সাভারকর একসময় বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছেন। কিন্তু ১৯২০-এর দশকে ও তার পর তিনি হিন্দুত্বের প্রধান তাত্ত্বিক প্রবক্তা ও হিন্দুমহাসভার নেতার ভূমিকাই মূলত পালন করেন। ১৯৪২-এর আন্দোলনের সময় বিভিন্ন পৌর ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠান, আইনসভা এবং বিভিন্ন চাকুরিতে মহাসভার সদস্যদের তিনি নিজ নিজ পদে অবিচলিত থেকে দৈনন্দিন কর্ম করে যেতে’ নির্দেশ দিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় তাঁর শ্লোগান ছিল ‘রাজনীতির হিন্দুকরণ ও হিন্দুধর্মের সামরিকীকরণ’। এর অর্থ দাঁড়ায় তীব্র মুসলিম বিরোধিতা ও বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতা। প্রকৃতপক্ষে ১৯৩৯ সালের অক্টোবর মাসে সাভারকার গোপনে ভাইসরয়কে বলেন যে, হিন্দুদের ও বৃটিশদের বন্ধু হওয়া উচিত এবং প্রস্তাব করেন যে কংগ্রেস মন্ত্রীসভাগুলি পদত্যাগ করলে হিন্দুমহাসভার কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে থাকা উচিত। (জোটল্যান্ডের প্রতি লিনলিথগো, ৭ অক্টোবর, ১৯৩৯)।
১৯২৯ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আর. এস. এস)-এর প্রধান কর্মধ্যক্ষ বা সংঘচালক হিসেবে মনোনীত হওয়া হেডগেওয়ার নিজে সত্যাগ্ৰহ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং কারাবরণ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৩০-৩১-এর আইন অমান্য আন্দোলনসহ অন্যান্য নানা আন্দোলনে আর এস এস-এর ভূমিকা নগন্য। ১৯৪০এর নাগপুরে অফিসারদের’ প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দিয়ে হেডগোওয়ার বলেছিলেন, ‘আমি আমার সামনে হিন্দুরাষ্ট্রের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ দেখতে পাচ্ছি।’ স্বাধীনতার চেয়ে এই হিন্দুরাষ্ট্রই ছিল তার প্রধান লক্ষ্য। তাই তার পরবর্তী সরসংঘচালক গোলওয়ালকর সমাজতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদ উভয়কেই এক করে ‘বিদেশী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং উই আর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড’ বইতে এই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নীরবই থেকেছেন। উল্টে তিনি বৃটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করে মন্তব্য করেছেন, ‘আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ এবং সর্বজনীন বিপদের তত্ত্ব থেকে আমাদের জাতিত্বের ধারণা তৈরী হয়েছে। এর ফলে আমাদের প্রকৃত হিন্দু জাতিত্বের ইতিবাচক অনুপ্রেরণা থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু আন্দোলনই নিছক বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। বৃটিশ বিরোধিতার সঙ্গে দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদকে সমার্থক করে দেখা হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, তার নেতৃবর্গ এবং সাধারণ মানুষের উপর এই প্রক্রিয়াশীল মতের প্রভাব সর্বনাশা হয়েছে।’
স্পষ্টতঃই এই হিন্দু মৌলবাদীদের কাছে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার চেয়ে হিন্দুজাতিত্ব বা হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তা সাম্রাজ্যবাদের হাত ধরে ও তার শোষণকে টিকিয়ে রেখে হলেও তাদের কিছু যায় আসে না।(৩) এবং এটিও আসলে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের শিক্ষারই ফল। অন্যান্য দেশের ইতিহাস বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ হিসেবে চিহ্নিত হলেও, বৃটিশরাই ভারতীয় ইতিহাসকে হিন্দুযুগ, মুসলিম যুগ, ও বৃটিশ যুগ (‘খৃষ্টান যুগ’ নয়) হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মুসলিম লীগ-এর জন্মের অনেক আগেই বৃটিশ শাসক স্যার হেনরি এলিয়ট ভারতের হিন্দু ও মুসলিমদের দুটি পৃথক জাতিসত্তা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মিল (Mill)-এর মত বৃটিশ ঐতিহাসিকেরা অবৈজ্ঞানিক ভাবে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভারতীয় ইতিহাসকে পূর্বোক্ত তিনভাগে বিভক্ত করে ‘হিন্দুযুগ’ ও ‘মুসলিম যুগ’-কে সাম্প্রদায়িক রঙে রাঙিয়ে দিয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে ও ঐ মানসিকতায় পরিশীলিত এইসব ঐতিহাসিকেরা হিন্দুদের সাধুসন্ন্যাসী ও মুসলিমদের অত্যাচারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অর্থনৈতিক শ্রেণীগত বিভেদ ও দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করে স্যার হেনরি এলিয়টের মত বৃটিশ শাসকরা এমনও মন্তব্য করেছেন যে, ‘… মুসলিমদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে হিন্দুদের হত্যা করা হয়েছে, হিন্দুদের ধর্মীয় মিছিল ও পূজা ইত্যাদিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, মূর্তি ভাঙ্গা হয়েছে, মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে, জোর করে ধর্মান্তরকরণ ও বিয়ে করা হয়েছে’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
সাম্রাজ্যবাদ তার স্বার্থে সর্বদা চেষ্টা করে। এইভাবে একপেশে, বিকৃত, আংশিক ইতিহাসকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে শাসিতদের বিভাজিত করতে এবং সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐক্যকে বিনষ্ট করতে। ভারতের হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদীরা এই সাম্রাজ্যবাদী প্রচারকেই লুফে নিয়েছে। কারণ তারাও শাসিত ও শোষিত জনগণকে ধর্মের মত একটি কৃত্রিম পরিচয়ে বিভাজিত করতে চায়। মানসিকতার এই ঐক্য কখনোই সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদকে পরস্পরের চরম বিরোধী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। আর তাই দেখা যায় বৃটিশ বিরোধী সত্যাগ্ৰহ আন্দোলন, ভারত ছাড় আন্দোলন, আজাদ হিন্দ ফৌজ ও তার বিচার, বোম্বাই-এর নৌবিদ্রোহকে কন্দ্র করে ১৯৪৫-৪৬-এর উত্থান ইত্যাদি কোনটিতেই কি আর এস এস কি মুসলিম লীগ কেউই নিজেদের জড়ায় নি, এবং এই সময় তারা নিজেদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেছে। পরোক্ষ বৃটিশ সহযোগিতার দ্বারা। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর বৃটিশরা যে অত্যাচারের বন্যা বইয়েছে, এইসব ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক তথা মৌলবাদী ‘দলগুলির উপর তার প্রায় কোন ছিটেই লাগে নি। উপরন্তু এদের সাম্প্রদায়িক আন্দোলনে বৃটিশবিরোধী সংগ্রামই দুর্বল ও বিভ্রান্ত হয়েছে। পাকিস্তানের জন্য জঙ্গী আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় হিন্দুরা আর এস এস-কে রক্ষাকর্তা হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে, এমন কি কংগ্রেসের একটি অংশের মধ্যেও এই মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলার মত মুসলিম অধূষিত এলাকায় বাম ও প্রগতিশীল শক্তিগুলি আর এস এস-এর উত্থান রোধ করতে পারলেও সারা দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এসময় এটি তার শক্তিবৃদ্ধিই ঘটিয়েছে। যুদ্ধের ঠিকাদারি ও বাড়তি মুনাফার ফলে সৃষ্টি হওয়া বণিক গোষ্ঠীর বড় অংশ তাদের অর্থের জোগানও দিয়ে গিয়েছেন।