ইনশিয়োরেন্স থেকে ফোন আসছে। চুরি যাওয়া গাড়ির কোনো কিনারা হল না। সুখের কথা, বর্ধমান গেস্ট হাউজ জানিয়েছে, চ্যাটার্জি খুব ভোরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, গাড়ির খবর তারা জানে না। কিন্তু স্যার তক্ষুনি পুলিশে ডায়েরি করলেন না কেন?
আমার মাথার ঠিক ছিল না। কর্পোরেট হাউজের ব্যাপার তো বোঝেন। শান্তিনিকেতনে ছুটতে হবে তক্ষুনি, জরুরি কাজ। ওখানে কনফারেন্স করে হন্যে হয়ে ফিরেছি। তারপর ডায়েরি করি। গাড়ির মেক, নাম্বার, ডেট অব পারচেজ, ইনশিয়োরেন্সের তারিখ। টার্মস।
একটাই বিপদ। অফিসে যদি খোঁজখবর করে কার সঙ্গে মিটিং করতে উইক এণ্ডে বর্ধমান, তারপর শান্তিনিকেতন ছুটতে হয়েছিল তাকে। তবে, অ্যাসোসিয়েট ম্যানেজার হিসেবে অনেক প্রজেক্ট তাকে একাই হ্যান্ডল করতে হয়, একাই প্ল্যানিং করতে, ডিসিশন নিতে হয়। যেটা শুরুতেই গুবলেট হয়ে গেল তারজন্য ডিটেল্ড রিপোর্টও দেওয়াটা জরুরি নয়। এই ইনশিয়োরেন্স কোম্পানি নতুন বাজারে নেমেছে। কমপিটিটিভ মার্কেট। টাকাটা শেষ পর্যন্ত চুকিয়েই দেবে বোধহয়। কেননা বলল—যদি নাম্বার প্লেট পালটে ভিন্ন রাজ্যে পালিয়ে গিয়ে থাকে, ফিরে পাবার কোনো আশাই নেই। সাধারণত কোনো অপরাধমূলক কাজ করলে গাড়িটা ব্যবহার করে এরা অকুস্থল থেকে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে যায়। যখন এত দিনেও বার হল না তখন গাড়িটা ইতিমধ্যেই চোরাই মাল, দু-তিন হাতফেরতা হয়ে গেছে।
একটা মারুতি এইট হানড্রেড ডিলাক্স কিনে সোজা বাড়ি ফিরে এল সত্যেন। ধবধবে সাদা। মণিমালার হাতে চাবি দিয়ে বলল, নাও এটা তোমার।
কী আশ্চর্য!
আশ্চর্যের কী আছে? গিফট! বিবাহবার্ষিকীর, অল রাইট? তোমার লাইসেন্স আছে, কিন্তু কলকাতার রাস্তায় আমি তোমাকে ড্রাইভ করতে দেব না।
ন্যাশনাল হাইওয়েতে রাত্তিরে একটি মেয়ে একা গাড়ি চালাতে পারে আর এই কলকাতার রাস্তায় দিনের বেলা আর একটি মেয়ে একটু পারবে না?
কোথায় আবার পেলে এ রকম?
কেন? ওই যে গাড়িটা সেদিন অ্যাকসিডেন্ট করল না? সেই তুমি যেদিন ফিরলে!
গায়ের চামড়ার খোল থেকে রক্তমাংসের মানুষটা প্রায় লাফিয়ে উঠেছিল। কী বলছে মণি? ও কি কিছু সন্দেহ করেছে? কী করে? কেন? অনেক কষ্টে সে শুধু বলতে পারল, ততাই ওরকম অ্যাকসিডেন্ট হয়।
কেন? ট্রাক ড্রাইভারটা? সে তো আর মেয়ে নয়! তার বেলা?…
সব মেয়েদের পারংগমতা প্রসঙ্গে কথাটা বলেছিল মণি। মেয়েরা পাইলট হচ্ছে, অ্যাস্ট্রোনট হচ্ছে…ইত্যাদি ইত্যাদি।
ট্রাক ড্রাইভার? রাত্তিরে ওরা একেবারে বেহেড হয়ে গাড়ি চালায়।
সে তো জানি! সেই জন্যেই তো বারণ করি, ধরো ওইটা যদি তোমার ইন্ডিকা হত? ওই মেয়েটির জায়গায় যদি তুমি…উহহ। শিউরে উঠল মণিমালা, আর তার চেয়েও বেশি শিউবোলো সত্যেন নিজে। তার গা ছমছম করছে। এবং বেশ কয়েকদিন যাবৎ শান্ত, শ্রীমতী মণিমালাকে কেমন ভীতিপ্রদ মনে হচ্ছে। যতবার দেখছে লিজের মুখে মনে পড়ছে। যতবার দেখেছে দুর্ঘটনার দৃশ্যটা হু হু করে চলে আসছে চোখের সামনে। ঋত! ঋত দেখা দিচ্ছে অদ্ভুত অদ্ভুত ভোরের স্বপ্নে। ঋত বাবা বলে ডাকতে চেষ্টা করছে, পারছে না, চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে তবু পারছে না। আতঙ্কিত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে নিজের গলাটা আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। একটা নীল গাড়ি চড়ে ঋত হুশশ করে চলে গেল। কাঁচের ভেতর থেকে দেখা যায় তার আবছা বাই-বাই।
তার বিমর্ষ ভাব লক্ষ করেছে মণি। বলল, চলো না, আমরা ক-দিন একটু কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসি। সামনেই ২৬ জানুয়ারি সাতাশে পড়েছে শনিবার। তিন দিন ক্লিন ছুটি পাওয়া যাচ্ছে।
কোথায় যাবে এই ক-দিনে? ট্রেনের টিকিট পাওয়া গেলে তো!
ট্রেনে কে যেতে চাইছে? নতুন এস্টিমটা করে, ড্রাইভার নিয়ে…কথা শেষ হল না চিৎকার করে উঠল সত্যেন—না-আ-আ।
তুমি এত আপসেট হয়ে পড়ছ কেন? আশ্চর্য তো!
ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যুরিজমের একটা ছোটো প্যাকেজ নেওয়া যায়—শান্ত গলায় বলল সত্যেন।
ঠিক বলেছ। ধর জয়রামবাটি কামারপুকুর!
ঠিক ঠিক। এই রকম, এই রকম কিছুই একটা দরকার এখন। শ্রীরামকৃষ্ণ মা সারদা, শ্রীচৈতন্য, যাঁরা যাঁরা এ পৃথিবীতে ঈশ্বরের দূত হয়ে এসেছেন—গেছেন তাঁদের দরকার তার। অন্য কিছু ভাবতে পারছে না সত্যেন। বার বিস্বাদ, অফিস বিরক্তিকর, মানুষের সঙ্গ ভীতিপ্রদ, এমনকি যাদের সঙ্গে এই ছোট্ট ভ্রমণে যাওয়া সেই একান্ত নিজের সষ্টি পরিবারকেও তার ভালো লাগছে না। ইতিমধ্যেই তারা যেন অনেক যোজন দূরে চলে গেছে।
অথচ ঋত ঠিক তেমন করেই বাবার ট্রাউজার্স-এর সঙ্গে লেপটে প্রশ্ন করছে, বাবা, এইগুলো সারদা মায়ের জীবন নিয়ে কমিকস?
প্রদর্শশালার কক্ষে ঋত কমিকস দেখছে তার বাবা দেখছে ট্রাজিকস। হে মা, হে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, যদি সত্যিকারের ঠাকুর হও তো এই অধম, নীচাশয়, ক্লিন্ন, বিশ্বাসঘাতক পাপী, হ্যাঁ পাপীকে রক্ষা করো। একবার। আর কখনও এমন হবে না। দীক্ষা নেব, মাছ-মাংস ছেড়ে দেবে, বিশাল ডোনেশান দেব মঠে। মাতৃমন্দিরের চৌকাঠে সে এতক্ষণ ধরে প্রণাম করে সে অন্য অভ্যাগতদের অসুবিধে হয়, মণিমালা সামান্য হেসে মন্তব্য করে, তোমার যে এত ভক্তি তা তো জানা ছিল না!
কে কাকে কতটুকু জানে মণিমালা? তুমি কি আদৌ সত্যেনকে জানো? জানো, দিনের পর দিন সে কীভাবে তোমাকে ঠকিয়েছে? অ্যাকসিডেন্ট করে অকুস্থল থেকে নিজের সমস্ত চিহ্ন লোপাট করে পালিয়ে এসেছে খুনির মতো! মেয়েটি একেবারে সর্বাংশে মৃত ছিল। কিন্তু তার যদি একটুও প্রাণ অবশিষ্ট থাকত সত্যেন কি তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করত? না। রূঢ় সত্য হল—না। মেয়েটি প্রমাণ তার আইডেনটিটির, যেমন নাম্বার প্লেটটা ছিল প্রমাণ–তার গাড়ির আইডেনটিটির। তার মানসম্মান, তার ঘর, বার সব ভেঙে যেত।