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তভাবে মিশিয়ে বিজ্ঞানমনস্কতার স্বপক্ষে ও ধর্মপ্রসঙ্গে আন্দোলনও অবশ্যই করা দরকার। একটিকে ছাড়া আরেকটি সফল হতে পারে না। মাওসেতুং যেমন বলেছিলেন, ‘আমি যখন গ্রামাঞ্চলে ছিলাম তখন কৃষকদের মধ্যে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আমিও প্রচার চালিয়েছিলাম।’ এবং যেভাবে করেছেন তার একটি সামান্য পরিচয় কৃষকদের সামনে রাখা তাঁর বক্তব্য থেকে বোঝা যেতে পারে। —’ঐসব দেব ও দেবীরা বাস্তবিকই করুণার উদ্রেক করে। আপনারা শত শত বছর ধরে তাদের পুজো করে এসেছেন, অথচ তারা আপনাদের উপকারার্থে স্থানীয় উৎপীড়ক বা অসৎ ভদ্রলোকদের একজনকেও উচ্ছেদ করেনি। এখন আপনারা আপনাদের খাজনা কমাতে চান। আমি জিগ্যেস করতে চাই-কিভাবে আপনারা সেটা করবেন? আপনারা কি দেবদেবীর উপর বিশ্বাস করবেন, না কৃষক সমিতির উপর বিশ্বাস করবেন?’ (হুনানে কৃষক আন্দোলনের তদন্ত রিপোর্ট, মার্চ, ১৯২৭; নবজাতক প্রকাশন প্রকাশিত ‘মাওসেতুং-এর নির্বাচিত রচনাবলী’ থেকে)
আর এর ফলে গ্রামের ‘অশিক্ষিত কৃষকরাও কিভাবে ‘ধর্মীয় কর্তৃত্বের জোয়াল ছুড়ে ফেলতে পারেন, তার একটি পরিচয়ও তাঁর বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়।–‘ভূস্বামীদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের উচ্ছেদ ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই গোষ্ঠীগত কর্তৃত্ব, ধর্মীয় ও স্বামীর কর্তৃত্ব(৩) সবইটিলায়মান হয়ে পড়ে।. সর্বত্র যেখানেই কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠেছে, সেখানেই ধর্মীয় কর্তৃত্ব টলে উঠেছে। অনেক জায়গায় কৃষক সমিতি দেবদেবীর মন্দিরকে তাদের অফিসের কাজের জন্য দখল করে নিয়েছে। সর্বত্র তারা কৃষকদের স্কুল খুলবার কাজে বা সমিতির খরচ নির্বাহের জন্য মন্দিরের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে বলে। এটাকে তারা বলে ‘কুসংস্কার থেকে সাধারণের আয়’। লিলিং জেলায় কুসংস্কারমূলক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা এবং মূর্তি ধ্বংস করার ধূম লেগেছে। এই জেলার উত্তরাঞ্চলীয় মহকুমাগুলোতে কৃষকরা মহামারীর দেবতাকে শাস্ত করার জন্য প্রজুলিত ধূপ-মোমবাতি নিয়ে শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। লুখীে-এর ফুপোলিংস্থিত তাও-মন্দিরে অনেক মূর্তি ছিল, কিন্তু কুওমিনতাংএর আঞ্চলিক সদর দপ্তরের জন্য যখন আরো ঘরের দরকার পড়ল, তখন ছোটবড় সব মূর্তিগুলোকে একসাথে কোণে গাদা করে রাখা হল। কৃষকরা এতে কোন আপত্তি তোলেনি। তারপর থেকে কোন পরিবারে কারো মৃত্যু হলে দেবদেবীর প্রতি উৎসর্গ, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন এবং পবিত্র বাতি প্ৰদান করার ঘটনা খুবই কম ঘটেছে। …উত্তরের তৃতীয় মহকুমায় লোংফেং নানের কৃষকেরা এবং প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকেরা কাঠের মূর্তিগুলোকে কেটে সেই কাঠ দিয়ে মাংস রাঁধে। দক্ষিণের অঞ্চলে অবস্থিত তোংফু মন্দিরের তিরিশটিরও বেশি মূর্তিকে ছাত্র ও কৃষকরা মিলে পুড়িয়ে ফেলে।…’ ইত্যাদি। (ঐ) ধর্মীয় কর্তৃত্বের জোয়াল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা এমন মানুষদের কোন গোলাম আজম-বোল থ্যাকারে-খোমেইনিঋতম্ভরাদের দল তাদের শিবগরে পরিণত করবে?
এটি স্মর্তব্য যে মাওসেতুং এ রিপোর্ট দেন। চীনের মুক্তিরও ২২ বছর আগে, ১৯২৭-এর মার্চ মাসে। তারপর সারা চীন জুড়ে এমন কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয় তথা গণজাগরণ ঘটে কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃত্বে। আমেরিকায় ফান্ডামেন্টালিস্টরা, ভারতে হিন্দুত্ববাদী ও মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা, কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম মৌলবাদীরা তাদের দাপট চালানোর সময় চীনের ঐ বিশাল ভূখণ্ডে এর ফলে এদের ছায়াও দেখা যায়নি।
সময় আরো এগিয়ে গেছে। শ্রেণীবৈষম্য ও সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়ন আরো বীভৎস ও সূক্ষ্মতর আকার ধারণ করেছে। এসবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে উঠেছে ধৰ্মজীবীদের মৌলবাদী তাণ্ডব। কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩), ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস (১৮২০-১৯৮৫), এমনকি ভলাদিমির ইলিয়াভিচ লেনিন (১৮৭০-১৯২৪)-এর সময়েও ধর্মীয় মৌলবাদের সাম্প্রতিক ভয়াবহ রূপ সম্যক পরিস্ফুট হয়নি। এ অবস্থায় মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-এর ধর্মের বিরুদ্ধে প্ৰত্যক্ষ আন্দোলনের প্রাসঙ্গিক শিক্ষাকে নতুন করে ভাবা যায়। লেনিন লিখেছিলেন,–