কিন্তু শুরুর দিকের ইতিবাচক বুর্জেয়া মূল্যবোধগুলিও টিকে থাকে,–সেই মানবতা, গণতন্ত্র, তথাকথিত সমানাধিকার (আসলে তা বুর্জোয়াদের নিজেদের মধ্যেকার সমানাধিকার), ধর্ম ও ঈশ্বরকে অস্বীকার করার প্রবণতা তথা নাস্তিকতা, ধর্মকে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের স্তরে নিবদ্ধ রাখা ইত্যাদি। তবে পরিবর্তিত পরিবেশ পরিস্থিতেতে তাদের বিকৃতি ঘটে। এই বিকৃতি মূলত ঘটে। পুঁজিবাদের দ্বিতীয় স্তরে, তার সাম্রাজ্যবাদী রূপান্তরের কালে। টিকে থাকার মরীয়া চেষ্টায় সে সাংস্কৃতিক ও চেতনাগত বিকৃতি, হিংস্রতা ও বিকৃত যৌনতার মত নেতিবাচক প্রবৃত্তিকে উৎসাহিত করা, অপ্রয়োজনীয় পণ্যের বন্যা, নিত্যনতুন কৌশাল, চুক্তি, আগ্রাসন, ষড়যন্ত্র, রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বঁধানো বা ধর্মীয় মৌলবাদকে মদত দেওয়ার মত নানা অমানবিক অগণতান্ত্রিক ক্রিয়াকাণ্ডে লিপ্ত হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সামাজিক প্রয়োগের চেয়ে ক্রমাগত ব্যক্তিগত স্বার্থে তার প্রয়োগের অবশ্যম্ভাবী। পরিণামও তাই হতে বাধ্য।
বর্তমান সময়ে ধর্মও তার প্রাথমিক সারল্য, অসচেতন বিশ্বাস, ভালবাসা, উদারতা, মানবিকতা ইত্যাদি হারিয়ে ক্রমশঃ ক্রুর, অসহিষ্ণু, জনবিরোধী, অনৈক্য সৃষ্টিকারী ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিশেষ শ্রেণীর স্বার্থে ধর্মকে ক্ৰমাগত ব্যবহারের পরিণামও হয়তো তাই। এরই চূড়ান্ত একটি রূপ মৌলবাদ, যা ভিন্ন ধর্মের মানুষকে শত্রু বলে গণ্য করতে শেখায়, যা মানুষের মনকে’ প্ৰাচীন ও এখন অপ্রাসঙ্গিক পরিবেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়, রুদ্ধ করতে চায় আলোর দিকের অভিসারকে। আসলে ধর্মের এই বিবর্তন ঘটে বিশেষ শ্রেণীর হাতে, যারা নিজেদের বাঁচাতে শ্রেণীবিভাজনের চেয়ে ধর্মীয় বিভাজনকে ও বৈজ্ঞানিক দর্শনের পরিবর্তে ভাববাদী দর্শনকে তীব্রভাবে উপস্থাপিত করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমস্ত সুফল আত্মসাৎ করেও মৌলবাদীরা বৈজ্ঞানিক দর্শনকে অস্বীকার করে। এমন কি তাকে ব্যবহার করে ধর্মীয় মৌলবাদ প্রচারের জন্যও। (হাই-টেক মৌলবাদী প্রচার ও ধর্মপ্রচার!!) ধর্মীয় মৌলবাদ যেমন যান্ত্রিকভাবে বিজ্ঞানের প্রয়োগ ঘটায়, সাম্রাজ্যবাদও তেমনি বিজ্ঞানচেতনার চেয়ে বিজ্ঞানের মুনাফাদায়ী প্ৰযুক্তিকেই প্রধান গুরুত্ব দেয়।
এ কারণে উভয়ের সাধারণ শত্রু হচ্ছে বস্তুবাদী দর্শন, সমাজতন্ত্র ও কম্যুনিজম। ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ উভয়েই সর্বশক্তি দিয়ে, ছলেবলে কৌশলে তাকে প্রতিরোধ করতে চায়। উভয়ের শত্রু যখন এক, তখন তাদের নিজেদের মধ্যকার মিত্ৰতাও অস্বাভাবিক নয়। কমিউনিজমকে আটকাতে তাই পোল্যান্ডে খৃষ্টীয় ধর্মীয় মৌলবাদ মাথাচাড়া দেয়। এগুলি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরই আরব্ধ কাজ। তাকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার দায়িত্ব নেয়। ধর্মীয় মৌলবাদ। কিন্তু কখনো আবার পরিস্থিতি অনুযায়ী তারা পরস্পরের সাময়িক বিরোধী ভূমিকাও পালন করে, যেমন ঘটেছে। ইরানে কিংবা সম্প্রতি ভারতের মহারাষ্ট্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হলেও শিবসেনা-বিজেপির দ্বারা আমেরিকার এনরনের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করার মধ্য দিয়ে।
কমিউনিজম-এর তত্ত্ব যথার্থ কি যথার্থ নয়, কিংবা তার সম্পূর্ণতা ও বাস্তবতা কতখানি, এসব প্রশ্ন অবাস্তর। কিন্তু এটি সত্য যে, সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদ উভয়েরই কমিউনিজম বিরোধিতার প্রশ্নে কোন দোদুল্যমানতা নেই। সাময়িক ও সংকীর্ণ স্বার্থে কখনো মৌলবাদী শক্তিরা (যেমন মুসলিম লীগ বা বিজেপি) বামপন্থীদের সঙ্গে একদা আপোষ ও বাহ্যিক ঐক্য গড়লেও, তা কখনোই কমিউনিজমের সঙ্গে ঐক্য নয়, বরং তা কমিউনিজমের নামাবলী গায়ে চাপানো সুবিধাবাদীদের সঙ্গে অতি ভঙ্গুর এক জোট মাত্র। সাম্রাজ্যবাদের পক্ষেও এই সংকটাপন্ন সুবিধাবাদী বামপন্থীদের সঙ্গে আপোষ অসম্ভব নয়। তবে প্রায়শ প্রাথমিক উদ্যোগটা আসে। দ্বিতীয়দের কাছ থেকেই। আর উদারপন্থী বুর্জোয়ারা বামপন্থীদের সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক ঐক্য গড়তেই পারেন এবং ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা রুখতে ধর্মনিরপেক্ষ বুর্জেয়াগোষ্ঠীর সঙ্গে বামপন্থীদের এমন ঐক্য একটি সুস্থ ব্যাপারই।
ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ উভয়েই ভিত্তিমূলে কমিউনিজম বিরোধিতা করতে বাধ্য হয়, কারণ মতাদর্শগতভাবে এটি তাদের উভয়েরই অস্তিত্বের পক্ষে বিপজ্জনক। (আমেরিকার ফান্ডামেন্টালিস্টদের কাছে বিবর্তনবাদ বা ইয়োরোপের খৃস্টীয় ‘মৌলবাদীদের কাছে গালিলেও প্রমুখের বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণও একইভাবে বিপজ্জনক বলে প্রতীয়মান হয়েছে।) এই বিরোধিতার ক্ষেত্রে তারা সর্বাধিক আন্তরিক এবং কোন আপোষ করতে রাজী নয়। কিন্তু তাদের উভয়ের মধ্যে প্রয়োজনে আপোষ বা পরোক্ষ প্রশ্রয়ের ব্যাপার ঘটতে পারে। এর একটি পরিচয় পাওয়া যায়। ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে হিন্দু ও মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদী ও মৌলবাদীদের মধ্যে। এই মৌলবাদীরা ভিন্ন ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে (যারা তারই দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী ও বন্ধু ছিল) যতটা না সোচ্চার ছিল, তার অতি সামান্য অংশে সোচ্চার ছিল সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে। গান্ধীবাদী বা সন্ত্রাসবাদী যে পথেই হোক না কেন হিন্দু-মুসলিম-শিখ নির্বিশেষে বহু ধর্মবিশ্বাসী মানুষই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সাংগঠনিকভাবে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দল বা গোষ্ঠীগুলি সাধারণভাবে এর থেকে দূরে থেকেছে—তাদের প্রধান শত্রু ছিল সাম্রাজ্যবাদ নয়, ভিন্ন ধর্মের মানুষ।