জার্মানির সেই ফ্যাসিবাদ শুধু বাঁচার কথা বলেছিল জার্মান জাতিকে,-ইহুদি ও অন্যান্য তথাকথিত অনার্যদের শত্রু বলে বিপুল সংখ্যক জার্মান নাগরিককে বিশ্বাস করিয়েছিল। এটি বৃহদংশ জার্মানদের কাছে জনপ্রিয়ও হয়েছিল; তেমনি তা বৃহত্তর মানবিক ঐক্য, সৌহার্দ ও সম্প্রীতিকে ধ্বংস করে অন্যের প্রতি ঘৃণা ও নির্মম হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশও ঘটিয়েছিল। এটিকে শুধু পাশবিক বল্লে, পশুদেরও অপমান করা হয়, কারণ এটি জানা আছে যে আত্মরক্ষা, প্রাণধারণের জন্য খাদ্যে টান পড়া, যৌন অতৃপ্তি ইত্যাদির চরম প্রয়োজন ছাড়া সাধারণতঃ পশুরাও পরস্পরের প্রতিহিংস্র হয়ে ওঠে না। এখন সাম্রাজ্যবাদ প্রায়শঃ আরো ঠাণ্ডা মাথায় এ কাজ করে। হিটলারি-উগ্রতার ও চটজলদি সব কিছু পাওয়ার ততটা প্রয়োজন তার সবসময় হয় না, যতটা প্রয়োজন হয় ধীরগতিতে বিপুল সংখ্যক মানুষের সাংস্কৃতিক চেতনা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস এবং অর্থনীতি ও সমাজকে নিজের কন্তুজায় আনতে। এর ফলেই সে অন্যদের শুধু নিজের প্রতিযোগী হিসেবে ভাবতে শেখায়, সহযোগী বা সাখী হিসেবে নয়। কিভাবে প্রতিযোগিতায় ব্যবসা ও পুঁজি বাড়বে, নিজের ভাল চাকরি ও পদ অর্জন করা সম্ভব হবে, অর্থদায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হওয়া যাবে-এই ই তার শিক্ষণীয়। যতদিন এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হবে, এমনকি তার শ্ৰীবৃদ্ধিও ঘটানো হবে, ততদিন মানুষে মানুষে সত্যিকারের সম্প্রীতি ও সহযোগিতার বাতাবরণ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আর এই প্রতিযোগিতার ব্যাপকতর প্রয়োগ ঘটে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দাঙ্গা সৃষ্টির মধ্যে, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে মদত দেওয়ার মধ্যে—যে সবগুলিতে মাঝখান থেকে মারা পড়ে নিরীহ শতশত মানুষ, নিরপরাধ অসহায় মানুষই। যেন এক অদৃশ্য সুতোর টানে তারা মৃত্যুমুখে এগিয়ে যায়।
ধর্মীয় মৌলবাদ (এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদও) ধর্মকে কেন্দ্র করে এই মানবিক অনৈক্য প্রতিষ্ঠা করতে ও প্ৰেমগ্ৰীতিহীন ফ্যাসিস্ট ধর্মীয় সত্তা গড়ে তুলতে চায়। একদা যেসব প্রতিবেশীরা ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে দীর্ঘকাল পরস্পরের সহযোগী সুহৃদ হয়ে বেঁচেছিল, তারা এক সময় এই ধৰ্মীয় অপশক্তির হাতে ধরা সুতোর টানে ছুরি হাতে পরস্পরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানুষ থেকে অমানুষ হয় ওঠে। নবজাত শিশুদের শরীরে শারীরিক চিহ্ন হিসেবে কোন ধর্ম নেই, জাত নেই, শ্রেণী নেই। সমাজই তাকে এক সময় এমনভাবে শিক্ষিত করে ও এমন পরিচয়ে পরিচিত করায়। এই কৃত্রিম পরিচয় ও বিভাজন ধর্মের একটি কাজ। ধর্মীয় মৌলবাদ এই বিভাজনকে বাহ্যিক নয়। অভ্যন্তরীণ, পরিবর্তনীয় নয় অপরিবর্তনীয় ও অলঙঘ্য হিসেবে সুতীব্রভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ করতে গিয়ে সে ভিন্ন ধর্মের প্রতিবেশী মানুষদের প্রতিযোগী হিসেবে ও সমস্যার কারণ হিসেবে, এমনকি দেশেরও শত্ৰু হিসেবে চিহ্নিত করে। (ভাষাগত, জাতিগত, অঞ্চলগত ইত্যাদি ধরনের সাম্প্রদায়িকতাবাদীরাও তাই-ই করে।) সংখ্যায় যারা যেখানে বেশি সেখানে তারা ছড়ি চালায়। তার প্রতিক্রিয়ায় সংখ্যালঘুরাও ছড়ি ধরে। বিভাজন, অপ্রেম, অবিশ্বাস বেড়েই চলে। মৌলবাদকে ও সাম্প্রদায়িকতাকে টিকিয়ে রাখা ও বাড়তে দেওয়ার অর্থ মানুষের স্বভাববিরোধী এই সব দিকগুলিকে দ্রুত বাড়িয়ে তোলা, যার পরিণতি দাঙ্গা, যুদ্ধ ও ধ্বংসই হতে বাধ্য। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিশেষ ধর্মের মানুয নিজেদের কিছুদিনের জন্য শক্তিশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে ও কর্তৃত্বলাভ করতে পারে, কিন্তু দীর্ঘকাল নয়। ভিন্ন গোষ্ঠীর যাদের সে শত্রু পরিণত করেছে, হত্যা করেছে, নিপীড়ন চালিয়েছে তারা প্ৰতিশোধ নোবেই। অবিশ্বাস ও শক্রিতার পথ ধরে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে আসবে এই পারস্পরিক হনন, যদি না মানুষের শুভবুদ্ধি এই চক্রকে মধ্যপথে ছিন্ন করে। এবং তা করেও।
রাজনৈতিক মৌলবাদও দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার নামে ব্যক্তির স্বাধীন বিকাশ, স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব ও বিশেষ ভাললাগা-মন্দলাগার বোধ আর আবেগগুলিকে অস্বীকার করে। এবং পদদলিত করে,—এক রাজনৈতিক কর্তৃত্বের (তা ব্যক্তির বা গ্রন্থের) অধীনে। ‘রোবট’-এ পরিণত করে তার অনুগতদের। অন্যদিকে এই মানসিকতা ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের জনসাধারণকে শত্রু (শ্রেণীশত্রু?) হিসেবে, প্রতিযোগী হিসেবে ও সহযোগিতা পাওয়ার অযোগ্য বলে প্রতিষ্ঠা করে। একদা যে জনগণ বন্ধুর মত দীর্ঘকাল পাশাপাশি বসবাস করেছে, এখন রাজনৈতিক সচেতনতার নামে পাটিপরিচয় পরস্পরের মধ্যে বিভেদ ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করছে। এমনকি আমাদের মত দেশের গ্রামেগঞ্জেও, আগের মত ‘কৌন জাত বা’-র পরিবর্তে ‘কৌন পাটি বা’—এ প্রশ্নই সামনে আসে। ব্যাপারটি ধর্মীয় বা জাতপাতের বিভাজনের চেয়ে সামান্য কিছুটা সুস্থতর মনে হলেও, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনৈক্য সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট। এর ফলে রাজনৈতিক হানাহানিই বাড়ে। সবাই জনগণের মঙ্গলের কথা বলে, কিন্তু সবাই জনগণকেই বলি দিতে থাকে। মতাদর্শের অনুদার, যান্ত্রিক ও অমানবিক প্রয়োগ এই মৌলবাদীদের,—তারা ধর্ম ও ধর্মীয় মৌলবাদ, এমন কি পুঁজিবাদসাম্রাজ্যবাদের বিরোধী ভূমিকা নিলেও, মূলবিচারে মানুষের শত্রুতে পরিণত করে। তাই সবধরনের মৌলবাদই যে পরিত্যাজ্য এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক মৌলবাদী মানসিকতার সমাধান হয়তো ভবিষ্যতে কোনদিন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অবলুপ্তির মধ্য দিয়ে হতে পারে, যখন বৃহত্তর সমবায় ভিত্তিক ও নূ্যনতম কিছু ক্ষেত্রে ঐক্যভিত্তিক মতাদর্শ ও কর্মসূচীকে সামনে রেখে মানুষ তার দৈনন্দিন জীবন, সমাজ ও সংস্কৃতিকে স্বচ্ছল ও সুস্থ করে তুলবে। কিন্তু এটি অর্জনের পূর্বশর্ত সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও ধর্মীয় বিভাজনকে ধ্বংস করা এবং সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদকে অবলুপ্ত করা। কারণ এই শোষণ ও এই বিভাজন এমন ঐক্যের ভিত্তিমূলের শত্ৰু, শেকড়েই তাকে বিনষ্ট করে দিতে সচেষ্ট। আর এই সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদের উচ্ছেদে পরস্পর সংযুক্ত দুটি মোটা দাগের দায়িত্বের কথা বলা যায়—তা হল সচেতনতা ও সংগ্রাম।