ধর্ম ও পুঁজিবাদ দুটিই এক সময় মানব সভ্যতার ইতিহাসের বিশেষ সময়ে জনস্বার্থবাহী, প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু মানুষের সমাজ ও জ্ঞানের বিকশিত পর্যায়ে তাদের প্রয়োজন ক্রমশ ফুরিয়ে আসে বা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের প্রাসঙ্গিকতা আর থাকে না। প্রয়োজন হয়ে পড়ে নতুনতর মতাদর্শের, যা ধর্ম ও পুঁজিবাদের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিয়ে তাদের সরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু ধর্ম ও পুঁজিবাদকে সম্বল করে যে কায়েমী স্বাৰ্থ তৈরী হয়ে যায়। তারা নিজেদের অস্তিত্বকে সুরক্ষিত করতে এগুলিকে টিকিয়ে রাখতে বদ্ধ পরিকর থাকে। এদের ঘিরে বিশ্বাস, নির্ভরতা ও অভ্যাসও বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে তৈরী হয়ে যায়। এরাও নতুনতর চিন্তা ও নতুনতর ব্যবস্থাকে স্বাগত জানাতে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে। এই দ্বিধার ও বদ্ধপরিকর ইচ্ছার চরম সাংগঠনিক বহিপ্রকাশ ঘটে ধর্ম ও পুঁজিবাদের বিকৃত ব্যবহার তথা মৌলবাদী সংগঠন ও সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। এবং উভয়েই উভয়ের সাহায্য নিতে পারে বা না-ও নিতে পারে। কিন্তু উভয়েই মানুষের সভ্যতাকে পিছিয়ে নিয়ে যেতে চায়,-ধর্মীয় মৌলবাদ মূলত তার মননকে, সাম্রাজ্যবাদ মূলত তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে, যদিও উভয় ক্ষেত্রেই উভয়ের প্রভাব থাকেই।
ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ। বর্তমানে মানুষের সামনে সবচেয়ে বড় দুটি বিপদ। প্রথমটি মানুষের মনকে আদিম প্রচীন মূল ধর্মীয় বাতাবরণে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে তার বিকাশ ও উত্তরণকে ব্যাহত করে সমস্ত প্ৰগতিশীল বৈজ্ঞানিক চিন্তাকে সক্রিয়ভাবে প্রতিহত করে এবং আরো বিপজ্জনক হল তা মানুষে মানুষে কৃত্রিমভাবে তীব্র বিভেদ সৃষ্টি করে। এই বিভেদ প্রতিহত না হলে তা হিংস্র৷ পারস্পরিক হানাহানিতে মানুষের ও তার সভ্যতার অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে সক্ষম। ধর্মপরিচয়ের মত সম্পূর্ণ কৃত্রিম ও আরোপিত একটি পরিচয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে নিজেরই মত আরেকটি মানুষকে ঘূণা করতে, শক্রতে পরিণত করতে, এমনকি হত্যা করতে উৎসাহিত করে ধর্মীয় মৌলবাদ। পাশাপাশি সে আপন ধর্মের শত্রুদেরও সুহৃদের মুখোশ পরায়। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ তার নেতৃত্ব দিলেও সরল ধর্মবিশ্বাসী বহু মানুষকে সে এই বিশ্বাসের কারণে তার চারপাশে জড়ো করে ফেলার ক্ষমতা রাখে।
অথচ এক সময় এই ধর্ম মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে শিখিয়েছে, সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে। (Religion কথাটিই এসেছে re-digare থেকে যার অর্থ পুনঃসংযুক্ত করা।) তখনকার সমাজ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তার প্রাসঙ্গিকতা ও উপযোগিতাও ছিল। কিন্তু সমাজে যতই শ্রেণীদ্বন্দ্ব বেড়েছে, ততই ধর্মের বিকৃত ব্যবহার তীব্রতর হয়েছে। শাসকগোষ্ঠী তাকে নিজের শাসন, শোষন ও অস্তিত্বের স্বার্থে মানুষকে ভুলিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে। এই শ্রেণীবিভক্ত ব্যবস্থার অনুসঙ্গ হিসেবে সৃষ্টি হওয়া ও টিকে থাকা নানা প্ৰতিষ্ঠানিক ধর্মকে তারা নিজেরাও অনুসরণ করেছে, কখনো নিছক নিজস্ব বিশ্বাসের কারণে, কখনো বা সচেতন ভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে। এ কারণেই অ্যারিস্টটল (জন্মঃ খৃ:পূ: ৩৮৪) তাঁর ‘Politics’-এ মন্তব্য করেছিলেন, ‘স্বেচ্ছাচারী শাসককে (অটোক্র্যাট) ধর্মের প্রতি অতিশয় আনুগত্য দেখাতেই হবে। কারণ জনগণ যদি তাকে ধাৰ্মিক বলে মনে করে তবে তার বেআইনি অত্যাচার, নিপীড়নকেও সহ্য করবে এবং তার বিরুদ্ধে সহজে বিদ্রোহও করবে না, কারণ তারা মনে করবে। তার পক্ষেই দেবতারা রয়েছে।’
তাঁর জন্মের প্রায় ১৮০০ বছর পরেও ছবিটা যে পাল্টায়নি, তা বোঝা যায় ম্যাকিয়াভেলি (জন্মঃ ১৪৬৯ খৃস্টাব্দী)-র মন্তব্যে (The Prince)-’রাজপুত্রের পক্ষে সমস্ত ভাল মানবিক গুণাবলী থাকা প্রয়োজন, অন্তত তাকে দেখে সে রকম গুণসম্পন্ন মনে হওয়া চাই, এবং সর্বোপরি, তাকে দেখে যেন পুণ্যবান, ধাৰ্মিক মনে হয়। তাতে যদি কেউ কেউ তাকে অন্যরকম দেখতে পায় তাহলেও তারা কিছু বলবে না.। জনগণের অধিকাংশই মনে করবে। যে সে একজন সম্মানিত ব্যক্তি, যদিও কোনো বিশ্বাসই সে করে না বা ধর্মের প্রতিও তার কোনো আস্থা নেই। তবুও সে শুধু সাধু ব্যক্তির ভান করেই চালিয়ে যাবে, কারণ তার জন্য তো কোনো মূল্যই দিতে হয় না। তদুপরি ধর্মানুষ্ঠান ও ধর্মযাজকদের প্রতি তার বিশেষ আগ্ৰহ দেখাতে হবে।’ (এইভাবে ধর্মের ভান করে মানুষকে প্রতারিত করা ও শাসন করার কৌশলের নির্দেশ সব ধর্মগ্রন্থেই আছে, হিন্দুদের মহাভারত, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্ৰ, মনুসংহিতা ইত্যাদিতে বটেই। বর্তমানের হিন্দু মৌলবাদীদের কাছে এইসব গ্ৰন্থ খুবই মূল্যবান’)
ধর্ম ও শাসকশ্রেণী এইভাবে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে গোলাম আজম-এর মত মুসলিম মৌলবাদী বা ডঃ মুরলীমনোহর যোশীর মত হিন্দু মৌলবাদীরা আদৌ ইসলাম বা হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী। কিনা বা কতটা বিশ্বাসী এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে। আসলে তারা এমন ভান করে যাতে তাদের ‘দেখে যেন পুণ্যবান, ধাৰ্মিক মনে হয়।’ নিক্সন থেকে রাজীব গান্ধী, বিল ক্লিন্টন থেকে নরসিমহা রাও—সবার ক্ষেত্রেই কথাটা হয়তো কমবেশি সত্যি। শাসন ও ধর্মের এই সম্পর্কের কারণেই হয়তো যুধিষ্ঠিরের মত খালি ‘ধর্ম ধৰ্ম’ করা অজঙ্গী শাসকের চেয়ে কৃষ্ণ বা রামের মত যাঁরা ধর্ম আর শাসনের মধ্যে ব্যালেন্স করেছিলেন, তাঁরাই হিন্দু মৌলবাদীদের কাছে বেশি প্রিয় ও কাছের লোক (যদি সত্যিই এরা কোন দিন থেকে থাকেন)।(১) ইসলামী মৌলবাদীদের কাছে একা হযরত মহম্মদই এ ব্যাপারে, একশ’ জনের কাজ করে দিয়েছেন।