সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার সঙ্গে ধর্মীয় মৌলবাদের বন্ধুত্বের স্বাভাবিক প্রবণতাই রয়েছে এবং তার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে গণবিরোধী শ্রেণীস্বার্থ। (কিন্তু এই স্বার্থে ঘা লাগলে তারা পরস্পরের বিরোধিতা করতেও পিছপা হয় না।) তাই আমেরিকা ফান্ডামেন্টালিস্টরা রাষ্ট্রকে আরো সশস্ত্র করার দাবী জানায়, হিরোসিমা-নাগাসাকির উপর বোমাবর্ষণ বা ভিয়েতনাম যুদ্ধের বর্বরতায় অনুতপ্ত না হওয়া এই ধরনের মানসিকতারই একটি প্রকাশ। তাই বিলি গ্রাহামের মত ফান্ডামেন্টালিস্ট নেতৃত্ব টুমান-আইসেনহাওয়ার থেকে জনসন-নিক্সনের পরম সুহৃদ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে সেই দেশেই শ্ৰীবৃদ্ধি ঘটে অন্যান্য মৌলবাদীদের নানা সংগঠনেরও। যেমন ক্যালিফোর্নিয়ায় রয়েছে ‘ফেডারেশান অব হিন্দু অ্যাসোসিয়েশনস’। (এরা ১৯৯৫-এর ‘বর্ষসেরা হিন্দু বা ‘Hindu of the Year’ উপাধিতে সম্মানিত করেছে। পিতাম্বারা ও বাল থ্যাকারে-কে। পরের বছরের জন্য মনোনীতদের তালিকায় অন্যতম। নাম-উমা ভারতী ও টি এন শেষন।) আর মহেশযোগী থেকে প্রভুপাদ-অসংখ্য বদমায়েস ধর্মজীবীদের রমরমা বাজারের পরিবেশও ঐসব দেশই।
পোল্যান্ডের মত দেশ সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্ম তথা মৌলবাদের গাঁটছড়া বাঁধার আরেকটি উদাহরণ। একদা সে দেশ ছিল সমাজতন্ত্রের নামধারী কিন্তু অসমাজতান্ত্রিক। সমাজতন্ত্রের মুখোশপরা পোল্যান্ডে ধর্মের রমরমা শুরু হয়েছিল। ১৯৩৭ সালে সে দেশে পাদ্রীর সংখ্যা ছিল ৯৫৩০, কিন্তু ১৯৭০-এ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৩৭৬৫তে। চার্চের সংখ্যা ৫১২০ থেকে বেড়ো হয় ১১৭০৯। লক্ষ লক্ষ কপি ধর্মীয় বই ও পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এ সবই খৃস্টীয় মৌলবাদের পথ পরিষ্কার করছিল। পাশাপাশি অর্থনৈতিক ভাবেও তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক পোল্যান্ডে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ ঘটছিল। এসব কারণে ‘শেষ পর্যন্ত সেখানে ‘গণতন্ত্রের’ নামে সোভিয়েত সমর্থিত প্রতিবিপ্লবী সরকারকে হটিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অপর এক প্ৰতিবিপ্লবী সরকারী-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ক্যাথলিক চার্চের নিয়ন্ত্রণাধীন এক সরকার। কিন্তু এই সত্যটি গোপন করার জন্য সারা বিশ্ব জুড়ে সাম্রাজ্যবাদী প্রচার মাধ্যমসমূহ তাদের একনায়কত্বমূলক প্রচারণার মাধ্যমে এই পরিবর্তনকে ‘সমাজতন্ত্রের’ বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের বিরাট বিজয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এবং শ্রমিক সহ শ্রমজীবী জনগণের এক বিরাট অংশ এই প্রচারণার শিকার হয়ে অনেক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষ অবলম্বন করছে এবং সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ বলতে কিছু নেই এই ধারণার বশবতী হয়ে নিজেদের শ্রেণী স্বার্থের বিরোধিতায়, সাময়িকভাবে হলেও, নিযুক্ত হচ্ছে।’ (বদরুদ্দীন উমর, অনীক, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৯০) ফ্যাসিবাদের সঙ্গেও ধর্মের তথা ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির এমন গাঁটছড়া বাধা অস্বাভাবিক নয়। ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদ-সবাইয়ের জনবিরোধী চরিত্রের মিল তাদের অবস্থা বিশেষে পরস্পরের সুহৃদ করে তোলে। পোল্যান্ডকে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ধর্মের সহযোগী হওয়ার একটি প্রতীকী উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করা যায়। একইভাবে ইটালি ও জার্মানিতেও ফ্যাসিবাদের সঙ্গে ধর্মের এই সহযোগী ভূমিকার কথা জানা আছে। এখানে ধর্ম (ক্যাথলিক চাৰ্চ) একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার ভূমিকা পালন করে। আসলে এসব ক্ষেত্রেই ধর্ম বৃহত্তর অর্থের নিছক একটি বিশ্বাস নয়, সেটি শাসকশ্রেণীর একটি গণবিরোধী প্ৰতিষ্ঠানিক হাতিয়ার, যে হাতিয়ার মৌলবাদেরই রকমফের মাত্র।
ইটালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানে ও শক্তিশালী হওয়ার পেছনে ভ্যাটিকানের বিরাট ভূমিকা ছিল। ১৯২১-এ ভবিষ্যতের পোপ পিউস-১১ (Pius XI) মুসোলিনি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘মুসোলিনির মত একজনকে আমাদের খুব দরকার,–ঈশ্বরই (Providence) তাকে আমাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। উদার চিন্তার আচ্ছন্নতা থেকে তিনি সম্পূর্ণভাবে মুক্ত।’ ১৯২৩-এর জানুয়ারী মাসে রাষ্ট্রের ধর্মীয় (papal) সেক্রেটারী, কার্ডিন্যাল গ্যাসপেরি এই ফ্যাসিষ্ট নেতার সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করেন, যাতে তাঁর সঙ্গে একটি চুক্তিতে আসা যায়। গ্যাসপেরি মন্তব্য করেছিলেন, ‘এই মুসোলিনি। যদি কোনদিন পূর্ণ ক্ষমতায় আসে, তবে আমরা যা চাই সেটিই আমরা পেয়ে যাব।’ পোপ হওয়ার পরও পিউস-১১ মুসোলিনিকে সমর্থন করার জন্য ক্যাথলিক কেন্দ্রীয় দল (Catholic Centre Party)-র নেতাদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তিনি ঈশ্বর প্রেরিত ব্যক্তি।’
১৯২৯ সালে ভ্যাটিকান ইটালির ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে একটি চুক্তি (concordatঅর্থাৎ পোপ তথা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাষ্ট্রের চুক্তি) করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্ৰীয় ধর্ম হিসেবে রোমান ক্যাথলিক ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করা এবং এসবের ফলে সরকার থেকে চার্চ ১ কোটি ৯০ লক্ষ পাউন্ড অনুদানও পায়। প্রোটেস্টান্টদের মধ্যে গড়ে ওঠা আমেরিকান ফান্ডামেন্টালিজম-এর মত রোমান ক্যাথলিক গোষ্ঠীও যে একই ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তাতে কোন সন্দেহ নেই, যদিও ‘ফান্ডামেন্টালিস্ট’-এর ছাপ তার নেই, কিন্তু মৌলবাদী চরিত্রের প্রায় সবটুকুই রয়েছে। নাৎসি-জার্মানির তিন মুখ্য ফ্যাসিস্ট নেতৃত্ব—হিটলার, গোয়েকেবলস ও হিমলার-সবাই ছিল একনিষ্ঠ রোমান ক্যাথলিক। কঠোর যান্ত্রিক শৃঙ্খলা ও প্রশ্নহীন দ্বিধাহীন আনুগত্য ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদের টিকে থাকার প্রধান শর্ত। এ কারণেই রাষ্ট্ৰীয় স্বয়ং সংঘ বা জামাতে ইসলামী তাদের সংগঠনকে ‘ক্যাডার ভিত্তিক’ করে গড়ে তোলে এবং এদের কাজেকর্মে কথায় বার্তায় ফ্যাসিস্টদের ছায়া স্পষ্ট অনুভব করা যায়। এই একই বৈশিষ্ট্য ছিল নাৎসীদেরও। ধর্মীয় কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য, সত্যের তথা যুক্তির প্রতি সম্পূর্ণ অনীহা, আর অমানবিকতা-পোপের অধীন ক্যাথলিক ধর্মের এই ধরনের শিক্ষা হিটলাররাও পেয়েছে। ইট্ৰলির মত জার্মানিতেও প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের এই রূপ ফ্যাসিস্টদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে। এই কারণেই দেখা যায় জার্মানির পার্লামেন্টে (রাইখস্টাগ-এ) হিটলারকে যে একটি ভোটের গরিষ্ঠতায় একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা (dictatorial power) দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল ঐ ভোটটি (decisive vote) দিয়েছিল ক্যাথলিক সেন্টার পাটি। হিটলার ক্ষমতা পাওয়ার ছ’ মাসের মধ্যেই ১৯৩৩-এর ২০শে জুলাই, পোপ হিটলারের সঙ্গে চুক্তি (concordat) করেন।