প্রাকৃতিক ও স্বকীয় কিছু কারণ আমেরিকার এই সম্পদের পেছনে হয়তো, ভূমিকা পালন করেছে, দরিদ্র দেশের মানুষের অযোগ্যতাও হয়তো তাদের দুরবস্থার পেছনে কিছু ভূমিকা পালন করে,-কিন্তু যখন এক ‘ধনী’ ‘দরিদ্রের’ উপর এই ‘প্রত্যক্ষ শক্তি প্রয়োগের’ নীতি গ্ৰহণ করে, তখন আর তা মানবিক থাকে না। অবশ্য এই মানবিকতা ও গণতন্ত্রের কথাবার্তা যে আসলে ভানমাত্র তা-ও স্বীকার করা হয়। যেমন প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এবং লাতিন আমেরিকায় কেন্যান-বৰ্ণিত আমেরিকান নীতির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ‘আমাদের কঁচামাল রক্ষা করা।’ কাদের হাত থেকে? এইসব দেশের জনসাধারণের হাত থেকে, যারাই আসলে ঐ কঁচামালের মালিক এবং গায়ের জোরে সাম্রাজ্যবাদ তাকে তাদের নিজেদের ‘কাচামাল’ হিসেবে গণ্য করে। আর এই রক্ষা করার কাজ কিভাবে হবে তার উত্তরও স্পষ্ট,–
‘চুড়ান্ত উত্তরটা অগ্ৰীতিকর হতে পারে, কিন্তু স্থানীয় সরকার দিয়ে পুলিশী নিপীড়নে আমাদের দ্বিধা করলে চলবে না।’ এই দ্বিধাহীন নিপীড়ন এখন দেশে দেশে। ঐ সময় (১৯৪৯-এর গোয়েন্দা রিপোর্টে) এও বলা হয়েছিল, কমিউনিষ্টদের কোনোভাবে বাধা না দিতে পারলে আমাদের এই কঁচামাল’ বিপন্ন হতে পারে। এও মনে রাখা দরকার, চল্লিশের দশকের ঐ সময়ে আমেরিকায় ফান্ডামেন্টালিস্টরাও চূড়ান্ত কমিউনিস্ট-বিরোধিতায় নেতৃত্ব দিচ্ছিল, এবং এই সময়ের পর কমিউনিজমএর প্রসার রেখা ও বিভিন্ন দেশে কঁচামাল রক্ষণ করা (একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে)–র মহান’ উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন চরম আকার ধারণ করে। —১৯৫০৫।৩-তে কোরিয়ায় মার্কিন আগ্রাসন, ১৯৫৪-তে গুয়াতেমালায় মার্কিন সামরিক অভিযান, ১৯৫৬-তে মিশরে ব্রিটেন-ফ্রান্স-ইজরায়েলের, ১৯৫০-তে জর্ডান ও লেবাননে মার্কিন ও ব্রিটেনের, ১৯৬০-৬২-তে কঙ্গোয়, ১৯৬১-তে কিউবায়, ১৯৬২তে সেনেগালে প্রেসিডেন্ট সেংঘর-কে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টা, ১৯৬৪-৭৫-এ ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন, ১৯৬৫-তে ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রে মার্কিন হস্তক্ষেপ, ১৯৬৯-৭৫-এ কম্বোডিয়া-লাওসে মার্কিন আগ্রাসন, ১৯৭৩-এ চিলিতে মার্কিন সমর্থনে গণতান্ত্রিক সরকারের পতন, ১৯৭৫-৭৬ ও ১৯৮১-তে অ্যাঙ্গোলায় আগ্রাসন, ১৯৮১-তে মোজাম্বিকে, ১৯৮৩-তে গ্রেনাডায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। তালিকা এখনো শেষ হয় নি।
এইভাবেই ১৯৬৫-তে ইন্দোনেশিয়ার একটি অভ্যুত্থানে আমেরিকা মদত দিয়েছিল। তাতে মারা যায় সাত লক্ষ মানুষ, যাঁদের অধিকাংশই ভূমিহীন কৃষক। কয়েক মাসের মধ্যেই দেশটি আমেরিকার ‘বিনিয়োগকারীদের স্বৰ্গে’ পরিণত হল। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর একটি প্রবন্ধে একে বলা হল ‘এশিয়ার আলো’। আমেরিকার বহু ‘বুদ্ধিজীবী’-ই এ কাজকে খুব বাহবা দিলেন। তাঁরা বললেন, ‘এই চমৎকার ঘটনাগুলি ভিয়েতনামে আমাদের নীতির প্রাজ্ঞতা প্রমাণ করে।’ নতুনতর কৌশলে, নতুন নতুন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তির মধ্য দিয়ে এমন আগ্রাসন এখনো অপ্রতিহত গতিতে চলছেই।
বৃহৎ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি এসবের নেতৃত্ব দেয়। আসলে তারা নিজেদের সংগঠন যে রাষ্ট্র তার মাধ্যমেই এই কাজ করে। তারা নিজেদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা চালায়। সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে বিশাল ক্ষমতাধর এই একচেটিয়া পুঁজি, যা নিজ দেশের বাজার শেষ করে ফেলে বাঁচার জন্য বাইরে থাবা বাড়ায়, যেন প্রাচীন রাজাবাদশার সাম্রাজ্য বাড়ানোর মত। তা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিপদগ্ৰস্ত ক্ষয়িষ্ণু বা মুমূর্ষ রূপ, বিপদে পড়ে ক্ষুদ্র পুঁজির উপর আর নির্ভরশীল হয়ে সে বাঁচতে পারছে। না। একদা প্রগতিশীল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এই রূপান্তর ঘটে বিশেষ শ্রেণীর হাত দিয়েই। এরা সংখ্যায় কম। কিন্তু তাদের ছত্ৰছায়ায় লালিত ও সুবিধাভোগী ব্যক্তির সংখ্যা বিপুল।
অর্থনৈতিক নয়াউপনিবেশবাদ আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। নিজের দেশের বাজার ফুরিয়ে যাওয়ার পর পুজিবাদ এইভাবে, এই রূপে বহির্বিশ্বের জনগণের মধ্য থেকে মুনাফা তথা পুঁজি সংগ্রহের জন্য সচেষ্ট হয়। এ করতে গিয়ে তাকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবেও আধিপত্য বা প্রভাব বিস্তুত করতে হয়। এর স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করতে বা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদকে মদত দিতেও সে পিছপা হয় না। আমেরিকায় ফান্ডামেন্টালিস্টদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টদের গভীর সখ্য কিংবা পোল্যান্ডে খৃস্টীয় মৌলবাদীদের সঙ্গে ‘গণতন্ত্রের’ প্রতিষ্ঠা এরই ফলশ্রুতি। এ ব্যাপারটিও পুঁজিবাদের করুণ সাংস্কৃতিক বা মননগত অসহায়তার পরিচয়। শুরুতে পুঁজিবাদের উদগত বুর্জোয়ারা ছিল উদার ও বৈজ্ঞানিক মানসিকতার অধিকারী। কিন্তু পরে তাদেরই নিজেদের বিপুল পণ্যবাহী জাহাজকে বাঁচাতে ধর্মের ঝালাই-ও লাগাতে হচ্ছে—যতদিন তা কাজ করে ততদিনই তাদের পক্ষে ব্যাপারটি মঙ্গলকর।
বাঁচার চেষ্টায় তাকে নয়াউপনিবেশে নিজেদের অনুগত এক গোষ্ঠীকেও তৈরী করতে হয়। নানা পুরস্কার, নানা ধরনের বৃত্তি ও অনুগ্রহ প্ৰদান, ভ্রমণ ও ভক্ষণ, সাংস্কৃতিক প্রভাব, আদিম প্রবৃত্তিকে সুড়সুড়ি দেওয়া আনন্দ ইত্যাদির মাধ্যমে তো বটেই,-শ্রেণীচেতনাহীন ও গণ বিচ্ছিন্ন বুর্জোয়া নাস্তিকতা, যান্ত্রিক যুক্তিবাদ, তথাকথিত গণতন্ত্র ও সমানাধিকার (যা প্রায়শঃ বাস্তবত নিজ শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যকার গণতন্ত্র ও সমানাধিকারে পর্যবসিত হয়), আপাত সেবাপরায়ণতা ও সেবামূলক কাজকর্ম, নানা সংস্কারবাদী ক্রিয়াকাণ্ড ইত্যাদি। আপাত মানবিক ও আপাত প্রগতিশীল (অন্তত সামন্ততান্ত্রিক বাতাবরণের পরিপ্রেক্ষিতে) নানা ভাবেও নিজেদের বন্ধুমনোভাবাপন্ন ও নিজেদের প্রতি সহানুভূতিশীল গোষ্ঠীর সৃষ্টি করে। এমনকি নিজেদের ক্ষমতার অস্তিত্ব বজায় রাখতে ও পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতির নাম করে, বিপদগ্ৰস্ত অবস্থায় তথাকথিত বামপন্থীরাও সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধি একচেটিয়া পুজিকে স্বদেশে আমন্ত্রণ করে আনে।