সেই ভাল। অমল চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, বলার তো কিছু নেই। তোমাকে তো আগেই বলেছি। এবার তুমি মিঃ গুহর সঙ্গে কথা বলে নাও। কবে যেতে হবে, কী করত হবে? কী বলেন মিঃ গুহ।
হ্যাঁ! মানে…নিজেকে সামলানোর প্রচেষ্টা অনুতোষের কণ্ঠে। এতক্ষণে সে পরিস্থিতির সঙ্গে অনেকটা মানিয়ে নিয়েছে বোঝা গেল। নিজেকে সংযত করে বলল, আমার মেয়ের স্কুলে ভর্তির জন্য একদিন আপনাকে ওর মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে।
অভিনয়! কথাটা কানে একটা বিদ্রুপের খোঁচা দিল। আমার মেয়ে বলে অনুতোষ যেন তাকে একটু আঘাতও করল। আজ মেয়েটি শুধুই অনুতোষের। রমিতার কোনও অধিকারই সেখানে নেই। সে অনুতোষের চোখে চোখ রাখল। অনুতোষের অপরাধী দৃষ্টি জানালার বাইরে যেন আড়াল খুঁজতে চাইছে। রমিতা মনে মনে ভাবল, অভিনয় তো বটেই। এখন অনুতোষ আর সে তো অভিনয়ই করছে। তারা দুজন সুদক্ষ অভিনেতা অভিনেত্রী, আর অমন তদর সামনে বসে আছে অজ্ঞ দর্শকের মতো। রমিতা ভাবল, মানুষ তার মনের দিক থেকে কত নিরাপদ। এখন অনুতোষ আর তার কথা অমল কিছুই জানতে পারছে না। সেই কি জানতে পারছে অনুতোষের কথা? নাকি কোনও দিন পেরেছে? মানুষ তার মনের মধ্যে সম্পূর্ণ একা। সেখানে কারও ঢোকার ক্ষমতা নেই। সকলেই এক একটা মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে। রমিতা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কেন? আপনার স্ত্রী! মানে মেয়ের মা পারবেন না ইন্টারভিউ দিতে?
রমিতার প্রশ্নে চোখ তোলে অনুতোষ। ইঙ্গিতটা বুঝতে একটু সময় নেয়। তারপর ধীর কণ্ঠে জবাব দেয়, ওর মা এখানে নেই। সেসব অন্য কথা। আপনি যদি এই কাজটা করে দেন, আমি উপকৃত হব।
উনি তোমাকে তোমার পারিশ্রমিক দেবেন। অমল মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করে।
পারিশ্রমিক! রমিতার কণ্ঠে একটু বিদ্রূপ খেলে যায়। অনুতোষ তার মেয়ের জন্য আজ তাকে টাকা দিতে চায়। পারিশ্রমিক। হ্যাঁ তাতো দিতেই পারে, তাদের মধ্যে তো এখন তার কোনও সম্পর্ক নেই। তারা পরস্পরের কাছে অচেনা, অজানা।
হ্যাঁ। তোমার কথা মতো বলেছি। উনি তাতে রাজি।
কত দেবেন? প্রশ্নটা অমলকে করলেও বাঁকা দৃষ্টি একবার অনুতোষকে ছুঁয়ে যায়। অনুতোষ চুপ করে থাকে। কথা বলে অমল, কত চান?
মূল্য দিয়ে মানুষের সব প্রয়োজন মেটে কিনা জানেনা রমিতা। কিন্তু তার মনে পারিশ্রমিকের প্রসঙ্গে একটা অভিমান খেলা করে। নিজের কথা মনে করে তার জেদি স্বভাবের ঘোড়াটা যেন তীব্রবেগে ছুটতে তাকে। ছুটতে ছুটতে তা এক সময়ে ঘৃণায় পরিণত হয়। মনের উপরে একটা কঠোর আবরণ টেনে দিয়ে বলে, পাঁচশো টাকা।
বেশ তাই হবে। অনুতোষ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চাইল। পারিশ্রমিকের কথা বলে রমিতা নিজের চাহিদা প্রকাশ করায় তার আড়ষ্টতা কেটে গেল। কথা আর বেশি দূর এগোল না। ইন্টারভিউয়ের দিন, ঠিক সময়ে এসে রমিতাকে তার গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবে অনুতোষ। আবার কাজের শেষে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাবে। ওরা উঠল। রমিতার বুকের মধ্য একটা পুরনো ঘা থেকে টুপটাপ করে নিঃশব্দে রক্ত ঝরতে লাগল।
***
সকাল সাড়ে দশটায় অনুতোষ গাড়ি নিয়ে এল। রমিতা তৈরি হয়েই ছিল। পায়ে পায়ে গাড়ির কাছে এগিয়ে গেল। গাড়ির পিছনের সিটে ছোট্ট মেয়েটিকে বসে থাকতে দেখেই তার বুকটা দুলে উঠল। এই কি তার মেয়ে? জানে না সে! জানলেও চেনা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অনুতোষ মেয়েকে ডেকে বলল, রণি! তামার মা! রণির চোখে অবিশ্বাস আর সন্দেহ একই সঙ্গে তাকে যাচাই করতে চাইল, অনুতোষ রমিতাকে বলল, তোমার মেয়ে রমিতা।
রমিতার মনে একটা মৃদু কম্পন খেয়ে যায়। তার মেয়ে। আজ তার মেয়েকে তারই সঙ্গে পরিচয় দিয়ে চিনিয়ে দিতে হচ্ছে। বেশ মিষ্টি চেহারা। বাবার আদল পেয়েছে ঠিক। নামটা তারই নামের সঙ্গে মিলিয়ে রেখেছে। না রাখলেও কোনও ক্ষতি ছিল না। কিন্তু এই সামান্য কারণে কোথায় যেন অনুতোষের হৃদয়ের স্পর্শ অনুভব করল মনে মনে।
অনুতোষের আচরণে আজ কোনও জড়তা নেই। অনেকটা সহজেই আগের এলে ‘তুমি’ সম্বোধন করল। রমিতা হাসতে চেষ্টা করল, তবে সে হাসি রণিতার সন্দিগ্ধ চোখের দিকে তাকাতেই কেমন শুকিয়ে গেল। অনুতোষ মেয়ের দিকে ঝুঁকে বলল, রণি! সত্যিই তোমার মা। একটু সরে মাকে বসতে দাও।
না! আমি একলাই বসব। রণিতার কণ্ঠে তীব্র জেদ। তার মতোই জেদি হয়েছে মেয়েটা। রমিতা সহজ হতে চাইল, থাক না। আমি সামনেই বসছি।
রমিতা সামনে উঠে বসল। একবার পিছন ফিরে দেখল। রণিতা বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। তবে মনটা যে এদিকে তা বোঝা যায়। অতটুকু মেয়ে হলেও সে নিশ্চয়ই জেনে গেছে, রমিতা একদিনের জন্যই তার মা সাজতে এসেছে। অনুতোষ গাড়িতে স্টার্ট দিল। রমিতা পথ চলার অস্বস্তিকে ভেঙে দিতে চাইল, তোমার আর ছেলে-মেয়ে?
তুমি হয়তো জান না, আমি আর বিয়ে করিনি।
যা স্বাভাবিক, তার বিরুদ্ধ ধারণায় মানুষ হোঁচট খায়। রমিতা ভেবেছিল, অনুতোষ আবার বিয়ে করে থাকবে। হয়তো স্ত্রী দেশের বাড়িতে থাকে। এবার তার কণ্ঠে সহানুভূতি ফোটে, কেন? এভাবে জীবন কাটানোর চেয়ে একটা বিয়ে করলেই পারতে!
তা পারতাম। তবে রণির কথা ভেবে আর করিনি।
রমিতা কী বলবে খুঁজে পেল না। অনুতোষ আগের থেকে অনেক সহজ, তুমিও তো করোনি?
আমার ব্যাপারটা অন্য। ইচ্ছে করলেও আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়। মা অথর্ব হয়ে আমার কাঁধে ভর করেই বেঁচে আছে। তাছাড়া মনকে মানিয়ে নিতে পারতাম না বলেই ওসব চিন্তা ছেড়ে দিয়েছি।