এখনকার ধর্মীয় মৌলবাদ সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলার আগে অন্যান্য কয়েকটি প্রাসঙ্গিক দিকেরও উল্লেখ করা দরকার। সম্প্রতি যাদের মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে (যেমন আন্তর্জাতিক খৃস্টীয় বা ইসলামী মৌলবাদীরা কিংবা ভারতের হিন্দু মৌলবাদীরা) তাদের ক্ষেত্রে আরো কয়েকটি বৈশিষ্ট্যও সৃষ্টি হয়েছে, যেমন–
(১) বর্তমানে এটি আরো জঙ্গী ও হিংস্র। আমেরিকার ঐ ফান্ডামেন্টালিস্টরা নিজেরা প্রত্যক্ষভাবে দাঙ্গার জন্ম দিয়েছে, মানুষ খুন করেছে বা শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে—এমনটি নয়। অবশ্য তাদের একেবারে নিরীহ ভাবারও কারণ। নেই, কারণ আমেরিকায় ম্যাকার্থিবাদের সৃষ্টিতে এবং বিপুল সংখ্যক কমিউনিষ্ট নিধনে তাদের পরোক্ষ ভূমিকা ও উৎসাহ ছিলই। তবু তা ঘটেছে তাদের সৃষ্টির পরবর্তী পর্যায়ে। শুরুর দিকে ধৰ্মরক্ষা ও ধর্মবিরোধী বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বিরুদ্ধে আদর্শগত লড়াই ছিল প্রধান দিক। কিন্তু এখনকার হিন্দু-মুসলিম ইত্যাদি ধর্মীয় মৌলবাদীরা এই ধরনের মানসিকতার সঙ্গে গুণগতভাবে উচ্চতর ও লক্ষ্যণীয় মাত্রায় প্রত্যক্ষভাবে হিংস্রতাকেও সংযুক্ত করেছে। ১৯৭৮-এ ইরানে ইসলামী মৌলবাদীদের হাতে ৫৮ জন আমেরিকানের বন্দী থাকার উদাহরণ কিংবা আফগানিস্থানে রুশ সামরিক উপদেষ্টাদের হত্যার ঘটনা জানা আছে। এ-ও জানা আছে যে হিরোসিমা-নাগাসাকিতে যত মানুষ বোমার আঘাতে মারা গেছিলেন, তার চেয়ে বেশি মানুষ এই ভারতেই ধর্মকেন্দ্ৰিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছেন; তারই ধারাবাহিকতায় ‘রামরথ’ বের করে দাঙ্গার উস্কানি দিতে এই মৌলবাদীরা এখনো কোন ইতস্তত করে না। পরিণতি জানা সত্ত্বেও অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙ্গ আর উসকানি দিতে তাদের হৃদয়ে এতটুকু ভালবাসা ও মনুষ্যত্ব জাগে না। (অযোধ্যার পরে আসছে মথুরা, বারাণসী ও আরো কয়েকশত ‘উসকানি’-অর্থাৎ হিন্দু মৌলবাদের অন্তহীন অমনুষ্যত্ব।) কোরাণকে অপমানের ছুতো তুলে মুক্তমনা ব্যক্তিদের হত্যা করতে বা হত্যার ফতোয়া দিতে, কিংবা তথাকথিত নৈতিকতার সামান্য বিচ্যুতিতে নৃশংস শাস্তি দিতে, এদের হাত এতটুকু কাঁপে না।
Fundamentalism-এর ঐতিহ্যে এই ভয়াবহ মাত্রায় হিংস্রতার সংযোজন সাম্প্রতিক মৌলবাদীদের একটি বিশেষ কৃতিত্ব।
এবং এক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদের সঙ্গে তার যথেষ্ট মিল রয়েছে। (ফ্যাসিবাদ প্রথম দেখা দেয়। ১৯১১তে ইটালিতে এবং ফ্যাসিবাদের সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব বর্তমান শতাব্দীর চতুর্থ দশকে জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্যাসিবাদকে ফাইন্যান্স পুঁজির সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল একনায়কতন্ত্র হিসেবে অভিহিত করা হয়। এদিক থেকে ধর্মীয় মৌলবাদের সঙ্গে তার কিছু তফাৎ হয়তো রয়েছে। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী হিংস্ৰতা সহ নানা দিকে তাদের মিলও প্রচুর।)
(২) এখনকার মৌলবাদীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল তথা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা ধর্মের মূল ভিত্তিকে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টার চেয়ে অনেক বেশি তীব্র। এই ব্যক্তিগত বা শ্রেণীগত স্বার্থসিদ্ধির সংকীর্ণ মানসিকতা মৌলবাদী সংকীর্ণতাকে আরো মরিয়া, জঙ্গী ও অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছে। সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগের মৌলবাদী উত্তরাধিকারী জামাতে ইসলামী (যেমন তার বাংলাদেশী সংস্করণ) কিংবা আর এস এস-ভি এইচ বি-বিজেপি চক্র রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করছে। এবং বিশেষ দেশে বা রাজ্যে তারা ক্ষমতা দখল করতে ইচ্ছক। ধৰ্মরক্ষার চেয়ে গদিতে বসার আকাঙ্খীই স্পষ্ট হচ্ছে, যদিও আগেও ধর্মরক্ষার নামে সিংহাসনে বসার উদাহরণ ছিলই। এখন সব ধর্মের মৌলবাদী সংস্থার মধ্যে এমন রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপারটা সর্বজনীন না হলেও, Fundamentalism-এর র তকীকরণ সাম্প্রতিক মৌলবাদের অন্যতম একটি পার্শ্ববৈশিষ্ট্য।
তবে মৌলবাদের রাজনৈতিকীকরণ ও রাজনৈতিক মৌলবাদ—এ দু’টি ভিন্ন জিনিষ। মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের তথা মানসিকতার দিক থেকে তারা অভিন্ন কিন্তু মৌলবাদের রাজনৈতিকীকরণ আসলে ধর্মীয় মৌলবাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের সাম্প্রতিক আকাঙ্খারই বহিঃপ্রকাশ। আমেরিকার Fundamentalist-দের প্রধানতম কাজের ক্ষেত্র ছিল ধর্ম (এখানে খৃস্ট ধর্ম)। তার কিছু রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ হয়তো ছিল, কিন্তু তা ছিল গৌণ একটি দিক। কিন্তু ভারতীয় জনতা পাটি বা জামাতে ইসলামীদের কাজের ক্ষেত্র ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে আরো অনেক স্পষ্টভাবে ও সুনির্দিষ্টভাবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রসারিত; ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে পাল্লা বিচারে ধর্মের দিকে পাল্লা ভারী তো নয়ই, বরং উল্টোটাই,–অন্তত সমান তো বটেই। অন্যদিকে রাজনৈতিক মৌলবাদের ক্ষেত্রে ধর্মের ব্যাপারটি নগন্য এমনকি শূণ্যও হতে পারে, যেমন মার্কসীয় মৌলবাদীদের’ ক্ষেত্রে। ‘মৌলবাদের রাজনৈতিকীকরণ’ কথার মধ্যে আসলে ধর্মীয় মৌলবাদের রাজনৈতিকীকরণকেই বোঝানো হচ্ছে—ধর্মীয় মৌলবাদের ক্ষেত্রে যা আগে এমনভাবে ছিল না। অন্যদিকে ‘রাজনৈতিক মৌলবাদ’ বলতে রাজনৈতিক দলের মধ্যে মৌলবাদী কিছুমানসিকতার প্রতিফলনকে বোঝানো হচ্ছে মাত্র যা কাম্য নয়। বিশেষত যারা মার্কসবাদের মত দর্শনের কথা বলেন তাদের ক্ষেত্রে এবং সাধারণভাবে সমস্ত ধরনের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের পরিপ্রেক্ষিতে।