(২) বিবর্তনবাদ’ কথাটি এখানে একটি পৃথক তত্ত্ব হিসেবে তো বটেই, মানুষের ক্রমশ বিকশিত বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির প্রতীকী হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে।
(৩) পশ্চিমবঙ্গের বহু মুসলিম বাঙালী রমণীই প্রতিবেশী হিন্দু মহিলাদের প্রভাবে দুর্গাপূজার সময় অনায়াসে পূজার নতুন শাড়ি কেনেন। গ্রামের মহররমের মেলায় হিন্দু শিশুরা হুটোপাটি করে আসে।
(৪) যেমন, মুসলিম লীগের ১৯৩৬-র সভাপতি ও শুরুর দিকের উদারপন্থী পর্যায়ের একজন প্রথম সারির নেতা, এস, ওয়াজির হাসান। তিনি ১৯৩৮-এর ফেব্রুয়ারীতে একটি চিঠিতে নেহেরুকে লিখেছিলেন, ‘কেবল মুসলমান-হিন্দুদের মধ্যেই নয়, মুসলমানদের নিজেদের মধ্যেও বিকৃতি, মিথ্যা এবং ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ প্রচার শুরু হয়েছিল গত অক্টোবরে মুসলিম লীগের লক্ষ্মৌ অধিবেশনের সভাপতির ভাষণ থেকে। দিনে দিনে সংখ্যালঘুদের অধিকারের মুখোশের আড়ালে সত্যের অপলাপ ও ধর্মীয় বিদ্বেষ আরো বেড়েই চলেছে।’
(৫) যেমন, যখন অন্য ধর্মের নাম না করেও, শুধু হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে বলা হয় যে, এটি পরমতসহিষ্ণু, সবচেয়ে উদার, এর মধ্যে নানা মত ও পথ মিলিত হয়ে এর এক বিশেষ বৃহত্তর রূপ দিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি, তখন স্বাভাবিকভাবেই এইসব কথার এই অর্থ দাঁড়ায় যে অন্যান্য ধর্ম এরকম পরমতসহিষ্ণু নয়,উদার নয়, নানামতের মিলনক্ষেত্ৰনয় ইত্যাদি। একইভাবে মুসলিমদের অনেকেইএমন কথা বলেন যে, ইসলামেই একমাত্রসাম্য ইত্যাদির কথা আছে, তখন তারও এমন সাম্প্রদায়িক অর্থ দাঁড়ায়।
(৬) আমেরিকায় ঈশ্বরবিশ্বাস ও ধর্মপরিচয় থেকে মুক্ত (atheist ও, nonreligious) ব্যক্তির সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬.৮ শতাংশ (১৯৮০ সালে)। অন্যদিকে মঙ্গোলিয়ায় তা ৬৫ শতাংশ (১৯৯০), উরুগুয়েতে ৩৫.১ শতাংশ (১৯৮০), জামাইকায় ১৭.৭ শতাংশ (১৯৮২), বুলগেরিয়ায় ৬৪.৫ শতাংশ (১৯৮২), ইটালিতে ১৬.২ (১৯৮০) ইত্যাদি। অন্যদিকে যেসব দেশে সমাজতন্ত্রের স্বপক্ষে ব্যাপক গণ আন্দোলন ঘটেছে, অন্তত যেসব দেশ সমাজতান্ত্রিক (বা কমিউনিস্ট) হিসেবে পরিচিত সে সব দেশে এ হার অনেক বেশি, যেমন চীনে ৭১.২ (১৯৮০), কিউবায় ৫৭.১ (১৯৮০), উত্তর কোরিয়ায় ৬৭.৯ (১৯৮০), আলবেনিয়ায় ৭৪.১ (১৯৮০) ইত্যাদি।
(৭) বিবেক দংশন নেই মার্কিনীদের।–হিরোসিমা-নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষেপের পঞ্চাশ বছর পরেও এই দুষ্কর্ম সঠিক হয়েছে বলে মনে করেন অধিকাংশ মার্কিন নাগরিক। সি বি এস নিউজ ও নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এক যৌথ সমীক্ষায় মার্কিনীদের এই অভিমতের কথা জানা গেছে। সমীক্ষার ফল প্ৰকাশ করা হয় সোমবার।
‘২৬ শতাংশ মার্কিন নাগরিক মনে করেন, ১৯৪৫ সালের ৬ই ও ৯ই আগস্ট হিরোসিমা-নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষেপের জন্য আমেরিকার ক্ষমা চাওয়া উচিত নয়। আর ৬৫ বছরের বেশি বয়স্কদের মধ্যে ৮৪ শতাংশই ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না’ বলে জানিয়েছেন।
‘সব মিলিয়ে ৫৮ শতাংশ মার্কিন নাগরিকের বিশ্বাস, এই দুই শহরকে ধ্বংস করা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা নৈতিকতার মানদণ্ডে বেঠিক কাজ হয় নি। যাদের বয়স ৬৫-এর উপরে তাদের মধ্যে ৬৮ শতাংশই এই মতের শরিক।
‘উল্লেখ্য, দশ বছর আগে অনুরূপ এক সমীক্ষার ফলাফলও ছিল একই। এবারের সমীক্ষাটি ২৩শ্রে থেকে ২৬শে জুলাই পর্যন্ত চালানো হয়েছিল।’ (গণশক্তি; ২৮,৯৫)। তবু আশার কথা আমেরিকাবাসীর বেশকিছু অংশই এইসব মতের শরিক নন। অর্থাৎ তাদের বিবেক দংশন আছে।
(৮) যেমন কয়েক দুশক আগেও ভাবা যেত না যে পৃথিবীর এক পঞ্চমুংশেরও বেশি মানুষ নিজেদের ঈশ্বরবিশ্বাসমুক্ত বা নাস্তিক (atheist) ও ধর্মপরিচয়মুক্ত (nonreligious) হিসেবে প্রকাশ্যে সাগর্বে ঘোষণা করবেন, সরকারিভাবে এই হিসাব নথিভুক্ত হবে এবং তাঁরা সম্মানের সঙ্গে ঘুরেও বেড়াবেন।
(৯) এবং একইভাবে হিন্দুদেরও। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক জানোয়ারেরা এরই সুযোগ নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু মানুষের শুভবুদ্ধি ধর্মকেন্দ্ৰিক এই পশুত্বকে প্রতিহত করতে সক্ষম। যেমন, ‘সিউড়ি, ৩ আগস্ট-বীরভূমের খয়রাশোল থানার লোকপুর গ্রামে একটি দুর্গামন্দিরের নাটমন্দিরে মঙ্গলবার রাত্রে দুষ্কৃতীর দল একটি গরুর কটা-মুণ্ডু রেখে যায়। কিন্তু বুধবার এলাকার হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষ মিলিতভাবে ওই ঘটনার প্রতিবাদে এক সম্প্রীতি-মিছিল বের করে ওই চক্রান্ত ভেস্তে দেয়। এদিন এলাকার দোকানপাটও বন্ধ রেখে চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে ‘ধিক্কার দিবস’ পালিত হয়।’ (আজিকাল; ৪-৮-৯৫) ধর্মনিষ্ঠা ও ধর্মান্ধতার মধ্যে, ধর্মের অসাম্প্রদায়িক ও সাম্প্রদায়িক প্রয়োগের মধ্যে এবং অমৌলবাদী ও মৌলবাদী রূপান্তরের মধ্যে মানুষের ধর্মবিশ্বাস দোদুল্যমান থাকে। কিন্তু সচেতন থাকলে ধর্মবিশ্বাসীরাও ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদকে যে প্রতিহত করতে পারেন, তা এই ধরনের আরো অসংখ্য ঘটনা থেকে স্পষ্ট।
৫. মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ
ধর্ম তার বিপন্ন অস্তিত্বের সময় নিজেকে টিকিয়ে রাখতে মৌলবাদের আশ্রয় নেয়। পুঁজিবাদ তার মুমূর্ষ অবস্থায় বেঁচে থাকার মরিয়া চেষ্টায় সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়। উভয়ের সৃষ্টির পেছনেই বিশেষ একটি শ্রেণীর বা তার একাংশের ভূমিকা প্রধান।