“… তখন ব্রাহ্মণ তো কেবলমাত্ৰ যজন-যাজন অধ্যয়ন লইয়া ছিল না–মানুষের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করিয়াছিল। তাই ক্ষত্ৰিয়-প্ৰভু ও ব্রাহ্মণ-প্ৰভুতে সর্বদাই ঠেলা ঠেলি চলিত; বশিষ্ঠে বিশ্বামিত্রে আপস করিয়া থাকা শক্ত।’ (লড়াইয়ের মূল, কালান্তর; পৌষ ১৩২১)
“… মুষলধারে নামিল বেহার অঞ্চলে মুসলমানের প্রতি হিন্দুদের একটা হাঙ্গামা। অন্য দেশেও সাম্প্রদায়িক ঈর্ষাদ্বেষ লইয়া মাঝে মাঝে তুমুল দ্বন্দ্বের কথা শুনি। আমাদের দেশে যে বিরোধ বাধে সে ধর্ম লইয়া, যদিচ আমরা মুখে সর্বদাই বড়াই করিয়া থাকি যে, ধর্মবিষয়ে হিন্দুর উদারতার তুলনা জগতে কোথাও নাই।” (ছোটো ও বড়, কালান্তর; অগ্রহায়ণ, ১৩২৪)
“এ কি হল ধর্মের চেহারা? এই মোহমুগ্ধ ধর্মবিভীষিকার চেয়ে সোজাসুজি নাস্তিকতা অনেক ভালো। ঈশ্বরদ্রোহী পাশবিকতাকে ধর্মের নামাবলী পরালে যে কী বীভৎস হয়ে ওঠে তা চোখ খুলে একটু দেখলেই বেশ বোঝা যায়।” (৮ বৈশাখ, ১৩৩৩-এ শান্তিনিকেতনে দেওয়া ভাষণ)
‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মারে।”
কিংবা
“হে ধর্মরাজ ধর্মবিকার নাশি,
ধৰ্মমূঢ়জনেরে বাঁচাও আসি।” (পরিশেষ, রচনাকাল ১৯২৬)
রবীন্দ্রসৃষ্টির বিপুল ব্যাপ্তির মধ্যে মৌলবাদী মানসিকতা ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর প্রতি তীব্ৰ কাষাঘাতের চিহ্ন ছড়িয়ে আছে, যদিও তিনি ব্ৰহ্মা বা ঈশ্বর জাতীয় একটি অলীক মায়াময় সত্তায় গভীর বিশ্বাসও পোষণ করতেন। অবশ্যই এ তাঁর নিজস্ব বিশ্বাসের ব্যাপার; কিন্তু শুভবুদ্ধি, মনুষ্যত্ব ও মানবসভ্যতার মঙ্গলকর দিকের প্রতি তাঁর আন্তরিক আস্থা তাঁকে ধর্মের নামে এই ‘মোহমুগ্ধ ধর্মবিভীষিকার’ ও ‘পাশবিকতার’ বিরুদ্ধে সোচ্চার করেছে। তবু তাঁর এই বিশাল সৃষ্টিতে শেষ অদিও ‘মৌলবাদী বা ‘মৌলবাদী’ কথাগুলির আবির্ভাব ঘটে নি।
বিদ্যাসাগর থেকে শরৎচন্দ্র, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় থেকে রাজশেখর বসু-বহু মনীষীই বাংলাভাষায় উগ্র ধর্মান্ধত তথা মৌলবাদের বিরুদ্ধে, তাদের সংগ্রামের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এদের সাহিত্য ও সৃষ্টির মধ্যে ‘মৌলবাদ’ আসে নি। আর এসব কারণে এই কথাটিকেই এখনকার অনেক প্রবন্ধকার একটি ‘আধুনিক পরিভাষা’ হিসেবে গণ্য করতে শুরু করেছেন। যেমন–
“এই ‘এরা’ কারা? এরাই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘পৌরোহিত্য শক্তি’, আধুনিক পরিভাষায় ‘মৌলবাদী শক্তি’।”
কিংবা “রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মণ্যশক্তি সম্পর্কে আপন মনোভাব একটুও গোপন রাখেননি। যা বলার তা খোলাখুলি বলেছেন। যে ব্রাহ্মণদের কথা তিনি তুলে ধরেছেন, বিবাকেনন্দ, বৈদান্তিক সন্ন্যাসী হয়েও তাদের বললেন ‘কলির রাক্ষস’। বিবেকানন্দের প্রাসঙ্গিক অভিমতটি তুলে ধরি। ১৮৯২-এ বোম্বে থেকে জুনাগড়ের দেওয়ানকে লিখছেন—’দুষ্ট ও চতুর পুরুতরা (আধুনিক পরিভাষায় যারা মৌলবাদী শক্তি) যত সব অর্থহীন আচার ও ভাঁড়ামিগুলিকেই বেদের ও হিন্দুধর্মের সার বলে সাধারণ মানুষদের ঠকায়, শোষণ চালায়। মনে রাখবেন যে, এসব দুষ্টু পুরুতগুলো বা তাদের পিতৃপিতামহগণ গত চারপুরুষ ধরে একখণ্ড বেদও দেখেনি। সাধারণ মানুষরা উপায়ান্তর না দেখে পুরুতদের ধর্মাচরণের নির্দেশকে মেনে নেয়। এর ফলে তারা নিজেদের হীন করে ফেলে। কলির রাক্ষসরূপী ব্ৰাহ্মণদের কাছ থেকে ভগবান তাদের বাঁচান।’ এই মৌলবাদী শক্তিকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে বিদেশ থেকে বিবেকানন্দের আহ্বান এসে পৌঁছয় ভারতীয় যুবকদের কাছে–” ইত্যাদি (পশ্চিমবঙ্গ, রবীন্দ্রসংখ্যা, ১৪০২-এ তাপস বসুর প্রবন্ধ; বন্ধনীর মন্তব্য তাঁরই)
‘মৌলবাদ’ যে অধুনা প্রচলিত একটি শব্দ তা অন্যরাও স্বীকার করেন। ডঃ গৌতম নিয়োগী তার ‘ইতিহাস ও সাম্প্রদায়িকতা’ গ্রন্থে (১৯৯১) ‘মৌলবাদী’ ‘পুনরুজীবনবাদ’ ও ‘সাম্প্রদায়িকতা’ এই তিনটিকেই ‘অধুনা প্রচলিত শব্দ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। (পৃঃ ১৫)
এখন মৌলবাদ বা মৌলবাদী কথাগুলি ক্রমশঃ তার বিরল চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। সংবাদপত্রের প্রাসঙ্গিক প্রতিবেদনে তা একটি সাধারণ শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত তথা বিশ্বের নানা স্থানে হিন্দু মৌলবাদী-মুসলিম মৌলবাদীদের সাম্প্রতিক পরিবর্ধিত দাপট ও আস্ফালনকে কেন্দ্র করে যে শব্দ ব্যবহার শুরু হয়েছিল, তা গ্রামেগঞ্জের এমন মানসিকতার লোকেদের জন্যও ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন মুর্শিদাবাদের বাগড়ি ও নদীয়ার করিমগঞ্জ এলাকায় বাউল ফকির দরবেশদের উপর ধর্মীয় অত্যাচারের কথা বলতে গিয়ে এখন বলা হয় ‘মনের এই ভাবকে সিনায় রেখে যাঁরা বাউল সাধনায় জীবনযাপন করছেন, তাদের উপর নেমে এসেছে মৌলবাদীদের হুঙ্কার’ (আজকাল, ২৩ মে, ১৯৯৫); অমিতাভ সিরাজের প্রতিবেদন— “গান গেয়ে একঘরে, জল বন্ধ, জরিমানা”)।
ব্যাপারটা শুধু ভারত বলে নয়,–এই ধরনের মানসিকতা যাদের বা যে সংগঠনেরই আছে তাদের ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে শব্দটি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন, “ইংল্যাণ্ডের অনেক কলেজেই দানা বঁধছে ধর্মীয় উত্তেজনা : …রমজানকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের জেরে নাইজিরিয়ার এক কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্র মারা যান।… কলেজের ছাত্রদের সূত্রে জানা গিয়েছে সারা বিশ্বে ইসলামের অনন্ত প্রভুত্ব স্থাপনে বিশ্বাসী মৌলবাদী সংগঠন হিজব-উত-হাহরির-এর সমর্থক একদল পাক ছাত্রের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার পরই ছাত্রটি আক্রান্ত হন। … উল্লেখ্য, ইংলণ্ডের অধিকাংশ কলেজেই এই মৌলবাদী সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। …’ (আনন্দবাজার পত্রিকা ; ১৩ই মার্চ, ১৯৯৫)