রাষ্ট্ৰীয় আইনী ব্যবস্থার পাশাপাশি মৌলবাদের চিকিৎসায় জনসাধারণের ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক প্রচেষ্টা আরো বেশি মূল্যবান। নিজেদের মানসিকতায় ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদকে সচেতনভাবে পরিহার করার পাশাপাশি বিজ্ঞানমনস্কতা ও গণমুখী যুক্তিবাদ অনুসরণ করার অনুশীলন অতি গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভব ক্ষেত্রে যার মধ্যে এমন ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ দেখা যাবে, সক্রিয়ভাবে তার বিরোধিতাও করা উচিত। নিজের নিশ্চেষ্টতা প্রশ্রয়ের নামান্তর মাত্র। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার চেয়ে যৌথ সাংগঠনিক উদ্যোগই অধিকতত কার্যকরী। এলাকায় এলাকায় বিজ্ঞান ক্লাব থেকে শুরু করে ‘মৌলবাদ (বা সাম্প্রদায়িকতা) প্রতিরোধী সংস্থা’ জাতীয় অজস্র সংগঠন, প্রতিটি সচেতন ও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিদের গড়ে তোলা ও জনসাধারণের তৃণমূলস্তর আদি বিস্তৃত করা প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রে তারা তা করেছেনও। কিন্তু প্রয়োজন আরো অনেক, অনেক বেশী।
এই ধরনের সংগঠন রাজনৈতিকও হতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষ দক্ষিণপাহী এবং বামপন্থী আন্দোলনের ব্যাপকতা মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতায় বিষাক্ত পরিবেশকে কলুষমুক্ত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়কার ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রাবল্যের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের প্রসার এই ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি মূল্যবান অংশ। (এ প্রসঙ্গে এটিও গুরুত্বপূর্ণ যে, বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে ও যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপুল প্রসারের সময়, কি অর্থনীতি, কি সংস্কৃতি ও সমাজনীতি কোনটিই বিশেষ দেশে গণ্ডিবদ্ধ থাকতে পারে না। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও লেনদেন ছাড়া কোন দেশে শুধুমাত্র সংকীর্ণ জাতীয়তা অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ও বিশুদ্ধ নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি সম্ভব নয়।)
এবং মূল্যবান উপযুক্ত অর্থনৈতিক কর্মসূচীও। মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলি যে অর্থনৈতিক সংকটের সুযোগে তাদের গণভিত্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করে, জনগণের ঐ সংকট ও দুরবস্থাকে দূর করার ক্ষেত্রে আন্তরিক ও বিকল্প উদ্যোগও জরুরী। এমন কি তা সংস্কারমূলক হলেও। তবে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থবিমুক্ত, বৈষম্যহীন ও গণমুখী অর্থনৈতিক পরিকল্পনার জন্য এবং তাকে রূপায়িত করার জন্য আন্তরিকতটুকু অন্তত থাকা চাই। প্রকৃতপক্ষে মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলি অর্থনৈতিক সুখ-স্বপ্ন সহ যে সব মিথ্যা। আশা ভরসার কথা জনসাধারণের সামনে হাজির করে, তাদের প্রতিটিরই বাস্তব ও উপযুক্ত বিজ্ঞানসম্মত বিকল্প রাখা দরকার। এ ক্ষেত্রে মার্কসীয় দার্শনিক ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামো একটি বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম, যদিও এর অর্থ এ নয় যে মার্কসবাদই শেষ কথা ও অদূরভবিষ্যতে আরো বিকশিত কোন প্রক্রিয়া মানুষ আয়ত্ত করবে না।
ধর্মীয় মৌলবাদ তথা ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে যক্ষ্মারোগের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অন্ধকারাচ্ছন্ন আলো-বাতাসহীন স্যাৎসেতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, উপযুক্ত পুষ্টি ও বিশ্রামের অভাব তথা প্রতিরোধ ক্ষমতার হ্রাস, তীব্র জীবাণু সংক্রমণ ইত্যাদি যক্ষ্মরোগ সৃষ্টির পথ সুগম করে। একইভাবে বিজ্ঞানমনস্কতার আলোর অভাব, অসচেতনতার অন্ধকার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসহায়তার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ধর্মাশ্রয়ী ঐসব অসুস্থতাকে ডেকে আনে। ধর্মজীবী ধান্দাবাজেরা যক্ষ্মার জীবানুর মত মানুষের মনের এই অন্ধকারকে আশ্রয় করে তার জাল বিস্তার করে। অচিকিৎসিত যক্ষ্মারোগ তিলে তিলে শরীরকে ধ্বংস করে, উন্দরী থেকে মস্তিষ্কবিকৃতি জাতীয় নানা জটিলতার সৃষ্টি করে এবং এক সময় হঠাৎ করে মৃত্যুর দরজা খুলে যায়। অপ্রতিহত মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাও মানুষ ও তার সমাজকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করতে থাকে, এক বিকৃত পিছিয়ে পড়া আদিমতার অন্ধকারের দিকে মানুষকে ঠেলে দেয়, ভ্রাতৃহত্যা থেকে উন্নয়নের স্থবিরত্ব জাতীয় নানা ধরনের জটিলতার সৃষ্টি করে এবং এক সময় ফ্যাসিস্টদের মত তার বিধ্বংসী প্ৰাবল্য নিয়ে জাতির উপর ঝাপিয়ে পড়ে। অচিকিৎসিত যক্ষ্মা শুধু ব্যক্তির মধ্যে সীমিত থাকে না, তা প্রবল সংক্রামকও বটে, নিকট মানুষদের মধ্যেও তার সংক্রমণ ঘটে, বিশেষত যাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। অপ্রতিহত ধর্মান্ধতা-সাম্প্রদায়িকতামৌলবাদও শুধু কিছু ব্যক্তি বা একটি গোষ্ঠীতে সীমিত থাকে না, তা পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ায় অন্যদেরও উত্তেজিত করে তোলে এবং ভিন্ন ধর্মের অসচেতন ও মানসিক প্রতিরোধহীন ব্যক্তিদেরও স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে একই পন্থা অবলম্বন করে মোকাবিলার জন্য প্ররোচিত করে। যক্ষ্মার চিকিৎসায় জীবাণুকে মারার ওষুধের পাশাপাশি তার প্রতিরোধ অতি গুরুত্বপূর্ণ-উপযুক্ত পুষ্টি-বিশ্রাম-আলো-বাতাস ইত্যাদি রোগ নিরাময় ও প্রতিরোধের জন্য ওষুধের সঙ্গে অবশ্যই সুনিশ্চিত করা দরকার। মৌলবাদ জাতীয় অপশক্তির ক্ষেত্রেও তার চিকিৎসা ও প্রতিরোধের দিকগুলি একই সঙ্গে প্রযুক্ত হওয়া দরকার।
ধর্মীয় মৌলবাদ তথা ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার প্রতিরোধের ক্ষেত্রে গণমুখী যুক্তিবাদী চিন্তার প্রসার এবং বিজ্ঞানমনস্কতার আলোকোজ্জল পরিবেশ সৃষ্টি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। অহংকার, অবিনয়, স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার মত বদ্ধ পরিবেশ থেকে গণতান্ত্রিক বাতাবরণে মুক্তি এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শ্রেণীসচেতন অর্থনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জন করা এক বৈষম্যহীন ও পারস্পরিক সহযোগিতা নির্ভর সমাজব্যবস্থায় মৌলবাদের মত অপশক্তিগুলি তার টিকে থাকার বা সৃষ্টি হওয়ার জমিই হারায়।