প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরোকার সময়ে আমেরিকানদের মধ্যে চরম অস্থিরতা, নৈরাশ্য, অসংযমী আচার-আচরণ ও সামাজিক নানা ধরনের ভীতির সৃষ্টি হয়েছিল। যুদ্ধের ফলে উদ্বেগ, হতাশা ও দুশ্চিস্তা আমেরিকাবাসীর বৃহদংশের মধ্যে ছড়িয়ে ‘ পড়ে। যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক না কেন, ব্যাপারটি এ চিত্রকে পাল্টাতে পারে নি। ইতিমধ্যেই আমেরিকায়, বিশেষত শ্রমিকদের মধ্যে, সাম্যবাদী মতাদর্শের প্রসার ঘটেছে এবং কম্যুনিষ্ট সংগঠন তৈরী হয়েছে। বিগত শতাব্দীতে বির্বতনবাদ যেমন প্রধানত ধর্মের ভিত্তি মূলে নাড়া দিয়েছিল, এখন এই সাম্যবাদ ধর্মীয়-সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বৈপ্লবিক রূপান্তরের সম্ভাবনা নিয়ে উপস্থিত হয়। এসবের প্রতিক্রিয়ায়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বিদ্যালয়গুলিতেও ধর্মোপদেশের মধ্যে কম্যুনিজমএর প্রতি ভয়, শ্রমিক অসন্তোষ ও খুনজখম মারামারির ব্যাপারগুলি স্থান পায় ও আলোচিত হতে থাকে। আমেরিকার দ্বারা লীগ অব নেশনস ত্যাগ করার ঘটনায় এটি বোঝা যায় যে, বহু আমেরিকানই নতুন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পছন্দ করে নি। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের ফান্ডামেন্টালিস্টদের মধ্যেও এই মানসিকতা ও কম্যুনিজম-এর প্রতি ভীতি ইত্যাদি অন্যান্য অনেকেরই মত ছিলই, কিন্তু ছিল আরো তীব্রভাবে, এবং ছিল পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিগত বিচ্ছিন্নতাবোধও।
তবে প্রোটেস্টাণ্ট সংগঠনের সর্বত্রই যে ১৯২০-এর সময় এ ধরনের বিতর্ক, বিরোধ বা দোদুল্যমানতা ছিল তা নয়। সাউদার্ন ব্যাপটিস্টদের মত কোন কোন সংস্থায় আধুনিকতা (Modernism) স্পষ্টভাবে দেখা দেয় নি; মেথডিস্ট ও এপিস্কোপাল চার্চে এর অনেক প্রভাব ছিল। কিন্তু পুরনোর সঙ্গে নতুনের দ্বন্দ্ব যথেষ্ট সংগঠিত হয় নি, সংস্থাগুলির সরকারী গঠনতন্ত্রও ব্যাপারটিকে সামনাসামনি আনার মত প্রচার চালানোর উপযোগী ছিল না।
কিন্তু নর্দার্ন ব্যাপটিস্ট সহ উত্তরাঞ্চলের রাজ্যগুলির প্রেসবিটেরিয়ানদের মধ্যে গুরুতর বিতর্ক সৃষ্টি হয়। প্রেসবিটেরিয়ান চার্চের মধ্যে যে রক্ষণশীল গোঁড়া অংশে প্রিন্সটন সেমিনারীর ঈশ্বরতাত্ত্বিক অবস্থান প্রতিফলিত হয়, তারা মিলেনারিয়ানদের সাহায্য নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ রচনা করে এবং ১৯১০-এ যে অবস্থান ছিল তার সঙ্গে যুক্ত করে, তারা বলে যে, খৃস্টান ধর্মে বিশ্বাসী হতে হলে কয়েকটি দিককে অবশ্যই গ্ৰহণ করতে ও বিশ্বাস করতে হবে, যেমন, (১) বাইবেলের অবিসংবাদিত কর্তৃত্ব ও প্রেরণা, (২) কুমারী মায়ের থেকে খৃস্টের জন্ম (the virgin birth of Christ), (3) প্রায়শ্চিত্ত করা ও এর জন্য অনুষ্ঠানাদি, (8) পুনরভ্যুত্থান (resurrection) এবং (৫) যিশু খৃস্টের ঐশ্বরিক অলৌকিক ক্ষমতা। ১৯২২ সালে হ্যাঁরি এমারসন ফসডিক (Harry Emerson Fosdick) নামে নিউইয়র্কের এক যাজক মডানিস্ট-দের একজন প্রথম সারির মুখপাত্র হয়ে ওঠেন এবং বিদেশে মিশনারীদের কর্মক্ষেত্রে মিলেনারিয়ানদের কিছু কাজকর্মের (যেমন ফান্ডামেন্টালিস্টরা কি জিতবো?’ এমন শিরোনামে ধর্মোপদেশ দেওয়া) প্রতিবাদ করেন। কিন্তু এর ফলে ‘ফাস্ট প্রেসবিটেরিয়ান চর্চ’-এর প্যাস্টর-এর পদ থেকে, ব্যাপটিস্ট ফসডিক-কে রক্ষণশীলেরা ও মিলেনারিয়ানরা মিলে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়।
জেমস এইচ ব্রুকস (James H. Brookes)-এর মত মিলেনারিয়ানরা এবং প্রিন্সটন অধ্যাপক জে. গ্রেশাম মাচেন (J. Gresham Machen)-এর মত রক্ষণশীলেরা চাইছিলেন যাতে উদারনৈতিকেরা নিজে থেকেই সরে যায়। আমেরিকার প্রেসবিটরিয়ান চার্চের মধ্যে বিভাজন আটকাতে সমঝোতার একটি রাস্তা বের করানোর জন্য ১৫ জনের একটি কমিশন (Commission of Fifteen) নিয়োগ করা হয়। এঁরা রিপোর্ট দেন যে, প্রেসবিটেরিয়ান সম্প্রদায়ের মধ্যে মতামতের বৈচিত্র্যাকে সহ্য করার ঐতিহ্য রয়েছে। খৃস্টান ধর্মে বিশ্বাসের অত্যাবশ্যক দিকগুলি কি তা ঠিক করার জন্য সাধারণ সভাকে ক্ষমতা দেওয়ার ব্যাপারটিকেও তারা বাতিল কদের দেন। এর ফলে প্রধানত রক্ষণশীলদের অবস্থান ধ্বসে যায়। নর্দার্ন ব্যাপটিস্টদের অভ্যস্তরীণ বিরোধ তাদের বাৎসরিক সভায় প্রকাশ্যে আসে, যেটি একটি দলীয় রাজনৈতিক সভার চেহারা নিয়েছিল। ১৯২০ সাল থেকে ব্যাপটিস্টদের একটি গোষ্ঠী নিজেদের ‘ন্যাশন্যাল ফেডারেশান অব ফান্ডামেন্টালিস্টস’ (National Federation of Fundamentalists; মৌলবাদীদের জাতীয় জোট) নামে অভিহিত করতে থাকে। মৌল ব্যাপটিস্ট নীতির উপর এরা বাৎসরিক সভার অব্যবহিত পূর্বে সম্মেলনের আয়োজন করতে শুরু করে, এইভাবে সংগঠিত হয়ে নিজেদের মতামতকে তারা মূল সভায় নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। ‘ন্যাশনাল ফেডারেশান অব ফান্ডামেন্টালিস্টস’-এর এ ধরনের কৌশল খুব একটা কাজ দেয় নি; এর ফলে আরো কিছু জঙ্গী ব্যাপটিস্ট ফান্ডামেন্টালিস্টরা ‘ব্যাপটিস্ট বাইবিল ইউনিয়ন।’ (Baptist Bible Union) গড়ে তোলে। কিন্তু প্রেসবিটেরিয়ানদের মত ব্যাপটিস্টদের মধ্যেও ফান্ডামেন্টালিস্টদের নিজেদের মধ্যেকার বিভাজন তাদের পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ক্রমবর্ধমান বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ তথা ধর্মের ক্রমশঃ প্রমাণিত অপ্রাসঙ্গিকতা ইত্যাদির ফলে রক্ষণশীল গোঁড়ারা শামুকের মত মৌলবাদের আশ্রয় নেয় অর্থাৎ নতুনকে জোর করে অস্বীকার করে প্রাচীনকে আঁকড়ে রাখে। আমেরিকার ফান্ডামেন্টালিস্টরা ছিল। এরই আধুনিক সাংগঠনিক রূপ। ইয়োরোপের মধ্যযুগে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে এমন বাইবেল-বিরোধী। কিন্তু সত্যি কথা বলার জন্য কত মনীষী ও বিজ্ঞানীকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে, এমনকি হত্যাও করা হয়েছে। একই মানসিকতা থেকে এই বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, ১৯২০ সাল নাগাদ, বিবর্তনবাদ (evolution)-এর শিক্ষায় রুষ্ট হয়ে, বাইবেলের সমালোচনায় উদ্বিগ্ন হয়ে, আমেরিকায় ফান্ডামেন্টালিস্টরা জঙ্গী আন্দোলন শুরু করে। তারা মনে করত যে, চার্লস ডারউইন যে বিবর্তনবাদের তত্ত্ব উপস্থিত করেছেন তার সঙ্গে বাইবেলের শিক্ষা খাপ খায় না, তাই তারা বিবর্তনবাদের বিরোধিতা করে। কিন্তু মজার ব্যাপার ও লক্ষণীয় বিষয় এই যে, যাঁরাই বিবর্তনবাদের বিরোধিতা করতেন তারা সবাই যে ফান্ডামেন্টালিস্ট ছিলেন তা নয়। বিবর্তনবাদ-বিরোধী ‘যোদ্ধারা’ সরকারী স্কুলে বিবর্তনবাদ না পড়ানোর জন্য আইনপ্রণয়ন করতে প্রচার চালায়। টেনেসি (Tennesse)-তে এ ধরনের আইনও হয়ে যায়। অবশ্য পরে, ১৯২৫-এ, আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (ACLU)-এর উদ্যোগে আদালতে এটিকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়। ছোট্ট শহর ডেটন’ (Dayton)-এর জন টি. স্কোপিস (John T. Scopes) নামে এক বিজ্ঞান-শিক্ষক বিবর্তনবাদ পড়ানোর অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হিসেবে সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে আসেন। ঐ দশকের দুই বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, প্রেসবিটেরিয়ান ফান্ডামেন্টালিস্ট উইলিয়াম জেনিংস (William Jennings) ও বিখ্যাত মামলাগুলিতে প্রতিবাদী পক্ষের নামকরা উকিল ক্ল্যারেন্স ড্যারো (Clarence Darrow) ঐ সময় এই মামলায় সংবাদের শিরোনামে আসেন; প্রথম জনের ভূমিকা ছিল মামলা রুজু করে বাদী পক্ষের সহকারী অ্যাটর্নির এবং দ্বিতীয় জন ছিলেন প্রতিবাদী পক্ষের অ্যাটর্নি।