মৌলবাদী মানসিকতায় অভ্যস্ত বা সাম্রাজ্যবাদের প্রসাদপুষ্ট মানুষদের কাছ থেকে এমন ধরনের কূট বিতর্ক উঠলেও উঠতে পারে, কিন্তু তা উভয়ের সভ্যতাবিরোধী ভূমিকাকে আলোকোজ্জ্বল আদৌ করে না। এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এক সময়ে ইটালিতে ফ্যাসিবাদের অনুগামীও কম ছিল না। এই শতাব্দীর চতুর্থ দশকে যখন জার্মানীতে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সমগ্র জার্মান জাতিই তার সমর্থক ছিল, এবং এখনো তার অবশেষ আছে, নিও-নাৎসি গোষ্ঠী আছে, আছে একই ধরনের সন্ত্রাসবাদী কর্তৃত্ববাদ ও হিংস্র৷ জাতীয়তাবোধ। তবু দক্ষিণপাহী-বামপন্থী নির্বিশেষে পৃথিবীর কোন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই তার উৎসাহদাতার ভূমিকা পালন করতে ইচ্ছুক নন। কারণ ফ্যাসিবাদকে ‘ফ্যাইন্যান্স পুঁজির সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল একনায়কত্ব’ হিসেবে অনুভব করা যাক বা না যাক, এটি অন্তত বোঝা গেছে কি বীভৎস নারকীয়তার সঙ্গে সে তার কাজ হাসিল করতে চায়, কিভাবে বাজারের স্বার্থে যুদ্ধ বাধায়, কিভাবে লক্ষ লক্ষ নির্দোষ আবালবৃদ্ধবনিতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই মানবতাবিরোধী মানসিকতার অবসানে তাই দলমত নির্বিশেষে বহু মানুষ এক সময় সংগ্ৰাম করেছেন। ১৯৪৫– এ, এখন থেকে ৫০ বছর আগে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছিল। কিন্তু ঐ ফ্যাসিবাদ ভিন্ন রূপে এখনো আছে, রেখে গেছে তার সঙ্গীসাথী ও সন্তানসন্ততিদের। এদেরই অন্যতম ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ।
পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা মানুষের সমস্যা সমাধানের কোন পথ যে আদৌ নয়, তা বোঝা যায় তাদের নিজেদেরই ক্রমবর্ধমান সংকটের বিপুলতা থেকে। এই ব্যবস্থা নৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটে ক্রমশ নিমজমান। নৈতিকসামাজিক ক্ষেত্রে সংকট ও অবক্ষয় কি ভয়াবহতা অর্জন করেছে তা উন্নত ইংরেজ জাতির’ সাম্প্রতিক অবস্থা থেকে আচি করা যেতে পারে; শুধু বিগত ২৫ বছরে (১৯৭০-৯৫) ইংল্যান্ডের এই অবস্থা কেমন দাঁড়িয়েছে তার একটি আংশিক চিত্র শ্ৰী নীরদচন্দ্ৰ চৌধুরীর বর্ণনা থেকে পাওয়া যেতে পারে।–
‘১. নরনারী সম্পর্কিত আচরণ। বর্তমানে ইংরেজের মধ্যে লাম্পট্যের যে বিস্তার, বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতা দেখা যাইতেছে তাহা দ্বিতীয় চার্লস-এর যুগে বা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষেও দেখা যায় নাই।
এ-যুগের ইংরেজ লম্পটেরা শিশু, বালিকা ও বৃদ্ধাকেও বলাৎকার করিয়া হত্যা করিতেছে। এমন কি বারো তেরো বৎসরের বালকও এইরূপ বলাৎকার করিতেছে। অপর পক্ষে অল্পবয়স্কপ বালিকারাও এরূপ কামপরবশ হইয়াছে যে, তাহাদিগকে গৰ্ভ নিবারণের ঔষধ দিবার ব্যবস্থা হইয়াছে।
২। নরহত্যা। শুধু কামের বশেই নয়, অর্থের জন্যও নরহত্যার বিস্তার হইতেছে। বারো-তেরো বৎসরের বালকেরাও সামান্য অর্থের জন্য পেনসনভোগিনী বৃদ্ধাকে হত্যা করিতেছে। আমি ১৯৭৫ সাল পর্যন্তও অক্সফোর্ডের চারিদিকে অতি নির্জন স্থানে প্রাতঃভ্রমণ করিতে যাইতাম, এখন আর ভরসা পাইনা।
৩। গুন্ডাবাজির যে প্রসার হইয়াছে, উহা ভীতিজনক, একটু রাগ হইলেই একজন বা একদল অন্য ব্যক্তির বা অন্য দলের উপর ছোরা চালাইতেছে।
৪। অর্থালিন্সা সর্বব্যাপী এবং সকল বয়সের ইংরেজের মধ্যে দেখা দিয়াছে, কিন্তু সেই অৰ্থলিন্সাও, লাম্পট্যের মতই, ইতর, সামান্য অর্থের জন্য। সকল ইংরেজের মনে এক চিন্তা-কি করিয়া টাকা হইবে-ইংরেজি ভাষায় উহার পরিচয় দিতে হইলে বলিতে হয়–Everybody wants his penny-worth for his penny or his penny for his pennyworth. ইহার বেশি উচ্চ ধারণা অর্থোপার্জন সম্বন্ধেও নাই।’ (দেশ; ১২.৮.৯৫)
যাঁরা একটু খোঁজ খবর রাখেন তাঁরা জানেন আমেরিকা ও তার মানুষও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। ‘ইউ এস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট নামে মার্কিন সাময়িকী ১৯৮০-তে এ ব্যাপারে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল তার থেকে জানা যায়, ওখানে ‘গড়ে প্রতি দু সেকেন্ডে একটি সিঁদেল চুরি, প্রতি ২৮ সেকেন্ডে একটি গাড়ি চুরি, প্রতি ৪৮ সেকেন্ডে একটি মারাত্মক শারীরিক আক্রমণ ও আঘাত, প্রতি ৫৮ সেকেন্ডে একটি সশস্ত্ৰ ডাকাতি, প্রতি ৬ মিনিটে একটি ধর্ষণ এবং প্রতি ২৩ মিনিটে একটি খুনের ঘটনা ঘটে।’ এবং সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান এর চেয়ে আশাব্যঞ্জক তো নয়ই, বরং আরো ভয়াবহ।
নৈতিক ও সামাজিক এই সংকট যে ধর্মহীনতার জন্য সৃষ্টি হয়েছে তা আদৌ নয়। ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রভাব ও ধর্মবিশ্বাস যথেষ্টই আছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিপুলভাবে এগিয়ে থাকলেও এই এগিয়ে থাকার ব্যাপারটি নিছকই যান্ত্রিক ও শ্রেণী:স্বার্থে প্রযুক্ত। প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্কতার পরিবেশ এমন পুঁজিবাদী তথা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে এখনো তৈরি হয় নি। এরই একটি প্রতিফলন ঘটে এমন দেশের নাগরিকদের মধ্যে ঈশ্বরবিশ্বাস ও ধর্মমোহ থেকে মুক্তির মানসিকতা অতি নূ্যনতমমাত্রায় বিকশিত হওয়ার মধ্যে। যেমন ১৯৮০ সালের হিসাব অনুযায়ী উত্তর কোরিয়ার শতকরা ৬৭.৯ জন, আলবেনিয়ার ৫৫.৪ জন, চীনের ৭১.২ জন বা মঙ্গোলিয়ার ৬৫.৪ জন (১৯৯০) ব্যক্তি যখন ঈশ্বরবিশ্বাসমুক্ত (atheist) ও ধর্ম-পরিচয়হীন (nonreligious) হিসাবে নিজেদের ঘোষণা করেছেন, সেখানে আমেরিকায় এমন মানুষের সংখ্যা মাত্র শতকরা ৬.৮ ও ইংল্যান্ডে ৮.৮ ভাগ। (বিগত বছরগুলিতে এই পরিসংখ্যান বিরাটভাবে কিছু পরিবর্তিত হয় নি।) স্পষ্টতঃই আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের ৯০ ভাগেরও বেশি মানুষ ধর্ম ও ঈশ্বরকে যতটুকুই হোক না কেন এবং যেভাবেই হোক না কেন আঁকড়ে আছেন। আমেরিকায় ফান্ডামেন্টালিজমসহ চার্চের প্রভাব কম নয়। ইংল্যান্ডে তো রাজতন্ত্রের পাশাপাশি চার্চ অব ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের মহিমা ও প্রাধান্য বিপুল। এই অবস্থায় ইংল্যান্ডে বা আমেরিকায় এই চূড়ান্ত নৈতিক অবক্ষয়, এই হিংস্রতা, লাম্পট্য ও অর্থগৃধুতা, চরম ভোগবাদী মানসিকতার পেছনে বস্তুবাদী দর্শনের বা বামপন্থী আন্দোলনের ভূমিকা শূন্য। বরং এটি বলা অসঙ্গত নয় যে, এর পেছনে ভূমিকা পালন করেছে। ধর্ম এবং শোষণভিত্তিক পুঁজিবাদী তথা সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার ককটেল। খৃস্ট ধর্মের ব্যবহার ঐ সব দেশে সম্পূর্ণত আদর্শ মৌলবাদী চরিত্র হয়তো অর্জন করে নি। কিন্তু মানসিকতা বা ভিত্তি আছেই, এবং ঐসব দেশে হিংস্র ধর্মীয় মৌলবাদের অনুপস্থিতির একটি বড় কারণ হিংস্র ভিন্ন বা বিরোধী ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির সংখ্যার নূ্যনতম পরিমাণ। (আমেরিকায় শতকরা মাত্র ৬.৭ জন ও ইংল্যান্ডে শতকরা ৪.৩ জন ব্যক্তি অন্যান্য নানা ধর্মাবলম্বী।)