কখনও কচি মেয়ের মত ওকে ভুলাইতে হয় নাই। আমার খেলাঘরের মা হইয়া ও-ই এতদিন আমায় আদর করিয়াছে, আশ্বাস দিয়াছে সেইটাই আমাদের সম্বন্ধের মধ্যে যেন সহজ এবং স্বাভাবিক হইয়া পড়িয়াছিল, ভাল মানাইত। আজ প্রথম ওকে বুকে চাপিয়া সান্ত্বনা দিলাম— যেমন দুধের ছেলেমেয়েকে শান্ত করে বুঝাইয়া, মিথ্যা কহিয়া, কত প্রলোভন দিয়া।
তবুও কি থামিতে চায়? ওর সব হাসির অন্তরালে এতদিন যে গোপনে শুধু অঞই সঞ্চিত হইয়া উঠিতেছিল।
অনেকক্ষণ ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া সে থামিল। অভ্যাসমত আমার করতল দিয়াই নিজের মুখটা মুছাইয়া লইল তাহার পর হাতটাতে একটু টান দিয়া আস্তে আস্তে বলিল, “এদিকে এস, শোন মেজকা।”
দুইজনে একটু সরিয়া গেলাম। সকলে এই সময় মাতাপুত্রের অভিনয়ের দিকে চাহিয়া রহিল। রাণু বুকের কাছ হইতে তাহার সুপ্রচুর বস্ত্রের মধ্য হইতে লাল ফিতায় যত্ন করিয়া বাঁধা দশ বারোখানি প্রথম ভাগের একটা বান্ডিল বাহির করিলা অশ্রুসিক্ত মুখোনি আমার মুখের দিকে তুলিয়া বলিল, “পেরথোম ভাগগুলো হারাই নি মেজকা, আমি দুষ্টু হয়েছিলুম, মিছে কথা বলতুমা”।
গলা ভাঙিয়া পড়ায় একটু থামিল, আবার বলিল, “সবগুলো নিয়ে যাচ্ছি মেজকা, খুব লক্ষ্মী হয়ে পড়ে পড়ে এবার শিখে ফেলব। তারপরে তোমায় রোজ রোজ চিঠি লিখব তুমি কিছু ভেবো না মেজকা।”
রামতারণ চাটুজ্যে, অথর
পনেরো-ষোলো বছর আগেকার কথা। পটলডাঙা স্ট্রিটে এক বেঞ্চিপাতা চায়ের দোকানে রামতারণবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ শুরু হয়। এক পয়সা দামের এক পেয়ালা চাঃ; গোলদিঘি বেড়িয়ে এসে সস্তায় চা-পান সারতে দোকানটাতে ঢুকলাম। আমার দরের আরওঃপাঁচ-ছ-টি খরিদ্দার অত সকালেও সেখানে জমায়েত হত এক পয়সার এক পেয়ালা চা খেতে। এই দলের মধ্যে অনেকেই ২৫।২নং মেস-বাড়ির অধিবাসী; একমাত্র রামতারণবাবুই ছিলেন গৃহস্থ লোক, যিনি ভাড়াটে বাড়িতে বাস করেন, মেসে নয়। সেইজন্যেই তাঁর সঙ্গে আলাপের প্রবৃত্তিটা আমার হয়তো অত বেশি ছিল। তখন থাকি মেসে, গৃহস্থবাড়ির মধ্যে একটা নতুন জগৎ দেখতাম।
রামতারণবাবুর সঙ্গে এই ধরনের দেখাশোনা প্রায় তিন-চার মাস ধরে হল। অবিশ্যি চায়ের দোকানে যেমন আলাপ হওয়া সম্ভব তেমনি।-নমস্কার, এই যে, কেমন আছেন? হেঁ হেঁ। আমার ওই একরকম কেটে যাচ্ছে, আপনি? হেঁ হেঁ, ওই একরকম।
একদিন রামতারণবাবু বললেন—কোন দিকে যাবেন? চলুন গোলদিঘিতে।
দু-জনে একখানা বেঞ্চির ওপর এসে বসি। রামতারণবাবু একটা বিড়ি ধরালেন। তার পর বললেন—একটা কথা আজ শুনলাম, শুনে বড়ো খুশি হলাম, তাই আজ আপনাকে একটু আলাদা করে এখানে আনা। আপনি নাকি লেখক? শুনলাম নাকি। একখানা বই লিখেছেন, অনেকে ভালো বলছে?
আমার সসংকোচ বিনয়কে তিনি হাত-নাড়া দিয়ে হটিয়ে বললেন—বাঃ, এতে আর অত ইয়ের কারণ কী। ভালোই তো। বেশ বেশ, বড়ো সন্তুষ্ট হওয়া গেল। সুরেন কাল আমায় বিকেলে বলছিল কিনা।
আমি চুপ করেই রইলাম। রামতারণবাবুর বয়স আমার চেয়ে অনেক বেশি, মাথার চুল একটিও কাঁচা নেই, তাঁকে একটু সমীহ করেই চলতাম, বিড়ি সিগারেট চায়ের দোকানে কখনো তাঁর সামনে খাইনি। রামতারণবাবু গম্ভীরভাবে বললেন বড়ো আনন্দ হল আপনার পরিচয় জেনে। শুনলাম নাকি আপনার বই বেশ বিক্রি সিক্রি হয়?
—ওই একরকম। হয় মন্দ নয়।
–বটে!
রামতারণবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন—তবুও কীরকম বিক্রি হয়? একটা এডিশন ফুরিয়েছে?
—আজ্ঞে এই সেকেন্ড এডিশন চলছে।
—কত দিনে হল?
—ধরুন, তা প্রায় দেড় বছর।
–বটে?
রামতারণবাবু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চুপ করলেন। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না আমার বইয়ের সেকেন্ড এডিশন হওয়া এমনকী একটা সামাজিক দুর্ঘটনা।
আবার তিনি বললেন—আজকাল হয়েছে যত সব বাজে বইয়ের আদর— লোকের রুচিও গিয়েছে নেমে।
আমি মনে মনে ভীষণ রেগে গেলাম। আমি নতুন লিখতে আরম্ভ করিনি। পাঁচ সাত বছরের মধ্যে দুটো উপন্যাস ও অনেকগুলো ছোটো গল্প লিখেছি। লোকে সেগুলো মন্দ বলেনি, উনি প্রবীণ ব্যক্তি, কোথায় আমায় উৎসাহ দেবেন, তা নয়, আমার বইকে বাজে বইয়ের পর্যায়ে ফেলে দিলেন একনিশ্বাসে! কী করে জানলেন উনি? পড়েছেন আমার বই? লেখকের অভিমান একটু বেশি, আমি বেঞ্চি থেকে উঠে বললাম—আচ্ছা, চলি। কাজ আছে।
-না না, বসুন। এই দেখুন, রেগে গেলেন। এই আপনাদের মতো ইয়ং লেখকদের বড় একটা ইয়ে। শুনুন, আমি বলছি কী, আপনি বোধ হয় জানেন না
—আমিও একজন অথর।
‘অথর’ কথাটা বেশ গালভরা করে সময় নিয়ে টেনে টেনে উচ্চারণ করলেন। ‘অ —অ—থ–র’।
আমার বিরক্তি কেটে গেল একমুহূর্তে। বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করি—ও! আপনার কী কী বই—উপন্যাস না ধর্মগ্রন্থ?
একটা সন্দেহ জেগেছিল মনে, বোধ হয় ধর্মগ্রন্থই হবে। কিন্তু আমায় আরও বিস্মিত করে দিয়ে উনি বললেন—উপন্যাস।
আমি বললাম—আপনার নাম তো রামতারণ—রামতারণ—
—চাটুজ্যে। নাম শোনা আছে? আমার বই-এর নাম ‘রঙের গোলাম’, পরশমণি’, ‘সোনার বাংলা’—
—ও!
কোথাও নাম শুনেছি বলে মনে করতে পারলাম না। তবুও আপ্যায়ন ও হৃদ্যতার সুরে বললাম—বেশ বেশ। বড়ো খুশি হলাম। এতদিন ধরে চায়ের দোকানে মেলামেশা, কই এ কথা তো এতদিন শুনিনি—আজই প্রথম
রামতারণবাবু বললেন—আরে আমিও তো আজ প্রথম
সেই থেকে ওঁর সঙ্গে আলাপ ঘনিষ্ঠ হয়ে জমল। রোজ চায়ের দোকানে দেখা, প্রায়ই গোলদিঘির বেঞ্চিতে দুজনে নিভৃতালাপ। একদিন রামতারণবাবু বললেন— চলুন আমার বাড়ি একদিন। কবে যাবেন বলুন।