পাশাপাশি অস্তুত হাজার আড়াই বছর আগে কিছু মানুষের বস্তুবাদী দার্শনিক উপলব্ধিও ঘটেছে। উপলব্ধি করা গেছে ঈশ্বর বিশ্বাস আর এই বিশ্বাসকে কেন্দ্ৰ করে গড়ে ওঠা ধর্ম ও তার অনুশাসনের অসারতা ও ফকির দিকগুলিও। কিন্তু তখন এগুলি মূলত ছিল উপলব্ধিই, যদিও তার সামাজিক ইতিবাচক কিছু দিকও অনুভব করা বা প্রমাণ করা সম্ভব ছিল। (যেমন পুরোহিতদের উচ্ছেদ ঘটিয়ে মানুষের উপর শোষণ ও অত্যাচার কমানো সম্ভব।) তা সত্ত্বেও উৎপাদন ব্যবস্থাকে পাল্টানো এবং ধর্মের ভিত্তিকে নাড়ানোর মত অবস্থা তার ছিল না, কারণ ঐ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানই তখনো মানুষের করায়ত্ত হয়নি। এই অজ্ঞানতার পরিবেশে মধ্যযুগীয় ধর্মীয় তাণ্ডব ও চূড়ান্ত শোষণভিত্তিক সমাজ হাতে হাত ধরে টিকে থেকেছে৷
কিন্তু মূলত ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দী থেকে দীর্ঘদিনের বন্ধ্যাত্বি কাটিয়ে মানুষ আবার যুগান্তকারী নানা আবিষ্কার ও জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছে। ব্যপারটি এখন থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে শেষ হওয়া নব্য প্রস্তর যুগের শেষ দু’হাজার বছরে মানুষের একের পর এক যুগান্তকারী নানা আবিষ্কারের সঙ্গে তুলনীয়, —যখন মানুষ মাটির জিনিষ তৈরী করা, লোহা ছাড়া অন্যান্য কিছু ধাতুর আবিষ্কার ও ব্যবহার, কৃত্রিম সেচ-ব্যবস্থা, নদীকে পোষ মানানো, চাকার আবিষ্কার, পাল তোলা নৌকার ব্যবহার, লাঙলের ব্যবহার, চাষের কাজে গবাদি পশুর ব্যবহার, আদিম পঞ্জিকার উদভাবন, সংখ্যার ব্যবহার, ইট আবিষ্কার করে তা দিয়ে ঘরবাড়ি বানানো, লেখার পদ্ধতি তথা আদিম লিপি-ইত্যাদির মত বৈপ্লবিক নানা আবিষ্কার করেছে। স্পষ্টতঃ এগুলি মানুষের জীবন, মনন, অর্থনীতি ও সমাজ সবকিছুকে প্রভাবিত করেছে। উৎপাদন বেড়েছে ও উদ্ধৃত্তি সম্পত্তির সৃষ্টি হয়েছে। তাকে রক্ষা করার জন্য শাসকের প্রয়োজন হয়েছে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজ সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু একসময় এই শ্রেণীবিভাজন তীব্র হওয়ার কারণে মানুষের চেতনাও দাস ব্যবস্থার মত দাসত্বে অভ্যস্ত হয়েছে। ফলে নব্যপ্রস্তর যুগের পরবর্তী ২০০০ বছরে (অর্থাৎ তথাকথিত সভ্যতা শুরুর তথা ঐতিহাসিক যুগ শুরু হওয়ার প্রথম ২০০০ বছরে) মানুষের চিস্তাচেতনায় এই দাসত্বের অনিবাৰ্য প্রতিক্রিয়ায় তার বিজ্ঞানচর্চাও অবরুদ্ধ হয়েছে। দেখা গেছে এই সময়ে মাত্র চারটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ঘটেছে, যেমন দশমিক পদ্ধতি (২০০০ খৃস্টপূর্বাব্দ), লোহার আবিষ্কার (১৪০০ খৃস্টপূর্বাব্দ), বর্ণমালার আবিষ্কার (১৩০০ খৃস্টপূর্বাব্দ) এবং পয়ঃপ্ৰণালীর আবিষ্কার (৭০০ খৃ খৃস্টপূর্বাব্দ)।
এবং প্রকৃতপক্ষে তারও পরবর্তী প্রায় ২০০০ বছর ধরে অর্থাৎ সমগ্ৰ মধ্যযুগ অব্দি এই অবৈজ্ঞানিক আচ্ছন্নতা ছিল। সামাজিকভাবে বিজ্ঞানচেতনার শূন্যতা পূরণ করতে এই আচ্ছন্নতন্ত্রর একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল ধর্ম। ভারত থেকে ইয়োরোপ পর্যন্ত ছিল একই চিত্র, যদিও সর্বত্রই কমবেশি কিছু বৈজ্ঞানিক কাজ ও গবেষণাও চলেছিল কিছু মানুষের স্বাভাবিক অনুসন্ধিৎসার প্রেরণায়। মধ্যযুগে খৃস্টান ইয়োরোপে ধর্মচৰ্চা ও ধর্মসাধনাই ছিল মানুষের জীবনের প্রধান কাজ। ভারতসহ অন্যান্য নানা দেশও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে এছবি আস্তে আস্তে পাল্টাতে থাকে। দীর্ঘদিনের জড়তা ও অন্ধত্বের প্রতিক্রিয়ায় হয়তো এক সময় কর্মচাঞ্চল্য ও আলোকের সৃষ্টি হয়। কিন্তু ধর্মের তথাকথিত রক্ষকেরা এই আলো-কেমোটেই যে সহজভাবে নেয়নি তা অজানা নয়। গ্যালিলিও গালিলি (১৫৬৪— ১৬৪২) বা জিওরদানো ব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০)-এর মত বৈজ্ঞানিক মানসিকতার লোকেদের উপর ধর্মীয় অত্যাচারের কথা সুবিদিত। এমনি ভাবেই ধর্মসংস্থার কর্তৃপক্ষীরা যান্ত্রিক ঘড়ির প্রচলনেরও বিরোধিতা করেছিল, কারণ তা হলে তাদের ঘোষণা করা খৃস্টান ধর্ম-মুহূর্তগুলি(২) ওলট-পালট হয়ে যেতে পারে। বিজ্ঞান চর্চার প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের এমন প্রতিরোধের ঘটনা ঘটেছে। (এখনো যেমন বলা হয় যে, ‘দু পাতা বিজ্ঞান পড়ে ধর্ম-ভগবান মানছে না’)
কিন্তু মধ্যযুগের শেষদিক থেকে একের পর এক অসংখ্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানুষের সমাজ, উৎপাদন ব্যবস্থা ও মননকে পাল্টাতে থাকে, কিংবা ধর্মান্ধতার প্রতিক্রিয়ায় মানুষের মধ্যে ক্রমশ বেড়ে ওঠা যুক্তিবোধ ও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার ফলেই এমন সব আবিষ্কার করা সম্ভব হয়। ১৪০০-১৬০০ সময়কাল-এটি এই আধুনিক বিজ্ঞানের আবির্ভাবের সময় তথা ইয়োরোপীয় রেনেশার (বা পুনর্জন্মের) কাল, যখন রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও ধর্মব্যবস্থা, জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্য চর্চা, শিল্পকলা ও ভাস্কর্য ইত্যাদি নানা মানবিক ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন ঘটে। (এবং তারই ধারাবাহিকতায় মানুষের জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চা তথা সত্যের প্রতি অনুসন্ধিৎসা এই বিংশ শতাব্দীতে বিশেষ তীব্ৰতা লাভ করেছে।)
এই রেনেশাঁর ফলে মধ্যযুগীয় পোপতন্ত্রের অবসানে জাতিগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হতে থাকে। সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও সম্পর্ক ক্রমশ ভেঙ্গে পড়তে থাকে, জন্ম হয় পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি। জন্ম হয় গোঁড়ামিমুক্ত বুর্জেয়া শ্রেণীরও এবং এটিও সুবিদিত, যে এই শ্রেণী প্ৰথমের দিকে ধর্মের বিরুদ্ধেই সোচ্চার ছিল। ধর্মীয় ক্ষেত্রেও রিফর্মেশান আন্দোলন শুরু হয়,-প্রোটেস্টান্টবাদ-উইজম-এর মত খৃস্ট ধর্মের বুর্জেয়া রূপের আবির্ভাব ঘটে। ধর্মকে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার বিরোধিতা করে তথা ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করে, তাকে শুধু ব্যক্তিগত বিশ্বাসের গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার মানসিকতা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এই রোনেশী-র ফলেই গণতন্ত্র ও মানবতার পুনর্জন্ম ঘটে।