হিটলার কোনদিনই সরকারীভাবে চার্চ ত্যাগ করেননি। ক্যাথলিকরা অনেক বইকে নিষিদ্ধ করলেও (যেমন গ্যালিলেও-দের), কখনোই হিটলারের ‘মাইন কাম্পফ’ (Mein Kampf) এই নিষিদ্ধ তালিকায় ওঠেনি। অথচ গ্যালিলিওরা যখন একটি বৈজ্ঞানিক সত্যকে তুলে ধরেছিলেন, তখন মাইন ক্যাম্পফ’ ছিল জাতিভেদ ও হিংস্রতায় ভরা। হিটলার নিজেও স্বীকার করেছেন, তিনি ‘মার্কসীয় সন্ত্রাসবাদ’ ও ও ‘ধর্মীয় অনুশাসন’ থেকে শিক্ষাগ্ৰহণ করেছেন, তবে সবচেয়ে বেশি শিক্ষা পেয়েছেন ও উৎসাহিত হয়েছেন খৃস্টীয় গোষ্ঠীর থেকে (Jesuit Order থেকে)। নিজের উচ্চপদাধিকারী এস এস বাহিনীর সদস্যদের তিনি খুসন্ট সংঘ’ (Society of Jesus) নামে অভিহিত করতেন এবং অন্ধবিশ্বাস ও কঠোর শৃঙ্খলার ব্যাপারে শিক্ষা নিতে তাদের বিশেষ কিছু ধর্মগ্রন্থ (যেমন Spiritual Exercises of Ignatius of Loyola) পড়তে নির্দেশ দিতেন। এই শিক্ষায় শিক্ষিত নাৎসি প্রচার বিভাগীয় প্রধান গোয়েকেবলস একসময় মন্তব্য করেছিলেন, ‘চার্চ যদি কালো-কে সাদা বলে। তবে আমি তাইই বিশ্বাস করব।’ আরেক শীর্ষস্থানীয় নাৎসি নেতা হিমলার তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘যাই-ই ঘটুক না কেন আমি সবসময় ঈশ্বরকে ভালবাসব, তার কাছে প্রার্থনা করব, ক্যাথলিক চার্চের প্রতি বিশ্বস্ত থাকব এবং আমাকে যদি তার থেকে বহিষ্কারও করা হয়, তবু তাকে সমর্থন করে যাব।’ (Heinrich Himmer; Roger Manvel 3 H. Frankeal) (এছাড়া ‘The Psychopathic God, Rober G. L. Waite 44° ‘History of the SS, Graber ইত্যাদি)
ধর্মের মূল শিক্ষা অন্যকিছু বলে যতই বলা হোক না কেন, ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে যে অবৈজ্ঞানিক যুক্তিহীন মানসিকতা ও অন্ধ আনুগত্য সম্পৃক্তভাবে মিশে থাকে তা। এইভাবে ফ্যাসিবাদের সৃষ্টিকে উৎসাহিত করে, ধর্মের মৌলবাদী রূপান্তরে ভূমিকা পালন করে এবং ধর্মের গণবিরোধী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশও ঘটায়। আসলে বিশ্ব মানবতা, প্রেম, অহিংসা, সবার প্রতি সমদৃষ্টি ইত্যাদি জাতীয় ধর্মের এইসব তথাকথিত মূল শিক্ষা’-গুলি ঈশ্বর ও ধর্মের নাম না করেও অনায়াসে বলা যায় এবং সেটিই সুস্থ ও কাম্য ব্যাপার, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। তা না করে এগুলি ধর্মের নামে প্রচার করতে গিয়ে এই শিক্ষাগুলিকে প্রতিষ্ঠা করা তো যায়-ই নি, উপরন্তু মৌলবাদ ও ফ্যাসিবাদের মত অপশক্তিগুলির সৃষ্টিকেই উৎসাহিত করা হয়েছে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এই যুক্তিহীনতা ও অন্ধ আনুগত্য একনায়কতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদকে আমন্ত্রণ করে আনে। যেমন ভারতের বেশ কিছু লোক প্রয়াত রাজীব
উপাধিকারী এরা ব্যক্তিগতভাবে যাই-ই হোন না কেন, দেশের ও দেশের মানুষের স্বার্থে কোন সংগ্রামের ইতিহাস বা কোন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান যে তাদের নেই-তা স্পষ্ট। তবু ঈশ্বরের সামনে হামাগুড়ি দেওয়ার মত বা রাজার সামনে নতজানু হওয়ার মত এমন হাস্যকর উন্মাদের (যেন রাজনৈতিক জোকারের) দল এদেশে যথেষ্টই রয়েছে। অন্যদিকে শৃঙ্খলা রক্ষার নাম করে কিছু কিছু কমিউনিষ্ট নামধারী ‘ক্যাডারভিত্তিক’ রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের মধ্যেও এই ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা ও যুক্তিবুদ্ধিহীন আনুগত্যকে উৎসাহ দেওয়া হয়। একনায়কতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, স্বৈরতন্ত্র ইত্যাদি এদের ঘাড়ে চেপেই আবির্ভূত হয়, এরাই পরিস্থিতি বিশেষে নয়াফ্যাসিবাদ বা ধৰ্মীয় ও রাজনৈতিক মৌলবাদের ক্যাডারেও পরিণত হয়।
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় ১৯৪৫-এ অর্জিত হয়েছে বলে মনে করা গেলেও, তার সঙ্গী ও সস্তানেরা এখনো রয়েছে-ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে। এই সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদ সর্বত্র ও সর্বদা চেষ্টা করে জনসাধারণের উপর অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে। তার জন্য তারা বিশেষ ক্ষেত্রে নিজেদের সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে পরস্পরের হাতে হাত মেলাতেও প্রস্তুত। গণবিরোধী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য উভয়েই অনুভব করে যে অর্থনৈতিক আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে গেলে ধর্মমোহ একটি বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।(৪) এরজন্য তারা জনগণের সমস্ত বিপ্লবী প্রচেষ্টা এবং শোষণমুক্ত, শ্রেণীহীন বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে টুটি টিপে মেরে ফেলতে চায়। তার জন্য অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানা কৌশল তারা অবলম্বন করে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রসার ঘটিয়ে কিছু মানুষের আপাত স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টি করা যেমন এর একটি দিক, তেমনি নিজেদের ধর্মীয় ঐতিহ্যকে রক্ষা করে ধর্মীয় গোষ্ঠীগত স্বাতন্ত্র্য, জাতীয়তাবাদ ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতিও অন্য একটি দিক।
কিন্তু এর ফলে আপামর জনসাধারণের স্বাচ্ছন্দ্য আন্দেী অজিত হয় না, মাঝখান থেকে কিছু দেশ ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলির মত সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নয়া ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক দাসে পরিণত হয় এবং স্বদেশেরই ও স্বধর্মেরই কিছু শাসক-শোষকের অধীনে ক্ৰমশঃ বেড়ে চলা বৈষম্য, দারিদ্র্য ও সংকটের দিকে এগিয়ে যাওয়া হয়। এমনকি আমেরিকার মত অগ্রসর’ দেশের জনসাধারণের একটি বড় অংশই গৃহহীন, দরিদ্র, বেকার, অসহায় জীবনে ক্রমশ পতিত হয়। রমরমা ঘটে (অন্তত সাময়িকভাবে) শুধু সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধি বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থার (একচেটিয়া পুঁজির) ও কিছুটা তার প্রতিনিধি-কর্মচারীদেরও, কিন্তু উভয়ের চূড়ান্ত স্থায়িত্বও এই ব্যবস্থা দিতে অক্ষম। অন্যদিকে ধর্মীয় মৌলবাদীরা বিশেষ ধর্মের মূলভিত্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে যে ঐতিহ্যকে রক্ষা করার কথা বলে, তার ফলে মানুষে মানুষে সম্প্রীতিই বিনষ্ট হয় এবং কৃত্রিম বিভাজন বাড়ে মাত্র। কৃত্রিম ধর্মপরিচয়ের চেয়ে মানুষ হিসেবে নিজের ও অন্যের পরিচয়ই যে একমাত্র ও বড় পরিচয় ঐ বোধ সে ভুলিয়ে দেয়। বিজ্ঞানমনস্কতার পরিবর্তে ভাববাদী দর্শনের অন্ধকারে মানুষের মনকে নিমজ্জিত করে। সাম্রাজ্যবাদ মুনাফার তথা পণ্যবিক্রির স্বার্থে জড়বাদী ও ভোগবাদী মানসিকতায় ভুলিয়ে এবং ধর্মীয় মৌলবাদ জঙ্গী ভাববাদে নেশাগ্ৰস্ত করে মানুষকে ও তার সভ্যতাকে ক্রমশঃই এক বৃহৎ সংকটের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। উভয়েই মানুষকে তার প্রকৃত অবস্থান, সমস্যা, সমস্যার স্বরূপ ও তার সমাধানের উপায় সম্পর্কে সচেতন হতে অতি সক্রিয়ভাবে বাধা দেয়।