পিছনে না তাকালেও বুঝতে পারছে, পিছনের সিটে বসা ছোট্ট রণিতা তাদের কথা শুনছে। কৌতূহল দমন করতে না পেরে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। সঙ্গে সঙ্গে রণিতা চোখ দুটোকে বাইরে পাঠিয়ে দিল। তবুও তার মুখে কেমন একটা বিস্ময় খেলা করতে দেখল। হয়তো এই দু’জন নরনারীর কী সম্পর্ক তা ভাববার চেষ্টা করছে। শিশুদের মন সব বিষয়েই বেশ সচেতন তা সে অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করেছে।
নিজের কথা ভেবেও রমিতা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। আজ একই গাড়ির যাত্রী হয়েও সে তার নিজের সন্তানকে ছুঁতে পারে না। আদর করে কোলে নিতে পারে না। মা বলে কোনও দাবি করতে পারে না। তবুও তো ওই শিশু তারই সন্তান। আর অনুতোষ! অনুতোষের সঙ্গেও এই মুহূর্তে তার কোনও সম্পর্ক নেই। একদিন যে অনুতোষের সঙ্গে তার সবচেয়ে মধুর সম্পর্ক ছিল, আজ তারই পাশে বসে আছে সম্পর্কহীন পরিচয়ে। এসব ভাবতে ভাবতে, হতাশায় ভাঙতে থাকে সে। এক সময়ে গাড়ি এসে পৌঁছে যায় স্কুলের সামনে।
স্কুলের কাজ মিটে যায় সহজেই। রণিতা তার সঙ্গে কথা বলেনি একটাও। সেও বুঝতে পেরেছে তাদের তিনজনের মধ্যে একটা নাটকের অভিনয় চলছে। যাকে ছোটবেলা থেকে কোনওদিন দেখেনি, তাকেই হঠাৎ মা বলে হাজির করানোর মধ্যে সে একটা মিথ্যে সাজানো ঘটনার আঁচ পেয়ে গেছে।
মা বাবা সম্পর্কে সে স্কুলের অধ্যক্ষার কাছে সন্তোষজনক উত্তর দিলেও, রমিতাকে মেনে নেয়নি। একটা দূরত্ব থেকে গেছে তার আচরণে। কাজ মিটে যাবার পরে অনুতোষের অনুরোধে তার ফ্ল্যাটে যাওয়ায় আপত্তি করেনি রমিতা। মনের মধ্যে মেয়ের সান্নিধ্য পাওয়ার ইচ্ছাটাকে দমন করতে পারেনি।
অনুতোষের ফ্ল্যাট বেশ বড়ই। উচ্চ-পদস্থ কর্মীর ফ্লাট যেমন হয়। আভিজাত্যের ছাপ সর্বত্র। আধুনিক আসবাবপত্রে একটা বৈভবের ছায়া। বসবার ঘরটিতে ঢুকেই বুঝতে পারে অনুতোষ এখন অনেক উপরে উঠে গেছে।
তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনুতোষের কণ্ঠে মৃদু অনুরোধ ঝরে, তুমি বোসো! আমি চায়ের কথা বলে আসছি।
বলেই ভিতরে চলে যায় সে। রণিতা এক পাশে দাঁড়িয়ে। তার চোখের সন্দেহ এখনও প্রকট। রমিতা সহজ হতে চেষ্টা করে তাকে কাছে ডাকে, এসো। তোমার সঙ্গে গল্প করি।
রণিতা তার ডাকে সাড়া দেয় না। তেমনি দূরেই দাঁড়িয়ে থাকে। রমিতা তাকে দ্বিতীয়বার ডাকতে সাহস পায় না। সে বুঝতে পারছে, ওই ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গে এখন তার দূরত্ব অনেক। সেই দূরত্ব কমানোর ক্ষমতা তার নেই। মা হিসেবে তার কোনও দাবি ওর কাছে নেই। ওরা যেন দুই ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ভিতরে চলে যায় রণিতা। সে বুঝে গেছে এই মহিলাকে তার বাবা স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে নিয়ে এসেছে, সে কাজ শেষ। এরপরেই তার চলে যাওয়ার সময় এসেছে। এর বেশি প্রয়োজনীয়তা রমিতার নেই। আর পাঁচজন অচেনা মহিলার মতো সেও এদের কাছে অচেনা, অজানা।
একটু পরেই ফিরে আসে অনুতোষ। কাজের মেয়েটা জলখাবার নিয়ে ঘরে ঢোকে। রমিতা এখন অনুতোষের বাড়িতে অতিথি। অথচ একদিন এই সংসারে তার অধিকার ছিল স্বীকৃত। যন্ত্রের মতো চায়ের কাপ তুলে নেয় সে। অনুতোষের কণ্ঠে অনুযোগ ফোটে, একী! একটু কিছু মুখে দাও।
না শুধু চা-ই ভাল।
অনুতোষ দ্বিতীয়বার অনুরোধ করতে পারে না। তাদের মধ্যে একটা আড়ষ্টতা কাজ করে। নিঃশব্দে চায়ের কাপে চুমুক দেয় দুজনে। তাদের জীবনের সব কথা যেন শেষ হয়ে গেছে। মনের দরজায় তালা পড়ে গেছে। শত চেষ্টা করেও তার চাবি খুঁজে পায় না কেউ। বয়সের ভারে অভিজ্ঞ দুটি মন আজ একটি নিরেট কাঁচের দেয়ালের দু’পাশে বসে আছে। কারোর মধ্যে সে দেয়াল ভেঙে ফেলার মতো কোনও শক্তিও নেই, প্রচেষ্টাও নেই। বয়সের সঙ্গেই মানুষ তার উৎসাহ আর উদ্যমকে হারিয়ে ফেলে। তারাও আজ তেমনি নিঃস্ব দুটি মন। তাদের যেন করার কিছুই নেই।
চা শেষ হয়। রমিতা এবার উঠে দাঁড়ায়। তার যাবার সময় হল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, অনেক সময় কেটে গেছে। অনুতোষের কাছে অনুমতি চাওয়ার মতো করে বলল, এবার আমি উঠি।
ও হ্যাঁ! অনুতোষও উঠে দাঁড়ায়। তারপর হঠাৎ মনে পড়ার মতো করে বলে, দাঁড়াও তোমার টাকাটা।
কিসের টাকা?
তোমার পারিশ্রমিক।
পারিশ্রমিক দিতে চাইছ! একটা ম্লান হাসি ফুটে ওঠে রমিতার কণ্ঠে, এটা তুমি ভাবলে কী করে?
না! মানে, সে রকমই তো কথা ছিল। কিছুটা দ্বিধায় পড়ে বলে অনুতোষ, তুমি নিজেই তো…
কথা শেষ করতে পারে না সে। তার আগেই রমিতা কথা বলে, আমি বলেছিলাম। দেখলাম তুমি আমার মেয়ের জন্য কতটা ভাব। আর তখন তো আমি শিওর ছিলাম নারণিতা আমারই মেয়ে। নিজের মেয়ের মা সাজার জন্য টাকাটা নাই বা নিলাম।
দরজার পাশ থেকে ছোট্ট একটা ছায়া যেন সরে গেল। রমিতা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, মেয়ের প্রতি আমার কোনো দাবি নেই। সেদিন যেভাবে তাকে ছেড়ে যেতে হয়েছিল, তাতে আমার অযোগ্যতাই প্রমাণিত। তবুও তো আমি ওর মা-ই। কিন্তু মা হিসেবে ওর কাছে আমার কোনও জায়গা নেই আমি জানি। আমার সত্যিকারের পরিচয় ওকে না-ই বা দিলে। ওকে বোলো, ওর মা মরে গেছে। আমি কখনই ওর সামনে মায়ের দাবি নিয়ে আসব না। ও একমাত্র তোমার মেয়ে হয়েই বেঁচে থাকুক।
কান্নায় রমিতার গলা বুজে এল। অনুতোষ কথা বলতে পারে না। সেদিনের সেই জেদি তরুণীকে খুঁজে পায় না কোথাও। আজকের রমিতার মধ্যে প্রাজিত মাতৃহৃদয়ের বিষাদ ঘনিয়ে আসতে দেখল আনুতোষ। সেদিনের সেই ঔদ্ধত্য যেন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অনুতোষের করার কিছু নেই। সেও আজ শক্তিহীন। অসহায় অথর্ব মানুষ হয়ে গেছে কখন, বুঝতেই পারেনি। নিশ্চল আনুতোষকে ও কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায় রমিতা। দরজার চৌকাঠেতে পা রাখতেই সে নিশ্চল মূর্তির মতো থেমে গেল হঠাৎ। বদ্বার ঘরের ভেতরের দরজায় তখন একখানি কচি মুখের উপর দুটি কালো ছলছলে চোখ নিয়ে রণিতার কণ্ঠ আছড়ে পড়েছে মা তুমি যেও না। আমি সব শুনেছি। তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না মা। আমি সব জানি। তোমাকে আমি কিছুতেই যেতে দেব না।