“ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার আজকের দিনে শ্রমিকশ্রেণীর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী পুঁজিবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র। তাই স্বৈরাচার ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন কখনও ধর্মের রাজনীতি ও মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন থেকে পৃথক হতে পারে না।…” (বাংলাদেশ লেখক শিবির, ঢাকা কর্তৃক জুলাই, ১৯৮৮-এ প্রকাশিত ‘সাংস্কৃতিক আন্দােলন’ পুস্তিকায় মনিরুল ইসলাম-এর ‘রাষ্ট্রীয় ধর্ম ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’) কিংবা “বাংলাদেশে মৌলবাদীরা ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার মধ্যকার বিরোধটিকে জিইয়ে রাখতে যে কোনো প্রসঙ্গকে তুলে নিতে আগ্রহী। তসলিমা নাসরিনের ইসলাম বিরোধিতা, হিন্দু প্রীতি ও ‘লজ্জা’র প্রকাশ ইস্যু হিসেবে মৌলবাদীদের কাছে খুব লোভনীয়। সিলেটের একটি ক্ষুদ্র মৌলবাদী দল তসলিমা নাসরিনের ইসুতে সিলেটে ধর্মঘট ও হরতাল ডাকে।…” (ফারুক ফয়সল-এর প্রবন্ধ ‘তর্কবিতর্ক এবং তসলিমা নাসরিন’; গোলাম মোর্তোজা ও কাজী মোস্তাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘প্রসঙ্গ নারীবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও তসলিমা নাসরিন’, ঢাকা, ১৯৯৪)
স্পষ্টতই আগেরটিকে মৌলবাদ বলতে সামগ্রিকভাবে মৌলবাদ ও মৌলবাদী মানসিকতা-ক্রিয়াকাণ্ডকেই বােঝানাে হয়েছে; পরেরটিতে বাংলাদেশের মৌলবাদী বলতে মুসলিম মৌলবাদীদেরই বােঝানো হয়েছে, যদিও ‘মুসলিম’ বিশেষণটি উহ্য রয়েছে।
(আর ‘মৌলবী’ ও ‘মৌলবাদী’ কথা দুটির মধ্যে বেশ ধ্বনিগত সাদৃশ্য রয়েছে, যদিও তাদের উৎস ও অর্থ আলাদা। ‘মৌলবী’ কথার অর্থ ইসলামী শাস্ত্ৰে পণ্ডিত মুসলিম। কিন্তু তাদের অনেকের আচরণ এমন হয়ে উঠেছে যে, মৌলবী ও মৌলবাদী প্রায় সমার্থক হয়ে যাচ্ছে এবং পাশাপাশি উল্লেখিত হচ্ছে। যেমন, ‘অন্তঃসত্ত্বাকে মাটিতে পুতে পাথর ছুড়ে মারার ফতেয়া’ : জহিরুল হক, ঢাকা, ২৭ জুলাই–মৌলবাদীরা কতটা অমানবিক, নৃশংস হতে পারে তার নতুন নজির ফের মিলল। এক দরিদ্র অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে অর্ধেক মাটিতে পুঁতে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলার ফতোয় দিয়েছে বাংলাদেশের গাজিপুরের ইসলামপুর গ্রামের মৌলবীরা।…” ইত্যাদি। আজকাল, ২৮.৭.৯৫)
তসলিমা নাসরিনও ১৯৯১-এ বাংলাদেশে প্রকাশিত তার ‘নির্বাচিত কলাম’- এ (এর লেখাগুলি আরো আগে বাংলা দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।) অনেকবার কথাটি ব্যবহার করেছেন। –”মৌলবাদীরা বলে নারীর স্থান ঘরে, সে সর্বদা পর্দার ভেতরে থাকবে, তার বাইরে এসে বিজ্ঞাপন করা বারণ। …মৌলবাদীরা নারীকে উপাৰ্জনক্ষম, স্বনির্ভর ও প্রগতিশীল দেখতে চায় না। …তলিয়ে দেখলে পুঁজিবাদী ও মৌলবাদীর অন্তর্নিহিত সাযুজ্য বেশ ধরা পড়ে। পুঁজিবাদীরা নারীকে যে শৃঙ্খল পরায় তা রঙচঙে বাহারি। আর মৌলবাদীদের শৃঙ্খল সুরা কলমা পড়া, ফু দেওয়া, ফ্যাকাসে। …” (এখানে আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশিত ‘নির্বাচিত কলাম’- এর তৃতীয় মুদ্রণ থেকে সংগৃহীত)
অন্যদিকে এই ‘ধর্মীয় মৌলবাদীদেরই বোঝাতে নানা প্ৰবন্ধকার অন্যান্য নানা পরিভাষাও ব্যবহার করেছেন। যেমন হিন্দু ধৰ্মীয় মৌলবাদীদের জন্য ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী’ কথাটি। “হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মনে রাখা উচিত, মহাত্মা গান্ধী অথবা পণ্ডিত নেহরু এমন কোন ‘রথ’ কখনো চালাননি যাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। আদবানির রথ যাত্রা সম্বন্ধে কি এই কথা বলা যায়?”–ডঃ অমলেন্দু দে-র ‘ধর্মান্ধতাকে চালানো হচ্ছে জাতীয়তার নামে’, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২.১২.৯০। এই ‘ধর্মান্ধতা’ কথাটিও বহু জন ধর্মীয় মৌলবাদের সমর্থক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। (সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে যে সব দম্পতি লড়াই করে আসছেন, তাঁদের মধ্যে একটি প্রখ্যাত নাম, ঐতিহাসিক ও সুলেখক ডঃ অমলেন্দু দে এবং তাঁর স্ত্রী নাসিমা। ডঃ দে তাঁদের বাংলা লেখায় ১৯৯০-এর অগাষ্ট থেকে ‘মৌলবাদ-মৌলবাদী’ কথাগুলি ব্যবহার করছেন বলে জানিয়েছেন। তার আগে, ১৯৭৩ থেকে লিখতেন ‘ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ’, ‘সাম্প্রদায়িক স্বাতন্ত্র্যবোধ’ ‘ইসলামিকরণ’ ইত্যাদি কথা। আর বক্তৃতাদিতে ১৯৮০ সাল থেকেই মৌলবাদ-মৌলবাদী ইত্যাদি ব্যবহার করতেন। যাঁরা এ প্রসঙ্গে কাজ করছেন, তাদের অন্যতম একজনের শব্দ ব্যবহারের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত রাখার জন্য এখানে এই ব্যক্তিগত উল্লেখ।)
‘হিন্দুত্ববাদী’ কথাটিও হিন্দুমৌলবাদীদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। (“…তাঁরা মার্ক্সবাদীই হন আর হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টিই হন, তফাৎ ধরা পড়ে কেবল বুকনিতে।।”—আবদুর রউফ-এর ‘মহারাষ্ট্রে নতুন জমানা সাম্প্রদায়িক এবং প্রাদেশিক’, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১শে মার্চ, ১৯৯৫)
কেউ কেউ আবার ‘হিন্দু দক্ষিণপন্থা’ কথাটি ব্যবহার করেন ‘হিন্দুমৌলাবাদের’ প্রায় সমার্থক হিসেবে। (সুভাষীরঞ্জন চক্রবর্তী অনুদিত তপন বসু প্ৰমুখের ‘খ্যাকিপ্যান্ট গেরুয়া ঝাণ্ড’, ১৯৯৩) তবে এই হিন্দু দক্ষিণপন্থা বা ধর্মীয় দক্ষিণপন্থা (Religious right) শুনলে কেমন একটা খটকা লাগে। তাহলে ‘হিন্দু বামপন্থা’ বা ‘ধর্মীয় বামপন্থা’ নামে কোন কাঁঠালের আমসত্ত্ব হয় নাকি ?
পাশাপাশি বাংলা ‘সাম্প্রদায়িকতা’ শব্দটির কিছু ভিন্নতর ব্যঞ্জনা থাকলেও অনেকে বিশেষত ‘ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা’-কে ধর্মীয় মৌলবাদের কাছাকাছি একটি অর্থে প্রায়শঃই ব্যবহার করেন—এমনকি তার অর্থ আরো প্রসারিতও করেন। (“ভারতীয় রাজনীতিতে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ এই শব্দটি আদিতে প্রধানত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের রাজনীতি, বিশেষত হিন্দু-মুসলমান রাজনীতি বোঝাতো। বর্তমানে শব্দটির অর্থ আঞ্চলিকতাবাদ, জন্মলব্ধ বৰ্ণাশ্রমবাদ ও গোষ্ঠীবাদে সম্প্রসারিত হয়েছে।”–ডাঃ ধীরেন্দ্ৰ নাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ সাম্প্রদায়িকতা : মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ’, মানবমন।)