(৮) জনগণের বৃহদংশের সচেতনতা সৃষ্টি করা, আস্থা অর্জন করা ও সমস্যা সমাধান করার ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ-বামপন্থীদের ব্যর্থতা,
(৯) ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ধর্মান্ধতা-সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তির অস্তিত্ব ও প্ররোচনা এবং তাদের দ্বারা নিজেদের সামাজিক-অৰ্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে বলে বিশ্বাসের সৃষ্টি হওয়া,
(১০) জনগণের বৃহদংশের সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক তথা সুস্থ জীবন যাপনের নানা সমস্যাবলীর সমাধানে অক্ষম এবং বৈষম্যভিত্তিক, শোষণজীবী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী শাসকশ্রেণীর দ্বারা, জনগণের ধর্মবিশ্বাসকে ব্যবহার করে। তাদের বিভ্রান্ত করার জন্য তথা আত্মরক্ষার জন্য ষড়যন্ত্রমূলক কৌশল।
শাসকশ্রেণীর একাংশের এই ষড়যন্ত্রমূলক কৌশলই ধর্মীয় মৌলবাদের জন্ম দেয়। মানুষের হতাশা আর যুক্তিহীন ধর্মীয় আবেগ ও বিশ্বাস তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রাখে। বিকল্প বৈজ্ঞানিক মতাদর্শের অভাব বা ব্যর্থতা তার জন্য স্থান ছেড়ে দেয়। এই মৌলবাদ মানুষের সংগ্রামকে বিপথগামী করে। সংগ্রামী মানুষদের ধর্মের নামে বিভক্ত ও দুর্বল করে দিতে এবং মূল শত্রুর পরিবর্তে পরস্পরের মধ্যে হানাহানি করে শক্তিক্ষয় করতে প্ররোচিত করে। সমাজ ও তার সমস্যা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক উপলব্ধি অর্জনে বাধা দেয়। মন ও চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে অলীক ও কল্পিত ঈশ্বরে বিশ্বাসের দ্বারা এবং এই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানিক ধর্মে মোহের দ্বারা। বৈজ্ঞানিক মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে ও মানুষকে ভালবাসতে বাধা দেয়। এইভাবেই মৌলবাদ তার অবৈজ্ঞানিক, অমানবিক, প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র নিয়ে গণশত্রুদের অভিষেকের আয়োজন করে।
ধৰ্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা সচেতনভাবে সৃষ্টি করা একটি মানসিকতা তথা বিশেষ ধরনের আন্দোলনের প্রক্রিয়া। ঐশ্বরিক অলৌকিক শক্তির ও আত্মা জাতীয় কোন একটি কিছুর কল্পনা ও বিশ্বাস, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নানা বিধিনিষেধ ও সংস্কারের সৃষ্টি ইত্যাদির মত মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা জনগণের মধ্যে প্রায় সর্বজনীনভাবে ও স্বতঃস্ফুর্তভাবে সৃষ্টি হয় না। তাকে সক্রিয় উদ্যোগে সৃষ্টি করা হয়। সৃষ্টি করে স্বল্পসংখ্যক কায়েমী স্বার্থের সংকীর্ণ চিন্তার কিছু মানুষ। তারা তাকে ছড়িয়ে দেয় জনগণের মধ্যে। অবৈজ্ঞানিক মানসিকতা, যুক্তিহীন আবেগ, সুস্থ বিকল্পের অভাব, নিজস্ব হতাশা ও নানাধরনের বিভ্রান্তির কারণে জনগণের একাংশ তাকেই নিজের মুক্তির পথ ভেবে বসে। এই ভাবনা তাকে যখন সর্বনাশের দোরগোঁড়ায় দাঁড় করায়, তখন সে দেখে সে নিজের ভাইকে হত্যা করেছে, প্রতিবেশী বন্ধুকে পর করে দিয়েছে, সে নিজে আটকেছে আরো শক্তিশালী বাঁধনে। আর দেখে, ঐ দোর গোঁড়ার বহু দূরে সব মৌলবাদীরা পরস্পরের কঁধে হাত দিয়ে এই বাঁধন হাতে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
——————
(১)এই যুক্তিবোধহীন অবৈজ্ঞানিক অন্ধবিশ্বাস হচ্ছে ধর্মান্ধতাত তথা ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবাদী মানসিকতার সৃষ্টি ও টিকে থাকার একটি বড় ভিত্তি। ১৯৯৫ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর একেই মূলধন করে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা সম্ভবত তাদের পরিকল্পিত এক ভয়াবহ ভবিষ্যৎ ষড়যন্ত্রের রিহার্সেল করে; সারা ভারতে ও ভারতের বাইরেও তারা সুকৌশলে রটিয়ে দেয় যে, গণেশ মূর্তি (এবং শিব, দুৰ্গা ইত্যাদির মূর্তিও) ভক্তদের দেওয়া দুধ পান করছে। লক্ষ লক্ষ সরল ধর্মবিশ্বাসী ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ এর ফলে দলে দলে বাড়িতে বা মন্দিরে ঐ সব মূর্তিকে দুধ খাওয়াতে থাকে এবং সারা ভারত জুড়ে আচমকা এক গণউন্মাদনার সৃষ্টি হয়। আমেরিকা-ইংল্যাণ্ডের মন্দিরেও তার খামতি ছিল না। ব্যাপারটি যে সুপরিকল্পিতভাবে প্রচারিত একটি গুজব ও রটনা, তা বোঝার জন্য শুধু এটি বোঝাই যথেষ্ট যে, অতি অল্প সময়ে এমন গুজব ছড়িয়েছে প্রধানত শহরাঞ্চলে যেখানে এস টি ডি করে টেলিফোনে এমন গুজব ছড়ানো গেছে বা গুজব ছড়ানোর নির্দেশ দেওয়া গেছে। গ্রামের লোকেরা বেশি কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে ধারণা থাকলেও, সেখানে এই উন্মাদনা ছড়ায়নি। গণেশের গুড়ই হোক বা ছাগলমূর্তির পা-ই হোক,-দুধ, মদ, সাবান জুলি, কেরোসিন তেল ইত্যাদি, তরলের পৃষ্ঠটান (surface tension) & Kirrtt isfits first (Capiliary action)-এর জন্য এই তরলসহ চামচ ওখানে ঠেকালে সেটি আস্তে আস্তে বেয়ে যায়। এতে অলৌকিকতার কোন ব্যাপার নেই। কিন্তু বিশ্বহিন্দু পরিষদ সহ নানা হিন্দুত্ববাদী ও হিন্দুমৌলবাদী গোষ্ঠীই এটিকে দৈবী ব্যাপার বলে এবং আগামী শতাব্দী যে ‘হিন্দু শতাব্দী’ হতে যাচ্ছে তার লক্ষণ বলে অভিহিত করেছে। (এশিয়ান এজ, আনন্দবাজার পত্রিকা ইত্যাদি; ২২৯.৯৫) সব দেখে শুনে মনে হয় ব্যাপারটি মৌলবাদীদের একটি সুপরিকল্পিত কর্মসূচীর অঙ্গ। কত তাড়াতাড়ি তারা দেশ জুড়ে যুক্তিবোধহীন ও ধর্মবিশ্বাসী অসংখ্য মানুষকে (হিন্দুদের) উন্মত্ত করে তুলতে পারে,-যথাসম্ভব তা যাচাই করার জন্যই গণ উন্মাদনার সৃষ্টি।
এইভাবে ভবিষ্যতে কোন একদিন যদি তারা হঠাৎ দেশজুড়ে রটিয়ে দেয় যে, মথুরা বা অযোধ্যায় কয়েক শত হিন্দুকে মুসলমানরা মেরে ফেলেছে (এবং তা জোরদার করতে কিছু দরিদ্র বস্তিবাসী হিন্দুকে তারা মেরেও ফেলতে পারে) তবে ভয়াবহ মুসলিম নিধন ও তার প্রতিক্রিয়ায় উন্মত্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো সম্ভব হবে। ২১শে সেপ্টেম্বর যারা দুধ ভরা চামচ নিয়ে গণেশ মূর্তির দিকে ছুটেছিল, তারাই তখন কোন যুক্ত বা তথ্যের ধারে কাছে না গিয়ে, কোনকিছু তলিয়ে না দেখে, ছুরি হাতে প্রতিবেশী মুসলিমদেৱ দিকে ছুটে যাবে। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হিন্দুমৌলবাদীদের পরিকল্পিত জঙ্গী লড়াই-এর রিহার্সেল হল না তো ঐ গণেশের দুধ খাওয়ার গণ উন্মাদনার সৃষ্টি?