যুদ্ধের পরবর্তী দশকগুলিতে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য, ১৯৫০-এর ধর্মীয় পুনরভ্যুত্থান এবং কম্যুনিস্টরা সব গণ্ডগোল করে দেবে এমন ভয় ও অভিযোগ–এই বিষয়গুলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে আমেরিকায় ফান্ডামেন্টালিস্ট ও ইভানজেলিক্যাল চার্চের উপর সবচেয়ে বেশি ও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। এই সময়ে ফান্ডামেন্টালিস্টদের নতুন এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, বিখ্যাত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিটি যথাসম্ভব ছিলেন ইভানজেলিস্ট বিলি গ্রাহাম (Billy Graham) (জন্ম-৭.১১.১৮; ভিন্ন নাম-উইলিয়াম ফ্র্যাংলিন গ্রাহাম)।
১৯৫০ সাল নাগাদ ইনি ছিলেন ফান্ডামেন্টালিস্টদের প্রধান মুখপাত্র। ফান্ডামেন্টালিস্ট তথা ধর্মীয় মৌলবাদীদের সঙ্গে শাসকশ্রেণীর আঁতাতের জুলন্ত উদাহরণ ছিলেন ইনি। ১৯৪৯ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হ্যাঁরি এস. ট্রম্যান। এঁকে প্রথম হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ করে আনেন। পরে সেখানে তার অবাধ যাতায়াত শুরু হয়। ডুইট ডি, আইসেনহাওয়ার, লিন্ডন জনসন ও রিচার্ড এস. নিক্সনের মত আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্টদের ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত বন্ধু এবং গলফ খেলার সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন এই বিলি গ্রাহাম। জোনস কলেজে (ক্লিভল্যান্ড, টেনেসি) ও ফ্লোরিডা বাইবেল ইনস্টিটিউট (ট্যাম্পার নিকটবতী) নামে ফান্ডামেন্টালিস্টদের দুটি প্রতিষ্ঠানে ইনি পড়াশুনা করেন এবং শেষেরটি থেকে ১৯৪০-এ স্নাতক হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইলিনয়েসের হুইটন কলেজ থেকে নৃতত্ত্বে বি.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। ক্রুসেড নাম দিয়ে বহু প্রচারমূলক ভ্ৰমণ করার পাশাপাশি, ‘বিলি গ্রাহাম ইভানজেলিস্টিক অ্যাসোসিয়েশন’ প্ৰতিষ্ঠা করেন। নিজের ধর্মীয় প্রচারগুলিকে ‘ডিসিসান’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করে ও অন্যান্য লেখাপত্রের মধ্য দিয়ে প্রচার করেন।
কম্যুনিজমের ভয় এই ১৯৫০-এর সময়কালে আমেরিকায় একটি বিরাট গণ বিতর্ক ও বাদ প্রতিবাদের বিষয় ছিল। এর জন্য বহু সংস্থায় ভাঙ্গনও ঘটে গেছে। আমেরিকার শাসকশ্রেণী ও ফান্ডামেন্টালিস্ট-উভয়ের কাছেই এই কমিউনিজম ছিল প্রধান শত্রু ও প্রবল ভীতিপ্রদ, প্রতিরোধযোগ্য ব্যাপার। কম্যুনিজমের প্রতি এই ভয়ের ব্যাপারটার সঙ্গে ফান্ডামেন্টালিস্টদের চিরাচরিত শত্রুর (অর্থাৎ বাইবেলের সমালোচনা ও বিবর্তনবাদ) চরিত্রগত কিছু মিল রয়েছে, যেমন এটি (কমিউনিজম) বাইরে থেকে এসেছে, এমনভাবে তা ছড়িয়ে পড়ছে যে মনে হচ্ছে তাকে আটকানো যাবে না। আর সবকিছু ওলোট পালট করে দেবে এবং সেটি খৃস্টধর্মকে বেশ হতমোনই করছে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালের এই কম্যুনিস্ট-বিরোধী ধৰ্মযুদ্ধ যেন ১৯২০এর বির্বতনবাদ-বিরোধী ধর্মযুদ্ধেরই হুবহু পুনরাবৃত্তি।
সত্তর-এর দশকের শেষের দিকে বিবর্তনবাদ নিয়ে বিতর্ক আবার মাথা চাড়া দেয়। এই সময়কালের মধ্যে বিবর্তনবাদ একটি বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে গৃহীত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। কিন্তু তথাকথিত সৃষ্টিবাদীরা (Creationists) স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে বাইবেলের সৃষ্টি সৃষ্টি কাহিনী (Biblical Creation account)-কে অন্তর্ভুক্ত করার দাবী জানাতে থাকে এবং তার জন্য প্রচার আন্দোলন চালায়। রক্ষণশীল ক্ষেত্রগুলিতে এর ফলে ফান্ডামেন্টালিস্ট সৃষ্টিবাদীরা কিছু জমি খুঁজে যায়। নিজের ছেলেমেয়েদের কি পড়ানো হবে বা হচ্ছে, তা ঠিক করার অধিকার বাবা-মায়েরও থাকা উচিত। কিনা,—এ ধরনের বৃহত্তর বিতর্কও এর ফলে সৃষ্টি হয়।
আর ৭০-এর দশকের শেষের দিকের এই সময়কালেই তথাকথিত মরাল মেজরিটি, (Moral Majority) নামে ফান্ডামেন্টালিস্ট নাগরিকদের একটি সংস্থা ধৰ্মযুদ্ধে নামে। এর নেতৃত্ব দেন ভার্জিনিয়ার ব্যাপটিস্ট যাজক জেরি ফ্যালওয়েল (Jerry Falwell)। বাইবেলের কর্তৃত্বের প্রতি আগেকার আপোষহীন মানসিকতার সঙ্গে গর্ভপাত, সমলিঙ্গী যৌন অধিকার, সমানাধিকার সম্পর্কিত আইনের সংশোধন—এ সবের বিরুদ্ধে এবং স্কুলে প্রার্থনাসভার আয়োজন করা, প্রতিরক্ষণ খাতে ব্যয় বাড়ানো, কম্যুনিস্ট বিরোধী বৈদেশিক নীতিকে শক্তিশালী করা, —এসবের স্বপক্ষে এই ফান্ডামেন্টালিস্টরা আন্দোলন গড়ে তোলে। মৌলবাদী বলতে এখন যাদের বোঝানো হচ্ছে, তাদের সঙ্গে এই মরাল মেজরিটি-র সাদৃশ্যই সবচেয়ে সাম্প্রতিক। ভারতের হিন্দুমৌলবাদীরা বা কিছু ইসলামী দেশের মুসলিম মৌলবাদীরা প্রায় হুবহু একই ধরনের দাবী এখন জানাচ্ছে-হিন্দু-মুসলিম সবার জন্য একই আইন থেকে কঠোর কম্যুনিষ্ট বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গী আদি।
এখনো আমেরিকায় টিকে থাকা ফান্ডামেন্টালিস্টদের বিশ্বাস সেই নায়াগ্রা সম্মেলনের সময় থেকে এমন কিছু পাল্টীয় নি। এখনকার ফান্ডামেন্টালিস্টরা ধূমপান বা মদ্যপান না করা, নাটকে অংশগ্ৰহণ না করা জাতীয় নানা ধরনের আচরণবিধি অনুসরণ করেন। এ সম্পর্কে গোঁড়ার দিকেই বলা হয়েছে। এটিও উল্লেখ্য যে, সম্প্রতিকালে আধুনিক ফান্ডামেন্টালিজমের ইতিহাসে সবচেয়ে উত্তেজনাকর আধ্যাত্মিক তথা ঈশ্বরতাত্ত্বিক (theological) আলোড়ন ঘটে কার্ল বার্থ (Karl Barth)-এর ঈশ্বরতত্ত্ব সম্পর্কিত ব্যাখ্যায়। তিনি বাইবেলের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বকে কঠোরভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। এবং এটি ফান্ডামেন্টালিস্ট দৃষ্টিভঙ্গীরই প্রতিফলন বলে অনেকে মনে করেন।