ধর্মীয় মৌলবাদ প্রতিরোধে ধর্মপ্রসঙ্গে বৈজ্ঞানিক সত্য প্রচারও এ ব্যাপারে। সচেতনতাবৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কিভাবে একসময় নিয়ানডার্থল আমলের মানুষ তার উন্নততর চিন্তা, অনুসন্ধিৎসা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার সাহায্যে একটি অতিপ্রাকৃতিক শক্তি ও মৃত্যুপরবর্তী প্রাণের কল্পনার জন্ম দিয়েছে, কিভাবে হাজার হাজার বছর ধরে এই কল্পনা ঈশ্বর আত্মা ও নানা ধর্মের সৃষ্টি করেছে, শ্রেণীবিভাজিত সমাজে কিভাবে শাসক ও শোষিত উভয়েই এই ধর্মকে ব্যবহার করেছে এবং কোন সামাজিক ও প্রাকৃতিক প্রতিকুল বৈরীশক্তির অস্তিত্বের কারণে এখনো বহু মানুষ এই ধর্মকে অনুসরণ করছে—এসবের অসূয়ামুক্ত ঔদ্ধত্যহীন বিনম্র বৈজ্ঞানিক আলোচনা ও প্রচার ব্যাপকভাবে করা দরকার। বিশেষত শ্রেণীবিভক্ত সমাজের এই গণবিরোধী সামাজিক শত্রুগুলিকে দূর করার উদ্যোগ ব্যাপকতর করার সঙ্গে মৌলবাদবিরোধিতার ও মৌলবাদপ্রতিরোধের প্রশ্নটি সম্পৃক্তভাবে যুক্ত।
এ কথাগুলি পরিপূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করেই এবং ধর্মের বিরুদ্ধে এ ধরনের পরোক্ষ লড়াই-এর পাশাপাশি প্রয়োজনে ধর্মের বিরুদ্ধে প্ৰত্যক্ষ সংগ্রাম চালানোরও সময় এসেছে,-বিশেষত ধর্মীয় মৌলবাদীদের সাম্প্রতিক ক্রমবর্ধমান দাপটের পরিবেশে। এর অর্থ কখনোই সরলধর্মবিশ্বাসী মানুষের অসহায় ধর্মবিশ্বাসকে অপমান ও ব্যঙ্গ করা নয়। কিন্তু অবশ্যই তার অর্থ বেদ-বাইবেল-কোরান-হাদিসমনুসংহিতাদির মত ধর্মগ্রন্থের বর্তমান অপ্রাসঙ্গিকতা, শ্রেণীভিত্তি, ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক দিকগুলিকে উন্মোচিত করা। পাশাপাশি তাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও প্রাচীন উপযোগিতাকে মর্যাদা দেওয়াও দরকার, দরকার তাদের উপর গোঁড়ামিমুক্ত গবেষণারও। ধর্মের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের অর্থ খীশু-মহম্মদ বা যাজ্ঞবল্ক্যাদির প্রতি একপেশে, সবজান্তা ও উদ্ধত মানসিকতা থেকে অপমান ও ব্যঙ্গের বাণ নিক্ষেপ করা নয়। কিন্তু অবশ্যই তাদের মূল্যবান ঐতিহাসিক ভূমিকাকে উপযুক্ত মর্যাদা দিয়েই, এখনকার দিনেও তাদের হুবহু অনুসরণ করা ও অন্ধভাবে ভক্তিপ্রদর্শন করার মানসিকতাকে প্রতিহত করা। ধর্মের বিরুদ্ধে প্ৰত্যক্ষ সংগ্রামের অর্থ ধর্মীয় বাতাবরণে বিশ্বমানবিক সৌভ্রাতৃত্বের মত যে সব মানবিক মূল্যবোধের কথা যতটুকু বলা হয়েছে সেগুলিকে অস্বীকার করা নয়। কিন্তু অবশ্যই তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে এবং গ্রহণ-বর্জনের গোঁড়ামিমুক্ত মানসিকতা থেকে, ধর্মের তথা ঈশ্বর-নির্ভরতার নাম না করেই মনুষ্যত্ব ও মানবিক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠা করা। (যেমন ‘বিশ্বমানবিক সৌভ্রাতৃত্ব’ বা ‘চুরি করা মহাপাপ’ জাতীয় কথাগুলি শুনতে ভাল লাগলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলি শাসকগোষ্ঠীর স্বাৰ্থবাহী। নিকট অতীতের বা বর্তমানের শ্রেণীবিভাজিত সমাজে পৃথিবীর সবাইকে ভাই বা বন্ধু ভাবার অর্থ শোষিত জনগণের কাছে শাসকশ্রেণীকেও সুহৃদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা অর্থাৎ অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধেও শাসিতদের সংগ্রামকে দুর্বল করে দেওয়া। চুরি করা মহাপাপ’-এর প্রচারও আসলে ব্যক্তিগত সম্পত্তি সৃষ্টির পর, বৈষম্যভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায়, অর্থবানদের সম্পদরক্ষার একটি কৌশলমাত্র, যে সম্পদ তারা অর্জন করেছে নিজেদেরই নিয়ন্ত্রিত সমাজব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কাঠামোর সুযোগ নিয়ে। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বমানবিক সৌভ্রাতৃত্বের’ মত কথাগুলি প্রকৃত মর্যাদা পাবে শ্রেণীহীন বৈষম্যমুক্ত সমাজে। এই সমাজে ‘চুরি করা মহাপাপ’-এর মত নীতিবাক্য প্রচারেরও কোন প্রয়োজন থাকবে না—এখনো যেমন আদিবাসী গোষ্ঠীর বহু মানুষ চুরির ব্যাপারটিই জানে না এবং এমন নীতিবাক্য তাদের কাছে হাস্যকর। চুরির বা পারস্পরিক বৈরিতার সৃষ্টিই হয়েছে শ্রেণীবিভাজনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তা যখন বিধ্বংসী ও শাসকশ্রেণীর পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়, তখন তারা নিজস্বার্থে নানা ধৰ্মকথার মাধ্যমে এমন নীতিবাক্যের সৃষ্টি ও প্রচার করে। যতদিন এই বিভাজন থাকবে, ততদিন এই ধরনের নীতিবাক্যের উপযোগিতাও থাকবে, কিন্তু তার পেছনের সত্যগুলিকে জেনে একটি বিজ্ঞানসম্মত মানবিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়াই মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। ধর্ম তথা ধর্মীয় নানা নীতিবাক্য-অনুশাসন-নির্দেশাদির প্রসঙ্গেও একথাগুলি প্রযোজ্য।)
প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় মৌলবাদী আটকাতে গিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে শুধু ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করা বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর একটি পদ্ধতি,–যা এক সময় ব্যর্থ হবে বাধ্য। কারণ প্রথমত, মানুষের সমস্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থাগুলিকে টিকিয়ে রেখে এবং ধর্ম সম্পর্কে একটি স্তর আদি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী অর্জন করার আগে, ধর্মকে শহিদ করলে ধর্ম তথা প্রাচীন ঐতিহ্য সম্পর্কে আগ্রহ নতুন করে জেগে ওঠার সম্ভাবনাই বেশি। এবং এরই প্রতিক্রিয়ায় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তির এবং ধর্মান্ধতার পালে হাওয়াই লাগবে। ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই তার সামাজিক ভিত্তিগুলির বিরুদ্ধে লড়াইয়েরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। বস্তুবাদী দর্শনকে সামনে রেখে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শ্রেণীসচেতন সংগ্রামই ধর্মকে উচ্ছেদ করার সর্বোৎকৃষ্ট ও সবচেয়ে কার্যকরী পথ। বিচ্ছিন্নভাবে ধর্মকে দূর করা সম্ভব নয় অর্থাৎ সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক কোন ক্ষেত্রে সংগ্রাম পরিচালিত হওয়ার আগে বা না করে, শুধু ধর্মীয় মৌলবাদকে চূড়ান্তভাবে উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। এ কারণেই শ্রেণীসচেতনতাহীন বুর্জোয়া নাস্তিকতা কিংবা যান্ত্রিক যুক্তিবাদ কখনো ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ব্যাপক মানুষকে ঈশ্বরবিশ্বাস থেকে প্রকৃত মুক্তি বা যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক মানসিকতা অর্জন করাতে পারে না। তাই চারপাশে এমন উদাহরণ কম নেই যে, সমাজে এ ধরনের নাস্তিক মানুষ যথেষ্ট আছেন, পাশাপাশি মৌলবাদও আছে শুধু নয়, নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যান্য দেশের কথা ছেড়ে শুধু পশ্চিমবঙ্গের কথাই বলা যায়, যেখানে দীর্ঘদিনের বামপন্থী ও উদারপন্থী আন্দোলনের ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও কিংবা বুদ্ধিজীবীদের একাংশ যথেষ্ট উদার, ধর্মমোহমুক্ত বা নাস্তিক হওয়া সত্ত্বেও বিগত কয়েক বছরের মধ্যে ভারতীয় জনতাপাটি বা অখিল ভারতীয় বিদ্যাহী পরিষদের মত হিন্দুত্ববাদী ও ভিত্তিমূলে মৌলবাদী শক্তিগুলি তৃণমূলস্তর অব্দি তাদের প্রভাব, যতটুকুই হোক না কেন, বিস্তৃত করতে পেরেছে। একইভাবে এমন যুক্তিবাদী’রাও আছে যাদের মধ্যে আত্মপ্রতিষ্ঠা, আত্মপ্রচার ও নিজেকে সর্বোত্তম যুক্তিবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগই বেশি; কুসংস্কারের শিকার সাধারণ মানুষদের তো বটেই, বিজ্ঞানমনস্কতার স্বপক্ষে আন্দোলনে রত অন্য ব্যক্তিদের হেয় করার প্রবণতাও রয়েছে। এবং যারা যান্ত্রিকভাবে কিছু ম্যাজিকপত্ৰ দেখিয়ে অলৌকিকতার বুজরুকি তুলে ধরাকেই প্রধানতম কাজ বলে মনে করেন। এই ধরনের ‘নাস্তিক’ বা যুক্তিবাদী’-দের কোন ইতিবাচক ভূমিকা নেই তা নয়, কিন্তু শেষ বিচারে ইতিবাচক কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ যথেষ্টই রয়েছে।