দেখে সত্যিই কষ্ট হল। দারিদ্র্যের কালিমাখা হাতের ছাপ ঘরের আসবাবপত্রে, মলিন বিছানায়, ছারপোকার ছোপ-ধরা তক্তপোশে। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বৎসর পূর্বের একজন নামকরা লেখকের এই পরিণতি দেখে নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে খুব পুলকিত হয়ে উঠলুম না, বলাই বাহুল্য।
একথা-ওকথার পর রামতারণবাবু বললেন—আচ্ছা এক জুয়াচোরকে পাঠিয়েছিলেন মশাই। এই বলে গেল টাকা নিয়ে আসছি, তার পর আর এলই না ও আমাকে ভেবেছে কী? আমার এখানে সেই লাইব্রেরির দোলগোবিন্দ সেন একদিন তিনশো টাকা নিয়ে খোশামোদ করেছে একখানা ছোটো উপন্যাসের জন্য—এই সাত-আট ফর্মা। ওর ভাগ্য ভালো যে দেড়শো টাকায় ওকে বই দিতে রাজি হয়েছিলাম—তা বুঝল না ও–
রামতারণবাবুর ব্যথা কোথায় জানতে দেরি হয় না। আমি কোনো কথা না-বলে চুপ করে রইলাম।
উনি বললেন—আপনার সঙ্গেও দেখা করেনি।
অম্লান বদনে বললাম—কই, না!
—হামবাগ কোথাকার! ওর কোনো পুরুষে প্রকাশক নয়। মুড়িমিছরির যে একদর করে সে আবার প্রকাশক! অনেক পাবলিশার দেখেছি আমি, বুঝলেন? আমার এখানে ধন্না দিয়েছে, বুঝলেন?
—নিশ্চয়ই। তা হবে না? কত বড়ো নাম আপনার!
রামতারণবাবু আত্মপ্রসাদের প্রসন্ন হাসি হাসলেন। বললেন—সে আপনারা বুঝবেন মশাই, কারণ আপনারা লেখেন নিজেরা। ভালো হোক মন্দ হোক, লেখেন তো? আমার ‘রঙের গোলাম’ বইখানা পড়েছেন, দেখেছেন তো? ওর নাম চিরকাল থেকে যাবে—কী বলেন আপনি?
—তা আর বলতে! সেদিন এক বড়োলোকের বাড়ি গিয়েছি—সেখানে আপনার ‘রঙের গোলাম’-এর কথা উঠল—
রামতারণবাবু আগ্রহের মাথায় বিছানা ছেড়ে সোজা হয়ে বসে বললেন ব্যগ্রভাবে—কোথায়? কোথায়?
—ওই—ইয়ে, বালিগঞ্জে।
—তার পর? তার পর?
—তার পর ওরা বললে, বইয়ের মতো বই একখানা। খুব ভালো বলছিল সবাই।
—বলতেই হবে যে মশাই, বলতেই হবে। এমন কৌশল করে রেখেছি ওর মধ্যে যে, সব ব্যাটাকে ভালো বলতে হবে। কেঁদে ভাসিয়ে দিতে হবে শেষের দিকে—কেমন, না?
—উঃ, সে আর—
ভগবান যেন আমায় ক্ষমা করেন। রামতারণবাবুকে দেখে মনে হচ্ছিল, তাঁর রোগ অর্ধেক সেরে গিয়েছে। নিজের বইয়ের প্রশংসা শোনা অনেকদিন বোধ হয় তাঁর ভাগ্যে ঘটেনি।
সেদিন একটু পরেই চলে এলাম।
এইদিনটি থেকে কী জানি কী হল, যখনই রামতারণবাবুর কাছে গিয়েছি, তখনই মাঝে মাঝে তিনি জানতে চাইতেন, তাঁর ‘রঙের গোলাম’ সম্বন্ধে আর কোথাও কিছু শুনলাম কিনা। কী আগ্রহেই জিজ্ঞেস করতেন কথাটা!
আমায় সংবাদ দিতেই হত। কখনো তাঁর বইয়ের প্রশংসা শুনে এলাম
বালিগঞ্জের কোনো ক্লাবে, কোনোদিন ট্রেনে, কোনোদিন তরুণ সাহিত্যিকদের আড্ডায়, কোনোদিন-বা আমার কোনো বান্ধবীর মুখে।
এর পরেই তাঁর সানুনয় অনুরোধ শুনতে হত প্রায় প্রত্যেকবার—দেখুন-না মশাই, বইখানার সেকেন্ড এডিশন যদি কেউ নেয়। একবার উঠে-পড়ে লাগতে হয় এবার। আপনি তো পড়েছেন, আপনি বলবেন তাদের বুঝিয়ে—কী বলেন?
ভগবান জানেন, ‘রঙের গোলাম’ নামধেয় কোনো উপন্যাস আমি চক্ষে দেখিনি। হয়তো রামতারণবাবুর বাসাতে যাতায়াত করা উচিত ছিল না অত, কিন্তু না গিয়ে আমি পারতাম না। কেমন একটা টান অনুভব করতাম। প্রবীণ লেখক অসহায়ভাবে রোগশয্যায় পড়ে আছেন। কখনো দু-পাঁচটা কমলালেবু, কখনো একটু মিছরি হাতে নিয়ে যেতাম কিন্তু রামতারণবাবু সবচেয়ে খুশি হতেন ভালো গুড়ক তামাক নিয়ে গেলে। বৈঠকখানা বাজারের সাধনের দোকানের তামাক বড়ো পছন্দ করতেন।
এর পরে ধীরে ধীরে রামতারণবাবু কাছে যাওয়া আমার কমে গেল।
এমনিই হয়ে থাকে জীবনে। কিছু সময় ধরে এক-এক লোকের রাজত্বকাল চলে, সে-সময় পার হয়ে গেলে সারাজীবনেও আর হয়তো সে লোকের দেখা মেলে না। দেখা মিললেও প্রথম আলাপের দিনের উৎসাহ খুঁজে পাওয়া যায় না। রামতারণবাবুকে সে চায়ের দোকানে আর অনেকদিন দেখিনি।
দশ-এগারো বছর কেটে গেল এর মধ্যে।
আমার নিজের জীবনেও কত পরিবর্তন ঘটে গেল। কলকাতার অধিবাসী এখন আর আমি নই। গ্রামদেশে বাড়ি করেছি, মাঝে মাঝে আসি যাই, এই পর্যন্ত।
একদিন হেদোর ধারের বেঞ্চিতে বসে একটু জিরোচ্ছি, পাশেই একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি বসে ছিলেন আমার আগে থেকেই। দু-একবার চেয়ে দেখে লোকটিকে চিনতে পেরে আমি একেবারে বেঞ্চি ছেড়ে প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। বললাম— রামতারণবাবু যে! চিনতে পারেন?
রামতারণবাবু খুব বুড়ো হয়ে গিয়েছেন—চেহারাও গিয়েছে অনেক বদলে। আমার মুখের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন—ও, আপনি?
আবার ওঁর পাশে বসে পড়ি। এত দিনের অদেখা, অনেক কথাবার্তা হয়।
ওঠবার সময় বললেন—চলুন-না আমার বাসায়। সেই ভীম ঘোষের লেনেই আছে বাসা। ওখানেই বহুকাল কাটল। এখন আর কোথায়-বা যাব? আপনি তো ভুলেই গিয়েছেন একেবারে।
গেলাম সেই পুরোনো বাড়িতে। সেই পুরোনো দিনের আসবাবপত্র ঠিকই আছে, মায় ঢুকবার দরজার সামনে সেই বেঞ্চিখানা পর্যন্ত। পরিবর্তনের মধ্যে রামতারণবাবু একটু স্থবির হয়ে পড়েছেন, নিজেও তুললেন সে কথা।
—আর তেমন হাঁটাহাঁটি করতে পারিনে। হেদোটাতে গিয়ে বসি বিকালটাতে। যাবই বা কোথায়, গেলে পয়সা খরচ। যা টানাটানির সংসার
—আপনার বড়ো ছেলে কোথায় কাজ করছে?
—সে তো নেই। আজ এই আট বছর। ওই ছোটো ছেলেটা কী একটা চাকরি করে, রেশন পায়, তাতেই কোনোরকমে—
—কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। কী কথা বলি?
রামতারণবাবুই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলে উঠলেন—ভালো কথা—