ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদীরা যেমন আপনি সম্প্রদায়ের বা ধর্মের সবার স্বার্থ সমান করে দেয় (অন্তত প্রচারের ক্ষেত্রে) এবং ভিন্ন সম্প্রদায় বা ধর্মের সবাইকে শত্রুর পর্যায়ে ফেলে দেয়, এই রাজনৈতিক দলবাজাদের বৃহদংশও তাই করে। ভিন্ন রাজনৈতিক দলের উপযুক্ত দাবিগুলিও তাদের কাছে মর্যাদা পায় না। ধর্মের নাম করে মানুষে মানুষে যখন এই অসুস্থ বিভেদ সৃষ্টি হয়, তখন বুদ্ধ-মহাবীরচৈতন্য-নানক বা রামকৃষ্ণের মত বহু ধর্মীয় নেতাই মানবিক সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন। একইভাবে মার্কস বা গান্ধীর মত রাজনৈতিক মতাদর্শের বহু প্ৰবক্তাও কখনো এটি বলেন না যে, তাকে কেন্দ্র করে একটি সংকীর্ণ গোষ্ঠীবদ্ধতার সৃষ্টি হোক। তবু ধর্ম এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের এমন বিকৃত ব্যবহার ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক মৌলবাদীরা করে যায়। ধর্মীয় মৌলবাদীরা ধর্মের বিতর্কিত সুবিধাজনক মূল দিকগুলিকে সময়োপযোগী না হলেও আপনি শ্রেণীস্বার্থে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। রাজনৈতিক মৌলবাদীরাও একইভাবে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শকে সময়ের সঙ্গে পরিমার্জিত না করে হুবহু প্রয়োগ করে চলে এবং তার থেকে খুঁটিনাটি বিচ্যুতিতে গেল গেল’ রব তোলে। ধর্মীয় মৌলবাদীরা রাম বা কৃষ্ণের মত এক একটি চরিত্রকে বেছে নিয়ে অন্ধভাবে তার মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠায় নামে, রাজনৈতিক মৌলবাদীরাও মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্টালিন-মাওসেতুং (-শিবদাস ঘোষ)-মহাত্মা গান্ধী (ইন্দিরা গান্ধী-রাজীব গান্ধী)-দের প্রতি অন্ধ ব্যক্তিপূজা শুরু করে। এদের কোন ধরনের সমালোচনাকেই প্রতিক্রিয়াশীলতা বা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মেরুর অন্তর্ভুক্ত বলে ছাপ মেরে দেওয়া হয়। একইভাবে ধর্মীয় মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিরাও ধর্মের খুঁটিনাটি বিচ্যুতিতেই ‘ধম বিপন্ন’ বলে আওয়াজ তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাই মসজিদের সামনে শুয়োর মেরে রেখে এই ধরনের মুসলিমদের ক্ষেপিয়ে দেওয়া যায়(৯) আর মহরমের মিছিলে এই ধরনের হিন্দুদের গা কসকস করতে থাকে। রাজনৈতিক দলবাজি করতে করতে এই ধরনের অমানবিক বিভেদ সৃষ্টি, বৈরিতা, সংকীর্ণতা ইত্যাদির চর্চা যখন চলে তখন ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা একই কর্মপদ্ধতি চালিয়ে খুব একটা নিন্দাৰ্থ হয়ে ওঠে না। সরল ধর্মবিশ্বাসী মানুষ দেখে ধর্মীয় এইসব লোকেরা অন্তত তার ধর্মবিশ্বাসকে মর্যাদা’ দেয়, ধর্মীয় গোষ্ঠীর স্বাৰ্থ রক্ষায় ‘প্ৰাণপাত’ করে। ঐসব শ্রেণীভিত্তি, অর্থনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণের মত বড়বড় বিচারের চেয়ে কাজকর্ম ও মানসিকতার এই বাহ্যিক সাদৃশ্যও অনেক মানুষকে রাজনৈতিক মৌলবাদীদের কোল থেকে ধর্মীয় মৌলবাদীদের কোলে ঠেলে দেয় এবং ধর্মীয় মৌলবাদীদের গ্রহণীয় করে তোলে।
সংকটাপন্ন অস্তিত্বের অনুভব ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। এই সংকট নতুন মতাদর্শের কারণে হতে পারে—আমেরিকায় যেমন ফান্ডামেন্টালিজম-এর সৃষ্টি হয়েছিল প্রাথমিকভাবে খৃস্টের অভ্যুত্থান জাতীয় ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন মিলেনারিয়ান আন্দোলনের স্তর পেরিয়ে বিবর্তনবাদ ও কম্যুনিজমকে ধর্মের অস্তিত্ব বিপন্নকারী হিসেবে অনুভব করে। এই মতাদর্শগত বিপন্নতার প্রতিফলন ঘটে সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও যখন সামন্তশ্রেণী এবং বিশেষত বুর্জোয়া শ্রেণী তাদের শ্রেণীগত সংকট অনুভব করতে থাকে। তাই ফরাসী বিপ্লবের আগে যে প্রগতিশীল বুর্জেয়ারা ধর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, তারাই পরে ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করে। হিন্দু ও ইসলামী মৌলবাদীদের ক্ষেত্রেও এটি কম বেশি সত্য। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান যতই ধর্মকে কোণঠাসা করতে থাকে, ততই এরা মরিয়া হয়ে ওঠে। হিন্দু মৌলবাদীরা তাই কয়েক সহস্র বছরের পুরনো রামমাহাত্ম্যকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, বৈদিক শিক্ষাকে ফিরিয়ে আনতে চায়। মুসলিম মৌলবাদীরা ধর্মভিত্তিক মাদ্রাসা শিক্ষাকে জোরদার করে, হাজার দেড়েক বছরের পুরনো কোরান ও হাদিসকে হুবহু অনুসরণ করতে চায়।
সব মিলিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদের সৃষ্টি, টিকে থাকা ও পরিপুষ্টির জন্য কয়েকটি শর্তের কথা উল্লেখ করা যায়
(১) প্রাকৃতিক ও সামাজিক প্রতিকুল শক্তির কাছে মানুষের অসহায়তা এবং অসম্পূর্ণ জ্ঞান,
(২) যে ব্যবস্থার উপরিকাঠামো হিসেবে ধর্ম ও ঈশ্বরবিশ্বাস টিকে থাকে ঐ ব্যবস্থার অস্তিত্ব,
(৩) ধর্মের ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ করার মত বৈজ্ঞানিক তথ্য, চিস্তা ও আদর্শএর উদ্ভব, এবং তার প্রতি প্রতিক্রিয়া,
(৪) শাসকশ্রেণীর বিশেষ অংশের বিপন্নতাবোধ, এবং তাদের মধ্যে এই বিপন্নতা কাটানোর জন্য নিজেদের ও নিজেদের অধীনে অন্যদের সংগঠিত করতে ধর্মকে ব্যবহার করার প্রবণতা,
(৫) চারপাশে সুবিধাভোগী ধর্মবিশ্বাসী মধ্যশ্রেণীর অস্তিত্ব এবং তাদেরও নিজ স্বার্থের ও অস্তিত্বের সংকট,
(৬) ধর্মবিশ্বাসী বিপুল সংখ্যক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, যাদের বিভ্রান্ত করা যায় ও যারা নিজ ধর্মের স্বার্থে বিভ্রান্ত হতে প্ৰস্তুত এবং দীর্ঘকালীন সমস্যার কারণে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া হতাশা,
(৭) বৈজ্ঞানিক, ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা গণমুখী বামপন্থী আন্দোলনের অভাব বা দুর্বলতা,