এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, আমেরিকা-ইংল্যান্ডের মত দেশগুলির ধর্ম ও পুঁজিবাদী সংস্কৃতির ককটেল ভারতের মত দেশেও চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে এবং সম্প্রতি তা বিপুল উদ্যোগে বাড়ানো হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘সর্বধর্মে সমভাব’ করে ধর্মীয় সুড়সুড়ি দেওয়া হয়েছে, ধর্মীয় মৌলবাদের সৃষ্টির পথ পরিষ্কার করা হয়েছে। বামপন্থী-দক্ষিণপন্থী নির্বিশেষে প্রায় সব রাজনৈতিক সুবিধাবাদী দলগুলি ভোটের লক্ষ্যে ধর্মীয় কুসংস্কার এবং ধর্মকে ব্যবহার করছে ও প্রশ্ৰয় দিচ্ছে। অন্যদিকে-ভোগবাদ, পণ্যবাদ বা কনজিউমারজম, আত্মকেন্দ্রিকতা, যে কোনভাবে অর্থোপার্জনের মানসিকতা ইত্যাদি এবং এসবকে জনপ্রিয় করার জন্য যৌনতা ও হিংস্রতার সংস্কৃতি–কে দূরদর্শন ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে ঢালাও ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে। সবাইকে নিয়ে বাঁচা নয়, শুধু নিজেকে প্রতিষ্ঠা করাই এখনকার যুব সমাজের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে।
(সামাজিকভাবে এর প্রতিফলনও ঘটছে। এর একটি সামান্য পরিচয় এ ধরনের হিসাব থেকে পাওয়া যাবে যে, ভারতে এখন প্ৰতি ৪৭ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিতা হন, প্ৰতি ৪৪ মিনিটে একজন নারী অপহৃত হন এবং প্রতিদিন পণজনিত কারণে বধূহত্যা ঘটে ১৭টি। —-গণশক্তি, ৬৯.৯৫)
আমেরিকা-ইংল্যান্ডে ধর্মের অবস্থান থেকে এটি বোঝা যায় যে, ধর্ম এই নৈতিক সংকট আটকানোর ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা তো নেয়ই না, বরং তাকে বাড়িয়ে তোলায় সাহায্য করে। কোন কোন সরল বিশ্বাসী ধামিক ব্যক্তি এমন মনে করতে পারেন যে, ধর্মের মূল শিক্ষা ঐ সব দেশের মানুষ ভুলে গেছে, আগে এই শিক্ষা ছিল বলে এমন নৈতিক-সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টি হয় নি। এটি একটি ভ্রান্ত ও আত্মপ্রবঞ্চনাকারী ধারণা। অতীতেও, ধর্মীয় শিক্ষার চেয়ে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও ঐ অনুযায়ী সামাজিক পরিকাঠামোই। এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে ব্যবস্থায় বর্তমানের পুঁজিবাদী তথা সাম্রাজ্যবাদী পরিকাঠামো টিকিয়ে রাখার উপযোগী মুনাফা বাড়ানো, পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবর্তে অবাধ প্রতিযোগিতা (অর্থাৎ অন্যকে ল্যাং মেরে বা ধাক্কা মেরেও নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া), চূড়ান্ত পণ্য নির্ভরতা, ক্রমবর্ধমান ভোগবাদ (না হলে পণ্য বিক্রি হবে না) ইত্যাদি থাকার প্রয়োজন ছিল না বা থাকবে না সেই ব্যবস্থাগুলিতে এমন অর্ধগৃধুতা, হিংস্ৰতা ও তাদের হাত ধরাধরি করে আসা যৌনবিকৃতি সৃষ্টির পরিবেশও শক্তিশালী ছিল না বা থাকবে না। বরং দেখা গেছে তথাকথিক ধৰ্মশাস্ত্রগুলিতে আদিম যৌনতাকে সুড়সুড়ি দেওয়ার উপকরণ বহুতু পরিমাণেই মজুত আছে। ‘লীলা’ বলে যতই চালানোর চেষ্টা করা হোক না কেন, শ্ৰীকৃষ্ণের উলঙ্গ গোপিনীদের তারিয়ে তারিয়ে দেখার, বা ছদ্মবেশে ঝোপে ঝাড়ে কুয়াশার মধ্যে যেখানেই হোক সুন্দরী মহিলাদের উপর হামলে পড়ার দৈব অনুগ্রহের’ মত অজস্র লাম্পট্যের ঘটনা এই সব তথাকথিত ধর্মগ্রন্থে অসংখ্য রয়েছে। আছে শ্ৰীীরামচন্দ্রের সুগ্ৰীব বধ বা ইন্দ্ৰজিতকে খুন করার মত নৃশংস হিংস্রতার অজস্র উদাহরণও। ব্যাপারগুলি তখনকার পরিবেশে স্বাভাবিক হয়তো ছিল। কিন্তু ধর্মের নামে এখনো তা প্রচার করা ও মহীয়ান করার অর্থ ঐ বিকৃতিকে, ক্যান্সার বৃদ্ধিকারী উত্তেজনার (carcinogenic) ভূমিকা নিয়ে বাড়িয়ে তোলা। সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতিও তাই চায়। তারা চায় ধর্মের অবৈজ্ঞানিক মানসিকতার সঙ্গে যৌনতায় আচ্ছন্ন এক ব্যক্তিত্বহীন ক্ৰেতাজনগণ, যারা যা প্রচার করা হবে। বিনাযুক্তি প্রয়োগে (যেন ঈশ্বরভক্তির মত), নিজেকে তৃপ্ত করতে (যেন এক যৌন আনন্দ লাভের মত) তাই-ই কিনবে।
মৌলবাদী ধর্মের এই নোংরা ব্যবহারের এক কেন্দ্রীভূত রূপ,—তার এই কেন্দ্রীভবন মূলত ধর্মকে নিয়ে, সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্রীভবন যেমন ঘটে একচেটিয়া পুঁজির মধ্যে। সাম্রাজ্যবাদ সামান্য সংখ্যক কিছু মানুষের একটি ছোট্ট গোষ্ঠীর স্বাের্থরক্ষণ করতে, বিপুল সংখ্যক পৃথিবীবাসীকে তাদের অর্থনৈতিকভাবে ক্রীতদাস, সাংস্কৃতিকভাবে পঙ্গু এক সত্তায় পরিণত করতে চায়। ধর্মীয় মৌলবাদও তেমনি মানুষকে এক ভাববাদী অবৈজ্ঞানিক চেতনার ক্রীতদাসে পরিণত করতে ও স্বাধীন বিকাশে অক্ষম, জড়বদ্ধ প্রাচীন সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে আচ্ছন্ন করে পঙ্গু করে তুলতে চায়। উভয়ের নেতৃত্ব দেয় স্বল্প কিছু মানুষের একটি আপাত শক্তিশালী শ্রেণী, যারা বিপুল শক্তিধর ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে সাময়িকভাবে শাসন করে বা করতে চায়। তাই উভয়েই সমানভাবে ঘূণ্য, পরিত্যাজ্য ও মানবতার শত্রু।
এরা মানুষের স্বাভাবিক মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতাই ভালবাসা ও পরস্পরকে সাহায্য করা। এর পেছনে তার হরমোন ও জীন-গত (genetic) গঠন যেমন কাজ করে, তেমনি কাজ করে তার বহু শত বছরের অভিজ্ঞতা, যে অভিজ্ঞতায় সে জেনেছে পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা সম্ভব নয়। ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদ—একই বৃন্তের এই তিন বিষফুল মানুষের এই পারস্পরিক মমত্ববোধ, সহযোগিতা ও সহমর্মিতাকে ধ্বংস করতে চায়। তা না করলে তাদের অস্তিত্বই সম্ভব নয়।