নিজেদের ও প্রতিবেশীদের,-বিশেষত দরিদ্র, প্রথাগত শিক্ষাবর্জিত ও সামাজিকভাবে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে, সচেতনতা বৃদ্ধির ঐক্যবদ্ধ ও গণমুখী ব্যাপক বিজ্ঞান আন্দোলন, কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা বিরোধী কাজকর্ম এবং সরাসরি মৌলবাদবিরোধিতা তীব্রতম করার সময় এসেছে। নিছক বিজ্ঞান আন্দোলনের জন্য বিজ্ঞান আন্দোলনও এ ক্ষেত্রে কিছু ভূমিকা রাখবেই। কিন্তু সচেতন ব্যক্তিদের উচিত এই বিজ্ঞান আন্দোলনকে সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলন, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এবং ছাত্র-যুব-নারী সংগঠনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এবং উচিত ক্রমশ এই বিজ্ঞান আন্দোলনকে শ্রেণী সচেতনতা ও সমাজঅর্থনীতি সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির দিকে নিয়ে যাওয়া। যান্ত্রিক যুক্তিবাদী ক্রিয়াকাণ্ড বা শ্রেণীবোধহীন বুর্জেয়া নাস্তিকতা আমাদের মত বিপুল সংখ্যক দরিদ্র ও নিরক্ষর জনসাধারণের দেশে একটি স্তর আদি মূল্যবান হলেও, ক্রমশঃ যদি না তার এই উত্তরণ ঘটানো যায়। তবে তা একসময় কানাগলির সম্মুখীন হতে ও ব্যর্থ হতে বাধ্য। এই উত্তরণের অভাবে এই ধরনের যান্ত্রিক বিজ্ঞান আন্দোলন এক সময় মৌলবাদের মত সামাজিক অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হতে থাকে এবং দোদুল্যমান শিক্ষিত মানুষ (এমনকি তথাকথিত বিজ্ঞানীদের’ও) সৃষ্টি করে, যারা সুযোগ পেলেই অবিজ্ঞান, ধর্মীয় কুসংস্কার এমনকি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের শিকার হয়ে যায়। এই উত্তরণের অভাবেই যান্ত্রিক যুক্তিবাদী আন্দোলনের মধ্যে স্বৈরতান্ত্রিক নেতৃত্বের সৃষ্টি হয়, যে নিজেকে নির্ভুল সবোত্তম বলে ভাবে, ভিন্ন গোষ্ঠীর লোকেদের শত্রু বলে ধরে নেয় এবং মানুষের অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও অনাবিল ধর্মবিশ্বাসকে অপমান ও ব্যঙ্গ করে। বিজ্ঞান আন্দোলনের মূল লক্ষ্য বিজ্ঞানমনস্কতা অর্জন করা, যার সাহায্যে ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি সম্পর্কে তথা মানুষের বিভিন্ন শ্রেণীবিভাজন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ক্রমশ উচ্চ পরিমাণে লাভ করা সম্ভব। এর ফলেই একজন বিনয়ী, পরমতসহিষ্ণু, মানবিকও হয়ে ওঠে। কারণ প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিই ক্ৰমশঃ উপলব্ধি করতে পারেন জ্ঞান কত বিপুল। আর ব্যক্তিগতভাবে তার কত ক্ষুদ্র অংশ জানা সম্ভব এবং জ্ঞানের চরম সত্যতা, কত অসম্ভব, তাই নিজের জানার মধ্যে কত বিতর্কের অবকাশ আছে। (পাশাপাশি নতুন জ্ঞানের আলোয় তা পরিবর্তিত না হলে, তার থেকে তাঁরা সরেও আসেন না, আবার নতুনকে বিনা দ্বিধায় গ্রহণও করেন।)
তাই বিজ্ঞান আন্দোলন নিছক ধর্মবিরোধী আন্দোলন নয়। কিন্তু বিজ্ঞান তথা বস্তুবাদী দর্শন ধর্মবিরোধী অবশ্যই। বিজ্ঞানের সঙ্গে ভাববাদ, ঈশ্বরবিশ্বাস ও এই বিশ্বাসকেন্দ্ৰিক ধর্মের মিলনের নানা গন্তীর বাগাড়ম্বর ও সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা, আসলে বিজ্ঞান আন্দোলনকে বিপথগামী করার এবং ভাববাদ ও ধর্মকে নতুন কৌশলে প্রতিষ্ঠা করার কৌশল মাত্র।
বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বরা (আসলে এরা সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী ব্যক্তিদেরই জ্ঞাতি ভাই) এবং তাদের অনুগত তথাকথিত শিক্ষিত ও এমনকি বিজ্ঞানের ডিগ্রিধারী ব্যক্তিরা নানা গুরুগম্ভীর লেখাপত্ৰ-আলোচনা-সেমিনারে এমনভাবে বিজ্ঞান ও ধর্মের মিলনের(২) কথা প্রচার করলেও, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, এ ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক বা অজ্ঞতাপ্রসূত কথাবার্তা আদতে শাসকশ্রেণীর স্বার্থবাহী এবং ধৰ্মজীবী পরজীবীদের আত্মরক্ষার উপায় মাত্র।
আসলে ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করার পথটি সঠিকভাবে আয়ত্ত করা দরকার। যে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অঙ্গ হিসেবে ধর্মের টিকে থাকা, সেই সমাজের পরিবর্তন ছাড়া ধর্মের অবস্থানেরও গুণগত কোন পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়। ধর্ম সম্পর্কে বিজ্ঞান সম্মত তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করার প্রক্রিয়াটি এই শ্রেণীবিভক্ত সমাজ সম্পর্কে সচেতন হওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটিকে ছাড়া আরেকটি পরিপূর্ণতা পেতে পারে না। একইভাবে ধর্মের বিরদ্ধে সংগ্রামের বিষয়টি এই সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য যে সংগ্রাম, বা অন্তত শোষণ, আধিপত্য ও বৈষম্য দূর করার জন্য মানুষের যে লাগাতার দৈনন্দিন সংগ্রাম, তার সঙ্গে সম্পূক্তভাবে না। মিশলে সফল হতে পারে না। তা না করে, বিশেষত ধর্ম সম্পর্কে সচেতনতা না। বাড়িয়ে, বিচ্ছিন্নভাবে ধর্মের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলে মানুষের মধ্যে ধর্মকে আরো বেশি আঁকড়ে রাখার প্রবণতা সৃষ্টি হবে এবং ধর্মান্ধতা-সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদ সৃষ্টি হওয়ার বা শক্তিশালী হয়ে ওঠার ব্যাপারটিই জোরদার হবে। ধর্ম তখন শহিদ হয়ে সহানুভূতি অর্জন করবে। ধর্ম যে নিপীড়িত মানুষকেই শহিদ করছে, এ বোধ জাগার আগেই ধর্মকে ও ধর্মবিশ্বাসীদের আঘাত করে গেলে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিগুলি মানুষকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ আরো বেশী করে পাবে।
তাই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা বা মৌলবাদকে রুখতে গিয়ে, তখনো অসচেতন জনসাধারণের উপর শ্রেণীসচেতন বৈজ্ঞানিক হলেও ধর্মপরিচয়মুক্তি বা ধর্মবিরোধিতাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা জনসাধারণকে এদেরই শক্ৰ করে তুলবে, আসলে যারা তার বন্ধুই হতে চাইছিল এবং মৌলবাদ ইত্যাদিকে তার বন্ধু করে তুলবে, আসলে যারা তার শত্রুই। ধর্ম ও তার এই ধরনের বিভিন্ন রূপ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করাটাই বড় দরকার, যে সচেতনতা অবশ্যই তার নিজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান বা সমস্যাবলী সম্পর্কে সচেতনতারই অংশ হিসেবেই হবে। এবং এই সচেতনতাই তাকে লড়াইয়ের সঠিক পথ খোঁজার উপযুক্ত করে তুলবে। এই লড়াই ধর্মের যে সব সামাজিক ভিত্তি, সেই অজ্ঞতা, অসহায়তা, বঞ্চনা, শোষণ, বৈষম্য ও দারিদ্র্য ইত্যাদি দূর করার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মেরও বিলুপ্তি ঘটাবে, কারণ তখন ঐভাবে ধর্মকে আঁকড়ে রাখার প্রয়োজন মানুষের আর থাকবে না। স্বাভাবিকভাবে তখন ধর্মকে কেন্দ্র করে অন্ধবিশ্বাস, সাম্প্রদায়িকতা বা মৌলবাদও শেকড়েই শুকিয়ে যাবে।