—দুটি ছেলে একটি মেয়ে।
—বেশ, বেশ। আচ্ছা, আমার কথা মনে পড়ত হীরুদা?
মনে খুব পড়ত না, কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, এখন এমন মনে পড়চে যে সুরমা ও জামালপুর অস্পষ্ট হয়ে গিয়েচে। বড়োলোকের মেয়ে সুরমা তার মনের মতো সঙ্গিনী নয়, তার সঙ্গে সব দিক থেকে মেলে—খাপ খায় এই কুমীর। অথচ সুরমার জন্য দামি মাদ্রাজি শাড়ি কিনে নিয়ে যেতে হবে কলকাতা থেকে যাবার সময়—সুরমা বলেচে, যাচ্চ যখন দেশে, ফিরবার সময় কলকাতা থেকে পুজোর কাপড়-চোপড় কিনে এনো। এখানে ভালো জিনিস পাওয়া যায় না, দরও বেশি।
আর কুমীর পরনে হেঁড়া আধময়লা কাপড়।
না—দরিদ্র গৃহলক্ষ্মীকে বড়োলোকী উপহার দিয়ে সে তার অপমান করবে না। কুমী বকেই চলেছে। অনেক দিন পরে আজই ও আনন্দ পেয়েছে—নিরানন্দ অসচ্ছল সংসারের একঘেয়ে কর্মের মধ্যে বালিকাবয়সের শত আনন্দের স্মৃতি নিয়ে পুরোনো দিনগুলো হঠাৎ আজ সন্ধ্যায় কেমন করে ফিরেচে।
ঘণ্টা দুই পরে কুমীর মা এলেন। বললেন—এই যে, জুটেচ দুটিতে? আমি শুনলুম দিদির মুখে যে হীরু এসেচে। কাল লক্ষ্মীপুজো, তাই রায়েদের বাড়ি রান্না করে দিয়ে এলাম। তা ভালো আছিস বাবা হীরু? কুমী কত তোর কথা বলে। তোর কথা লেগেই আছে ওর মুখে; এই আজও দুপুরবেলা বলছিল, মা, হীরুদা নদীতে বন্যা দেখলে খুশি হত; এবার তো বন্যা এসেছে, হীরুদা যদি দেখত, খুব খুশি হত—না মা? তা, আমি তুই এসেছিস শুনেই দিদির ওখানে গিয়েছিলুম। বাড়ি নেই দেখে ভাবলাম সে ঠিক আমাদের ওখানে গিয়েছে। তা বোসো বাবা, চট করে পুকুর থেকে কাপড় কেচে গা ধুয়ে আসি। গামছাখানা দে তো কুমী। খোকার জন্য তরকারি এনেচি কাঁসিতে। ওকে ভাত দে। এই ওর বিয়ে দিয়েচি সামটায়— বুঝলে বাবা হীরু? জামাই দোকানে সামান্য মাইনের খাতা-পত্র লেখার কাজ করে। তাতে চলে না। তার ওপর দজ্জাল ভাই-বউ। খেতে পর্যন্ত দেয় না ভালো করে মেয়েটাকে। এই দেখোএখানে এসেচে আজ পাঁচ মাস, নিয়ে যাবার নামটি নেই, বউদিদির হুকুম হবে তবে বউ নিয়ে যেতে পারবে। আর এদিকে তো আমার এই অবস্থা, মেয়েটার পরনে নেই কাপড়, জামাই আসে-যায়, কাপড়ের কথা বলি, কানেও তোলে না। আমি যে কী করে চালাই? তা সবই অদৃষ্ট! নইলে–
কুমী ঝাঁজালো সুরে বললে—আ : যাও না, গা ধুয়ে এসো না—কী বকবক শুরু করলে—
অদৃষ্ট, হাঁ অদৃষ্টই। সে আজ কোথায়, আর কুমী কোথায় পড়ে কষ্ট পাচ্ছে।
পরনে কাপড় নেই, পেটে ভাত নেই, জীবনে আনন্দ নেই, সাধ-আলহাদ নেই, কিছুই দেখলে না, কিছুই ভোগ করলে না, সবই অদৃষ্ট ছাড়া আর কী?
খানিক রাত্রে হীরু উঠল। কুমী প্রদীপ ধরে এগিয়ে দিলে পথ পর্যন্ত। বললে— আমাদের হ্যারিকেন লণ্ঠন নেই, একটা পাকাটি জ্বেলে দিই, নিয়ে যাও হীরুদা, বাঁশবনে বড় অন্ধকার।
সকালে কুমী পিসিমার বাড়ি এসে ডাক দিলে—কী হচ্চে, ও হীরুদা—
—এই যে কুমী, কামিয়ে নিলাম। এইবার নাইব।
কুমী ঘরের মধ্যে ঢুকে বললে—কেন, কীসের তাড়া নাইবার এত সকালে? তোমার কিন্তু আজ যাওয়া হবে না হীরুদা—বলে দিচ্চি। আজ ভাদ্রমাসের লক্ষ্মীপুজোর অরন্ধন, তোমায় নেমন্তন্ন করতে এলুম আমাদের বাড়ি। মা বললেন—যা গিয়ে বলে আয়।
হীরু আর প্রতিবাদ করতে পারলে না, কুমীর কাছে প্রতিবাদ করে কোনো লাভ নেই সে জানে। কুমী খানিকটা পরে বলল—আমার অনেক কাজ হীরুদা, আমি যাই। তুমি নেয়ে সকাল সকাল এসো।
হীরু বেলা দশটার মধ্যে ওদের বাড়ি গেল। আজ আর রান্নার হাঙ্গামা নেই। কুমী বললে—আজ কিন্তু পান্তা ভাত খেতে হবে জানো তো? আর কচুর শাক— আর একটা কী জিনিস বলো তো?…উঁহু… তুমি বলতে পারবে না।
কুমীর মা বললেন—কাল রাত্রে তুই চলে গেলে মেয়ে অত রাত্রে তোর জন্যে নারকেল কুমড়ো রাঁধতে বসল। বললে, হীরুদা বড়ো ভালোবাসে মা, কাল সকালে খেতে বলব, বেঁধে রাখি।
কুমী স্নান সেরে এসে একখানা ধোয়া শাড়ি পরেচে, বোধহয় এইখানাই তার একমাত্র ভালো কাপড়। সেই চঞ্চলা মুখরা বালিকা আর সে সত্যই নেই, আজ দিনের আলোয় কুমীকে দেখে ওর মনে হল—কুমীর চেহারা আরও সুন্দর হয়েছে, তবে ওর মুখে-চোখে একটা শান্ত মাতৃত্বের ভাব ফুটে উঠেচে, যেটা হীরু কখনো ওর মুখে দেখেনি। কুমী অনেক ধীর হয়েছে, অনেক সংযত হয়েচে। মাথায় সেইরকমের এক ঢাল চুল, মুখশ্রী এখনও সেইরকম লাবণ্যময়। তবুও যেন কুমীকে চেনা যায় না, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বালিকা কুমী অন্তর্হিত হয়েছে, এখন যে কুমীকে সে দেখচে তার অনেকখানিই যেন সে চেনে না।
কিন্তু খানিকটা বসবার পরে হীরুর এ ভ্রম ঘুচে গেল। বাইরের চেহারাটা যতই বদলে যাক না কেন, তার সামনে যে কুমী বার হয়ে এল, সে সেই কিশোরী কুমী। ওর যেটুকু পরিচিত তা ওর মধ্যে বার হয়ে এল—যেটুকু হীরুর অপরিচিত, তা নিজেকে গোপন রাখলে।
কী চমৎকার কুমীর মুখের হাসি। হীরুর মোহ নেই, আসক্তি নেই, আছে কেবল। একটা সুগভীর স্নেহ, মায়া, অনুকম্পা…এ এক অদ্ভুত মনের ভাব, কুমীকে সে সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারে তাকে একটুক খুশি করবার জন্য।
কুমী কত কী বকচে বসে বসে…পুরোনো দিনের কথা তুলচে কেবল।
–মনে আছে হীরুদা, সেই একবার জেলেদের বাঁশতলায় আলেয়া জ্বলেছিল —সেও তো এই ভাদ্রমাসে…সেই চারুপাঠ মনে আছে?
হীরুর খুব মনে আছে। সবাই ভয়ে আড়ষ্ট, আলেয়া নাকি ভূত, যে দেখতে যায় তার অনিষ্ট হয়। হীরু সাহস করে এগিয়ে গিয়েছিল দেখতে, কুমীও পিছু পিছু গিয়েছিল।