চিন্তার স্বাধীনতার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও রূপান্তর ঘটতে থাকে। দাসব্যবস্থার পরিপূর্ণদাসত্ব ও সমস্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রায় দাসত্বের অবস্থান থেকে নতুন উদ্ভূত শ্রমিক শ্রেণীকে নতুন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মুক্ত করে দেয়, যদিও তার হাতে উৎপাদন ব্যবস্থার উপাদানগুলির মালিকানা দেয় না, উৎপাদিত পণ্যাদির মালিকানাও নয়। এই নতুন ব্যবস্থা শ্রমিকের শ্রম স্বল্পমূল্যে ক্রয় করে নিয়ে মুনাফা বাড়ানোর জন্য তথা সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের জন্য সচেষ্ট থাকে। মুনাফা না বাড়লে পুঁজির বিকাশ ঘটবে না, পুঁজির বিকাশ না ঘটলে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাটাই ভেঙ্গে পড়বে।
গণতন্ত্র, মানবতা, চিন্তার স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত স্তরে ধর্মের প্রয়োগ, যুক্তিবাদী চিন্তা, বুর্জোয়া নাস্তিকতা ইত্যাদির মত নানা মানবিক মানসিকতার বিকাশের পাশাপাশি পুঁজিবাদী ব্যবস্থা একদিকে প্রয়োজনীয় ও ভোগ্য পণ্যের উৎপাদন বিপুলভাবে বাড়িয়ে তোলে,-অন্যদিকে অবাধ প্রতিযোগিতার পরিবেশ, পণ্যনির্ভরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্য ইত্যাদিরও জন্ম দিতে থাকে। এই ধরনের প্রতিযোগিতায় স্বাভাবিকভাবেই মুষ্টিমেয় দু’চারজনই সফল হতে পারে। বিপুল সংখ্যক মানুষের সাফল্য পুঁজির অতিবিভাজন ঘটায় তথা পুঁজিবাদী ব্যবস্থারই বিরোধী। যত দিন যায়, ততই এই ব্যবস্থা নিজের সৃষ্টি করা সমস্যার জলে আটকে যেতে থাকে। তার থেকে মুক্ত হতে সে নতুনতর কৌশলের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। পুঁজি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একসময় অবধারিতভাবে মুনাফার হার কমে যায়। এটি পুঁজিবাদের অস্তিত্বের ক্ষেত্রেই সংকটের সৃষ্টি করে। এই সংকট আরো বাড়িয়ে দেয় পুঁজিপ্রয়োগের অসামঞ্জস্যতা। পুঁজিবাদের মূল কথা হল ব্যক্তিগত মালিকানায় ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য উৎপাদন। ফলত যে যার সুবিধা ও পরিকাঠামো মত পণ্যের উৎপাদন করে। আর এর থেকে সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলা। তৃতীয়ত, অতি উৎপাদনের সংকট পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে। তারা মুনাফা (অর্থাৎ পরোক্ষ শোষণ) করতে করতে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতাই কমিয়ে দিতে থাকে। ফলে পণ্য আর আশানুরূপ বিক্রি হয় না, তাকে নষ্ট করে দিতে হয়। কিন্তু জনগণের মধ্যে বিনামূল্যে তা বিতরণ করে না, করলে পরবর্তী মুনাফার পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, পণ্যের দামও পড়ে যায়। এই অতি উৎপাদনের আরেকটি পরিণাম একের পর এক কারখানা বন্ধ করে দেওয়া। এর ফলে শ্রমিকরা চরম সংকটের মধ্যে পড়ে, বেকারত্ব বাড়ে, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা আরো কমে। সব মিলিয়ে একদিকে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মানুষের বিক্ষোভ ও জঙ্গী আন্দোলন যেমন শুরু হয়, তেমনি পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিই ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। এক সময় যে ব্যবস্থা মানুষের মনন ও অর্থনীতিকে বিকশিত করার প্রগতিশীল ভূমিকা নিয়েছিল, পরবর্তীকালে তা নিজের অস্তিত্বের স্বার্থে চুড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল গণবিরোধী ভূমিকা নিতে বাধ্য হয়। এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার সাম্রাজ্যবাদী হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে এবং ধর্মকেও নতুন করে ব্যবহার করার তথা ধর্মে আশ্রয় নেওয়ার মাধ্যমে।
সংকট থেকে বাঁচতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বহু গবেষণার মধ্য দিয়ে নতুন পথ হাতড়ে বেড়ায়। অন্যের পুঁজিকে যথেচ্ছ বাড়তে দেয় না, নিজের পুঁজির বিভাজন ঘটায় না, বড়জোর নিজ পরিবারের মধ্যে তাকে ভাগ করে। পুঁজিপতিরা পরস্পরের মধ্যে পরামর্শ করে ও বাজার-গবেষণা করে কারখানা খোলে। জনগণের মধ্যে নিত্যনতুন অনাবশ্যক পণ্যের প্রতি কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে (হরলিক্স-কমপ্লান না হলে বাচ্চার শরীর ভাল হবে না, লিপস্টিক-নেলপালিশ না ব্যবহার করলে সুন্দরী হওয়া যাবে না বা ব্যক্তিত্বের বিকাশ হবে না ইত্যাদি অজস্রভাবে)। এর জন্য তাকে হাজারো গবেষণা ও মিথ্যাচার, অর্ধসত্য কথা বলা, চতুর বিজ্ঞাপন, ব্যক্তিত্ব ও মানবতার নতুনতর সংজ্ঞা দেওয়া ইত্যাদির মত অজস্র কাজ করতে হয়।
পুঁজিবাদের প্রথম অবস্থা হচ্ছে অবাধ প্রতিযোগিতার কাল। কিন্তু এর ধারাবাহিকতায় এক সময় অবধারিতভাবে, দ্বিতীয় অবস্থায়, পুঁজির কেন্দ্রীভবন ঘটে তথা কিছু একচেটিয়া পুঁজির জন্ম হয়। ব্যক্তি মালিকানাধীন বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য সৃষ্টি হওয়া এই একচেটিয়া পুঁজি ক্রমশঃ নিজের অস্তিত্বের স্বার্থে বিশ্বের বাজার নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। দরিদ্র, পিছিয়ে থাকা দেশের স্বাধীন শিল্প বিকাশ ও অর্থনৈতিক প্রগতিকে প্রতিহত করে নিজেদের সুবিধাজনক শিল্প, পণ্য ও প্রক্রিয়া চাপিয়ে দিতে থাকে। তা করতে গিয়ে যুদ্ধ বাধাতে আর নিরপরাধ মানুষদের হত্যা করতেও তারা পিছপা হয় না।
এরই প্রতিফলন ঘটেছে, ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারীতে তৈরী পি পি এস-২৩ নামে আমেরিকার চরম গোপনীয় ঐ দলিলে, যেটিতে পররাষ্ট্র দপ্তরের জর্জ কেনান জানিয়েছিলেন, ‘পৃথিবীর ঐশ্বর্যের শতকরা ৫০ ভাগের মালিক আমরা, কিন্তু আমরা পৃথিবীর জনসংখ্যার মাত্র ৬.৩ ভাগ। এই অবস্থায় আমরা ঈর্ষা ও বিদ্বেষের লক্ষ্য না হয়ে পারি না। আমাদের সামনে মূল কাজ হল এমন একটা সম্পর্কের ছক খুঁজে বের করা, যার সাহায্যে আমাদের এই অসাম্যের অবস্থা জিইয়ে রাখা সম্ভব হবে। আমরা, বিশ্বের হিতসাধন কিংবা পরার্থপরতার ব্যয়ভার বহন করতে পারি এরকম চিন্তাধারা দিয়ে নিজেদের প্রতারণার কোন প্রয়োজন আমাদের নেই। মানবিক অধিকার, জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন এবং গণতান্ত্রিকরণ–এই সমস্ত অস্পষ্ট এবং অবাস্তব লক্ষ্য সম্পর্কে কথা বলা আমাদের বন্ধ করা উচিত। সেদিন আর বেশি দূরে নয় যখন আমাদের প্রত্যক্ষ শক্তি প্রয়োগের ধারণার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। তখন আদর্শবাদী বুলিতে আমরা যত কম বাধাপ্রাপ্ত হই ততই ভাল।’