[কার্লবাৰ্থ (জন্ম সুইজারল্যান্ডের বাসেল-এ, ১০ই মে, ১৮৮৬; মৃত্যু-৯ বা ১০ই ডিসেম্বর, ১৯৬৮)-একদিকে নাৎসি-বিরোধী ও জাতীয় সমাজতন্ত্র’ (National Socialism)-বিরোধী কাজের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন, অন্যদিকে ছিলেন প্রোটেস্টান্ট চিন্তায় মৌলিক পরিবর্তন আনার প্রসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। ঊনবিংশ শতাব্দীর উদার ঈশ্বরতত্ত্ব (liberal theology) ঈশ্বরকে মানুষের মত, মানুষের কাছাকাছি এনে (anthropocentrism) হাজির করছিল। এর বিরুদ্ধে কার্ল বার্থ ঈশ্বরের পরিপূর্ণ অনন্যতা (Wholy Otherness of God)–র উপর জোর দেন। সুইজারল্যান্ড থেকে ইনি আমেরিকায় যান। ১৯৬২ সালে। চার্চ ডগম্যাটিকস’ নামে এর লেখা সুবৃহৎ গ্রন্থ আছে। বাইবেল সহ যিশুখৃস্ট সম্পর্কে কোন ধরনের দ্বিধা, অবিশ্বাস, সমালোচনা বা তর্কবিতর্ককে পরিপূর্ণভাবে পরিহার করে তাঁর দ্বিধাহীন ঘোষণা ছিল,–‘…Jesus Christ, as He is attested for us in Holy Scripture, is the one Word of God, which we have to hear and which we have to trust and obey in life and in death.’]
আমেরিকায় সৃষ্টি হওয়া ও টিকে থাকা এই ফান্ডামেন্টালিজম ও ফান্ডামেন্টালিস্টদের মানসিকতা ও ক্রিয়াকান্ডের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকার কারণেই আমাদের দেশে সম্প্রতি মৌলবাদ ও মৌলবাদীর মত ‘আধুনিক পরিভাষা’-র সৃষ্টি হয়েছে। এবং সাম্প্রতিক মৌলবাদীরা ফান্ডামেন্টালিজমের আধুনিকীকরণ করেছে। হিংসা, জঙ্গীপনা ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের আকাঙক্ষা-এগুলিকে তার সঙ্গে সংযুক্ত করে। কথাগুলির তাৎপর্য শুধু আমেরিকা বা ভারত বলে নয়, আন্তর্জাতিক ভাবেই তার সাধারণীকরণ ঘটেছে, পেয়েছে কিছু নতুনতর মাত্রাও।
৩. মৌলবাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
Fundamentalis ও মৌলবাদের অন্যতম দুটি আভিধানিক অর্থের উল্লেখ আগেই করা হয়েছে, এগুলি হল যথাক্রমে, ‘বাইবেল বা অন্য ধর্মশাস্ত্রের বিজ্ঞানবিরুদ্ধ উক্তিতেও অন্ধবিশ্বাস’ এবং ‘ধর্মীয় গোঁড়ামির ফলে জাত সংকীর্ণ মতবাদ’। এ ধরনের সংজ্ঞা থেকে মৌলবাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কয়েকটি দিক স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, যেমন তা ধর্মের সঙ্গে (অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে) সংশ্লিষ্ট, ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি তার সম্পৃক্ত দিক, এটি একটি বিজ্ঞানবিরুদ্ধ ও সংকীর্ণ চিন্তা। স্পষ্টতঃই মানুষের চেতনা ও সমাজের উত্তরণের বিরোধী এটি এবং যাদের মধ্যে এই অন্ধবিশ্বাস, গোঁড়ামি, বিজ্ঞানবিরুদ্ধতা ও সংকীর্ণতা দেখা যায়, তাদেরই সাধারণভাবে মৌলবাদী বলা যায়।
Fundamental কথাটিরও অর্থ ‘আদিম’ বা ‘মূল’। মৌলবাদ কথার ভাবগত অর্থ তাই মূল বা শিকড়ে ফিরে যাওয়ার তত্ত্ব। কথাটি এখন সাধারণভাবে ব্যাপক ব্যবহৃত হতে হতে একটি নিন্দাসূচক কথায় পরিণত হলেও, এই শিকড়ে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা মানুষের কমবেশি থাকেই। অ্যালেক্স হেলির বিখ্যাত বই ‘The Root’ (বাংলা অনুবাদ-‘শেকড়ের সন্ধানে’) এই প্রবণতারই ফসল। কিন্তু তা মৌলবাদ নয়। নিজের অতীতকে জানা, নিজ ধর্মীয় বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রথমদিকের ইতিহাস জানা তথা নিজের উৎস সম্পর্কে আগ্রহ বরং একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া ও মানবিক ইতিবাচক লক্ষণ। কিন্তু যখন তা তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ঐ আদিম প্রাচীন মূল দিকেই ফিরে যাওয়ার কথা অন্ধভাবে বিশ্বাস করা ও করানো হয় অর্থাৎ পরিবর্তিত পরিবেশ-পরিস্থিতি জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঐ মৌলিক আদিমতার পরিমার্জনা ও রূপান্তরকে অস্বীকার করা হয় তখন তা মৌলবাদ বা মৌলবাদী তত্ত্বে পরিণত হয়। এর সঙ্গে পরমত-অসহিষ্ণুতা, নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাবা, এই তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের সংকীর্ণস্বার্থ সিদ্ধি করা এবং তার জন্য অনৈতিহাসিক মিথ্যাচারের সঙ্গে হিংস্ৰ উগ্ৰ অন্ধ আচরণ করা-ইত্যাদিও মিশে থাকে। এটি অবশ্যই মানুষ ও তার সভ্যতার বিরোধী। এটি প্রগতি ও বিকাশের পথ রোধ করে। বাইবেল ও যিশুকে অভ্রান্ত ধরা, কোরাণকে হুবহু অনুসরণ করার কথা ভাবা, হিন্দুধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ ভেবে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা—ইত্যাদি এরই ফসল। এইভাবে বিশেষ কোন প্ৰতিষ্ঠানিক ধর্মকে কেন্দ্র করে সাধারণতঃ মৌলবাদ তথা ধর্মীয় মৌলবাদ সৃষ্টি হলেও, কোন রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক তত্ত্ব কিংবা বিশেষ কোন মতাদর্শে অন্ধ গোঁড়া উগ্ৰ বিশ্বাসও মৌলবাদী মানসিকতারই বিশেষ রূপ।
আমেরিকায় প্রতিষ্ঠানিক ভাবে সৃষ্টি হওয়া Fundamentalism-এর পূর্ববর্তী সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে এর কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দিকে দৃষ্টি আকৰ্ষিত হয়। যেমন
(১) এটি অবশ্যই ধর্মের সঙ্গে সম্পূক্তভাবে যুক্ত। প্রতিষ্ঠানিক একটি ধর্মে (এখানে খৃস্টধর্মে) বিশ্বাস তার প্রাথমিক ভিত্তি। তাকে আরো গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত করাই তার লক্ষ্য।
(২) এটি আসল প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থকে (তথা মৌলিক প্রাথমিক দিকগুলিকে) অপরিবর্তনীয়, সমালোচনার উদ্ধেৰ্ব, সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের অধিকারী হিসেবে মনে করে এবং এই মনে করার মধ্যে কোন আপোষ করতে সে প্রস্তুত নয়। এ কারণে তার কাজের মধ্যেও ধর্মান্ধিতার স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং Fundamentalism বা মৌলবাদ নামটি এ কারণেই হয়েছে।