কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুধু এই কারণে স্তিমিত করাটা বিপজ্জনক। পরস্পর সম্পর্কিত, পরস্পরের সুহৃদ এবং একই সমাজব্যবস্থার কাঠামো ও উপরিকাঠামো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এই দুই সভ্যতা-বিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই স্তিমিত করার অর্থ, দুর্বলতার সুযোগে তাদের শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করা এবং বৈষম্যমুক্ত বৈজ্ঞানিক চেতনাসম্পন্ন নতুন মানবসমাজ প্রতিষ্ঠার কাজকে বিলম্বিত করা। এর জন্য সরাসরি এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও ধর্মের স্বরূপ সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত প্রচার ও তার জনস্বার্থবিরোধী দিকগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রামও করা প্রয়োজন। কিন্তু তার লক্ষ্য হওয়া উচিত সেই শ্রেণী যারা মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তির মোহ ও প্রয়োজন এবং ধর্ম ও ঈশ্বর-বিশ্বাসে মোহ ও প্রয়োজনকে ব্যবহার ক’রে তাদের শাসন, শোষণ ও প্রতারণা করে। বিভিন্ন স্তরের শোষিত মানুষকে এ ব্যাপারে। সচেতন করা, সংগঠিত করা ও বৈজ্ঞানিক সত্য জানতে সাহায্য করা যায়, এবং এইভাবেই তাদের স্বাবলম্বী হয়ে মুক্তির পথ খোঁজার উপযুক্ত করে গড়ে তোলার চেষ্টা চালানো যায়। কিন্তু তা করতে গিয়ে এখনো মানুষ তার যে অসহায়তা, অনিশ্চয়তা, অজ্ঞতা ও আবেগের কারণে ব্যক্তিগত সম্পদ ও ধর্মকে আকড়ে রাখতে চায়, সেগুলিকে অস্বীকার করে মানুষকে অপমান, হতমান ও আঘাত করা অপরাধ।
এবং অপরাধ মানুষের শারীরিক, মানসিক তথা আবেগগত বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে তাকে যন্ত্রে পরিণত করা বা যন্ত্রের মত ব্যবহার করার মানসিকতাও। ‘আমি (নেতা) যা বলছি, সেটিই সত্য, আর তার অনুসরণ যে না করে সে ভ্রান্ত ও শত্ৰুস্থানীয়’-এমন মানসিকতা মূলত কর্তৃত্ববাদী, পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের হলেও এই মানসিকতা এখনকার, রাজনৈতিক দল, এমন কি তথাকথিত বামপন্থীদের মধ্যেও সংক্রমিত।
মানুষের সমাজে বাস করতে গেলে প্রতিটি মানুষকেই নির্দিষ্ট কিছু বিধিনিষেধ, আচারবিধি ও শৃঙ্খলা মানতেই হয়; সমাজে বিশেষ একজনের চূড়ান্ত ব্যক্তিস্বাধীনতা ও চরম গণতন্ত্র অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু তা যান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে কিনা এবং কাদের স্বার্থে এই শৃঙ্খলা ও আচারবিধি—এগুলি বিচার করা অবশ্যই অতি গুরুত্বপূর্ণ। যান্ত্রিকতা-মুক্ত একটি বৈজ্ঞানিক মতাদর্শ ও পথ মানুষকে তার সভ্যতার স্থায়িত্বের দিকে নিয়ে যাবে, যে স্থায়িত্বকে রক্ত লোলুপ সাম্রাজ্যবাদ ও চেতনাবিকৃতকারী মৌলবাদ অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বর্তমান সময়ে মার্কসীয় দর্শনকে অনুসরণ করার কথা বলা কিছু ব্যক্তিদের মধ্যে মানুষকে যন্ত্র হিসাবে ও একই ছাঁচে ফেলা আদর্শ একটি সত্তা হিসেবে ভাবার এবং ব্যবহার করার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেলেও, প্রকৃতপক্ষে এই দর্শনই মানুষকে তার সামগ্রিকতার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করার কথা বলে। মানুষের নিজের মধ্যে, পরস্পরের মধ্যে ও সমাজের সঙ্গে নিরস্তুর ঘটে চলা দ্বন্দ্ব ও মিলনের প্রক্রিয়া এই দর্শনের অন্যতম দিক। ‘যান্ত্রিক মার্কসবাদীরা’ বা ‘মার্ক্সিস্ট মৌলবাদীরা’ তাদের আচরণে এসব অস্বীকার করে। অধৈৰ্য, অসহিষ্ণু, সুবিধাবাদী এরাই মার্কসবাদের নামে সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি করে।
প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদই মানুষকে এক যন্ত্রে পরিণত করে। সাম্রাজ্যবাদী একচেটিয়া পুঁজি তার অস্তিত্বের স্বার্থে মানুষকে এক পণ্যক্রেতা, মুনাফাদাতা যন্ত্র হিসেবেই দেখে। মানুষ সম্পর্কে তার প্রধান বিচার্য কোন দেশের মানুষের মধ্যে বাজার ভাল, কারা বেশি মুনাফা দেবে। তার কাছে মানুষের স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তার স্বাধীন মূল্য ততটা নেই, যতটা আছে। এই স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তাকে কিভাবে পুঁজির স্বার্থে লাগানো যায় তার চিন্তাটি। ধর্মীয় মৌলবাদও যান্ত্রিকভাবে ধর্মানুসরণকে উৎসাহিত করে। একজন ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তি যান্ত্রিকভাবে সারা দিন রাত নানা ধর্মীয় আচার ও সংস্কারগত খুঁটিনাটি মেনে চলেন। তার একটু ব্যতিক্রম হলেই খুঁতখুঁতানি শুরু হয়। মৌলবাদ এর ওপর আরো রঙ চড়ায়। সে মানুষকে মানুষ হিসেবে না দেখে, একটি বিশেষ ধর্মপরিচয়ের অধীনস্থ হিসেবে বিচার করে। মানুষের স্বাধীন অস্তিত্ব তার কাছে মূল্যহীন। জন্মসূত্রে একজন হিন্দু বা মুসলিম কিভাবে চলবে, কিভাবে চিন্তা করবে, কি চোখে ভিন্নধর্মাবলম্বী প্রতিবেশীদের দেখবে তা ঠিক করে দেওয়ার ঠিকাদারি নেয় মৌলবাদ (ও সাম্প্রদায়িকতা)। একইভাবে সাম্রাজ্যবাদও ঠিকাদারি নেয়। তার অর্থনৈতিক উপনিবেশের মানুষরা কিভাবে চিন্তাভাবনা করবে, কিভাবে নাচ-গান করবে, তাদের ব্যক্তিত্ব কেমন হবে, তারা কি কেনাকাটা করবে, কি খেলে ভাল থাকবে, কি বানাবে ইত্যাদি সবকিছু ঠিক করে দেওয়ারও।
এগুলিকে পরিহার করে এবং প্রতি মানুষের স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্ৰ্যকে মর্যাদা দিয়ে চরম অর্থে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়তো বাস্তবত অসম্ভব। সম্প্রতি জানা আপেক্ষিকতার তত্ত্ব বা কোয়ান্টাম তত্ত্ব জাতীয় কিছু বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রকল্পের সামাজিক প্রয়োগ এ ব্যাপারে নতুনভাবে ভাবতেও হয়তো বাধ্য করবে। তবু আপাতত এই সমাজের জন্য চেষ্টা করাটাই বৈজ্ঞানিক ও সুস্থ ব্যাপার। অন্তত এই প্রচেষ্টা বৈষম্য ও শোষণকে নূনতম করবে, প্রতি মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রতিশ্রুতি পালন করবে। আর তা না করার অর্থ এই বৈষম্য বাড়তে দেওয়া এবং সাম্রাজ্যবাদ-মৌলবাদের হাতকে তথা শাসকশ্রেণীর হাতকে শক্ত হতে দেওয়া। পৃথিবীর কোন দুটি বট গাছের গড়ন, পাতার সংখ্যা ইত্যাদি হুবহু এক নয়। এই বৈচিত্র্য থাকলেও সবগুলিই বটগাছই বটে। একইভাবে দুটি মানুষের মধ্যেকার যে পার্থক্য তা বাহ্যিক, ও ততটা গুরুত্বপূর্ণও নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ণ এই সমগ্র মানবজাতির অন্যতম সদস্য হিসেবে তার পরিচয়টি। তাই আপাত কিছু বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা সত্ত্বেও সমগ্র মানবজাতির ঐক্য অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু তা অর্জন অদূরভবিষ্যতেও হবে কিনা সন্দেহ। তবু তার প্রচেষ্টাই বৈজ্ঞানিক, সুস্থ ও কাম্য। তা না করার অর্থ মানুষের মধ্যকার অনৈক্য, অবিশ্বাসকে বাড়তে দেওয়া। এবং তা করার অর্থ সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদের মত অপশক্তির বিরুদ্ধে নিরলস লড়াই করাও। সদা সত্য কথা বলিবো’-র মত নির্দেশ চরম অর্থে আজীবন মেনে চলা দুরূহ ও প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। তবু তাকেই অনুসরণীয় হিসেবে সামনে রাখাটাই কাম্য, তা না হলে মিথ্যারই বিপুল ব্যাপ্তি ঘটবে। একইভাবে চুড়াস্ত বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও ঐক্যবদ্ধ সমাজের লক্ষ্যই সামনে থাকাটা কাম্য-অন্যথায় অনৈক্য, বৈষম্য ও শোষণকেই বাড়তে দেওয়া হবে মাত্র। সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদ উভয়েই এই বৈষম্য, শোষণ ও অনৈক্যাকে উৎসাহিত করে। তাই অন্যান্য নানা সামাজিক অপশক্তি তথা গণশত্রুর মত তাদের উচ্ছেদের লক্ষ্যও সমস্ত সচেতন, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জীবনেরই একটি অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।