-তাই তো!
রামতারণবাবু একটা বান্ডিল খুলে কতকগুলো পুরোনো বই আমার সামনে ধরে বললেন—এই দেখুন আমার সব বই।
অনেক দিনের ছাপা, অনেকদিন আগের কাগজ। সেকালের ধরনের চটকদার বাঁধাই। সোনার জলে রূপোর জলে নাম লেখা। বইগুলোর বাঁধাই শুধু শক্ত কাগজের বোর্ডের। কী রকম ঘোরানো গড়নের অক্ষর। গ্রন্থকারের নামের পূর্বে লেখা আছে—অমুক অমুক বইয়ের লেখক শ্রীরামতারণ চট্টোপাধ্যায়।
একখানা বই হাতে দিয়ে রামতারণবাবু সগর্বে বললেন—এই আমার ‘রঙের গোলাম’।
আগ্রহের সঙ্গে বইখানা হাতে নিলাম। বইখানার প্রথমদিকে এক সুদীর্ঘ ভূমিকা। শ্রীভুবনমোহন শর্মণ: নাম লেখা আছে ভূমিকার শেষে। আর ভূমিকায় লেখা আছে, ‘আমি এই পুস্তকখানির ভূমিকা লিখিতে অনুরুদ্ধ হইয়াছি, আমার সব ভালো লাগিয়াছেঃ; আমার মনে হয়, আমি নিঃসংকোচে লিখিতেছি, হিন্দুর পবিত্র বর্ণাশ্রম ধর্মের আদর যতদিন থাকিবে ততদিন সাধারণ্যে এই পুস্তকখানির আদর—’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু এতবার যিনি ‘আমি’ লিখেছেন ভূমিকায় যাঁকে এত অনুরোধ করে ভূমিকা লেখানো হয়েছিল একদিন, আজ ত্রিশ বৎসর পরে তাঁকেও লোকে বেমালুম ভুলে গিয়েছে, আমার তো মনে হল না এ নাম কখনো শুনেছি।
রামতারণবাবু বললেন—ভূমিকাটা দেখেছেন?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
–ভুবন বাঁড়ুজ্যের লেখা।
কথাটা বলেই রামতারণবাবু আমার মুখের দিকে চাইলেন, বোধ হয় লক্ষ করবার জন্যে এ নাম শুনে আমার মুখের ভাব কেমনতরো হয়। কিন্তু আমার মুখের ভাবের উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি বলেই আমার ধারণা, তবুও গলায় যতদূর সম্ভব সম্ভ্রমের সুর এনে বললাম—তাই দেখছি।
রামতারণবাবু বললেন—আরও আছে বইয়ের পেছনে। উলটে দেখুন। অনেক লোকের মতামত ছাপানো আছে।
আমি উলটে দেখি, সত্যি অনেকে ভালো বলেছে বইখানাকে। ওদের মতামত ছেপে দেওয়া আছে বটে, কিন্তু যেসব লোকের মতামত ছাপানো হয়েছে, তখনকার দিনে তাদের ব্যক্তিত্ব হয়তো যথেষ্টই ছিল, তাদের মতামতের মূল্যও ছিল সেই অনুপাতে, আজকাল তাদের কেউ চেনে না, তাদের মতামতের মূল্য কানাকড়িও না। যুগ পরিবর্তন হয়েছে, সেদিনের বাণী যারা শুনিয়েছিল, আমড়াগাছের পাকা পাতার মতো তাদের দিন ঝরে গিয়েছে, তাদের আজ কেউ চেনে না।
তত্বটা কী অদ্ভুতভাবেই উপলব্ধি করলাম সেদিন সেখানে বসে। আমার সামনে নোনাধরা পুরোনো দেয়াল, চুন-বালি খসে অনেকখানি করে ইট বেরিয়ে পড়েছে। একগাদা পুরোনো বাঁধানো খাতা-জীর্ণ হলদে বিবর্ণ খবরের কাগজের কাটিং-এ ছাপানো জীর্ণ হলদে বিবর্ণ প্রশংসা—যাদের মতামত, তারা ইহলোকের হিসেব চুকিয়ে ফেলেছে বহুকাল…পুরোনো কাগজপত্রের ভ্যাপসা গন্ধ। প্রবীণ পক্ককেশ গ্রন্থকার রামতারণ চাটুজ্যে সামনে বসে শিরাবহুল হাতে পুরোনো বহু-খাতার পাতা ওলটাচ্ছেন…
মন খারাপ না-হয়ে পারে না। আমিও লেখক। আমার চেয়ে অনেক বড়োদরের লেখক ছিলেন ইনি একদিন। দিন চলে যায়, থাকে না। এ যুগের ঔপন্যাসিকের বইয়ের জীর্ণ পাতা ও-যুগে লাইব্রেরির আলমারির পেছনে তেলাপোকায় কাটে। ওজন-দরে বিক্রি হয়।
রামতারণবাবু বললেন—দেখেছেন? এই দেখুন রায়বাহাদুরের মত–
—কোন রায়বাহাদুর?
রায়বাহাদুর যোগেন্দ্রনাথ মুনশি—কত বড়ো ইয়ে—কলকাতায় হেন সভা ছিল না যেখানে রায়বাহাদুর সভাপতিত্ব না-করতেন—
—ও।
চিনলাম না। যেমন চিনিনি বইয়ের ভূমিকা-লেখক ভুবনমোহন বাঁড়ুজ্যেকে।
রামতারণবাবু এইবার ‘রঙের গোলাম’ সম্বন্ধে বলতে আরম্ভ করলেন। কে পড়ে কবে কী বলেছিল। কোন সভায় তাঁর সম্বন্ধে কী কী বলা হয়। ‘রঙের গোলাম’ সম্পূর্ণ নতুন ধরনের জিনিস বাংলা সাহিত্যে। ও ধরনের প্লট নিয়ে কেউ কখনো লেখেনি। আমাকে বললেন—নিশ্চয় আপনি পড়েছেন? পড়েননি?
পড়িনি এ কথা বলতে কষ্ট হল ওঁর সাগ্রহ প্রশ্নভরা দৃষ্টির সামনে। বললাম— নিশ্চয়ই।
এর পরেই তিনি তাঁর উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি দেখালেন। অনেকদিনের পাণ্ডুলিপি বলেই মনে হল। আমায় বললেন—শোনাব?
একটু একটু করে পড়েন তিনি, আর আমি বসে বসে শুনি আর ঘাড় নাড়ি। মাঝে মাঝে বলেন, আপনার কেমন লাগছে? বলি, ভালোই লাগছে। ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। ত্রিশ বছর আগের বাংলায় লেখা মামুলি প্লট বলে মনে হবারই কথা আমার কাছে। ওসব খোঁচ, ওসব কৌশল অনেক পেছনে ফেলে এসেছি আমরা। “পাঠক! এই যুবক ও যুবতিকে কি চিনিতে পারিলেন? ইহারাই আমাদের নবকুমার ও ইন্দুমতী!”
বেলা যায় যায়। এতক্ষণে আমাদের আড্ডা বসেছে ‘উদিত-ভানু’ আপিসে— বন্ধুবান্ধব এসে গিয়েছে, চা চলছে। আমি উসখুস করি আর ঘন ঘন বাইরের দিকে উঁকি মারি। রামতারণবাবুর সেদিকে দৃষ্টি নেই, তিনি তন্ময় হয়ে দরদের সুরে পড়ে চলেছেন ‘ইন্দুমতী’-র পাণ্ডুলিপি। ইন্দুমতী কী একটা ফ্যাসাদে পড়েছে, ভালো করে বোধ হয় জায়গাটা শুনিনি, এখন তার করুণ স্বগতোক্তি খুব দরদ দিয়ে উনি পড়ছেন। কী মুশকিলেই পড়া গেল, আজকের আড্ডা ফসকাল দেখছি! ভাবছি হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে বলব—’’আচ্ছা থাক, আমার কাজ আছে আজ?”
না, রামতারণবাবু কী মনে করবেন। তার চেয়ে শুনি বসে বসে। আর কখনও আসব না। সন্ধ্যা হয়ে এল ক্রমে। আর পড়া চলে না। রামতারণবাবু হেঁকে যেন কাকে বললেন, ওরে আলো একটা দিয়ে যা! আমি এই সুযোগে বলি—তাহলে আজ
–যাবেন?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। একটু দরকার আছে।
–কাল আসবেন কোন সময় বলুন? সবটা শুনতে হবে তো, নইলে প্রকাশকদের কাছে বলবেন কী? কেমন লাগছে?