অনাবিল ধর্মবিশ্বাস আছে, মৌলবাদ নেই, কিংবা তারও পরোকার, সেই কৈশোরের পুঁজিবাদ আছে সাম্রাজ্যবাদ নেই। —এমন হলে হয়তো কত সুন্দরই হত এই পৃথিবীটা। ২ কিন্তু তা আর হবার নয়। মানুষের সভ্যতার ইতিহাস সময়ের স্রোতে ঐ কাল পেরিয়ে এসেছে। তাকে আবার পশ্চাদগমনে ফেরানো যায় না। তার বড় কারণ এই এগিয়ে যাওয়ার পথে, মানুষ অনেক কিছু অর্জনও করেছে, যা তার অবস্থানকে গুণগতভাবে পাল্টে দিয়েছে। এমন বৈজ্ঞানিক সত্য ও জ্ঞান মানুষ লাভ করছে। যাতে ঐ ঈশ্বরের ও ধর্মের কোন স্থান নেই, প্রয়োজন হয়ে পড়েছে নতুনতর মূল্যবোধের, যার একমাত্র ভিত্তি মনুষ্যত্ব। এমন উৎপাদন পদ্ধতি মানুষ করায়ত্ত করছে, যাতে পুঁজিবাদের প্রাথমিক রূপ একেবারেই বেমানান ও বর্তমান স্তরও একসময়ে বিধ্বংসী হয়ে উঠছে। তাই প্রয়োজন নতুনতর এক ব্যবস্থা, যার প্রধান লক্ষ্য স্বনির্ভরতার নামে সংকীর্ণ জাতীয়তা নয়, ব্যাপক আস্তর্জাতিক সহযোগিতায় এক বিপুল গণ উৎপাদন ব্যবস্থা, যাতে পৃথিবীর সব মানুষ প্রায় সমান স্বাচ্ছন্দ্যে সুন্দর হয়ে উঠবে। কিন্তু এই প্রয়োজন কবে মিটবে তা জানা নেই,—হয়তো দু’ চার দশক বা দু’ চার শতাব্দী পরে। কিংবা হয়তো আদৌ মিটবে না, যদি মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছেদকে সক্রিয়ভাবে দ্রুততর না করা হয়; হয়তো তাহলে এই প্রয়োজন মেটার আগেই মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ, এই দুই দৈত্যের হাতে মানবসভ্যতার ধ্বংস ঘটবে (সেই সঙ্গে তাদেরও)। যাদের জন্য এই প্রয়োজন মেটার প্রয়োজন ছিল, সেই মানুষই আর থাকবে না।
এই ভয়ংকর পরিণতির কথা ভেবে আমরা শিহরিত হতে চাইনা। মানুষ বিপুল ক্ষমতাধর। তার মানবিকতা অক্ষয়, অমর। মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতিক্রিয়ায় চরমতম সর্বনাশের প্রাগমুহূর্তেও সে রুখে দাঁড়াতে সক্ষম। এবং সে রুখে দাঁড়াবেও, দাঁড়াচ্ছেও।
—————————-
(১) অবশ্য এদের ‘অবতারত্ব সম্পর্কিত প্রচার ও বিশ্বাসও এক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকা পালন করে।
(২) হিন্দুদের মত বা মুসলিমদের নামাজের সময়ের মত মধ্যযুগে খৃস্টান ইয়োরোপেদিনে ৭টি বিশেষ ধর্মীয় সময় চিহ্নিত করা হত-(১) ম্যাটুটিনা-ব্রাহ্মা মুহূর্ত (বিছানা ছেড়ে ওঠার সময়), (২) প্রাইমা-সূর্যোদয় (৩) টার্সিয়া—সূর্যোদয় ও মধ্যাহ্নের মাঝামাঝি, (৪) সেক্ষ্ট্ৰী-মধ্যাহ্ব, (৫) নোনা-মধ্য অপরাহ্ন, (৬) ভেসপেরি—সূর্যাস্তের এক ঘণ্টা আগে, (৭) কমপ্লিাটা-সূর্যস্ত। এই সময়গুলিতে গীর্জা থেকে ঘন্টাধ্বনি করে সবাইকে জানানো হত।
(৩) তবে বিশেষ সময়ে কৌশল হিসেবে তারা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার কথাও বলে। যেমন, ‘সাম্রাজ্যবাদ রাখতে বিজেপি সঙ্গে চায় বাম দলগুলিকে—দলের সাধারণ সম্পাদক কে এন গোবিন্দাচাৰ্য আজ সরাসরি বামন্দালগুলিকে বলেছেন, বিজেপি সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণাও সংস্কার ঝেড়ে ফেলেনিয়া সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমরা একত্রে রুখে দাঁড়াই আসুন…’ ইত্যাদি। ব্যাপারটি প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা ও গণসমর্থন আদায় করা ইত্যাদির লক্ষ্যে একটি কৌশলীই ব্যাপারটি স্পষ্ট হয় যখন দেখা যায়। তার পরেই গোবিন্দাচাৰ্য বলেন, ‘আমাদের উচিত একজোট হয়ে ভারতীয় জীবনদর্শন ও মূল্যবোধকে রক্ষা করা।’ এই দর্শন ও মূল্যবোধ তাঁদের কাছে দ্বিধাহীনভাবে হিন্দুত্বেরই। (সংবাদ প্রতিদিন, ২৯.৯.৯৪)
(৪) কিন্তু শুরুতে পুঁজিবাদী বিকাশের জন্য প্রয়োজন ছিল বিজ্ঞানের অনুসন্ধিৎসা। তখন এই ধর্মমোহ তার বিকাশে বিরোধী ভূমিকা পালন করছে বলে অনুভব করা গিয়েছিল। তাই শুরুর দিকে বুর্জেয়ারা ছিলেন ধর্মবিরোধী।
৬. মৌলবাদের সমাধান সন্ধানে
প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভাল, মৌলবাদী সমস্যার সমাধানে কোন চটজলদি ফর্মুলা বা প্রেসক্রিপশান হাতের কাছে মজুত নেই। আর এ ব্যাপারে নিজের বোধ এত কম ও অক্ষমতা এত বেশি যে, এ ধরনের কথা বলাও অনেকের কাছে একটি হাস্যকর ঔদ্ধত্য বলে মনে হতেই পারে। এ ব্যাপারে উপযুক্ত পণ্ডিত ও সচেতন ব্যক্তিরাও চিন্তাভাবনা করছেন। তাঁদের চিন্তার সামান্য শরিক হতে চাওয়াটা অন্যায় নয় বলেই, এমন ঔদ্ধত্য প্রকাশ করার সাহস হয়।
মৌলবাদী সমস্যার সমাধানের কথা ভাবতে গিয়ে প্রথমে একটি কথা মনে আসে যে, আদৌ এর সমাধানের প্রয়োজন আছে কিনা এবং যে ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে তার সৃষ্টি হয়েছে তাকে পরিবর্তন করাও সম্ভব কিনা। মৌলবাদের উচ্ছেদ ঘটানোটা যে অতি জরুরী তা হয়তো যে কোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, মানবতাবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিই নিদ্বিধায় স্বীকার করবেন। তবু প্রশ্ন জাগে, পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন ধর্মের মৌলবাদীরা ও সামগ্রিক ভাবে মৌলবাদী মানসিকতা যে জনসমর্থন বিগত দু’এক দশকের মধ্যে অর্জন করেছে, সেটি এটি অন্তত প্রমাণ করে যে, জনগণের একটি অংশ মৌলবাদ চান, হয়তো বা অসচেতনভাবে কিংবা ধর্মীয় অভ্যাসে। তাই তাঁদের এই আকাঙ্ক্ষাকে মর্যাদা না দেওয়া অনুচিত কিনা। একইভাবে সাম্রাজ্যবাদের জনবিরোধী ও মানবতাবিরোদী ভূমিকার কথা যাঁরা উপলব্ধি করেন, তাদেরও এই প্রশ্ন করা যায় যে, সত্যিই এইভাবে সাম্রাজ্যবাদকে চিহ্নিত করা উচিত হচ্ছে কিনা,–নাকি এটি একটি বিশেষ উৎপাদন ব্যবস্থার বিকশিত এক রূপ, যার সাহায্যে উৎপাদন বাড়ছে, বহু ভোগ্যপণ্যের সৃষ্টি হচ্ছে, বহু মানুষ এর ফলে সুখস্বচ্ছন্দ্যের মুখ দেখছেন (সাময়িকভাবে হলেও) এবং বহু মানুষ মানসিকঅর্থনৈতিক-সামাজিক ভাবে এই ব্যবস্থার শরিক হয়েছেন,-ধর্মবিশ্বাস তথা ধর্মের বিভিন্ন স্তরের শরিক হওয়ার মত।