অনুতোষ কয়েকবার তার সঙ্গে দেখা করেছিল। ফিরে যেতে অনুরোধও করেছিল। তার কোনও অনুরোধেই আর সাড়া দেয়নি সে। শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেল দু’বছরের মাথায়। নতুন এক অধ্যায়ের শুরু হল তার জীবনে। মেয়ের জন্য মনের কষ্টটাকে গলা টিপে মেরে ফেলে দিতে চেয়েছে। পারেনি। তবুও সে সব ভোলার জন্য অনেক চেষ্টায় একটা অফিসে চাকরি জুটিয়ে নিল। মা তাকে আবার বিয়ে করতে বলেছিল। রাজি হয়নি সে। পাছে সে ঘরও ভেঙে যায়। হয়তো সে ভয়ও একদিন থাকত না। তার আগেই মা অসুস্থ হয়ে তার ঘাড়ের বোঝা হয়ে রইল। এখন প্রায় অথর্ব। অসহায় বৃদ্ধার সে-ই একমাত্র সম্বল। মায়ের কথা ভেবেই আর বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে মাথা ঘামায়নি।
অনুতোষ তার জীবন থেকে হারিয়েই গিয়েছিল। ধরেই নিয়েছে, নতুন করে সংসার পেতে সুখেই আছে। আবার সে যে বদলি হয়ে কলকাতায় এসেছে খবরও তার জানার কথা নয়। জানার প্রয়োজনও ফুরিয়ে গেছে তার কাছে। অসুস্থ মায়ের সেবা আর চাকরিটাই একমাত্র বর্তমান হয়ে আছে তার জীবনে। অতীতও নেই, ভবিষ্যৎ নেই।
তবুও কয়েকদিন আগে তার অফিসের সহকর্মী অমলের কাছ থেকে একটা অদ্ভুত প্রস্তাবে, নানা করেও রাজি হয়েছিল সে। অমল জানাল, তার এক পরিচিত ভদ্রলোক ছোট্ট একটি মেয়েকে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করতে চান। কিন্তু তিনি একটু বিপদে পড়েছেন।
রমিতা বলল, বিপদটা কী?
যে স্কুলটায় ভর্তি করাতে চাইছে, সেখানে মেয়ের মা বাবার একটা ইন্টারভিউ নেবে।
কেন? মা বাবার ইন্টারভিউ কেন?
ওঃ মিতাদি। তুমি আজকাল কোনও খবরই রাখে না দেখছি। অমল তাকে বুঝিয়ে বলল বিষয়টা। আজকাল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ছেলে মেয়েকে ভর্তি করাতে গেলে, বাবা-মাকেও তারা যাচাই করে দেখবে। দেখবে সেখানে ছেলে-মেয়ে পড়ানোর মতো শিক্ষা এবং কালচার তাদের আছে কিনা।
রমিতা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া মেয়ে। কিন্তু এখন তার ধরন ধারণ অনেক পালটে গেছে। সেসব খবর সত্যিই সে রাখে না। এখন ছেলে মেয়ের পড়াশোনার ক্ষেত্রে বাবা মায়ের ভূমিকা আগের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাবা মাকে যাচাই করবার দু-একটা ঘটনার কথা সে শুনেছে তবে ও নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি। অমলের কাছে শুনল ভদ্রলোক মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করতে চান। কিন্তু সেক্ষত্রে বিপদটা কোথায়? অমলের কথায় জানতে পারে, এই ভদ্রলোকের মেয়ের মা সেজে তাকে ইন্টারভিউ দিতে হবে। তাকে সাজতে হবে কেন? সন্দেহটাকে সে গোপন করতে পারেনি। অমলকে জিজ্ঞেস করে রমিতা, আমাকে সাজতে হবে কেন? মেয়েটির কি মা নেই?
তা ঠিক জানি না। অমল তাকে ঠিক সংবাদ দিতে পারে না, হয়তো ওর মা তেমন লেখাপড়া জানে না। তুমি রাজি হও মিতাদি। ভদ্রলোক খুব মুশকিলে পড়েছেন।
অমলের অনুরোধ এড়াতে পারেনি সে। ছেলেটিকে সে ছোট ভাইয়ের মতো। স্নেহ করে। তাতেই ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে অমল এসেছে তার কাছে। ভদ্রলোক যে অনুতোষ তা সে এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে কি তাকে তারই মেয়ের জন্য অভিনয় করতে হবে। অনুতোষ কি সত্যিই আর বিয়ে করেনি? না কি যাকে বিয়ে করেছে সে বেশি লেখাপড়া করেনি। কিছুই বুঝে উঠতে পারে না রমিতা। প্রথমে ভাবল, আমলকে ডেকে না করে দেয়। অনুতোষের সঙ্গে এভাবে আবার মুখোমুখি হতে ইচ্ছে নেই তার। পরক্ষণেই মনে হল, যদি তারই মেয়ের জন্য এসে থাকে? তার কি না করা সাজে? অনুতোষের সঙ্গে তার আজ আর কোনও সম্পর্ক না থাকলেও, মেয়েটি তো তার নিজের। মেয়ের ভাল করার দায়িত্ব তারও তো কম নয়। দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলায় মনটা দুলে ওঠে। কিন্তু যে মেয়েকে সে নিজের ভাবছে, সেকি তার নিজের আছে? সে কি তাকে মা বলে কোনও দিন স্বীকার করতে পারবে। হয়তো তার কাছে রমিতা আজ মৃত। মেয়ের কাছে তার অস্তিত্বই আর নেই। তবুও কোথাও যেন একটা দুরন্ত ইচ্ছা তাকে তিল তিল করে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে তার দৃঢ়তার আসন থেকে। না এভাবে সে হেরে যেতে চায় না। যে অবস্থার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তাকে আর অস্বীকার করার কোনও পথ নেই। মনকে গুছিয়ে নিল। কাজের মেয়েটিকে চায়ের কথা বলে বাইরের ঘরে এসে ঢুকল। অমল তাকে দেখেই বলল, এই যে মিতাদি! তোমাকে যার কথা বলেছি,—মিঃ গুহ। অনুতোষ গুহ। আর উনি মিতাদি!
হাত তুলে নমস্কার করল সে। অনুতোষও দ্বিধাগ্রস্তের মতো হাত তুলে নিশ্চল হয়ে বসে রইল। অনুতোষের দিকে চোখ ফেলে নিমেষে অনেককিছু দেখে নিল সে। আগের থেকে চেহারায় পরিবর্তন এসেছে। বয়সের ছাপ পড়েছে মুখের রেখায়। কানের পাশে চুলে সাদা রঙের ছোঁয়া লেগেছে। একটু হয়তো বা মুটিয়ে গেছে। অমলের কাছে শুনেছে চাকরিতে পদমর্যাদা বেড়েছে। না বাড়ার কোনও কারণ নেই; ছেলে হিসেবে অনুতোষ তো কোনওদিন খারাপ ছিল না।
ঘরের মধ্যে একটা অপ্রস্তুত নীরবতা। যাকে ঠিক সহ্য করতে পারছিল না সে। এভাবে সবার চুপ করে যাওয়া বেমানান। কী কথা বলবে? কীভাবে বলবে? ঠিক করে উঠতে পারে না রমিতা। একদিন ও মানুষটির সঙ্গে কলকাতার বহু জায়গায় ঘুরে ঘুরে কথা ফুরত না, অপ্রয়োজনীয় কথাও কত দরকারি মনে হত, আজ তার মুখোমুখি বসে প্রয়োজনীয় কথাই খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ এভবে বসে থাকার কোনও মানে নেই। কিছু একটা বলা দরকার। কে বলবে? কী বলবে? কীভাবে বলবে? ভাবতে ভাবতেই চা নিয়ে ঘরে ঢুকল কাজের মেয়েটি। রমিতা চায়ের কাপ এগিয়ে দিল দু’জনের দিকে। চায়ের কাপ তুলে দিতে দিতেই কিছুটা স্বাভাবিক হল সে। অমলকে উদ্দেশ্য করে কথা বলল, চা খেতে খেতে কাজের কথা হোক! কী বল?