পৃথিবীর নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে একসময় মানুষ মার্কসীয় দর্শন তথা সাম্যবাদী-সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের সন্ধান পেয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে এই দর্শনই চরম সত্য, সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত এবং শতাধিক বছর। পরেও সে অপরিবর্তনীয়। মার্কসীয় দৰ্শন নিজেই এই মৌলবাদী মানসিকতার বিরোধী। কিন্তু ক্ৰমশঃ পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে এই ধরনের নানাবিধ দার্শনিক মতাদর্শের থেকে শিক্ষা নিয়ে কিভাবে জড়বাদ-ভোগবাদ-বৈষম্যবাদ-শোষণবাদের মোকাবিলা করার উপায় ও তত্ত্ব আবিষ্কার করা যাবে, সেই পথ অনুসন্ধানের বৈজ্ঞানিক চেতনাকেই দুর্বল ও বিকৃত করে দেয় সাম্রাজ্যবাদী প্রচার ও মৌলবাদী মানসিকতা। এখনো পর্যন্ত জানা তত্ত্বগুলির মধ্যে মার্কসীয় দর্শন জনগণের বৃহত্তম অংশের স্বাৰ্থবাহী বলে প্রতিষ্ঠিত এবং সাম্রাজ্যবাদ-মৌলবাদ মানুষের একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশের স্বাের্থবাহী বলে প্রমাণিত। তা সত্ত্বেও এখনকার পৃথিবীতে মানুষ ও তার সমাজ এই সাম্রাজ্যবাদী-মৌলবাদী মানসিকতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রস্তুত বলেই প্রতীয়মান হয়, যে কারণে এখনো এরা শক্তিশালী এবং একইসঙ্গে, প্রাসঙ্গিকভাবে, শক্তিশালী মানুষের হিংস্রতা, উগ্ৰপন্থা, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও অনৈক্যের মানসিকতা, অসহিষ্ণুতা এবং (পুজিবাদ প্রচারিত) ভোগবাদী বা (ধর্মাচরণের নামে) ভাববাদী মনোবৃত্তি। অন্যদিকে মানুষ এখনো যথাসম্ভব মার্কসীয় দৰ্শন বা এই ধরনের আরো বিকশিত যে মতাদর্শ মানুষকে শ্রেণীহীন, শোষণমুক্ত, মানবিক ঐক্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, তার জন্য প্রস্তুত নয়। পাশাপাশি বহু মানুষের মধ্যেই অসততা, শ্রমবিমুখতা, সুবিধাবাদী স্বার্থপরতা, ক্ষমতালিন্সা ইত্যাদি এখনো তীব্রভাবে রয়েছে, রয়েছে বহু বিচিত্র ধরনের স্বার্থগত, শ্রেণীগত ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব। এসবের প্রতিফলন ঘটে যারা এই মতাদর্শকে অনুসরণ করার কথা বলে তাদের বহুজনের আপাত বিচ্যুতি, ব্যর্থতা ও বিভ্রান্তির মধ্যে। এবং এই মতাদর্শকে প্রয়োগ করার ব্যবহারিক দিকগুলি সাময়িকভাবে ভেঙ্গে পড়ার মধ্য দিয়েও। ঐতিহাসিক নিয়মে আপনা থেকেই এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে-এমন নিয়তিবাদী, স্বতস্ফুৰ্ততানির্ভর মানসিকতা অবশ্যই বিপজ্জনক এবং অবশ্যই সচেতন প্ৰয়াসে ও সক্রিয় উদ্যোগে ছবিটিকে পাল্টানো দরকার। এই পাল্টানোর ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদ উভয়ের মূলোচ্ছেদ ঘটানো অন্যতম প্রাথমিক শর্ত।
এটি হয়তো ঠিক যে চরম অর্থে বৈষম্যহীন সমাজ কোনদিনই মানুষ অর্জন করতে পারে না। এর বড় একটি কারণ মানুষ যন্ত্র বা ছাঁচে গড়া কোন বস্তু নয়। মানুষ তার আবেগ ও আকাঙ্খা নিয়ে পরস্পরের থেকে পৃথক। এই পার্থক্যের পেছনে নার্ভকোষ থেকে শারীরিক নানা দিক তথা জীন-গত (genetic) কারণ যেমন রয়েছে, তেমনি আছে চতুষ্পপাশ্বের জাগতিক প্রতিফলন এবং বিগত বহু সহস্র বছরের বিচিত্র অভিজ্ঞতার পুরুষানুক্ৰমিক ধারাবাহিকতাও। এই ধারাবাহিকতার প্রতিফলন শুধু মানুষে মানুষে ঘটে না, তার ছোট বড় অজস্ৰ গোষ্ঠীর মধ্যেও ঘটেছে। এই বৈচিত্ৰ্য নিয়েই মানুষ ও তার সমাজ। এই বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে ও তার আবেগকে মূল্য না দিয়ে, মানুষকে যন্ত্রের মত একটি আরোপিত মত বা আদর্শকে অনুসরণ করায় বাধ্য করলে, এক সময় সে বিদ্রোহ করবেই। এইভাবেই যে দীর্ঘকালীন মানসিক ও সামাজিক প্রস্তুতি তাকে তার নানাবিধ শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার উপযোগী, স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলবে, সেই ধৈর্যশীল প্রক্রিয়া এড়িয়ে গিয়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ধর্ম–এদের উৎখাত করার প্রচেষ্টা একসময় ব্যর্থ হতে বাধ্য।
একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় ও প্রয়োজনে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ধর্মের সৃষ্টি। মানব সভ্যতার একটি বিশেষ পর্যায়ে উভয়ের বিপদ ও অপ্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে অনুভব করা যাচ্ছে। এটিও অনুভব করা যাচ্ছে যে, এ দুটি বস্তুগত ও মনোগত পদ্ধতিই সাম্রাজ্যবাদের মত ভয়াবহ ও মৌলবাদের মত বিপজ্জনক সামাজিক অপশক্তির জন্ম দিতে পারে এবং দিয়েছেও। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ধর্ম-এদের টিকিয়ে রেখে সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদ উভয়ের চূড়ান্ত মূলোচ্ছেদ করা ও পুনরাবির্ভাবকে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। মানুষের সভ্যতার যে পর্যায়ে এ দুটির অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদের আবির্ভাব ঘটে নি, সেই সময় মানুষ পেরিয়ে এসেছে বিগত শতাব্দীতেই। এখন তাদের বিদায়ের পালা। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মানুষের বিগত নৃত্যুনতম ৬-৭ হাজার বছরের অভ্যাসকে দুই-এক শত বছরে পুরোপুরি উচ্ছেদ করার চিন্তা কতটা বাস্তব সম্মত তা বিচার করা অতি গুরুত্বপূর্ণ। এটিও বিচার করার প্রয়োজন যে, বর্তমান পর্যায়ে এ দুটির সামাজিক উপযোগিতা, প্রয়োজনীয়তা ও মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা আরো কতটা রয়েছে। তাদের এই উপযোগিতা, প্রয়োজনীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যদি ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ধর্মের মূলোচ্ছেদ করার জঙ্গী আপোষহীন ও বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা চালানো হয়, তবে এই অকালবোধনের প্রতিক্রিয়ায় মানুষের মধ্যেই ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ধর্ম—উভয়কে আরো অন্ধভাবে আঁকড়ে ধরার প্রবণতা সৃষ্টি হতে বাধ্য এবং তা হচ্ছেও।