(৩) কোন নতুন ধরনের বৈজ্ঞানিক চিন্তা, —তা সে বির্বতনবাদ থেকে সাম্যবাদ বা কম্যুনিজম যাই-ই হোক না কেন, যা ঐ ধর্ম তথা ধর্মগ্রন্থের ভিত্তিমূলে নাড়া দিতে চায়, তার প্রতিক্রিয়ায় তার জন্ম ও তার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামে সে কঁাপিয়ে পড়ে। এক কথায় যুক্তিবোধ ও বিজ্ঞানমনস্কতাকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করেই তার সৃষ্টি ও টিকে থাকা। এটি চূড়ান্তভাবে অবৈজ্ঞানিক ও প্রতিক্রিয়াশীল।
(৪) ধর্মীয় ক্ষেত্রেও উদারনীতি, আধুনিকতা ও ভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতি সহিষ্ণুতা-এ সবেরও সেটি বিরোধী। তাই ধর্মীয় সংকীর্ণতা তার কাজকর্মের মধ্যে প্রকাশ পায়।
(৫) কিছু প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের সৃষ্টি তথা ধর্মীয় আন্দোলন মানুষের সমাজইতিহাসের বিশেষ পর্যায়ে তার অগ্রগমন ও সংস্কারের পথ সুগম করলেও ফান্ডামেন্টালিজম-এর ক্রিয়াকান্ডের মধ্যে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার, এমনকি পশ্চাদগমনের আকাঙক্ষারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
এখন থেকে আড়াই হাজার বছর আগে বৌদ্ধ বা জৈনধর্মের, দু’হাজার বছর আগে খৃস্টধর্মের, দেড়হাজার বছর আগে ইসলাম ধর্মের বা পাঁচশ’ বছর আগে শিখধর্মের সৃষ্টি, এমনকি হিন্দুধর্মের মধ্যে ব্রাহ্মধর্ম, ভক্তি আন্দোলন বা বৈষ্ণবধর্ম ইত্যাদির সৃষ্টি এবং খৃস্টধর্মে প্রোটেস্টান্টিজমের জন্ম ইত্যাদির মধ্যে তখনকার ধর্মীয় আবিলতা, সামাজিক অবক্ষয় ও অনাচার, সামাজিক পীড়ন ও শোষণ, ইত্যাদির বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই রূপ পেয়েছিল। ঈশ্বর বিশ্বাস বা বিশেষ ধর্মীয় আধ্যাত্মিক বিশ্বাসকে অবলম্বন করে বিশেষ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তার নেতৃত্ব দিলেও, ধর্ম ও সমাজের প্রসঙ্গে সেগুলির ইতিবাচক কিছু সংস্কারমূলক দিকও ছিল। কিন্তু বিগত শতাব্দীতে এই যে ফান্ডামেন্টালিজম নামে সংগঠিত ধর্মীয় আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যার অবশেষ এখনো আছে এবং ভারতসহ নানা দেশে ভিন্ন পরিবেশে যা মূলত একই চরিত্র নিয়ে আরো উগ্রভাবে মাথা চাড়া দিয়েছে, তার মধ্যে ঐ ধরনের কোন ইতিবাচক দিক আবিষ্কার করা দুরূহ। বরং তা প্রগতিশীল সংস্কারইচ্ছার বা বৈপ্লবিক প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করতে তার প্রতিক্রিয়াতেই জন্মলাভ করছে।
(৬) দ্বিধাহীন বিশ্বাস ও প্রশ্নহীন আনুগত্য তথা চূড়ান্ত কর্তৃত্ববাদ তার অন্যতম সম্পূক্ত দিক। প্রাচীন ধর্মীয় অনুশাসন ও ধর্মগ্রন্থগুলিকে নিজেরা তো প্রশ্ন করেই না, অন্য কেউ তার চেষ্টা করলেও তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করতে থাকে। কেন পরিবর্তিত পরিবেশ পরিস্থিতি ও উন্নততর জ্ঞানের আলোয় তাদের বিচার করা যাবে না, ‘পাপ’ করলে ‘প্ৰায়শ্চিত্ত’ নামক কিছু মনগড়া ধর্মীয় অনুষ্ঠান করলে সব অপরাধ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। কিনা, কোন মেয়ে ‘কুমারী’ থাকলেও বাচ্চার জন্ম দিতে পারে। কিনা, অলৌকিক ক্ষমতা বলে কিছু আছে কিনা, শিগগিরই যিশুর আবার আসা সম্ভব কিনা এবং যুগাস্তে যিশুর পুনরভ্যুত্থান হওয়াও আদৌ সম্ভব কিনা—এ জাতীয় প্রশ্ন করার মানসিকতাই Fundamentalist-দের ছিল না! আর এদের মধ্যে একটি তো, অর্থাৎ যিশুর শিগগিরই মর্তে আবির্ভূত হয়ে মানবজাতিকে উদ্ধার করার বিশ্বাসটিতে, ইতিমধ্যে ভুলই প্রমাণিত হয়েছে; প্রায় দেড়শ’ বছর কেটে গেল, ‘তিনি’ আর এলেন না।
(৭) এটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণীবিভাজন ও বৈষম্য, নারী-পুরুষ দ্বন্দ্ব তথা পুরুষ আধিপত্য ইত্যাদিকে অস্বীকার করে। কৃত্রিম ধর্মই তার প্রধান বিবেচ্য। এ ক্ষেত্রে একই ধর্ম মতাবলম্বী বিভিন্ন ব্যক্তিদের সে পারস্পরিক সুহৃদ বলে ভাবতে শেখায়, যদিও তাদের মধ্যে বৈষম্য ও শাসক-শাসিতের বিভাজন রয়েছে। এই বৈষম্য ও বিভাজনকে দূর করা দূরে থাক, তাকে কমিয়ে তোলার আন্দোলনেরও সে বিরোধী। এরই একটি বহিঃপ্রকাশ ঘটে কট্টর কম্যুনিজমবিরোধিতার মধ্যে। সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ানোর মত নানা পদক্ষেপ নিয়ে সে শাসকশ্রেণীর হাতকে শক্তও করতে চায়। সব মিলিয়ে ফান্ডামেন্টালিজম হচ্ছে শাসক শ্রেণীর স্বার্থবাহী, জনস্বার্থবিরোধী, পুরুষ আধিপত্যকামী একটি মতবাদ।
(৮) আমেরিকার Fundamentalist-দের আরেকটি দিকও গুরুত্বপূর্ণ যে, তারা তাদের কাজকর্ম বা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা বা রাষ্ট্রযন্ত্রের শীর্ষে বসার চেষ্টা করে নি। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ও রাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা তারা অবশ্যই করেছে (প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানো বা কঠোর কম্যুনিষ্ট-বিরোধী বৈদেশিক নীতির জন্য আন্দোলন করার মত কাজকর্মের মধ্যে), কিন্তু তাদের নীতি ও বিশ্বাস অনুযায়ী নিজেরা নেতৃত্ব দখল করে সমগ্র রাষ্ট্রকে পরিচালিত করা, কিংবা খৃস্টান বা ফান্ডামেন্টলিস্ট রাষ্ট্র গড়ে তোলা—এমন আশা বা দাবী তারা করে নি, অন্তত তা ততটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে নি।
আমেরিকার ফান্ডামেন্টালিস্টদের এই সব বৈশিষ্ট্য–বিশেষত প্রথম সাতটি চারিত্রিক দিক যাদের মধ্যে দেখা যায়, তাদেরই সাধারণভাবে মৌলবাদী হিসেবে এবং এ ধরনের মানসিক ও তাত্ত্বিক প্রক্রিয়াকে মৌলবাদ হিসেবে অভিহিত করা যায়। সাংগঠনিকভাবে ব্যাপারটি মূলত ধর্মীয় পরিমণ্ডলে সীমিত থাকলেও, ব্যাপকতর অর্থে এই ধরনের মানসিকতাকেই মৌলবাদী মানসিকতা বলা যায়। সব সময় তা যে ধর্ম ও ঈশ্বর-বিশ্বাসের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে বা থাকছে, তার কোন মানে নেই। রাজনৈতিক মতাদর্শগত ক্ষেত্রেও এই মানসিকতার প্রসার ঘটতে পারে এবং তা ঘটেছেও। এমন কি মার্কসবাদ নামক যে দার্শনিক চিন্তা চূড়ান্ত অর্থে ধর্ম ও ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তাকে ও বাস্তব অস্তিত্বকে অস্বীকার করে এবং দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে সব কিছু বিচার করার কথা বলে, ঐ মার্কসবাদকে সামনে খাড়া করে রেখেও এমন মৌলবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। সহজভাবে বললে ব্যাপকতর অর্থে এইভাবে মৌলবাদকে দুটি মোটা দাগে ভাগ করা যায়-ধর্মীয় মৌলবাদ ও রাজনৈতিক মৌলবাদ।