বর্তমান পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে অর্থনৈতিক শাসনের (এবং পরোক্ষ রাজনৈতিক শাসনেরও) সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। সে অনায়াসে একটি দেশের অননুগত সরকারকে ফেলে দিতে পারে, পুরো অর্থনীতিকে কাজ করতে পারে, লক্ষ লক্ষ যুবক যুবতীর সাংস্কৃতিক চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধকে বিকৃত করে দিতে পারে, গাধার সামনে গাজর ঝোলানোর পদ্ধতিতে দরিদ্র দেশের হাজার হাজার মেধাবী ছাত্রছাত্রীকে ক্রীতদাসে পরিণত করতে পারে। এমনকি বাজার দখলের স্বার্থে বোমা মেরে কয়েক লক্ষ মানুষকে মুহূর্তের মধ্যে মেরেও ফেলতে পারে। স্পষ্টতঃই এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অ্যারিষ্টটল-ম্যাকিয়াভেলি-ভীষ্ম-মনু বা মহম্মদের শিক্ষাকে সে-ও তার স্বার্থে ব্যবহার করে। এ করতে গিয়ে সে যে সব সময় ধর্মীয় মৌলবাদী হয়ে ওঠে তা নয়, কিন্তু প্রয়োজনে ধর্মকে ব্যবহার করতে বা ধর্মীয় মৌলবাদীদের সাহায্য করতে সে পিছপা হয় না। তাই দেখা যায় ইরানে যখন ইসলামী মৌলবাদীরা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকা নেয় (যদিও সাময়িকভাবে ও নিজের স্বার্থেই), তখন পাকিস্থানের ইসলামী মৌলবাদীরা ঐ সুগ্ন্যুই মত নেয় বা আমেরিকার মৌলবাদীরা শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠে।
নব্যপ্রস্তর যুগের শেষ ১০০০ বছরে (অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় ৬ হাজার বছর আগে) ঐতিহাসিকভাবে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের সৃষ্টির সময় থেকে ঈশ্বর বিশ্বাস তথা ধর্মের এই শ্রেণী:স্বার্থে ব্যবহার শুরু হয়েছে। কিন্তু ঐ সময়, এবং তারো আগেকার সময়ে, ধর্ম ও ঈশ্বরবিশ্বাস বিভিন্ন মনুষ্যগোষ্ঠীর অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ ছিল। জাগরণ থেকে নিদ্রা ও তার মধ্যবর্তী সমস্ত দৈনন্দিন কাজে এই ধর্মীয় চেতনার ঐতিহ্য অনুসারী নির্দেশগুলি সম্পূক্তভাবে মিশে থাকত। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে বিভেদ থাকলেও এবং একই গোষ্ঠীর মধ্যে দায়িত্বের পার্থক্য থাকলেও, অর্থনৈতিক শ্রেণীর অনুপস্থিতির কারণে এই বিশ্বাসের শ্রেণীগত ব্যবহারও আদিম মানব সমাজে অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু গোষ্ঠীপতির সৃষ্টি, তাকে সাহায্যকারী পুরোহিত শ্রেণীর উদ্ভব এবং কিছু মানুষের হাতে উদ্ধৃত্ত সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে যে বৈষম্য ধীরে ধীরে, যেন অতি স্বাভাবিকভাবে সৃষ্টি হল, ঐ বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখতে ঐসব ব্যক্তিরা ধর্মীয়-ঐশ্বরিক বিশ্বাসকেও কাজে লাগাতে থাকে। নিজেদের প্রতি আনুগত্যকে ঐশ্বরিক নির্দেশ ও ইচ্ছা বলে প্রচার করেছে। যতদিন গেছে, ততই তা তীব্র হয়েছে। কিন্তু তারও পরোকার দীর্ঘ সময় ধরে এই ধর্মবিশ্বাসও কিছু মানুষের সামাজিক আন্দোলনে হাতিয়ারের ভূমিকা পালন করেছে। নতুন দার্শনিক উপলব্ধি, ধর্মের নামে পুরোহিততন্ত্র বা রাজতন্ত্রের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করা, মানবিক ঐক্য ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা, সামাজিক উৎপাদনে ও শিল্প-সাহিত্যে মানুষকে উৎসাহিত করার মত নানা ইতিবাচক কাজ ধর্মকে কেন্দ্র করে বা ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষ করেছে। কিন্তু কখনোই ধর্মের শ্রেণী:বহির্ভুত ব্যবহার হয় নি, তা হওয়া সম্ভবও নয়। শাসকশ্রেণী ধর্মকেও তার হাতিয়ার করেছে। আর শোষিত মানুষ তাকে ব্যবহার করেছে একটি অলীক অসহায় আশ্রয়স্থল হিসেবেও,-একটি মানসিক নেশার মত। আফিম যেমন কৃত্রিমভাবে রোগযন্ত্রণা বা ব্যথার অনুভূতি কমায়, কিন্তু মূল রোগটি সারায় না, তেমনি তারাও তাদের দৈনন্দিন জীবনের হতাশা, বঞ্চনা, ব্যর্থতা ও দুরবস্থার যন্ত্রণাকে ভুলে থাকতে ঈশ্বর ও ‘তাঁর’ ধর্মকে আঁকড়ে ধরেছে। কিন্তু এর ফলে এসব সমস্যার সমাধান তো ঘটেইনি, বরং বেড়েছে।
এই শ্রেণীর সৃষ্টি তথা ধর্মের শ্রেণীগত ব্যবহার অর্থনীতির সঙ্গেই যুক্ত। কৃষি পদ্ধতির আবিষ্কার, ব্যক্তিগত সম্পত্তির সৃষ্টি, শৃঙ্খলার স্বার্থে গোষ্ঠী ও গোষ্ঠীপতির উদ্ভব ইত্যাদি নানা কিছু এর পেছনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। আদিম উৎপাদন ব্যবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে দাস ব্যবস্থা, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মত সাধারণভাবে বিভক্ত করা অর্থনৈতিক ইতিহাসের প্রতিটি স্তরে ধর্ম ও তার ব্যবহারের রূপান্তর ঘটেছে। রূপান্তর ঘটেছে ধর্মীয় অনুশাসন, মূল্যবোধ ও নীতি বাক্যেরও। আদিমকালে মানুষ যখন শুধুমাত্ৰ ঐশ্বরিক শক্তির কাছে প্রার্থনাদি করেই নিজেদের উৎপাদন ও সম্পদ বৃদ্ধির চেষ্টা করেছে, দাসব্যবস্থা ও সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় এর রূপান্তর ঘটল দ্বিধাহীন আনুগত্যের মানসিকতা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। এই চরম আনুগত্য ঈশ্বর ও ধর্মের প্রতি যেমন তেমনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি ও ধর্মের রক্ষক হিসেবে প্রচারিত পুরোহিত ও রাজার প্রতিও তথা শাসকগোষ্ঠীর প্রতিও। এই মানসিকতা না থাকলে মুখ বুজে উৎপাদন বাড়ানো যায় না, এক স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের অধীনে তথাকথিত সামাজিক শৃঙ্খলাও বজায় রাখা যায় না। ভারতে যেমন দাসপ্রথা প্রচলিত না হয়েও চতুর্বর্ণ বিভাগের মধ্য দিয়ে শূদ্রদের সৃষ্টি করা হয়েছে, যারা সামাজিক ভাবেই দাস-গোষ্ঠী ও একান্ত অনুগত একটি শ্রেণী। প্রকৃতির উপর তথা এক অজ্ঞাত শক্তির উপর নির্ভরতা এই আনুগত্যের শক্তি জুগিয়েছে। (কিন্তু অবশ্যই প্রতিটি স্তরে নানা ভাঙ্গাগড়া ও টানাপোড়েনের সঙ্গে মানুষের নিজস্ব শ্রম, মেধা ও উদ্যমও মিশেছিল, সৃষ্টি হয়েছে নিত্য নতুন দ্বন্দ্ব।)