একদিন সে নগরীর বাইরে বেড়াতে-বেড়াতে সেই উদ্যানবাটীতে প্রবেশ করলে। সেই শৈবালাচ্ছাদিত পাষাণবেদী, সেই লতাগৃহ, সেই যক্ষমূর্তি-শোভিত বাপীতট—সব তেমনি আছে। যেন কতকাল আগের স্বপ্ন! একদিন সেই রূপসীকে যেন স্বপ্নে দেখেছিল এখানে—সেই বসন্তকালের পুষ্পসৌরভ, সেদিনকার সে সন্ধ্যাটি—সব যেন হিপোলিটাসের সেই করুণ কবিতাটি স্মরণ করিয়ে দেয় —’আপেলগাছের ছায়া, রূপসী-কণ্ঠের গান, সুবর্ণের দ্যুতি—’ প্রথম যৌবনের হারানো দিনগুলির দূরাগত বংশীধ্বনি। হায় ভারতীয় দেবতা বাসুদেব, তোমার পাষাণদেউলের মতো তুমিও কি কঠিন? কিংবা আমি গ্রিক বলে, বিধর্মী বলে আমায় অবহেলা করলে? কথা কানে তুললে না? সে আজ নেই, সে রূপসী কোনো দূররাজ্যের রাজমহিষী। জীবনে আর তার সঙ্গে দেখা হবে না, সে জানে। কেউ বসে নেই তার জন্যে তিন বৎসর পরে।
৫.
আবার বসন্তকাল। সুদীর্ঘ তিন বৎসর পূর্বে এই বসন্তকালে এই সময় মালবিকার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল। হেলিওডোরাস কি মনে করে এবার ঠিক তেমনি প্রস্ফুটিত কুসুমগন্ধে আমোদিত পথ দিয়ে যেতে যেতে রথ থামিয়ে সেই উদ্যানটিতে প্রবেশ করলে। কতদিন এখানে আসেনি। সম্পূর্ণ বাস্তব এই পাষাণবেদী। স্বপ্ন তো নয়—বিশাল রাজপুরীর অন্ত :পুর-প্রান্তে সেই রূপবতী রাজনন্দিনীও তো স্বপ্ন নয়। এখানে এসে তবুও যেন কেমন একটু স্পর্শ…একদিন এখানকার এই মৃত্তিকায় তো সে এসে দাঁড়িয়েছিল। আজ সে হয়তো বিবাহিতা— কোনো দূর রাজ্যের রাজমহিষী।
কতক্ষণ কেটে গেল। অপরাহু অবসান-প্রায়। বনলক্ষ্মী স্নিগ্ধ বাতাস কুসুমগন্ধে ভরেঃদিয়েছেন।
হিপোলিটাসের সেই কবিতা—’আপেলগাছের ছায়া, তরুণীকণ্ঠের গীতধ্বনি, সুবর্ণেরদ্যুতি—’
হঠাৎ পাষাণবেদিকার পিছনে বৃক্ষশ্রেণীর মধ্যে কার পদধ্বনি শোনা গেল। তবে কি সেই কৃষ্ণকায় উদ্যানরক্ষক, যাকে একবার সে কিছু পুরস্কার দিয়েছিল! মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখেই হেলিওডোরাস স্তব্ধ হয়ে রইল বিস্ময়ে, ঘটনার অপ্রত্যাশিত আকস্মিকতায়। সেই অপরূপ রূপসী তরুণী স্বয়ং।
হেলিওডোরাস উঠে দাঁড়াল। মেঘাবরোধ ছিন্ন করে বিদ্যুৎশিখা একেবারে তার সামনে—কতদিনের স্বপ্নে চাওয়া তার সেই মানসী প্রতিমা! দীর্ঘ তিন বৎসরে তার রূপ একটুকু ম্লান হয়নি—বরং বেড়েছে।
তার চেয়েও আশ্চর্য, তরুণী তার দিকে চেয়ে হাসিমুখে বল্লে–ও, আপনি!
হেলিওডোরাসের ঘোর তখনও যেন কাটেনি—মাথা ও শরীর ঝিমঝিম করচে। সে উত্তর দিল, হাঁ ভদ্রে—
মেয়েটি বল্লে—আপনি অনেকদিন এদিকে আসেননি—আপনি ছিলেন না এখানে তাও জানি। হূণদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন—বীর আপনি, কিন্তু ফিরেছেন কবে তা শুনিনি।
হেলিওডোরাসের গ্রিক রক্ত শরীরের মধ্যকার শিরায় উপশিরায় আগুন ছুটিয়ে দিলে। সে স্থিরদৃষ্টিতে তার প্রেমাস্পদার দিকে চেয়ে বল্লে—আমি ফিরে এসেছি এবং এই উদ্যানেও এসেচি কয়েকবার—কিন্তু আপনাকে দেখিনি—
মেয়েটি অবাক হয়ে বল্লে—আমাকে?
—আপনাকে খুঁজেছি যে—এই তিন মাস ধরে। গান্ধার থেকে ফিরে পর্যন্ত কতদিন এসেছি।
মেয়েটির মুখে যেন অতিঅল্প সময়ের জন্য কীসের দীপ্তি, ওর শ্বেতপদ্মের আভাযুক্ত গণ্ডস্থল যেন অতিঅল্প সময়ের জন্য রক্তিম হয়ে উঠল—সে বল্লে আচ্ছা, আমি শুনেছি, আপনি নাকি যুদ্ধে যাওয়ার পূর্বে বাসুদেবের মন্দিরে যাতায়াত করতেন প্রায়ই
—হ্যাঁ, ভদ্রে—কে বল্লে?
—সবাই বলে। আপনি গ্রিক, আপনার ওখানে যাতায়াত নিয়ে নগরীর লোকজনের মধ্যে একটা কৌতূহলের সৃষ্টি হবেই তো—আপনি কি আমাদের দেবতা মানেন?
—মানি। আজ বিশেষ করে মানচি। বাসুদেব অতিদয়ালু দেবতা, মানুষের প্রার্থনা উনি শোনেন, আজ বুঝলাম।
মেয়েটি বিস্ময়ের সুরে বল্লে—আজ? কেন?
—আজই। অভয় দেবেন ভদ্রে? মার্জনা করবেন একজন বিদেশি লোকের প্রগলভতা?
মেয়েটির মুখ হঠাৎ যেন বিবর্ণ হয়ে গেল, পরক্ষণেই সে-মুখে সাহস ও কৌতূহলের দীপ্তি ফুটে উঠল—সেই সঙ্গে যেন লজ্জাও। মেয়েটি যেন আগে থেকে অনুমান করেছে—সে কি শুনবে এই রূপবান গ্রিক যুবকের মুখ থেকে।
হেলিওডোরাস বল্লেভদ্রে, আপনাকে আর একটিবার দেখব এই প্রার্থনা করেছিলাম দেবতার কাছে।
মেয়েটি রক্তিম মুখে চুপ করে রইল মাটির দিকে চেয়ে। কি দীপ্তিময়ী, মহিমময়ী মূর্তি! নিবিড় কৃষ্ণ কেশপাশে সেদিনকার মতোই রক্তজবা ও যূথীগুচ্ছ। গ্রীবার কি অদ্ভুত ভঙ্গি!
হেলিওডোরাস বল্লে—আপনাকে না-দেখলে বাঁচব না। আমি এই তিন বৎসর উদভ্রান্তের মতো বেড়িয়েছি।
মেয়েটি প্রসন্নহাস্যে বল্লে—কি হবে দেখে বলুন।
দেবী যেন জাগ্রতা হয়ে উঠেছেন—এই অদ্ভুত প্রসন্ন হাসির মধ্য দিয়ে অন্তরশয্যা থেকে সদ্যজাগ্রতা প্রেমের ও করুণার দেবী যেন মূর্ত হয়ে উঠেছেন।
হেলিওডোরাস সহাস্যে বল্লে—শুধু দেখব দেবী, আমার হৃদয়ের সমস্ত অর্ঘ্য–যদি কোনোদিন—
—এই জন্যে যেতেন আপনি বাসুদেবের মন্দিরে? ঠিক বলচেন?
—মিথ্যা বলিনি। কত পূজো দিয়েচি পূজারিদের হাতে—আর—
হেলিওডোরাস কুণ্ঠিত মুখে চুপ করে রইল।
—আর কি?
—মনোবাসনা পূর্ণ হলে বাসুদেবকে মূল্যবান কিছু উপহার দেব–।
রাজকন্যার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। বাসুদেব ওর মূল্যবান উপহার পাবার প্রত্যাশা করেন কিনা! এই বিদেশি যুবক বড়ো সরল, মায়া হয় ওর ওপর।
মুখে বল্লেন মৃদু হেসে—তারপর বাসুদেবকে ভুলে যাবেন বুঝি?