তবে ‘মৌলবাদ’ কথাটি স্বাধীনভাবে এখনো শুধুমাত্র ধর্মীয় মৌলবাদকেই বোঝায়। যদি তার আগে অন্য কোন বিশেষণ বসানো হয় তবে তা কিছু ভিন্নতর তাৎপর্য বহন করতে পারে, যেমন সাম্প্রদায়িক মৌলবাদ, রাজনৈতিক মৌলবাদ। এমনকি মৌলবাদের আরো সাধারণীকরণ করে অর্থনৈতিক মৌলবাদ, যুক্তিবাদী মৌলবাদ ইত্যাদি কথাগুলিকেও ব্যবহার করা যায়, —যদি অর্থনীতি ও যুক্তিবাদের নাম করে একই রকম গোঁড়ামি, অসহিষ্ণুতা, সামাজিক ক্ষতিকর প্রভাব ইত্যাদি একই রকম ভাবে দেখা যায়।
আবার মৌলবাদ-মৌলবাদী কথাগুলি ব্যবহৃত হতে হতে অনেক সময় অনেকের দ্বারা শুধুমাত্র ‘গোঁড়ামি’ বোঝাতেই সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়। (যেমন, ‘শঙ্করাচার্যের ফতোয়ায় রবিবার কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে মহিলার বেদপাঠ নিষিদ্ধ হওয়ায় স্তম্ভিত বহু সংগঠন। তাদের সম্মিলিত মঞ্চ মানব সংহতি-র তরফে আজ ক্ষোভ জানিয়ে বলা হয়েছে, এই ফতোয় হিন্দু মৌলবাদেরই দম্ভ। বাংলার মানুষ তা মেনে নেবে না। …’ আজকাল, ১৮ই জানুয়ারী,১৯৯৪)
হিন্দু, ইসলাম, খৃষ্ট, শিখ ইত্যাদি নানা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মমতকে কেন্দ্র করে যখন মৌলবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তখন তা ধর্মীয় মৌলবাদ। এই ধরনের প্রায় সব ধর্মই ঈশ্বর নামক এক অলীক ও মানুষেরই মনগড়া শক্তিতে বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ধর্মীয় মৌলবাদীরা সবাই সাধারণভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাসী এটি বলাটা বাহুল্য মাত্র। তবে তাদের সবার ক্ষেত্রে এই বিশ্বাস আন্তরিক না-ও হতে পারে। যেমন ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু বা মুসলিম মৌলবাদীদের সবাই পরম ঈশ্বরভক্তি কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এদের অনেকের ক্ষেত্রেই ঈশ্বর ও ধর্মকে সামনে দাঁড় করিয়ে অর্থাৎ সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের ভুলিয়ে, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের ধান্দাটিই বড়। এ ধরনের তথাকথিত মৌলবাদীরা আসলে প্রকৃত মৌলবাদীর মর্যাদা পাওয়ারও যোগ্য নয়, তাদের আরো নিকৃষ্টতর কোন বিশেষণে ভূষিত করা যায় এবং উচিতও। একজন বিশুদ্ধ মৌলবাদী, তার সমস্ত সংকীর্ণতা ও প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র নিয়েও, ঐশ্বরিক শক্তিতে বিশ্বাসের ব্যাপারে অন্তত অটল। তার এই অনড় অটল বিশ্বাস বা ভক্তিই তাকে মৌলবাদী করেছে,–ঐশ্বরিক গ্রন্থের সামান্য অমর্যাদা সে সহ্য করে না। বা তার ভিত্তিটাকে নাড়াতে উপক্রম যে-ই করে (কোন মানুষ বা তত্ত্ব) তাকে সে নিজের কাছের বলে গ্রহণ করতে পারে না। তারই জন্য তার মধ্য থেকে উদারতা ও অন্যের প্রতি সহিষ্ণুতা বিনষ্ট হয়, এ কারণেই সে প্রয়োজনে নিজেকে ও নিজের সমাজকে দু’এক হাজার বছর পিছিয়ে নিয়ে যেতেও রাজী। হিন্দু মৌলবাদীরা বেদকে, মুসলিম মৌলবাদীরা কোরানকে, খৃষ্টান মৌলবাদীরা বাইবেলকে সনাতন অপৌরুষেয়, সমালোচনা ও পরিমার্জনার উর্ধে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব-দায়ী একটি ভিন্ন সত্তা হিসেবে মনে করে। কিন্তু বেদ বা কোরানকে শ্রদ্ধার সঙ্গেও হুবহু না মেনে চলা এবং তাদের সম্পর্কে সামান্য কিছুও না জানা (স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায় ‘চার পুরুষ ধরে এক খণ্ড বেদও না দেখা’) ধর্মীয় মৌলবাদীর অভাব নেই। ওরা আসলে মৌলবাদের পচা ডোবায় ভেসে থাকা পচা পাতার মত।
ধর্মীয় মৌলবাদীদের থেকে রাজনৈতিক মৌলবাদীদের একটি বড় তফাৎ এখানে যে, রাজনৈতিক মৌলবাদীরা ঈশ্বরে বিশ্বাসী নাও হতে পারে, এমনকি ঈশ্বরে অবিশ্বাসী বা তথাকথিত নাস্তিক (অন্তত বাহ্যিকভাবে) হতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষ কোন রাজনৈতিক মতাদর্শ কিংবা মার্কসবাদের নাম করে, কিছু কিছু রাজনৈতিক দল বা তথাকথিত কম্যুনিষ্ট পার্টির মধ্যে এই লক্ষণ যখন দেখা যায়, তখন ধর্মীয় মৌলবাদীদের থেকে তাদের এই পার্থক্যের দিকটি পরিষ্কার হয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তারাও ঈশ্বরের পরিবর্তে তাদের পিতৃসুলভ তত্ত্বটিকে একই ভঙ্গিমায় একই আসনে বসায়।
‘মাকর্সবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ ইহা সত্য’–এই ধরনের পোস্টার ও প্রচার বাংলায় এখন বেশ দেখা যাচ্ছে। তথাকথিত মার্কসবাদী বা কম্যুনিষ্টদের মধ্যে অন্যত্রও এই মানসিকতার রকমফের দুর্লভ নয়। (যথাসম্ভব বিশ্বের নানা স্থানে মার্কসবাদ বা কম্যুনিজম ও সমাজতন্ত্রের তথাকথিত বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আপন তত্ত্বের মাহাত্ম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার তাড়নায় তা করা হয়েছে।) মাকর্সবাদকে এইভাবে বিচ্ছিন্নভাবে ‘সর্বশক্তিমান’ হিসেবে ব্যাপক প্রচার করার বালখিল্যসুলভ (কিংবা অমার্কসীয়) প্রচেষ্টার মধ্যে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরে ভক্তির দিকটিই ভিন্নভাবে পরিস্ফুট হয়। মার্কস নিজেও কখনো তাঁর নিজের ‘তত্ত্বকে’ সর্বশক্তিমান হিসাবে দাবী বা প্রচার করেছেন বলে জানা নেই। বরং যে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শন তার ভিত্তি, ঐ অনুযায়ী মার্কসের তত্ত্বেরও যুগোপযোগী পরিবর্তন, বৈজ্ঞানিক পরিমার্জনা ও গোঁড়ামিযুক্ত সমালোচনা সুস্থ ও অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। এই রাজনৈতিক মৌলবাদীরা (এক্ষেত্রে আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে মার্কসীয় মৌলবাদীরা) ধর্মীয় মৌলবাদীদের মত অন্যান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতেও বাধ্য। তাদের ঐ মৌলবাদী চরিত্রেরই একটি বহিঃপ্রকাশ মার্কসবাদকে সর্বশক্তিমান হিসেবে প্রচার করার মধ্যে। অথবা কোন ধরনের সমালোচনা পর্যালোচনা ও পরিমার্জনার মানসিকতা ও যোগ্যতা অর্জন না করে এবং সেগুলিকে মুক্ত মনে গ্ৰহণ না করার মানসিকতা নিয়ে, অন্ধভাবে নিজেদের আঁকড়ে রাখা তত্ত্বকে সর্বশক্তিমান হিসেবে গণ্য করার সঙ্গে সঙ্গে মৌলবাদী চরিত্রও তারা অর্জন করে ফেলে (একই ধরনের অন্ধবিশ্বাস, হিংস্রতা, পরমত অসহিষ্ণুতা, সংকীর্ণতা তথা অনুদার দৃষ্টিভঙ্গী, মূল রাজনৈতিক গ্রন্থটিকে সর্বোচ্চ ভাবা ইত্যাদি)। কিংবা উভয়ই। প্রকৃত বিচারে এই গোঁড়ামি মার্কসবাদ অনুসরণে নিজেদের অক্ষমতা ও ভন্ডামি এবং হয়তো বা তজনিত হতাশারই বহিঃপ্রকাশ।