ধর্মীয় মৌলবাদ প্রসঙ্গে এই সচেতনতার লক্ষ্য,-ধর্ম ও ধর্মীয় মৌলবাদ সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত সত্যগুলিকে জানা, তার উদ্ভব ও সৃষ্টির ইতিহাস ও কারণগুলিকে উপলব্ধি করা। সংগ্রামের লক্ষ্য,-যে ব্যবস্থার উপরিকাঠামো হিসেবে ধর্ম ও ধর্মীয় মৌলবাদের টিকে থাকা ও সৃষ্টি হওয়া, সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন। এবং প্রয়োজনে ধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রামও।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিপুল সংখ্যক মানুষকে সচেতন করে তোলা একটি বড় প্রয়োজন। এর ফলে ধর্ম, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের শিকার তারা হবেন কি হবেন না, এই সিদ্ধান্ত র্তারা নিজেরাই নেওয়ার উপযুক্ত হয়ে উঠবেন। আর ফলতঃ পারস্পরিক হানাহানি বন্ধ করে প্রকৃতির বিরুদ্ধে ও অর্থনৈতিক সংগ্রামে যুক্ত হওয়াকে তাঁরা সুস্থতর ব্যাপার বলে অনুভব করতে সক্ষম হবেন।
ধর্মীয় মৌলবাদ সৃষ্টির পেছনে এই সংগ্রামের শূন্যতা একটি বড় ভূমিকা পালন করে। তাই তৃণমূল স্তর অব্দি বিস্তৃত বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে অবিজ্ঞান ও গণবিরোধী শত্রুর বিরুেদ্ধে সংগ্রাম যত বিস্তৃত হবে, ধর্মীয় মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা ততই হ্রাস পাবে বা প্ৰতিহত হবে। এক্ষেত্রে সঠিক বামপন্থী আন্দোলনই তার গণমুখী, ভাববাদবিরোধী মতাদর্শ নিয়ে এবং অর্থনৈতিক ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের পাশাপাশি একটি বিরাট ভূমিকা নিতে সক্ষম। এটি ঠিক যে, এই সঠিক’ কথাটি একটি বিরাট গোঁজামিলের ব্যাপার। চূড়ান্ত অর্থে সঠিক কোন কিছু সম্ভব নয়। তবু ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতাগুলিকে আন্তরিকভাবে ও খোলামনে নূ্যনতম করার মধ্য দিয়ে এই সঠিকতার কাছাকাছি পৌঁছনোর চেষ্টা করাটা অসম্ভব নয়।
ধর্মের প্রভাব মুক্ত এবং বিজ্ঞানমনস্ক মানসিকতার নেতৃত্বে, অজস্র সংগঠন গড়ে তোলা দরকার। দেশের প্রতিটি গ্রামে ও শহরের প্রতিটি পাড়ায় এ ধরনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংস্থা বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। আন্তরিক ইচ্ছা থাকলে সরকারী উদ্যোগেই প্রতিটি গ্রামে ও পাড়ায় সামান্য কিছু সাম্মানিক দিয়ে দু’তিন জন স্থানীয় সচেতন তরুণ-তরুণীকে এ ব্যাপারে নিয়োগ করা যায় এবং পশ্চিমবঙ্গ এ ক্ষেত্রে একটি মডেল রাজ্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। সাক্ষরতা কর্মসূচীর অঙ্গ হিসেবে এ রাজ্যে দু’একটি জেলায় এমন উদ্যোগ গড়েও উঠছে। (যেমন বর্ধমান জেলায় ১৯৯৫-এর অক্টোবরের সূর্যগ্রহণকে কেন্দ্র করে।) তবে এটি সভয়ে লক্ষ্য করার ব্যাপার যে, এই সুস্থ উদ্যোগ যেন সংকীর্ণ দলবাজির শিকার না হয় এবং দলীয় রাজনীতিকে বা তার মাহাত্ম্যকে প্রতিষ্ঠা করার আত্মহননকারী উদ্যোগে না পর্যবসিত হয়। এছাড়া এই পশ্চিমবঙ্গের (অন্যান্য কিছু রাজ্যেও)। সরকারী প্রভাবমুক্ত বহু বিজ্ঞানসংস্থা গড়ে উঠেছে। এদেরও গোঁড়ামিমুক্ত সামগ্রিক ঐক্যবদ্ধতা ধৰ্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা রুখতে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে সক্ষম এবং প্রকৃতপক্ষে সরকারীভাবে একাজ কতটা আন্তরিকভাবে হবে, এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহও আছে। এখনকার পরিস্থিতিতে সরকারী বন্ধন মুক্ত মানুষের গণ উদ্যোগ এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা নিতে সক্ষম।
ধর্মীয় মৌলবাদ যেভাবে মাথা চাড়া দিচ্ছে, তাতে এ ধরনের গণবিজ্ঞান আন্দোলন অতি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী। এক্ষেত্রে মৌলবাদবিরোধী প্রত্যেকের মধ্যে ও প্রতিটি সংস্থার মধ্যে ঐক্যও গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে বুর্জেয়া নাস্তিকতা ও যান্ত্রিক যুক্তিবাদের সঙ্গে বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়াটাও দরকার। কি হিন্দু, কি ইসলাম, কি খৃস্ট–সব ধরনের ধর্মীয় মৌলবাদীরা ক্ষমতা পেলে পরিপূর্ণ ফ্যাসিবাদী ক্রিয়াকাণ্ড শুরু করার জন্য প্রস্তুত। শিবসেনা-আর এস এস-এর মত হিন্দু মৌলবাদী নয়াফ্যাসিস্ট গোষ্ঠী বা ইরান থেকে পাকিস্তান নানা দেশের অজস্র মুসলিম মৌলবাদী সংগঠনগুলি প্রকাশ্যে এমন কথাবার্তাও বলে এবং ফ্যাসিবাদের ইঙ্গিত দেয়। (নেহাত বি জে পি-র মত কিছু কিছু ‘রাজনৈতিক দল’ আইন বাঁচাতে ও ভোটে দাঁড়ানোর জন্য প্রকাশ্যে এখনকার মত একটু রেখে ঢেকে কথা বলে।) সেক্ষেত্রে এরা ক্ষমতা পেলে,-হিটলারের ইহুদি নিধনের মত, ভিন্ন ধর্মের এবং কম্যুনিষ্ট বা মুক্তমনানাস্তিক-ধর্মপরিচয়মুক্ত বলে মনে করা ব্যক্তিদের লাখে লাখে হত্যা করতে পিছপা হবে না।(১) (৯০ কোটি ভারতবাসীর ৮-১০ কোটিকে মেরে ফেল্পে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকেই যাবে।) হয় পরিপূর্ণ আনুগত্য, কিংবা নিশ্চিহ্নকরণ—এই এদের নীতি। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি আটকাতে ধর্মীয় মৌলবাদীদের সামান্য সংস্রবকেই প্রধান গুরুত্ব দিয়ে প্রতিহত করার কাজে সামান্যতম গাফিলতির কোন ক্ষমা নেই। মৌলবাদী প্রভাব ও প্রচার টিকিয়ে রাখার অর্থ অন্যান্য ক্ষতির পাশাপাশি এই লক্ষ্যে তাদের পৌঁছনোর পথকে খুলে রাখা।
সমাজের শ্রেণীবিভাজন ও শ্রেণীবৈষম্যকে স্বীকার করুন, বা না করুন, অন্তত ধর্মীয় প্রভাব তথা ধর্মীয় মৌলবাদের প্রভাবকে আটকানোর প্রশ্নে, তাই ধর্মনিরপেক্ষ বুর্জেয়া, বুর্জেয়া নাস্তিক ও যুক্তিবাদীদের সঙ্গে বামপহী-দক্ষিণপন্থী নির্বিশেষে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীরও যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলা এবং ঐক্যবদ্ধ ব্যাপক কর্মসূচী নেওয়া উচিত। এঁরা পরস্পরের মধ্যে রাজনৈতিক সংগ্ৰাম চালাতেই পারেন, কিন্তু মৌলবাদ বিরোধিতার প্রশ্নে নিজেদের অনৈক্য মৌলবাদের আগমনকেই উৎসাহিত করবে।