ধৰ্মীয় মৌলবাদের মত সাম্রাজ্যবাদও এইভাবে যাদের শাসন ও শোষণ করা হবে তাদেরই মধ্যে নিজের অনুগৃহীত অনুগত বাহিনী তৈরী করে। কারণ এটি স্পষ্ট যে, শোষিত মানুষের একাংশই যদি তাদের সাহায্য করে তবে এই শাসন, শোষণ ও আধিপত্য নিশ্চিত দীর্ঘস্থায়িত্ব অর্জন করবে। কিন্তু ধর্মীয় মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা সাধারণ সরল ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের অসহায় ধর্মবিশ্বাসকে কাজে লাগায়—উৎসাহিত করে পিছিয়ে থাকা অবৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনাকে। আর সাম্রাজ্যবাদী একচেটিয়া পুঁজি কাজে লাগায় পিছিয়ে থাকা দেশের স্বচ্ছন্দ্যকামী মানুষদের উন্নততর চিস্তার আকাঙ্খা, শ্রম ও মেধাকে,—উৎসাহিত করে আত্মকেন্দ্রিকতা, যান্ত্রিকতা ও পরনির্ভরতাকে।
পুঁজিবাদের মুমূর্ষ অবস্থা যেমন সাম্রাজ্যবাদ, তেমনি ধর্মের বিপদগ্ৰস্ত, ক্ষয়িষ্ণু বা মুমূর্ষ অবস্থা ধর্মান্ধতাত, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদ। বিবর্তনবাদ থেকে বস্তুবাদী দর্শনের মত নানা বৈজ্ঞানিক মতাদর্শ এবং পরিবর্তিত উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্কের কারণে ঈশ্বরকেন্দ্ৰিক ধর্মের তথা ভাববাদী দর্শনের ভিত্তি কেঁপে ওঠে। তার আদিম ও প্রাচীনকালের প্রয়োজনীয়তাও কমে আসে (যখন ম্যাজিক ও ধর্মানুশাসন উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা পালন করত)। দলে দলে মানুষ ঈশ্বরবিশ্বাস ও ধর্মপরিচয় থেকে মুক্ত বলে নিজেদের ঘোষণা করতে থাকে। (বর্তমানে যেমন প্রায় ১১৫ কোটি পৃথিবীবাসী এই দলভুক্ত)। এ অবস্থায় ধর্ম নিজেকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ধর্মবিশ্বাসী ব্যক্তিদের ও ধর্মজীবী শ্রেণীর নিজস্ব সংকটের অসমাধান ব্যাপারটিতে ইন্ধন জোগায়। হিংস্র অন্ধভাবে ধর্মানুসরণের মধ্যে এই সংকটের সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে। তারা নিজ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে এক কাট্টা করে ভিন্ন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে মুক্তির পথ খোজে। তারা ধর্মের মূল অনুশাসন ও নিয়মনীতিকে ফিরিয়ে এনে আনন্দময় ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। ধর্মীয় মৌলবাদ শুধু ধর্মের এই মূলে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্খা নয়, তা ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার রসে জারিতও বটে। সাম্রাজ্যবাদ। এই ধর্মকেন্দ্রিক উন্মত্ততা ও বিপথগমনকে উৎসাহিত করে, কারণ সে অনুভব করে এর ফলে তার গায়ে অন্তত আচড়টি পড়বে না। পরিস্থিতি বিশেষে তাই ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ সাম্রাজ্যবাদের বড় প্রিয় বন্ধু, বড় আপন জন।
কিন্তু ধর্মের এই নাজেহাল অবস্থার পেছনে বুর্জেয়াদের তথা পুঁজিবাদের উদ্ভবই বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। শুরুর দিকে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা পুঁজিবাদ ও ঐ উপযোগী৷ উদার বুর্জেয়া মানসিকতাকে রুখতে সর্বশক্তি দিয়ে ধর্মকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে, কারণ তার অস্তিত্বের সঙ্গে ধর্ম ও ভাববাদ গভীরভাবে সংযুক্ত (এবং এখনকার ধর্মান্ধতা-সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদের মধ্যে তারই ধারাবাহিকতা বর্তমান)। পাশাপাশি পুঁজিবাদও তখন চেষ্টা করেছে ধর্মের ভাববাদী কুয়াশা সহ সামন্ততন্ত্রকে হটাতে। কারণ তার বিকাশের জন্য এই অবৈজ্ঞানিক ভাববাদী পরিমণ্ডল ছিল বাধাস্বরূপ। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার চেয়ে কম অনিশ্চয়তায় ভরা, কম প্রকৃতি নির্ভর এবং অনেক বেশি মনুষ্য-ও বিজ্ঞান-নির্ভর। তখন অলৌকিক শক্তির বা ধর্মীয় অনুশাসনের ভাবালুতার চেয়ে বাস্তববাদী, যুক্তিনির্ভর, বস্তুকেন্দ্ৰিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও মানসিকতার প্রয়োজন ছিল বেশি। তাই প্রয়োজন হয়েছিল নতুনতর আইনকানুন, রাষ্ট্ৰীয় ব্যবস্থা, মূল্যবোধ ও রীতিনীতির। বেদ-বাইবেলের চেয়ে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রিই তখন প্রধান পাঠ্য হয়ে ওঠে। দরিদ্রকে অন্নদান করে পুণ্য অর্জনের চেয়ে, তাদের চাকরি দিয়ে ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন বাড়ানো বেশি গুরুত্ব পেতে থাকে।
রেনেশাঁর ধারাবাহিকতায় যে আধুনিক জ্ঞান ও মানসিকতার বিকাশ ঘটে, তাতে প্ৰতিষ্ঠানিক ধর্মের চিরাচরিত অবস্থান ও ঐতিহ্যনির্ভর মূল্যবোধ-রীতিনীতির প্রতি এই আলোকিত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রশ্ন ও সন্দেহ জাগে। সৃষ্টি হয় বুর্জেয়া নাস্তিকতা, অধাৰ্মিকতা ও যুক্তিবাদ। এসবের প্রতিক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠানিক ধর্মকে বাঁচাতে খৃস্টীয় রিভাইভ্যালিজম বা ধর্মীয় পুনরভুত্থানবাদ ও ফান্ডামেন্টালিজম বা মৌলবাদের ও সৃষ্টি হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে ধমীর্য নানা রিফর্মেশান আন্দোলন,-পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ধর্মকে গ্রহণযোগ্য রূপে টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু পরবর্তীকালে বুর্জেয়ারা যখন নিজেরাই সংকটে পড়ে তথা পুঁজিবাদের ক্রম ঘনায়মান বিপদ অনুভূত হয়, তখন তাদের একাংশের মধ্যে আবার ধর্মকে ব্যবহার করার বা ধর্মে আশ্রয় নেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। সামন্ত প্ৰভুদের মত পুঁজিপতিরাও ক্রমশ অনুভব করল শ্রমিকদের মধ্যে ধর্ম ও ঈশ্বর বিশ্বাস গভীরভাবে টিকে থাকলে তাদের ক্ষোভ ও হতাশা অনেক কমে যায়, তাদের থেকে আনুগত্যও বেশি পাওয়া যায়। তাই জৈন ব্যবসায়ীরা বা বিড়লারা বিশাল মন্দির বানায় বা জিন্ডাল অ্যালুমিনিয়াম কোম্পানির ফ্যাকটরির মধ্যে মন্দির গড়ে ওঠে। আমেরিকাইংল্যাণ্ডে চার্চের পুনরায় রমরমা শুরু হয়। ব্যাপারটি প্রধানতঃ, ক্রমশ পরিস্ফুট হতে থাকা পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার অনিশ্চয়তা ও সংকটের প্রতিফলনও বটে। একজন পুঁজিপতির সর্বস্বাস্ত হওয়া, মুনাফা কমে যাওয়া, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া—এই ব্যবস্থায় এ সবের কোনটিই যে চূড়ান্তভাবে আটকানো সম্ভব নয় তা পরের দিকে ক্রমশ পরিষ্কার হয় (যেন প্রকৃতিনির্ভর কৃষি উৎপাদনের মত)। এই ব্যবস্থার এই যে অদেখা, অজানা, সামাজিক প্রতিকূল শক্তি, সেটিরও প্রতিফলন ঘটতে থাকে বুর্জেয়া, পুঁজিপতি এমনকি জনসাধারণের মধ্যেও—একদা যেমন ঘটেছিল অজ্ঞাত রহস্যময় প্রাকৃতিক প্রতিকূল শক্তির প্রতিফলনে অলৌকিক শক্তিকল্পনার সৃষ্টির সময়ে। এর ফলে বুর্জেয়া পুঁজিপতিরাও ধর্মে তার প্রাথমিক অনীহা ত্যাগ করে ধর্মশ্রিয়ী হতে থাকে। পাশাপাশি প্রকৃতিকে জয় করার ক্ষেত্রে এখনো মানুষের বিপুল অসম্পূর্ণতাও প্রতিফলিত হয় এই ধর্মাশ্রয়ের প্রক্রিয়াতে।