প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, আমেরিকা থেকে বহুদূরে, ভারতীয় ভূখণ্ডেও মোটামুটি এই সময়কালেই হিন্দু মৌলবাদেরও তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। কুড়ির দশকের মাঝামাঝি, একদা ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামী বীর সাভারকর হিন্দুত্বের প্রধান তাত্ত্বিক প্রবক্তা ও হিন্দু মহাসভার নেতারূপে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯২৩এ প্রকাশিত হয় তঁর ‘হিন্দুত্ব! হিন্দু কে?’ পুস্তিকাটি। আর ১৯২৫-এর বিজয়া দশমীর দিন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আর এস এস) প্রতিষ্ঠা করেন ডঃ হেডগেওয়ার ও তার অন্য পাঁচজন বন্ধু। উল্লেখযোগ্য যে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ভারতীয় জনতা পার্টি (বি জে পি), বজরং দল, ভারতীয় মজদুর সংঘ বা অখিল ভারতীয় বিদ্যাথী পরিষদ হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণার মূল চালিকাশক্তি নয়; এর মূল চালিকাশক্তি এই আর এস এস-ই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরোকার অর্থনৈতিক সামাজিক ব্যবস্থা এবং একই সঙ্গে আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রতিক্রিয়া—এগুলি এক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করেছিল।
অন্যদিকে ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে আমেরিকার ফান্ডামেন্টালিস্টরা সংঘাতের জায়গা থেকে সরে আসে এবং জাতীয় ক্ষেত্রেও তারা আর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকে না। এই সময়কালে যান্ত্রিকভাবে ও কঠোরভাবে সংযত নৈতিক জীবনযাপনকে একটি দার্শনিক ভিত্তি দেওয়া হয়। ভোগসর্বস্বতা, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা, বিলাসব্যসন থেকে দূরে থাকার, এমন কি নাচগান করা, সিনেমা নাটক দেখা বা মদ্যপানধূমপান করা ইত্যাদির বিরুদ্ধেও তাঁরা তীব্র প্রচার শুরু করেন। এই সময়েই আধুনিক ফান্ডামেন্টালিজম-এর প্রতিষ্ঠানিক রূপ বিকশিত হতে থাকে, (যা এখনো আমেরিকায় নানাভাবে এবং ভালভাবেই আছে)। কিছু ফান্ডামেন্টালিস্ট তাদের সংগঠন থেকে বেরিয়ে এসে নতুন চার্চ প্রতিষ্ঠা করেন যেমন জেমস জে মাচেন (James J. Machen)-এর নেতৃত্বে কিছু প্রেসবিটেরিয়ান ‘প্রেসবিটেরিয়ান চার্চ ইন আমেরিকা’ বা ‘নির্দান ব্যাপটিস্ট কনভেনশান’ ছেড়ে কিছু ব্যাপটিস্ট ‘জেনারেল অ্যাসোসিয়েশন অব রেগুলার ব্যাপটিস্টস’ গড়ে তোলেন। কিন্তু অধিকাংশ ফান্ডামেন্টালিস্টরাই এক একটি ক্ষুদ্রতর গোষ্ঠীতে জড়ো হন, যেগুলি সর্বতোভাবে বাইবেলের আক্ষরিক অনুসরণে এবং মিলেনারিয়ানের পূর্ববর্তী অবস্থানের প্রতি বিশ্বস্ত, যেমন ‘খুষ্টান অ্যান্ড মিশনারী অ্যালয়েন্স’, ‘প্লাইমাউথ বৃন্দ্রেন’, ‘ইভানজেলিক্যাল ফ্রি চার্চ কিংবা ঐ সময় গড়ে ওঠা অজস্র স্বাধীন ‘বাইবেল চার্চ’ ও উপাসনাকেন্দ্রের কোন কোনটিতে।
বর্তমানে আমেরিকায় ফান্ডামেন্টালিজম এইভাবে রূপান্তরের পর নানান ক্ষেত্রে টিকে আছে। এই আধুনিক ফান্ডামেন্টালিজম (modern Fundamentalism) তার সাংগঠনিক রূপের অনেকটাই ‘বাইবেল ইনস্টিটিউট’ ও ‘বাইবেল কলেজগুলি থেকে পেয়েছে। চিকাগোর ‘মুডি বাইবেল ইনস্টিটিউট’ (Moody Bible Institute) বা লস এঞ্জেলস-এর বাইবেল ইনস্টিটিউট’-এর মত এ ধরনের অনেক শিক্ষাকেন্দ্ৰে শুধু ছাত্রদের পড়ানোই হয় না, তারা তাদের নিজস্ব পত্রিকা প্রকাশ করে, নিজেদের বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচার চালায়, সভা-সম্মেলনের আয়োজন করে এবং সংগঠন বাড়ানোর জন্য বক্তাদের মাইনে পাওয়া কৰ্মচারী হিসেবেও রাখে। মূল সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ কেন্দ্রের মতই তারা সংগঠন চালায় এবং এইভাবে প্রায় সমমনোভাবাপন্ন কিন্তু পরস্পরবিচ্ছিন্ন সংস্থাগুলির মধ্যে একটি যোগসূত্র বজায় রাখে। চিকাগোর শহরতলী এলাকায় এই ধরনের জ্ঞানচর্চার নামকরা কেন্দ্ৰ, হুইটন কলেজ, দীর্ঘদিন ধরে শিল্প ও বিজ্ঞানের সবচেয়ে শক্তিশালী দুর্গ হিসেবে কাজ করেছে।
আমেরিকার সমাজের ব্যবসায়িক ও পেশাগত বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি, ও প্রায় সমকক্ষ হিসেবে, ফান্ডামেন্টালিস্টদেরও বহু সংস্থা রয়েছে। ছাত্র, নার্স, ডাক্তার, বিজ্ঞানী, ক্রীড়াবিদ, সমাজকর্মী, ঐতিহাসিক, ব্যবসায়ী ও অন্যান্যরা তাঁদের নিজস্ব স্বাৰ্থবাহী বা প্ৰশিক্ষণের জন্য গড়া এ ধরনের আপনি আপন সংস্থায় যোগ দিতে পারেন। বৃহৎ প্রোটেস্টান্ট সংগঠন ও রোমান ক্যাথলিকদের মত, শত শত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এঁদেরও নিজস্ব ‘ক্যাম্পাস ক্রুসেড ফর ক্রাইস্ট’ ও ‘ইন্টার-ভার্সিটি ক্রিস্টিয়ান ফেলোশিপ’,ইত্যাদি রয়েছে। এদেরই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘আমেরিকান সায়েন্টিস্ট অ্যাফিলিয়েশন’ নিয়মিত আলোচনাসভায় বসেন এবং একটি পত্রিকা প্ৰকাশ করেন; এই পত্রিকায় বিজ্ঞানের সঙ্গে বাইবেল ও খৃস্টান বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী কিভাবে একসঙ্গে পাশাপাশি মানিয়ে থাকতে পারে তার উপর জোর দেওয়া হয়।
প্রোটেস্টান্ট মতের বৃহৎ সংস্থাদির সমকক্ষ হিসেবে ফান্ডামেন্টালিস্টদের দ্বারা প্রভাবিত ‘অ্যামেরিকান কাউন্সিল অব ক্রিস্টিয়ান চার্চেস’ (ACCC; প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৪১) ও ‘ন্যাশন্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব ইভানজেলিক্যিাল’ (NAE; প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৪২) রয়েছে। ১৯৬৯ অবিদ প্রথমোক্ত সংস্থাটি বাস্তবত ক্যাল ম্যাকআনটায়ার (Carl McIntire) নামে একজন ব্যক্তিরই মুখপাত্র ছিল। ন্যাশন্যাল কাউন্সিল অব চার্চেস-এর মত বৃহত্তর খৃস্টান সংগঠনের বিরুদ্ধে এবং আমেরিকাকে ধ্বংস করার জন্য কম্যুনিস্ট, ষড়যন্ত্রের বিপদের বিরুেদ্ধে ইনি প্রচার চালাতেন। দ্বিতীয়োক্ত সংস্থাটি তার সদস্যদের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে কিন্তু নিজস্ব কোন কর্মসূচীর রূপায়ণ করে না।