ব্যাপারটি এইভাবে বলে যাওয়া যেমন সহজ, বাস্তবে তার প্রয়োগ তেমনি অনেক জটিল, কঠিন ও দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়ার অংশ। নিয়তিবাদী বা স্বতস্ফুর্ততানির্ভর মানসিকতা থেকে যদি এমন ভাবা হয় যে ইতিহাসের নিয়মে ব্যাপারগুলি রয়ে সয়ে ঠিক ঘটে যাবে, তবে তা হবে আত্মঘাতী ও সুবিধাবাদী, পলায়নী একটি মনোবৃত্তির পরিচয়। একাজে অবশ্যই সচেতন বহুজনকে নেতৃত্বদায়ী ভূমিকা নিতে এগিয়ে আসতে হয়, যে নেতৃত্ব কখনোই কর্তৃত্ববাদী, একনায়কতান্ত্রিক বা স্বৈরতান্ত্রিক হবে না।
মৌলবাদ একটি অসুস্থতা। ধর্ম তার বিপন্ন আস্তিত্বের সময় যেমন জঙ্গী মৌলবাদের মাধ্যমে তার ভিত্তিমূলকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তেমনি যারা এর নেতৃত্ব দেয় সেই গোষ্ঠী তার হতাশা ও সংকটের সময়, ক্ষমতা অর্জন করতে ধর্ম ও মৌলবাদকে কাজে লাগায়। শোষিত মানুষের যে অংশ তাদের সঙ্গী হয়। তারাও নিজেদের ক্রমবর্ধমান নানা সামাজিক সংকট, বিপন্নতাবোধ ও হতাশার ফলে প্ৰত্যারিত হয়।
মৌলবাদী অসুস্থতার সমাধানের ক্ষেত্রে দুটি প্রধান দিক রয়েছে, (১) এর তাৎক্ষণিক চিকিৎসা, (২) এর স্থায়ী প্রতিরোধ। এই তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে চরম ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও কারো কারোর মাথায় আসে। যেমন আলজিয়ার্সে মুসলিম মৌলবাদীদের মৃত্যুদণ্ড। —
‘১৩ মৌলবাদীর মৃত্যুদণ্ড–তিউনিস, ৩০ মে-আলজিয়ার্সের এক বিশেষ আদালত ১৩ জন মৌলবাদী মুসলমানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। ’৯২ সালে ঐ বিশেষ আদালত গঠন করা হয়। ইসলামি মৌলবাদের বিরুদ্ধে সরকারের লড়াইয়ের অঙ্গ হিসেবেই এই আদালত বসানো হয়। এ পর্যন্ত ৪৮০ জন মৌলবাদীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে এই আদালত। এ ছাড়াও ৫ জন জঙ্গিকে যাবজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছে বিশেষ আদালত।–রয়টার’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩১.৫.৯৪)।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স এবং আফ্রিকার এই দেশে জনসংখ্যার শতকরা ৯৯.১ জনই মুসলমান (সুন্নি) ও দেশটির রাষ্ট্ৰীয় ধর্ম ইসলাম। ইসলাম ধর্মাবলম্বীর এত সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশে মুসলিম মৌলবাদীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘটনা এটি প্রমাণ করে যে, ইচ্ছা থাকলে মৌলবাদীদের শায়েস্তা করার কঠোরতম পন্থা অবলম্বন করা যায়ই। বাংলাদেশের যে মৌলবাদীরা তসলিমাকে হত্যার ফতোয়া দেয় কিংবা দরিদ্র অন্তঃসত্ত্বা এক রমনীকে নৈতিকতার দোহাই তুলে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ঢ়িল ছুড়ে মারার নির্দেশ দেয়, তাদের এই মৃত্যুদণ্ড দেওয়াটা মৌলবাদবিরোধিতার ঐকান্তিক ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশই হতে পারত। পাকিস্থান বা ইরানের মৌলবাদীদের কিংবা ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের (আসলে যারা মৌলবাদী-ই) ঐ ধরনের অপরাধে কিংবা একটি জাতীয় ঐতিহাসিক সৌধ বিধ্বংস করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিলেও ঐ ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারত। আরব থেকে চীন নানা দেশেই ড্রাগপাচারকারীদের যেমন এইভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মৌলবাদীদের ধর্মীয় ধান্দা এই ড্রাগব্যবসায়ীদের চেয়ে কোন অংশে কম বিপজ্জনক ও কম অপরাধমূলক নয়। বরং হয়তো বেশিই, কারণ ধর্মীয় মৌলবাদের মত ড্রাগ অন্তত বিপুল সংখ্যক ভিন্নধর্মের মানুষকে ঘূণা করতে ও নিশ্চিহ্ন করতে প্ররোচিত করে না। কাউকে হত্যা বা আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করা যদি অপরাধ হয়, তাহলে এইসব ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাবাদী ও মৌলবাদীরাও একই অপরাধে অপরাধী। তবে ড্রাগের বিরুদ্ধে লড়াই করা তুলনায় অনেক সহজ, কারণ ড্রাগ চোখে দেখা যায়। কিন্তু ধর্মাশ্রয়ী মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই অনেক কঠিন, কারণ তার এই ধর্মীয় আশ্রয় চোখে দেখা যায় না বা ‘মিফার ডগ’ দিয়ে চিহ্নিত করা যায় না। তা এক কায়াহীন মানসিক দিক, যা সরল ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে নানা স্তরে, নানা মাত্রায় মিশে থাকে।
তবে সাধারণভাবে আধুনিক বিশ্বে এই মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি একটি অমানবিক ও মনুষ্যত্ববিরোধী দিক। যত অপরাধে অপরাধীই হোক না কেন, ঐ অপরাধীরই মত একটি প্রাণকে নিশ্চিহ্ন করার অপরাধ করাকে সুস্থভাবে মেনে নেওয়া মুস্কিল। বিশেষত, কে প্রকৃত মৌলবাদী, সে কি অপরাধ করেছে, তাকে অপরাধী সাজানোর ক্ষেত্রে কোন রাজনৈতিক বা ভিন্নতর ষড়যন্ত্র আছে কিনা, মৌলবাদের সৃষ্টির পেছনে অমৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের ভূমিকাও শাস্তিযোগ্য কিনা, তার মৌলবাদী আচরণ সংশোধনের অতীত কিনা— ইত্যাদি নানা ব্যাপার এর সঙ্গে জড়িত এবং এ ব্যাপারটি বিতর্কিতও বটে। এ ব্যাপারে চরমভাবে সঠিক সিদ্ধান্তে আসাও দুরূহ।
তবু মৌলবাদীদের কঠোর আইনী শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত,-যাবজীবন কারাদণ্ড বা শ্রমশিবিরে পাঠানোর মত, যেমন দেওয়া হয়। হত্যাপরাধীদের। সতীদাহ, নদীতে শিশুনিক্ষেপ বা বহুবিবাহ প্রথার মত বর্বর ও তথাকথিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে আইন ও শাস্তি তাই বড় ভূমিকা পালন করেছে। একইভাবে ভিন্ন ধরমের মানুষের প্রতি বিষেদাগার করা, তাদের নিগৃহীত করতে অন্যদের প্ররোচিত করা, মানবিক মূল্যবোধগুলিকে অস্বীকার করা, ইত্যাদির মত যে সব আচরণ মৌলবাদীদের বৈশিষ্ট্য সেইগুলি প্রমাণিত হলেও আরো কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে এবং আন্তরিকভাবে তা প্রয়োগ করাও উচিত,–বর্তমানে যেমন ভারতবর্ষে ধর্ম ও জাতপাতকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক প্রচার কোন আইনী রাজনৈতিক দলের পক্ষে নিষিদ্ধ। (এ কারণে বিজেপি বা মুসলিম লীগ বহুৎ উসখুসি করলেও একটু সমঝে চলে, তবে তাদের হয়ে এ কাজ করে দেয় অন্য সমমনোভাবাপন্ন গোষ্ঠীগুলি।)