ইভানজেলিক্যাল প্রোটেস্টান্টদের রক্ষণশীল গোঁড়া চিন্তার মধ্যে মিলেনারিয়ানদের প্রভাবের একটি উল্লেখযোগ্য বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯০২ সালে। এই সময় বাইবেলের প্রতি দ্বিধাহীন আনুগত্য ঘোষণাকারী অন্যান্য গোষ্ঠীদের সহযোগিতায় মিলেনারিয়ানরা ‘আমেরিকান বাইবেল লীগ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ‘দি ফান্ডামেন্টালস’ নাম দিয়ে পরপর ১২টি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এই প্রথম ফান্ডামেন্টাল’ কথাটি একটি বিশেষ। ধর্মীয় তাৎপর্য বহন করে সাংগঠনিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু এই সব পুস্তিকার মধ্যেও তীব্র ঘূণা বা মনোরোগীসুলভ (hysterical) ধর্মীয় আবেগ ততটা ছিল না,-যা দেখা যায় এখনকার হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদীদের মধ্যে। তবে এগুলিতে বাইবেলকে পুন্যমূল্যায়ণ বা সমালোচনা করার তৎকালীন তত্ত্ব ও চিন্তাভাবনাগুলিকে আক্রমণ করা হয় এবং প্রিন্সটন সেমিনারীতে পাওয়া যুক্তির সাহায্যে বাইবেলের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়। বাইবেলের সমালোচনা ও আধুনিকতাকে যুক্তিতর্ক দিয়ে পর্যুদস্ত করার জন্য পূর্বসূরীরা যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন এই পুস্তিকাগুলি ছিল তারই সারসংক্ষেপ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই অর্থাৎ ১৯১৪ সালের মধ্যে নায়াগ্রা সম্মেলনের প্রতিষ্ঠাতা নেতৃবৃন্দের প্রায় সবাই মারা যান। নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব পূর্বসূরীদের মত আপন আদর্শে ততটা স্থির ছিলেন না, যতটা ছিলেন মিলেনারিয়ান মতাদর্শকে রক্ষণ করার ক্ষেত্রে আরো জঙ্গী ও আপোষহীন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকেই ঈশ্বরের প্রতিনিধি সম্পর্কিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রসঙ্গে মতবিরোধ প্রকাশ পাচ্ছিল। কিন্তু জেমস ব্রুকস বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীদের একত্রিত করে রাখতে পেরেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর কয়েকবছরের মধ্যেই নায়াগ্রা সম্মেলন বন্ধ করে দেওয়া হল এবং তার অল্প কিছু পরেই ‘ওয়াচওয়ার্ড অ্যাণ্ড টুথ’ ও ‘আওয়ার হোপ’ নামক দুটি মিলেনারিয়ান পত্রিকার মধ্যে কাগুজে লড়াই শুরু হয়ে গেল। এর ফলে মিলেনারিয়ান আন্দোলনে স্পষ্ট বিভেদ সৃষ্টি হয়। কিন্তু তার কাজ চলতেই থাকে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ক্রমবর্ধমান উদারনীতিবাদ (Liberalism) ও ধর্মীয় সামাজিক অবক্ষয়ের ব্যাপকতায় সন্ত্রস্ত হয়ে মিলেনারিয়ানরা নিউ ইয়র্ক ও ফিলাডেলফিয়ায় সম্মেলন ও সমাবেশের আয়োজন করেন এবং এর ফলশ্রুতিতে, ১৯১৯ সালে ‘ওয়ার্লডুস। ক্রিশ্চিয়ান ফান্ডামেণ্টলস অ্যাসোসিয়েশন’ (World’s Christian Fundamentals Association) নামে একটি বৃহত্তর ও অধিকতর কার্যকরী সংগঠন সৃষ্টির পথ সুগম হয়। এর ফলে মিলেনারিয়ান আন্দোলন তার মূল চরিত্র না পাল্টে নামটি পাল্টায়। উপরন্তু ১৯১৯-এর এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে যে সাংগঠনিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, তার উপর। পরবর্তী তিরিশ বছর ধরে মিলেনারিয়ানফান্ডামেন্টালিস্ট আন্দোলন দাঁড়িয়ে থাকে। আমেরিকার ফান্ডামেণ্টালিজম মতবাদের তথা ফান্ডামেন্টালিস্টদের সংগঠিত রূপ ছিল এই অ্যাসোসিয়েশন। এখনকার মৌলবাদ-মৌলবাদী কথাগুলির সৃষ্টি ও ব্যবহারের পেছনে এরই অবদান সর্বাধিক।
আধুনিকতা (Modernism)-এর সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ লড়াই এই সময় থেকেই বিশেষ মাত্রা পায়। নেতৃবৃন্দ আন্দোলনের ধর্মীয় ভিত্তিকে বারংবার জোর দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন, আধুনিকতা এবং তার সব ধরনের ‘অশুভদিক’কে (বিশেষত বিবর্তনবাদ-কে) বেঁটিয়ে বিদায় করার আহ্বান জানান। তারা বাস্তবত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে পরিহার করেন এবং সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত বাইবেল সংস্থায় (Bible Institutes-এ) তাঁদের আস্থা স্থাপন করেন। সব মিলিয়ে যেন মধ্যযুগের অন্ধকারাচ্ছন্ন ইয়োরোপের ধর্মীয় কুসংস্কারকে বিংশশতাব্দীতে আমেরিকার বুকে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা চলতে থাকে। (হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদীরা ভারত-বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে বিংশশতাব্দীর শেষ পাদে যা করতে চাইছে।)
তখন আমেরিকায় ‘ফেডারেল কাউন্সিল অব চার্চেস অব দি ক্রাইস্ট’ (The Federa Council of Churches of the Christ) নামক ধর্মীয় সংগঠন ধর্মীয় ক্ষেত্রে ঐক্য, মিলন ও সহযোগিতার কথা বলছিল। এই নব্য ফান্ডামেন্টালিস্টরা তীব্রভাবে তারও বিরোধিতা করে এবং এই ধরনের আধ্যাত্মিক অবক্ষয়।’ চলতে থাকলে আলাদা হয়ে যাওয়ার হুমকি দিতে থাকে। (ভারতের হিন্দু মৌলবাদীরা যেমন এই ধরনের মানসিকতা থেকে মুসলিম তোষণ’-এর অভিযোগ এনে প্রতিক্রিয়াশীল। লড়াই চালাতে চাইছে)। কিন্তু মিনিয়াপলিস-এর ‘ফাস্ট ব্যাপটিস্ট চার্চ’-এর আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা (প্যাস্টর; pastor) ডব্লু. বি. রিলে (W. B. Riley), ব্যাপটিস্ট প্যাস্টর ও ইভানজেলিস্ট এ.সি. ডিক্সন (A. C. Dixon) এবং মুডি বাইবেল ইনস্টিটিউট’ (Moody Bible Institute)-এর অধ্যক্ষ, ইভানজেলিস্ট আর. এ. টোরি (R. A. Torrey)-র মত ব্যক্তিবর্গের জঙ্গী নেতৃত্ব সত্ত্বেও তাদের এই সংস্থার কখনোই এমন কিছু উন্নতি ঘটে নি।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আমেরিকায় গির্জা তথা ধর্মীয় পরিমণ্ডলে উদারপন্থী ব্যক্তির সংখ্যা ছিল নগণ্য,-তাদের অধিকাংশই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় বা রোমান ক্যাথলিক যাজকদের শিক্ষণকেন্দ্ৰ (সেমিনারি)-র অধ্যাপক। আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে উন্নত সমালোচনাকে তাঁরা গ্রহণ করতেন। কিন্তু অধিকাংশ যাজক সম্প্রদায় ও ঐ ধরনের ব্যক্তিরা ব্যাপারটিকে আশঙ্কার চোখে দেখতেন। নব্য শিক্ষাকে খতিয়ে দেখার ক্ষেত্রে যেখানে আইনী ব্যবস্থা ছিল (যেমন প্রেসবিটরিয়ানদের মধ্যে), সেখানেই উদারপন্থীদের নতুন চিন্তাভাবনাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, যেমন ঘটেছে বাইবেলীয় ঈশ্বরতাত্ত্বিক চার্লস এ. ব্রিগস (Charlis A. Briggs; Str8 S-SSSO) এর ক্ষেত্রে। কিন্তু কয়েক দশকের মধ্যেই এ ধরনের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কৌশলগুলি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়, কারণ বাইবেলকে নতুনভাবে উপলব্ধি করার (তথা সমালোচনা করার) ব্যাপারটি মাথা চাড়া দিতে থাকে এবং নতুন প্রজন্মের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা সেমিনারিগুলি উদারনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে থাকে। ১৯১৪ সালের মধ্যে উত্তরাঞ্চলের এপিস্কোপাল, মেথডিস্ট, ব্যাপটিস্ট ও প্রেসবিটেরিয়ানদের মত কিছু খৃস্টীয় গোষ্ঠীর মধ্যে উদারনীতি (Liberalism)-এর অনেক সমর্থক সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই নতুন চিন্তাভাবনাকে প্রতিহত করার ও তার বিস্তার আটকানোর জন্য লড়াই করার অবস্থা তখন আর প্রায় ছিল না। ১৯২০ সাল নাগাদ শুধু এটুকু দেখা আর বাকি ছিল যে, এই উদারনৈতিকদের (Liberalsদের) সম্প্রদায় থেকে বের করা যায কিনা।