মূল + ষ্ণ = মৌল ; এই সম্পর্কিত যে মানসিকতা বা মতবাদ আক্ষরিকভাবে তাই-ই মৌলবাদ। মৌল কথাটির অর্থ অনেকভাবেই দেওয়া হয়েছে অভিধানে। তার কয়েকটি হল মূল হইতে আগত, আদিম, প্রাচীন (মৌল আচার) ইত্যাদি। বিমলকৃষ্ণ মতিলাল তার ‘মৌলবাদ—কি ও কেন?’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘ফাণ্ডামেন্টালিজম’ এর বাংলা প্রতিশব্দ তৈরী করা হয়েছে–মৌলবাদ–একেবারে সংস্কৃত ঘেঁষা প্রতিশব্দ– ‘মূল’ থেকে ‘মৌল’। বন্ধু গায়ত্রী চক্রবতী-স্পিভাক বলেন ‘ভৈত্তিকতা’–’ফাণ্ডামেন্টালিজম’-এর প্রতিশব্দ হওয়া উচিত। ‘ভিত্তি’ অথবা ‘ফাউণ্ডেশান’ থেকে। আমি ‘মৌলবাদ’কে গ্ৰহণ করলাম।
‘ভিত্তি’-কে আঁকড়ে রাখার যে প্রবণতা তাকে ‘ভৈত্তিকতা’ বলা যায়; এই ভিত্তি কোন বিশেষ চিন্তাপদ্ধতি, মতাদর্শ, ধর্মমত ইত্যাদির ভিত্তি হিসেবে যে কথাবার্তা বলা হয়েছিল তাকেই বোঝায়। কিন্তু এই অর্থে, মৌলবাদের বিকল্প কথা হিসেবে ‘ভৈত্তিকতা’ শব্দটি আর কেউ ব্যবহার করেছেন বা তার প্রস্তাব দিয়েছেন। কিনা জানা নেই।
অন্যদিকে ‘মৌলবাদ’ শব্দটির ব্যবহার বিগত শতাব্দীতে এমন কি এই বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেও আদৌ হয়েছিল বলে মনে হয় না। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্ৰ বা রবীন্দ্রনাথ–বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যাদের হাতে শৈশব পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছিল, তাঁরা ধর্ম, ধর্মীয় গোড়ামি, ধর্মীয় কুসংস্কার, ধর্ম সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি প্রসঙ্গে বহু আলোচনা করলেও তাদের লেখায় কোথাও মৌলবাদ শব্দটি সাধারণভাবে চােখে পড়ে না। এটি অবশ্যই ঠিক যে, তাদের প্রতিটি লেখা খুঁটিয়ে পড়ে তারপর এমন মন্তব্য করা হচ্ছে তা নয়। উপযুক্ত গবেষক ও মনোযোগী পাঠক এ ব্যাপারে আলোকপাত করতে পারবেন। তবে এতে অন্তত কোন সন্দেহ নেই যে, বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে (বিশেষত আশির দশকের শেষার্ধ থেকে, রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্কের প্রসঙ্গে) বাংলা ভাষায় এই শব্দটি পূর্বেকার কয়েক শত বছরের তুলনায় এত বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে যে, শব্দটির উদ্ভবই এই সময়ে ঘটেছে বলে বলা যায়।
এই শব্দটির এমন সৃষ্টি ও বহুল ব্যবহারের জন্য ‘ধন্যবাদ’ প্রাপ্য এখনকার হিন্দুত্ববাদী ও ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠীগুলির। এই অর্থে হিন্দু, খৃস্ট বা ইসলামের ইতিহাস ধর্মান্ধ ও গোড়া হিসেবে তার অনুসরণকারী ব্যক্তিদের একটি অংশকে প্রতিষ্ঠা করলেও এবং একটি বিশেষ গোষ্ঠী হিসেবে পাশ্চাত্যে ‘Fundamentalist’— দের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা শতাধিক বৎসর পূর্বে ঘটলেও বাংলা ভাষায় ‘মৌলবাদ’ ‘মৌলবাদী’ কথা দুটি বিশেষ মানসিকতাকে ও ঐ মানসিকতার ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বােঝাতে এত সুনির্দিষ্টভাবে আশির দশকের আগে ব্যবহৃত হয়নি। এর একটি বড় কারণ আধুনিক ইসলামী মৌলবাদের আবির্ভাব ঘটেছে। ৭০-এর দশকের শেষের দিকে, ইরান ও আফগানিস্থানে। আর শিবসেনা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ভারতীয় জনতা পার্টি ও তার অন্যান্য সহযোগী সংগঠনগুলি এই আধুনিক বিশ্বে, ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে ঘোষিত ভারতের বুকে বসে ধর্মীয় সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা ও অসহিষ্ণুতার যে চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে ও ঘটাচ্ছে এবং ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলিও যে একই অ-সভ্য আচরণ করেছে, এসবের প্রভাবে কোন এক সময় কোন লেখক বা সাংবাদিক এমন একটি গ্রহণযোগ্য শব্দ ব্যবহার করে বসেছেন। তাঁর মাথায় যথাসম্ভব ঐ Fundamentalism বা Fundamentalist-দের উদাহরণ ছিল অর্থাৎ একেবারে স্বাধীনভাবে এই শব্দটি যে সৃষ্টি হয়েছে তা নয়। শ্ৰদ্ধেয় পণ্ডিত শ্ৰী বিমলকৃষ্ণ মতিলালও এই অনুমানই করেছেন। অর্থাৎ ঐ সময় এখানে গুণগতভাবে Fundamentalism-এর সঙ্গে তার সাদৃশ্যও খুঁজে পাওয়া গেছিল।
রামমোহন রায় তাঁর ‘সহমরণ বিষয় প্ৰবৰ্ত্তক ও নিবৰ্ত্তকের সম্বাদ’ (১৮১৮-১৯) লেখায় বলেছিলেন, “যে সকল মূঢ়েরা বেদের ফলশ্রবণবাক্যে রত হইয়া আপাত প্রিয়কারী যে ওই ফলশ্রুতি তাহাকেই পরমার্থসাধক করিয়া কহে আর কহে যে ইহার পর অন্য ঈশ্বরতত্ত্ব নাই” ইত্যাদি। এখন এই মানসিকতার কথা বলতে গিয়ে মৌলবাদ বা মৌলবাদী কথাগুলি যুৎসইভাবে কোথাও হয়তো বসিয়ে দেওয়া যেত।
১১ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩ তারিখে স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো ধৰ্মসভার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অভ্যর্থনার উত্তরে বলেছিলেন, “সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণতা ও এসবের ফলস্বরূপ ধর্মোন্মত্ততা এই সুন্দর পৃথিবীকে বহুকাল ধরে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। পৃথিবীতে এরা তাণ্ডব চালিয়েছে, বহুবার পৃথিবীকে নরশোণিতে সিক্ত করেছে, সভ্যতাসংস্কৃতি ধ্বংস করেছে এবং সমগ্র মানবজাতিকে নানা সময়ে বিভ্রান্ত, হতাশায় নিমগ্ন করেছে। এই সব ধর্মোন্মাদ পিশাচ যদি না থাকত, তবে মানবসমাজ আজ যে অবস্থায় উপনীত হয়েছে, তার থেকে কত সুন্দর হয়ে উঠতে পারত; এরা তা করতে দেয়নি!” এই ‘ধর্মোন্মাদ পিশাচরা’ ধর্মীয় মৌলবাদীরাই। কিন্তু তখন অন্তত বিবেকানন্দ ‘Fundamentalism’ বা ‘মৌলবাদী’ তথা ‘মৌলবাদী’ কথাগুলি ব্যবহার করেন নি।
এই মৌলবাদ ও মৌলবাদীদের বােঝাতে রবীন্দ্রনাথ ‘ঈশ্বরদ্রোহী পাশবিকতা’, ‘গোঁড়ামি’, ‘ধর্মের বেশে মোহ’, ‘পৌরোহিত্য শক্তি’, ‘সাম্প্রদায়িক ঈর্ষাদ্বেষ’, ‘ধর্মবিকার’, (ধর্মের নামে) ‘মানুষের উপর প্রভুত্ব’ ইত্যাদি নানা শব্দ ব্যবহার করেছেন।