আমেরিকায় এ ধরনের মিলেনারিয়ান আন্দোলনের সূত্রপাতের সঙ্গে স্পষ্টভাবে সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তন, সংকট, ঘাত-প্ৰতিঘাত ও ঘটনাবলীর সম্পর্ক ছিল। আমেরিকায় ক্রমশঃ মাথা চাড়া দেওয়া শ্রমিক বিক্ষোভ, সামাজিক অসন্তোষ ও ক্রমবর্ধমান রোমান ক্যাথলিক অনুপ্রবেশের কারণে কিছু প্রোটেস্টান্ট নেতৃত্বের মধ্যে আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। (তুলনীয়, ভারতে মুসলিম অনুপ্রবেশ’-এর কারণে ভারতের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম ইত্যাদি বিপন্ন হচ্ছে বলে হিন্দু মৌলবাদীদের আশঙ্কা ও দেশের রুগ্ন অর্থনীতি ও কায়েমীস্বার্থের সামাজিক অবস্থানের অনিশ্চয়তা এই আশঙ্কা যথার্থ বলে বিশ্বাস করতে তাদের সাহায্য করে—যদিও এই রুগ্নতার কারণ তা নয়।) এছাড়া নতুনতর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঊনবিংশ শতাব্দীর অষ্টম দশকের শেষের দিকে ও নবম দশকে আমেরিকায় বাইবেলের মত তথাকথিত পবিত্র ধর্মগ্রন্থের সমালোচনামূলক মুক্তচিন্তার প্রচার ও প্রসারও তখন ঘটছিল; এর প্রতিক্রিয়াতেও ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তিদের একাংশ এই গোঁড়া, ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুসারী মিলেনারিয়ান আন্দোলনে আকৃষ্ট হন। এবং তাকে ধৰ্মরক্ষার (তথা দেশকে রক্ষার) একটি উপায় বলে বিশ্বাস করেন। (ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইয়ংবেঙ্গল বা রামমোহন-বিদ্যাসাগরের সমাজ-সংস্কারমূলক আন্দোলনের স্তর পেরিয়ে এবং তার প্রতিক্রিয়ায় এই বাংলাতেও গোঁড়া হিন্দুত্ববাদের আবির্ভাব ঘটে—বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শশধর তর্কচূড়ামণি জাতীয় বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে।)
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে প্রোটেস্টান্ট ইভানজেলিস্ট ডুইট এল মুডি (Dwight L. Moody; ১৮৩৭-৯৯)। নর্থফিল্ডে তার সমাবেশগুলিতে মিলেনারিয়ান চিস্তাভাবনার প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি প্রভাবশালী কর্মপন্থা উপস্থাপিত করেন। বিদেশে গিয়ে ধর্মপ্রচার তথা মিশনারী কাজকর্ম করাকে মিলেনারিয়ানরা সমর্থন ও উৎসাহিত করেন!! (হিন্দু বা মুসলিম মৌলবাদীরাও বিদেশের নানা স্থানে নিজেদের শাখা প্রতিষ্ঠা করছেন।) এর ফলশ্রুতিতে এ ধরনের মিশনারী উৎসাহ ও কাজকর্ম উত্তাল তরঙ্গের আকারে বিস্তার লাভ করে এবং একসময় তা ‘স্বেচ্ছাসেবী ছাত্র আন্দোলন’ (Student Volunteer Movement বা SVM) নামে বিশ্বষ সাংগঠনিক রূপ পায়। তাঁরা নিউ জার্সির প্রিন্সটনে প্রিন্সটন থিওলজিক্যাল সোসাইটি’ (প্রিন্সটনের ঈশ্বরতাত্ত্বিক সংস্থা)-র মধ্যে কিছু অধ্যাপক তথা বিদ্বান ব্যক্তিরও সন্ধান পান যাঁরা বাইবেলের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ও প্রেরণাকে কঠোরভাবে রক্ষা করতে আগ্রহী। প্রিন্সটনের এই অধ্যাপকদের মিলেনারিয়ানরা নিজেদের সভা-সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানান এবং বাইবেলের সমর্থনে তাদের বক্তব্যগুলিকে নিজেদের মত করে গ্রহণ করেন। বাস্তবত প্রিন্সটনের এই সব ব্যক্তিদের প্রায় কেউই মিলেরিয়ানদের মতবাদকে গ্ৰহণ করেন নি, কিন্তু উভয়পক্ষই বাইবেলের কর্তৃত্বের প্রশ্নে উভয়ের সমর্থনকে সম্মান জানান ও স্বীকার করেন।
(প্ৰসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, আমেরিকায় ধর্ম-কেন্দ্ৰিক আলোড়নের ঐ পরিবেশে এই সময় অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে, ১৮৯৩ সালে, আমেরিকার চিকাগো শহরে বিখ্যাত বিশ্বধর্ম সম্মেলন বা ধর্ম মহা সভা অনুষ্ঠিত হয়,-স্বামী বিবেকানন্দের কারণে এবং প্রচারের গুণে যার সঙ্গে ভারতীয়, বিশেষত বাঙালীদের, একটি আবেগগত। সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মিলেনারিয়ান আন্দোলন বা পরবর্তীকালের ফান্ডামেন্টালিজম’-এর সংকীর্ণ ও গোঁড়া মানসিকতা থেকে না হলেও এই ধর্মমহাসভার উদ্দেশ্য ছিল,-’একই সভায় বিভিন্ন ধর্মমতাবলম্বীদের প্রতিনিধিদের একত্রিত করে মত বিনিময় করা, বিভিন্ন খৃস্টান গোষ্ঠীদের সমন্বিত করা এবং পারস্পরিক সহানুভূতির সঙ্গে সবার কথা শোনা, জড়বাদীদের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ ধর্মীয় ফ্রন্ট’ গড়ে তোলা, বিশ্বের জন জীবনের উপর ধর্মের সুগভীর প্রভাব ব্যক্ত করা এবং বিভিন্ন দেশের ও ধর্মের মানুষের মধ্যে গ্ৰীতি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। সম্মেলনের দু’বছর আগে থেকে জন ব্যারোজ-এর সভাপতিত্বে এই ধর্মমহাসভার জন্য কমিটি গড়া হয়েছিল; এর পক্ষ থেকে বিশ্বের নানা স্থানে যে চিঠি দেওয়া হয়েছিল তাতেই তার এই উদ্দেশ্যগুলি লেখা ছিল। স্পষ্টত এর মধ্যে মিলেনারিয়ানদের সংকীর্ণ বা মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গী ততটা ছিল না, যতটা ছিল। উদারনৈতিক কিন্তু নিছক ধর্মীয় অনুপ্রেরণা। এলাহাবাদের জ্ঞানেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, কলকাতার হেবাবির্তনে ধর্মপাল, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার ও স্বামী বিবেকানন্দ সহ মোট ১৩ জন ভারতীয় প্রতিনিধি সশরীরে ঐ ধর্ম মহাসভায় উপস্থিত ছিলেন। মিলেনারিয়ান বা ফান্ডামেণ্টালিস্টদের মত বাইবেলের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য না থাকলেও, ঈশ্বরবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে। গড়ে ওঠা ধর্মের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য তাঁদের অবশ্যই ছিল। এই উদ্দেশ্যের একটি সার্থক রূপায়ণ ঘটে স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে। এই ধর্মমহাসভায় ও তার পরেই তিনি হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় নিরলস চেষ্টা করেন। কিছু সংস্কারমূলক, আপাত প্রগতিশীল, উদার ও কুসংস্কারমুক্ত কথাবার্তা মাঝে মাঝে বল্লেও, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ১৮৯৩-এর শিকাগো বক্তৃতার পরই বিবেকানন্দ কার্যত ঐক্যবদ্ধ, পেশীবহুল তথা জঙ্গী হিন্দুত্বের ভ্ৰাম্যমান দূতে পরিণত হন। এ কারণে এখনকার হিন্দু মৌলবাদীদের কাছে তিনি ও তাঁর কিছু সুবিধাজনক কথাবার্তা বেশ প্রিয়।)