অনিকেত
অদ্ভুত একটা কিনকিন কিরকির আওয়াজ করতে করতে দেয়াল ঘড়িতে ভোর চারটে বাজল। অনেকক্ষণ আগেই জেগে গিয়েছিলেন অনিকেত রায়মহাশয়। তিনটে বাজাও শুনেছেন জেগে জেগে। অনিদ্রার রাতে এইসব ঘড়ির আওয়াজ যে কী গা-শিরশিরে হতে পারে অনিকেতবাবুর চেয়ে ভালো তা কেউ জানে না। তবু কী একটা মায়ার বশে ঘড়িটাকে তিনি অবসর দিতে পারেননি। তাঁর দাদামশায়ের ঘড়ি। চমৎকার চলে এসেছে চিরকাল। ঘড়ির এইরকম চলে আসাটাকে কোনো ব্র্যান্ড-নেমের গৌরব মনে করার কোনো কারণ নেই। কত সুইস, কত জার্মানই তো এল গেল। কে ফাস্ট যাচ্ছে, কে স্লো, কার টাইম বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ প্রলাপ বকছে। কিন্তু অনিকেতবাবুর দাদামশায়ের ঘড়ি টিকটাক ঠিকঠাক চলছে। সাত জার্মান জগাই একা, তবুও জগাই লড়ে। এ কৃতিত্ব জগাইয়েরই। আসল কথা কোনো কোনো ঘড়ি যন্ত্র হলেও ঠিক যান্ত্রিক থাকে না শেষ পর্যন্ত। প্রাণটান গোছের কিছু একটা পেয়ে যায়। জগাই পেয়েছে। এটাকে একটা মির্যাকল বলা যায়। ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে অনিকেতবাবু খসখসে গলায় বললেন, তুই যদি পারিস জগাই তো আমিই বা পারব না কেন? পেরে যাব ঠিক। কী বল!
টিক টক জগাই বলল।
টিক টক? ঠিক কথা বলছিস? … অনিকেতবাবু বললেন, তা হলে পারি? পেরে যাই? বলতে বলতে সজোরে কম্বলটা সরিয়ে বিছানার বাইরে এক লাফ মারলেন অনিকেতবাবু। পা দুটো ঝনঝন করে উঠল। কিন্তু ওইটুকুই। ফাটা, ভাঙা এসব কিছু হল না। হৃষ্ট মুখে কনকনে ঠান্ডা মেঝের ওপর সোজা পায়ে ল্যান্ড করলেন অনিকেতবাবু।
ডাক্তারেরা কিন্তু বলে থাকে ঘুম থেকে উঠে হুটোপাটি করবেন না। ধীরে সুস্থে কয়েকটি আড়মোড়া ভাঙবেন। ডান কাতে শোবেন, বাঁ কাতে শোবেন, তারপর হাতের ওপর ভর দিয়ে আস্তে উঠে বসবেন, পা ছড়াবেন। এক পা এক পা করে মাটিতে নামবেন। ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে আরও একটি পেল্লাই আড়মোড়া ভাঙবেন। তারপর…
কে বলছে? কে বলছে কথাগুলো?
অনিকেতবাবু চারদিকে তাকিয়ে হদিস করতে পারলেন না। চিপচিপে বুকে অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে বুঝলেন এই এস, সি, ডি বা সুপার কমপ্যাক্ট ডিসক বাইরে কোথাও নয়, তাঁর নিজের বুকের ভেতরেই বাজছে।
বছর চারেক আগে স্ত্রী গায়ত্রী যখন খুব অসুস্থ, হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে এসেছেন জোর করে, সেই সময়ে গায়ত্রীর নাম করে নিজেও একবার ভালো করে ডাক্তারি চেক আপ করিয়ে নিয়েছিলেন। সেই ডাক্তারই বলেছিলেন, আরে দাদা, আপনার হাইপারটেনশন নেই, রক্তে চিনি নেই, ব্ল্যাড কোলেস্টেরলও ধর্তব্যের মধ্যে নয়। হার্ট চলছে চমৎকার ল্যাবডুব ঝাঁপডুব ছন্দে। জোয়ানের মতো আপনি বাঁচবেন না তো বাঁচবে কে? তবে হ্যাঁ…।
ডাক্তার এক ঝুড়ি কর্তব্য ও অকর্তব্যের কথা বলেছিলেন। সেগুলো সযত্নে মুখস্থ করে রেখে দেন অনিকেতবাবু। কষ্ট করে মুখস্থ করতে হয়নি। কানের ভেতর দিয়ে একবার ঢুকতেই মরমে পশেছে। তাই তাঁর শরীর মনে না রাখলেও মন সেগুলো মনে রাখে, মনে করিয়ে দেয়।
বিছানা গোছাতে লাগলেন অনিকেতবাবু। সবাই-ই হয়তো নিজের কাজ নিজে করে কিন্তু করে দায়ে পড়ে, দায়সারা করে। অনিকেত করেন যত্ন করে মেথডিক্যালি। বালিশটা থুপে থুপে ঠিক জায়গায় রাখলেন। কম্বলটা দু-হাতে তুলে নিলেন। খুব ভারী লাগল। ভালো করে দেখতে গিয়ে রায়মহাশয়ের বুক হিম হয়ে গেল। এ কী? দুটো কম্বল কেন? জানালা বন্ধ। পায়ে মোজা। গায়ে উলিকট। একটা কম্বলই তো যথেষ্ট? দুটো কেন? এ কি দার্জিলিং নাকি? কিংবা নিদেনপক্ষে বর্ধমান, চাতরা, নবাবগঞ্জ? আরে বাবা এ যে শহর কলকাতার গাদাগাদি মধ্যিখান? কম্বলটা দিলে কে? কে এমন ষড়যন্ত্রনিপুণ, নিষ্ঠুর অন্তরালবর্তী বিভীষণ আছে যে মাঝরাতে তার ঘরে ঢুকেছে এবং গায়ে দিয়ে দিয়েছে দ্বিতীয় কম্বল? নাঃ সুপ্রতীকের কথা তিনি আর শুনবেন না। এবার থেকে দরজা বন্ধ করে শোবেন। তিনি নিশ্চয়ই রাতে কুঁই কুঁই করেছেন। বেশ সশব্দে। বলা যায় না হয়তো কেঁদেছেন, অচেতনের ওপর তো হাত নেই! ছি ছি! সেই কান্নার শব্দে আকৃষ্ট হয়ে সুপ্রতীক অথবা আরও ভয়াবহ। রুমিই হয়তো। কী ভাবল।
চটপট করে বাথরুম সেরে মাথা গলা কান-ঢাকা টুপিটা মাথায় গলিয়ে নিলেন তিনি। গায়ে চাপালেন ওভারকোট। পায়ে উলের মোজা। এ সবই সিমলাতে কেনা হয়েছিল অন্তত বিশ বছর আগে। সিমলায় সে বছর ভালো বরফ পড়েছিল। এখন সেই সিমলাই আয়োজন কলকাতিয়া জানুয়ারিতে গায়ে চাপাচ্ছেন তিনি। আয়নার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, অ্যাবমিনেবল স্নোম্যান! বলেই চমকে উঠলেন কারণ কে যেন সঙ্গে সঙ্গেই বলল, অ্যাবমিনেবল ওল্ড ম্যান। চারদিকে চকিতে একবার তাকিয়ে নিলেন অনিকেত রায়মহাশয়। তাঁর দীর্ঘশ্বাসে আয়নার পরিষ্কার গায়ে একটা দলা-পাকানো বাষ্পের দাগ হল। সিনথেটিক সোলের জুতো জোড়া পায়ে গলিয়ে এবার নিঃশব্দে লম্বাটে সরু দালানটা পার হওয়া, দরজাটা টেনে দিয়ে নিজেই এলিভেটর নামিয়ে সদরে পৌঁছোনো, তারপর নিজের ইয়েতি সদৃশ আকারটি নামিয়ে দেওয়া। রাত-দারোয়ান গলা বাড়িয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় প্রশ্ন করল, কে যায়?
দুশো তেইশ।
কচ্ছপের মতো গলা গুটিয়ে নিল ব্যাটা।
খোলা গালের ওপরে এসে বিঁধছে মাঘের ধারালো ছুরির মতো হাওয়া। একবারটি শিউরে উঠলেন অনিকেতবাবু। তারপর হনহন করে পা চালালেন পুবের পার্কটার দিকে। দু-চারটে রাত-কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল। শীতে পা টেনে ধরেছে, কিন্তু তাকে ওই রাত কুকুরগুলোর মতোই পাত্তার মধ্যে আনতে চাইছেন না তিনি। নির্ভীক পদক্ষেপে তিনি পার্কের দিকে এগিয়ে চলেছেন।
রাস্তায় এখনও দাপটের সঙ্গে জ্বলছে পরাক্রান্ত পথ-বাতিগুলো। যেন বড়ো বড়ো জ্বলজ্বলে চোখে দেখছে কে যায়, কারা যায়। খোকা না বুড়ো, বুড়োখোকা না বুড়ো-বুড়ো। দেখছে এবং হিসেব রাখছে। মাথা নীচু করে ওভারকোটের দু পকেটে হাত ভরে রাস্তাটা পার হলেন তিনি। হনহন করে হেঁটে পার্কে পৌঁছোতে পাঁচ মিনিট। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন আরও কিছু কিছু মূর্তির আবির্ভাব হয়েছে আশেপাশে। মাথা-গা-কম্বল-শাল মুড়ি দেওয়া, কেউ কোট-প্যান্টালুন হাঁকড়েছে। মাথা ঢেকে নিয়েছে মাফলারে! নানান মূর্তি। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। প্রাণপণে হাঁটছে।
হাঁটবেন, হাঁটবেন, ভোরে একবার, সন্ধেয় একবার করে হাঁটবেন। হাঁটাই এখন একমাত্র ব্যায়াম…বুকের ভেতরে এস. সি. ডি.-টা খনখনে গলায় বলে যেতে লাগল। আশপাশ দিয়ে জড়পুঁটলির মতো হন্টনকারীদের দেখে মনে হয় তাদের বুকের মধ্যেও ডিসকটা বাজছে… হাঁটবেন। হাঁটবেন…..ভোরে…..সন্ধেয়…হাঁটাই এখন একমাত্র ব্যায়াম…।
আজ নিয়ে তৃতীয় দিন হল অনিকেত এইভাবে বেরোলেন। সুপ্রতীক জানে না, রুমি জানে না। ওরা ওঠবার আগেই আবার নিঃশব্দে ফিরে যাবেন তিনি। পকেট থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলবেন। ওই সময়ে একটা দমকা কাশি আসতে চায়, সেটাকে কোনোমতে চেপে টয়লেটের মধ্যে গিয়ে মুক্ত করে দেন তিনি। বালতির ওপর কলটাকে পুরো প্যাঁচ ঘুরিয়ে খুলে দেন। ছড়ছড় করে জল পড়তে থাকে। খক খক ঘঙঘঙ ঘঙ আখা আখা আখ খা আখা, অনিকেত মনের সুখে কাশতে থাকেন। ঘরে গিয়ে এক চামচ ওষুধ খাবেন ড্রয়ার চাবি দিয়ে খুলে, একটা থ্রোট লজেন্স মুখে রাখবেন তারপরে।
রুমি যখন ঘুমচোখে বসবার ঘরে এসে কাগজ খুঁজবে তখন সে কাগজ পড়ে ভাঁজ করে টেবিলে রাখা, বিজয়ীর ভঙ্গিতে অনিকেতবাবু বাঁ পায়ের ওপর ডান পা রেখে তাকে মৃদুমন্দ নাচাতে নাচাতে সিগারেট খাচ্ছেন। রুমি যদি ভালো করে লক্ষ করত তো দেখতে পেত অনিকেতবাবুর সিগারেট থেকে বিশেষ ধোঁয়া উঠছে না। ঠোঁটে ওটা আলতো করে ধরে রেখেছেন তিনি। রুমি কাগজের মোটা খবরগুলোতে চোখ বুলোবে : ইকোয়েডরে আবার ভূমিকম্প, কিয়োটোতে জলপ্লাবন। না ক্ষয়ক্ষতি বিশেষ কিছু হয়নি। সুপ্রতীক আসবে, চেঁচিয়ে খবরগুলো পড়বে তখন রুমি।
সে কি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি? আশ্চর্য!
হলেই বা এখানে কী! রুমি আলগা গলায় বলবে, আমাদের আছে সাইক্লোন আর পথ দুর্ঘটনা।
রুমি এবার উঠে যাবে। সুপ্রতীক বাবার সিগারেট থেকে নিজেরটা জ্বালিয়ে নিতে চাইবে, সেই সময়টার জন্যে সামান্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নেন অনিকেতবাবু। তুষের আগুনের মতো জ্বলতে থাকে সিগারেটের মুখ। ধোঁয়াটা পুরো ছেড়ে দিয়ে দু-আঙুলের ফাঁকে সেটাকে সন্তর্পণে ধরে রেখে কোনো একটা হাজারবার পড়া জার্নাল আবার পড়বেন অনিকেতবাবু। সুপ্রতীকের মুখচোখ কাগজে আড়াল। সে কিছুই বুঝতে পারবে না।
টি-মেশিন থেকে প্রত্যেকে এক এক কাপ চা নিয়ে মুখোমুখি বসবেন এবার। মৌজ করে। চমৎকার শান্তিময় আবহাওয়া। পারিবারিক প্রভাত।
রুমি আজকাল প্রায়ই জিজ্ঞেস করছে, রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল তো বাবা? গতকাল এ প্রশ্ন শুনে বড়ো বড়ো সরল চোখে তাকিয়ে ছিলেন অনিকেতবাবু, ঘুম? মানে? ঘুম হবে না কেন?
না তাই বলছিলাম।
জিজ্ঞেস করার সময়ে রুমির চোখ দুটো চায়ের কাপের ওপর থেকে আধখোলা হয়ে ভেসেছিল। ঝিনুক-ঝিনুক চোখ। দেখেও যেন দেখলেন না সেই ঝিনুকের পেটের মতো দৃষ্টি।
সুপ্রতীক পরশু বলল, তুমি এবার সকালের দিকে চা-টা বন্ধ করে দাও বাবা। একটু গরম দুধ খেলে শরীরটা ঠিক থাকবে।
অনিকেতবাবু আকাশ থেকে পড়ে বলেছিলেন, দুধ? দুধ মানে? ও দুধ! দুধ কথাটা জীবনে প্রথম শুনলেন অনিকেতবাবু।
অন্ততপক্ষে চায়ে চিনিটা খেয়ো না—সুপ্রতীক তাঁর দিকে চেয়ে বলেছিল।
চিনি দুধ না হলে তাকে আর চা বলে না মাই চাইল্ড? বেপরোয়া সাহসের সঙ্গে সুপ্রতীকের চোখে চোখ রাখলেন তিনি। মাই চাইল্ড বলতে পেরে একটা অদ্ভুত আত্মপ্রসাদ। সুপ্রতীক তাঁর ছেলে যদি চাইল্ড হয়, তা হলে তিনি কী? আর যাই হোন, নিশ্চয়ই দুগ্ধমাত্রসার দ্বিতীয় শৈশবগ্রস্ত নন।
চা-টা শেষ করে স্প্রিং-এর মতো উঠে দাঁড়ান অনিকেত।
চলি রুমি, চলি রে সুপ্রতীক। আমাকে আবার লেখা-টেখাগুলো নিয়ে বসতে হবে। কেউ কোনো সাড়া শব্দ করে না। এই নীরবতা এক হিসেবে স্বস্তির। মাথা খুঁড়ে কোনো আইডিয়া-টিয়া বার করতে হয় না তাঁকে। আবার অস্বস্তিরও। তবে কি ওরা তাঁর লেখা-টেখাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না? নাকি বিশ্বাসই করছে না! ভেতরে ভেতরে দমে গেলেও তিনি চেহারার ওপর সেটা ফুটতে দ্যান না। স্প্রিং এর মতো চলনভঙ্গিটা বজায় রেখে তিনি ওদের সামনে দিয়ে চলে এলেন। ওরা আড়াল হতে একটু আলগা দিলেন। নিজের ঘরে এসে পর্দাটা টেনে দিয়ে সোয়াস্তি।
জানলার পাশে আরামকেদারা। এই আরেকটা দাদুর আমলের জিনিস। ভাঙে না, মচকায়ও না। কুচকুচে আবলুশ কাঠের জিনিস। নরম গদি দেওয়া। সেই গদির গায়ে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে জানলার বাইরে চোখ রাখলেন তিনি। তাঁদের পনেরো তলা, পাশের ব্লকটা সতেরো তলা। সতেরো তলা টপকে আকাশরেখা দেখতে পেলেন অনিকেত। দেখতেই থাকলেন। দেখতেই থাকলেন। কী সুন্দর। কী অপূর্ব সুন্দর! কী চমৎকার এই জীবন ব্যাপারটা। আর কিছু না। শুধু সুস্থ সবল হয়ে বেঁচে থাকাটাই একটা…কী দুর্লভ সৌভাগ্য?
পাশের ব্লকটাতে ওরা ছাদ-বাগান করেছে। একটা করবী গাছ। সরু সরু বাঁকা কুকরির মতো পাতার মধ্যে থেকে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল ফুটে থাকে। সবুজে লালে নবীন। এখন, এই শীতেও সবুজ জাগিয়ে রেখেছে গাছটা। একটু খুঁজলে দেখা যাবে দুটো ব্লকের মাঝখানের জমিতে গজিয়ে ওঠা তিনটে বটল পাম। দুধ সাদা গা। ওপর থেকে সেসব দেখা যায় না। কিন্তু স্মৃতিতে ভাসে মাথায় সবুজ পালক। গাছেরা কখনও বুড়ো হয় না। ওরা যতদিন খুশি আকাশ দেখে, মাটি থেকে খাদ্য নেয়, বাতাস থেকে শ্বাস নেয়, এবং অতি মূল্যবান অক্সিজেন পৃথিবীকে দিতে থাকে। দেয় বলেই না গাছপালার এতো দাম, এতো আদর। এই যে সব গগনচুম্বী বাড়ি। তাদের প্রতি গুচ্ছে নির্দিষ্ট সংখ্যক বৃক্ষ আছে। আছে ঝোপ জাতীয় গাছ। ঝকঝকে তকতকে। ছোটো চারা যখন পোঁতা হয় তখন চারদিকে বেড়া দেওয়া হয় ভক্তিভরে। গাছ সবসময়ে জীবন দিচ্ছে, তাই গাছ দেবতা। দিতে হবে সবসময়ে কিছু-না-কিছু দিয়ে যেতে হবে। বি প্রোডাকটিভ, অনিকেত! বি প্রোডাকটিভ। বুকের ভেতরে ব্যাটাচ্ছেলে এস, সি, ডি-টা আবার বলছে। চমকে প্রায় আরামকেদারার আশ্রয় থেকেও পড়ে যাচ্ছিলেন অনিকেতবাবু।
তাড়াতাড়ি টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। মোটা নোটবই। লাইব্রেরি থেকে আনা রেফারেন্স। বেশ কিছু পত্র-পত্রিকা। ভেতরে মার্কার দিয়ে সব ওলটানো আছে। বিশ্ব রাজনীতির ওপর জনসংখ্যার প্রভাব নিয়ে একটা তথ্যবহুল প্রবন্ধ লিখছেন তিনি। লিখছেন মানে ছেলে-বউয়ের কাছে বলেছেন যে লিখবেন। আসলে কলম চিবোচ্ছেন। ভালো লাগছে না মোটেই।
পঞ্চান্ন বছর বয়সে অবসর নেবার পর ঠিক পনেরোটা বছর কেটে গেছে। গোড়ায় গোড়ায় অনিকেতবাবু খুব উৎসাহের সঙ্গে লেখাজোকা ধরেছিলেন। বিজ্ঞাপনসংস্থার সঙ্গে কাজ কারবার করতে হত, তাই চেনাশোনা ছিল কিছু কিছু। লেখার অভ্যেস। আইডিয়া নিয়ে নাড়াচাড়া করার অভ্যেস এগুলোও ছিল। নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতেন। ছাপত। রোজগারও হত। আত্মতৃপ্তিও হত। পেনশন তো পাঁচ বছর অন্তর শতকরা দশভাগ করে কমে যায়, কাজেই এই উপরি আরে নাতির জন্য দামি খেলনা, রুমির জন্য একটা ভালো পারফিউম কি সুপ্রতীকের জন্য একটা শৌখিন সিগারেট লাইটার—এই জাতীয় উপহার কিনে বাড়ির হাওয়ায় খুশির ঝলক এনে দেওয়া হত। এমন ছোটাছুটি করে দোকান বাজার করতেন, হইহই করে আড্ডা মারতেন ছেলের বন্ধুদের সঙ্গে, দুপুরবেলাও কাজে-কর্মে বেরিয়ে থাকতেন যে, ছেলে-বউ-নাতি প্রতিবেশীরা কেউই বুঝতে পারত না তাঁর বয়স হচ্ছে। মাঝে মাঝে সুপ্রতীকের বন্ধু অবুদ বলত, কাকাবাবু আপনার চুলগুলো কাঁচাপাকা না হলে কেউ বুঝতেই পারত না আপনি অবসর নিয়েছেন। আপনি আমাদের থেকেও জোয়ান।
তা সে যাই বলুক, বললেই তো আর তিনি জোয়ান হয়ে যাচ্ছেন না। কঠিন সত্য হল এই: তিনি অবসরপ্রাপ্ত, দেশের সাম্প্রতিকতম নিয়ম অনুযায়ী পঞ্চান্ন বছরেই। তাঁর রাজনৈতিক অধিকার নেই, অর্থাৎ তিনি ভোট দিতে পারেন না, কোনো আদালতে বিচারও চাইতে পারেন না। তিনি ঠিক নাগরিক যাকে বলে তা নন পুরোপুরি। যেটুকুও বা নাগরিকত্ব আছে ক্রমশই খোয়াচ্ছেন, খোয়াতে থাকবেন। এখন যে-কোনোদিন, বুড়ো অকর্মণ্য বলে বোঝা গেলেই সরকারি বৃদ্ধনিবাসের টিকিটটি তাঁকে কেউ ধরিয়ে দেবে। ছেলে বউই দেবে, ওরা যেমন প্র্যাকটিক্যাল! আর ওরা না দিলেও প্রতিবেশী আছে, বন্ধুবান্ধবের ছেলেপুলে আছে, পুলিশ আছে। নেই কে?
কিন্তু আজকাল অনিকেতবাবুর এই দৌড়ঝাঁপ আর ভালো লাগছে না। রাতুলটা যতদিন ছোটো ছিল, ভালো জমত। কিন্তু দেখতে দেখতে সেও এখন সতেরো আঠারো বছরের হয়ে গেল। তারও বাইরের জগৎ হয়েছে, গোপনীয়তা হয়েছে। তার নিজের জগতের মধ্যে আর চট করে প্রবেশ করা যায় না। করার চেষ্টা করলেই বুঝতে পারেন সুর বাজছে না।
কী রে রাতু, কী পড়বি ঠিক করলি? মেডিসিন?
কোন মেডিসিন?–রাতুল মুখ তুলে জিজ্ঞেস করে। ছোট্ট রাতুল তাঁর চিকিৎসা করতে খুব ভালোবাসত। ড্রপার দিয়ে ইঞ্জেকশন দিত। পিপারমিন্টের ট্যাবলেট খেতে দিত। অকেজো প্লায়ার্স বুকে পিঠে বসিয়ে হার্ট বিট দেখত।
কোন মেডিসিন মানে?–অনিকেতবাবু ওর কথা বুঝতে পারেন না।
মিলিটারি না সিভল না পুলিশ?
আজকাল এইসব আলাদা বিভাগ হয়েছে বুঝি?।
ততক্ষণে রাতুল তাঁর চোখের সামনে থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। যাবার সময়ে ছুড়ে দিয়ে গেছে সে কমটেক পড়বে।
কিংবা!
কী রে দাদু আজকাল কার সঙ্গে স্টেডি যাচ্ছিস? খুব মাই-ডিয়ার দাদু হতে চেষ্টা করেন তিনি।
দিয়া, চই আর দাভিনা।
তিনজনের সঙ্গে?—অনিকেত কেমন ভোম্বল মতো হয়ে যান।
হ্যাঁ!–রাতুলের অবাক উত্তর। ওসব তুমি বুঝবে না দাদু।
ইদানীং অনিকেতবাবু দুপুরবেলা আর লাইব্রেরি যান না। নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে লেখা লেখা খেলা করেন। রুমিরা জানে তিনি একটা বিশাল বই লিখবেন। প্রবন্ধ-ট্রবন্ধ ছাড়াও। বিশাল বই যা নাকি সমাজতত্ত্বের কাজে লাগবে। এ রকম বই লিখতে পারলে আলাদা করে গ্র্যান্ট পাবেন লেখক। প্রোডাকটিভ কিছু করলে সরকার নানারকম সাহায্য দিয়ে থাকে। সন্দীপন দেশাই বলে এক ভদ্রলোক পরের পর বই লিখে যাচ্ছেন। অর্থনীতির ইতিহাস। এদেশীয় অর্থনীতি, বিশ্ব অর্থনীতি। আশির কাছে বয়স হল ভদ্রলোকের। এঁর সঙ্গে অনিকেতবাবুর একসময়ে খুব আলাপ ছিল। খুব সম্প্রতি এঁকে এঁর শেষ বইটির জন্য অভিনন্দন জানিয়ে ফ্যাক্স করেছিলেন তিনি। দেশাই তার জবাব দিলেন খুব ছোট্ট এবং অপ্রাসঙ্গিক। হোপ আইল ডাই ইন মাই ওন বেড।
কিন্তু অনিকেতবাবু দরজাটা বন্ধ করে দেন দুপুরে। সন্তর্পণে জানলার পর্দাটা টেনে দ্যান। পাশের ব্লকের যে ভদ্রলোকের জানলাটা তাঁর মুখোমুখি? মনস্বী না কী যেন? বড্ড ইয়ে। কদিন আগেই গায়ে পড়ে বলেছিল, কাকাবাবু আপনার যেন কত হল? দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনার রিটায়ারমেন্টের ইয়ারটা……
অনিকেতবাবু ভীষণ উৎসাহের সঙ্গে হাত ঝাঁকিয়ে মাথা নেড়ে বলেছিলেন, সিনেমা যাবে নাকি মনস্বী। বেশ ভালো একটা অ্যাডভেঞ্চারের ছবি এসেছে। লুনার পার্ক। বলো তো টিকিট কাটি। তুমি আমি আয় রাতুল।
জানালার পর্দা টেনে দিয়ে একটা ভীষণ গর্হিত কাজ করতে থাকেন তিনি। দিবাস্বপ্ন দেখতে থাকেন : ধবধবে চুলের এক বৃদ্ধ। বারান্দায় বেতের চেয়ার পেতে সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। সময়টা ফাল্গুন চৈত হবে। ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছে, তার বাইরেটা গরম ভেতরটা ঠান্ডা হাওয়ার বৃদ্ধের এলোমেলো চুল আরও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। হাফ পাঞ্জাবি হাওয়ায় ফুলে ঢোল। বৃদ্ধবয়সের পাতলা চামড়ার ওপর বসন্তের হাওয়ার স্পর্শ, বড়ো সুন্দর! ছোট্ট একটি ছেলে বল লাফাতে লাফাতে এল।
দাদু তুমি বল খেলতে পারবে?
না ভাই।
তাহলে কুইজ? কুইজ করব?
পারব না ভাই।
আচ্ছা তাহলে বসে আঁকো।
তাও পারব না।
তবে তুমি পারবেটা কী?
মৃদু হেসে বৃদ্ধ বলেন, মনে মনে পারি। এখনও এসবই মনে মনে পারি। চোখ বুজে ঘুম ঘুম এসে যায়। স্মৃতির ওপর এক পর্দা কাপড়। ক্ষীণভাবে অনিকেতবাবুর মনে হয়, কে? কে এই বৃদ্ধ?—তাঁর দাদু বোধহয়। আর গুন্ডা ছেলেটা? তিনি, তিনিই নিশ্চয়। একাশি বছর বয়সে তাঁর এগারো বছর বয়সের সময়ে খুব সম্ভব মারা গিয়েছিলেন দাদু। এই আরামচেয়ার, ওই ঘড়ি তাঁর। অন্য এক পল্লির অন্য এক বহুতলের তিনতলায় থাকতেন তাঁরা। আবার ঘোর এসে যায় অনিকেতবাবুর।
রুমি, সুপ্রতীক, গায়ত্রী আর তিনি। রাতুলকে নিয়ে লম্বা পাড়ি দিয়েছেন। মোটরে। সুপ্রতীক চালাচ্ছে, রুমি তার পাশে। পেছনে বাকিরা। দু-পাশে পাহাড়ি গাছ। সরল, দেওদার…এটা কোন জায়গা…দার্জিলিং? শিলং? মুসৌরি? হঠাৎ গাড়িটা ঘ্যাচ ঘ্যাচাং করে থেমে গেল। সুপ্রতীক নেমে পড়ে অনেকরকম চেষ্টা চরিত্তির করল। এমন কি রাতুলও। কিন্তু কিস্যু হল না। গাড়ি যেমন নট নড়ন চড়ন তেমনি হয়ে আছে। তখন অনিকেতবাবু নামলেন। জাস্ট পাঁচ মিনিট। হাতের সাদা রুমালটা কুচকুচে কালো হয়ে গেল অবশ্য কিন্তু গাড়ি সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগল। রাতুল বলছে, তোমার হাতে জাদু লিভার আছে নাকি দাদু। রুমি বলছে, বাবা না থাকলে এই বিশ্রী জায়গায় রাত হয়ে আসছে…কী ঠান্ডা।
ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে দিচ্ছে রুমি। এটা বড়ো প্রিয় দিবাস্বপ্ন অনিকেতবাবুর। কখনও ঘটেনি। কিন্তু যদি ঘটে! এমন কেন সত্যি হয় না আহা! এ ছাড়াও আরও কত ভালো ভালো দিবাস্বপ্ন আছে অনিকেতবাবুর। কোনটা রেখে কোনটা দেখবেন? দেখতে দেখতে জমাট দুপুর ঘুম এসে যায়। ফুরফুর ফুরফুর করে নাক ডাকতে থাকে। হঠাৎ নাকে ফৎ করে একটা বেয়াড়া মতো আওয়াজ হতেই তিরবেগে উঠে বসলেন অনিকেতবাবু। বুকের ভেতরটা ধড়াস ধড়াস করছে। জানালার পর্দা টানা আছে তো ঠিক? দরজাটা বন্ধ? হ্যাঁ। আছে। আছে।
অর্থনীতির ওপর প্রবন্ধ! হু। রাজনীতির ওপর লোকসংখ্যার প্রভাব। মাথার মধ্যেটা রাগে চিড়বিড়িয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। লিখতেই যদি হয় তিনি রম্যরচনা লিখবেন। আবার ফর্মের দিক থেকে রম্য হলেও তা হবে রুদ্র রচনা। মনের যাবতীয় ক্ষোভ, জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা সব প্রকাশিত হবার জন্যে তাঁর মাথার মধ্যে ফাটাফাটি হুটোপাটি করে চলেছে। কিন্তু এরকম কিছু লেখা মানে নাহক নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা। ঠিক আছে না-ই বা প্রকাশ করলেন, শুধু নিজের তৃপ্তির জন্যেই তিনি লিখবেন। এই সংকল্প মনের মধ্যে উঁকি দেবামাত্র রায়মহাশয় তাঁর কম্পিউটারে কাগজ ভরলেন। একটু ভাবলেন, তারপর লিখলেন
জীবন সুন্দর, পৃথিবী সুন্দর, কিন্তু মানুষ কুৎসিত, সমাজ কুৎসিততর, শাসনযন্ত্র কুৎসিততম। যৌবনও কুৎসিত। যত বয়স হইতেছে, বুঝিতেছি যৌবনও কুৎসিত। কারণ, হ্যান্ডসাম ইজ দ্যাট হ্যান্ডসাম ডাজ। যে যৌবন বৃদ্ধের আত্মত্যাগের মূল্যে ফুর্তি কিনিয়া বাঁচিয়া থাকে তাহাকে ধিক। যে যৌবন বৃদ্ধের জীবন হইতে বসন্তের অধিকার ছিনাইয়া লয় তাহাকে ধিক। যে সকল বৈজ্ঞানিক উন্নতি, প্রাযুক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করিবার সামাজিক পরিকাঠামো তোমরা প্রস্তুত করিতে পার নাই, সে সকলের সঙ্গে তাল মিলাইবার চেষ্টা তোমাদের হাস্যকর। কারণ তাহা করিতে গিয়া মানুষের স্বাভাবিক অধিকারগুলি তোমরা ছিনাইয়া লইতেছ। এগুলি তোমাদের বেতালা বেসুরো আসুরিক কাণ্ড। জনসংখ্যা হু হু করিয়া বাড়িতেছে। তো আমরা কী করিব? আমাদের কাহার ঘরে একটি দুটির বেশি সন্তান আসে না। কোথায় বাড়িতেছে, কেন বাড়িতেছে খোঁজ আর লইবে কি! ভালো করিয়াই জানো সব। দারিদ্র্য, অপরাধ, অধিকার, কুশিক্ষা, প্রজাবৃদ্ধি সকলই তো পুষিতেছ? আর খাঁড়াটি তাক করিয়াছ সিনিয়র সিটিজেনের গলদেশ তাক করিয়া? যে নাকি সারাজীবন ধরিয়া তিল তিল করিয়া দিয়াছে?
ছাপা কাগজটার দিকে চেয়ে রইলেন অনিকেতবাবু। ভাষাটা যে দাদামশায়ের বেরোল। দাদামশায় কেন কে জানে এই ভাষায় চিঠিপত্র লিখতেন। তাঁর কাছে রয়েছে কয়েকটা। ভাষাটার কেমন একটা বুড়ো বুড়ো বিজ্ঞ বিজ্ঞ গন্ধ। তাঁর মধ্যে কি দাদামশায়ের ভূত ঢুকল? ঢুকুক, তাই ঢুকুক। রাজনীতির ভূত ঢোকার চেয়ে তা শতগুণে ভালো।
অস্থির হয়ে পায়চারি করতে শুরু করে দিলেন তিনি। গত পঞ্চাশ বছরে মৃত্যুর হার লক্ষণীয়ভাবে কমে গেছে। শেষ এপিডেমিক এসেছিল এডসের। এ শহরের সমস্ত হাসপাতাল, নার্সিংহোমের ব্লাড-ব্যাংক, ইনজেকশনের ভূঁচ এডসের ভাইরাসে ভরে গিয়েছিল। সেসময়ে ইউ, এন. ও.-র শাখা ডাবলু. এইচ. ও হাসপাতালগুলো অধিগ্রহণ না করলে কয়েক কোটি মানুষ মরে যেত। কিন্তু ডাবলু, এইচ, ও, তখন থেকে শক্ত হাতে হাসপাতালগুলো পরিচালনা করে চলেছে। সংক্রামক ব্যাধি এখন প্রায় নেই-ই বলতে গেলে। দেহযন্ত্র বিকল হলে চোখ থেকে শুরু করে হার্ট, কিডনি লাং সবই পাওয়া যাচ্ছে। চোখ থেকে মজ্জা পর্যন্ত সব কিছু ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে। মৃত্যুর হার তাই কমে গেছে। এদিকে জন্মের হার কমছে না। তা-ও আবার বিশেষ বিশেষ পকেটে বাড়ছে। কতকগুলি পল্লি থেকে কজন মানুষ বেরোয় হাতে গোনা যায়, আবার কতকগুলি পল্লি থেকে পিলপিল করে মানুষ বেরোয়। দারুণ সস্তা হয়ে গেছে টেলিযন্ত্র। বেশির ভাগ মানুষের সাংস্কৃতিক খাদ্য এখন হিংস্র, কামোত্তেজক এন চ্যানেল। স্কুলকলেজে ড্রপ-আউটের সংখ্যা বাড়ছে। বেকারভাতা এসে গেছে। ভোটাধিকারের বয়স ক্রমেই কমছে। আঠারো থেকে যোলো হল, এখন পনেরো।
বেলা তিনটের সময়ে অনিকেতবাবুর খিদে পেল। তিনি আভেনের হটচেম্বার থেকে বিরিয়ানি বার করে খেলেন। এই এক টং হয়েছে, সব কিছু নিউট্রিশন একত্র করে পনেরো মিনিটে স্বাস্থ্যপ্রদ এক পদ রান্না। চাইনিজ খিচুড়ি, থাই পোলাও, বিরিয়ানি আলা ফ্রাঁস। কোল্ড চেম্বার থেকে কাঁচা সালাড বার করলেন তিনি। আজকাল আর একদম কাঁচা খেতে পারছেন না। সালাড-ড্রেসিংটা মেয়নেজ মনে হচ্ছে। সেটুকু চেঁছে পুঁছে খেয়ে তিনি হাজার স্কোয়্যার ফুটের ফ্ল্যাটটা পায়চারি করে বেড়াতে লাগলেন।
রাত্রে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন দেখে রুমি জিজ্ঞেস করল, বাবার কি শরীরটা ভালো নেই!
আজ অনেক বেলায় খেয়েছি, খিদে নেই।
তোমাকে কতবার বলেছি টাইমটা মেনটেইন করো। রেগুলারিটিই হল গিয়ে আসল-সুপ্রতীক থমথমে গলায় বলল।
গ্রাহ্য করলেন না, অনিকেতবাবু। গম্ভীরভাবে বললেন, লিখতে লিখতে খেয়াল ছিল না। এ কথায় কেমন হৃষ্ট হয়ে উঠল দুজনেই। রুমি এবং সুপ্রতীক।
রুমি বলল, খেতে ভালো না লাগে নাই খেলেন। একগ্লাস ট্রাংকুইলেট খেয়ে নেবেন শোবার আগে…
ওসব তোমরা খাও—বলে অনিকেতবাবু বিরক্ত, ক্ষুব্ধ, অন্যমনস্ক হয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। আজ যেন কাউকেই গেরাহ্যি করছেন না তিনি।
এরা দুজনে অর্থপূর্ণভাবে চোখ চাওয়াচাওয়ি করল শুধু।
অনেক রাত অবধি ঘুমোতে পারলেন না অনিকেতবাবু। কিন্তু জেদ করে কোনো ওষুধ বিধুষও খেলেন না। ট্রাংকুইলেট নামে পানীয়টাও না। মাঝরাত পার করে দু এক ঘন্টার জন্যে ঘুমটা এসেছিল, তারপরই তাঁর দাদামশায় তাঁকে জানিয়ে দিলেন টং টং টং টং।
অনিকেতবাবু উঠে মুখ ধুলেন, ধড়াচূড়া চাপালেন। একটা আলোয়ান মুড়ি দিলেন সবার ওপর। তারপর নিঃশব্দে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে, এলিভেটর চালিয়ে নীচে নেমে এলেন। রাত-দারোয়ান ঘুমিয়ে পড়েছে। শুনসান মাঘের রাস্তায় একেবারে হিমমণ্ডলে ডুব দিলেন অনিকেতবাবু। শীতে আড়ষ্ট হরে থাকা পা বাড়ালেন পার্কের দিকে।
কোণটা সবে ঘুরেছেন, নিঃশব্দে একটা ঢাকা ভ্যানমতো এসে দাঁড়াল তাঁর পেছনে, নিঃশব্দে লাফিয়ে নামল দুজন আপাদমস্তক য়ুনিফর্ম-পরা লোক। একজন ডান দিকে, একজন বাঁ দিকে অনিকেতবাবুর। তিনি ভালো করে কিছু বোঝার আগেই ভ্যানের ভেতরে চালান হয়ে গেলেন। তাঁর মাথার ওপর দিয়ে একটা ঘেরাটোপ গলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কে তোমরা? কী চাও? কী চাও? তিনি বৃথাই চেঁচাতে লাগলেন। কেউ কোনো উত্তর দিল না। সামান্য পরে তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর মুখে যে ঘেরাটোপটা দেওয়া হয়েছে সেটা সাউন্ড প্রুফ। এবং তিনি ধীরে ধীরে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। এইভাবেই তাহলে ওরা অনিচ্ছুক বৃদ্ধদের বৃদ্ধাবাসে নিয়ে যায়!
যখন জ্ঞান হল, অনিকেতবাবু দেখলেন তিনি একটি চমৎকার আলোকিত ঘরে শুয়ে। তাঁর শয্যাটি মাথার দিকে এমন করে তোলা যেন তিনি আরামকেদারাতেই বসে আছেন। তাঁর চারপাশে বেশ কিছু ভদ্র ব্যক্তি দাঁড়িয়ে। দেখলে যেন মনে হয় ডাক্তার। সকলেরই হাসিমুখ। ঠিক এমন পরিবেশ অনিকেতবাবু আশা করেননি।
এখন কেমন বোধ করছেন?
ভালো—অনিকেতবাবু ক্ষীণস্বরে বললেন।
খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।
কেন?
রাস্তার মাঝখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন।
তাই?–অবাক হয়ে অনিকেতবাবু বললেন—আমি তো…আমাকে তো…
হ্যাঁ আমাদের হেলথ স্কোয়াডের ভ্যান ভাগ্যে ওখান দিয়ে যাচ্ছিল!
তাই? অনিকেতবাবু দুর্বলভাবে জিজ্ঞেস করলেন, আমি তো ভাবলুম…আচ্ছা আমার ছেলে বউ সপ্রতীক আর রুমি রায়মহাশয় তেত্রিশের বি,…
আহা হা ওঁদের খবর দেওয়ার তো আর দরকার হবে না।–একজন স্মিতমুখে বললেন, আপনি তো ভালোই হয়ে গেছেন। জাস্ট একটা ব্ল্যাক আউট হয়েছিল। আমরা সব চেক-আপ করে নিয়েছি। আপনি বাড়ি যেতে পারেন।
একলা একলা মানে একটা গাড়ি…
সব ব্যবস্থা আছে, আমাদের ভ্যানই যাবে।
একটা প্রেসক্রিপশন মানে ব্ল্যাক-আউটটা…
ভদ্রলোকেরা স্নেহের হাসি হাসলেন, পৌঁছে যাবে, ভ্যানে আপনার সঙ্গেই পৌঁছে যাবে।
কোমরের কাছে চওড়া বেল্ট দিয়ে শয্যার সঙ্গে বাঁধা ছিলেন অনিকেতবাবু। তার থেকে অনেক তার বেরিয়েছে।
হ্যাঁ একটা কথা, হাসিমুখে একজন বললেন, আপনি যদি কাইন্ডলি একটা কাগজে সই করে দ্যান।
সামনে মেলে ধরা কাগজটার অনিকেতবাবু দেখলেন তিনি স্বেচ্ছায় তাঁর কিডনি, হার্ট এসব দান করেছেন। আপত্তি কী? চোখদুটো তো আগেই দান করে রেখেছেন।
তিনি হেসে বললেন, জ্যান্ত থাকতে থাকতে আবার খুবলে নেবেন না যেন।
কথা শুনে ভদ্রলোকেরা সবাই হাসতে লাগলেন। একটা রসিকতা করেছেন বুঝে অনিকেতবাবুও হাসতে লাগলেন। হাসতে হাসতেই সই করে দিলেন।
ব্যস আপনি মুক্ত। বেল্টটা ধীরে ধীরে খুলতে লাগলেন একজন।
উঠতে গিয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন অনিকেতবাবু। তিনি তো আর জানতেন না তাঁর হার্ট, কিডনি, সব আগেই বার করে নেওয়া হয়ে গেছে। এসব এখন কাজে লাগবে কোনো অসুস্থ কিন্তু ভোটপ্রদানক্ষম তরুণের। এতক্ষণ তাঁকে যা বাঁচিয়ে রেখেছিল তা হল তাঁর মাথার কাছে রাখা যান্ত্রিক হার্ট, যান্ত্রিক কিডনি। তাঁর মুক্তির মুহূর্তেই সেগুলোর সুইচ অফ করে দেওয়া হয়েছে। এরা নিতে পারেনি শুধু তাঁর বৃদ্ধ, অভিজ্ঞ ব্রেইনটা। নেবার কৌশল এখনও আয়ত্ত করে উঠতে পারেনি, পারবে কি না তা-ও বলা যাচ্ছে না। এমন কি পারলেও নেবে কি?
জীবনের শেষ ধবনি অনিকেতবাবু শুনতে পেলেন সন্দীপন দেশাইয়ের গলায়। সহ্যের অতীত ডেসিবেলে আওয়াজ তুলে বলছেন, হোপ আইল ডাই ইন মাই ওন বেড।
অন্য ভাই
শমী এসেছে আগে। ধৈর্য ধরতে না পেরে। মেয়েকে নিয়ে একলা। ওর স্বামী বিনায়ক কথা দিয়েছে শিগগির আসবে। দু-একদিন থেকে ওদের নিয়ে ফিরে যাবে। সময় জিনিসটা ওর কখনও হয় না। ছুটি জিনিসটাও ও কক্ষনো নাকি পায় না। আসল কথা, শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কের কারও অতিথি হয়ে থাকতে বিনায়কের ভীষণ আপত্তি। কতবার শমী বলেছে, দিদির তো নিজের সংসার। শ্বশুরবাড়ির কেউ নেই। সংকোচ কিসের? অতবড়ো বাংলো, গেলেই একখানা পুরো ঘর, বাথরুম, সামনের ব্যালকনি ছেড়ে দেবে। ব্যালকনিতে তুমি যত খুশি যোগাসন কর না, কেউ দেখতে আসবে না। অত করে বলে জুলি, যেতে দোষ কি? দিদি বেশি বড়ো নয়, শমী তাকে জুলি বলে ডাকতেই অভ্যস্ত। বিনায়কের সঙ্গে কথায় কেউ পারবে না। বলবে—কী আশ্চর্য, দিদি অমন একখানা গ্ল্যামারাস শালী, যেতে বলছে, আমি কি উপায় থাকলে যেতুম না!
শমী এর চেয়ে বেশি কথা বলতে পারে না। তার ছিপছিপে নাতিদীর্ঘ শরীরের ওপর পাতলা ঈষৎ পাণ্ডুর মুখ। গভীরভাবে বসানো চোখের বাদামি মণি হঠাৎ হঠাৎ বড়ো বড়ো পল্লব দিয়ে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে সে। কোনো তর্কাতর্কির সম্ভাবনা দেখলেই এই তার প্রতিক্রিয়া। নাকের পাটা একটু কাঁপে। কপালের ওপর একটা লম্বা শিরা জেগে উঠেই মিলিয়ে যায়। শমী বেশি কথা বলতে পারে না।
হঠাৎ দেখলে মনে হবে সে খুব ধাতস্থ। কাণ্ডজ্ঞানের বেড়া ভাঙবার মতো ভাবাবেগের কারবারি আদৌ নয়। কিন্তু একটু লক্ষ করলেই বোঝা যাবে ভাবাবেগে কখনও কখনও তার গলার কাছের পেশি ত্বক সব কিছুকে প্রচণ্ড চাপ দিচ্ছে। তারপর বহু চেষ্টায় মস্ত বড়ো একটা খাদ্যপিণ্ডের মতো এবার নেমে যাচ্ছে গলনালি দিয়ে। এসব জিনিস কেউ বড়ো একটা লক্ষ করে না। শমীর স্বামী বিনায়কও না। কাজেই শমী যে কী, শমী যে কে এ প্রশ্ন অনুত্তরই থেকে যায়। আরও অনেক মেয়ে, কিছু কিছু পুরুষ অর্থাৎ আরও কিছু কিছু মানুষের মতো এ লোকযাত্রায় শমী পরিচয়হীন রয়ে গেছে। ছাইয়ের ওপর হালকা ফুলছাপ শিফন শাড়ি পরে, একটা পাতলা সুটকেস একহাতে, আর তার সযত্নলালিত বারো বছরের মেয়ে লোপামুদ্রাকে আর একহাতে নিয়ে শমী যখন প্ল্যাটফর্মে পা দিল, তার দিদি জুলি আর জামাইবাবু বরুণদা দু ধার থেকে মহা হইচই বাধিয়ে দিলেন, যাক শমী তুই শেষ পর্যন্ত আসতে পারলি তা হলে। সূর্যটা তো ঠিক দিকেই উঠেছিল রে।
দেখো চাঁদটা লক্ষ করতে হবে। চাঁদের একটা কিছু গোলমাল হয়ে থাকতে পারে।
জুলি আদর করে কাঁধে হাত রেখে বলল, তুই খুব রোগা হয়ে গেছিস। বরুণদা বললেন, নিজের সঙ্গে তুলনা করলে তুমি সবাইকেই রোগা দেখবে জুলি। ওটা কোরো না।
নিজেকে বাদ দিয়ে কথা বলো না। জুলি খ্যাঁক করে উঠল, যতই হোক তোমার মতো ভুড়ি আর ডবল গাল তো আমি বাগাতে পারিনি। জানিস শমী, তোর বরুণদার ক্লাবের ওপর কী টান, কী টান। ক্লাবে গিয়ে রোজ সন্ধেবেলা কী হয় বলো তো?
শমী একটু মৃদু স্বভাবের। সে বাধা দিয়ে বলল, ওঃ জুলি, বরুণদার কী সুন্দর লালচে গাল হয়েছে, তুই শুধু ফ্যাটটাই দেখলি!
বরুণদা গালে হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন, দেখো বাবা গালাগাল দিচ্ছে না তো?
লোপামুদ্রা ওরফে লুপ তখন তার তিন বছরের বড়োদাদা সীজারের সঙ্গে গল্পে মত্ত। উত্তেজিত হাত-পা নাড়ার মধ্যে থেকে স্টেফি, এডবার্গ, লেন্ডল বুলেটের মতো এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ছে। দুজনে এগিয়ে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে স্টেশন ছাড়িয়ে। বড়োরা কেউ এল, না এল লক্ষই নেই।
বরুণদা বলল, চলো, জুলি শমী তাড়াতাড়ি পা চালাও, সুটকেসটা আমার হাতে দাও, কী এমন মহামূল্যবান সম্পত্তি ওতে করে নিয়ে এসেছ যে তখন থেকে আঁকড়ে রয়েছ?
জুলি বলল, হ্যাঁরে শমী, তাড়াতাড়ি পা চালা, নইলে স্টিয়ারিং সীজারের হাতে চলে যাবে।
শমী ভুরু কুঁচকে বলল, সে কী? ওর কি লাইসেন্স আছে নাকি! ওর বয়সের ছেলেকে কি লাইসেন্স দ্যায়?
জুলি বলল, ষোল-আঠারো ওসব সাধারণ মানুষের নিয়ম শমী। জিনিয়াসদের ক্ষেত্রে বয়সটা কোনও বাধাই নয়।
বরুণদা বললেন, তা ছাড়া গাড়ির স্টিয়ারিং তো সামান্য কথা জীবনের স্টিয়ারিংটাই আমার ছেলের হাতে চলে বাবার উপক্রম হয়েছে।
শমী হেসে ফেলল, তা হলে আর দেরি নয়, শিগগির চলুন যদি আটকাতে পারি।
বরুণদা কটাক্ষে দুই বোনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি আটকাবে সিজারকে? বলে হাতি ঘোড়া গেল তল, এখন মশা মাপে কত জল!
জুলি রেগে উঠল, দ্যাখো আমাকে যখন তখন হাতি, ঘোড়া, জলহস্তী, বাইসন যা খুশি বলল আমার গা সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু আমার বোনকে খবরদার মশা মাছিটাছি বলতে পারবে না।
বরুণদা হাসতে হাসতে বলল, মাছির আগে যদি টুক করে একটা মউ বসিয়ে দিই? তবে? তবে গ্রাহ্য হবে তো?
শমী বলল, জুলি রাজি হসনি। মউমাছি কী রকম ভিনভিন করে দেখেছিস? ঘেন্না লাগে না ঘুরঘুর করলে? আর সুযোগ পেলেই হুল ফোঁটায়। আমাদের বারান্দার পাশে দোলনচাঁপার অত সুন্দর গাছটা কেটেই ফেলতে হল মউমাছির জ্বালায়।
বরুণদা বলল, দুই বোনই দেখছি সমান বিচক্ষণ। গাড়ি যখন জুলিদের বাড়ির গেটের ভেতর ঢুকল তখন তামাটে দিগন্তে সূর্য একটি গনগনে লাল গোলা। দু-দিকের দুটো দরজা খুলে সিজার আর লুপ আগে পিছে দৌড় দিয়েছে। শমী বলল, কী সুন্দর রে জুলি। রোজ ভোরবেলা বেড়াতে যাব।
বরুণদা বলল, খবরদার এটি কোরো না। ভীষণ ডাকাতের উপদ্রব এ অঞ্চলে, ভোরই বলো, সন্ধেই বলো, নির্জন সময়ে পায়ে হেঁটে এসব রাস্তায় বেরোনোর কথা কল্পনাও কোরো না।
শমী হতাশ গলায় বলল, কী যে বলেন বরুণদা। ওসব আপনার বাহানা। বেরোলে সাহেবের প্রেসটিজ যায় নাকি?
বরুণদা বলল, বেশ তো দিদিকে জিজ্ঞেস করো।
সত্যি রে, জুলি বলল, আমাদের থেকে দক্ষিণে কোণাকুণি ওই বাড়িটা, ওখানে চ্যাটার্জিরা থাকে, রবিবার সকালে চাবি দিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছে এসে দ্যাখে স্কুটার টিভি টোস্টার—মানে যাবতীয় গ্যাজেট চুরি গেছে। সেই সঙ্গে ভালো ভালো জামাকাপড়। তা ছাড়াও শুনেছি, গ্যাং রাস্তার মাঝখানে পথ আটকে কত লোকের ঘড়ি আংটি হার সব খুলে নিয়েছে।
শমী বলল, এসব পরাই বা কেন! সিজার, লোপামুদ্রা কখন ওদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা খেয়াল করেনি, সিজার বলে উঠল, ডোন্ট ওয়ারি মাসি। আমি তোমাদের বেড়াতে নিয়ে যাবো। শুধু টাইমটা আমার বলে দিয়ো। গ্যাং-ট্যাং এলে কী করবি? শমী হেসে বলল।
গ্যাং? আমি নিজেই তো একটা গ্যাং। কী করবে ওরা আমি থাকতে? ফুঃ।
বরুণদা জনান্তিকে বললেন, সিজারের বাণী কিন্তু ফাঁকা আওয়াজ হয় না, বুঝেছ শমী? সাধারণত উনি এত উদার হন না। হয়েছেন যখন অফারটা নিয়ে। নাও।
টেনে বাঁধা চুল খুলতে খুলতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল শমী। তামাটে রঙের মাটি। সুন্দর সুন্দর বাড়ি। ছবির মতো। সন্ধে হতেই ঝুপ করে নির্জনতা নেমে পড়ল যেন পাখা বিস্তার করে। জুলি নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে—এখানে জঙ্গল নেই, না রে?
নাঃ। জঙ্গল এখানে পাবি না। তবে এত গাছ, এত সুন্দর সাজানো, সযত্নে গড়ে তোলা পার্ক যে জঙ্গলের অভাব তুই টেরই পাবি না।
শমী ভুরু কুঁচকোল—কী যে বলিস? সাজানো পার্ক আর জঙ্গল এক হল? জঙ্গল যে অরণ্য, আদিম একেবারে প্রাথমিক, স্বতঃস্ফূর্ত, বলতে বলতে শমী হঠাৎ যেন সংকুচিত, হয়ে থেমে গেল। সে বেশি কথা বলতে পারে না। যখন বলে, বলে ফেলে, তখন এমনি করে সংকুচিত হয়।
জুলি ঈষৎ অন্ধকারে তার দিকে চেয়ে আছে। চোখে যেন ভৎসনার দৃষ্টি। বলল, শমী তোর জঙ্গল জঙ্গল বাই এখনও গেল না? সাজানো গাছপালা, বীথিকা, মানুষের হাতে পরিকল্পনা করে পোঁতা গাছ অনেক ভালো বুঝলি? জুলি নিঃশ্বাস ফেলল একটা। তারপর বলল, হ্যাঁ রে, বিনায়ক ঠিক আসবে তো?
না এলে কী? আমি একলাই তো এলাম। একলাই আবার চলে যেতে পারব।
তা নয়, মানে হ্যাঁরে শমী। তোরা একসঙ্গে বেড়াতে যাস না? এই যে তুই চলে এলি ওর দেখাশোনা কে করবে? শাশুড়ি? কিন্তু তোর মন খারাপ করবে না?
শমী হেসে ফেলল, বলল, কেন বেড়াতে যাব না, এই তো গত বছরই গোয় ঘুরে এলাম, জানিসই তো! আর শাশুড়িই তো বরাবর দেখাশোনা করে এসেছেন, এখনই হঠাৎ সেটা বদলে যাবে কেন?
জুলি স্বস্তির হাসি হাসে, বলে, যাই বলিস বাবা, বরছাড়া বিয়ের পর কোথাও যেতে কেমন কেমন লাগে। যেন মনে হয় লোকে মনে করবে দুজনে বনিবনা নেই।
তুই কি তাই-ই ভাবছিস না কি? এবার গম্ভীর হয়ে শমী জিজ্ঞেস করল।
না তা ঠিক নয়।
জুলি ভুলে যাস না তেরো বছর বিয়ে হয়ে গেছে আমার। ছোটোখাটো হলেও একটা কাজকর্ম আমি করি। বনিবনার বাইরের চেহারাটা তোদের মতো গাঢ় নাও হতে পারে।
ভেতরের চেহারাটা ঠিক থাকলেই হল জুলি হেসে বলল—যাক চল তো এখন, তোর বরুণদা চায়ের জন্য অনেকক্ষণ ধরে হাঁকডাক করছে।
চায়ের আসরে দুই ছেলেমেয়েকে দেখা গেল না। শমী ব্যস্ত হলে বরুণদা বললেন, তুমিও যেমন, সিজার নিশ্চয় লুপকে নিয়ে ক্লাবে চলে গেছে। দুজনেই খেলা পাগল, এখন ক্লাবে জুনিয়রদের টেনিস হবে।
শমী বলল, বলে যাবে তো!
বলে যাবে সিজার? তা হলেই হয়েছে। বলে-টলে যাবার কথা তার স্মরণে থাকলে তো! জুলি কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল। রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে শমীর ঘুম আসে না। চারদিক থেকে একটা নিবিড় আরাম ঘিরে ধরেছে তাকে। এই ফাঁকা ফাঁকা কলোনি, নিষ্কলঙ্ক বিশুদ্ধ বাতাস, বাতাসে গাছের গন্ধ, এ তার কিশোরী বয়সের প্রতিবেশ। গত চার বছর ধরে জুলিরা এখানে আছে। প্রথম থেকেই তাকে ডাক দিচ্ছে। এতদিনে তার আসার সময় হল। যেন মনে হচ্ছে সে এখানেই ছিল। মাঝখানটা অর্থাৎ হোস্টেল, গোয়াবাগান, এন্টালি, বিনায়ক এই সবসুদ্ধ জীবনের অংশটা স্বপ্ন। দরজায় টুকটুক করে আওয়াজ। উঠে দরজা খুলে দিল শমী। যা ভেবেছে তাই। জুলি উঠে এসেছে। ফিসফিস করে বলল-ঘুমোসনি তো! আমিও ঘুমোতে পারিনি। কতদিন পরে দু-বোনে, বল তো! তোর মেয়ে ঘুমিয়েছে?
অনেকক্ষণ। আমিই এপাশ ওপাশ করছি।
কেন রে? বালিশ-টালিশ ঠিক হয়েছে তো? তুই তো পাতলা বালিশে শুস।
বালিশটা কোনো সমস্যা নয়। আমার ঘুম হচ্ছিল না…
নতুন জায়গা বলে না কি রে?
নতুন বলে নয় রে জুলি পুরোনো বলে, শমী যথাসম্ভব ফিসফিস করে বলল।
বিছানার ওপর উঠে এসে জুলি সাবধানে লোপামুদ্রাকে সরিয়ে দিল। তারপর বোনের পাশে ঝপাং করে শুয়ে পড়ল।
তোর এ জায়গাটা পুরোনো লাগল?
দিনের আলোয় লাগেনি। এখন রাতের অন্ধকারে লাগছে…।
শমী বেশি কথা বলতে পারে না। জুলি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কী করে যে তোর পুরোনো লাগছে জানি না। কোথায় সে শালের জঙ্গল? বনকাটা বসত কই? রোজই কোয়ার্টাস উঠছে নতুন নতুন…সদ্য কাটা গাছের গুঁড়ি, ডালপালার ছাঁট রাস্তার পাশে সে সব কই?
না-ই থাকল, ছোট্ট গলায় জবাব দিল শমী, অন্ধকারে আমি শালমঞ্জরীর গন্ধ পাই এ রকম ফাঁকা জায়গায় এলেই। আসিনি অনেকদিন। গন্ধটাও পাওয়া হয়ে ওঠেনি। সেইসব দিনের গন্ধ। শমী পাশ ফিরে জুলিকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখে। জুলি বলল, শমী, তুই কি চিরকাল ছেলেমানুষ থাকবি! শমী জুলিকে ছেড়ে সরে শুল, বলল, আমি তো ছেলেমানুষ নই! আমি তো কোনো কালেও ছেলেমানুষ ছিলাম না জুলি, চিরকাল জ্ঞানবৃদ্ধ, তৌল করে, মেপে চলি, চলি না!
জুলি তরল গলায় বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই একেবারে ঠাকুমা-দিদিমা আমি জানি। এখন চুপ কর তো! লুপটা ঠিক তোর মতো হয়েছে। না রে?
শমী অবাক হয়ে বলল, লুপকে তুই আমার মতো কোথায় দেখলি? ও কি দস্যি জানিস! তা ছাড়া ও খুব মিশুক। খেলাধুলো করে। ওর চেহারাও খানিকটা ওর বাবার মতো। সবাই বলে।
সবাই বলুক। ভীষণ একটা আদল আছে। আসলে আজকাল ছেলেমেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষার ধরনটা এমন হয়েছে যে ওরা খানিকটা দস্যিগিরি দলে পড়েই করে। এগুলো বাইরের ব্যাপার। ভেতরে ভেতরে ও তোর মতন।
আমার মতো হয়ে আর কাজ নেই। তুই একদিন দেখেই ওর ভেতরটা বুঝে ফেললি।
তোরা রোজ দেখিস তো! আমরা মাঝে মাঝে দেখি বলে আদলটা ঝট করে ধরতে পারি। চুলের ফেরটা ঘাড় কাত করে তাকাবার ভঙ্গিটা। দেখিস ও-ও কথা বলতে বলতে হঠাৎ তোর মতো চুপ হয়ে যায়।
তোর ছেলে কিন্তু তোরও এক কাঠি বাড়া হয়েছে রে জুলি।
যা বলেছিস। সমস্ত গ্যাজেটস-এর পার্টস খুলে ফেলে জানিস, যখন তখন কার্নিশ বেয়ে বেয়ে ছাদে উঠে যাচ্ছে, লগি দিয়ে বাথরুমের ছিটকিনি ফেলে দিচ্ছে। বাড়িতে লোক এলে তার স্কুটার নিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে, যা-তা একেবারে।
পার্টস খুলে ফেলে? তার মনে ও এঞ্জিনিয়ার হবে, দেখিস।
মেকানিকও হতে পারে, জুলি মস্ত বড়ো একটা হাই তুলল।
আমরা পাহাড়ে যাচ্ছি, মা, বাবা, মাসি, আমার পাহাড়ে… স্কুটার নিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে গেল সীজার।
সিজার, সিজার সিজারের বাবা আতঙ্কিত রুষ্ট গলায় চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এলেন। কিন্তু স্কুটারের আওয়াজে বেচারার গলায় আওয়াজ একেবারে চাপা পড়ে গেল।
জুলি, তুমি কিছু বললে না।
বলবার সময় পেলে তো বলব। জুলি স্যান্ডউইচে মাখন মাখাতে মাখাতে উত্তর দিল। স্যান্ডউইচগুলো হাতে করে তৈরি করে প্রথমেই দুই ছেলেমেয়েকে দিয়েছে। দুধ ঢেলে দিয়েছে কাপে। সিজার তো খায় না, গেলে। চোঁ করে দুধ খাওয়া হয়ে গেল। তিন চার কামড়ে স্যান্টউইচ শেষ। লুপকে বলল, দেরি করছিস কেন? আর স্টাইল করে খেতে হবে না। এখনও গোঁফে দুধ লেগে যায়। আবার কড়ে আঙুল উঁচু করে কাপ ধরা হয়েছে!
জুলি একটা ধমক দিল, ওর তোর মতো সাপের গেলা নয়। দাঁত আছে তার ব্যবহার করছে। স্টাইল আবার কি? ভদ্রভাবে খাচ্ছে। তোর মতো হাউমাউ করছে এ আমাদের অনেক ভাগ্য।
লুপ কিন্তু একগাল হেসে উঠে দাঁড়িয়েছে—হাতে তখনও স্যান্ডউইচের টুকরো, আমার হয়ে গেছে। চুল নাড়িয়ে সুর করে সে বলল। বলতে বলতে দু-জনেই খোলা দরজা দিয়ে ছুট। তিনজনেই ভেবেছে ওরা বাগানে যাচ্ছে। সিজার যে সোজা গ্যারাজে গিয়ে স্কুটার বার করে ফেলবে, ভাবেনি কেউ।
জুলি বলল, এমনিতে কোনো ভাবনা নেই। কিন্তু ট্যাঁকে খুঁজে মেয়েটাকেও নিয়ে গেল যে, দলমা পাহাড় কি এখানে?
শমীর চোখে-মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠেছে, আর থাকতে না পেরে বলল, কী হবে বরুণদা! পাহাড়ের পথে স্কুটারের পেছনে। লুপের তো স্কুটারে চড়ার কোনো অভ্যেসই নেই।
বরুণদার মুখে চোখে ছেলের প্রতি গভীর বিরক্তি ফুটে উঠেছে। কিন্তু উদ্বেগ খুব বেশি নেই। বললেন, ভাবনার কিছু নেই। বিপদের ভয় নেই। ও ছেলেকে এখানে সবাই চেনে। আমার আপত্তি হচ্ছে এই ডোন্ট কেয়ার ভাবটাতে। নিজে প্ল্যান করেছে, বলবার জানাবার দরকার মনে করে না। মায়ের আদরের ফল। ফল ভোগ তো করতে হবেই। চোদ্দ পনেরো বছরের ধেড়ে ছেলেকে সব সময়ে আমার জোনি, আমার যিশু করে ন্যাকামি করার ফল পেতেই হবে।
জুলি বলল, আর তুমি যে একেকটা দুরন্তপনামি করে আর বাহবা-বাহ-বাহা করে ওঠো? শুধু জোনি যিশু করলেই আদর হয় না। সবেতে ও-রকম আমার ছেলে কী দারুণকীর্তি করেছে ভাব দেখালে প্রশ্রয় হয় যেটা আদরের চেয়েও খারাপ। জানিস শমী, সেদিন ভুলে চাবি না নিয়ে সদর দরজা টেনে দিয়ে বেরিয়েছে। তিনজনেই বেরিয়েছি। চাবি না নেওয়ার দোষটা ওর। তারপরে ফিরে রাত নটায় আর বাড়ি ঢুকতে পারি না। ওদিকে উনি, মানে সিজারচন্দ্র কোত্থেকে লাঠি জোগাড় করে পেছন দিকের দরজা দমাদ্দম পিটিয়ে তার ছিটকিনি খুলে ফেলেছে। সে এক কাণ্ড! আর তোর বরুণদার সে কি স্মিতমুখ, ভাবটা ছেলের মতো ছেলে তৈরি করেছি একখানা। গণ্ডগোলটা নিজে পাকিয়েছিল কিনা! এখন তুইই বল রাত নটায় ওভাবে খিড়কির দরজার ছিটকিনি খোলার কৌশলটা যদি চোর-ডাকাতের চোখে পড়ে যায়?
বরুণদা বলল, লুপের জন্য তুমি ভেবো না শমী। সিজার কিন্তু সত্যিই খুব ডিপেন্ডেবল।
দুপুর একটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে জুলি বলল, খেয়ে নিই আমরা। ভীষণ খিদে পেয়েছে।
শমীর ইচ্ছে নেই—বলল, আরেকটু দেখি, ওরা খেল না।
বরুণদা আর জুলি হাসি হাসি মুখে চোখাচোখি করল, বরুণদা বললেন, একটা বেজে গেছে অথচ সিজার খায়নি এ হতে পারে না। আর সিজার খেলে লুপুও খাবে। শমী তুমি বিনা দুশ্চিন্তায় খেয়ে নাও।
খেয়ে-টেয়ে মশলা মুখে দিয়ে দু বোনে সব তোলাতুলি করছে, দুই মূর্তি ঢুকল। আওয়াজে আগেই জানান দিয়েছিল।
জুলি মারমুখী হয়ে বলল, কী ব্যাপার? পিঠে বেত ভাঙব নাকি? নিজে তো যা খুশি করছ, বোনটার যে মুখ শুকিয়ে গেছে না খেয়ে না দেয়ে। সে খেয়াল নেই?
সিজার উবাচ, না খেয়ে না দেয়ে? লুপ! বলে লুপের দিকে তাকিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল।
লুপ বলল, না মাসি আমরা নটরাজ থেকে খেয়ে এলুম। সিজারদা অনেক খাইয়েছে।
রেস্ত কোথায় পেলি? জুলি সিজারের দিকে তাকিয়েছে।
তোমার ব্যাগ। অম্লানবদনে উত্তর দিলেন সিজারবাবু।
বরুণদা বললেন, ওকে চুরি বলে, তুই চোর তা হলে?
সিজার বলল, পকেট মানি দিচ্ছ না যে! গার্লফ্রেন্ডদের কাছে আমার প্রেসটিজ থাকে না।
সিজার আঙুলে চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।
শমী-জুলি চুপ। বরুণদাও। লুপ চুপিচুপি মার কানে কানে বলল, মা খুব রাগ করেছ? সীজারদা ব্রেকফাস্টের সময়েই ঠিক করল পাহাড়ে যাবে, বলবার দরকার নেই বলল। দারুণ অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে মা। দারুণ।
শমী যেন অনেক দূরে চলে গেছে, জবাব দিচ্ছে না, কিন্তু তার মুখে রাগের চিহ্নমাত্র নেই। সেও কি যাচ্ছে? স্কুটারে না, সে সময়ে স্কুটারের এত চল তো ছিল না। সাধারণ বাইসাইকেলে ডবল ক্যারি করছে তাকে একটি ছিপছিপে চেহারার লম্বা ছেলে। খুব কোমল মুখ। সবে গোঁফ দাড়ি গজিয়ে মুখটা জঙ্গল হয়েছে। ত্বকের লালিত্য যায়নি এখনও। চোখ দুটো স্বপ্নে ভরা। শালজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কখনও সাইকেলে, কখনও সাইকেলকে হাঁটিয়ে নিজেরা পায়ে হেঁটে, শুকনো শালপাতা দু পায়ে মাড়িয়ে মড়মড় শব্দ করতে করতে।
এই জঙ্গলটা পার হলেই একটা ছোট্ট টাকলামাকান মরুভূমি বুঝলে শমী। বালিতে পা ডুবে যাবে। মরুভূমি পার হলে তবে অজয়। অজয়ে হাঁটুজল। পার হলে কেন্দুবিল্ব। যদি কপালে থাকে, আর রাত জাগতে পারো তো আসল বাউলের গান শুনতে পাবে—ভালো করে পড়গা ইস্কুলে—এ-এ, নইলে কষ্ট পাবি শেষকালে।
জুলি বলল, গেছিস, গেছিস। মাকে না বলে গেছিস কেন রে?
দ্যাখ, মা কী ভীষণ অভিমান করেছে, লুপু আর এ রকম করিস না। জুলি দাঁড়াল না, তার অনেক কাজ। বরুণদা ঘরে চলে গেছে। এই একটা দিনই তো বিশ্রাম। নুপু মায়ের ঊরু জড়িয়ে মাটিতে বসে পড়ে বলল, মা তুমি সত্যি রাগ করেছ? সিজারদাটা যে কি? এমন করে বলে আমি না বলতে পারি না। ওর যা এনথু না! মা, সিজারদাটার মাথায় কয়েকটা স্কু ঢিলে আছে, কিন্তু একেবারে ফ্যানটা!
শমী মৃদু হেসে বলল, এখনও কিছু প্রোগ্রাম আছে না কি তোদের?
তেমন কিছু না। ওয়ার্ড-মেকিং খেলি একটু! খেলি?
এতদূর থেকে রোদে রোদে টহল দিয়ে এলি একটা বইটই নিয়ে বসলে তো হত।
দূর, টহল আবার কি। লুপ ফিক করে হেসে ফেলল।
সত্যিই ওদের বয়সে শুয়ে বসে থাকা কারোই রুটিনে লেখে না। জুলি বেড়াত সারাক্ষণ টঙস টঙস করে। শমী একটু শান্ত প্রকৃতির। কিন্তু সেও পড়াশোনার সময়টুকু ছাড়া দেখো জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নতুন গড়ে উঠেছে এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কলোনি। দেখতে দেখতে উঠে যাচ্ছে সামনে পেছনে জমিশুদ্ধ সুন্দর সুন্দর কোয়ার্টার্স। লরিতে করে কাটা গাছের গুড়ি যখন তখন হু হু করে চলে যাচ্ছে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে। শমীদের বাড়িটা তখনও শেষ বাড়ি। তারপর থেকেই জঙ্গলের সীমানা আরম্ভ হয়েছে। শালের ঘন জঙ্গল। তার সঙ্গে প্রচুর সেগুন, মহুয়া, ছাতিম, শিরীষ গাছ। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘোরাটাই ওর প্রধান করণীয়। তার ফাঁকে ফাঁকে খাওয়া পড়াশোনা ছোটখাটো ঘরের কাজকর্ম। বাবা সকালবেলা ইনস্টিটুটে চলে যাবেন। দুপুরবেলা কোনোদিন খেতে আসবেন। কোনোদিন টিফিন ক্যারিয়ার পৌছে দিতে হবে। বেশিরভাগ দিনই বাড়ির কম্বাইন্ড-হ্যান্ড দীনবন্ধু যায়, সে না পারলে জুলি চলে যায় সাইকেলে চড়ে। কেউ নেই আর, কেউ কোথাও নেই, একমাত্র মেজপিসিমার ছেলে রিনটিনদা ছাড়া। সে ইলেকট্রিক্যাল পড়ছে। হোস্টেলে থাকে। যখনই সময় পায় হঠাৎ হঠাৎ করে দুই বোনের কাছে চলে আসে। জঙ্গল চষা হয় আরও ভালো করে। অনেক দূর চলে গেছে ছুটির দিন সন্ধেবেলায়। সপ্তপর্ণী বৃক্ষের পেছন থেকে চাঁদ ওঠা দেখা হয়েছে। জুলি বলছে, রিনটিনদা তোর খিদে পায়নি, আমরা বেরিয়েছি তখন আড়াইটে, তিনটে হবে। দেখ তো কটা বাজে! জঙ্গলে শেয়াল ডাকছে।
ঘড়িটা রিনটিন রুমাল দিয়ে চট করে বেঁধে ফেলল। বলল, সময়কে একটু ভোলো, ভুলতে শেখো, খিদে তো আমারও পেয়েছে। খিদে পাওয়ার ফিলিংটা অদ্ভুত সুন্দর নয়? লেট ইট লাস্ট এ লিটল মোর। সুগন্ধ রাতটাকে সিল্কের চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে হিম আর জ্যোৎস্না মেখে বাড়ি ফেরা। বাবা টেবল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়ছেন, কিছুই খেয়াল নেই। দীনবন্ধু বাইরে দাঁড়িয়ে। মুখ গম্ভীর। তার সব খেয়াল আছে। হিম লেগে পরদিন শমীর ঠেসে জুর! গনগনে মুখের ওপর জুলি ঝুঁকে পড়েছে ওষুধটা খা। শমী। শমী মুখ টিপে আছে। জানলার কাছে দাঁড়িয়ে রিনটিনদা বলছে, জ্বর হলে আমিও চট করে ওষুধ খাই না। জ্বরের ফিলিংটা আমার অসাধারণ লাগে। কী রকম দাঁত কষতে ইচ্ছে করে। কী রকম একটা ঝিমুনি ধরে। লালচে ঝিমুনি! শমী, দেখো, চোখ চেয়ে দেখলে ঘরবাড়ি জীবন সব এখন স্বপ্ন মনে হবে। আসলে জ্বরটর হলেই সত্যি বোঝা যায় জীবনটা স্বপ্ন।
জীবনটা স্বপ্ন? জুলি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করছে।
জ্বরোজ্বরো গায়ে শমী মুগ্ধ হয়ে ভাবছে জীবনটা স্বপ্ন!
রিনটিন জানলার কাছে থেকে সরে এসে দাঁড়িয়েছে, শমীর বিছানার খুব কাছে–হ্যাঁ! ঘুমিয়ে পড়েছি, সামহোয়ার এলস দেখছি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে–আমি শমী, আমি জুলি, আমি রিনটিন, আমার কত কাজ, কত ইচ্ছা, সাধ! হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাবে, বুঝতে পারব…।
কী বুঝতে পারব? আমি জুলি নই! জুলি অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করছে।
শমী উদগ্র আগ্রহে উত্তরটার জন্যে অপেক্ষা করছে। রিনটিন হেসে বলছে, জানি না, জানি না তো কী বুঝতে পারব। এখনও তো ঘুম ভাঙেনি!
যত্ত বাজে কথা। রোজ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যেগুলো দেখি সেগুলো তবে কী?
স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন। তার ভেতর আরও স্বপ্ন। ভেতর থেকে ভাঙতে ভাঙতে আসবে স্বপ্নগুলো।
জ্বরের ঘোরে শমী শুনছে আর তলিয়ে যাচ্ছে, কোনো গভীর গহন, অন্যরকম অন্যলোকে। সমস্ত অন্তরঙ্গতা, বন্ধুতা, ভালোবাসাগুলো তো স্বপ্নই। ভেতর থেকে ভাঙতে ভাঙতে আসে। ঠিক যেমন শুনেছিল। অবিকল। নিশ্বাস ফেলে শমী পাশ ফেরে। ম্যাগাজিন হাতে করে, ছবি আর লেখার ওপর চোখ, মনের মধ্যে অন্য ছবি অন্য শব্দ। দিনের জাগরণবেলা নিমেষেই ফুরিয়ে যায়। বিকেলের ঘুম ভাঙে।
লুপের বাবা এসে গেছে। জুলি বলল, এসেছ খুব ভালো কথা, আমরা হাতে চাঁদ পেয়েছি, কিন্তু ঘোড়ায় জিন দিয়ে এলে কেন? দুদিন থাকো!
বিনায়ক বলল, উপায় নেই। সময় নেই। নাই নাই নাই যে সময়। দিদি কত। কষ্ট করে একটা উইকএন্ড বার করেছি যদি জানতেন।
উইকএন্ড আবার বার করতে হয় না কি? ও তো প্রত্যেক সপ্তাহের শেষে থাকেই!
আরে? শমীকে জিজ্ঞেস করুন! কত শনিবার আমাকে হুটহাট করে টুরে চলে যেতে হয়!
শমী হাসছে। গুছিয়ে নিচ্ছে আস্তে আস্তে সব। পেছনের বাগানে শুকোচ্ছে তোয়ালে, পেটিকোট, পটির কাছটায় একটু ভিজে। শাড়িটা পাট করে নিচ্ছে। ঘরে এল। লুপ পেছন পেছন বাগানে গিয়েছিল। এখন আবার পেছন পেছন ঘরে ফিরে এসেছে। বায়না ধরেছে, ও মা, আর দুদিন পর তো এমনিই ছুটি ফুরিয়ে যেত। আর একটা দিন, জাস্ট একটা দিন থেকে গেলে কী হয়!
বাবা বলল, তোর তো দিনপঞ্জি মাসির আদরে এখন সবই ওলটপালট হয়ে গেছে রে লুপু। অভ্যেসে ফিরতেই তো ও দুটো দিন লেগে যাবে।
পকেটে হাত, ঠোঁটে সিগারেট বাবা চলে যাচ্ছে। এখন কেউ নেই। বাবা, মাসি, মেসো সব লনে নেমে গেছেন, গল্প করছেন। মাসি লুপের জন্য রং-বেরঙের একটা জাম্পার বুনেছেন, তাড়াতাড়ি করে ঘর বন্ধ করছেন এখন। একটু পরেই বেরোতে হবে। এখানে শুধু মা, মায়ের হাঁটু জড়িয়ে ধরে লুপু কাঁদছে। বুকভাঙা কান্না। যেন লুপু নয়, তার বুকের ভেতর বসে অন্য কেউ এ কান্না কাঁদছে। শমী আশ্চর্য হয়ে গেছে, আবার তো ছুটি পড়বে লুপু তখন আসব, গ্রীষ্মের ছুটিতে এসে বেশি করে থাকিস। তখন আম পাকবে, কাঁঠাল পাকবে, মাসি বলছিল শুনিসনি?
গুমরে গুমরে কাঁদছে লুপ। আম-কাঁঠালের জগৎ থেকে অনেক দূরে।
লুপু শোন, এ রকম বোকার মতো কাঁদে না।
সিজারদা যে জানে না। ও যে নেই! টুর্নামেন্ট খেলতে গেল টেলকোয়। কাল আসবে, দেখা হবে না। লুপু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল।
তাতে কী হয়েছে! টুর্নামেন্ট খেলতে গেছে জানি তো। আবার পরে যখন আসবি, দেখা হবে!
আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ভাঙা ভাঙা বোজা গলায় লুপ বলল।
শমী হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেছে। স্তম্ভের মত অনড়। নির্বাক। থোকা থোকা চুল লুপুর মাথায়। তার কোলের ওপর। চারদিকে ছড়িয়ে আছে লুপুর সাদা নাচ-ফ্রক লাল-কালো স্কার্ট, ব্লু জিনস, লুপুর ছোটোবেলা। টুকরো টুকরো এইসব যাত্রার আয়োজন এবং মেয়ের ছোটোবেলা সামনে রেখে শমী ফিরে যাচ্ছে তার নিজস্ব সেই অন্ধকার বারান্দায়। ওই তো জুলি কিছুদুরে ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আঙুলে শাড়ির আঁচল পাকাচ্ছে। রিনটিন বলছে, ট্রেনের সময় হয়ে এল, এবার তো আমায় যেতেই হবে। জুলি, শমীকে বলো একবার আমার দিকে ফিরতে, একটিবার আমার সঙ্গে কথা বলতে, ওকে বুঝিয়ে বলো জুলি। আমি…আমি যে আর আসব না।
শমী যে বেশি কথা বলতে পারে না। নিজের ভেতরের অনুভব বাইরে প্রকাশ করতে অসীম সংকোচ। ধূসর অন্ধকারের মধ্যে সে শুধু ধূসরতর ছায়া। বিবর্ণ। প্রাণশূন্য। জুলি ফিসফিস করে বলল, তুই কেন এলি? আমরা তো বেশ ছিলাম। রিনটিনদা তুই কেন এলি? তার গলায় অভিমান, তিরস্কার।
বোধহয় সত্যি আসিনি জুলি, স্বপ্নে এসেছিলাম … তোরা একবার বল আমি শমীকে নিয়ে যেতে আবার আসব…
না। জুলি চাপা ক্রুব্ধ গলায় বলল, যা, তুই যা প্লিজ।
রিনটিনের পায়ের শব্দ কোনদিনই হয় না। নিঃশব্দে সে কখন চলে গেছে।
এখন মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শমীর গলা দিয়ে মস্ত বড়ো একটা পিণ্ড নামছে। গলার পেশি, ত্বক সব কিছুকে প্রচণ্ড চাপ দিয়ে। মা বলল, লুপ এখনই এত অধীর হলে চলবে কী করে? এইটুকুতেই যদি ভেঙে পড়ো। তা হলে এর পর?
কান্নাভেজা মুখ তুলল লুপ। মায়ের গলা নির্লিপ্ত, উদাসীন, যেন অনেক দূর থেকে বলছে। মা কখনও লুপকে তুমি বলে না! দুঃখ? অধীর? এর পর? আরও আছে? এর পর আরও আছে?
যাও, মুখ ধুয়ে এসো।
অন্য গাড়ির হেডলাইটের আলো পড়েছে লুপুর মুখে। জুলি মাথায় হাত বুলিয়ে ভিজে গালে চুমু খেয়ে বলল, মন খারাপ করছিস কেন? আবার আসবি মাসির কাছে। অনেক দিন থাকবি।
শমী মনে মনে বলল, না জুলি না, আর আসব না, আর ও থাকবে না। আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। ওই সিঁদুরে আগুন আমাকে পার হতেই হবে।
ট্রেনে উঠে বিনায়ক ডবল সিটে গুছিয়ে বসল মেয়েকে নিয়ে। মৃদু আলো জ্বলছে—ও কী রে লুপু! তোর মুখখানা যে কেঁদে কেঁদে ফুলে গেছে মা। এত কেঁদেছিস কেন?
লুপ কিছু বলছে না। বিনায়ক বলল, কী ব্যাপার শমী? কীসের কষ্ট ওর? অত কেঁদেছে। জাস্ট মাসিদের জন্য মন কেমন! কিছু বলছে না যে! বাবার মুখে উদ্বেগ। ট্রেনের শব্দ। গতিবেগ বাড়ছে। বাইরে অন্ধকার লম্বা দৌড়ে নেমেছে। শমী তার ঈষৎ ভাঙা অথচ কেমন এক রকম মিষ্টি গলায় যেন আপন মনে বলল, জানলে তো বলবে! ও যে জানেই না।
অপত্য
ব্যায়াম সমিতি থেকে ফেরবার পথটা অর্থাৎ শর্ট-কার্টটা একেবারে কাদা-জলা হয়ে আছে। অনুষ্টুপদা বলে রাবড়ি-কাদা। এই কাদার সঙ্গে রাবড়ির নাম জড়িয়ে থাকলে রাবড়িতে ঘেন্না ধরা বিচিত্র না। অবশ্য, রাবড়ি যেন কতই জুটছে! চটিজোড়া খুলে নিয়ে প্যান্ট গুটিয়ে নিতে থাকল অঞ্জু। সে জানে কাদায় বা জলে এভাবে খালি পায়ে নামা আর প্রাণটাকে নামিয়ে দেওয়া মোটের ওপর একই কথা। ওই কাদায় মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকতে পারে কাচের ফালি, পেরেক, ধারালো যে কোনো জিনিসের টুকরো। পায়ে ফুটলেই আই.ডি.হসপিট্যাল, বেলিয়াঘাটা। সেখান থেকে ফেরার কোনো গ্যারান্টি নেই। তবে, পঁচিশ বছর বয়সের একটা বি.কম বেকার ছেলের ফেরাও যা, না ফেরাও তা। দাদা আছে গড়িয়াহাটার মোড়ে একটা দোকানের সেলসম্যান। ছোটো বোনটাও এক ডাক্তারের চেম্বারে অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ জুটিয়ে নিয়েছে। একমাত্র অঞ্জুরই দু-পাঁচটা টিউশনি ছাড়া কিছু হল না। এদিকে ব্যায়াম সমিতিতে মুগুর ভেঁজে, প্যারালাল বারে উলটে পালটে খিদেটি আছে সাধা। মুগকলাই, ছোলা, সয়াবিন, রাজমা সবই পেটের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে। যখন রান্নাঘরের একপাশে বাবা চেয়ারে আর তিন ভাই-বোন মেঝেতে খেতে বসে, দেয়ালগুলো যেন মুখ বাঁকিয়ে বলতে থাকে, কম্মের হোত টিপি! খালি থালা থালা ভাত মারতে আছিস!
কে বলে দেয়াল থেকে? অঞ্জুর সতেরো বছর বয়সে মৃত মা না কি! দরিদ্র সংসারে দিবারাত্র খেটে খেটে মায়ের মেজাজ খুবই তিরিক্ষি ছিল। তার ওপর ছিল মাথার যন্ত্রণার রোগ। হলে, মাথায় কষে ছেঁড়া শাড়ির পাড় বেঁধে শুয়ে থাকত। কিন্তু মা অঞ্জুকে বড্ড ভালোবাসত। বোন যদি এ নিয়ে নালিশ করত, মা বলত, দ্যাখ মঞ্জু, পেটের সব সন্তানকেও সমানভাবে ভালোবাসা চাট্টিখানি কথা নয়, নিজে মা হলে বুঝবি। যে সন্তান সবচেয়ে হাসিমুখ, মায়ের দুঃখ বোঝে, যার ওপর ভরসা করা যায়, সে একটু বেশি পাবেই। তবে সেটুকু উথলোনো দুধ। আর কারও ভাগ থেকে কেড়ে কুড়ে নেওয়া নয়। অঞ্জু চিরদিনই হাসিখুশি, আড্ডাবাজ, গুমোট কাটিয়ে দিতে ওস্তাদ, মায়ের ফরমাশ সামান্যই সব, তবু সেই সামান্যটুকু মেটাবার কথা কখখনও ভুলত না অঞ্জ। সরু করে কুচোনো একটু কাঁচা সুপুরি চিবিয়ে বোধহয় মায়ের একটু নেশামতে হত। সুপুরির জোগান আসত অঞ্জুর হাত দিয়ে। কাছাকাছি ঠাকুরের আশ্রমে যেতে ভালোবাসতো মা। অঞ্জু ওসব ঠাকুর-টাকুর কস্মিনকালেও পছন্দ করে না। তবু যেত মাকে নিয়ে। সেই মাকে জীবনে যেই একবার মাত্র সে এন.সি.সি.-র সঙ্গে ট্রেনিং-এ গেল ঠিক সেবারই মারা যেতে হল? স্ট্রোক! তাকে খবর দেওয়া গেল না। সে যখন ফিরল শ্রাদ্ধ-শান্তি সুষ্ঠু মিটে গেছে, মায়ের ছবিতে রজনিগন্ধার মালা শুকনো! ছোটো ছেলে, প্রিয় ছেলের কাছ থেকে, মার কি শেষ সময়ে একটু জলও যাচা ছিল না? মানুষটা যে ছিল এবং এক সময়ে তার না থাকা নিয়ে এই বাড়িতে মানুষগুলির আচার-আচরণ পোশাক আশাকে কিছু সাময়িক পরিবর্তন হয়েছিল সেসব কিছু তখন বোঝবার উপায় পর্যন্ত নেই। শুধু দাদা আরও গম্ভীর, বোন আরও ক্লান্ত, বাবার আরও বিছানার সঙ্গে মিশিয়ে যাওয়া। হতভম্ব অঞ্জু বাড়ি ঢুকতে বাবা শুকনো মৃত চোখে চেয়ে বলল, যাক, তোমাদের সংসারে, একটা মুখ কমল। সংসারটা যে কী করে তাঁর হয়ে তাঁর ছেলেদের হয়ে গেল তা অঞ্জু বোঝে না। সে তো তখন বাচ্চা, দাদা সুন্ধু চব্বিশ পেরোয় নি। কিন্তু যবে থেকে চোখ খারাপের অজুহাতে বাবার কাজটা গেছে তবে থেকেই বাবা সুযোগ পেলেই তোমাদের সংসার কথাটা বলতেন। এখন বাবার চোখে গ্লকোমা, পায়ের নার্ভ শুকিয়ে আসছে। শিরদাঁড়ায় লাম্বার স্পন্ডিলাইটিস! যথাসাধ্য চিকিৎসা করানো হয়! কিন্তু সেই একটা কথা আছে না, তোমার যথাসাধ্যটাও যথেষ্ট নয়! এ হল সেই।
দাদা ভালো করে কথা কয় না। মঞ্জুও ভুরু কুঁচকে থাকে। বাবার সদাই দীর্ঘশ্বাস। তবু অঞ্জু যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটে, শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হেঁটেই যাতাযাত করে সে, তখন তার মনে হয় সে রাজা। এই পৃথিবী, এই আকাশ, বাতাস, সূর্যের কিরণ, চাঁদের আলো সব তার। কোনো ভিক্ষুক, বিকলাঙ্গ বা বৃদ্ধ দেখলে মনে হয় কাছে গিয়ে বলে, ভয় কী? আমি তো আছি! যেন সে রোদ থেকে তার নবীন ত্বক ব্যবহার করে অনায়াসে সালোকসংশ্লেষ করে যাচ্ছে। যেটুকু পুষ্টি ভোলা, মুগকলাই, রাজমা ইত্যাদি দিতে পারছে না, সেটুকু সে নিজেই বানিয়ে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত তার কোষকলায়। ভোলা গলায় সে হাসতে পারে যেন পৃথিবীর সর্বসুখ তার আয়ত্তে। বাড়ির মধ্যে তার এমন হাসি শুনলে মঞ্জু ভুরু কুঁচকে ওঠে, কী রে, কী খেয়েছিস?
কী আবার খাব?
এত হাসছিস যে?
হাসির সঙ্গে খাওয়ার সম্পর্ক কী?
মঞ্জু মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বলে, আজ এক এক বেলায় ক-টা স্লিপ কেটেছি জানিস? দুশো পঞ্চান্নটা করে। একবার ওপর আবার নীচ আবার ওপর। ভাতের ফ্যান গালতে গিয়ে আবার হাত ফসকে একটু গরম ফ্যান পড়ে গেছে হাতে। যদি বাংলা-ফাংলা পাস তো আমাকেও দিস দু-এক ঢোঁক। নইলে এত খাটুনি সয় না।
হাতে ফ্যান পড়েছে তো কী দিয়েছিস?
কী আবার দেব? হাতের কাছে নুনের বাটি ছিল এক খাবলা চেপে ধরেছি।
খুব ভালো করেছিস। কিন্তু এবার ওষুধ লাগাতে হবে।
থাক থাক তোকে আর ওস্তাদি করতে হবে না। তুই নিজের নিয়ে থাকগে যা।…
তার এই এগিয়ে আসা, এই সদিচ্ছাটাকেও যেন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় মঞ্জু। অথচ অঞ্জু আদৌ নিজের নিয়ে থাকে না। বাবাই বরং তাকে কিছু ছাড়তে চায়। সে না কি অল্প পয়সায় গুছিয়ে বাজার করতে পারবে না। সে না কি একদিনেই গেরস্তকে ডকে উঠিয়ে দেবে। বাবার সেবার খুঁটিনাটিও বাবা মঞ্জু ছাড়া কারও কাছে করতে চায় না। কলঘরে, খাবার জায়গায় নিয়ে যাবার সময়ে খালি অঞ্জ। কিন্তু অঞ্জ যথাসম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে বাবার ব্যবহারের জিনিস। জামাকাপড় কেচে দেয়। শুধু নিজেরটা নয়, সবারই। তবু তাকেই সবচেয়ে ফিটফাট দেখায়। সবচেয়ে ঝকঝকে। উজ্জ্বল। আর সবসময়ে মনের ভেতর দিয়ে একটা আনন্দের বাতাস হিল্লোল তুলে বয়ে যায়।
অনুষ্টুপদা বলেন, আরে ছোকা, শরীরমাদ্যং শাস্ত্রে যে বলেছে সে কি আর এমনি বলেছে? গভীর উইজডমের কথা বলেছে। এই যে ব্যায়াম করছিস, শরীরের যন্ত্রপাতিগুলো ঠিকঠাক কাজ করছে। গ্ল্যান্ড-ফ্ল্যান্ড সব পার্ফেক্ট। যেখান থেকে যতটা স্টিমুলেশন দরকার আসছে। আর তার ফলেই একটা চমৎকার মানসিক ভারসাম্য, একটা স্থিতিস্থাপকতা। এটাই মানুষের আসল অবস্থা। সচ্চিদানন্দ স্টেট। বুঝলি ছোকা? —ছোকরা না বলে ডোকা বলেন অনুষ্টুপদা।
বোঝে অঞ্জু। খুব বোঝে। এই শারীরিক আনন্দ বা সুস্বাস্থ্য থেকে ক্ষরিত আনন্দ থাকলে যে কী হত, বাবাকে দেখে খানিকটা বোঝা যায়। দাদা, মঞ্জ, শুধ তার পরিবার কেন আরও কত ছেলে-মেয়ে-নারী-পুরুষ এই শারীরিক আনন্দের খোঁজই রাখে না। তবে আরও একটা জিনিস আছে। ব্যায়াম সমিতির সবাই কি অঞ্জুর মতো? বোধহয় না। অনুষ্টুপদা হয়তো বলবেন, যে কোনো কারণেই হোক সবাইকার শরীরের ভেতরটা সমান ভালোভাবে চলে না। তাই তারতম্য হয়ে যায়। কিন্তু কথাটা বোধহয় ঠিক নয়। মানুষে মানুষে একটু তফাত আছেই। এই যে নেপাল, ওই ব্যায়াম সমিতিরই ছেলে তো! নিজের এলাকাটাকে ভয়ে জুজু করে রেখে দিয়েছে একেবারে। কাউকে তোয়াক্কা করে না। যখন তখন ভয় দেখায়, চোখ গরম করে। নেপাল এখন নেউল হয়ে গেছে। অঞ্জুকে দলে ভেড়াতে চেয়েছিল। এলাকার পলিটিক্যাল দাদার কাছে নিয়ে যাবার কথা বলেছিল। সোজাসুজি কি আর?—কী রে অঞ্জু, কমার্স গ্র্যাজুয়েট তো হলি। আর কদ্দিন ভ্যারেন্ডা ভাজবি? চল একদিন রবীনদার কাছে নিয়ে গিয়ে তোর একটা হিল্লে লাগিয়ে দিই।
অঞ্জু বলেছিল, তুই অ্যাদ্দিন লেগে আছিস তোরই কিছু হল না! আমার? কিছু হয়নি? বলছিস কি রে? তুই একটা গ্রাজুয়েট আর আমি ইস্কুলের চৌকাঠ ডিঙোইনি। দুজনের হিল্লে কি একরকম হবে? তা ছাড়া এখন আমি পার্টির হোল টাইমার। কিছুদিন পরেই দেখবি একটা লরি কি বাস বার করে নিয়েছি। মনমোহন সিংটা আবার সময় বুঝে লোন-ফোনে গুচ্ছের গ্যাঁড়াকল ঢুকিয়ে দিল কি না।
চলি রে দেরি হয়ে যাচ্ছে। টুউশনি আছে।—অঞ্জু পা চালায়।
কোন কেলাস? ছাত্র না ছাত্রী?
ছাত্র। তিনটে একসঙ্গে। হায়ার সেকেন্ডারি।—অঞ্জু কেটে পড়ে। এইভাবেই সে নেপাল-নেউলকে কাটাতে কাটাতে আসছে। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যেও করে না, আবার মাথায় তুলে নাচেও না। খুব সাবধানে চলতে হয়। যেন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে না পারে। ওদের অহং প্রচণ্ড। ভুলেও সেখানে লেগে গেলে সর্বনাশ করে ছাড়বে।
ইদানীং নেপাল ঘন ঘন ধরছে তাকে। বিকেল তিনটে। অঞ্জু বেরিয়েছে। ছাত্রীর বাড়ি রিচি রোড। স্বভাবতই সে হেঁটে যাবে। মোড়ে নেপাল।
কী রে অঞ্জু ছাত্তর ঠ্যাঙাতে চললি?
আর বলিস কেন? পরীক্ষা এসে গেছে, এক্সট্রা দিন যেতে হচ্ছে।
ছাত্রী নিশ্চয়ই।
একটা নয় আবার, দুটো।
তাই এত গরজ। হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছিস একেবারে।
কী যে বলিস নেপাল, ক্লাস ফাইভের দুটো পুঁচকে।
রবীনদার কাছে কবে যাচ্ছিস?
সময় করতে পারছি না রে। বাবার জন্যে ডাক্তারের কাছে যেতে হয় ফি-মাসে। তিন ঘন্টা লাইন। তা ছাড়াও কত কাজ।
বেশি দেরি হয়ে গেলে তুই-ই পস্তাবি, আমার কী!
চলি রে! … তার শক্ত হাতের মুঠোয় নেপালের হাতের পাঞ্জা ধরে কষে ঝাঁকুনি দেয় অঞ্জু।
ছাত্রীদের দেড়তলার ঘরে যখন ঢোকে তখন তার মুখ দেখে তারা বলে ওঠে, কী অঞ্জুদা, রাজ্যজয় করে এলেন মনে হচ্ছে?
রাজ্যজয়ই বটে! মনে মনে ভাবে অঞ্জু। জানো না তো আর তোমাদের দুটো হায়ার সেকেন্ডারির মেয়ের এক ঝটকায় ক্লাস ফাইভে ডিমোশন হয়ে গেছে।
এভাবেই চলে অঞ্জুর, চলে যায়। তার বয়সের অন্যান্য ছেলেরা যখন হতাশায় ভুগছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তখন অঞ্জু নীরবে চেষ্টা করে যাচ্ছে চাকরির, আর প্রাণপণ টিউশনি। সেই সঙ্গে ব্যায়াম। ব্যায়াম-ট্যায়ামের সুবাদেও তো অনেকের চাকরি-বাকরি হয়ে যায়। অঞ্জুর তাও হল না। কোনও ব্যাপারেই সে বোধহয় প্রথম সারিতে আসতে পারেনি। প্রথম সারিতে আসতে না পারলে বিধিসম্মত, সম্মানজনক আয়ের দরজাগুলো বন্ধ থাকে। তখন কি না খেয়ে মরে যেতে হয়? তা নয়। তখন থাকে উঞ্ছবৃত্তি। যেমন এটা-ওটার দালালি, যেমন নেপালের রবীনদার চামচাগিরি, যেমন অঞ্জুর টিউশনি। টিউশনিতে সে মন্দ রোজগার করে না। নিজের খরচ তো চলে যায়ই। বাড়িতেও কিছু দিতে পারে। তবু…লোকে যখন জিজ্ঞেস করে, বলা যায় না কিছু করি। বেকার! এত বড়ো ছেলে বেকার! বাবা মাথা নুইয়ে, দাদার মুখে নির্বেদ, মঞ্জু ভুরু কুঁচকে আছে। সবাইকার হীনম্মন্যতা।
ল্যান্সডাউন দিয়ে হাঁটছে অঞ্জু। হাঁটতে হাঁটতে মনের কোণে ড্যালা পাকিয়ে আছে তার ব্যর্থতার চিন্তা। কিন্তু তার ওপর দিয়ে একটা আনন্দের ভালোলাগার হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। আষাঢ় মাস। দুপুর বেলা প্রচণ্ড একটা ঝড়বৃষ্টি হয়ে গেছে। বেশ কিছুদিন গুমোটের পর। রাস্তা ভিজে, বাতাস ভিজে, ভিজে-ভিজে হাওয়া। আকাশে মেঘগুলো তখন হুড়হুড় করে ভেসে যাচ্ছে। ভীষণ একটা তাড়া পড়ে গেছে যেন। সন্ধেবেলাটা একটু কালি-কালি হয়ে আছে তাই। মেঘের ছায়া পড়েছে। পিচ রাস্তার পাতলা জমা জলের আয়নার মতো গায়ে। রাস্তায় বেশি লোক নেই। গাড়িগুলো খুব জোরে ছুটছে। এটা ঠিক নয় কিন্তু। বৃষ্টিপিছল রাস্তায় গাড়ি স্কিড করতে পারে। মানুষ আজকাল খুব বেপরোয়া হয়ে গেছে। জেনে-শুনেও কেন যে সাধারণ নিয়মগুলো মানে না!
শরৎ ব্যানার্জি রোড থেকে এক ভদ্রমহিলা বেরোলেন। হাতে ব্যাগ, এক হাতে শাড়ির কুঁচি তুলে আস্তে আস্তে হাঁটছেন। ঠিক অঞ্জুর সমকোণে। তাই সে ভালো করে দেখতে পাচ্ছিল। উনি রাস্তা পার হচ্ছেন। ওদিকের দোকানটায় চলে গেলেন। রাস্তায় আলোগুলো মিটমিট করছে। অঞ্জু আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। হঠাৎ একটি তীব্র কি-চ শব্দে তার চোখ চলে গেল রাস্তার মাঝবরাবর। সে কিছুক্ষণ আগেকার দেখা ভদ্রমহিলাকে শূন্যে দেখল। জামাকাপড় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের একটা খাপছাড়া বল শূন্যে, ভীষণ বেগে নেমে আসছে নীচের দিকে। একটা ম্যাটাডর পাশ কাটিয়ে তীব্র বেগে চলে গেল। পেছনে হেলমেট মাথায় একজন মোটরসাইকেল-আরোহী ছুটছে। ধর ধর—আশপাশের দোকান থেকে কিছু লোকও ছুটে যাচ্ছে ভ্যানটার পেছনে। অঞ্জু দৌড়ে গিয়ে ওঁকে রাস্তা থেকে তুলে নিল কোলে। মুখটা ওঁর ভেঙে যাচ্ছে। অঞ্জুর দু-হাত জামাকাপড় রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আর. কে. মিশনে স্ট্রাইক চলছে—সে তাড়াতাড়ি ভেবে নেয়—ট্যাক্সি-ট্যাক্সি… শিগগির শিগগির। খালি ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছে একটা। দু একজন চলুন আমার সঙ্গে চটপট। বাস, ভিড় ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। কে ওঁর ঝুলতে থাকা পা দুটো ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। কে একটা ব্যাগ তুলে দিল গাড়িতে। পুলিসের ঝামেলা…কে হ্যাঁপা পোয়াবে? ওপাশের দরজা খুলে তবু একটি অল্পবয়সি ছেলে উঠে এল।…… যদি কেউ এঁকে চেনেন, বাড়িতে খবর দিয়ে দিন। এস.এস.কে.এম-এ নিয়ে যাচ্ছি…….শরৎ ব্যানার্জি থেকে বেরিয়েছিলেন……।
হু হু করে ছুটছে গাড়ি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মুখ। উনি যেন কী বলছেন! অঞ্জু কান নামাল, কিছু শব্দ, কিছু গোঙানি। মানুষের ভেতরে আরও অনেক কিছুর মতো একটা ধবনি ভাণ্ডারও থাকে। সেই ভাঁড়ারের দরজা ভেঙে পড়েছে। তাই ধবনিরা বেরিয়ে আসছে। অঞ্জুর কাঁধে জলের বোতল। সে একটু জল দিল মুখে। আরও জোরে, আরও জোরে ভাই! হর্ন বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে যান…অঞ্জু প্রাণপণে ঝাঁকানি থেকে তার কোলের মানুষটিকে রক্ষা করতে করতে বলল।
হাসপাতাল দেখা যাচ্ছে অবশেষে। এমার্জেন্সির আলো। কে হন আপনি? কেউ। সে কী? আননোন? এ তো পুলিশ কেস হবেই। আপনি পাবেন না যেন। সিস্টার, ব্যাগটা নিন।
শুনুন ডাক্তার, ব্যাগ-ট্যাগ, পরিচয়-টরিচয় পরে হবে। আগে ওঁকে অক্সিজেন আর কী কী লাগে দিন প্লিজ। টেবিলে তুলুন। ফর গডস সেক।
তরুণ ডাক্তারটি চোখ ফিরিয়ে বলল, জানেন না তো পাবলিক আর পুলিশের হয়রানি! আগে পেপার্স ঠিক করতে হয়।
ওহ ডক্টর, উনি আমার মা, ধরুন আমারই। আপনার, আপনারও। মায়ের মুখ মনে করতে পারছেন না? কুইক, কুইক, প্লিজ, ফর গডস সেক।
স্যালাইনের বোতল। অক্সিজেন। অবাক চোখে চেয়ে তরুণ ডাক্তার, প্রৌঢ় নার্স……শি ইজ গ্যাসপিং। সরি, ইয়াং ম্যান!
কী হল?
শি হ্যাজ এক্সপায়ার্ড।
এক্সপায়ার্ড?–হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছে অঞ্জু। ওহ, পারলুম না, পারলুম, পারিনি, কত চেষ্টা করি পারি না।
শুনুন, কী নাম আপনার?
অঞ্জন পোরেল।
ও. কে। এই ব্যাগে একটা কার্ড রয়েছে। ডক্টর শিশির বিশ্বাস। সাদার্ন অ্যাভিনিউ। ঠিকানাটা নিন। চটপট কনট্যাক্ট করুন।
ট্যাক্সি ড্রাইভার এখনও দাঁড়িয়ে। দিশেহারার মতো অঞ্জুকে এদিক ওদিক চাইতে দেখে ডাকল।
কী হল ভাই? ম্যাডাম কেমন আছেন?
অঞ্জু মাথা নাড়ল ডাইনে-বাঁয়ে। অন্য ছেলেটিও বের হয়ে এসেছে। সে অন্যদিকে যাবে এবার। ড্রাইভার অঞ্জুকে বলল, কোন দিকে যাবেন?
খবর দিতে।
ঠিকানা পেয়েছেন?
হ্যাঁ।
চলুন নিয়ে যাচ্ছি।
বিশাল বহুতল বাড়ি। জানলায় জানলায় পর্দা ভেদ করে আলো এসে পড়ছে। নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটের সামনে এসে অঞ্জু নিজের পোশাকের দিকে তাকাল। কালো প্যান্ট, তার ওপরে মেরুন টিশার্ট। জায়গায় জায়গায় শুকিয়ে খরখরে হয়ে উঠেছে রক্তের দাগ। বোঝা যাচ্ছে একটু লক্ষ করলেই। হাতগুলো? হাতগুলো কি কোনো সময়ে ধুয়েছিল? বেল টেপবার সঙ্গে সঙ্গেই দরজাটা খুলে গেল। একটি যুবক। এক্ষুনি বোধহয় অফিস থেকে ফিরেছে। হাতের ব্যাগটা এখনও রাখেনি। পেছনে একটি প্রৌঢ় মুখ। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা।
তোর মা ফিরল না কি রে রঞ্জন? অনেকক্ষণ গেছে।
কাকে চান?
এই কার্ড কার?
দেখি। ও, আমার বাবার।
শুনুন, এক্ষুনি এস. এস. কে. এম. এ এমাজেন্সিতে চলে আসুন। একটা দুর্ঘটনা হয়েছে। মায়ের। বোধহয় আপনার মায়ের।
কে রে রঞ্জন? কী বলছে?
কী? রঞ্জন নামের ছেলেটির মুখ পালটে যাচ্ছে। সে প্রায় রুদ্ধ গলায় চিৎকার করল, কৃষ্ণা, আমার ব্যাগটা ধরো।
ভেতর থেকে একটি অল্পবয়সি মেয়ে বেরিয়ে এল।
আমি পি. জি-তে যাচ্ছি। মায়ের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।
কী-ই-ই?
—প্রৌঢ়ের গলায়, তরুণীর গলায় আর্ত জিজ্ঞাসা শুনতে পেল অঞ্জু। প্রৌঢ় ভদ্রলোক, ইনি ডক্টর শিশির বিশ্বাস, বেরিয়ে এলেন।
আমি যাব।
বাবা। যেতে দিন। অঞ্জু বলল।
নীচে নেমে সেই ট্যাক্সিই ছুটল। ডক্টর বিশ্বাস বললেন, সিরিয়াস কিছু নয় তো? কত করে বললুম সেলোটেপের এক্ষুনি দরকার নেই। সকালে হলেও হবে। কৃষ্ণা আনতে পারে। পূর্ণিমাকে পাঠালেও হয়। সেই এক গোঁ! কী বাবা! সিরিয়াস কিছু নয় তো?
শিশির বিশ্বাস ওদিকে। মাঝখানে রঞ্জন। এদিকে অঞ্জু। পূর্ণ দৃষ্টিতে রঞ্জন চেয়ে আছে তার দিকে। তার জামাকাপড় ভিজে। রক্তর গন্ধ উঠছে। সে চোখ নামিয়ে নিল।
ওঁর নাম মাধবী। মাধবী বিশ্বাস। ব্যাগে চশমা ছিল এক জোড়া। বাই ফোক্যাল।
কে আইডেনটিফাই করবেন? আপনি কে?
আমি ওঁর হাজব্যান্ড।
আর কেউ নেই?
এই যে আমি, ছেলে।
আসুন, আপনি আসুন।–ঘরটায় ঢুকতে ঢুকতে তরুণ ডাক্তার বললেন, মনকে শক্ত করুন। শি হ্যাজ এক্সপায়ার্ড। ন্যাস্টি উন্ডস। বিশ্রী অ্যাকসিডেন্ট একটা। আমি আমরা কিছু করতে পারিনি। ওই ছেলেটি, অনেক চেষ্টা করেছিল, পারেনি।
হাসপাতাল দুলছে। পৃথিবী দুলছে। ভূমিকম্প হচ্ছে দূরে কোন আগ্নেয় বলয়ে। ডক্টর শিশির বিশ্বাসকে শক্ত দু-হাতে ধরে আছে অঞ্জু। টলতে টলতে রঞ্জন বেরিয়ে আসছে, বাবা, ইটস মাদার অল রাইট। শি ইজ নো মোর। নো মোর, নো মোর, চারদিকে একটা চাপা আর্তনাদ। তারপর স্তব্ধতা। বিনা নোটিশে যখন পৃথিবীর মানুষকে এভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হয় তখন পৃথিবী বিবরে প্রবেশ করে চুপ করে যায়। একদম চুপ।
শুনুন, জায়গাটা এ থানার অন্তর্গত হলেও সব রোড অ্যাকসিডেন্টস লালবাজার ডিল করে। আমি চেষ্টা করছি। কনট্যাক্ট করছি। কিন্তু আপনাদের ওখানেই যেতে হবে। ও. সি. বললেন।
লালবাজার বলল, পোস্টমর্টেম হবেই। আটকাতে পারবেন না। আপনাদের এটাতে গোলমাল নেই। কিন্তু গোলমাল হয়, হরেই থাকে। কেসগুলো ওভাবে আলাদা করা যায় না। আমাদের রেকর্ড ঠিক রাখতেই হবে। একটা কাজ করতে পারি। পি. এম. যিনি করবেন সেই ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি। কথা বলুন। চট করে কাজটা হয়ে যেতে পারে। আগলি সিন। ডোম বডি আগলে আছে। পার্টির স্ট্রেনথ বুঝে দরাদরি করছে……..এটা অ্যাভয়েড করতে পারেন, দেখুন।
রাত বারোটা নাগাদ মোমিনপুর থেকে রঞ্জনকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে অঞ্জু বলল, আমি আসছি একটু বাড়ি থেকে। ঠিক সময়ে আবার এসে যাব।
রঞ্জনদের ফ্লাটের সামনেটা এখন লোকারণ্য। রঞ্জন আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশীদের হাতে প্রায় বাহিত হতে হতে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। এত আলো এখন চারদিকে। তখন সেখানে যথেষ্ট আলো ছিল না। এত লোক! সেই বিন্দুতে একটি মাত্র মানুষকে কে আসতে বলে রেখেছিল। নির্বাচিত একজন।
এই যে ভাই!
আপনি এখনও আছেন?
কী করি। বলুন–ঘামে ভেজা জবজবে মুখটা মুছতে মুছতে জবাব দিল ট্যাক্সি ড্রাইভার ভদ্রলোক।
আপনি তো বাড়ি যাবেন, চলুন পৌঁছে দিই। কোনদিকে?
যাদবপুর। কিন্তু আপনি কি পাগল হলেন? সেই সন্ধে থেকে….. মিটার তো আপ করে রেখেছেন দেখছি। আমি কিন্তু গোটা বিশেকের বেশি দিতে পারব না।
আরে ভাই, কী টাকা দেখাচ্ছেন? আমরা সেন্টিমেন্টাল জাত জানেন তো? যত গরিব তত সেন্টিমেন্টাল। পয়সা নেই….. তাই বলে…… যাক গে চলুন, পৌঁছে দিই। আমাকে একটু ব্যাক করে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে গ্যারাজ করতে হবে। এতক্ষণ সমানে আপনিও তো ঘুরলেন নিজের কাজ-কম্মো ফেলে।
ট্যাক্সির দরজা বন্ধ করতে করতে অঞ্জু বললো, আমি তো বেকার!
হাত জোড় করে কপালে ঠেকাল ড্রাইভার, বলল, ভাগ্যিস, আপনি বেকার ছিলেন, তাই একজন মা শেষ সময়ে ছেলের হাতের জল পেলেন। আপনার ওই ঢাউস ওয়াটার-বটল—এ কি গঙ্গাজলই নিয়ে যাচ্ছিলেন?
গঙ্গাজল? ধুর। কলকাতার জল এখন খেলেই আন্ত্রিক। জানেন না? আমি সব সময়ে ফোঁটানো জল ক্যারি করি। অনেক জল খেতে হয় কি না!
ওই হল! ওই-ই আধুনিক গঙ্গাজল ভাই। ভগবানের কী বিচিত্র লীলাই না দেখলুম।
গলির মোড়ে নেমে যেতে যেতে অঞ্জু জোর করে দশটাকার দু-খানা নোট গুঁজে দিল ভদ্রলোকের হাতে।
আপনি বেকার না?
আপনারও তো লস হল অনেক।
ওই ওঁদের থেকে বেশি কী? আচ্ছা আবার দেখা হয়ে যাবে। আমার নাম বিজন সরখেল। আপনি?
অঞ্জন পোরেল।
সাড়ে বারোটা বাজছে। জানলায় কাছে উৎকণ্ঠিত মুখ।
কী ব্যাপার, অঞ্জু? এত রাত? আর বোলো না। মর্মান্তিক একটা রোড অ্যাকসিডেন্ট। আটকে পড়েছিলুম। জামা কাপড়গুলো জলে ভিজিয়ে আবার যাব।
আবার যাবি? তোর কিছু হয়নি তো?–মঞ্জু চৌকাঠে।
আমার? অঞ্জু ভাবল, তারপর বলল, যাওয়া দরকার। তুই যা হোক কিছু খাবার দে। আমি চান করে আসছি।
রাত তিনটেয় মোমিনপুর থেকে গাড়ি বেরোল। সকার সমিতি, গুরুদ্বার কারও গাড়ি পাওয়া যায়নি। টেম্পোয়ও আজকাল অনুমতি দিচ্ছে না। একটা গাড়ি মর্গ থেকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে চলে গেছে। সকাল এগারোটার আগে কোনো গাড়ি পাওয়া যাবে না। এগারোটা মানেই বারোটা, কিংবা একটা। বহু অল্পবয়সি ছেলে চারদিকে। এদের আত্মীয়স্বজন, এ ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। সেদিকে তাকিয়ে নিজের ঘড়ির দিকে চাইল অঞ্জু। পাঁচটা বাজছে। বলল, আসুন না, আমরাই নিয়ে যাই, এই তো! কতটুকু আর পথ! সে ডান পাশের সামনের খুররাতে হাত দিল।
আজও মেঘভরতি আকাশ। চুইয়ে পড়ছে সকালের আলো। একজন বয়স্ক মানুষ বললেন, মঙ্গলবার কাজ। কী যেন নাম তোমার? অঞ্জন? এসো বাবা। এসো কিন্তু।
অঞ্জু বাড়ির পথ ধরল। গতকাল এ সময়েও মাধবী বিশ্বাস ছিলেন। হয়তো চা দিচ্ছিলেন তাঁর স্বামী শিশির বিশ্বাস, ছেলে রঞ্জন বিশ্বাসকে। ডাকাডাকি করে কিছু নির্দেশ দিচ্ছিলেন পুত্রবধু কৃষ্ণাকে। সামনের দিকের চুলগুলো পাকা। সিঁথিতে অল্প সিঁদুর। রোগা, লম্বা, বেশ টরটরে। যখন কুঁচিগুলো হাতে ধরে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। বেশ স্মার্ট! রাস্তায় চলাফেরা আজকালকার গৃহিণীদের তো বেশ অভ্যাসই আছে। তাহলে কী হল? চোখ? চোখের নজর কম হয়ে এসেছিল না কি? তার ওপর বর্ষাসন্ধ্যার ঘোলাটে আলো। ম্যাটাডরটা জ্ঞানহারা হয়ে ছটছিল। রাস্তা দিয়ে যে মানুষকেও চলতে হয় সে হুশ নেই। যন্ত্র ক্রমাগত মানুষকে চাপা দিয়ে চলেছে। সংঘর্ষ! সংঘর্ষের একমাত্র সাক্ষী, সংঘর্ষের কালে একমাত্র আশ্রয়, একটি বলিষ্ঠ বেকার যুবক শরৎ বোস রোড ধরে সোজা চলে আসছে। কে তাকে টেনে আনছে? তার তো এ রাস্তা দিয়ে যাবার কথা ছিল না। তাহলে কেন? একি মানুষীর জন্য মনুষ্য-শাবকের ভেতরের টান?
অজস্র ভিড়। প্রচুর জুতো। সেদিনের সেই ঘরখানাকে চেনা যাচ্ছে না। শ্বেতপদ্ম, রজনিগন্ধা, উঁই। ট্রেতে করে সন্দেশ পরিবেশন করছে দুটি মেয়ে। অনেক পরিচিত, অনেক বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজন। বেশিরভাগই পরস্পরের সঙ্গে গল্পে মত্ত। জড়ো হবার একটা উপলক্ষ্য পেলেই শব্দরা উথলে ওঠে। সেতু বাঁধতে চায়। মৃত্যু? মর্মান্তিক! শেষ! কিন্তু জীবন? আহো জীবন। আহা জীবন! আমি, আমরা, তুমি, তোমরা যে পর্যন্ত আছি, আছ। আছিস? আছেন? আর থাকা দাদা। হাইপারটেনশন। ব্লাড শুগার তিনশো ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বসুমল্লিকদের বাড়ি দেখা হয়েছিল না? হ্যাঁ, নাতির অন্নপ্রাশনে। সেই আর এই? এ তো আসতেই হয়। থাকি কোথায়? সিঁথি, নতুন বাড়ি করলুম যে! সিঁথি থেকে সাদার্ন অ্যাভেনিউ। বুঝুন। আপনি কি এখনও আই.সি.আই-তেই? জামাইটি তো খুব ভালো হয়েছে। লস এঞ্জেলিস। আরে বাবা আজকাল ভালো ছেলে মানেই মার্কিন দেশ। ও লিলিদি! দেখতেই পাচ্ছ না যে! সেদিন তোমার লেকচার শুনলুম। ওই তো গুরুসদয়ে। এখন সাঁই ভজনে যাস না তো কই আর? এক একটা হুজুগ আসে যেন! তা হোক, মানুষ বড়ো অসহায় রে! বুঝিস তো। একটা ভরসা চাই! কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ … দেখলি তো? নিদানকালে কিছুই কাজে আসে না। পথে পড়ে বেঘোরে যাওয়া যদি কপালে থাকে তো তাই! আহা মাধবী বড়ো ফিটফাট ছিল রে! কথায় কথায় বলত হাসপাতালে যাওয়ার চেয়ে বরঞ্চ আমি বিনা চিকিৎসায় থাকব! উঃ! সাবধানও ছিল খুব! কী যে হয়ে গেল! এক বিঘত দূরে বাড়ি, স্বামী, ছেলে-বউ! ভাবা যায় না। শিশিরদার দিকে যেন তাকানো যাচ্ছে না। চুলগুলো ক-দিনে আরও সাদা… বিনোদ, হ্যাঁ আমি ডাকছি। ওদিকের জানলাটা বন্ধ করে দাও না একটু। পুরুতমশাই দেশলাই জ্বালাতে পারছেন না।
অঞ্জ মুখ বাড়িয়ে দেখল মুণ্ডিত মস্তকে রঞ্জন আসনে বসে, হাতে কুশ, সামনে কোশাকুশি। পাশে সাদা লাল পাড় শাড়ি পরে সেদিনের সেই কৃষ্ণা বলে মেয়েটি। সে গোলাপ এনেছিল কতগুলো। মাধবী দেবীর ছবির তলায় নামিয়ে রাখল। ইনি? খুব সম্ভব কয়েক বছর আগেকার। তখনও সামনের চুলগুলো অতটা পাকেনি। ছবির চোখ তার দিকে সোজা তাকিয়ে হাসছে। শেষ সময়ে বড়ো তেষ্টা পায়, অঞ্জু তুই জল দিয়েছিলি। ধুলোয় পড়েছিলুম। তুই কোল দিয়েছিলি। বলুন…… বলুন পিতৃকুলের ঊর্ধ্বতন তিন পুরুষ। আর এই পিণ্ডটি সবার জন্য। যাঁরা জল পাননি, তাপিত, পিপাসার্ত, অথবা যাঁরা পেয়েছেন, আরও পেলে আরও তৃপ্তি। গতাসবঃ। তাঁদের কথা মনে করে, হ্যাঁ…।
অঞ্জু আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল। শ্রাদ্ধবাসর থেকে সবার অলক্ষ্যে সে পথে নেমে এসেছে। একটা মন্ত্রের ঘোর, একটা দৃষ্টির সম্মোহন তাকে গঙ্গার ঘাটে নিয়ে যাচ্ছে। আদিগঙ্গা।
মাতৃশ্রাদ্ধ করবেন? অপঘাত? তা মস্তক মুণ্ডন করেননি কেন? অশৌচান্ত কোন পুরুতে করাল? আমি পারব না মশায়। ওই দিকে দেখুন গেঁজেল ঠাকুর রয়েছে। ওই যে থামে ঠেস দিয়ে! ওর কাছে যান। ও রাজি হয়ে যাবে। যত তো অশাস্ত্রীয় কাণ্ড…।
কয়েকবার ডাকবার পর গেঁজেল ঠাকুর লাল চোখ মেলে বলল, বেশ বাবা, বেশ বেশ। মাতৃশ্রাদ্ধ করবে, কিছু নেই? আরে বাবা স্বয়ং পৃথিবী মাতা এত থাকতেও নিঃস্ব। কিছু নেই তাতে লজ্জা কী? প্রকৃত বস্তু হচ্ছে অন্ন, জল আর শ্রদ্ধা। আর সব ভেবে নিলেই হবে। সবই বাহ্য। অন্ন আর জলের সূক্ষ্ম অংশ আত্মা নেন। তা বাপু, ক-টি টাকা দাও, অন্নজলটুকুর জোগাড় করি।
চান করে এসো।
করেছি।
নব বস্ত্র পরো।
পরেছি।
তা একরকম ঠিকই বলেছ বাবা। একই বস্ত্র দেখার গুণে প্রতিদিন নতুন হয়ে ওঠে বই কি! সময়কে যদি পল-অনুপলের মালিক বলে দেখ, বস্তুকে যদি প্রতি নিমেষে লয় পেতে আবার জন্মাতে দেখ, তো নূতনে পুরাতনে কোনো ভেদ নাই। গঙ্গোদক একটু মাথায় দিয়ে বসো তবে। … নাম বলো মায়ের! মাধবী দেবী? বাঃ! গোত্র? মনু? এরকম কোনো গোত্রনাম তো শুনি নাই বৎস! পিতৃপুরুষের নাম বলো। পিতামহ?
মানব।
পদবি নাই? নিরুপাধিক? বেশ বেশ। তা, তৎপূর্বে? প্রপিতামহ?
মানব।
তৎপূর্বে?
ইনিও মানব? বা বা বা।
মাতৃকূলের নামগুলি জানা আছে বৎস? মাতামহ?
মানব।
নিরুপাধিক? প্রমাতামহ?
মানব।
তৎপূর্বে? বৃদ্ধ প্রমাতামহ? ইনিও মানবই হবেন নিশ্চয়! চমৎকার। তবে বলো বৎস—বিষ্ণুর ওম মনুগোত্রস্য প্রেতস্য মন্মাতুর মাধবীদেব্যা…..পিতামহস্য মানবদেবস্যে… মাতামহস্য মনুগোত্রস্য মানবদেবস্য অক্ষয়স্বৰ্গকামঃ এতদ অন্নজলং শ্রীবিষ্ণুদৈবত যথাসম্ভব গোত্ৰনাম্নে ব্রাহ্মণায় অহং দদানি।
অবস্থান
ওয়াজিদ? ওয়াজিদ আলি শা? খিদিরপুরে থাকেন বললেন না? কেমন উৎসাহিত উত্তেজিত গলায় বলল খুকিটা। ছুট্টে গিয়ে আজকালের সব টেপটাপ হয়েছে, সেই একখান চালিয়ে দিল, বাবুল মেরা নৈহার ছুট হি জায়, ঘুরে ঘুরে মিহিন। সানাইয়ের সুরে বাজতে লাগল টেপটা।
ভালো লাগছে? আপনার ভালো লাগছে এই গান? জ্বলজ্বলে চোখে খুকি বলে।
কী করবে? মাথাটা তালে তালে নেড়ে দেয় সে। ভালো আসলে লাগছে না ততটা। কিন্তু অত উৎসাহের আগুনে ফুস করে জল ঢালা যায় কি?
খুশি অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে।
আপনার পূর্বপুরুষের লেখা গান। জানেন তো? নবাব ছিলেন ওয়াজিদ আলি শা। ঠিক আপনার নাম। একেবারে হুবহু।
এত উৎসাহ, উত্তেজনা, গান-ফানের কিছুই বোঝে না সে।
ওয়াজিদ নয় খুকি, আমার নাম ওয়াজির, ওয়াজির…। আলি নয়, শা নয়, মোল্লা—থেমে থেমে বলে সে। গলার আওয়াজটা বড়ে গোলামের মতো না হলেও বেশ জোয়ারিদার।
মোল্লা? ওরে বাবা খুকি যেন চমকে ওঠে।
কেন? ওরে বাবা কেন?
সে আমি বলছি না জেদি ঘাড় দোলায় খুকি।
আমি বুজতে পেরেছি ওয়াজির মোল্লা দাড়ির ফাঁকে হাসে।
বুঝতে পেরেছেন তো? খুকির গলায় সোয়াস্তি। বস্তুত দুজনেই হাসে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ষড়যন্ত্রীর হাসি।
কিন্তু আপনাকে ওয়াজিদ আলি শা সাহেব বলেই ডাকব। কেমন?
এটা কিন্তুক বুজলুম না খুকিসাহেব। … ওয়াজির মোল্লা মন দিয়ে পাকা পুডিং, রজন জ্বাল দেয়। নুটি ঠিক করে মার্কিনের টুকরোর মধ্যে ঝুরো তুলো ভরে।
খুকিসাহেব?—খুকিটি ভীষণ হাসি হাসতে থাকে। লুটিয়ে লুটিয়ে পড়ছে একেবারে।
এত হাসি! ওয়াজির মোল্লা তার পালিশের নুটি নিয়ে প্রস্তুত। এত কিছু মজাদারি আছে নাকি কথাটায়! নাকি সিরেফ জওয়ানি। যৌবনই এমন বাঁধভাঙা হাসি হাসায়।
খুকির বাবা একটুকুন আগে অফিস চলে গেছেন। এবার মা যাচ্ছেন। নাম্বা নাম্বা ইস্ট্রাপের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে খুটখুট করে ছ্যাকরা গাড়ির ঘোড়ার মতো, না না ছ্যাকরা গাড়ির ঘোড়া হতে যাবেন কেন? কত বড়োমানুষ! এতগুলিন সামানে ল্যাকর পালিশ দিবেন। ব্যাপরে। সেন্টের গন্ধে ভেসে যাচ্ছে চাদ্দিক। চকচক কচ্ছে চামড়া। কত ল্যাকর কত জলুসের জান! ছ্যাকরা গাড়ির ঘোড়া কেন হতে যান! ইনি হলেন গিয়ে ভালো জাতের রেসের ঘুড়ি। যেমনটি কুইনের পার্কের পাশে ঘোড়দৌড়ের বাজির মাঠে দেখা যায়! অতটা নাম্বাই-চওড়াই নেই। তা না-ই থাকল।
উনি বললেন, অত কী বকবক করছিস খুকি। কাজটা হবে কখন?
আমার হাত কামাই নেই দিদিসাহেব।–নুটি চালাতে চালাতে মোল্লা বলে।
তা হোক, খুকি, বড্ড বিরক্ত করছ!
না মা। ইনি একজন বিশেষ মানুষ। হিস্ট্রির লোক। এঁর নাম জানো? ওয়াজিদ, ওয়াজিদ আলি শাহ। খিদিরপুরে থাকেন।
তা-ই-ই? ভীষণ অবাক আবিষ্কারের দৃষ্টিতে কর্ত্রী তাকালেন। চেহারাটাও দেখেছিস!
খুকি আবার হাসতে থাকে! তুমি তো আমজাদের চেহারার কথা ভেবে বলছ। আসল মানুষটা তো নয়! তোমার যা হিস্ট্রির সেনস।
আহা, আমরা লেম্যান তো ওইভাবেই জেনেছি! এ মিলটাও কি কম আশ্চর্যের!
ওয়াজির মোল্লা জানে না, কেন এই আশ্চর্য, কেনই-বা আবিষ্কার। কীসের মিল। কেন মিল। ভুল নাম নিয়ে কেনই বা এত কচলাকচলি। তবে সে আর শুধরে দেয় না। কী দরকার! রুজি যাদের কাছে, একটু-আধটু ভুলভাল বলে তারা যদি খুশি থাকে, থাক।
আমার মাকে দিদিসাহেব ডাকলেন কেন?
কর্ত্রী চলে যেতে খুকিটি আবার জিজ্ঞেস করে। প্রশ্নের তার শেষ নেই।
কেন? ভুল হয়েছে কিছু?
না, ভুল নয়। সবাই তো মা, বউদি এসব বলে। ও, আপনাদের বউদি নেই, না?
ওয়াজির মোল্লা কাঁধের কিনার দিয়ে চিবুক চুলকাতে চুলকাতে ভাবতে থাকে।
তাই তো? দিদিসাহেব কেন? এই ডাকগুলান মুখ দিয়ে আপসে বেরিয়ে যায়। এখন তার কার্যকরণ বাতলাও এই কৌতূহলী বালিকার কাছে। মাথায় সিন্দুর নাই। ঘোমটা নাই। খাটো চুল গুছি গুছি পিঠ ঝেপে আছে। ঝুলঝুলে দুল। গলায় ঝুটো পাথরের দেখনাই হার। হাতেই-বা কী? একটা হাতঘড়ি। একটা কাঠ না কিসের বালা। এমন ধারা শো হলে মা ডাকটা ঠিক হয় না। দিদিই ঠিক। কিন্তু এসব কথা খুকিকে বলা যাচ্ছে না। সে খানিকটা প্রশ্নের উত্তর বেমালুম উড়িয়ে এড়িয়ে বলে সাহেব মানে একটা মান, একটা সনভ্রম, বোঝেন তো?
খুকি আবারও প্রচুর হাসে। সনভ্রম? কী বললেন? সনভ্রম?
খুকি বলতে ঠিক যতটা বাচ্চা হওয়া দরকার, এই খুকি কি ততটা? উলিথুলি চুল। চক্ষু দুটি ডাগর। তাতে ভাসে কৌতুক, কুতূহল, কোশ্চেন, ছোট্টখাট্ট, সবই ঠিক। কিন্তু খুকি খুকি শো থাকলেও এঁর সোমত্ম বয়স হয়েছে। ঢলঢলে কামিজ তবু বোঝা যায়। তা ছাড়াও, চলনবলন ছোটন-দাঁড়ান, কাজকম্মের একটা গোছ ধরন সবই ওই কথাই বলে।
তুমি ইস্কুলে যাবে না?
আমি কলেজে পড়ি, সেকেন্ড ইয়ার। ওরে বাবা! সেকেন কেলাস একেবারে? তবে তো খুব ভুল হয়ে গ্যাছে। খুকিসাহেব? তা আপনি কলেজে যাবেন না?
টেস্ট হয়ে গেছে, এখন আর যেতে হয় না।
বা বা–বাহবাটা কেন দিল মোল্লা তা জানে না।
শীতের বাতাসে বেশ আঁচ লেগেছে। শুখুটে শুখুটে দিনগুলো। পুরোনো সামান সব ঘষেমেজে, বাটালি দিয়ে চেঁছে ফেলে, নতুনের সঙ্গে তাকে মানিয়ে-গুনিয়ে কাজ। দরজার এড়ো, ক্যাবিনেটের পাওট সব নতুন করে বাদাম কাঠ মাপসই করে করা। এখন আর সব মিস্তিরি জববর, গোপাল, মুন্না—সব কটিকে বিদেয় করে দিয়েছে। একটু একটু কবে সাজিয়ে তুলতে হবে এখন সব। একা একা। অভিনিবেশ চাই তো না কি? শীতের শুখে থাকতে থাকতে সারতে হবে।
যবে থেকে একলা কাজ করছে আপন মনে, খুকিটি সেই ইস্তক সেঁটে আছে। অবিশ্যি সেঁটে বলতে ঠিক সেঁটে নেই। মাঝে মাঝে একেবারে অদর্শন হয়ে যায়। তারপর ঘুরছে ফিরছে, কাছে এসে বসছে, এটা ওটা নাড়ছে চাড়ছে। আর ফুলঝুরির মতো কোশ্চেন।
আরে সববনাশ, ও ঢাকা খুলেন না, খুলেন না।
কেন?
ইস্প্রিট সব ভোঁ হয়ে যাবে। পড়ে থাকবে পানি। জল।
জল? স্পিরিটে জল?
একটু আধটু ভেজালি এই লাইনে সবাই দিচ্ছে খুকি, কাকে ফেলে কাকে ধরবেন?
কী করে বুঝলেন জল আছে?
এই দ্যাখেন, নিজের মোটা মোটা খসখসে আঙুলগুলি মেলে ধরে ওয়াজির!
চামড়া কেমন কুঁকড়ে উঠেছে দেখেছেন? এই হল গিয়ে পানির নিশানি। … মনোযোগ দিয়ে দেখে খুকি।
স্পিরিট শুদ্ধ থাকলে কী হত?
পেলেন থাকত চামড়া।–স্পিরিটের মধ্যে গালা ঢালে ওয়াজির।
কী দিলেন ওগুলো?
গালা, কুসমি গালা খুকিসাহেব।
কুসমি? কুসমি কেন?
ডিমের কুসুম দেখেন তো? তলতলে কাঁচা-সোনা বর্ণ? সেইমতো হল গিয়ে বাজারের সেরা গালা। ফার্নিচারে মারলে কাঠের ওরিজন্যাল রংটিই ধরবে। এমন ঝিলিকদার হবে যে, এদিক থেকে লাইট মারলে ওদিকে পিছলে পড়বে।
তা অ্যাত্তো সব হাঁড়ি-কুঁড়ি বাটি-ঘটি নিয়ে কী করছেন?
খেলা করছি। রান্নাবাড়ি—ছোটো ছেলেরা খেলে না?
খেলাই তো!
খেলা, কিন্তুক কেমন জানেন? পরানপনের খেলা।
কেন এর মধ্যে আবার প্রাণপণের কী হল?
ও আপনি বুঝবেন না খুকিসাহেব। এ হল গিয়ে রং ফেরাবার খেলা। একেকটি খোরায় জানের একেকটি ধরে রাখছি।
দেখি দেখি কেমন আপনার জানের রং।
তো দ্যাকেন, এই রং মেহগনি, ডার্ক ব্রাউনের সঙ্গে ভুষো কালি, একটু এই অ্যাতেটুকু সিন্দুর…
সিন্দূর?
বাঃ, আপনারা সাজেন আর আপনাদের ফার্নিচার সাজবেন না। সিন্দুরে, আলতায় কাজলে, সুর্মায় সাজবেন বইকি! তারপর কাপড় পড়বেন ঝাঁ চকচক!
কী কাপড়? সিনথেটিক তো? নাইলন। … এতক্ষণে খুকি খেলাটা ধরতে পেয়েছে।
না খুকিসাহেব, ওরে কি কাপড় কয়? পরবে বেনারসি, তসর, মুগা, বিষ্ণুপুরের বালুচরি।
ওরে বাবা! কই বেনারসি, তসর এসব কই?
বানাচ্ছি। খাপি মিহিন খোলে। এমন গ্লেজ দেবে যে সিল্কের সঙ্গে তফাত করতে পারবেন না। চোখে ঝিলিক মারবে।
সবই তো দেখছি একরকম!
আরে সাহেব, সবই একরকম হলে কি আর এত ছাবাছোবার দরকার হত? এই দ্যাখেন এরে কচ্ছে ওয়ালনাট। বড়ো বড়ো হৌসে এই রং লাগায়। আই. সি. আই, আই. টি. সি., টাটা স্টিল…। ওয়ালনাটেরই কি আর একরকম? তিন-চার রকম আছে খুকি। আপনারা হয়তো দেখে কইবেন মেহগনি। যে জন জানে সে জন বুঝবে।
খুকি একটা কাঠের টুকরো তুলে নিল, বলল, বাঃ, খুব সুন্দর তো ধরিয়েছেন রংটা।
ধরাব না? আপনার মা-বাবা এসে স্যাংশন দিবেন তবে না? কাঠের পিসে সবরকমের ধরতাই দিয়ে রাখছি।
এতে কী দিয়েছেন?
কিচ্ছু না, কুসমি গালার রসের সঙ্গে এই অ্যাটুকুনি বেগনি রং।
তাতেই এই টিন্টটা এসে গেল?
তাতেই। তারপর আছে ঘষামাজা। আপনার মাথা ঘষেন না? একবার দুবার। তারপর মুখে কিরিম দাও, মোছো, আবার মাখো, আবার মোছো…এই সুন্দরীদেরও তেমনি। মাখবেন, তুলবনে, মাখবেন, তুলবেন। তবে না গ্লেজ আসবে। মুণ্ডু ঘুরবে দেখনদারের। এই তো সাইডটায় হাত দিয়ে দ্যাখেন।
সত্যি তো! কী স্মথ করে ফেলেছেন।
আরও করব খুকিসাহেব। তারপর ফেরেঞ্চ চক মাখাব। পাউডার মাখবেন সোহাগি আমার।
তেমন তেমন লাগসই উপমাগুলো ওয়াজির মোল্লা খুকির সামনে বলা উচিত মনে করে না। যত্ত চিকনচাকন হবে দেহখানি বিবির পালিশ তো তত্ত খুলবে! না কী?
তা এইটুকু শুনেই খুকির মুখ সামান্য লাল হয়। সে বলে ওঠে, দাঁড়ান, দাঁড়ান, আপনার চা-টা হল কি না দেখে আসি।
বড়ো গেলাসের চায়ে পাঁউরুটি ডুবিয়ে ডুবিয়ে তৃপ্তি করে খায় ওয়াজির মোল্লা।
এ মা, বর্ডারগুলোতে কালো দিলেন কেন?
উ হুঁ হুঁ। কালো নয়। কালো বলেন না। ও হল ডার্ক মেহগানি। যত শুকোবে তত খোলতাই হবে। হাসতে থাকবে। এই যে ভেতরে? সব ওয়ালনাট ফিনিশ দিইছি। দেখে ন্যান, ধারে ধারে একটু অন্যতম রং চাই, বুজলেন? অন্যতম কিছু। আবার ধরেন আপনাদের শয়নের ঘরে একরকম, তো বসার ঘরে বিকল্প চাই। সবখানেই ওয়ালনাট মেহগনি হলে হবে না। রোজউড দেব ক্যাবিনেটটাতে, দেখবেন চোখ যেন স্তম্ভিত হয়ে থাকতে চাইবে। একেবারে বিকল্প।
খুকি অনেকক্ষণ ধরেই হাসছিল,বলল, আপনি লেখাপড়া জানেন, না?
কই আর জানলুম খুকি।
খুকির বাবা এসে ডাকেন, মিস্ত্রি।
নতুন রং করা চেয়ারে বসলাম, গ্লেজ তো উঠে গেল।
তা তো যাবেই সাহেব।
সে কী! তাহলে এত কষ্ট করে খরচা করে পালিশ করার মানে কী!
আহা এখনও তো ফিনিশ হয়নি। শেষ অস্তে ল্যাকার পালিশ চড়াব। চক্ষে ধাঁধা লেগে যাবে।
গ্লেজ?
উঠবে না সাহেব। দশটি বচ্ছর চোখ বুজে থাকতে পারবেন।
পারলেই ভালো। সাহেব গটমট করে চলে যান।
হ্যাঁ কী যেন বলছিলেন! খুকি সুযোগ পেয়ে কাছিয়ে আসে।
কী আবার!
ওই যে অন্যতম, বিকল্প …ভালো ভালো কথা বাংলা রচনা বই থেকে?
ওই সেই কথা? এই যেমন ধরুন, খুকিসাহেব আপনারা আজকালের মেয়েরা সব ম্যাচিং দ্যান না? ফলসা রঙের শাড়ি, তো সেই রঙের সায়া, সেই রঙের জামা! মনে কিছু করবেন না, সরবো চেহারা লেপেপুঁছে খেদিকুঁচি লাগে।
খুকি আর হাসি সামলাতে পারে না।
আপনি হাসছেন? আমি যখন একেকটি ফার্নিচার সাজাই, তাকে জামা পরাই, সায়া পরাই, কাপড় পরাই, তকন আমার ওই লেপাপোঁছা মনে ধরে না। একটা কিছু অন্যতম খুঁজি। কেমন জানেন? লাহা বাড়িতে কাজ করতে গেছলুম। সে কি আজকার কথা! সে এক অন্যতম কাল! তা সে বাড়ির মেয়েরা সব হুরি রূপসি। আশি নম্বর একশো নম্বর কাগজ দিয়ে ঘষে ঘষে ঘষে তবে তেমনতরো তেলা চামড়া হয় খুকি, তারপর খালি সবেদা দিয়ে সাদা গালার পোঁচ, সর-হলুদ বাটা আর কমলালেবুর খোসা,গ্লেজ কী! চোখ পিছলে যায়।
পিছলে যায়? আটকে থাকে না? খুকি হাসি চেপে দুষ্টু প্রশ্ন করে।
উঁহু, রজন পাইল দিলে চিটে হবে, ওইখানেই তো পালিশের সরবো কারিগরি।
আহা পালিশ নয়, ওই লাহা বাড়ির সুন্দরীদের কথা কী যেন বলছিলেন?
ও হ্যাঁ, তা ওনারা পরতেন ধবধবে সাদা খোলের কাপড়। তাতে ভোমরাকালো, কিংবা খুনখারাবি লাল রঙের পাড়। জামা পরতেন ছিটের। লালের মধ্যে হলুদ কালো সবুজ চিকিমিকি। আর সায়াটি থাকত ধোয়া গোলাপি।
এ মা! কী বিচ্ছিরি!
হাঁ হাঁ করে ওঠে ওয়াজির মোল্লা। না না। একেবারে বিকল্প। ওই যে সবটি লেপাপোঁছা, হল না, অন্যতম রঙের খোয়ব রইল, তাতেই রূপগুলি বিকল্প হয়ে উঠত। এই যে বর্ডার দিচ্ছি, একটা জমিনকে আলে আলে বেঁধে দিচ্ছি, এতে করে আপনার আপন হয়ে যাবে দ্রব্যটি। উদোম মাঠ নয়, যেটা বারোয়ারি। একটা ধরুন শস্যক্ষেত্র। কেমন? নয় কি?
খুকি এখন আর হাসছে না। অভিনিবেশ সহকারে শুনছে। একটু পরে সে উঠে গেল।
বাড়িটি চমৎকার সেজে উঠেছে। ওয়াজির মোল্লাসাহেব দেখছেন। ঘরের মধ্যে যেন চাঁদনি। এমনধারা চাঁদনিতে মানুষের প্রকৃত মুখটি এই ধরা পড়ে, তো এই পড়ে না। একঘর আলো, তা বুঝি তার কতকগুলান উঁচার দিকে মুখ। মানুষগুলিকে মনে হয় খোয়াবে দেখা হুরি পরি জিন জাদুকর। হ্যাঁ জাদুকরও আছে। মোল্লাসাহেব বড়ো আয়নায় দেখছেন, তিনি নিজেই যেন জাদুর মানুষ। ভুষো কালি আর শ্বেত গালাতে মিলেমিশে ছোটো দাড়ি। হাতের কালচে চাম ইস্পিটের অ্যাকশনে উঠে উঠে যাচ্ছে, কাজের লুঙ্গি আর গেঞ্জিটি আলাদা করে রাখলেও ছাপছোপ পুরোপুরি এড়াতে পারেননি। পেলে একটু আধটু নানা রঙের পোঁচ লেগেছে। হলঘরটি যেন সিনেমা হল। তার মধ্যে ফার্নিচারে আলো ঠিকরোয়, ভালো গোমেদ পাথরের কাটিং যেন।
দুটো হাঁড়ি ওপর ওপর বসানো। ফরসা পুরোনো কাপড়ে বেঁধে দিচ্ছেন কর্ত্রী।
মিস্ত্রিসাহেব, ছেলেমেয়ে বিবিদের দেবেন গিয়ে।
কী আছে মা এতে? … দাত্রী রমণীকে আজ মা ডাকতে ইচ্ছে যায়।
লেডিকেনি আছে। আর রসগোল্লা…ভালোবাসেন তো?
হ্যাঁ মা…চমৎকার ভালোবাসি সব।
সন্ধে হয়ে গেল আজ শেষ দিনে আপনার…আর এই শাড়িখানা…পছন্দ হয়?
আপনার পছন্দ হয়েছে মাওয়াজির চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখেন, দেখান।
খুব। আবার দরকার পড়লে ডাকব আপনাকে। খোদা করুন, ডাকবার দরকার না হয় মালিক। বিশ বচ্ছরের কাম ফতে করে গেছি। রাখতে যদি পারেন। পানি আর রোদ্দুর এই দুই হল পালিশের দুশমন। পাতলা কাপড় দিয়ে মোলায়েম করে মুছে দেবেন, বাস। আর পাড়া-পড়োশন, ভাই-বহেন এঁদের কাছে যদি সুপারিশ করেন তো…আজকাল তো পালিশ লোকে করায় না, সব তেল রং আর পেলাস্টিক রং, হাউহাউ চিৎকার করছে। পালিশের কদর ওই বনেদি বাবুরাই করেন। বিকল্প কিছু…।
শাড়িটা প্যাকেট থেকে খুলে বার করেন মোল্লাসাহেব। ছাপের কাপড়। নানান রঙের হোরিখেলা। বিবি পরবেন ভালো। মোল্লাসাহেবের তত মনোমতো হয় না। কিন্তু তিনি বলেন, সুন্দর, চমৎকার। হেসে উঠছে কাপড়, আপনার এই বাড়ির মতো। সালাম, সালাম। কাঁধে ঝোলাঝুলি নিয়ে নীচে নেমে যান মোল্লাসাহেব।
ও ওয়াজিদ আলি শা সাহেব…একটু দাঁড়ান, একটু দাঁড়ান। হাঁফাতে হাঁফাতে ছোট্ট জমি দিয়ে ছুটে আসে খুকিসাহেব।
ঘাসের জমিতে সবুজ টিলটিল করছে। বেগুনি আভা সাঁঝের গায়ে। মিহি কাঞ্চন রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছে খুকি। চওড়া জাম রঙের পাড়। ভেতরে জরির সুতো, কালো সুতো চমকাচ্ছে। আর জামাতে বেশ খলখলে হাসকুটে কালো, কালো না মেহগনি, বুঝি খুকিও ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছে। কোনো উৎসবে যাবে বোধহয়।
অন্যতম হয়েছে? …
হাসি দাড়ি বেয়ে টাপুর টুপুর ঝরে।
হয়েছে, হয়েছে।
আর বিকল্প?
চতুর্দিকে হাতড়ান মোল্লাসাহেব। বিকল্পটি কি ঠিক হল? বিকল্প বলে কি তিনি সবসময় এক কথাই বোঝাতে চান? বিকল্প মানে এখন, এখানে অবিকল্প। সেরকমটি? হয়েছে কি?
খুকি রিনরিন করে হাসে। বোঝার চোখে তাকায়।
বিকল্পটা ঠিক হল না, না শা সাহেব?
হল না কি?—হাঁ হাঁ করে ওঠেন ওয়াজির মোল্লা—এখন এক্কেবারে বেগমসাহেবা। হানডেড পার্সেন। দুজনেই ষড়যন্ত্রীর মতো হাসতে থাকেন। একটা যে রঙ্গ হয়ে গেল সেটা উভয়েই বুঝেছে। শিল্পীর চোখে বিকল্প অর্থাৎ অবিকল্প?
তাও কি সম্ভব?
আচ্ছা চলি বেগমসাহেবা…
আবার আসবেন ওয়াজিদ আলি শা সাহেব…
ওয়াজির মোল্লা কিছু দূর চলে গিয়েছিলেন। ঘুরে দাঁড়ান।
ওয়াজিদ নয় কিন্তুক। ওয়াজির…ওয়াজির মোল্লা। খিদিরপুরে বাস নয়, কাজকাম করি ওখানে, নাহারবাবুদের ফ্যাকটরিতে। সাকিন নপাড়া বাগনান, সাউথ ইস্টার্ন রেলোয়ে।
নিজস্ব শিল্পভাবনার অবিকল্প নিশানখানা কাঁধের ওপর প্রশান্ত গর্বে তুলে ধরে নতুন পাড়ার দিকে রওয়ানা দেন ওয়াজির মোল্লা। কোনো ইতিহাস, পুরাণ কিংবদন্তির সঙ্গে অন্বিত হতে চান না। কিছুতেই।
আকাশে পাখিরা
কলেজ জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অবনীশ আর সীতার সঙ্গে বহুকাল পরে দেখা হল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট, ওরা বলে কানেটিকাট স্টেটে। বাঙালি ছেলে অবনীশ আর আমেদাবাদের মেয়ে সীতার প্রেম আমাদের মধ্যে বেশ জল্পনাকল্পনার বিষয় ছিল। আন্তঃপ্রদেশীয় বিয়ে! অবনীশের বাড়ি শেষ পর্যন্ত মানবে কি না, সীতার বাড়ি থেকে আপত্তি উঠবে কি না, ওরা দুজনে শেষ অবধি অ্যাফেয়ারটা টিকিয়ে রাখতে পারবে কি না? তা, সত্যিই কোনো পক্ষ বাদ সেধেছিলেন কি না জানি না। অবনীশ চটপট মার্কিন দেশে একটা ফেলোশিপ জোগাড় করে চলে গেল। বছরখানেক পরে গেল সীতা। ও বরাবরই দুর্ধর্ষ ছাত্রী ছিল। সব দিক থেকেই চৌখশ। প্রথমে গেল কলম্বিয়া, কী সব ম্যানেজমেন্ট-টেন্ট করল। তারপর দু-জনেই এই কানেটিকাট। ওখানেই ওদের বিয়ে, ওখানেই ওদের স্থিতি। এই তিরিশ বছরে একবারও আসেনি। কিংবা হয়তো এসেছে আমি জানি না। এলে আমাকে জানাবে না এটা ভাবতে আমার খারাপ লাগছে ঠিকই। কিন্তু এতগুলো বছর ধরে নতুন বছরের কার্ড আর পুজোর সময়ে সংক্ষিপ্ত চিঠি বাদে যাদের মধ্যে সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন, এ ধরনের খেলাপ তাদের মধ্যে হতেই পারে। তা সত্ত্বেও আমি যখন বিশেষ কাজে নিউইয়র্ক যাবার একটা সুযোগ পেলুম, তখন আমার প্রথম। কাজই হল ওদের একটা বিস্তারিত চিঠি লেখা, পরিবর্তিত ফোন নম্বর সহ। ঠিক তেরো দিন পরে ওদের ফোনটা পাই।
কী রে লম্বু, আমাদের মনে পড়ল তাহলে?
তাহলে তুই বাড়ি আছিস?, আমি বলি।
কেন? রাত এগারোটায় বাড়ি থাকব না কেন?
আমি হাসি—অবনীরা শুনেছি বাড়ি থাকে না!
একটু সময়! তারপয়েই অবনীশের মার্কামারা হাহা হাসি। যেটাকে আমরা হাহাকার বলতুম। যাক, হাসিটা যখন এক আছে, মানুষটাও খুব বদলাবে না। এই সময়ে বোধহয় অবনীশের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিল সীতা।
উদোয়, তুমার তো ওপন টিকেট। আমাদের এখানে অন্তত মাসখানিক থাকবে কিন্তু।
সীতার ভাঙা বাংলা আমরা বরাবরই উপভোগ করেছি। মজার এবং মিষ্টি, দুটোই। জানি না বাঙালিরা যখন অন্য ভাষা এমনি ভাঙা ভাঙা বলেন, তখন সেই ভাষাভাষীরা সেটা আমাদের মতো সানন্দে উপভোগ করেন কি না। আমরা নিজেরা কিন্তু খুবই অপ্রস্তুত হই। লজ্জা পাই। সীতা দিব্যি স্মার্টলি তুমার, অ্যাকন, কেন কি, হামরা চালিয়ে গেল।
আরও কিছুক্ষণ ওদের উচ্ছসিত আলাপ চলল। মাঝখানে এতগুলো বছর কেটে গেছে বলে মনে হল না। আমার এক মেয়ে, এক ছেলে শুনে ওরা জানাল ওদের দুই ছেলে, এক মেয়ে। টেলিফোনের তারের মধ্যে দিয়ে যেন উৎসাহের ঝড় বয়ে গেল কিছুক্ষণ।
অবনীশ বলল, চলে আয়। আমরা পথ চেয়ে বসে আছি। তোকে সময় দিতে আমার কোনো অসুবিধে হবে না। আমি একটু-আধটু ছুটি ম্যানেজ করতে পারব। সীতাটারই একটু মুশকিল…।
কথা শেষ হল না, সীতা বলে উঠল, অবনী কীকর্ম একলা ষাঁড় থেকে যাচ্ছে দেখেছ? আমি মোটেই অসুবিধে করব না। আমরা তিনজনে খুব ঘুমব।
বুঝতেই পারছেন এ ঘুম সে ঘুম নয়। এ হল ঘোরানোর উদাত্ত প্রতিশ্রুতি। সুতরাং অফিস ম্যানেজমেন্টের কাছে দরবার করি। আপনাদের কাজ ষোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা করে দেব কথা দিচ্ছি। কিন্তু পত্রপাঠ আমাকে ফিরতে বলবেন না। প্লিজ!!
ম্যানেজমেন্ট মৃদু হেসে বললেন, উই আন্ডারস্ট্যান্ড। ইউ হ্যাভ স্কোর্স অব রিলেটিভস অ্যান্ড ফ্রেন্ডস দেয়ার।
গৃহিণী নিপুণভাবেই সব গুছিয়ে দিলেন। কিন্তু অবিকল, যেতে নাহি দিব-র স্টাইলে। চক্ষু ছলছল। কারণটা অবশ্য আলাদা। তিনি কেঁদেছিলেন বিশুদ্ধ পতিবিরহে। ইনি ফোঁপাচ্ছেন মজা মারতে নিজে যেতে পারছেন না বলে। বাড়ির বিচ্ছু দুটোও সমানে তালে তাল দিচ্ছে। রিনি বলল, বলছ দেড় মাস, কিন্তু ভিসা তিন মাসের। দেড় মাসের বেশি থেকেছ তো বাবা আমিও অদূর ভবিষ্যতে জার্মানি কি ইংল্যান্ডে সেটল করছি। তার ভাই রণো আবার এক কাঠি বাড়া। সে বলল, আমি তো ভাবছি হায়ার সেকেন্ডারিটা হলেই জি. আর. ই, তারপরই স্টুডেন্ট ভিসা। এবং মার্কিন মুলুক। এখন সেটাই করব না এই পচা কাঁকুড়গাছিতে পচা বাবার পচা বাড়িতেই পচব, সে সিদ্ধান্তটা নির্ভর করছে বাবার সময়মতো ব্যাক করার ওপর। আমি মনে মনে বলি—বাবার কিছুর ওপরই কিছু নির্ভর করছে না। বাপধন, সেটা শর্মা জানে।
প্রসঙ্গত আমার মেয়েটি যাদবপুরে সিভল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। অঙ্কে খুব মাথা ছিল। আমার পরামর্শ ছিল অঙ্ক নিয়ে পড়া। মুচকি হেসে ইঞ্জিনিয়ার হতে চলে গেল। ছেলে শুনেছি চান্স পেলে ডাক্তারিও পড়তে পারে। আবার না পেলে ইতিহাসও পড়তে পারে। ওদের ব্যাপারস্যাপার আমি বুঝি না।
আমার মা আবার আর এক। তিনি বললেন, আমিও তাহলে বাপের বাড়ি চলে যাব। বোঝে ঠ্যালা। চুয়াত্তর বছর বয়সে মহিলা অরিজিনাল বাপ-এর বাড়ি কোথায় পাবেন তা তিনিই জানেন।
যাই হোক, এদের কাটিয়ে তো কোনো মতে ব্রিটিশ প্লেনে ওঠা গেল। এ ঘটনা এগারোই সেপ্টেম্বর, ২০০১-এর পাঁচ বছর আগেকার। কাজেই সহযাত্রীদের আগাপাশতলা জরিপ করার দরকার পড়েনি। ডাউনটাউন নিউ ইয়র্কে ঘোরবার সময়ে কোনো সন্দেহজনক আঁশটে গন্ধও পাইনি। বেশি কথা কি ওই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দ্বিতীয় টাওয়ারটার পনেরো তলাতেই আমার বেশিরভাগ কাজকর্ম ছিল।
প্রতিদিনই ফোনে অবনীশ আর সীতার সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছিল। আমার হোটেলে ফেরার ওয়াস্তা। পি পি করে ফোন বাজবে।
কী রে লম্বু! ব্যাটা সেটল করিচিস?
এক্ষুনি সেটল করব কী রে?
আরে ফর দা টাইম বিয়িং। চান করিচিস? এক পাত্তর নিয়ে বসিচিস?
সময় দিলি কোথায়? এই তো ঢুকছি।
এই ঢুকছিস বলে নাঙ্গাবেলার বন্ধু ফোন করবে না?
করবে না কেন, কিন্তু চান টান, সেটল-ফেটল, এক্সপেক্ট করবে না। …
কিংবা হয়তো সত্যিই চান সেরে এক পেগ নিয়ে বসেছি, সঙ্গে সোনালি চিংড়ি ভাজা। ফোন এসে গেল, উদোয় আছে?
উদয়ের ঘরে আর কে থাকবে ম্যাডাম? বুধোয়?
আমি আর অপেক্ষার সহ্য হচ্ছে না, তাড়াতাড়ি কোরো।
এতই যদি অধৈর্য তো গ্যাঁটের ডলার খর্চা করে একটা রিটার্ন-টিকিট কিনে পাঠিয়ে দিলেই তো পারতেন দেবী! দিব্যি হলিডে করতে আসতে পারতুম! যে অফিস পাঠিয়েছে তার ফাইল বগলে সারা মাস চরকি-নাচন নাচতে হত না।
সরি উদোয়। যু আ রাইট। নেক্সট টাইম আর ভুল করছি না। যা হোক, ছাড়া পেলেই আসছ তো?
আর কোন চুলোয় যাব দেবী, এক কাজিন থাকে ক্যালিফোর্নিয়া, শ্বশুরবাড়ির দিকের এক আত্মীয় থাকেন ফ্লরিডা, তা সেসব জায়গায় যাবার কড়ি আমার নেই আজ্ঞে।
যাক, তুই সেই আগের মতোই আছিস রে লম্বু!–অবনী বোধ হয় শুনছিল, ফট করে বলে উঠল।
তুইও তো আগের মতোই আছিস। ঠিক আড়ি পেতেছিস? তোর শ্যোন চক্ষু শ্যোন কর্ণ ফাঁকি দিয়ে যে বউ একটু পরকীয় করে নেবে তার উপায়ও রাখিসনি।
দুজনেরই ইচ্ছে আমাকে নিতে নিউ ইয়র্ক আসে। একটু শহর দেখায়। কিন্তু এখানে আমার অফিসতুতো এক পূর্বতন সহকর্মী থাকেন। বিপত্নীক মানুষ, দুই ছেলের একজন কানাডার মনট্রিঅলে। আর একজন ইউ.এস.এ-তেই এইমস-এ। নিউ ইয়র্কে কেউই থাকে না। ভদ্রলোক আমাকে কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে নিউ ইয়র্কের থিয়েটার, পার্ক, মিউজিয়াম, স্টাচু অফ লিবার্টি, মায় লং আইল্যান্ড পর্যন্ত ঘুরিয়ে দেখাবার ভার নিয়েছেন। তাঁর উৎসাহেই বা জল ঢালি কী করে? এক মানুষ, সঙ্গী পেয়ে আর ছাড়তে চান না।
সেই মি, বাগচিই আমাকে অ্যামট্রাকের নীলবরণ ট্রেনে তুলে দিলেন। আমাদের এখানে একদম গোড়ায় ইলেকট্রিক ট্রেনগুলো এইরকমই ছিল। শুধু রংটা আলাদা। হুশশশ করে মফসসলি প্রকৃতি দেখতে দেখতে পৌঁছে যাই।
সবুজ-স্টেশনে দুই মূর্তি হাজির। অবনীশের মাথা প্রায় ফাঁকা। কিন্তু চেহারাটি একেবারে পেটা। পঞ্চাশোধেঁ পেটে-ফুটবল নেই সফল স্বজাতীয় আমি দেখিনি। বিশ্ব পরিসংখ্যান বলছে, বাঙালিদের মধ্যে হার্ট ট্রাবল বেশি, কারণ এই ফুটবলের ধাক্কা। সীতার সবচেয়ে সৌন্দর্য ছিল তার চুলে। সেই চুল দেখি কেটে ফেলেছে। তা ছাড়া একটু গায়ে সেরেছে। গাল-টালগুলো একটু বয়ঃভারী। ব্যাস।
কী করে চেহারাটা এমন ফিট রেখেছিস রে?
বন্ধু বলল, খর্চা আছে! খাটনি আছে!
আমাদের শুভদীপ য়ুনিভার্সিটি ব্লু ছিল, মনে আছে? এখন তাকে দেখলে চিনতে পারবি না। ছ-ফুট ব্যাসের একটি প্রকাণ্ড বল।
অবনীশ গর্বের হাসি হেসে আমার পিঠ চাপড়ে দিল।
তোকেও কিছু আধবুড়ো লাগছে না, তবে এইবেলা যদি সাবধান না হোস তো ফুটবল না হোক একটি টেনিস বল তোর প্রাপ্তি হবেই। শরীরটা আলগা হতে থাকবে। তার হাইটটাই এখনও তোকে বাঁচাচ্ছে।
ওকে আশ্বস্ত করি। আমিও মোটামুটি স্বাস্থ্য-সচেতন। একটু-আধটু যোগাসন করি, হাঁটাহাঁটিও করি। শুভদীপকে দেখে আমার ভয় ধরে গেছে।
তোমার তো চুলও চোমোক্তার আছে উদোয়। বেশ সল্ট অ্যান্ড পেপার। তুমার বন্ধুর দিকে একবার তাকিয়ে দেখ। একেবারে চোকচোক গোড়ের মাঠ হয়নি?
তখন আমি সুযোগ পেয়ে বলি, তো সীতাদিদি, তোমারই বা সে ভ্রমরকৃষ্ণ মেঘপুঞ্জ কেশদামের কী হল?
মুখটা বিরক্তিতে কুঁচকে সীতা বলল, যা খাটুনি! চুল এখানে রাখা যায় না উদোয়। অন্তত আমি পারি না। লম্বা চুল গাছের পাতার মতো ঝরে পড়ে যায়।
হইহই করতে করতে গাড়ি চালাচ্ছে অবনীশ। পাশে সীতা। পিছনে আমি বেল্ট বাঁধা-ছাঁদা লাগেজের মতো।
শহর থেকে দূরে, পাইন-মেপল-বার্চ ঘেরা একটা চমৎকার গ্রামে থাকে ওরা। নাম শেলটন। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে অনায়াসে আমার সুটকেসটা তুলে নিয়ে গেল সীতা। কিছুতেই আমাকে নিতে দিল না। পিছন-পিছন আমি। অবনী গ্যারাজে গাড়ি রেখে আসছে। বাড়ির বাইরেটা অবিকল ইংরেজি ফেয়ারি-টেলের বাড়িগুলোর মতো। ভেতরটাও যেন খেলাঘর। তা সিঁড়ি দিয়ে উঠে কফি রঙের কার্পেটের ওপর পা রেখেছি কি না রেখেছি—কুঁ কি ক্যাঁ কুঁ কি ক্যাঁ করে কিছু একটা কর্কশ গলায় চিৎকার করে উঠল।
ওঃ মাই প্রিটি, মাই সুইটি মিটু ডিয়ার, মা ইজ হিয়ার—বলতে বলতে কয়েক কদম গিয়ে সীতা হাত উঁচু করে একটা খাঁচার দরজা খুলল। খাঁচাটা সোনালি রঙের। সিলিং থেকে একটা চকচকে ধাতুর বাঁকানো ডগায় ঝুলছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয়—কোনো গৃহসজ্জা। কিন্তু কাঁচের দরজা খুলতেই একটা সবুজ টিয়াজাতীয় পাখি বিদ্যুৎবেগে উড়ে সীতার কাঁধে গিয়ে বসল।
আমার দিকে ফিরে সীতা বলল, প্লিজ বসো, উদোয়, আগে একটু রেস্ট নিয়ে নাও তারপর তুমাকে বাড়ি দেখাব।
ততক্ষণে কয়েক সিঁড়ি টপকে টপকে উঠে এসেছে অবনীশ। পিছন থেকে সোৎসাহে বলল, ও কী বলল বল তো!
আমি বলি, বলল আগে একটু রেস্ট নিয়ে নিতে, তারপর…
অবনীশ হা হা করে হেসে বলল, সীতা নয় সীতা নয়, মিঠুর কথা বলছি।
মিঠু কে?
কী আশ্চর্য! ওই প্যারটটা।
ও আর কী বলবে? ক্যাঁ ক্যাঁ করে চেঁচাল খানিকটা।
উঁহু, আমাকে হারিয়ে দেবার বিজয়গর্ব ফুটে উঠল অবনীশের মুখে।
সীতা হেসে বলল, ও বলল হু ইজ দ্যাট, হু ইজ দ্যাট। আশ্চর্য ইনটেলিজেনট পাখি। একটা মানুষ বাচ্চার সঙ্গে কোনো তফাত নেই।
অবনীশ বলল, চন্দনা জাতীয় বুঝলি। আমি আবার ল্যাটিন নামটা মনে রাখতে পারি না। আয় এদিকে আয়।
ওকে অনুসরণ করে যাই। ওদিকে সোফায় সীতা বসে আছে। তার টি শার্ট শোভিত কাঁধে চন্দনা। হঠাৎ একটা সবুজ ঝলকানি তারপরই আমার মাথায় খটাস করে লাগল। উঃ আমি মাথাটা সরিয়ে নিই।
নটি বয়, যাও মিঠু মায়ের কাছে যাও, যাও, … অবনীশের গলায় আদেশের সুর।
সীতা বলল, হি ইজ জেলাস, বুজলে উদোয়। অবনী যে তুমাকে আদর করে নিয়ে যাচ্ছে, কাঁধে হাত রেখেছে! হিজ পা হ্যাজ টু বি ওনলি হিজ।
অবনী তাড়াতাড়ি আমার মাথাটা দেখল, রক্ত-টক্ত কিছু বেরোয়নি নাকি। তবু অবনী একটু ফার্স্ট এইড দিল। মাথার ভেতরটা ঝনঝন করছে আমার। সীতা বলল, জেনার্যালি হি ইজ ভেরি ওয়েল-বিহেভড, আসোল কথা, হিংসা হচ্ছে।
এখন মিঠু তার ডান হাতের উলটানো পাতার ওপর। এই ভঙ্গিতে মোগল বাদশাদের ছবি পাওয়া যায়। তাঁদের হাতে অবশ্য চন্দনা থাকে না, থাকে শিকরে বাজ। তা এই বা কম কী?
আমি সংক্ষেপে বলি, ওরে বাপ।
সত্যিই রে উদয়, ও একদম এসব করে না। পার্ফেক্ট ম্যানার্স একেবারে।
আমি বলি, আমি খারাপ লোক বুঝতে পেরেছে আর কি! আমাকেও ওয়ার্নিং দিল, তোদেরও সাবধান করে দিচ্ছে।
এই যাঃ, সীতা বলল, তুমি মাইন্ড করেচো। এক্সট্রিমলি সরি, উদোয় আ অ্যাম গোয়িং টু পানিশ হার।–সে পাখিটার ওপর তার বাঁ হাত চাপা দিল, তারপর তাকে তার তীব্র প্রতিবাদের মধ্যে খাঁচায় পুরে দিল।
কাঁ কাঁ কাঁ, পাখিটা চিৎকার করেই যাচ্ছে।
নো মা। অ্যাম নট ইয়োর মাদার এনি মোর।
সীতা চলে এল। কী আশ্চর্য! পাখিটাও ঘাড় গুঁজে কেমন একটা ঝিমিয়ে মতো বসে রইল। ঠিক যেন একটা বাচ্চা দুষ্টুমি করে বকুনি খেয়ে মুখ গোঁজ করে, নীচু করে বসে আছে।
ততক্ষণে আমরা লিভিংরুমটার শেষ প্রান্তে এসে পড়েছি। লম্বা লম্বা ভেনিশিয়ান ব্লাইন্ড সরে গেল। কাচ দিয়ে সমস্তটা ঢাকা, তার ওদিকে একটা রীতিমতো জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। ঘন কালচে সবুজ পাতা-ঝরা-গাছের অরণ্য। বাড়ি আর জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে একটা চওড়া নালার জল বইছে। তাতে দু-চারটে হাঁস।
অবনীশ বলল, ওই যে জঙ্গলটা দেখছিস ওটা আমাদের। ওই স্ট্রিমটাও।
আমি জীবনে এই প্রথম কোনো জঙ্গল এবং নালার মালিক দেখলাম ভাই। আমি বলি।
আরে এখানে সাবাবে অনেকেরই এমন জঙ্গল আছে। জঙ্গলই বলিস, বন বাগানই বলিস!
মানে!
ওয়াইল্ড গার্ডেন ধর। আমাকে রীতিমতো মেনটেইন করতে হয়। সময় মতো ডাল-ফাল কাটানো, নীচেটা পরিষ্কার করা। এ সবের লোক পাওয়া যায়। তবে আমাদের স্পেশ্যাল অ্যাকুইজিশন হচ্ছে ওই নালাটা, হরিণ জল খেতে আসে। চাঁদনি রাতে যা লাগে না!
হরিণও আছে তোর জঙ্গলে? তুই তাহলে হরিণযুথেরও ওনার?
না তা নয়।–ও বলল, হরিণরা রাস্তা ক্রস করে জঙ্গল পেরিয়ে অন্য জঙ্গলে চলে যায়। যাবার স্বাধীনতা তাদের আছে। আমার জঙ্গল বলে তাকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আমি ঘিরতে পারি না। দিস ইস আ ফ্রি কানট্রি।
সীতা বলল, কোতো পাখি আসে ওখান থেকে। আমাদের ডেকটার তলাতেই বার্ড ফিডার রাখি। দেখবে এস, ভাগ্যে থাকলে ফ্লিনচ রবিন, ব্ল্যাক বার্ড, ব্লু জে, কার্ডিন্যাল আরও কোতো পাখি দেখতে পাবে। মাঝে মাঝে ওয়াইল্ড টার্কিও এসে যায়।
আমাদের ছাদ থাকে, বারান্দা থাকে। এদের এখানে বেশিরভাগই দেখছি বাড়ির পেছনে একটা ডেক থাকে, ঠিক জাহাজের ডেকের ছোটো সংস্করণেরই মতো। এরা সেখানে নানা রকম হার্বস চাষ করে-ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, চায়না-গ্রাস, আরও কত কী তাদের নামও ছাই আমি জানি না। সীতা-অবনীশের ডেকে একটা রং-করা বেতের বসবার ব্যবস্থা দিবারাত্র রোদ খাচ্ছে জল খাচ্ছে। জঙ্গলের দৃশ্যটা এখান থেকে বেশ ভালো দেখা যায়। একটা মাত্র ধূসর রঙের পাখি খুঁটে খুঁটে কী সব খাচ্ছিল, আমরা ঢুকে বসতেই হুশশ করে উড়ে গেল।
সীতা বলল, আশ্চর্য, ওরা তো অন্য দিন পালায় না।
আমি বলি, আমি খারাপ লোক, দেখো তোমাদের পোষা এবং না-পোষা পাখি সকলেই তোমাদের জানিয়ে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে অবনীশ অতি চমৎকার দেখতে মার্গারিটার ট্রে নিয়ে উপস্থিত। একটা ক্রিস্ট্যালের পাত্রে যথেষ্ট মেওয়া, যাকে এরা বলে ড্রাই ফুট। আমার এখন একটু হাত-পা ছড়িয়ে কোনো পানীয় নিয়ে বসবারই দরকার ছিল।
আমার শেষ কথাটা অবনীশ বোধ হয় শুনতে পেয়েছিল। বলল, পোষা-টোষা বলিসনি। মিঠুটা পোষাও নয়, পাখিও নয়, ও আমাদের পুত্র, যাকে বলে ছোটোখোকা।
সীতা বলে, আমাদের চারটা। অত্রি, জিষ্ণু, রশমি আর মিটু।
একটু গল্পগাছা করবার পর ওরা পরম উৎসাহে বাড়ি দেখাতে লাগল। প্রাসাদবিশেষ। তিন ছেলেমেয়ের তিনখানা ঘর, ওদের নিজেদের একটা বিশাল শোবার ঘর, সঙ্গে লাউঞ্জ। টয়লেটে বাথটবে জাকুজি। অতিথি-ঘরটার সঙ্গেও একটা লাউঞ্জ। আগাগোড়া ছবির মতো সাজানো। লাইব্রেরি। ডাইনিং কাম লিভিংরুম। ফর্মাল ড্রয়িংরুম। বিশাল ব্যাপার। যাদের বাড়ি তারা বিশেষ উপভোগ করতে পায় বলে মনে হয় না। আমি দু-দিনের জন্যে এসে আচ্ছা করে আরাম খেয়ে নিই। ভোরবেলা উঠে হাঁটতে হাঁটতে শেলটনের গাছে-ছাওয়া গ্রামাঞ্চলের রাস্তা বেয়ে চলে যাই যত দূর পারি। আশ্চর্য সবুজ গাছপালা সব। যেন কেউ প্রতিদিন সাবানজল দিয়ে ঝকঝকে করে মুছে যায়। রাস্তার নেড়ি-বিল্লি বলে জিনিস নেই। মাঝে মাঝে অবশ্য ডিয়ার ক্রসিং নোটিস দেখে বুঝতে পারি নেড়ি হরিণ এখানে আছে বিস্তর। আর আশ্চর্য, আকাশে কোনো পাখি নেই। আমাদের তো গাছ থাকলেই সেখানে কাকে বাসা করবে। ভোর বা সন্ধে মানেই হরবোলা অর্কেস্ট্রা। এখানে সকালে পাখিদের জেগে-ওঠা নেই, বিকেলে তাদের ঝাঁকে-ঝাঁকে ঘরে ফেরা নেই। কাকের কা-কা নেই এমন অবস্থা তো আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আশ্চর্য নিরালা, নীরব দিন-দুপুরে হঠাৎ-হঠাৎ কেমন অপ্রাকৃত নিঃশব্দ লাগে সব। কেন এত অস্বস্তি! তার পরে আবিষ্কার করি—কাক নেই, কা-কা নেই তাই। পাখি দেখতে হলে যাও সেই ডেকে। মেহেদি আর থাইদেশীয় তুলসীর মধ্যে বসে থাকো যদি ব্লু-ফিনচ, রবিন কি ব্ল্যাকবার্ড দেখতে চাও।
কিন্তু আমরা তো আর সবাই সেলিম আলি নই, বিভূতিভূষণ বা বুদ্ধদেব গুহও নই, যে পাখির জন্য পথ চেয়ে আর কাল গুনে বসে থাকব! আসলে পাখপাখালির ডাকাডাকি আমাদের শহুরে জীবনযাত্রারও আবহসংগীত। সংগীত হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় কেমন একটা কেমন-কেমন লাগে।
আমাকে কথা দিলেও অবনীশরা সেভাবে ছুটি নিতে পারেনি। দুটো উইক এন্ডের সঙ্গে আর একটা করে দিন যোগ করে নিয়েছে। ওই দুটোর একটায় আমরা যাব হার্ভার্ড, কেমব্রিজ, বস্টন এবং তার কাছাকাছি নিউ হ্যাম্পশায়ার বলে একটি পাহাড়ি জায়গায়। আর একটায় যাব নিউ ইংল্যান্ডের প্লিমাথ নায়াগ্রা।
ভোরবেলা আমার চ্যানেল মিউজিক শুনে ঘুম ভাঙে। আমি চটপট বেরিয়ে পড়ি। ফিরে দেখি ব্রেকফাস্ট রেডি। ফেনায়িত কফির গন্ধে বাড়ি ভরপুর। সীতা বেচারি অত সকালে পরোটা-ফরোটা ভেজে ফেলে এক এক দিন। অবনী আগে, সীতা একটু পরে বেরিয়ে যায়। দুজনের দুটো গাড়ি মোড়ের ওধার ঘুরে হারিয়ে যায়। আমি আস্তে আস্তে ভেতরে এসে বসি। খুব ভোরে উঠি তাই এক এক দিন আর এক ঘুম ঘুমিয়ে নিই। অলস মাথায় বই পড়ি। ভি.সি.পি-তে ক্যাসেট চাপিয়ে ভালো ভালো ছবি দেখি। একটা কি দুটো কি আড়াইটে বাজলে ফ্রিজ থেকে কিছুমিছু বার করে মাইক্রোওয়েভে গরম করে নিই। তবে অনেক সময়ে মাঝেও একটু মুখ চালাতে ইচ্ছে করে। ফ্রিজের মধ্যে দিব্যি ছাড়ানো বেদানা-ডালিম, বাদাম আখরোট থাকে, টুকটাক চালাই। মোটকথা এরকম আলসে কুঁড়ে নিপাট নিশ্চিন্ত বাদশাহি ছুটিযাপন আমার ভাগ্যে জীবনে এই প্রথম। লাগছে মন্দ না। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে এই বাড়ি এই জঙ্গল এই বৈভব এই হরিণ সব বোধহয় আমারই। গান শুনতে শুনতে একঘেয়ে লাগলে ঘুরে বেড়াই বাড়িটার মধ্যে। কত রকমের যে অলংকরণ! কাচের স্ফটিকের, কাঠের, গালার, কাপড়ের, পোড়া মাটির। আর ঘরে ঘরে ছবি, ছবি মানে ফোটো। ছবি দেখে-দেখে অত্রি-জিষ্ণু রশমিকে আমার চেনা হয়ে গেছে। শিশুকাল থেকে এখনকার বয়স পর্যন্ত অজস্র ছবি। কখনও মার সঙ্গে কখনও যাবার সঙ্গে কখনও দুজনের কোলে পিঠে, কখনও ভাইবোন তিনজন, কখনও কেউ একা, বন্ধুদের সঙ্গে, পাহাড়-নদী-অরণ্য-পথ, পথের মানুষের সঙ্গে। অজস্র অজস্র। অত্রি নাকি এখন আঠাশ তো আট বছরের অত্রিও যদি আমার সামনে এসে দাঁড়ায় আমি নির্ভুল চিনতে পারব। জিষ্ণু ছাবিবশ, তার নাকি আবার নিজস্ব পরিবারও আছে, রীতিমতো ফ্যামিলি ম্যান। আর রশমি একটা উনিশ বছরের কিন্তু গাল টিপলে দুধ বেরোয় গোছের বালক-বালক মেয়ে। তিনজনেই সুন্দর প্রাণবন্ত। রঙিন ছবিতে তাদের গালের লালিমা, স্বাস্থ্যের দীপ্তি ফেটে বেরোয়। জিষ্ণুই ওদের মধ্যে অবনীশের রং পেয়েছে, ঘষা তামার মতো একটা অদ্ভুত রং যেটা অবনীশের ছাত্রবেলায়ও ছিল।
একা-একা একঘেয়ে লাগত যদি সন্ধে থেকে মাঝরাত্তির অবধি অমন জমাট আড্ডাটা না হত। এতদিনের জীবনের আদি-মধ্য-অন্তের ভেতরে যে আদি-ঘেষা মধ্যভাগটায় আমাদের তিনজনের জানাশোনা সেইসব দিনের স্মৃতিচারণের বেশিরভাগ সময়টা কাটে। তবে তারই অনুষঙ্গে আগেকার জীবন, এখনকার জীবনযাত্রার প্রসঙ্গে এসেই পড়ে। অবনীশ আসে আগে, ডিনারের ব্যবস্থা শুরু করে দেয়। দুজনে চা নিয়ে বসি। ওদের জন্যে ভালো দার্জিলিং চা নিয়ে এসেছি, তারই সদব্যবহার হয়। খাঁচার মধ্যে ঝটপটাতে থাকে মিঠু। কাঁ কাঁ, কাঁক, কাঁক।
কী বলছে বল তো!—অবনীশ পরমোৎসাহে জিজ্ঞেস করে।
আমি তোর টিয়ের ভাষা কিছুই বুঝতে পারছি না অবনী, অনেস্টলি।
আরে কী আশ্চর্য! ও বলছে বাবা, বাবা, বাবা।
আমি হেসে বলি, আমি তো শুনছি বড়োজোর নাকিসুরের কাকা, আবার টাটা ও হতে পারে।
না রে, এটাই ওর ফেমাস বাবা ডাক। প্রথম ডেকেছিল মা। সে ঠিক আছে। মা একটা এক অক্ষরের শব্দ, সবাই বলে। কিন্তু বাবা বলে যেদিন আমার কাঁধের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম বুঝলি। কেননা, ডাকটা ও শুনল কোথায়? আমার ছেলেমেয়েরা যখন আসে, ডাকে ড্যাডি। বাবা কোত্থেকে পেল ও অনেক ভেবে-ভেবে বার করি একদিন ও এই টেবিলটাতে খেলে বেড়াচ্ছিল, আমি আর সীতা আমাদের বাবাদের গল্প করছিলাম। সেই থেকে পিক-আপ করেছে। বোঝ একবার, কী সাংঘাতিক বুদ্ধি!
ইতিমধ্যে তো অবনীর সেই প্রডিজি পাখি ছাড়া পেয়ে তার বাবার মাথায় চড়ে বসেছে। বাবা তাকে মাথায় নিয়েই ফ্রিজের দরজা খুলল। দেখি সেই বেদানা আর কাঠবাদামের কৌটোগুলো নিয়ে আসছে।
বুঝলি এই আমন্ড আর ডালিম—এই দুটোই ওর সবচেয়ে ফেভারিট।
যাচ্চলে! আমি মনে-মনে জিভ কাটি। দুপুরের একাকিত্ব কাটাতে পাখির দানা মেরে দিয়েছি?
তবে অবনীর মিঠুর যে কোনটা ফেভারিট নয়, বুঝলাম না। ছোট্ট একটা সোনালি কফি পটে তার জন্য চা এল, খেল, ফেলল, ছড়াল, তাতেও শানাল না, অবনীর কাপেও ঠোঁট ভিজিয়ে নিল তুরন্ত। বিস্কিটে ঠোকর মারতে লাগল। প্লেটে চুড়ো করে চিনি দিতে হল তাকে।
বুঝলি উদয়, এই পুঁচকেটাকে আর ম্যানার্স শেখাতে পারলাম না। অত্রি, জিষ্ণু এমনকি আমাদের একমাত্তর মেয়েটাও এত অসভ্য ছিল না। কারও সামনে বেসহবত হলে বাচ্চা বয়সে ওদের কত বকাঝকা করেছি। এটার বেলায় ফেল মেরে গেলাম।
আমি বলি, একটা পাখিকে পেট হিসেবে তুই কতকগুলো সাধারণ জিনিস শেখাতে পারিস, কিন্তু…
অবনী বলে উঠল, উদয় প্লিজ, মিঠুকে পাখি-পাখি পেটটেট বলিসনি, বিশেষত সীতার সামনে। ভীষণ দুঃখ পাবে। রেগে যেতেও পারে।
যা ব্বাবা! যতই ভালোবাসুক, পাখিকে পাখি বলতে পারব না?
সীতা এলে আর দেখতে হবে না। কাঁ কাঁ করে ডাকতে ডাকতে সীতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
আমি বলি, আমি একটু বেড়িয়ে-টেড়িয়ে আসি বাবা, তোমাদের মিঠুর তো। এখন আবার হিংসে হবে, আর ঠোক্কর খেতে আমি রাজি নই।
প্লিজ উদোয়, একটু আদর খেয়ে নিক, তারপর ওর ব্যবস্থা করছি, যেয়ো না।
মিঠুর চিৎকার আর ওলটপালট, সীতার মুখ ঠুকরোনো অর্থাৎ চুমু খাওয়ার বহর দেখবার মতো। অনেকটা সেই সার্কাসের টিয়ার খেলার মতো। কাঁধ থেকে কোলে লাফিয়ে পড়ছে, তারপরেই আমাকে চমকে দিয়ে ঝটপট করতে করতে উড়ে গিয়ে বসছে মাথায়। হাত থেকে ডালিমের দানা নিয়ে কুট কুট করে খাচ্ছে। গর্বে ভরতি মিঠুর বাবা-মার মুখ। ভাবটা কেমন দেখছিস? জীবনে কখনও এমনটা দেখেছিস আর?
যাই হোক, অবশেষে সীতা মিঠুর ব্যবস্থা করে, নিজেদের শোবারঘর ও লাউঞ্জের ভেতরে তাকে পুরে দিয়ে আসে। ওখানে নাকি মিঠু অনেকটা ওড়বার জায়গা পাবে। টয়লেটে জল ভরা টব আছে, সেখানে চান করতেও পারে। আলমারির মাথায় বসে থাকতে পারে আবার কার্পেটের ওপর বসে বসে ঝিমিয়ে নিতেও পারে।
রশমিকেও নাকি ওরা ঠিক ওইরকম নিজেদের হলে বন্ধ করে রেখে দিত। সেটা অবশ্য কোনো দুষ্টুমির শাস্তি। এক ঘন্টা-দু ঘন্টার জন্যে।
অবনী বলল, রশমি খুব দুষ্টু ছিল ঠিকই, কিন্তু জিষ্ণুর কাছে ও কিছুই নয়। জিষ্ণু অবিকল সেই আবোল-তাবোলের বাপরে কী ডানপিটে ছেলে!
দুজনেই হাসতে লাগল।
আমি বললুম, তা সেই সবচেয়ে ডানপিটেই তো সবচেয়ে আগে পোয মেনেছে শুনছি।
ওর কথা আর বলো না, সীতা বলল, হাইস্কুল পাস কোরবার পোরই কলেজে জয়েন করতে না করতেই একটা ব্ল্যাক মেয়ের সঙ্গে থাকতে লাগল।
অবনী বলল, এ হে হে, এসব কথা উদয়কে বলছ কেন? কী মনে করবে বলে তো?
সীতা বলল, চব্বিশ বছর বয়েসে এখানে এসেছি উদোয়, থার্টি ইয়ার্স প্রায় হতে চোলে, হামাদের ওয়েজ আমেরিকান হোয়ে গেছে, মোনে কিছু কোরো না। ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট।
আমি তাড়াতাড়ি ওদের আশ্বস্ত করি, আমি কিছুই মনে করিনি, আর মার্কিন সমাজ ও জীবনযাত্রার আদর্শ সম্পর্কে কিছু-কিঞ্চিৎ ধারণা তো আমাদেরও আছে রে বাবা!
সীতা বলল, ইভন দেন, উই ওয়্যার শকড। অ্যাট ফাস্ট। একটা আঠারো বছরের ছেলে তো আফটার অল!
তোমরা কিছু বলোনি? রাগারাগি করে এখানে লাভ হয় না জানি।
আরে জানব তবে তো বলব। অবনী বলে, জানানোর দরকার বলেই মনে করেনি। বিয়ে করলে জানাত। এখানেই জন্মকর্ম, এখানেই শিক্ষা, এদের মতোই অবিকল তো। এটা ওরা লুকোনোর বা বলবার মতো কিছু মনে করে না। তবে আমরা ঠিকই জানতে পেরেছিলাম। তারপর এসেছেও এখানে।
সীতা বলল, মোজা কি জানো উদোয়, মেয়েটা নিজে চাকরি করে পোড়াতে লাগল। দুটো বাচ্চা হয়ে গেল। তার নিজের কেরিয়ার বারোটা। তারপর জিষ্ণু কী বিহেভ করেছিল জানি না। দুটো বাচ্চা নিয়ে মেয়েটা, সোফিয়া, একজন ব্ল্যাককে বিয়ে কোরে চোলে গেল। জিষ্ণু কিছুদিন পোরেই একটা ট্রাভল এজেন্সি খুলল, একটা স্প্যানিশ মেয়েকে বিয়ে কোরলো। দুজনে মিলে বিজনেস ভালোই চালায়। একটা বাচ্চা।
থাকে অ্যারিজোনা স্টেটে বুঝলি উদয়, অবনীশ বলল, আসে বছরের একবার তো বটেই। নাতিটা বেড়ে হয়েছে। ওর মায়ের মতো। তবে মজা কি জানিস, সীতা কিন্তু মনে মনে সেই প্রথম দুটো নাতি-নাতনিকেই বেশি ভালোবাসে, সম্ভবত সোফিয়াকেও যদিও তারা আমাদের কারও সঙ্গেই যোগাযোগ রাখে না।
সীতা বলল, এগুলো একদোম বিশ্বাস কোরো না, বিয়ে হোক না হোক বাচ্চা দুটো তো আমাদেরই। বোলো? তাদের জন্য মন পুড়বে না? আর সোফি! হোতে পারে ব্ল্যাক। মেয়েটা প্রাণ দিয়ে জিষ্ণুকে তৈরি করে দিয়েছিল। তার স্যাক্রিফাইসটা হামি নিজে মেয়ে হরে কী করে ভুলতে পারি? উই হ্যাভ অ্যাকসেপ্টেড হার অ্যাজ আওয়ার ডটার-ইন-ল।
আমি কথা পালটাই। আবহাওয়া ভারী হয়ে উঠেছে। আমি ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে বুঝতে পারছি অবনীর পক্ষপাত বর্তমান পুত্রবধূর ওপর, সীতার সহানুভূতি পুত্রবান্ধবীটির ওপর। কেন? কোন সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্ব এখানে কাজ করেছে কে বলবে?
সীতাও বলে, তুমার ফেমিলির কোথা বলো উদোয়।
আমার ফ্যামিলি? সেই যথা পূর্বম তথা পরম। আমার বাবাকে ওরা চিনত খুব। তা বাবা গত হয়েছেন অনেকদিন। আমার ছাত্রজীবন শেষ হতে না হতে। ভাগ্যিস একটা চাকরি পেয়ে গিয়েছিলুম তাড়াতাড়ি, দিদিরও বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তাই সামলে নিতে পেরেছি।
মা বেচারি অনেক কষ্ট করেছেন ক-টা বছর। তারপর দিদির ননদ শকুন্তলাকে বিয়ে করেছি। বলা যায় একটা আধা-প্রেম, আধা-অ্যারেঞ্জড গোত্রের ব্যাপার। ছেলে রণো ছোটো কিন্তু আমার চেয়েও বড়ো এক এক সময়ে মনে হয়। মেয়ে রিনির ঠাকুমা মা-বাবার ওপর টান এমনই যে সে যাতায়াত অসুবিধে হলেও যাদবপুরে হস্টেলে থাকতে চায় না এখনও পর্যন্ত। কাঁকুড়গাছিতে একটা ছোটো বাড়ি করতে পেরেছি। জমি বাবারই কেনা ছিল। জামাইবাবু অনেক সাহায্য করেছেন বাড়িটা দাঁড় করাতে। মায়ের ত্যাগের কথা না-ই বললাম। শকুন্তলা মাকে অনেক আগে থেকেই চিনত, মাও ওকে। কে জানে সেই জন্যেই কিনা, বেশ মানিয়েই তো আছে। বিশেষত আমার মাতৃদেবী একটু মাই ডিয়ার গোছের আছেন। রিনি বলে গেছো মেয়ে। রণো বলে বড়ো-ছোটো মেয়ে। রিনি এখনও ঠাকুমার কাছেই শোয়। রিনির রণোর উভয়েরই পড়াশোনার বিপুল খরচ আমাকেই চালাতে হয়। শকুন্তলা অবশ্য শাড়ির ব্যাবসা করে কিছু রোজগারপাতি করে। তবে তার হ্যাপা অনেক। এখন এইসব খবরাখবরের মধ্যে কোনটা কতটা ওদের বলব। এই প্রগতিশীল, অত্যাধুনিক সমাজে থাকে। দেশে এই ত্রিশ একত্রিশ বছরে কবার গেছে হাতে গোনা যায়। ওদের অভ্যাস, ধ্যানধারণা, অভিজ্ঞতা, সুখদুঃখ সবই আমাদের থেকে একেবারে আলাদা। ছেলেমেয়ে যে আমায় দেড় মাসের কড়ারে আমেরিকা পাঠিয়েছে এ কথা কি ওদের বলবার? আমার ফাজিল বড়ো-ছোটো মেয়ের মা যে তাড়াতাড়ি না ফিরলে বাপের বাড়ি যাবার ভয় দেখিয়েছেন সে কথা বলতে গিয়ে যদি হাস্যকর প্রতিপন্ন হই?
ওদের মেয়ে রশমির মোটে উনিশ বছর বয়স। আমার রিনির চেয়েও দু-বছরের ছোটো। সেই মেয়ে স্কুলের পড়া শেষ করে এখন মাউন্টেনিয়ারিং করছে। আপাতত পূর্ব আফ্রিকায়। তার জন্য কোনো খরচখরচা করতে হয় না ওদের। গিফট দেয় অবশ্য। গিফট হিসেবে ডলার-ড্রাফটও দেয়। কিন্তু এই উনিশ বছরের কিশোরী পার্বতী মা-বাবার জন্মদিনে বিবাহবার্ষিকীতে কিছু-না-কিছু গিফট পাঠাতে ভোলে না। কোথা থেকে সে নিজের খরচ চালায়, কোথা থেকে আবার উপহারের ব্যবস্থা করে ভাবতে গিয়ে আমি মুগ্ধ, অভিভূত হয়ে থাকি। আমার মেয়েও অবশ্য আমাকে উপহার দেয়। মার্চ মাস থেকে তাড়া দেবে, বাবা আমার শ তিনেক টাকা বড্ড দরকার, দাও না।
শ তিনেক? অত কেন?
বেশি হল? আমি তো মিনিমানটাই চাইলাম।
এপ্রিলের পনেরো আমাদের বিয়ের তারিখে আমরা পতি-পত্নী একটি ফ্লাওয়ার ভাস, বা একটা-দুটো বিখ্যাত বই উপহার পাই। ওই তিনশো টাকা থেকে কেনা। মোড়কের বাহারি কাগজ, আর একগোছা ফুল রণোটাই নাকি যোগ করে। ও বলে, কাগজ আর ফুল বলে তুচ্ছ করো না বাবা, আই হেট টু বাই য়ু আ গিফট উইথ ইয়োর ওন মানি। ইটস রিডিক্লাস।
আমি বলি, তা তোর কি আজকাল নিজের রোজগার হয়েছে? ড্রাগ-পেডলার হয়েছিস না কি?
শকুন্তলা বলে, দেখো কোনো বন্ধুর কাছ থেকে ধার করেছে, পকেট মানি থেকে বাঁচিয়ে শোধ করবে। পাকামি না করলেই যেন নয়। মারব এক থাবড়া। তো এই আমার ছেলেমেয়ের আধুনিকতা। এখনও পর্যন্ত।
আর ওদের বড়ো ছেলে অত্রি? মাত্র আঠাশ বছর বয়সেই তার ট্যালেন্টের জোরে সে সিয়াটলের কোনো ইউনিভার্সিটির বায়োকেমিস্ট্রির হেড। বিয়ে করেছে নিজেরই মতো পণ্ডিত আর এক শ্রীমতীকে। সে আবার গ্রিক। অত্রি এবং তার গ্রিক স্ত্রী সারা পৃথিবী পরিভ্রমণ করে বেড়ায় গবেষণার দরকারে। বিভিন্ন সময়ে ওদের পাঠানো কার্ড ও ছবিগুলো দেখাল অবনী। ক্রিসমাস কার্ড, বার্থ ডে, ম্যারেজ অ্যানিভার্সরি, নিজেদের এবং মা-বাবার, নভেম্বরে থ্যাংকস-গিভিং-এর কার্ড, অসুখ করলে গেট ওয়েল কার্ড। অত্রি আর আদ্রিয়ানার কার্ড দিয়েই গোটা কয়েক অ্যালবাম হয়ে যায়।
রবিবারের সকালবেলা। এইবারে আমরা বেরোব। গত সপ্তাহান্তে দেখে এসেছি নিউ হ্যাম্পশায়ারে অপূর্ব উইনিপেসাকি লেক, বোটিং-ও হল। নামটা কী সুন্দর। এইসব রেড ইন্ডিয়ান নামে ভরতি মহাদেশটা। সাসকাচুয়ান, কেন্টাকি, কানেটিকাট, মিসিসিপি, মিসৌরি, ক্যানসাস, উইসকনসিন মিনেসোটা। দুদিন বেশি ছুটি নিয়েছিল ওরা। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হু হু করে পেরিয়ে, বস্টনের পাশে হার্ভার্ড থেকে পৌঁছে গেলাম নিউ ইংল্যান্ডের প্লিমাথ-এ। সেখানে আমেরিকায় প্রথম ব্রিটিশ পদার্পণের স্মৃতিসমূহ ঠিক তেমনই করে সাজানো আছে। আজ যাচ্ছি সোজা বাফেলো শহর। সেখানে থেকে নায়াগ্রায় মার্কিন দিকের চেহারাটা দেখা যায়।
গ্যারাজের দিকের দরজা দিয়ে আমরা বেরোই। গাড়িতে মালপত্র সব ভোলা হয়ে গেছে। আমি, সীতা বেরিয়ে এসেছি। শেষ ব্যক্তি বেরোবে অবনী। হঠাৎ ফরফর ফরফর শব্দ। একটা সবুজ ঝিলিক, তারপরেই সীতার আর্ত চিৎকার, মিটু! মিটু! মিটু! ব্লু-জিনস আর কুঁচি-দেওয়া হলুদ শার্ট পরে সীতা দৌড়াচ্ছে, ক্রমেই গতি বাড়ছে তার। অবনীর মুখে গভীর আতঙ্কের অভিব্যক্তি। আমি হতভম্ব।
দু-তিন দিনের সফরে গেলে ওরা মিঠুকে ওদের শোবার ঘরে বন্ধ করে রেখে যায়। ওই স্যুইটটা মিঠুর ভারি পছন্দ। ওখানে রাখলে নাকি ও মনে করে ওকে ভি.আই.পি ট্রিটমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। ঘরের মধ্যে ভারে ভারে ডালিম, কমলার কোয়া, বাদাম আরও কী সব ভিটামিন-মিশ্রিত বার্ড-ফিড রাখা থাকে, বাথটবে জল। যত খুশি চান করবে মিঠু। আর একটা ছোটো ভারী পাত্রে খাবার জল। এ ক-দিন ইচ্ছে করলে মিঠু তার বাবা-মার বিছানায়ও নৃত্য করতে পারে। এখন আজ ওরা দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছে, না টেনেছে ঠিকই কিন্তু ল্যাচ আলগা হয়ে গেছে, তারপর খুলে আধখোলা মতো হয়ে গেছে দরজা। ভগবান জানেন। মোট কথা মিঠু কোন ফাঁকে বেরিয়ে এসেছে। গ্যারাজের দরজা দিয়ে আনাগোনাগুলো লক্ষ করেছে এবং ফাঁক পেয়েই ফুড়ুৎ করে পালিয়েছে।
বাড়িটা ডানদিক দিয়ে বেড়ে হরিণের নালা পার হয়ে পিছনের জঙ্গলের দিকে যাই আমরা। সবুজে সবুজে সব বিরাট ওক, মেপল, বার্চ অ্যাশ জঙ্গল আঁধার করে দাঁড়িয়ে আছে।
অবনী বলল, কোন দিকে গেছে খেয়াল করেছ?
এদিকেই এদিকেই-কাতর উচ্চকিত স্বর সীতার।
মিটু, মিটু, মা ইজ হিয়ার, কাম ব্যাক, কাম ব্যাক মাই সুইট।–কম্পমান অক্লান্ত স্বরে ডেকে যেতে থাকে সে।
অবনী দৌড়ে বাড়ি ফিরে যায়, চিনি আর আঙুর নিয়ে আসে। কালো আঙুর মিঠুর বিশেষ প্রিয়। হাতে আঙুরের থোকা দোলাতে থাকে সে। সীতা হাত ভরতি চিনি নিয়ে ঊর্ধ্বমুখী।
মি–ঠু, লুক অ্যাট দ্য গ্রেপস, কাম ডাউন মিঠু।
মিঠু। মিঠু!
হঠাৎ দেখি সীতার দু চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে।
কাঁদছ কেন সীতা।–আমি ব্যস্ত হয়ে বলি, যদি ওই বন আর আকাশের স্বাদ ও পায় তত ভালোই তো, ওটাই কিন্তু এর আসল জায়গা, ওখান থেকে কখনও ফিরে আসে? বর্ন ফ্রি-র সেই সিংহটার কথা মনে করো।
হঠাৎ চোখ ভরতি জল নিয়ে পিছন ফিরে আমার বুকে দুম দুম করে কিল মারতে লাগল সীতা, হাউ ক্যান য়ু বি সো ক্রুয়েল, ওহ হাউ ক্যান য়ু বি সো ক্রুয়েল।
অবনী তাড়াতাড়ি এসে তাকে থামায়। বলে, ও ঠিক ফিরে আসবে, যাবে কোথায়? এমন কোরো না সীতা, ধৈর্য ধরো।
মি-ঠু—আবার ডাকে অবনী। তার কপালে ভাঁজ। গলার স্বরে মরিয়া রাগ।
অনেক উঁচুতে গাছের পাতার ঘন সবুজ থেকে একটা হালকা সবুজ বিন্দু হঠাৎ আলাদা হয়ে যায়। আমরা সবাই দেখতে পাই। কেমন গোঁত্তা খেয়ে খেয়ে উড়ছে। মিঠু। এক গাছ থেকে আর এক গাছে। সীতা হিস্টিরিক গলায় বলল, ও ভোয় পেরেছে। কখনও জোঙ্গল দেখেনি। অত উঁচুতে ও গেল কী করে? অবনী কিছু। করো, কিছু একটা করো প্লি-জ।
মুখের দুপাশে হাত রেখে তীব্র স্বরে শিস দিয়ে ওঠে অবনী। মিঠু ঝাঁপ খেয়ে নীচের ডালে নেমে আসে।
মিটু-উ-উ, মায়ের কোলে এসো… দু-হাত বাড়িয়ে বলে সীতা।
আর একটা এলোমেলো ঝাঁপ শূন্যে। মিঠু আরও নীচের ডালে এসে বসেছে।
হাত উঁচু করে আঙুর দোলায় অবনী। চিনিসুদ্ধ হাত অঞ্জলি করে ওপর দিকে তুলে ধরে সীতা। মুখে অনর্গল আদরের ডাক। গলা ভেঙে গেছে, মুখের চামড়ায় গভীর কষ্টের খাল, সীতা চিৎকার করে, মিটু, মি-টুস মাম কলস ডিয়ার, কাম ব্যাক টু মা, লুক হিয়ার, আই হ্যাভ সুগার ফর য়ু, মি-টু।
গ্যারাজের মাথায় এসে বসেছে মিঠু। ঢালু করোগেটের ওপর পায়ের কুড়মুড় খচমচ মতো শব্দ তুলে গুটগুট করে হেঁটে হেঁটে আসছে।
অবনী বলে, টেক কেয়ার বেবি। হাঁ, ঠিক হয়েছে হাঁটি হাঁটি পাপা, হাঁটি হাঁটি পা পা।
ঠোঁট বাড়িয়ে আঙুরের থোকা কামড়ে ঝুলে পড়ল মিঠু। অন্য হাত দিয়ে তাকে ধরে ফেলল অবনী।
লিভিংরুমের সোফাগুলোতে হাত-পা ছড়িয়ে এখন বসেছি তিনজনে। বাববাঃ। একখানা কাণ্ড হল বটে।
সীতা লজ্জিত, অনুতপ্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আয়্যাম স্যরি উদোয়। আই ওয়াজ নট ইন মাই সেনসেজ। প্লিজ।
আমি হাসি, ইটস অল রাইট। কিছু মনে করার প্রশ্নই নেই। আই আন্ডারস্ট্যান্ড। কিন্তু সীতা মনে করো যদি আবার একদিন এরকম হয়। হতেই পারে। বোঝাই যাচ্ছে ও সব সময়ে তক্কে তক্কে থাকে। ফাঁক পেলেই আবার পালাবে। আফটার অল ওর ওই ডানা দুটো তো ওড়বার জন্যেই, কবিত্ব করে বলতে গেলে আকাশের নীল ডাকে হারিয়ে যাবার জন্যে। যদি ওকে ভালোবাসো, ওর ছোট্ট জীবনের এই কৃতিত্বে, সার্থকতায় তোমরা খুশি হবে না?
ডোন্ট য়ু সি। সীতা ভয়ের গলায় বলে, আমরা তো ওর ডানা হেঁটে দিয়েছি। সামান্য একটু, এরকমই করতে হয় বুঝলে। ও বার্ড-ব্রিডারদের কাছে হ্যাচারিতে জন্মেছে, জোঙ্গল আকাশ এসোব ও জানে না, জেনেটিক্যালি হয় তো জানে, কিন্তু অ্যাকচুয়ালি জানে না। ও ভয় পাবে। হার্ট ফেল করবে। সাপখোপ কি কোনো শিকরে পাখিতে ওকে… বলতে বলতে শিউরে উঠলে সীতা। যেন ওকেই সাপখোপ কি শিকরে পাখি ধরেছে।
তখন বুঝলুম কেন অমন অস্বাভাবিক উড়ছিল মিঠু।
বললুম, তোমাদের মিঠু স্ত্রী না পুং জানি না। তবে ওর জীবনে সঙ্গীর প্রয়োজনও তো আছে। সে জন্যও কিন্তু ও পালাতে চাইবে। আত্মরক্ষা করতে পারুক আর না পারুক।
অবনী বলল, ওর মেট-এর চেষ্টা কি আর করিনি ভাবছিস। হি ইজ আ মেল, অনেক খুঁজেও ওর প্রজাতির ফিমেল পাইনি আমরা। অন্য প্যারট-টট দিয়ে চেষ্টা করে দেখেছি। তারা ওকে ঠুকরে শেষ করে দিতে চায়। তাই শেষ পর্যন্ত ও পাট চুকিয়ে দিতে হয়েছে।
মানে?
মানে আর কি! ক্যাসট্রেশন করিয়ে নিয়েছি।
ওইটুকু পাখি! তার…?
আমি বিস্ময়ে হাঁ হয়ে থাকি? মুখ দিয়ে কথা সরে না। হঠাৎ একটা কথা মনে হয়। এই জন্যেই, এই জন্যেই বোধহয় এ দেশের আকাশে পাখি ওড়ে না। জঙ্গলের গভীরে যারা রয়েছে তারা রয়ে গেছে। কিন্তু বাকি সব পাখিকেই বোধহয় ওরা সন্তানসঙ্গহীন জীবনে শূন্যতা পূরণের মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজনে পুষে ফেলেছে। সীতা-অবিনাশ দুই অভিমানী মা-বাবা এখন মিঠুকে নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত। একবার এ আদর করছে আর একবার ও আদর করছে। কত রকমের দানা বেরিয়েছে স্টক থেকে আখরোট, কাবুলিচানা, ঝুরি ভাজা। আমি তৃতীয় ব্যক্তি, আনমনে দেখছি। দেখতে-দেখতে একটা অদ্ভুত জিনিস ঘটল। সোফায়-বসা আমার চারপাশে যেন ডানা ঝাপটানোর ঝড়ো আওয়াজ। পাখিহীন আমেরিকা মহাদেশের আকাশে, শুধু আমেরিকাই বা কেন, অল্পবিস্তর সারা সভ্য দুনিয়ার আকাশে আকাশে আমি অসংখ্য পাখি উড়তে দেখলুম। বার্মুডা আর টি-শার্ট, তাপ্পি দেওয়া জিনস আর পোলো নেক, সাদা ঝোলা-হাতা আর নীল সুতো ঝোলা… মোটের ওপর সবাই একই ধরনের, একই রকম উদগ্রীব উড়ান। তা-এর তাপে ডিম ফেটে ফেটে বেরিয়ে আসছে ছোটো ছোটো পালকের বল, কচি কচি ডানা গজাচ্ছে আর সঙ্গে সঙ্গে উড়ে যাচ্ছে বেপরোয়া। আশ্চর্য! ওরা কি ভয় পাচ্ছে আমাদের এতদিনের এই সভ্যতা ভুলিয়ে-ভালিয়ে ওদের খোজা করে দেবে?
আত্মজন
বাড়িতে আদ্যিকালের দেয়ালঘড়িখানায় ট্যাং ট্যাট্যাং ট্যাং করতে করতে বেলা তিনটেও বাজল, ডাক্তারবাবুরাও সব একত্তরে যেন সাঁট করে রুগির ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। মুখগুলোয় সব থম ধরেছে। কেউ কারও পানে চাইতে পারছেন না সোজাসুজি। মোটা টাকার ফি গ্যাঁটস্থ হয়েছে, সারাদিন এলাহি খাওয়া দাওয়া, কিন্তু সুরাহা কিচ্ছুটি হল না। তা ছাড়াও, মানুষগুলির বিদ্যে-সিদ্যে সব যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। বড়োবাবুও সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসেছেন। শুধু মেজোবাবু এখনও ভেতরে। মুখময় খোঁচা খোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়ি, পালঙ্কের ইদিক-উদিক দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে ঘুরে ঘুরে মরছেন।
শহর থেকে গলা-কাটা-দাম দিয়ে আনা ডাক্তারগুলি সব যে যার গাড়ি করে হুস করে বেরিয়ে গেল। বাড়ির বদ্যি গুহ ডাক্তারই শুধু জালে আটকা পড়ে বাড়ি কাতলার মতো খাবি খাচ্ছেন। বড়োবাবু তাঁর কনুইয়ের কাছটা ক্যাঁক করে ধরে আছেন। কোনোমতেই ছাড়ছেন না। নজর মাটির পানে রেখে গুহ বদ্যি মাথাটা নাড়লেন, ডাইনে-বাঁয়ে। বড়োবাবু বললেন, সে কি? কথার ভাবে মনে হল অত বড়ো মানুষটি এক্ষুনি ভ্যাঁ করে ফেলবেন। গুহ নীচু গলায় বললেন, ব্যাপার তো ভূতুড়ে কিনা বড়োবাবু! রক্তে চিনি নেইকো, হার্ট প্রেশার সব ঠিক ঠাক, ইনফেকশন নেই। আঘাত-টাঘাত কিছু না। খামোখা মানুষটার এমনিধারা অবস্থা যাকে কিনা আমাদের শাস্তরে বলে কোমা। আপনি তো দেখতেই পেলেন বড়োবাবু ওনারা সব বলছেন হাসপাতালে নিলেও সুবিধে বিশেষ কিছু হবে বলে মনে হয় না। আর, হাসপাতালের ব্যবস্থা তো এখানেই সব করেছি—গ্যাসকে গ্যাস! স্যালাইন কে স্যালাইন। চব্বিশ ঘন্টা নার্স মোতায়েন। ত্রুটি তো কিচ্ছুটি রাখেননি বড়োবাবু!
গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। মেজোমণিকে শহরের বড়ো ডাক্তারেও। জবাব দিয়ে গেছে। কবরেজ, হাকিম, হোমিওপ্যাথিক, জড়িবুটি সবরকমই হচ্ছিল। এখন শেষমেশ ভারী শহরের ভারী ডাক্তার, বুকের ছবি, পেটের ছবি, হ্যান একজামিন, ত্যান একজামিন, এক কাঁড়ি করে টাকা খর্চা, তা তেনারাও সব যে যার মতো মাথা নেড়ে নেড়ে জবাব দিয়ে গেলেন।
ছোটো গ্রাম। গঞ্জর কাছেই। টাউন-শহরও দূর-দূরান্তে। তা সেই গাঁয়ের যে যেখানে আছে আজ এতোগুলিন দিন একবার করে অন্তত বড়োবাড়িতে হাজরে দিয়ে আসছে। জমিদারবাড়ি নয়, হাকিম না হুকুম না, তবু বড়োবাড়ি বড়োবাড়িই। গাঁয়ের ছেলে ছোকরার, ঝি-বউয়ের বিয়ে-বউভাতে ওই বড়োবাড়ির উঠোনেই শামিয়ানা পড়ে, পালাগান, যাত্রা, অষ্টপ্রহর সব ওইখানেই।
কিছুর মধ্যে কিছু না বড়োবাড়ির মেজোমণি অজ্ঞান হয়ে আছেন আজ মাস ফুরুতে চলল। অমন লম্বা চওড়া জগদ্ধাত্রীর মতো শরীরটি ছোট্ট হয়ে বিছানার সঙ্গে মিশে আছে। সোনাহেন বর্ণ কালিঢালা। চোখমুখ সব যেন গর্তে ঢুকে আছে।
ঘটনাটা যে রোববার ঘটল, তখন দুপুরবেলা। সিরাজুলের অন্দরে বসা। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণখানা সে ইতিমধ্যেই যেখানে পেরেছে চাউর করে ফেলেছে। বাড়িটিতে মানুষ তো আর কম নয়! শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে যেটের বাছা এই এতগুলি। সব যে যার তালে। বড়োমণি পুজোর ঘরে। বেরোতেই কোন না একটা দুটো বেজে যাবে। তিরিশ রকম ঠাকুর-দেবতাকে ফুল-জল দেওয়া তো আর চাট্টিখানি কথা নয়! বড়ো ভক্তিমানী মানুষটি বড়োমণি। এতটি বেলা পর্যন্ত সুষ্ঠু এক ঘটি চা খেয়ে ঠাকুর দেবতাদের সব জলপান দিচ্ছেন, ছোটোমণি তখন টেবিল ঢাকায় ফুল কাটছেন ফুটফুট। সূচ ঢুকছে, সূচ বেরুচ্ছে, আর কত রঙবেরঙের কারুকাজ—দোপাটি ফুল, বেড়ালছানা, শিবলিঙ্গ জড়িয়ে কালসাপ—সব সিলসিল সিলসিল করতে করতে ঢাকার ওপর আঁকা হয়ে যাচ্ছে। ছোটোবাবু তখন আড্ডাঘরে, তাস পিটছেন, ইয়ার-বন্ধুদের নিয়ে গুলতান খুব জমেছে। ওদিকে বড়োবাবুতে মেজোবাবুতে তক্কো চলেছে। ইনি বলছেন সাংখ্য হলেন গিয়ে আদি সংখ্যার আখ্যান-বাখ্যান, সাংখই সবচেয়ে বড়ো, উনি বলছেন, বেদান্ত হচ্ছেন সব বিদ্যের অন্ত বাপধন! কে বড়ো কে ছোটো এখন আপনি বোঝ।
পেল্লাই ভাতের হাঁড়িখানি নামিয়ে মেজোমণি বললেন, আর একটু সবুর কর সিরাজুলের, বেলাবেলি দুধটুকু জ্বাল দিয়ে নিই। একরাশ কচুর ডাঁটা কাটতে আমার সৈরভীর দুধটুকু জ্বাল দেওয়া হয়নিকো এখনও।
বসতেই তো এয়েছি তোমার ঠেয়ে, সিরাজুলের গাছের আম-জাম কোঁচড়ে নিয়ে অপেক্ষা করে। দুধ জ্বাল দিয়ে, উনুনে রাশ রাশ কয়লা ঢাললেন মেজোমণি। উনুন দুখানা কী! রাই খাই না রাবণ খাই। কয়লা দিয়ে-টিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে দাওয়ায় এসে বসলেন মেজোমণি। মেজোমণিও বসলেন সিরাজুলের মাও নিস্পলকে দেখতে থাকল। দুগগা ঠাকুরের মতো এই টানা টানা চোখ, ভুরু কান ছুঁয়েছে, এই থাক দোয়া দোয়া চুল! এতক্ষণ হাতখোঁপা করে বেঁধে রেখেছিলেন রসুইঘরে ছিলেন বলে, এখন খুলে দিতেই শাঁত করে পিঠময় ছড়িয়ে দাওয়ার ওপর বিলি কাটতে লাগল। কী রাশ! বাববাঃ! ডিবিসি বাঁধের বন্যের মতন।
হাত দিয়ে চুলের গোড়ার কাছটি খেলাতে খেলাতে মেজোমণি বললেন, আম ক-খানি তুই নিয়ে যা দিকিনি। তোর সিরাজুল খাবে। বচ্ছরকার জিনিস। একটি তো মোটে তোর গাছ, তা থেকে বিকোবি, বিলোবি, তবে আর খাবি কি বাছা। চাল তোর থলিতে আমি ভরে দিয়েছি। দেখিস কাগজের ঠোঙায় মুড়ে আলাদা করে একটুখানি কামিনী দিলুম, পায়েস করে মায়ে-পোয়ে খাস।
বেশ গল্প করছিল সিরাজুলের গেজেটবুড়ি, গাঁয়ের গল্প, গঞ্জর গপ্প, টাউন শহর থেকে যা-যা তথ্য-সংবাদ কুড়িয়ে বাড়িয়ে আনতে পেরেছে তা-ও। গল্প করছিল আর ভেবে মরছিল, এই মানুষের আবার অংখার! লোকে দেখেই বা কি আর বলেই বা কি! পাড়া বেড়াবে কি মানুষটা, মরবার সময়টুকু থাকলে তো!
হঠাৎ মেজোমণি কেমন অস্থির হয়ে বললেন, মা, শরীরটা আমার কেমন আনচান করছে, আমি একটুক ঘরে যাই।
যেতে যেতেই মেজোমণি টলতে লাগলেন, সিরাজুলের না ধরলে বোধ করি পড়েই যেতেন। পালঙ্কে কোনোমতে কাত করে দিয়ে সিরাজুলের অন্দরের অন্য দিকে ছুটল, ও বড়োমণি গো, ও ছোটোমণি গো দেখে যাও তোমাদের মেজোমণি কেমন করতেছে। বড়োমণি ঠাকুরঘরে, শুনতে পেল না। ছোটোমণি সিলোতে সিলোতে সুতোটুকু দাঁত দিয়ে কাটছিল, তা দাঁতের সুতো দাঁতেই রয়ে গেল, ছোটোমণি দৌড়ে এসে বললে—মেজদি-ই-ই। আর মেজদি; মেজদি তখন ঘোরে কি বেঘোরে।
বড়োবাবু এল ধমধম করে, মেজোবাবু এল কাছা কোঁচা সামলাতে সামলাতে, ছোটোবাবু এল বাঁটা তাস কটা হাতে ধরে, শেষকালে গুহবদ্যি এল তার চামড়ার থসথসে ব্যাগটি নিয়ে, গলায় ইস্টেথো ঝুলিয়ে। ক্রমে গাঁ গঞ্জের মানুষগুলি আড়ালে-আবডালে উঁকিঝুঁকি মারতে মারতে বড়োবাড়ির পেল্লাই বার-উঠোনে, ভেতরবাড়ির দরদালানে, দোলমঞ্চের ফাটা ফোঁটা থামগুলির আশেপাশে ভেঙে পড়ল। কী হয়েছে গো মেজোমণির? কী হল হঠাৎ মেজোমণির? আগে তো কখনও কিছু শুনিনিকো বাতিকের ব্যামো আছে বলে? কী হয়েছে না কী হয়েছে! সেই যে মেজোমণি চোখ বুজেছেন আজ নিয়ে পুরো সাতাশটি দিন কাবার হয়ে গেল, সে-মানুষের আর চোখ মেলবার নামটি নেই।
জমিদারি কবেই উঠে গেছে। তারও আগে থেকে গেছে বড়োবাড়ির ঝাড়বাতি, বোলবোলাও, লোকলশকর। বলতে লাগে না, পাঁচিলের গায়ে বড়ো বড়ো বট অশ্বথ ডুমুরের বাড়বাড়ন্ত দেখলে কথাটি আপনি বোঝে যে জন বুঝদার। যে ক বিঘে ধানজমি, পুকুর, বাগান, গোধন আছে, তল্লাটের সব মানুষ জানে তা দিয়ে বড়োবাড়ির জলখাবার টুকুনিও হয় কি না হয়। বড়োবাবু দেবভক্ত সাত্ত্বিক মানুষ, জীবনে কখনও রোজগায়ের টাকা ছুঁয়ে দেখেননি। ভাত পাতে তেতো থেকে মিষ্টান্ন অব্দি কুটি কুটি সবরকম না পেলে রোচে না। ক্ষীর কদূর ঘন হল ঢালা-উপুড় করে দেখতে হয় রোজ। কোঁচা লুটুবে একহাত। ঝাড়া বাহান্ন ইঞ্চি, কলকাঁপাড়ের দিশি কাপড় নিবারণের কুঁচিয়ে দেওয়া নইলে বড়োবাবু পরেন না। মেজোকর্তার তক্কো বাতিক। যেখানেই চাকরি করতে যান তক্কো করে সেসব খুইয়ে-টুইয়ে দুদিন পরেই বাড়ি এসে বসেন। আপিসে লোক রাখে কাজের জন্যে, খামোখা তক্কো করলে তারা শুনবে কেন বাপু? ছোট কত্তার অতসব ভাববার চিন্তোবার সময় নেই। ছেলেবেলা থেকেই নানান শখ। তাসের শখ, যাত্রা-থিয়েটারের শখ, মেডেলের শখ। কিছুর মধ্যে কিছু না ছোটো কত্তা হঠাৎ মেডেল হেঁকে বসেন। তালদিঘি, পাড়ইপুর, কন্নাট এই তিনখানা গ্রাম যে সবচেয়ে আগে বড়ো বেড় দিয়ে আসতে পারবে সে সোনার মেডেল পাবে। ছোটো কত্তার মুখ থেকে কথা বেরুনো আর রামচন্দ্রের ধনুক থেকে তির বেরুনো মোটের ওপর একই কথা। ওরে এই বাজারে সোনার মেডেল কোথায় পাব রে? পাত দিয়ে মুড়ে দিতে হলেও হাজার দু-হাজারের ধাক্কা। ওরে অমন হাঁকা হাঁকলি কেন? আর কেন। ছোটো কত্তা মাথায় নতুন গামছা চাপিয়ে গোঁজ হয়ে বসে থাকে। ভাত খাবে না, ঘুমোবে না, কথা কও তার জবাব দেবে না। চোখের জলে নাকের জলে হয়ে সদর-অন্দর করতে করতে অবশেষে ছোটোমণি রসুইঘরে গিয়ে দড়াম করে আছড়ায়, আ মেজদি, কী হবে গো, মানুষটা যে শেষ পর্যন্ত আত্মঘাতী হতে চলেছে।
মেজোমণি হেসে বলে, আচ্ছা সে আমি দেখছিখন। মেজোমণি দেখছি বলল তো হিল্লে হয়ে গেল। আর ভাবনা নেই, চিন্তা নেই। এখন যে যার ঘরে বসে শিবের মাথায় বিশ্ব-চন্দনই দাও, কি কাঁথাই সিলোও, তাসই পেটো কি বিদ্যের জাহাজ ভাসিয়ে তক্কাতক্কিই করো। যা করো বাপু নিশ্চিন্দে করো গে। মেজোমণি বলে দিয়েছে, সে আমি দেখছিখন।
বড়োবাড়ির এই হল গিয়ে বৃত্তান্ত। ননদিনিরা আসেন, যান। শহর-বাজারের মস্ত মস্ত সব জামাই। গো-গাড়ি, সাইকেল রিকশা, কি জগঝম্প মটর গাড়ির ভেঁপু বাজাতে বাজাতে এসে পড়েন। তখন বড়োবাড়িতে যেন রসুনচৌকি বসে। জামাই শালা ভাজ ননদাই নিয়ে সে বড়ো আদিখ্যেতার রোশনাই। বড়োবউয়ের ঘরে বসে হাত পা ছড়িয়ে গালগল্প করতে করতে বড়ো ননদ বলেন, পানে বেশ করে কেয়ার খয়ের দিয়ে সেজো গো মেজোবউ। মেজমণি বলে, আচ্ছা!
মেজোননদ বলে, ছেলে দুটো আমার কেন যে অমন খ্যাংরা কাঠির জ্ঞাত গোত্তর বুঝি না ভাই মেজোবউদি।
মেজোমণি বলে, ওষুধ আছে। মেজদি তুমি ঘুম যাও।
মেজদি গিয়ে ছোটোমণির ঘরে এ কেলেচ্ছা ও কেলেচ্ছা করতে করতে ঘুমিয়ে যায়।
সেজোননদ বলে, তোমার ননদাই বলছে কষে জলসা বসাও গিয়ে একদিন গাঁয়ে। গাইয়ে-বাজিয়ে বাজাবার দায় তাঁর, রাখবার দায় তোমার। উনি সারারাত ঠায় তবলায় বসে থাকবেন।
মেজোমণি বলে, বেশ তো।
ছোটো ননদ বলে, পুজোর কাপড়-চোপড়গুলি দেখে শুনে নাও গো বউদিরা। ফুল কাটাটি ছোটো বউর, দাঁত দেওয়া মেট্রোপাড়খানা বড়ো বউর, ছেয়ে-রঙটি নয় মেজো বউদি নিও।
নিজে নিজেই উলটেপালটে দেখে ননদ তেমন সরেস হল না এটি। না-ই হোক। অনেক আছে মেজোর। অনেক, অনেক।
ছেলে-পিলেরা সারাটা দিন মেজোমণির পায়ে বাজছে। মেজোমণি না খাওয়ালে ভাতের পাত শুধু ঠোকরাবে। মেজোমণি রূপকথা না বললে—দুপুর রাত পর্যন্ত চোখ সব টেনে টেনে খুলে রাখবে, বলবে, ঘুম আমাদের পায়নি গো। ঘুম পায় না। এমনি বজ্জাত সব।
ছোটো কত্তার ছেলের মুখে-ভাত হবে। কত্তারা সব মেজোর ঘরে শলা নিতে গেছেন। কোথা থেকে দই আসবে? মেজোমণি বললেন, অনন্ত ঘোষেরটাই ভালো। কোন পুকুরের মাছ উঠবে? মেজোমণি বললেন, কেন? তেলি পুকুরের! থই থই করছে এখন রুই কাতলায়! নেমন্তন্নের লিস্টি মেলাও, গুষ্টি জ্ঞাতিবর্গের কেউ যেন আবার বাদ না যায়। তদারক করো, তদবির করো।
মেজোমণি শশব্যস্তে বলেন, বড়দি, তোমার পুজো হয়েচে তো ভাতের হাঁড়িটা একটু নামিয়ো, নবাই এয়েচে, মাছের কথাটা ঠিকঠাক করে আসি গে।
বড়োমণি চোখ কপালে তুলে বলেন, এই সেদিন যে বুকের ব্যামো ধরা পড়ল রে মেজো, ভুলে গেলি? ওমা! আমি যাব কোথা।
মেজোমণি বলেন, কী সবেনাশ, তাই তো! ছোটো কোথায় গেলি? ছোটোকে ডাকো, নবাই বড্ড ব্যস্ত হচ্ছে।
ছোটো ফিসফিস করে বলে, খোকার আমার ঘুমটা সবে ধরেছে গো মেজদি। চাঁদের কপালে চাঁদ আহা! নইলে তোমার ভাতের হাঁড়ি কেন গোটা হেঁসেলখানাই নামিয়ে দিয়ে আসতুম গিয়ে।
গভীর রাত্তিরে সব ঘুমিয়ে-জুমিয়ে পড়লে মেজোকত্তা আড়ে আড়ে দেখে মেজোমণি গদির তলা থেকে চাবি বার করল, ঘরের কোণে আঁধার বরন সিন্দুকের চাবি ঘোরাল ঝনাৎ করে, সিন্দুকের ভেতর রুমঝুম, টাকায় মোহরে গাঁদি লেগেছে, সব মেজোমণির ইস্ত্রীধন। তা থেকে মেজোমণি সংসারের সার খরচ-খর্চা যেটুকু যা দরকার, অন্নপ্রাশনের মোচ্ছবের টাকা গুনে গেঁথে সব তুলে নিল। মেজোকত্তা পাশ ফিরে নিশ্চিন্দে ঘুম গেল।
এইভাবে বড়োবাড়ির বড়ো সংসার—তার দৈনন্দিন, তার পালপার্বণ, তার মোচ্ছব সব চলে। সেই মেজোমণির আজ সাতাশটা দিন জ্ঞান নেই, ঘোরের মধ্যে পড়ে। চলে?
কী করবে! বড়োকত্তা গোবিন্দ বসাক গদিওয়ালার কাছে কর্জ করে আসেন। মেজো বউ উঠলে পরে শোধা যাবে। মেজোকত্তা গদিটদি হাতড়ে চাবিটাবি কই কিছু পায় না। সিন্দুকের ডালা যেমন ভারী হয়ে বসে থাকে তেমনি। দেয়ালের তাক হাতড়ে আলমারির খোপ হাতড়ে অবিশ্যি টাকাকড়ির পুঁজি মন্দ মেলে না। মেজোকত্তা সেইগুলি দিয়ে বড়োদাদার সঙ্গে শলা করে বড়ো শহর থেকে ভারী ডাক্তার আনায়। গোটা সংসারের মুখ শুকিয়ে এতটুকু। ছেলে-পিলেগুলি সময়ে আহার না পেয়ে খিদেয় কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ে, রসুইঘর ছমছম করছে, কোনোমতে দুটি ভাতে-ভাত নামিয়ে বড়োমণি ছোটোমণি এ-ওর মুখে চায়। কী হবে গো? কী হবে? কত্তাদের মুখে খাবার রুচছে না। বড়ো মেজোর তো হুঁশই নেই। এদিকে তিন তিরিক্ষে তেত্রিশ রকম পরীক্ষার পর বড়ো শহরের ভারী ডাক্তার কিনা বড়ো আশায় ছাই দিয়ে জবাব দিয়ে গেল?
তে-তল্লাটে মেজোমণির বাপের বাড়ির কেউ নেই। খবর দেবে কাকে? একটি মাত্তর মেয়েকে টাকার পুঁটুলি সুদ্ধ শ্বশুরঘর সই করে দিয়ে বাপ-মা চোখ বুজে নিশ্চিন্দি হয়েছেন। ননদিনিরা সব আসেন। চোখে আঁচল দিয়ে বড়োর ঘরে, ছোটোর ঘরে থানা দিয়ে বসে থাকেন। যদি কোনো সুখবর হয়। তা বসে থাকাই সার হয়। মন কারুর ভালো নেইকো। মেজোকত্তা একবার বলেছিল শহরের নার্সিংহোমে নিলে কি হয়? বড়োকত্তা জবাব দেন, বড়োবাড়ির ইজ্জতটুকুও তালে বড়ো শহরে রেখে এসো গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে। ছোটোকত্তা জবাব দেয়, তা ছাড়া ঠাঁই নাড়া করতে তো ডাক্তার মানাই করে গেল মেজদা, কান পেতে শোননিকো? মেজোকত্তা কাঁচুমাচু মুখে সরে যায়। আঁদাড়েপাঁদাড়ে ঘোরে, ফকিরদরবেশ, সাধুসন্ত কেউ যদি কিছু সুলুকসন্ধান দিতে পারে। আশা ছাড়তে পারছে কই?
এমন দিনে ভোর রাতে স্বপন দেখে উঠে বসল মেজোকত্তা। ঘুমের ঘোরেই জড়িত গলায় বলল, দাদা, সন্নিসি ঠাকুর এয়েছেন, দোতলায় দাঁড়িয়ে। বড়োকত্তা কোমরে লুঙ্গি কষতে কষতে আসছিলেন, দোরগোড়া থেকে বললেন, আমিও তাই বলছিলুম।
ওদিক থেকে দৌড়োত দৌড়োতে ছোটোকত্তা এসে বলল, শেষ রাতে মাঠ সারতে গিয়ে দেখি পেল্লায় এক চিমটেধারী ব্রহ্মচারী দাদা, ওই যে দোলতলায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
সারা বাড়ি দেখতে দেখতে জেগে উঠল। বড়োমণি যে বড়োমণি ধূলিশয্যায় ছিলেন, বুকে বড়ো ব্যথা মা। সারা রাত জপ করেছেন মেজোমণির জন্যে, এখনও কড়োজালির মধ্যে আঙল নড়চে, উঠে বসে আঁচল সামলে মুখে চোখে জল দিলেন। ছোটোমণি ঘুম ভেঙে খুঁক খুঁক করে কাঁদছিলেন—চোখ মুছে বাইরে এলেন। কপাট খুলে ওঁরাও সব দাঁড়িয়ে গেছেন—ননদিনি, ননদাই। ছেলেপিলেগুলি দলবদ্ধ হয়ে গোঁজ দাঁড়িয়ে সন্নিসিঠাকুর দেখছে।
দোতলায় প্রায় কার্নিশ সমান উঁচু এক পাহাড়ের মতো সন্ন্যাসী। জটাজুট গোড়ালি ঢেকে লুটুচ্ছে একেবারে। গোঁফসুদু দাঁড়ি বুক অব্দি নেমে পড়েছে। হাতে ইয়া কমণ্ডলু, চিমটে। কপালে ত্রিপুণ্ড্রক, গলায় বড়ো বড়ো রুদ্রাক্ষের মালা, একটার পর একটা কুঁড়ির কাছে দুলছে। ভস্মলিপ্ত। দারুণ, করুণ সুন্দর, ভরাট ভরসা-জাগানো মুখখানি।
সন্ন্যাসীর পায়ের তলায় সব এক-একখানা কাটা মাছের মতো শুয়ে পড়লেন। বড়ো, মেজো, ছোটোকর্তা, বড়োমণি, ছোটোমণি, ননদিনিরা চারজনা। তিনটি ননদাই, একজন এখনও এসে উঠতে পারেননি। ছেলেরা সব খাড়া দাঁড়িয়েছিল। সর্দার ছেলেটি যেমনি বড়োদের দেখাদেখি উপুড় হল বাকি ছেলেগুলিও অমনি তার দেখাদেখি সব মাজা ঘটিবাটির মতন উপুড় হয়ে পড়ল।
দয়া করো বাবা।
রক্ষা করো।
বিপদভঞ্জন মধুসূদন, রাখো ঠাকুর রাখো।
শেষরাত্তিরে ঝিমঝিম করে আঁধার বৃষ্টি হচ্ছে, জনপ্রাণীর সাড়া নেই, শব্দগুলি ভারী-ভরতি হয়ে যেন রাতের চাতালে বিড়ে পেতে সব মাটির কলশ, পেতলের কলশ যে যার ঠাঁই বসে গেল। জল চলকাতে লাগল বেশ কিছুক্ষণ। গমগম করছে শেষ রাত্তিরের বড়োবাড়ি মেজোবউটির জন্য প্রার্থনায়, দয়া করো বাবা, রক্ষা করো, বিপদভঞ্জন মধুসূদন হে, রাখো ঠাকুর, রাখো।
রেশটুকু যেন ধূপের ধোঁয়া, মিলিয়ে গেল ক্রমে। সন্নিসি বললেন, কীসের দয়া? কার রক্ষা? কাকে রাখবেন, ঠাকুর?
গলা নয়কো মৃদঙ্গ। ভাষা নয়কো সুর।
মেজোমণির ঘরে দীপ জ্বলছে, সেদিকে তাকিয়ে সন্নিসি বললেন, শিখাঁটি ক্ষীণ। কিন্তু আলোটি তো দেখছি দিব্যি পরিষ্কার। তোরা এতগুলি প্রাণী তার জন্যে আহার নিদ্রা ছেড়েচিস আর আলোটি নিভে যাবে? তাও কী হয়? আধারখানি রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করো গে যাও বাছারা। আর হোমের জোগাড় দেখো গে। শুদ্ধ কাপড় অত চাই না মা। শুদ্ধ মনে করো, এখুনি। মহাপ্রাণী কী বলেন, দেখছি।
ভাণ্ডার থেকে মাসের জমা গব্যঘৃত বার করে দিলেন বড়োমণি। চন্দন কাঠ নিয়ে এলেন ছোটোকত্তা, দিঘির মাটি নতুন সরায় করে এনে হাজির করলেন। মেজোকর্তা। ছেলেরা সব নদীর পাড় থেকে হোমের বালি বের করল। বড়কর্তা দোতলায় গিয়ে আসন করে বসলেন, দেব-দ্বিজে শ্রদ্ধা ভক্তি কত্তার। যজ্ঞস্থলে নাম করবেন। সন্নিসি বললেন, আর কিছু চাই না। কাউকে চাই না। নির্জন ঘরে একলা হোম করব বাবারা। না হলে আদেশ পাওয়া শক্ত।
তা—তাই হল। ঠাকুরঘরে ঠাঁই করে দেওয়া হল। ঘরের দরজায় কড়া পাহারা, বন্ধ ঘরে তিন প্রহর নির্জনে হোম করলেন সন্ন্যাসী। দরজার ফাঁকটুকু দিয়ে সারাটা সকাল হু হু করে চন্দনের গন্ধ, গব্যঘৃতের গন্ধ। দুগ্ধ, মধু … সন্ন্যাসী হোম করছেন। হোম করছেন। গন্ধের সঙ্গে মিলেমিশে শব্দ আসছে—আহুতি দেবার চড়বড় শব্দ, অং বং মন্ত্র পড়ার শব্দ। তারপর সব চুপ। সারা দুপুর, সারা বিকেল নিঃশব্দ রইল হোমঘর, ঠাকুরঘর।
২.
সন্ধ্যা আসন্ন হইলে সশব্দে দরজা খুলিয়া গেল। কবাটবক্ষ বিরাট সন্ন্যাসী হোমগৃহের চৌকাঠে দাঁড়াইয়া উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করিলেন, উপায় মিলিয়াছে। বধূমাতার প্রিয়জন যে স্থানে এতগুলি, সে স্থানে তাঁহার প্রাণরক্ষা এমন কঠিন কর্ম কিছু না। স্নানাহার সম্পন্ন করিয়া, পবিত্র ও পরিতুষ্ট হইয়া একে একে এ ঘরে আইস, রক্ষার উপায় আমি করিয়া দিই।
প্রথম প্রবেশ করিলেন বড়োবাবু। গরদের ধূতি ও পিরান পরনে, দিনান্তে মার্জনার ফলে গৌরবর্ণ মুখমণ্ডল রক্তাভ, যুক্ত করে জোড়াসনে বসিয়া বড়োবাবু ভক্তিভরে বলিলেন, আদেশ করুন প্রভু।
সন্ন্যাসী বলিলেন, বৎস বধূমাতার রক্ষার একমাত্র উপায় কিঞ্চিৎ প্রতিদান। দান সাতিশয় পুণ্যকর্ম ইহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু সংসারী ব্যক্তি বিশেষত রমণীর অন্তরাত্মার গঠন বড়ো বিচিত্র। ডান হস্ত দান করিল, বামহস্ত জানিতে পারিল না এই শাস্ত্রোক্ত বিধান উহাদের ক্ষেত্রে খাটে না। উহারা স্বীকৃতি চায়। অবিশ্রান্ত দান করিয়া করিয়া মাতার মহাপ্রাণী বড়ো ক্লান্ত দেখিতেছি। অঞ্জলি পাতিয়া করুণ নয়নে চাহিয়া আছেন। আমি যাহা বলি তাহা যদি উহাকে সমর্পণ করিতে পারো তো রক্ষা হইবে, অন্যথায় …
বড়োকর্তা বলিলেন, আমি ত্রিদিবশরণ দেবশর্মা বলিতেছি প্রভু। ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী ব্যতীত জল পান করি না, ত্রিলোকে এমন দেবদেবী নাই যিনি আমার হস্তের তুলসী-চন্দন নিত্যসেবা গ্রহণ করেন না। মোক্ষ ব্যতীত আমার নিজের জন্য দ্বিতীয় প্রার্থনা নাই। আদেশ করিতে আজ্ঞা হয়, মেজোবধূমাতাকে আমার অদেয় কিছুই নাই।
সন্ন্যাসী শান্তকণ্ঠে বলিলেন, বাস। এই অহংকারটুকু ওই নির্বাপিত হোমকুণ্ডে আহুতি দিয়া চলিয়া যাও। দেবতায় তোমার ভক্তির অহংকার। সাত্ত্বিক জীবনযাপনের অহংকার। এইমাত্র। ভাবিয়া-চিন্তিয়া দিযে, ঘর মন্ত্রসিদ্ধ। দিলাম বলিলেই দেওয়া হইবে না। দান পূর্ণ হইলে হোমকুণ্ড আবার জ্বলিবে।
বলিয়া সন্ন্যাসী একমনে মন্ত্র পড়িতে লাগিলেন। দণ্ডকাল পরে চক্ষু তুলিয়া দেখিলেন সম্মুখের আসন শূন্য। হোমকুণ্ড জ্বলে নাই।
ধীরে ধীরে প্রবেশ করিলেন বড়োব। লাল পাড় শুদ্ধ বস্ত্রের প্রান্ত কণ্ঠে জড়াইয়া অবগুণ্ঠনবতী ভক্তি ভরে প্রণাম করিলে সন্ন্যাসী বলিলেন, অধিক সময় লইব না মা, দক্ষিণ হস্তে কোশা হইতে বিল্বপত্র তুলিয়া বাম হস্তের মুষ্টিতে স্থাপন করো। ঈর্ষার বিষে মেজোবধূর দেহ নীলবর্ণ হইয়াছে। কেহ জানিবে না মা, তোমার এই গোপন ঈর্ষাটুকু হোমকুণ্ডে ফেলিয়া দিয়া চলিয়া যাও, তাহা হইলেই উনি আরাম হইবেন। বিপত্রে ঈর্ষা আকর্ষণ করো। দেখিও মা, মন্ত্রসিদ্ধ ঘর, দিব বলিলেই দেওয়া না-ও হইতে পারে।
সন্ন্যাসী জানিতেও পারিলেন না, কখন বড়োবধূ নির্গত হইয়া গিয়াছেন। আসনে মেজোকর্তা, যজ্ঞকুণ্ডে সামান্যতম ধূমও আর নেই। মেজোকর্তা গদগদ কণ্ঠে বলিলেন, আদেশ করুন প্রভো।
সন্ন্যাসী মৃদুস্বরে কহিলেন, দারাপুত্র পরিবারসম্পন্ন গৃহস্থ মানুষের কোনো দায়িত্ব অস্বীকার করিলে চলে না বৎস। আচমন করিয়া বসো। উদাসীনতা হোমকুণ্ডে বিসর্জন দিয়া একটি কাষ্ঠখণ্ড দায়িত্ব স্বীকারের প্রতীক স্বরূপ যজ্ঞকুণ্ড হইতে তুলিয়া লইয়া পীড়িতা পত্নীর বক্ষে স্থাপন করো গে। উনি রক্ষা পাইবেন।
মেজোকর্তা কিছুক্ষণ প্রাণপণে কাষ্ঠখণ্ড তুলিবার চেষ্টা করিয়া অবশেষে শুষ্ক মুখে, ঘর্মাক্ত কলেবরে বাহির হইয়া গেলেন। মনে হইল এইবার সন্ন্যাসীর ধৈর্যচ্যুতি হইতেছে। মুখমণ্ডলে প্রশান্ত শিবভাব অন্তর্হিত হইয়াছে, ধীরে ধীরে যেন চক্ষে, গণ্ডদ্বয়ে, ওষ্ঠাধরে রুদ্রভাব প্রকাশ পাইতেছে। সেই মেঘগম্ভীর মুখমণ্ডল দেখিয়া ভয়ে ছোটোকর্তা ও ছোটোবধূর প্রাণ উড়িয়া গেল। সন্ন্যাসীর আদেশে তাঁহারা একত্রে প্রবেশ করিয়াছিলেন। বজ্রকণ্ঠে সন্ন্যাসী বলিলেন, স্বার্থপরতা ত্যাগ করিতে পারিবে? মন্ত্রমুগ্ধ সর্পের ন্যায় দুলিতে দুলিতে দম্পতি বলিল, না। দীপ্ত চক্ষে সন্ন্যাসী বলিলেন, তবে দূর হইয়া যাও।
আসন ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসী হোমঘরের কপাট খুলিয়া দাঁড়াইলেন। যেন মূর্তিধারী কালভৈরব। দীপ্ত চক্ষু, কণ্ঠে বজ্র—বলিলেন, আর তিন দণ্ড কালমাত্র বাকি আছে ইহার মধ্যে মাতার প্রাণ রক্ষা করিতে হইলে তোরা কেউ শীঘ্র কিছু দে। ননদিনিদের কাহাকেও বলিলেন, লোভ দে, কাহাকেও বলিলেন, মিথ্যায়
মুগ্ধ হইয়া আছিস, মোহটুকু দে, কাহাকেও বলিলেন, একদেশদর্শিতা বিসর্জন দে সন্ন্যাসীর মন্ত্রের ক্রিয়ায় সকলে সত্যবদ্ধ। কেহই প্রার্থিত বস্তু দিতে পারিল না।
অবশেষে সন্ন্যাসী বালক-বালিকাদিগের প্রতি চাহিয়া মৃদু, কোমল কণ্ঠে বলিলেন, ওঁ তৎসৎ। বৎস, তোরা শুচি নিষ্কলঙ্ক অকপট, তোরাই তাঁহার শেষ আশ্রয়। বল, বাছারা মেজোমাতাকে ভালোবাসিস?
হ্যাঁ। সমবেত কণ্ঠে উত্তর আসিল।
কেন?
মেজোমণি পুতুল কিনিয়া দেয়, লাটিম কিনিয়া দেয়?
বল কিনিয়া দেয়, মেজোমণি খাবার করে, গল্প বলে।
যদি তিনি আর কিছু কিনিয়া না দেন, আহার্য প্রস্তুত না করেন, যদি রূপকথা আর না বলিতে পারেন?
বালক-বালিকার দল মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইল। সন্ন্যাসী খড়মের শব্দ তুলিয়া বাহির হইয়া গেলেন। প্রথমে দরদালান, তাহার পর বাহির প্রাঙ্গণ, তাহার পর বিরাট মানুষটিকে আর দেখা গেল না।
৩.
হোমঘরে চন্দন কাঠ, গব্যঘৃত, ধুনো গুগগুলের গন্ধ কেমন তীব্র কটু হয়ে উঠেছে। বড়োবাবু রোষকষায়িত লোচনে বললেন, ভণ্ডামিগুলো টান মেরে ফেলে দে। নিবারণ, বিশু কে কোথায় আছিস।
সিরাজুলের বুক চাপড়াতে এসে বলল, সবেবানাশ হয়ে গেল গো। মেজোমণিমা আমার আর নেই যে গো! টিমটিম করে পিদ্দিমটি জ্বলছিল, আগলে বাগলে রেখেছিনু, তা মাকে আর ধরে রাখা গেলনি।
মেজোমণির ঘরে দীপ জ্বলেনি। বডোকর্তা বললেন, মেজো, চাবি দে।
মেজো বললেন, চাবি নেই।
ছোটোকর্তা বললে, ইয়ার্কি মেরো না দাদা। চাবিটা দিয়ে ফেলল। চাবি হলে সব হবে।
বড়োমণি বললেন, চাবি হলে সব হবে?
ছোটোমণি বললেন, সব হবে।
ননদিনিরা বললেন, হবে, হবে, সব হবে।
গদির তলায় হাত দিয়ে মেজোকৰ্তা অবাক হয়ে দেখলেন—ওমা এই তো চাবি। শেষ-সম্বলটুকু দাদার হাতে তুলে দিতে দিতে মেজোকর্তা ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
চাবি একবার ঘোরাতেই সিন্দুকের ডালা ফাঁক হয়ে গেল। অভ্যন্তর শূন্য। মেজোমণির স্ত্রীধন মেজোমণির দেহান্তের সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্ধান করেছে।
আবেশ
বাঁড়জ্যেদের বাড়ির অলকার উপর তারা-মার ভর হয়েছে শুনেছ গো?–ও শান্তি!
শান্তি সারাদিনের কাজকর্ম সেরে একটু দুপুর-ঘুমের জোগাড় করছিল। তার স্বামী পোস্টঅফিসে কাজ করে, ছেলে সেক্রেটারিয়েটে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরে। নিশ্চিন্দির চাকরি। খেয়েদেয়ে স্বামী দুটি পান, ছেলে চারটি সুপারি-কুচি মুখে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ছোটো ছেলে তারও পরে। তারপর শান্তির কাজ শুরু। একটা না কি? আড়াইটে নাগাদ সে একটু নিশ্বাস ফেলার ফুরসত পায়। পাশের বাড়ির গীতাদি বারান্দা থেকে বুক অব্দি ঝুঁকিয়ে ডেকে যাচ্ছে তো ডেকেই যাচ্ছে।
কে অলকা?—ধড়মড় করে সে উঠে বসে। বারান্দা নেই, জানলায় দাঁড়ায় শান্তি।
অলি গো, অলি, আমাদের ঠাকুরবাড়ির অলি।
তাই বলো, অলকা বললে বুঝব কী করে? ওর বিয়ের জন্যে পাত্তর দেখা চলছে না?
সে তো কবে থেকেই চলছে। রূপের ধুচুনি মেয়ে। তার উপরে বিএ এমএ পাস দিয়ে বসে আছে। বিয়ে কি সোজা?
তা গীতাদি, রূপের ধুচুনি পাত্তরও তো চারিদিকে কিছু কম দেখছি না। তোমার আমার ছেলের কথা বাদ দাও। নিজের ছেলে কেউ কুচ্ছিত দেখে না। কিন্তু আমাদের বরেরাই বা কী নবকার্তিক ছিল গো? তা-ও তো তোমার মতো চোখোলো মুখোলো মেয়ে জুটেছে। আমার যে অন্তত রংটা আছে এটুকু তো স্বীকার করবে? কেউই মুকখু নই।
তা যদি বললি—ব্যাটাছেলের রূপ আর কে দেখতে যাচ্ছে।
তাহলে গুণ দেখুক। কোনোমতে রোজগার। দুটি মাছ-ভাত। কোনোমতে বছরের কাপড়চোপড়, ছেলে চাকরিতে ঢুকে গেল এতদিনেও একখানা গয়নার মুখ দেখলুম না তা যদি বলো? ছেলের বউ এলে ওই ঘরের সোনা-ই হাতে ধরে তুলে দিতে হবে ভেবে আমার এখন থেকেই বুক কাঁপছে ভাই। গতর ক্ষয়ে গেল। বাসন মাজা, ঘর পোঁছার একটা লোক আছে এই পর্যন্ত। রান্না করো, কাপড় কাচো, ইস্ত্রি করো, সাধের রকম রকম জলখাবার করে দাও, বোতাম বসাও, শার্টের কলার উলটে দাও। নিজের ব্লাউজ-সায়া, এদের পাজামা-লুঙ্গি নিজে হাতে সেলাই করো। এসো জন বসো জন—যেটুকু বজায় আছে দিদি আমার জন্যেই আছে। নিজে না খেয়েও কিছু না কিছু জমাই। ছোটো ছেলেটার আবার যেমন দামালপনা, তেমন বায়না, কে হ্যাপা পোয়ায় গো? এই আমিই তো!
গীতাদির ছেলে এখনও হায়ার পড়াশোনা করছে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী স্কুলমাস্টার। উদরাস্ত কোচিং আর কোচিং। গীতাদির সিচুয়েশনও কিছু উত্তম নয়। ছেলে যে কত হাজার রকমের ট্রেনিং নিচ্ছে। ইয়া ইয়া টাকার ছোড়া বেরিয়ে যাচ্ছে। সাধের গয়না মেয়ের বিয়েতে তো সবই প্রায় গেছে। এখন ছেলের ট্রেনিং এর জন্যে স্বামী মুখে রক্ত তুলে খাটছেন, বাকিটুকুতে হাত দেওয়া কারো মনোমতো নয়। এই যা। ছেলেটার একটা কিছু হয়ে গেলে বাঁচা যায়। আরও একটি গুপ্ত ভয় তার আছে ছেলেকে নিয়ে। সেটা শান্তি জানে না। গীতাদি বললেন, যাবি নাকি?
কী করতে?
তারা-মার ভর সোজা কথা নয় শান্তি। গিয়ে দেখতে ক্ষতি কী?
রোজ হচ্ছে?
আমাদের যমুনা বলছিল, শনি-মঙ্গলবারে হয়। প্রথম প্রথম নাকি রোজ হত। এখন শনি-মঙ্গলে এসে ঠেকেছে আজ তো শুকুর হল। কাল যাওয়া যায়। যদিও আমার তর সইছে না।
তাহলে কাল বিকেলে গা-ধয়ে, এদের একটু বলে কয়ে রাখতে হবে। কতক্ষণে ছাড়া পাব তো জানি না! রুনিটাকে নিয়েই ভাবনা। সন্ধেবেলা অবিশ্যি কোচিনে যাবে। তবু…।
ও সব ম্যানেজ করো, কাল যাবই।গীতাদির ইচ্ছে ছেলে নিয়ে দুশ্চিন্তার গুপ্ত কথাটি তারা-মাকে পেশ করে।
পালপুকুর নাম হতে পারে। কিন্তু ঠিক গাঁ-গঞ্জ নয়। বিটি রোড ধরে যেতে যেতে যেতে যেতে যখন ভাবছ এ আর আসবে না, ঠিক তখনই এসে যাবে স্টপ। সামনে দিয়ে রেললাইন গেছে। সেই লেভেল ক্রসিং পার হলেই দেখবে দু-দিকে উপছে পড়ছে বাজার। আলু, পটোল, কুমড়ো, লাউ, পেঁপে, চিচিঙ্গে, ঢ্যাঁড়স সারি দিয়ে তো আছেই। ঘ্যাঁস ঘাঁস বড়ো বড়ো অন্ধে পোনা কাটছে মেছোরা, ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস মুরগির গলা কাটছে মুরগিঅলা, সরু একচিলতে দোকানে রোগা ছাল ছাড়ানো পাঁঠাও ঝুলছে। খাও কোনটা খাবে। জিলিপি ভাজছে গরম গরম, কচুরি ভাজার কটু গন্ধ উঠছে বাতাসে। বাজে ডালডা আর কেরোসিনের ঝাঁঝ। তার পাশে মস্ত মুদির দোকান। ডাল, মশলা থেকে বড়ি, পাঁপড়, আমসত্ত্ব, খেজুর, খোবানি কিছুই বাদ নেই। আর একটিমাত্রই ল্যান্ডমার্ক। একটি ফোটো স্টুডিয়ো। কাচের মধ্যে বাহার দেওয়া উত্তম-সুচিত্রার ছবি, প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণার ছবি, কে নেই? সববাই এখানে ওই পালপাড়ার ম্যাজিকল্যান্ড স্টুডিয়োয় এসে ফোটো তুলিয়ে গেছেন। এ ছাড়াও ফ্রক ছড়িয়ে কুঁজো হয়ে বসে ফোকলা দাঁতে বাচ্চা মেয়েটি হাসছে। থামে হাত দিয়ে স্টাইল মেরে শাড়ি পরা লোকাল সুন্দরীর ছবি, বিয়ের জন্য তুলতে আসা ছবির সার। ম্যাজিকল্যান্ড-এর তলায় ব্র্যাকেটে লেখাও আছে—এক ছবিতেই বিয়ে। বাস, আর কোনো ল্যান্ডমার্ক নেই। ডাইনে, বাঁয়ে সরু সরু গলি—তার ভিতরে ঢুকে আবার ডাইনে, বাঁয়ে সরু সরু গলি। এর ভেতর থেকেই প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় গুণে গেঁথে যে গলি চাইছ খুঁজে বার করতে পারলে তো পারলে। গুনতে ভুল হলে নিশি পাওয়ার মতো ঘোরো মাঝদুপুরে, কেউ দেখতে আসবে না খাঁ খাঁ গা-জ্বালানি রোদে।
জমির দাম সস্তা ছিল। খুব একটা বসতও গড়ে ওঠেনি। তাই এদিকে আসা। সস্তা হবে। শুনতেই বারো নম্বর রেলগেট পেরিয়ে। এক বাসে তুমি রবীন্দ্রভারতী ইউনিভার্সিটি, স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট পৌঁছোতে পার। পালপুকুর উত্তর চব্বিশ পরগনা, সড়কপথে, রেলপথে ঋদ্ধ। কোনো অসুবিধা নেই। কাছে-পিঠে কলকারখানা নেই, গাড়ি-ট্রাকের ধোঁয়া নেই। বাজারের এলোমেলো নোংরামিটুকু ছাড়িয়ে ডাইনে, বাঁয়ে ঘুরে যেতে পারলে নতুন বাড়ির গন্ধ, পুরোনো বাড়ির ভরসা, খোলামেলা মাঠে এবং নিষ্কলুষ আকাশ দেখতেই পারো। তবে কিনা— পপুলেশনে জেরবার এই দেশের আপামর সাধারণের নজর বড়ো নীচু, বা বলা ভালো সরু হয়ে গেছে। জমি যখন রয়েছে, বসত যখন নতুন হচ্ছে তখন রাস্তা কেন পাশাপাশি দুটো ছোটো গাড়ি পাস করার মতোও হবে না—এ প্রশ্নের জবাব নেই। কারা জমি বিক্রি করে, কারা বিল্ড করে কর্পোরেশন কতটা জমি রাস্তায় জন্যে হিসেবে রেখেছে সে অঙ্ক কবার দরকার নেই আমাদের। আমরা দেখব আমার রিকশায় উলটোদিকের রিকশার চাকা বেধে গিয়ে বিভ্রাট হল। দেখে গালাগালি দেব। গাড়িতে গেলে ওপাশ থেকে গাড়ি আসছে দেখে ও ড্রাইভারের হাত নাড়ুনিতে আমি পেছোব না আমার ড্রাইভারের খিচুনিতে ও পেছোবে, সেটা পরিস্থিতিই বলতে পারবে। বাড়িগুলি একটু উঁচু করে তৈরি করা ঠিকই। তিন চার ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে উঠতে হয়, কিন্তু সিলিং সেই নীচু। হাইরাইজের ফ্ল্যাট বাড়িতে যেমনটা হয়। ওই যে নীচু নজর! দোতলার বারান্দা লম্বা মানুষ হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারবে।
পালপুকুরের পালপাড়ার এই চেরা চেরা অলিগলির গোলকধাঁধা পেরোতে পেরোতে শেষকালে গা ঠেকে যাবে যে কুঠিতে সেটিই অলকার বাপ-ঠাকুরদার ভিটে তারাকুঠি। শ্রী দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, তস্য পুত্র তারাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধিকারে এখন। এর পরেই পালপুকুর এবং তার সামনে বিরাট মাঠ। পুকুরটি বাঁড়জ্যেদের, এখনও প্রোমোটারের নজর পড়েনি। সামনের মাঠ কার কে জানে। তবে বার্ষিক শারদ দুর্গাপুজো, শ্ৰীশ্ৰীকালীপুজো, বাণীবন্দনা, রবীন্দ্রজয়ন্তী…আদি উৎসব এখানেই হয়। পালপুকুর বন্ধুসংঘ, পালপুকুর পিপলস ক্লাব দুটিই মাঠের উপর শ্যেনদৃষ্টি রেখেছে, এলাকার কেউ কেউ জানে, সবাই জানে না। ছেলেপিলেরা এখানে একটু খেলাধুলো করতে পায়, এতেই সব খুশি আছে। বর্ষাকালে ঘাসে-আগাছায় ভরে যায়, খেলাধুলো হতে হতে টাক-পড়া মাথায় মাঝে মাঝে খামচা খামচা চুলের মতো ঘাসপাতা গজিয়ে থাকে।
এই তারাকুঠির বাড়িটির দিকেই মঙ্গলবার ভোর থেকে দলে দলে লোক চলেছে। বহুদূর ছড়িয়ে গেছে তারা-মার খ্যাতি। মাঠটি ভরো-ভরো। এইরকম শনিবারও। অন্য কোনো দিনে কিন্তু সব শুনসান। ছিমছাম মেয়েটি বাঁডজ্যে বাড়ির চাতাল পেরিয়ে সিঁড়ির ধাপে এসে পা দেয়। পায়ের বাসি আলতার ছাপ সে সাবান ঘষে ঘষেও তুলতে পারেনি। কালো মেয়ে, ছিপছিপে, একটু বেশি লম্বাই বোধহয়। একসময়ে পাত্রপক্ষ বলত–তাল-ঢ্যাঙা। যা ভালোবাসার লোকের কাছে শ্যামা ছিপছিপে বা তন্বী শ্যামা তাই পাত্রপক্ষের কাছে তাল-ঢ্যাঙা রক্ষাকালী প্রতিভাত হয়। রূপের খানিকটা তো নজরের উপর নির্ভর করেই। মেয়ের মুখটি রোগা, লম্বা, হনু জাগা ছিল-পাত্রপক্ষের ভাষায় ঘোড়ামুখো। তবে এখন শাঁসে-জলে খানিকটা ভয়ে ভরাট লম্বাটে আদল এসেছে। কপাল বড়ো, ঘন ভুরু, চোখ লম্বা, সরু, মণি বাদামি, নাক টিকোলো, হাঁ মুখটি বড়ো। ছড়ানো ঠোঁট। সবচেয়ে খারাপ ছিল বোধহয় দাঁত, সামনের দাঁতগুলি বড়ো বড়ো, এবড়োখেবড়ো। আজকালের সম্পন্ন সচেতন বাড়ির বাবা-মা ছোটোতেই এমন দাঁত ঠিকঠাক করিয়ে দেন। টলস্টয় বলেছিলেন, হাসলে যাকে ভালো দেখায় না সে মেয়ে দুর্লভ, তবে যদি নিতান্তই মেলে, সে-ই প্রকৃত কুৎসিত। এ মেয়েটি সেদিক থেকে প্রকৃতই কুৎসিত। তবে সে হাসতই না। ছোটো থেকে নিজের চওড়া কপাল, বড়ো হাঁ আর অসমান দাঁতের অসুন্দর হাসি সে লক্ষ করেছিল, তাই মুখ খুলে হাসতই না। এখন হাসে। খারাপ তো দেখায় না। সবচেয়ে যা ভালো তা হল চুল। অনেক চুল মেয়েটির। এখন শ্যাম্পু করে কীসব মেখে ফুলো চুল বাগে এনেছে। হলুদ শাড়ি পরা কেশবতী মেয়েটিকে পিছন থেকে দেখলে রূপবতীই মালুম হয়। পিছনের লোক সামনে এসে নির্লজ্জের মতো মুখ দেখে তারপর নির্লজ্জতরের মতো মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে যাই হোক, যারা অলকাকে আগে দেখেছে তারা আকাশ-পাতাল তফাত দেখে। এই মেয়েটির চিকন কালোয় হলুদ, কমলা শাড়ির আভা লেগেছে। চোখদুটির চাউনি গভীর রহস্যে স্থির। মুখে চাপা হাসি। মুখমণ্ডলে প্রসন্ন বিভা। অনেকেরই চেয়ে চেয়ে আঁখি না ফিরে। কেননা তারা দেবী না হোক দেবীর আধার দেখে। আর যারা নিতান্তই কামিনী রমণী দেখতে চায়, না জেনে না শুনে, তাদের পিছন থেকে দেখার প্রত্যাশাটা সম্মুখ দর্শনে পূর্ণ যদি না হয় তো কার কী করার আছে? অলকার? বয়েই গেল। এখন।
তখন? তখন বয়ে যেত না। বড়ো লজ্জা, বড়ো অপমান। গোঁড়া বাড়ি। ঠাকুরদা দেবপ্রসাদ ছিলেন তারা-মার ভক্ত। শেষদিকে প্রায় বিবাগী হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর পূজিত, নিজে হাতে গড়া তারা মূর্তি ঠাকুর ঘরে, সেখানে সকাল সন্ধে পুজো ঠাকুমার দায়। তারপরে মায়ের। পুজো মানে পুজোর জোগাড়। আসল পুজোটুকু বাবা ব্যাটাছেলে তারাপ্রসাদই করতেন। কখনও কখনও তিনি অসুস্থ হলে পুত্র শ্যামাপ্রসাদ বা শ্যামই করত। মায়ের অসুবিধা থাকলে অলকা করত পুজোর জোগাড়। অলকা বিএসসি পাস করল তারপর বাবা পড়া বন্ধ করে দিলেন, মুখে বললেন, গ্র্যাজুয়েট হয়েছে আর কী! ঠাকুরবাড়ির মেয়ে পুজো-অর্চনা করুক, রান্নাবান্না, বিয়ের জন্যে তৈরি হোক। আসল কথা অবশ্য অলকা জানে। তার মাও জানেন। শ্যামা অলকার মতো লেখাপড়ায় ভালো নয়। তার পড়ার খরচ আছে। মিনি মাগনা হয় না। সৎ ব্রাহ্মণ হলে কী হবে, তারাপ্রসাদ সামান্য চাকরি করেন। বসতবাটিটি ছাড়া আর কিছুই নেই। কাজেই মেয়ের পড়া বন্ধ। বিএড পাশ করে টিচার হওয়ার ঘোর বাসনা হয়েছিল অলকার। এমন কিছু খরচ না। না হয় টিউশনি করে সে নিজেই জোগাড় করবে। কিন্তু বাঁডজ্যেবাড়ির মেয়ে চাকরি করবে এতেও তারাপ্রসাদের ঘোর আপত্তি। হতে পারেন তাঁরা বংশানুক্রমে শক্তিপূজারী। কিন্তু বংশের মেয়ের হাতে তাঁরা কোনো প্রহরণ দেখতে চান না। সে কলম পেনসিল হলেও। বিশ্বাসও করেন না। রমণী চৌকাঠের পার কী ঘরের বার। বিশ্বাস নাই। ভালো কথা, মা তাকে রান্নাঘরে বেশি যেতে দ্যান না। উনুন তাতে কালো মেয়ের কী মূর্তি হবে কে জানে! তবে রান্নাঘর ছাড়াও ঊনকোটি কাজ আছে সংসারে। অলকা সবই করে, করেও ভাববার সময় পায়। একতলা বাড়ির ছাদের ওপর ফুলবাগান করার সময় পায়। বাড়ির পিছনে সামান্য জমি, সেখানেও ফুল ফুল আর ফুল। সবই অলকার এক হাতের করা। লাল পঞ্চমুখী, গোলাপি সপ্তমুখী। জবার গাছ বাগানে আছে অন্তত গোটা দশেক। ময়ের পুজোর ফুল। এ ছাড়া পেয়ারা গাছ এবং কদম, শিউলি, কাঠ-চাঁপা, করবী। একটি নিম গাছ, বাতাবি লেবু, গন্ধলেবুর গাছ এবং অদ্ভুত কথা এক সৃষ্টিছাড়া বটল পাম বাগানে।
ছাতে সাদা ফুলের জোছনায়, সুগন্ধে মাত হয়ে থাকে বাঁড়জ্যেবাড়ির ওপর বাতাস। কামিনী, বেল, জুই, কুন্দ, রজনিগন্ধা, টগর, শ্বেতকাঞ্চন, হাসনুহানা। সিমেন্টের উঁচু বেঞ্চি করা আছে, তার ওপর পরপর গাছ। বড়ো টব, ছোটো টব, দেয়ালের গায়ে ছোটো একটি খুপরি কুলুঙ্গিতে খুরপি, সারের কৌটো, কাঁচি সব মজুত থাকে। এই ছাতটিই অলকার জুড়োবার জায়গা ছিল। শীতকালে বড়ি দেওয়ার নাম করে, আচারের ভরসা নিয়ে সবাইকে সে ছাতে চলে আসত। যতক্ষণ রোদ ততক্ষণ সে টুপটুপ বড়ি দিচ্ছে, বড়ি দিয়ে আচারের শিশির ঢাকনা খুলে রোদে দিচ্ছে। মাঝারি সব কড়ির বয়ামে আমতেল, ছড়া তেঁতুল, এঁচোড় ফুলকপি-মটরশুটি তেলে দিয়ে রকম রকম আচার, আম কোরা, তেঁতুলের কাই। রকমারি। রোদ একটু সরে গেলে দেখবে কোন গাছে ঝুড়ি এসেছে, চড়ুই-শালিখ কুঁড়ির বোঁটা কেটে দিয়ে যাবে, সেগুলো সে বড়ো বড়ো কাঠির কুঁড়ি চাপা দেবে। আচার ছাতের ঘরে তুলবে। তারপর নীচে নেমে শুরু হবে রাজ্যের কাজ। রোদের ঝাঁঝ মরে এলে আবার চলল। হাতে বই, বেতের চেয়ার ছাত-ঘর থেকে টেনে নামিয়ে, চুল মেলে দিয়ে সাঁঝ না নামা পর্যন্ত পড়া। কী পড়ে অলকা? যা পায়। সঞ্চয়িতা, গীতাঞ্জলি, লাইব্রেরি থেকে আনা গল্প-উপন্যাস, ভ্রমণের বই, অদ্ভুত যত অভিজ্ঞতার গল্প, আর পড়ে পাঁজি, গীতা এবং ঠাকুরদা দেবপ্রসাদের ডায়েরি। শেষোক্ত বস্তুটি সে বইয়ের আলমারি ঝাড়তে-গোছাতে গিয়ে আবিষ্কার করে। করে এত অবাক হয়ে যায় যে প্রথমেই গলা দিয়ে আওয়াজ বার হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস ঝিমঝিমে দুপুর, বাবা অফিসে, মা ঘুমে, ভাই বাইরে—কেউ শুনতে পায়নি সঙ্গে সঙ্গেই সে নিজেকে সামলে নেয়। ঠাকুরদার ডায়েরি হেন রত্ন পাওয়া গেলে বাবা তো অবশ্যই তার রত্ন দাবি করবেন, সে ডায়েরি তার ছোঁয়া তত বারণ হয়ে যাবে। তাই সে ঝেড়েঝড়ে বাইরের সারির পিছনদিকে জিনিসটি যেমনকে তেমন। রেখেই দেয়। মাঝেমধ্যে অন্য বইয়ের ভেতর করে নিয়ে এসে পড়ে।
ডাক পড়ত। মাঝে মাঝেই। তার পাঠ-নিমগ্ন, কুসুমবেষ্টিত নির্জনতা থেকে নেমে যেতে হত। আলমারি থেকে টিসুর শাড়ি, কেন-না ফুলে থাকবে, ভরন্ত দেখাবে। মেক-আপ স্টিক তো স্রেফ এইজন্যেই কেনা। সাজগোজ শেষ করে কপালে একটি বড়ো টিপ দেবেন মা। তাতে কপাল একটু যদি ছোটো দেখায় চুলগুলো হাতখোঁপা করে হাজিরা দিতে হবে তাকে বাইরের ঘরে। সুটেবল গার্ল এর খোঁজে যেখানে দলকে দল বসে কচুরি-আলুর দম-রসগোল্লার গুষ্টির তুষ্টি করছে।
কী নাম মা?
অলকা ব্যানার্জি।
কুমারী তো? আসল কথাটি যে বন্দ্যোপাধ্যায়—বোধহয় জানা নেই।
অলকার মনে হয়, বলে, কুমারী জেনেছেন বলেই তো দেখতে এসেছেন। বিবাহিতা মেয়ের সঙ্গে ছেলের সম্বন্ধ করতে আসেননি নিশ্চয় অবশ্যই এত কথা সে বলে না। হাসি ঠেকিয়ে নম্র, নতভাবে জবাব দেয়–
কুমারী অলকা বন্দ্যোপাধ্যায়।
হ্যাঁ গো মেয়ে, খুব নাকি পাস করেছ শুনতে পাই।
মায়ের চোখের শাসনে, প্রাইভেটে এম এ পাস করার কথাটা সে আর বলে না, বলে—এমন আর কী! বিএসসি।–কেমিস্ট্রিতে অনার্স ছিল। ফার্স্ট ক্লাস কান ঘেঁসে বেরিয়ে গেছে, এত কথা সে কেনই বা বলতে যাবে।
চুলটা একটু আলগা করো তো মা!
কাঁটা তিনটি আলতো করে খুলে নিতেই পিঠে ফণা তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাশি রাশি কেশ। অলকার চোখে হাসি খেলে যায়।
তা ওদিক থেকে রি-অ্যাকশন আসে। বৃদ্ধাটি বলছেন,—চুল নিয়ে কি ধুয়ে খাব? —অথচ দেখতে তো ইনিই চেয়েছিলেন।
পরে খবর দেব বলে চলে গিয়ে যখন আর খবর দ্যান না এরা, বাবা-মার গায়ে কাঁটা ফুটতে পারে কিন্তু অলকার বড়ো স্বস্তি বোধ হয়। এরা তো বউমার হাতের রান্না চেয়ে-চিন্তে চেটেপুটে খেয়েও বলবে, রান্না নিয়ে কি ধুয়ে খাব?
তবে অলকা বেশি কথার মানুষ নয়। নিজের ভিতরের সোয়াস্তি সে বাইরে প্রকাশ করতে যায় না।
এভাবে দ্বিতীয় দল, তৃতীয় দল আসে। অলকাকে নিজে হাতে খাবার প্রস্তুত করতেও হয়। কিন্তু খবর আর আসে না। দেখতে দেখতে সাতাশ পার হয়ে গেল। হঠাৎ ঠাকুরঘরের চৌকাঠে বাবা খাড়া হয়ে দাঁড়ালেন। কী ব্যাপার? ঠাকুরঘরে ঢুকতে পাবে না অরক্ষণীয়া কন্যা। পুজোর জিনিসপত্রে হাত দেবে না।
মা বললেন, পাগল হলে না কি? আগেকার ওসব অরক্ষণীয়া-টিয়া আছে নাকি এখনও?
না।
রাগটা করছ কার উপর? মা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, কালোকুষ্টির ঝাড় তো তোমরা। দেয়ালের দিকে চেয়ে ছবিগুলো দ্যাখো না। আমার যদি কিছু ছিরিছাঁদ থেকেও থাকে, সে তোমাদের এই সংসারের পিছনে গেছে। মেয়ে যে রূপটা পাবে, কোন স্বগগো থেকে পাবে শুনি? আজকাল কত কি স্নো, ক্রিম উঠছে, পার্লার, মার্লার সেসব করার জন্যে দু-দশ টাকা ধরে দিয়েছ কোনোদিন? ওই মেয়ে বড়ি, আচার, পূজোর জোগাড়, কাপড় কাচা, বাসন মাজা সবই করছে আমার সঙ্গে সঙ্গে। ঝনাৎ করে মা চলে গেলেন।
সত্যি কথাই। জিনে থাকবে তবে তো রূপ পাবে? ছিটেফোঁটা নেই কোনো কুলে!, আয়নার দিকে চেয়ে অলকা মনে মনে বলে। দেবপ্রসাদ যেন কালীর হাতের খাঁড়াটা। একবগ্না, ঘাড় উঁচিয়ে পইতে হাতে করে এগিয়ে আসেন আর কী! ফোটোগ্রাফেও বোঝা যায় খসকা কালো রং, সব ঢেকে কাঁচাপাকা দাড়ি গোঁফ। তস্য পত্নী একেবারেই কেলে হাঁড়ি। ঠাকুমাকে ছোটোবেলায় দেখেছে, ভালোই মনে আছে তার। খুব বড়োলোকের মেয়ে ছিলেন। তাঁর অনেক গয়নাপত্তরও ছিল। হয়তো সেইসব ঘুষ দিয়েই নিরূপ কন্যার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু মানুষটি ছিলেন বড়ো ভালো। বউমাকে কোনোদিন কষ্ট দেননি। নাতি-নাতনিকে অশেষ ভালোবাসতেন। তাঁকে কোনোদিন দেখতে খারাপ বলে মনে হয়নি অলকার। রূপের ছববা কী জিনিস এই এখন ইদানীংই পুরো মালুম হচ্ছে। চতুর্দিকে হোডিং, তাতে রূপসি মেনকা রম্ভারা বুকের ভাঁজ দেখিয়ে সব উলঙ্গহার ছড়িয়ে রয়েছেন, ছিঃ। এইসব কাগজ, বিজ্ঞাপন আর পত্রপত্রিকার দৌলতেই তাদের পৃথিবী জানল রূপ রূপ, বিরূপ, রূপকথার নানান আখ্যান-ব্যাখ্যান। তা নয়তো সে কি কোনোদিন নিজের মাকে অসুন্দর দেখেছে? মুখে মেচেতার ছাপ, না ফরসা কালো, মাথার চুলগুলি সামনের দিকে উঠন্ত, থলথলে গড়নের মা তার জননীই তো! আর ভাই সেই আদরকাড়া বল-খেলুনেটা! লম্বা চওড়া, একমাথা চুল এখন, কিন্তু কুচকুচে খসকা কালো, মুখময় ব্রণর দাগ এক মুরারি ওকে কি কোনোদিন কুরূপ বলে সে জেনেছে! এতদিনে জানল—বাবা মা, ঠাকুরদা ঠাকুমা, সে নিজে সবাই কুরূপ। তবু সে হয়তো এই এদেরই মধ্যে একটু খোলতাই। কে জানে হয়তো যৌবনের গুণে। তার হ্যাঁ ওই, মা বলেছে আরেকটু দেখনসই হতে সে পারত যদি ক্রিম…ট্রিমের দৌলতে আরেকটু চকচকে হওয়ার চান্স পেত, পার্লারের গুণে সরু ভুরু, একটু ভালো খাওয়া দাওয়া করে দলমলে ঢলঢলে। তা সেও তো তোমরা দিতে পারছ না। তবে রাগটা কীসের, ঝালটা কার উপর ঝাড়ছো? নিজে যে রোজগার করে নেব–তাতেও তো বাদ সাধছ!
কিন্তু যেদিন জানালা দিয়ে লম্বা সুঠাম চেহারার ব্যাকব্রাশ চুল শ্যামকান্তি যুবকটিকে দেখে তার নিজেরই খুব পছন্দ হয়ে গেল, সেদিনই হল তার আসল মুশকিল। সে দিনেই মন দিয়ে হালকা কমলা রংয়ের সরু জরিপাড় শাড়িটা সে পরেছিল। মুখটি মেজে ঘষে, চুলগুলি খুলে দিয়েছিল। কপাল ঢেকে কান ঢেকে পড়েছিল চুলের গোছা। ছোটো তার পছন্দসই টিপ ছিল কপালে। টান টান করে শাড়ি পরা ফিগারে তনুশ্রী যতদূর খোলবার খুলেছিল। ঠোঁট ভালো করে ঘষে সামান্য একটু ভেসলিন দিয়ে চকচকে করে নিয়েছিল। আর বুকের খাঁজে লুকিয়ে নিয়েছিল একমুঠো শুভ্র কু-কুসুম। মৃদু সুগন্ধে চারদিক মাত হয়ে থাকবে।
যুবকটি ভদ্রভাবে নমস্কার করে বলল, আপনি সত্যি কথা পছন্দ করেন তো?—সে কী বলবে? সত্যেরও যে তেমন কোনো অ্যাবসলিউট নেই সে তো জীবন দিয়েই জানে।
দেখুন, আমি রাইটার্সের এইচডিসি। যতই চাই আমার ভাগ্যে যে হুরিপরি জুটবে না সে আমি জানি। আমার মা যিনি এতদিন আমাকে ভাত বেঁধে খাওয়ালেন দুঃখ ধান্ধা করে বড়ো করলেন, তিনিই দুরারোগ্য রোগে শয্যাশায়ী। আমি একজন ভদ্রঘরের রাঁধুনি-কাম-নার্স-কাম আয়া খুঁজছি স্ত্রীর মধ্যে। টানাটানির ঘরে একজন এইরকম রোগীকে সেবাশুশ্রুষা করে আর যাবতীয় যা করার যদি করতে রাজি থাকেন, তাহলে আপনার রূপ আমার চলবে।
চাঁছাছোলা কথাগুলি বলে ছেলেটি তার চোখের দিকে সোজা চেয়েছিল। অলকার কী যে হল, যেন ভেতরটা দারুণ গরম হয়ে উঠছে, সে যেন আর নিজেতে নেই। সে নমস্কার করল, তারপর উঠে দাঁড়াল চেয়ার থেকে, পেছনে ফিরে চলে এল।
কী ব্যাপার, কী হল?_যুবকটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, বাবা তারাপ্রসাদও তাই। কী হল? হলটা কী?
মা তার বন্ধঘরের দরজায় ঘা দিতে দিতে ক্রমাগত কাঁপা গলায় বলতে থাকলেন, কী রে অলি? তুই কি হ্যাঁ বললি, না, না বললি? হ্যাঁ বললি, না, না বললি!
সে বন্ধ ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসেছিল, কীরকম অসাড় দেহমন নিয়ে, কোনো জবাব দেয়নি। যুবকটি শেষে বলেছিল, আমার কথা বোধহয় ওঁর পছন্দ হয়নি।
সে সারারাত দরজা খোলেনি।
না, খুলেছিল। মাঝ নিশীথে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে যথাসম্ভব নিঃশব্দে দরজা খুলে বাগানে চলে গিয়েছিল ধীর পায়ে। সৃষ্টি ছাড়া বটল পামটির শুভ্র সুগোল কাণ্ডটি জড়িয়ে ধরেছিল। গাল বেয়ে চোখ ছুঁইয়ে, নাক চুইয়ে মনে মনে বলেছিল, বৃক্ষ যদি তুমি সত্যিকারের বৃক্ষ হও তাহলে আমাকে আশ্রয় দাও। পরদিন ওই গাছের তলাতেই তাকে পাওয়া যায়—জ্ঞানহীন। এবং কপাল ফিরতেই সে রক্ত চোখে চারপাশে তাকিয়ে বলেছিল, তোরা অপবিত্র, আমার এ পূতাঙ্গ ছুঁস না। যা স্নান করে আগে পবিত্র হয়ে আয়। আমার পেটিকায় পাটের কাপড় আছে। তারা-মালা, পলা আছে নিয়ে আয় পরি। হ্রীং শ্রীং স্ত্রীঃ ফট।
তার চোখের দিকে তাকিয়ে শিহরিত তারাপ্রসাদ ও সর্বাণী চুপ। তারাপ্রসাদ ছাড়া কেউ জানেনই না মায়ের পেটিকায় কী কী বস্তু আছে। শ্যাম শুনল না, শশব্যস্তে ডাক্তার ডাকল। তানা না না করে তিনি যখন এলেন তখন চান করে ভরপেট ফলাহার করে কেশের ঐশ্বর্য ছড়িয়ে মা তারা বগলামুখী নিবিড় ঘুম ঘুমোচ্ছেন। লাল চওড়া পাড় তসরের শাড়ি পরনে। হাত ভরতি লাল পলা, গলার থেকে লম্বা তারা তারা সোনার মালা লুটিয়ে আছে বুকের উপর। তারাপ্রসাদ ঘরের সামনে প্রহরায়।
উনি ঘুমোচ্ছেন, ছোঁবেন না।
শ্যাম বলল, বাবা আপনি কী পাগল হলেন? একটু দেখতে দিন।
হ্যাঁ দর্শন। একবারমাত্র দর্শন করুন, তারপর চলে যান।
সামান্য ফাঁক দরজা দিয়ে শয়ান মূর্তিটি দেখে সভয়ে ডাক্তার বললেন, অন্য সময়ে জাগলে, বুঝলে শ্যামাপ্রসাদ! ব্যাগ গুটিয়ে ভদ্রলোক পালিয়ে গেলেন।
প্রথম ক-দিন সে এইরকম গভীরভাবেই রইল। ভোরবেলায় উঠে স্নান সেরে কোরা লাল পাড় শাড়ি পরে সেজেগুঁজে ছাতে যায়, ঘুরে ঘুরে গাছগুলির উপর আশীর্বাদের হাত রাখে। আপন মনেই বীজমন্ত্র বিড়বিড় করতে করতে ঘোরে। নীচে আসে রোদ কড়া হয়ে উঠলে। তখন বাবা তাকে ঠাকুরঘরে ঢুকতে বললে, সে স্থির চোখে তাকায়। নিজের কোণের ঘরটিতে চলে যায়। যথাসময়ে পবিত্রভাবে প্রস্তুত তার ভোগ আসে। খাওয়া দাওয়া সারা হলে সে দরজা বন্ধ করে দেয়। পড়ে, পড়ে, পড়ে। বিকেল হলে আবার বেরিয়ে পবিত্র হয়ে বাগানে যায়। এই শ্বেত কাঞ্চন গাছটি তার বিশেষ প্রিয় ওই যুথী গাছটি তার বড়ো ন্যাওটা, সে না এলে কেমন ঝিমিয়ে থাকে। অনন্য মনে সে পরিচর্যা করে গাছগুলির, তাদের মৃদু অভিমান বোঝে, আদর করে, ফুলগুলি আহ্লাদে ফেটে পড়ে। তারপর পড়ন্ত সন্ধেয় নীচে নেমে সে সোজা ঠাকুরঘরে চলে যায়, আসন পেতে পদ্মাসনে বসে।
সে জানে না কখন সে দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছে। ডানহাতে যেন খড়গ ধরা, বামহাতে কপাল, কোন সুদূরে তার চোখ নিবদ্ধ মুখে প্রশান্তি। আবার কখনও তেজ। সে জানে না কখন সে বসেছে। মুখ দিয়ে অস্ফুট ধবনি বেরোচ্ছে—কোনো মন্ত্র কিন্তু এদের বোধের অতীত। বোঝেন অনুমান করতে পারেন একমাত্র তারাপ্রসাদ। তিনি বিহ্বল হয়ে প্রণাম করেন বারবার। সে দেখেও না, তার খেয়ালের মধ্যেই তখন থাকে না ঠাকুরঘরে শুধু প্রণত মাথার গাঁদি লেগেছে, যখন জ্ঞান হয় দেখে তার গলায় আজানুলম্বিত রক্তজবার মালা। আশেপাশে ঝুড়িতে ফলফুল মিষ্টান্ন, শাড়ি, কয়েনে কয়েনে ছয়লাপ, যে যা পেরেছে, পাঁচটাকা, দু-টাকা এক টাকা। নোটের তাড়া। ক্রমে ক্রমে বেনারসি, সিল্ক শাড়ি, মাকে প্রদত্ত সোনার গহনা। আরও বড়ো নোট, আরও বড়ো।
কোনোদিকে তাকায় না উঠে দাঁড়ায় সে। সসম্ভমে সবাই পথ করে দেয়। সে চলে যায় কোণে নিজের ঘরে। অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে। কোনো সময়ে মা ঘুম ভাঙিয়ে নিজে হাতে খাইয়ে যান। এবং আরও রাতে চুপিচুপি শ্যামা ভাই তার ওষুধের গুলি ঠোঁট ফাঁক করে খাইয়ে দেয়। যতই ঠাকুরবাড়ির ছেলে হোক শ্যামা আজকালকার ছেলে। বাবাকে লুকিয়ে দিদির সাধ্যমতো চিকিৎসা সে করাবেই। এবং চিকিৎসাতেই কিনা কে জানে ফল হয়। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তার নিজের ছাপা শাড়ি পরে অলকা রান্নাঘরে গিয়ে চা করে, রুটি তরকারি করে। পিছন থেকে মা এসে হতবাক।
ওরে তুই কেন? আমি তো আসছি।
সামান্য অবাক সামান্য বিরক্ত হয়ে সে একবার তাকায় তারপর চায়ের কাপ মায়ের হাতে তুলে দেয়। বাবা আর ভাইয়ের চা নিয়ে চলে যায় বইয়ের ঘরে যেখানে সবে সকালের কাগজ এসে পৌঁছেছে, দুজনে দু-খানা পাতা নিয়ে দু-দিকে বসে আছে। দুজনেরই মুখ কাগজে ঢাকা। শাড়ির খসখস শব্দ। তারাপ্রসাদ বললেন, বুঝলে এবার রান্নাবান্নার জন্যে দেখে শুনে একজন বামনি রাখো। এখন
অলকা বলল, বাবা চা নিন।
কাগজ হাত থেকে খসে গেল। তারাপ্রসাদ ভ্যাবলার মতো চেয়ে রইলেন, অবশেষে ফাঁসফেঁসে গলায় কোনোক্রমে বললেন, মা, তুই?
শ্যামাও চমকে উঠেছিল, সামলে নিয়ে বলল, আরে দিদি, তোর চা-টাও দিয়ে নিয়ে আয়। একসঙ্গে…।
অলকা শান্ত মুখে বাবার দিকে একবার তাকাল, ভাইয়ের দিকে একবার। মুখে কী মৃদুর চেয়েও মৃদুতর হাসি? হাসি না আর কিছু!
সকলের কাজকর্ম সারা হলে অলকা চিরদিনের অভ্যাসমতো সামান্য একটু পাড়া বেড়াতে বেরোয়। তার কাছাকাছি বয়সি কোনো বউ বা মেয়ে, পাড়াপড়শি, ছেলেবুড়ো, পিপলস ক্লাব বা বন্ধুসংঘর ছেলেরা যারা এখনও তেমন কোনো কাজকর্ম পায়নি, চারদিকে খুঁটির মতো ছিটিয়ে থাকে। চলতে চলতে কথা বলতে বলতে সে স্বচ্ছন্দে এগিয়ে যায়। শীত পড়ছে, রোদে তেমন ঝাঁঝ নেই। আকাশের রং সাদাটে। সবাই চলতে চলতে কেমন সম্ভ্রম মিশ্রিত কৌতূহলের দৃষ্টিতে চায়। সে খেয়াল করে না। বড়ো বাড়ির আধখোলা সবুজ ফটক আলতো ঠেলে সে ডাকে, রুবি বউদি, আসব?
চমকে উঠে বউদি বলে, ওম্মা অলকা! এসো এসো। পড়িমরি করে সে একখানা তোলা আসন এনে চেয়ারের উপর পেতে দেয়, বস।
হঠাৎ তুমি?–অলকা হেসে ফেলে। রুবি বউদিদের সঙ্গে তার বরাবর তুই তোকারির সম্পর্ক। প্রথমটা একটু আড়ষ্ট হয়ে কথা বলে, তারপর সহজ হয়ে যায় বউদি, তুমুল গল্প করে। এইরকমই অরুণা, মাধুরী, শীলাদের সঙ্গেও তার গল্প জমে যায় কোনো কোনো বিকেলবেলা।
কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ যেটাকে মনে করেছিল হোমিও-আরোগ্য, এবং তার বাবা মনে করেছিলেন দৈবী অন্তর্ধান, অচিরেই দেখা গেল সে জিনিসটা স্বল্পস্থায়ী। সেই বিশেষ বিশেষ বার অর্থাৎ শনি, মঙ্গলবারেই এখন মায়ের ভর হয়। কখন হবে কেউ জানে না, কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে হঠাৎ অলকা চুপ হয়ে যায়। তারপর অচেনা ভঙ্গিতে ওঠে, ঢুকে যায় ঠাকুরঘরে। বেরিয়ে আসে। পরনে লাল পাড় পাটের শাড়ি, গলায় তারা-মালা, হাত ভরতি লাল রুলি। বেরিয়ে আসে আরও অচেনা ভঙ্গিতে। তার কেমন একটা ঘোর লাগে। শাঁ শাঁ করে সে যেন এক মায়াবী পথ দিয়ে ক্রমাগত ওপরে আরও ওপরে উঠতে থাকে। চলে যায় এক আলোময় ভিন্ন জগতে যেখানকার চলাফেরা বোধ বোধগম্যতা সবই অন্যরকম। সে পাক খায় এক অস্তিত্বহীন অন্য চরাচরে। কণ্ঠ আর এই কণ্ঠ থাকে না। হাত পা চলে অন্যকোনো নির্দেশে—এর চেয়ে বেশি আর কিছু সে জানে না।—এটুকুও সে অনেক চেষ্টায় মনে করে বলে অনেকবার জিজ্ঞাসার পরে, শুধুমাত্র তার ভাইকেই। তাই শেষপর্যন্ত তারাপ্রসাদকে ডিঙিয়ে শ্যামাপ্রসাদই দেবীর সেবায়েৎ হয়ে যায় এবং পট্টবস্ত্র পরা, তারা-মালা গলায়, লাল পলা পরা হাত দুটি যখন খড়গধারী পদ্মকোরক মুদ্রা রচনা করে তার কোলের উপর এসে থামে প্রবল হুড়োহুড়ির মধ্যেও জনতা টু শব্দ করে না, সেবায়েতের চোখের নির্দেশে কিউ করে, পুজো দেয় এবং সকাতরে প্রশ্ন করে—
প্রশ্ন 1। মা আমার চাকুরে ছেলে কেমন উড়-উড়। আলগা হয়ে যাচ্ছে মা, বড়ো কষ্ট করে মানুষ করেছি।
উত্তর . তোমার ছেলের ভিনজাতের প্রেমিকা, সত্বর মেনে নাও, নইলে ছেলে হারাবে-অলৌকিক স্বর বলে।
প্রশ্ন 2। মা ভাড়াটে কিছুতেই উঠছে না, মামলা করেছি, জিত হবে তো? উত্তর . কিছুমাত্র সত্য যদি তোমার পক্ষে থাকে তবেই।
প্রশ্ন 3। মা, স্বামী ইদানীং অফিসের কাজ বলে হপ্তায় দু-দিন বাড়ি ফিরছে না, সব সময়ে দুর্ব্যবহার করে।
উত্তর . লোকটি চরিত্র হারিয়েছে। দুরারোগ্য রোগ হবে। মার পায়ের কাছে নিয়ে আসতে পারলে রক্ষা হতে পারে।
এবং প্রণামি পড়ে। প্রণামির পাহাড়। দেশবিদেশ থেকে পত্র আসে, দুঃখ আসে, প্রশ্ন আসে। জবাব যায়। আশীর্বাদ যায়। প্রসাদি ফুল ও ফল বিতরণ হয় অকাতরে। এতদিনে বাড়িটি প্রকৃতই ঠাকুরবাড়ি হয়। দোতলা ওঠে। সেখানে বসবাস। নীচে মন্দির। সেখানে অধিষ্ঠিত দেবপ্রসাদের নিজ হাতে গড়া তারামূর্তি। পেছনে মায়ের বসনভূষণ সমেত পেটিকা। সেই পেটিকার তত্ত্বাবধায়ক তারাপ্রসাদ তারই মধ্যে একদিন আবিষ্কার করেন পিতার জীর্ণ ডায়েরিটি। কপালে ঠেকিয়ে পড়েন—মায়ের অষ্টমূর্তি—তারা, নীলসরস্বতী, ভদ্রকালী এবং কামেশ্বরী। মূল মূর্তি নীলকণ্ঠ মহাদেবকে স্তন্যপানরত মহালক্ষ্মীর। এভাবেই তিনি নীলকণ্ঠের বিষ দূর করেছিলেন। শিলাময় সেই স্বয়ম্ভ মূর্তিকে নাটোরের মহারানি ঢেকে দেন লোকরঞ্জিনী লোকপালিনী মূর্তি দিয়ে।
বিবর্ণ অক্ষরমালা, স্থানে স্থানে কালি ম্লান হয়ে গেছে, উদ্ধার করা দুঃসাধ্য। অনেক চেষ্টায় সেইসব বর্ণ উদ্ধার করেন একদিন তারাপ্রসাদ এবং বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যান। সাধক বলছেন, ইনি ব্রহ্মের পরাশক্তি। পঞ্চ মহাশূন্যে বিরাজ করতেন, আকাশ, মহাকাশ, পরাকাশ, তত্ত্বাকাশ ও সূর্যাকাশ। আমি তাঁকে তারা মূর্তিতে দেখেছি, গড়েছি, প্রতিষ্ঠা করেছি। তিনি প্রসন্না কিন্তু রক্তাভ বদনা, তাঁর জিহ্বা অগ্নিশিখার ন্যায়। চতুর্ভুজা ডান হস্তদ্বয়ে খড়গ কর্তরী ধারণ করে আছেন, বামহস্তদ্বয়ে কপালপাত্র ও পদ্মকোরক। কিন্তু মায়ের যে ধ্যান মূর্তি আমি দেখি তাতে পিঙ্গল জটা। কাল সুর্যের ন্যায় প্রখর ত্রিনয়ন। প্রজ্বলিত চিতাবহ্নি থেকে উর্থিতা হন তিনি। মহালক্ষ্মী মূর্তি দিয়ে সেই দুঃসহ ধ্যান মূর্তিকে আবৃত করলাম। কিন্তু লোকশিক্ষার জন্য মা যে-কোনো মুহূর্তে উগ্রা, উগ্রতারা, মহাউগ্রতারা হতে পারেন। বস্তুত শক্তির অষ্টরূপের এই অষ্টাঙ্গী মাতৃমূর্তি আমি দর্শন করেছি। যদি সত্য সাধক হই তো কোনো না কোনোদিন লোকপালিনী, লোকশাসনা এই মহাশক্তি আমার এই সাধনক্ষেত্রেই প্রকাশিত হবেন।… পাঠ শেষ করেই স্থাণু হয়ে থাকেন তারাপ্রসাদ। মুখময় বিন্দু বিন্দু স্বেদ।
যেদিন শনিবারের সন্ধ্যারাত্রে জ্যান্ত মা দুশ্চরিত্র লোকটির গালে প্রবল চপেটাঘাত করলেন এবং সে তাঁর পায়ে পড়ে মা মা করে কাঁদতে লাগল,
তারাপ্রসাদ ছেলেকে এবং স্ত্রীকে ডেকে পিতৃডায়েরির সেই পরম অর্থময় অংশগুলি পড়ে পড়ে শোনালেন।
শীতের বিকেল সন্ধেয় ঘনিয়ে আসছে দ্রুত। বৃহস্পতিবার। চারদিকে শাঁখ বাজছে। চুলে দীর্ঘ আলগা বিনুনি ঝুলিয়ে তার ফেভারিট চুনে হলুদ রংয়ের তাঁতের শাড়িটি পড়ে, গলায় সরু হার, কানে ছোটো মাকড়ি, হাতে বালা, সে বেরিয়ে আসে। পায়ের বাসি আলতা সাবান ঘষে ঘষেও তুলতে পারেনি। পিছনে পড়ে থাকে মন্দির, প্রণামি, সেবাইত, সে নির্বাধ বেরিয়ে পড়ে। কেউ বলে না, কোথায় যাচ্ছিস? কেউ বলে না, তাড়াতাড়ি ফিরিস।
ক্লাবে ক্যারাম খেলতে খেলতে কর্কশকান্তি তরুণের দল জানলা দিয়ে দেখতে পায়, শশব্যস্তে বেরিয়ে আসে, অলকাদি, একটু খেলা দেখে যাবে না? অলকাদি।
সে মৃদু হাসে, বলে, কাল আসব এখন, আজ যাই। রুবি বউদি, মণি বউদির বাড়ি লক্ষ্মীপুজোর নেমতন্ন আছে।
আশ্চর্য! এতগুলি আমন্ত্রিত মানুষ, অচেনা, আত্মীয়স্বজন রুবি বউদি মণি বউদির বাড়িতে। কেউ তো বলে না, এতবড়ো মেয়ে, বিয়ে হয়নি?
কেউ বলে না, কাদের বাড়ির মেয়ে? কী করে? কী পাস?
শুধু সসম্ভ্রম বিহ্বলতায় এ ওকে শুধোয়, কে? কে? কে? এ কে গো?
আসন
সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেল। দরদাম, দলিলদস্তাবেজ, ইনকামট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স, সব। সব হয়ে যাবার পর গলদঘর্ম বাড়ি ফিরে একটু জল গরম করে নিয়ে ঠাকুর্দার আমলের বাথটাবটাতে শুয়ে শুয়ে বিকেল সাড়ে তিনটেয় একটা লম্বা। অবগাহন স্নান। আ-ই। যেন অনেক দিনের পুরোনো পাপের বোঝা নেমে গেল। ঘাড় থেকে। শুধু স্নান নয়, শুচিস্নান। সত্যিই, পিছটান বলে তো কিছু নেই। শুধু আপনি আয় কপনি। তা আপনির ইচ্ছেমতো কপনি চলবে? না কপনির। ইচ্ছেমতো আপনি! এ ক-দিনের মধ্যে এই নিয়ে বোধহয় সাতবারের বার গুরুদেবের ছবির দিকে তাকিয়ে দু-হাত কপালে ঠেকাল সুনন্দা। স্থাবর সম্পত্তির বড়ো জ্বালা! বড়ো গুরুভার। হালকা হয়ে যে আকাশে পাখা মেলতে চায় ইট-কাঠ তার ঘাড়ের ওপর অনড় হয়ে বসে থাকলে সে বাঁচে কেমন করে? সবই গুরুদেবের কৃপা! বাড়িটা শেষ পর্যন্ত কিনতে রাজিই হয়ে গেল শরদ দেশাই। তিন শরিকের এক শরিকি অংশ। বাবা নিজের অংশটুকু ঢেলে সাজিয়ে নিয়েছিলেন তাই বাসযোগ্য ছিল এতদিন। সামনের উঠোন চৌরস করে ভেঙে খোলামেলা নিশ্বাস ফেলবার জায়গা খানিকটা। একটা আম গাছ, একটা নিম, সেগুলো ফেলেননি। নিম-আমের হাওয়া ভালো। তা ছাড়াও আমের কোঁকড়া পাতায় ফাগুন মাসে কেমন কচি তামার রং ধরে! বাকি জায়গাটুকু নানারকমের বাহারি গাছপাতা দিয়ে সাজানো। ফুল গাছ নয়, পাতাবাহার। বাবার শখের গাছ সব। না-বাগান না-উঠোন এই খোলা জায়গাটুকু পার হতে হতে দোতলার লাল টালি ছাওয়া বারান্দাখানা চোখে পড়বে। তার ওপর ছড়ানো বোগেনভিলিয়ার ফাগ আর মুক্তো রঙের ফুলঝুরি। মার্চ-এপ্রিল থেকে ফুল ফোঁটা শুরু হবে, চলবে সেই মে অবধি।
বারান্দাটা যেন বেশ বড়োসড়ো একখানা মায়ের কোল। তেমনি চওড়া, নিশ্চিন্ত। নির্ভয়। সুনন্দার নিজের মায়ের কোলটিও বেশ বড়োসড়ো ছাড়ালো দোলনার মতোই ছিল বটে। মনে থাকার বয়স পর্যন্ত সেই শীতল, গভীর কোলটিতে বসে কত দোল খেয়েছে সুনন্দা। তারপর মায়ের বোধহয় বড্ড ভারি ঠেকল। হাত-পা ঝেড়ে চলে গেলেন, ফিরেও তাকালেন না। টাকার সাইজের এক ধামি সাদা ময়দার গোল পিংপং বলের মতো লুচি সাদা আলুভাজা দিয়ে না হলে যে সুনন্দা রেওয়াজে বসতে পারে না এবং সে-জিনিস যে আর কারও হাত দিয়েই বেরোবার নয় সে-কথা মায়ের মনে থাকল না।
অনেকদিন আগলে ছিলেন বাবা। মায়ের কোল থেকে বাপের কাঁখ, সে তো কম পরিবর্তন নয়। ঈশ্বর জানেন বাবাকে মা হতে হলে স্বভাবের নিগুঢ় বাৎসল্য রসের চালটি পর্যন্ত পালটে ফেলতে হয়। তিনি কী তা পারেন? কেউ কী পুরোপুরি পারে? মায়ের জায়গাটা একটা বায়ুশূন্য গহ্বরের মতো খালি না থাকলে বুঝবে কেন সে কে ছিল। কেমন ছিল? বোঝা যে দরকার। মা হতে পারেননি, কিন্তু চেষ্টা করেছিলেন, তাই বাবা আরও ভালো বাবা, আরও পরিপূর্ণ বাবা হতে পেরে গিয়েছিলেন। পাঁচজন যেমন বউ মরলেই হুল দিয়ে থাকে তেমন দিয়েছিল বই কি! তিনি চেয়েছিলেন মাথায় আধ-ঘোমটা গোলগাল ছবিটির দিকে। চোখ দুটি ভারি উদাস, কিন্তু ঠোঁটের হাসিতে ফেলে-যাওয়া সংসারের প্রতি মায়া ষোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা। তারপর ফিরে তাকিয়েছিলেন ঘুমন্ত ফুলোফুলো মুখ, ফুলো-ঠোঁট আর বোজা চোখ দুটির দিকে। ঘুমের মধ্যে চোখের মণিদুটো পাতার তলায় কাঁপছে। আহা! বড়ো বনস্পতির বীজ। কিন্তু কত অসহায়! মাতৃকুলে যন্ত্রসংগীত পিতৃকুলে কণ্ঠসংগীত। সরু সরু আঙুলে এখনই কড়া পড়ে গেছে। ওইটুকুন-টুকুন আঙুল তার টেনে টেনে এমন নাজনখরা বার করে যে মনে হবে রোশেনারা বেগম স্বয়ং বুঝি হেরি গুনগুন করছেন।
মানুষের আপন পেটের বাপ-মা কি দুটো হয়? ভ্যাবলা মেরে-যাওয়া কন্যাদায়গ্রস্ত কিংবা হিতৈষীদের তাঁর এই একই উত্তর। নাও এখন মানে করো।
বালিকা থেকে কিশোরী, কিশোরী থেকে তরুণী, তরুণী থেকে যুবতি বাবা ঠায় কাঁধে মাথাটি নিয়ে। আয় ঘুম যায় ঘুম বর্গিপাড়া দিয়ে। একটি দিনের জন্যও ঢিলে দেননি। সনি নতুন শীত পড়েছে, বালাপোয়খানা বার কর, সুনি, আদা তেজপাতা গোলমরিচ দিয়ে ঘি গরম করে খা, গলাটা বড়ই ধরেছে, টানা তিন ঘন্টা রেওয়াজ হল সুনি, আজ যেন আর খুন্তি ধরিসনি, তোর বাহন যা বেঁধেছে তাই ভালো।
মাতৃহীন, অবুঝ, অভিমানী, তার ওপর অমন গুণী পিতৃদেব কিছুতেই আর বিয়ের জোগাড় করে উঠতে পারেন না। পাত্র ঠিক বলে তো পাত্রের বাড়ি যেন উলটো গায়। বাড়ি-ঘর ঠিক আছে তো পাত্র নিজেই যেন কেমন কেমন! অমন ধ্রুপদি বাপের সেতারি মেয়ের পাশে দাঁড়াবার যুগ্যি নয়। গুণীর পাশে দাঁড়াতে হলে গুণী যে হতেই হবে তার কোনো মানে নেই। কিন্তু সমঝদারিটাও না জানলে কি হয়? বাবার যদি বা পছন্দ হয়, মেয়ে তা-না-না-না করতে থাকে।
অমনি রাঙা মুলোর মতো চেহারা তোমার পছন্দ হল বাবা? সবসুদু ক-মণি হবে আন্দাজ করতে পেরেছ?
মেয়ের যদি বা পছন্দ হল তো বাপের মুখ তোম্বা হয়ে যায়, হলই বা নিজে গাইয়ে। দু-দিন পরেই কমপিটিশন এসে যাবে রে সুনি, তখন না জানি হিংসুটে কুচুটে তোর কী হাল করে!
এই হল সুনির বিবাহ বৃত্তান্ত। বেলা গড়িয়ে গেলেও উৎসুক পাত্রের অভাব ছিল না। কে বাগেশ্রী শুনে হত্যে দিয়ে পড়েছে, কে দরবারির আমেজ আর কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না। কিন্তু পিতা-কন্যার মন ওঠেনি। আসল কথা ধ্রুপদি পিতার ধ্রুবপদটি যে কন্যা! আর কন্যা তার পরজ-পঞ্চমের আরোহ-অবরোহ যখন ঘাট নামিয়ে-নামিয়ে বেঁধে নিয়েছিল পিতার সুরে, জীবনের সুরটিও তখনই ঠিক তেমনি করেই বাঁধা হয়ে গেছে।
বেলা যায়। বেলা কারও জন্যে বসে থাকে না। একটু একটু করে একজনের মাথা ফাঁকা হতে থাকে। আরেকজনের রুপোর ঝিলিক দেয় মাথায়। বাবার মুখে কালি পড়ে। শেষে একদিন পাখোয়াজ আর পানের ডিবে ফেলে উঠে আসেন শীতের মন-খারাপ-করা সন্ধ্যায়।
কী হবে মা, বেশি বাছাবাছি করতে গিয়ে আমি কি তোর ভবিষ্যৎটা নষ্ট করে দিলুম?
ঝংকার দিয়ে উঠল সুনন্দা, করেছই তো, খুব করেছ, বেশ করেছ! এখন তোমার ডিবে থেকে দুটো খিলি দাও দেখি, ভালো করে জর্দা দিও, কিপটেমি করো না বাপু! হেসে ফেলে মেয়ে। বাপের মুখের কালি কিন্তু নড়ে না।
অবশেষে সুনন্দা হাত-দুটো ধরে করুণ সুরে বলে, বাবা, একবারও কি ভেবে দেখেছো, আর কেউ সেবা চাইলে আমার সেতার, সুরবাহার, আমার সরস্বতী বীণ সইবে কীনা! এই দ্যাখো–কড়া পড়া দু-আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে সুনন্দা বলে, এই দ্যাখো আমার বিবাহচিহ্ন, এই আমার শাঁখা, সিঁদুর।
আমি চলে গেলে তোর কী হবে সুনি, আঁধার মুখে বাবা বললেন।
বাঃ, এই আমার একলেশ্বরীর শোবার ঘর, ওই আমার তেত্রিশ কোটি দেবতার ঠাকুরঘর, ও-ই আমার জুড়োবার ঝুলবারান্দা, আর বাবা নীচের তলায় যে আমার তপের আসন! আমি তো আপদে থাকব না! এমন সজ্জিত, নির্ভয় আশ্রয় আমার, কেন ভাবছ বলো তো?
বাবার মুখে কিন্তু আলো জ্বলল না। সেই আঁধার গাঢ় হতে হতে যকৃৎ ক্যান্সারের গভীর কালি মুখময়, দেহময় ছড়িয়ে পড়ল। অসহায়, কাতর, অপরাধী দু-চোখ মেয়ের ওপর নির্নিমেষ ফেলে রেখে তিনি পাড়ি দিলেন।
তারপরও দশ-এগারোটা বছর কোথা দিয়ে কেটে গেছে, সুনন্দা খেয়াল করতে পারেনি। রেডিয়োয়, টেলিভিশনে, কনফারেন্সে, স্বদেশে-বিদেশে উদ্দাম দশটা বছর। খেয়াল যখন হল তখন আবারও এক শীতের মন-খারাপকরা সন্ধ্যা। এক কনফারেন্সে প্রচুর ক্লিকবাজি করে তার প্রাপ্য মর্যাদা তাকে দেয়নি, চটুল হিন্দি ফিলমের আবহসংগীত করবার জন্য ডাকাডাকি করছে এক হঠাৎ-সফল সেদিনের মস্তান ছোকরা, যে গানের গ-ও বোঝে না, এখনও এই বয়সেও এক আধা বৃদ্ধ গায়ক এত কাছ ঘেঁষে বসেছিলেন যে টেরিউলের শেরওয়ানির মধ্যে আটকে পড়া ঘামের দুর্গন্ধ দামি আফটার শেভের সৌরভ ছাপিয়ে যেন নাকে চাবুক মেরেছে।
সামনের কম্পাউন্ডে নিমের পাতা আজ শীতের গোড়ায় ঝরে গেছে। আম্রপল্লবের ফোকরে ফোকরে শীতসন্ধ্যার কাকের চিকারি কানে তালা ধরায়, শরিকি বাড়ির ডান পাশ থেকে স্বামী-স্ত্রীর চড়া বিবাদী সান্ধ্য ভূপালির সুর বারবার কেটে দিয়ে যাচ্ছে। বাঁ দিকের বাড়ি থেকে কৌতূহলী জ্ঞাতিপুত্র বারান্দায় মুখ বাড়িয়ে থেকে থেকেই কী যেন দেখে যাচ্ছে। এত রাগ-রাগিণীর ঠাট মেল জানা হল, নিজের রক্তের এই রক্তবীজটি যে কোন ঠাটে পড়ে, কী যে ও দ্যাখে আর কেন যে, সুনন্দা তা আজও ধরতে পারল না। শিল্পী বাড়ির শরিক যে কী করে এত রাম-বিষয়ী হয়, তাও তার অজানা। দেখা হলেই বলবে, তোমাদের ড্রেনটা ভেন্ন করে ফ্যালো, আমি কিন্তু কর্পোরেশনে নোটিফাই করে দিয়েছি, এর পরে তুমি শমন পাবে। হয় এই, আর নয়তো বলবে, ইস মেজদি, চুলগুলো তোমার এক্কেবারেই পেকে ঝুল হয়ে গেল। বয়ঃ কত হল বলো তো!
চুল পেকে গেলে যে কী করে ঝুল হয় তা সুনন্দা জানে না। আর, বিসর্গ যে উচ্চারণ করতে পারে স উচ্চারণ করতে তার কেনই বা এত বেগ পেতে হবে, তা-ও জানে না। ও যেন যমের দক্ষিণ দুয়ার থেকে রোজ এসে একবার করে জানান দিয়ে যায়। এই যে মেজদি, তুমি হয়ে গেলেই আমার হয়ে যাবে।
সামনের ঝুপসি অন্ধকারের দিকে চেয়ে সুনন্দা হঠাৎ বলে উঠল, ধ্যাত্তেরি।
বারান্দার আরামচেয়ার থেকে সে উঠে পড়ে, শোবার ঘরে ঢুকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে তার একলার খাট-বিছানা, চকচকে দেরাজ-আলমারি, দেয়াল আয়নার গোল মুখ, আবার বলে-ধ্যাত্তেরিকা। পাশে ছোট্ট ঠাকুরঘর। সোনার গোপাল, কষ্টিপাথরের রাধাকৃষ্ণ এসব তাদের কুলের ঠাকুর। মার্বেলের শিব, কাগজমণ্ডের বুদ্ধ, পেতলের নটরাজ, এসব শেলফের ওপর, নানা ছাত্রছাত্রী, গুণমুগ্ধ অনুরাগীর উপহার। চারদিকে সাদা পঙ্খের দেয়াল, খালি, বড্ড খালি। সিলিং থেকে জানলার লিনটেল বরাবর বেঁকা একটা চিড় ধরেছে। সেই খালি দেওয়ালে একটি যোগীপুরুষের ছবি। সেই দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে শেষকালে সে বলে, তুমিই ঠিক। তুমিই সত্য। তুমিই শেষ আশ্রয়।
ড্রয়ারের ভেতরে ফাইল, ফাইলের ভেতর থেকে মধুরাশ্রম ছাপ মারা খামটা দিনের মধ্যে এই তৃতীয়বার সে তুলে নেয়।
মোটা সুতোর কাগজ। হাতের লেখা খুব জড়ানো। ঠাকুর এক বছর ধরে রোগশয্যায়। স্মিতমুখে শবের মতো টান-টান শয়ান। বুকের ওপর খাপ কাটা হেলানো লেখার ডেস্ক, মাথার দিকটা তোলা। ঠাকুর সিদ্ধদাস নিজ হাতে সুনন্দাকে এই চিঠি দিয়েছেন অন্তত ছ-মাস আগে।
সুরাসুরসিদ্ধাসু মা সুনন্দা,
তোমার সমস্যা নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ অনেক ভাবাভাবি করেছি মা। আমি ভাবার কেউ নয়, যাঁর ভাবনা তিনি ভাবছেন বলেই বুঝি তোমার সুরসমুদ্রটি এবার এমন স্রোত গুটিয়ে ভাঁটিয়ে চলল। তোমার হৃদয়ে যখন তাঁর ডাক। এমন করে বেজেছে তখন দরজা দু-হাতে বন্ধ রাখবে সিদ্ধদাসের সাধ্য কী? তুমি এসো। মনের সব সংশয়, দ্বিধা ছিন্ন করে চলে এসো। বিষয়সম্পত্তি তুমি যেমনি ভালো বুঝবে, তেমনি করবে। আশ্রমে খাওয়া-থাকার জন্য নামমাত্র প্রণামি দিতে হয়। সে তো তুমি জানোই। এখানে বরাবর বাস করতে গেলে লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরার বিধি। নিজের পরিধেয়র ব্যবস্থা তুমি নিজেই করবে। খালি এইটুকু মনে রেখো মা, তোমার বস্ত্র যেন অন্য আশ্রমিকাদের ছাড়িয়ে না যায়। তোমার যন্ত্র সব অবশ্যই আনবে মা। তাঁর আশ্রম স্বর্গীয় সুরলাবণ্যে ভরিয়ে তুলবে, তাতে কি আমি বাধা দিতে পারি? তোমার সিদ্ধি সুরেই। সে তুমি এখানেই থাকো, আর ওখানেই থাকো। আমি ধনঞ্জয়কে তোমার ঘরের ব্যবস্থা করে রাখতে বলছি। আসার দিনক্ষণ। জানিয়ো। গাড়ি যাবে। শ্রীভগবানের আশীর্বাদ তোমার ওপর সর্বদা থাকে প্রার্থনা করি।
সিদ্ধদাস
চিঠিটা কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ ঠাকুরঘরে জোড়াসনে বসে থাকে সুনন্দা। তারপর আস্তে আস্তে ওঠে। ঠাকুরকে ফুল জল দেয়, দীপ জ্বালে। ধূপ জ্বালে। একলা ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে, কালো পাথরের চকচকে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামে। নিচের ঘরের তালা খুলে সুইচ টিপে দেয়। অমনি চারদিক থেকে ঝলমল করে ওঠে রূপ। আহা। কী রূপ, কত রূপ! কাচের লম্বা চওড়া শোকেসে শোয়ানো যন্তরগুলো। সবার ওপরে চড়া-সুরে-বাঁধা তার হালকা তানপুরা। পরের তাকে ঈশ্বর নিবারণচন্দ্র গোস্বামীর নিজ হাতে তৈরি, তার ষোলো বছর বয়সে বাবার উপহার দেওয়া তরফদার সেতার। তারপর লম্বা চকচকে মেহগনি রঙের ওপর হাতির দাঁতের সূক্ষ্ম কারুকাজ করা সুরবাহার। আর সবার শেষে, একেবারে নীচের তাকে অপূর্ব সুন্দর সমান সুগোল দৈবী স্তনের মতো ডবল তুম্বি শুদ্ধ সরস্বতী বীণ। তানসেনের কন্যা সরস্বতীর নামে খ্যাত সুগম্ভীর গান্ধবী নাদের বীণা। ডানদিকে নীচু তক্তপোশে বাবার খোল, মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ। কোণে বিখ্যাত শিল্পীর তৈরি কাগজের সরস্বতী মূর্তি-কাগজ আর পাতলা পাতলা বেতের ছিলে। বাঁ-দিকে শ্বেতপাথরের বর্ণহীন-সরস্বতী, গুরুদেব জববলপুর থেকে আনিয়ে দিয়েছিলেন। বলতেন অবর্ণা মা। এই মূর্তির সানুদেশ ঘেঁষে মেঝের ওপর সমুদ্রনীল কার্পেট। তার ওপর সাদা সাদা শুক্তি-ছাপ। পাশেই আর একটি নীচু কাচের কেসে তার শেখাবার সেতার এবং ডবল ছাউনির টঙটঙে তবলা। ঘরের মাঝখানে নীচু নীচু টেবিল-সোফা-মোড়ায় বসবার আয়োজন। মায়ের হাতের নকশা করা চেয়ার-ঢাকা, কুশন-কভার এখনও জ্বলজ্বল করছে।
সুনন্দা এই সময়ে রেওয়াজে বসবার আগে এ ঘরেও দীপ ধূপ জ্বালিয়ে দেয়। ঘর খুলতেই যেন কতকালের ধূপগন্ধ তার নাকে প্রবেশ করল। অগুরু গন্ধে আমোদিত ঘর। মার্বেলের প্রতিমার সামনে দীপগাছ জ্বালিয়ে বিজলিবাতি নিবিয়ে দিল সুনন্দা। আধা-অন্ধকার ঘর যেন গন্ধর্বলোক। বাবার পাখোয়াজের বোল কি শুনতে পাচ্ছে সুনন্দা? না, না, সেখানে শুধু ইষ্টনাম। শুনতে পাচ্ছে কি গুরুজির সেই অনবদ্য বঢ়হত, আচার, মন লুটিয়ে দেওয়া তারপরন? দীপালোকে অস্ফুট ঘরে প্রতিমার সামনে আসনপিড়ি হয়ে বসেছে সুনন্দা। হাতে নিবারণ গোঁসাইয়ের সেতার। সোনালি রূপালি তারে মেজরাপের ঝংকার। রাগ দেশ। গুরুজি সিদ্ধ ছিলেন এই রাগে। সেতার ধরলেও যা সুরবাহার ধরলেও তা। বীণকারের ঘরের বাজ। সুরে ডুবে ডুবে বাজাতেন। আলাপাঙ্গে তাঁর অসীম আনন্দ। আলাপ থেকে জোড়, মধ্য জোড়, ডুব সাঁতার কেটে চলেছেন। নদীর তলাকার ভারী জল ঠেলতে ঠেলতে গতের মুখটাতে এসে যখন তেহাই মেরে ভেসে উঠতেন তখন আঙুলে সে কী জলের উল্লাস! অনেকদিনের স্বপ্ন বুঝি আজ সত্য হল। যা ছিল রূপকথার কল্পনাবিলাস তা বুঝি ধরা পড়ে গেল প্রতিদিনের দিনযাপনের ছন্দে রূপে। এমনিই ছিল গুরুজির বাজের তরিকা। কনফারেন্সে বাজাতে চাইতেন না। অভ্যাস ছিল নিজের গুরুদেবের ছবির সামনে বীণ হাতে করে বসে থাকা। কিংবা। গুটিকতক নিষ্ঠাবান তৈরি ছাত্রছাত্রী ও সমঝদারের সামনে আনন্দসত্র খুলতেন। বলতেন, আজ তোদের কাঁদিয়ে ছাড়ব। লুটিয়ে লুটিয়ে কাঁদবি বাবারা।
কিন্তু সুনন্দা আজ জানতেই পারল না কখন তার দেশ তিলককামোদ-এর রাস্তা ঘুরে ঘুরে বৃন্দাবনি সারঙের মেঠো সুর তুলতে লেগেছে। একেবারে অন্যমনস্ক। ক-দিন ধরেই এই হচ্ছে। দিন না মাস! মাস না বছর! সুনন্দা যেখানকার সেতার সেখানে শুইয়ে রেখে হাত জোড় করে বলল, আমি চললুম, আমার মাফ করো। অবর্ণা সরস্বতীর দিকে ফিরে বদ্ধাঞ্জলি আবারও বলল, পারলে ক্ষমা করো, আমি চললুম।
মধুরাশ্রমে ধনঞ্জয়ের সাজানো ঘরে, নিশ্বাসে মালতীফুলের গন্ধ আর দু-চোখ ভরা তারার বৃষ্টি নিয়ে তবে যদি এ হাতে আবার সুরের ফুল ফোটে। আর যদি না-ই ফোটে তো না ফুটুক। অনেক তো হল। আর কিছু ফুটবে। এই আর কিছুর জন্যে সে বড়ো উন্মুখ হয়ে আছে।
২.
মধুরাশ্রমে ঢোকবার গেট বাঁশের তৈরি? তার ওপরে নাম-না-জানা কী জানি কি নীল ফুলের বাহার। মধুরে মধুর। জমিতে মধু, হাওয়ায় মধু, জলে মধু। ভেতরে দেখ বিঘের পর বিঘে বাগান, ফলবাগান, ফুলবাগান, সবজিবাগান। প্রতি বছরেই একবার করে এখানে এসে জুড়িয়ে যায় সুনন্দা। কোলাহল নেই। না যানের, না যন্ত্রের, না মানুষের। নিস্তব্ধ আশ্রম জুড়ে শুধু সারাদিন বিচিত্র পাখির ডাক। সন্ধান দিয়েছিল আজ দশ-এগারো বছর আগে–মমতা বেন। এক ছাত্রী। মমতার বাপের বাড়ির সবাই সিদ্ধদাসের কাছে দীক্ষিত। বাবার মৃত্যুর পর তখন সেই সদ্য সদ্য সুনন্দার মধ্যে একটা হা-হা শূন্যতা তেপান্তরের মাঠের মতো। সব শুনে বুঝে ছাত্রী মমতা গুরুগিরি করল। ঠাকুর সিদ্ধদাসের হাতের ছোঁয়ায় অনেকদিনের পর সেই প্রথম শান্তি।
দেশাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগও মমতার মাধ্যমে। মধুরাশ্রমে যখন মন টানল তখন। শরিকি বাড়ির অংশটুকু নিয়ে মহা মুশকিলে পড়েছিল সুনন্দা। মোটে আড়াই কাঠার বাস্তু, তার ওপরে তো আর জগদ্দল কংক্রিট-দানব তৈরি করা যাবে না, সুতরাং পোমোটারে ছোঁবে না। যারা বাস করবার জন্য কিনতে চায় তারাও দুদিকে শরিকি দেয়াল দেখে সরে পড়ে। জমির দাম আকাশ-ছোঁয়া। কে আর লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিবাদ-বিসংবাদ কিনতে চায়? এইরকম হা-হতোস্মি দিনে মমতা বেন দেশাইয়ের খোঁজ দিয়েছিল। কোটিপতি ব্যবসায়ী, কিন্তু সমাজসেবার দিকে বিলক্ষণ নজর। সোশ্যাল সার্ভিস সেন্টার খুলবে। একটা ছোটোখাটো বাড়ি কিনতে চায়। পরিবার-পরিকল্পনা, ফার্স্ট এড, শিশুকল্যাণ ইত্যাদি ইত্যাদি। সুনন্দার বাড়ি তার খুব পছন্দ হয়ে গেল। বসবার ঘরটাকে পার্টিশন করেই তিনটি বিভাগ খুলে দেওয়া যায়। ভালো দাম দিল দেশাই।
সবটুকুই সামলাল মমতা আর তার স্বামী। সমস্ত আসবাবসমেত বাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছে সুনন্দা। মায়ের বিয়ের আলমারি, খাট, দেরাজ, সোফাসেট, রাশি রাশি পুতুল আর কিউরিকো-ভর্তি শোকেস, বাহারি আয়না, দেওয়ালগিরি, ঝাড়বাতি, সমস্ত সমস্ত। শ্বেতপাথরের সরস্বতী প্রতিমাটি মমতাকে সে উপহার দিয়েছে। বেত-কাগজের শিল্পকীর্তি দেশাইয়ের বড়ো পছন্দ। তার নিজস্ব বাড়ির হলঘরে থাকবে। বিক্রিবাটার পর যতদিন সুনন্দা থেকেছে, বাড়ি যেমন ছিল তেমনি। আশপাশের কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি কিছু।
ঠাকুরঘরের ফাটল আর শোবার ঘরের বাঁ কোণে চুইয়ে-পড়া জলের দাগটার, দিকে তাকিয়ে সুনন্দা মনে মনে ভেবেছিল, বাববাঃ, এসব কি একটা একলা মেয়ের কম্মো! ওই ছাদ কতবার হাফ-টেরেস হল, টালি বসানো হল, তা সত্ত্বেও জল চোয়াচ্ছে দেখে মাঝরাত্তিরে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠেছিল সে। এখন বেশ ঝাড়া হাত, ঝাড়া পা, পরনে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি আর হাতে সেতার, বাঃ!
এবার যেন মধুরাশ্রম আরও শান্তিময় লাগল। গুরুভাই ধনঞ্জয় সেই ঘরটাই ঠিক করে রেখেছে যেটাতে সে প্রত্যেকবার এসে থাকে। সরু লম্বা। ছয় বাই বারো মতো ঘরটা। ঢাকবার নীচ দরজা সবজ রং করা। উলটো দিকে চার পাল্লার জানলা। খুলে দিলেই বাগান। এখানকার সবাই বলে মউ-বাগান। মউমাছির চাষ হয় ফুলবাগানের এই অংশে। ঘরের মধ্যে নীচু তক্তাপোশে শক্ত বিছানা। একপাশে সেতার রেখে শুতে হবে। একটিমাত্র জলচৌকি। ট্রাঙ্ক সুটকেস রাখতে পার, সেসব সরিয়ে লেখার ডেস্ক হিসেবেও ব্যবহার করতে পার, কোণে চারটি ইটের ওপর মাটির কুঁজো। আশ্রমের ডিপ টিউবওয়েলের জল ধরা আছে। ঘরের বাইরে টিউবওয়েলের জলে হাত-পা ধুয়ে পাপোশে পা মুছে, কুঁজো থেকে প্রথমেই এক গ্লাস জল গড়িয়ে খেল সুনন্দা। আহা! যেন অমৃত পান। ধনঞ্জয় বলল, দিদি, ঠাকুরের সঙ্গে যদি দেখা করবেন তো এই বেলা।
ট্রেনের কাপড় ছেড়ে সঙ্গে আনা বেগমপুরের লালপেড়ে শাড়িটা পরে দাওয়া পেরিয়ে ঠাকুর সিদ্ধদাসের ঘরে চলল সুনন্দা। চারদিকে খোলা আকাশ, একেবারে টইটম্বুর নীল। সেই আকাশটা তার রং, তার ব্যাপ্তি, তার গাঢ়তা আর গভীরতা নিয়ে ফাঁকা বুকের খাঁচাটার মধ্যে ঢুকে পড়ছে টের পেল সে। প্রণাম করল যে, আর প্রণাম পেলেন যিনি উভয়েরই মুখ সমান প্রসন্ন। সিদ্ধদাস বললেন, মা খুশি হয়েছ তো? আলোকিত মুখে জবাব দিল সুনন্দা।
ঠাকুর সিদ্ধদাস তাঁর পুবের ঘরের আসন থেকে বড়ো একটা নড়েন না। ব্রাহ্মমুহূর্তে একবার, সন্ধ্যায় একবার আশ্রমের চত্বর বাগান ঘুরে আসেন। নিত্যকর্মের সময়গুলো ছাড়া অন্য সময়ে তিনি তাঁর আসনে স্থির। ভোরবেলা তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় সুনন্দার। সে-ও সে সময়টা বেড়াতে বেরোয়। কিন্তু তখন সিদ্ধদাস তদগত তন্ময়। কারও সঙ্গে কথা বলেন না, হনহন করে খালি হেঁটে যান। কে বলবে ক-মাস আগেও কঠিন রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন!
এখানকার দিনগুলি যেন বৈদিক যুগের। শান্তরসাস্পদ। পবিত্র, সরল, উদার, সুগন্ধ। একটু কান খাড়া করলেই বুঝি মন্ত্রপাঠের ধবনি শোনা যাবে। নাসিকা আরেকটু গ্রহিষ্ণু হলেই যজ্ঞধুমের গন্ধ পাওয়া যাবে। যেন জমদগ্নি, শ্বেতকেতু, নচিকেতা, উপমন্যু এই বনবাগানের অন্তরালে কোথাও না কোথাও নিজস্ব তপস্যায় মগ্ন। কিন্তু কী আশ্চর্য, আশ্রমের রাতগুলি যে আরব্য উপন্যাসের! তারার আলো কেমন একটা রহস্যজাল বিছিয়ে দেয় রাত আটটা নটার পরই। কে যেন ড্যাঁও ড্যাঁও করে রবারের তাঁতের তারে চাপা আওয়াজ তোলে, চুমকি বসানো পেশোয়াজ, ওড়না সারা আকাশময়, ঘুঙুর পায়ে উদ্দাম নৃত্য করে কারা, হঠাৎ কে তীব্র স্বরে চিৎকার করে বলে খামোশ! একদিন দু-দিন করে মাস কেটে গেল। আকাশে বাতাসে চাপা রবাবের আওয়াজ শুনে শুনে সুনন্দা আর থাকতে পারে না। ব্রাহ্মমুহূর্তে বেড়াতে বার হয় না সে, চৌকির ওপর বিছানা গুটিয়ে রাখে। সদ্যতোলা গোলাপফুল রেকাবির ওপর রেখে অদৃশ্য সরস্বতী মূর্তিটির উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে সেতারের তারে মেজরাপ ঠেকায়। ললিতে আলাপ। মন্দ্র সপ্তকে শুরু। খরজের তারে অভ্যাস মতো হাত চালায়, টাঁই আওয়াজ করে তার নেমে যায়, নামিয়ে তারগুলোকে আবার টেনে বাঁধে সুনন্দা। কান লাগিয়ে লাউয়ের ভেতরের অনুরণন শোনে। আবার আলাপ ধরে! তারগুলি কিন্তু সমানে বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে, সুনন্দার তর্জনী আর মধ্যমার তলায় যেন কিলবিল করছে অবাধ্য, সুর-ছাড়া, সৃষ্টিছাড়া কতকগুলো সাপ, জোর হাতে কৃন্তন লাগাতে গিয়ে আচমকা ছিঁড়ে যায় তার।
সন্ধ্যাবেলায় ঠাকুরের ঘরের ধ্যানের আসর থেকে নিঃশব্দ পায়ে উঠে আসে সুনন্দা। সকালবেলাকার সেই ছেড়া তার যেন আচমকা তার বুকের মধ্যে ছিটকে এসে লেগেছে। সারি সারি নিস্তব্ধ, তন্ময় গুরু ভাইবোনেরা। কেউ লক্ষও করে না। কিন্তু তার মনে হয় ধূপজ্বলা অন্ধকারের মধ্য থেকে জোড়া জোড়া ভুরু তার দিকপানে চেয়ে কুঁচকে উঠছে।
রাতে তার ঘুম আসে না। সকালের ডাকে কলকাতার চিঠি এসেছে। অন্তরঙ্গ এক সহকর্মী দুঃখ করে লিখেছেন, তিনি ছিলেন না বলেই সুনন্দা এমন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। তিনি থাকলে নিশ্চয় বাধা দিতেন। কেন যে এ কথা লিখেছেন পরিষ্কার করে বলেনি। সুনন্দার ভালোমন্দ সুনন্দা কি নিজে বোঝে না! জানালা দিয়ে কত বড়ো আকাশ দেখা যাচ্ছে। শহরের সেই গলির বাড়িতে এত বড় আকাশ অকল্পনীয় ছিল। আস্তে আস্তে মনটা কী রকম ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে ওই আকাশে, তার যেন আর কোনো আলাদা অস্তিত্ব থাকছে না। কিছুতেই তাকে গুটিয়ে নামাতে পারছে না সে আঙুলে।
মাস তিনেকের মাথায় সিদ্ধদাস নিভৃতে ডেকে পাঠালেন, মা, খুবই কি সাধনভজন করছ?
সুনন্দা চুপ।
তোমার বাজনা শুনতে পাইনে তো মা!
বাজাই না ঠাকুর।
চমকে উঠলেন সিদ্ধদাস, বাজাবার কি দরকার হয় না মা? এমন দিন আসা অসম্ভব নয় যখন বাজাবার দরকার আর হয় না, মন আপনি বাজে।
আমার সে দিন তো আসেনি! সুনন্দা শুকনো মুখে বলল, আঙুলে যেন আমার পক্ষাঘাত হয়েছে। হাত চলে না। সুর ভুলে যাচ্ছি, হৃদয় শুষ্ক, সুনন্দার চোখ দিয়ে এবার অধৈর্য কান্না নামছে, অপরাধ নেবেন না ঠাকুর, কিছু ভালো লাগছে না, সব যেন বিষ, তেতো লাগছে সব।
সিদ্ধদাস বললেন, অপরাধ কি নেব! তুমিই আমার অপরাধ মার্জনা করো মা। তোমাকে সঠিক পথ দেখাতে পারিনি। কিছুদিন ধরেই শুনতে পাচ্ছি, তুমি খাচ্ছ না ভালো করে, ঘর ছেড়ে বেরোও না, ধ্যানের সময়ে আস না। মন অস্থির চঞ্চল হয়েছে বঝেছি। তুমি আর কিছুদিন অপেক্ষা করো, একটা না একটা উপায় বার হবেই, আশ্রম কখনও তোমাকে জোর করে ধরে রাখবে না। তোমার যেখানে আনন্দ, তাঁরও যে আনন্দ সেইখানেই।
সেই রাত্রে অনেক ছটফট করে ঘুমিয়েছে সুনন্দা, দেখল সে সমুদ্রের ওপর বসে বাজাচ্ছে। বার বার ঢেউয়ে ডুবে যাচ্ছে, আবার ভেসে উঠছে। বিশাল তুম্বি সুন্ধু বীণ বারবার তার সিল্কের শাড়ির ওপর দিয়ে পিছলে যাচ্ছে। খড়খড়ে তাঁতের কাপড় পরে এল সে। বীণে মিড় তুলেছে। পাঁচ ছয় পর্দা জোড়া জটিল মিড়। কার কাছে কোথায় যেন শুনেছিল। কিছুতেই পারছে না। বীণ শুধু ডাঁও ডাঁও করে মত্ত দাদুরির মতো আওয়াজ তুলে চলেছে, হাত থেকে ছটাং ছটাং করে তার বেরিয়ে যাচ্ছে। এক গা ঘেমে ঘুম ভেঙে গেল, বীণ কই? সুরবাহার কই? সেসব তো
এখনও আসেইনি! আঁচল দিয়ে সেতার মুছে দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইল সুনন্দা। শেষ রাতে আবার চোখ জড়িয়ে এসেছে। আবারও সেই স্বপ্ন। সমুদ্রের ওপর বীণ হাতে একবার ডুবছে, একবার ভাসছে। হাত থেকে বীণ ফসকে যাচ্ছে। ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে কেঁদে উঠল সুনন্দা।
দরজার কড়া নড়ছে জোরে। ঝাঁকাচ্ছে কেউ। খুলতেই সামনে মমতা।
সারা রাত কী বৃষ্টি! কী বৃষ্টি! এখানে পৌঁছে দেখি বালি মাটির ওপর দিয়ে সব জল কী সুন্দর সরে গেছে, মমতা একগঙ্গা বকে গেল, তারপর অবাক হয়ে বলল, একি সুনন্দাদি, কাঁদছ কেন?
সুনন্দা চোখের জল মুছে বলল, তুই হঠাৎ? কী ব্যাপার? আমার বীণ নিয়ে এসেছিস?
মমতা বলল, ব্যাপারই বটে সুনন্দাদি। বীণ আনব কি? গোটা বাড়িটাকেই বুঝি তুলে আনতে হয়।
ঘরে এসে বসল মমতা, শোনো সুনন্দাদি রাগ কোরো না। দেশাই তোমার বাড়ি নিতে চাইছে না। বলছে ওখানে ভূত আছে। রি-মডেলিং করার আগে যোশী আর দেশাই ক-দিন তোমার নীচের ঘরে শুয়েছিল, অমন সুন্দর ঘরখানা তো! তা সারা রাত বাজনা শুনেছে।
যাঃ, সুনন্দা অবাক হয়ে গেছে, কী বাজনা।
ওরা কি অত জানে! খালি বাজনা, কত বাজনা। ঘুম আসলেই শোনে, চোখ মেললেই সুর মিলিয়ে যায়। ঘরের একটা জিনিসও সরাতে পারেনি।
কেন? মমতাকে দুহাত দিয়ে চেপে ধরেছে সুনন্দা।
কেন আর? কিছুই না জিনিস সরাতে গেলেই অমন কাঠখোট্টা ব্যবসাদারেরও মনে হয় আহা থাক। বেশ আছে, বড়ো সুন্দর আর ক-দিন যাকই না।
সুনন্দা বলল—তুই বলছিস আমার ঘর যেমন ছিল তেমনি আছে?
শুধু ঘর নয় গো। বাড়ি আসবাব যা যেখানে ছিল, সেখানেই আছে।
সুনন্দা হঠাৎ উত্তেজিত পায়ে বাইরে ছুটল, ধনঞ্জয়! ধনঞ্জয়!
কী দিদি!
আমি আজকের গাড়িতেই কলকাতা যাচ্ছি। আমার বাজনা প্যাক করে তুলে দেবার ব্যবস্থা করো ভাই।
বৃষ্টি ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে ঘরে ফিরছেন ঠাকুর সিদ্ধদাস। উদভ্রান্ত সুনন্দা উল্কার মতো ছুটে আসছে।
ঠাকুর ঠাকুর, আমি বাড়ি ফিরছি, বাড়ি।
স্মিতমুখে ডান হাত তুলে সিদ্ধদাস বললেন, স্বস্তি স্বস্তি।
কেউ নেই এখন। কেউ না। না তো। ভুল হল। আছেন। অবর্ণা, বর্ণময়ী আছেন। সর্বশুক্লা। তাই লক্ষ সুরের রংবাহার তাঁর পায়ের কাছে মিলিয়ে গিয়ে আরও লক্ষ সুরের আয়োজন করে। সেতার নামিয়ে আজ বীণ তুলে নিয়েছে সুনন্দা। গুরুজির শেষ তালিম ছিল বীণে। বলতেন নদী তার নাচনকোঁদন সাঙ্গ করে সমুদ্রে গিয়ে মেশে বেটি, বীণ সেই সমুন্দর সেই গহিন গাঙ। বীণ তক পঁহুছ যা। সুনন্দা তাই বীণে এসে পৌঁছেছে। মগ্ন হয়ে বাজাচ্ছে, হাতে সেই স্বপ্নশ্রুত মিড়। সুরের কাঁপনে বুকের মধ্যে এক ব্যথামিশ্রিত আনন্দ, তবুও মিড়ের সূক্ষ্ম জটিল কাজ কিছুতেই আসছে না। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, সুনন্দা অসম্পূর্ণ সুরের জাল বুনেই চলেছে, বুনেই চলেছে। খোলা দরজা, বাইরের ছায়াময় উঠোন বাগান দেখা যায়। কিন্তু সুর বন্দিনির মতো গুমরে গুমরে কাঁদছে ঘরময়। কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছে না। সেই সঙ্গে মুক্তি দিচ্ছে না তাকেও, দরদর করে ঘাম নামছে, ঘাম না কি চোখের জল যা দেহের রক্তের মতোই গাঢ়, ভারী! পরিচিত জুতোর শব্দ। খোলা দরজা দিয়ে গুরুজি এসে ঢুকলেন, বললেন, সে কী? এতক্ষণেও পারছিস না বেটি। এই দ্যাখ। চট করে দেখিয়ে দিলেন গুরুজি। কয়েকটা শ্রুতি ফসকে যাচ্ছিল। স্মৃতির কোণে কোথায় লুকিয়ে বসেছিল। গুরুজি তাদের টেনে আঙুলে নামিয়ে আনলেন। সুনন্দা বাজিয়ে চলেছে। হুঁশ নেই আনন্দে। গুরুজি যে চলে যাচ্ছেন, ওঁকে যে অন্তত দুখিলি পান দেওয়া দরকার সে খেয়ালও তার নেই। যাবার সময়ে বলে গেলেন, আসন, বেটি। আসন! তুই যে আসনে ধ্যান লাগিয়েছিস, তুই ছাড়লেও সে তোকে ছাড়বে কেন? বলতে বলতে গুরুজি মসমস করে চলে গেলেন। হঠাৎ দেয়ালঘড়িতে ঢং ঢং করে দুটো বাজল। সুনন্দা যেন এতক্ষণ ঘোরে ছিল। সে বীণ নামিয়ে উঠে দাঁড়াল। গুরুজি এসেছিলেন এত রাত্রে? সে কি? পান? অন্তত দু খিলি পান…কাকে পান দেবে? গুরুজি তো বাবা যাবার তিন বছর পরেই কাশীতে…।
চারদিকে চেয়ে দেখে সুনন্দা। খোলা দরজায় এসে দাঁড়ায়। নিমের পাতায় হু হু জ্যোৎস্না। কোথাও কারও চিহ্ন নেই। দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিল সে, তারপর তীব্র ভঙ্গিতে এসে বীণ তুলে নিল। মিড় তুলল। সেই জটিল, অবাধ্য মিড়। হ্যাঁ। ঠিকঠাক বলছে। অনেক দিনের স্বপ্নের জিনিস তুলতে পেরে এখন সুনন্দার হাতে সুরের জোয়ার। আরও মিড়, জটিলতর, আরও ব্যাপ্ত, আরও প্রাণমন কাঁদানো, সব মানুষের মধ্যেকার জাত-মানুষটাকে ছোঁবার মিড়। গুরুজি সত্যি এসেছিলেন কি আসেননি তৌল করতে সে ভুলে যায়। সে তার আসনে বসেছে, তার নিজস্ব আসন। সমুদ্র নীলের ওপর বড়ো বড়ো শুক্তি ছাপ। সাত বছর বয়স থেকে এই আসনে বসে সে কচি কচি আঙুলে আধো আধো বুলির মতো কত সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম নাজ নখরা ফুটিয়েছে ত্রিতন্ত্রী বীণায়। ঠিক যেমনটি কেসর বাই কি রোশেনারার রেকর্ডে শুনেছে। অবর্ণা দেবীমূর্তির দিকে মুখ করে, কিন্তু নতমুখ আত্মমগ্ন হয়ে, সারারাত সুনন্দা সমুদ্রের দিকে চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। পাশে শোয়ানো সেতারের তরফের তারগুলি ঝংকৃত হয় থেকে থেকে। কাচের কেসের ডালা খোলা। সেখান থেকে সরু মোটা নানান সুরে আপনা আপনি বেজে ওঠে সুরবাহার, তানপুরা।
কে আছে দাঁড়িয়ে এই সুরের পারে? তারের ওপর তর্জনীর আকুল মুদ্রায় প্রশ্ন বাজতে থাকে। কে আছে? কে আছ? ঝংকারের পর ঝংকারে উত্তর ভেসে আসে। সুর। আরও সুর। তারপরে? আরও সুর। শুধুই সুর। ধু ধু করছে সুরের কান্তার। ঠিক আকাশের মতোই। তাকে পার হবার প্রশ্ন ওঠে না। শুধু সেই সুরের ধুলি বৃন্দাবন রজের মতো সর্বাঙ্গে মাখো। সেই সুরের স্রোতে ভেসে যাও, আর সুরের আসনে স্থির হয়ে বসো। মন রে, তুই সুরদীপ হ।
ইউলিসিসের কুকুর
There, full of vermins he lay abandoned on the heaps of dung.
বড়ো বড়ো মানুষদের নামে এখন আমাদের রাস্তা-ঘাট-পার্ক-ময়দান-সদন সরোবর-স্টেডিয়াম। বেশিরভাগই উনিশ থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়কার আমাদের গৌরব, আমাদের জনক, ঐতিহ্য, পিতৃপুরুষ। এইভাবেই তাই তর্পণ করি। পুরোনো নামের রাস্তা হয়ে যায় মহাত্মা গান্ধি রোড, রবীন্দ্র সরণি, শরৎ বসু রোড, নেতাজি সুভাষ রোড। নতুন প্রমোদ ভবন, মঞ্চ হয়, নাম দিই রবীন্দ্রসদন, নজরুলমঞ্চ, শিশিরমঞ্চ। সাদার্ন অ্যাভেনিউয়ের নামে ব্রিটিশ রাজের কোনো গন্ধ ছিল না, তবু সে রাস্তা এখন আমাদের জাতির অহংকার মেঘনাদ সাহার নামে। এই মেঘনাদ সাহা সরণির মোটামুটি মাঝখানে শরৎ বসু রোড আর কেয়াতলার মাঝামাঝি জায়গায় আমরা থাকি। লেকের দিকে মুখ। মা, দাদা, বউদি, টুটুল আর আমি। ছিমছাম শান্তির সংসার আমাদের। বাস, ট্যাক্সি, গাড়ি, অটো অনবরত ছুটে চলেছে এপার-ওপার দুটো রাস্তা দিয়েই। তবু আমরা নিরিবিলির স্বাদ পাই। কেননা, থাকি এগারো তলায়। এত ওপর থেকে লেকসমেত পুরো দক্ষিণ শহরতলিটাই মানচিত্রের মতো চোখের তলায় বিছিয়ে থাকে। এত গাছ! এত গাছ! আর এত সবুজ। এ যেন ধুলো-ধোঁয়া-আবর্জনার কলকাতাই নয়, প্রথম পৃথিবীর কোনো সবুজ নগর সভ্যতা। বাস্তবিকই এখান থেকে কলকাতাকে বড়ো সুঠাম দেখায়। গাছ-গাছালির মাঝসাঝ দিয়ে কখনও দেখা দিতে দিতে কখনও দেখা না দিতে দিতে এলিয়ে থাকে লেকের চিকচিকে চিকন বাহুলতা। লেকের ভেতরে দ্বীপ। সুন্দর অঙ্গদের মতো। শুনতে পাই লেকের জল আজকাল দূষিত হয়ে গেছে। তীরভূমির সুন্দর কোথাও বা নষ্ট হয়ে গেছে নোংরামিতে, মস্তানিতে। কিন্তু এত উঁচু থেকে সেসব বোঝা যায় না। সুন্দরটুকু আর সুঠামটুকুই চোখে ভেসে থাকে। চোখ থেকে প্রবেশ করে হৃদয়ে, মগজে। এমন একটা শান্তি ছড়াতে থাকে যে রাগ-ঝাল সব নিমেষেই হাওয়া।
দাদা বাড়ি এসেছে অফিস থেকে, অফিসে হয়ে থাকবে কিছু অপ্রিয় ঘটনা, হয়তো বা চোটপাটই! রাত হয়ে গেছে। সাড়ে নটা। টগবগ করে ফুটতে ফুটতে দাদা বেল দিচ্ছে ধরুন, বাড়ির চাবি তো দাদার পকেটেই ঘোরে। কিন্তু এসব সময়ে দাদা যেন চাবির অস্তিত্বটাই ভুলে যায়। সকাল আটটা থেকে রাত সাড়ে ন-টা পরের চাকরি তো! চুষে ছিবড়ে করে দেয় একেবারে। তাই বেলের ওপর অসহিষ্ণু আঙুল। আপনি দরজাটা খুলে যায়, যেন জাদু। বাবা! বাবা! বাবা! টুটুল তার মিষ্টি কচি গলায় কলকলিয়ে ওঠে। পেছনে বউদির কোমল, অথচ জিজ্ঞাসু চালচিত্র। মুখে বলছে না—কেন এত দেরি! অথচ উদবেগ লেগে আছে চোখে, উদবেগ আর উদবেগ-মুক্তি। ঝপ করে অমনি পারা নেমে যায়। প্রথম দফায়। মাঝখানের টেবিলে ব্রিফবাক্সটা নামিয়ে সোফায় বসে জুতোর ফিতে খুলতে থাকবে দাদা। ভেতরে ভেতরে হাসি হাসি পাচ্ছে, কিন্তু এমন গোঁ যে এটাকে প্রকাশ করবে না। অফিসি-অশান্তির আঁচটা বউদি-টুটুলকেও পেতেই হবে। বউদি পায়। মুখের হাসিটা থিরথির করে কাঁপতে থাকে। হাসা ভালো না না-হাসা ভালো ঠিক করতে পারছে না বেচারি। কিন্তু টুটুলের ভয় পেতে বয়ে গেছে। তার মনের ভেতরের খেলার মাঠে সদাই নির্ভার ছুটোছুটি। তাই সে বাবার গালের নাগাল না পেয়ে হাঁটুর ওপর, প্যান্টের জমিতেই চুমু দেবে। এমন মিষ্টি তার আওয়াজ, আর এমন চনমনে সেই চুমুর পেছনের চোখ আর ঠোঁটের কারসাজি যে দাদা তাকে কোলে টেনে না নিয়েই পারবে না। সন্টিপুটি! সন্টিপুটি! সন্টিপুটি! দুজনে লুটোপুটি খাবে।
আমি আস্তে করে দাদার চোখ টেনে নিয়ে যাব সামনের দেয়ালে। যেন নদীর ঘাট। নীল-বেগনি-সাদা জলে চিকমিক। নীলচে সবুজ, সবজে নীল ছায়ায় নৌকো, অদূর দ্বীপ, সাঁকো, বেড়াচ্ছে মানুষজন। ছাবিবশ বাই তেত্রিশ ইঞ্চির মতো হবে, ক্লোদ মনের আঁকা। এই একই ল্যান্ডস্কেপ এঁকেছিলেন নাকি দুই শিল্পীই মনে আর রেনোয়া। শান্তির দ্বিতীয় স্রোত মনের ওই নীল-সবুজ থেকেই এবার নামবে।
একটু ঠান্ডা খাবে নাকি?—কে বলল? বউদি?
ফ্রিজের দরজা খুলে যাবে। স্বপ্ন-আলোর মধ্যে থেকে ঝলক-ঝলক ঠান্ডা। গ্লাসে করে বরফ সাজিয়ে তার ওপর ঠান্ডা শরবত ঢালা হবে। হাসবে বউদি, বলবে, জলজিরা অন দা রকস। একটু একটু চুমুক দিতে দিতে শরীর শিথিল হয়ে আসবে দাদার। মনের মধ্যে ঠান্ডা বইতে থাকবে। এরপর যা একটা মজা হবে না। দাদা আর টুটুল একসঙ্গে শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে পড়বে। টুটুলটা একদম নাঙ্গা। তিড়িং তিড়িং করে উইচিংড়ের মতো লাফাবে। জলের পোকা তো ছেলেটা। এই গরমে ওকে যতবার খুশি শাওয়ারের তলায় দাঁড়াতে দাও কিছু হবে না। গ্রীষ্মের দিনে বাবার সঙ্গে এই রাত চান, তারপরে পাউডারে-পাউডারে সাদা হয়ে চারজনে খেতে বসা একটা মহা উৎসবের মতো ব্যাপার। নিত্য-নিত্য হলেও পুরোনো, একঘেয়ে হয়ে যায় না।
এইবারে আসরে নামবে মা। মায়ের এই অবতরণ এত সহজ যে বোঝাই যাবে মা-ই আপাতত এ দৃশ্যের নায়িকা। ফরসা রংটা মায়ের। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে —দ্যাখো দ্যাখো আমি ফরসা। আমি ফরসা! রোগাও না মোটাও না, খাটোও না লম্বাও না। মায়ের চুলগুলো পরিচ্ছন্ন বাঁধা থাকবে। একটি গাছিও নিজের অবস্থান ভুলবে না। বিকেলবেলায় টান টান করে পরা স্নিগ্ধ শাড়ি এখন একটু আলগা। অনুচ্চ গলায় মা ডাকবে—কী রে? তোদের হল? খাবার দিচ্ছি। চানের পরে একেবারে সাফসুতরো মেজাজ, দাদা আদুরে গলায় বলবে, মাম্মি ডিয়ার, মাম্মি ডিয়ার, কী বেঁধেছ আজ আমার জন্যে? নিজের দেড় গালটা দাদা মায়ের প্রৌঢ় শিথিল গালে ঘষবে। বউদি হাসবে। ও তো জানে এই দেড়ো গালের ঘষাতে গাল কেমন ছড়ে যায়। গালের এই ছড়ে-যাওয়াটুকু ওরা শাশুড়ি-বউয়ে ভাগাভাগি করে নিয়েছে, রাগারাগি করে না! মায়েরটা ভোরের আলোর মতো। বউয়েরটা গোধূলির লালের মতো।
রাতের খাবারটা খুব সাদামাটা। টুটুলের ভালো-মন্দের কথা ভেবে বাছাই। কেননা এই সময়টাই একমাত্র টুটুল বড়োদের সঙ্গে খায়। প্রথমে একটা স্যুপ দেবে মা। এটা বউদি স্পেশ্যাল। কোনোদিন লাল টকটকে তাজা টোম্যাটোর, কোনোদিন হালকা চিকেনের জলের মধ্যে নুডলরা জড়ামড়ি করে শুয়ে থাকে। কোনোদিন আবার বর্ণহীন তরলের ওপর কমলা, সবুজ, সাদা সবজির লেসের কারু। ফুলো ফুলো রুটি থাকে, হালকা-সেঁকা পাঁউরুটি থাকে। তা ছাড়া হয়তো একটা মাছের স্টু। সকালে দাদা শুক্তো খেয়ে যায়নি, কি পোস্ত খেয়ে যায়নি। দাদার ভাগ বাটিতে করে বসানো থাকবে। গরম, কিন্তু জিভ ঝলসায় না। রাতের গাঢ় ঘুমে ঢলবার আগে এই কুসুমকুসুম গরম খানা।
খেতে খেতে সামনের দেয়ালে চোখ পড়ে যাবেই। সেখানে লম্বাটে একটা এচিং। শিব-পার্বতীর মুখের মুগ্ধ ডৌল, লম্বা টানা যামিনী রায় চোখ, আর পার্বতীর চিবুকে শিবের, শিবের কাঁধে পার্বতীর অজন্তা-আঙুল।
দেখতে দেখতে দাদা ফট করে হয়তো বলবে, আচ্ছা মা, আমাদের আর্টে পুরুষকেও এমন মেয়েলি করে আঁকে কেন বলো তো?
এই এদের তক্কো শুরু হল। দেশের যাবতীয় জিনিস—তার শিক্ষাদীক্ষা, শিল্পকলা, সংগীত-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য—সব দাদা লেন্সের তলায় রেখে রেখে দেখবে। এটা কেন? ওটা কেন? সেটা কেন? যেন কোনো গোয়েন্দা-সংস্থা ওকে মাথায় দিব্যি দিয়ে রিপোর্ট দিতে বলেছে।
আমি কি অতশত জানি!–মা চট করে উত্তর দিতে চাইবে না। আসলে তর্কাতর্কি দিয়ে আবহাওয়াটা নষ্ট করতে চাইছে না। সারাদিনের মধ্যে এই একবারই তো।
তবু?
শুনেছি, সমঝদাররা বলেন আমরা বস্তু বা ব্যক্তি আঁকি না, ভাব আঁকি। এ ছবির মেজাজ খুব রোম্যান্টিক। দেখছিস না শিবের আঙুল আর পার্বতীর আঙুল একই রকম লীলায়িত।
তাই বলে শিবের মতো একটা জবরদস্ত পুরুষমানুষকে গোঁফ দাড়ি দেবে না। কী মিতালি, তুমি কিছু বলো!
বলব?–বউদি একটু একটু হাসবে।
বলতেই তো বলছি!
পুরুষের চোখ দিয়ে বিশ্ব দেখা তো, তাই তাদের যা ভালো লাগে তেমন করেই সব আঁকাজোকা গড়াপেটা হয়।
এই এক ফেমিনিস্ট কচকচি শুরু হয় তোমার।
বলছিলাম না তো সেইজন্যে। …বউদির চোখে অভিমান, একটু দুষ্টুমিও কি!
মা বলবে, মিতালি কিন্তু কথাটা খারাপ বলেনি। ভাববার মত। টুটুল মাছটা খাচ্ছিস না? বেছে দিয়েছি তো!
টুটুল আসলে এখন ঢুলছে। সারা দিন স্কুল, সারা বিকেল খেলা, সারা সন্ধে পড়া-পড়া খেলা আর খেলা-খেলা পড়া। চোখ টেনে টেনে জেগেছিল সুষ্ঠু বাবার জন্যে। বাবা, দিদু, মায়ের সঙ্গে একসঙ্গে বোদের টেবিলে, বড়োদের মতো করে খাবে। কিন্তু ওই গরমে রাত সাড়ে নটার চানটা তার সমস্ত স্নায়ু আলগা করে দিয়েছে। ঘুম এখন আঙুল বুলোচ্ছে তার কচি শরীরে। আয় ঘুম, যায় ঘুম।
সব ভালো, সব সুন্দর এদের। দাদার এই প্রশ্নগুলো, যখন-তখন ওই খারাপ লাগা, সংশয়, আর অসন্তোষ বাদে। কেমন ভয়-ভয় করে আমার। এত বিরক্তি ওর কীসের। বাবার কথা ভেবে?
কোনোদিন হয়তো হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরেই বলবে, পুরো দেড় ঘন্টা জ্যাম একটা মিছিলের জন্যে, ভাবতে পারো! গাড়িগুলো চলছে কোনো লেন-টেনের বালাই-ই নেই। আমার বনেটে আজ প্রায় ভিড়িয়ে দিয়েছিল এক ব্যাটা ট্যাক্সি। হঠাৎ দেখলে মনে হবে গোটা শহরটাই উন্মাদ হয়ে গেছে। সদ্য পালিয়ে এসেছে। কোনো পাগলাগারদের গারদ বেঁকিয়ে।
খামোকা রাগ করে নিজের ক্ষতি করছ। এটা রিয়্যালটি! মেনে নাও।বউদি বলবে।
রিয়্যালিটি নয়। অন্য অনেক সভ্য দেশ আছে পৃথিবীতে। এটাই অসভ্যতম, বর্বরতম দেশ। এগুলো এই দেশেরই রিয়্যালিটি। তোমার আর কী! বাড়িতে বসে হাওয়া খাচ্ছ।
বাঃ, আমি বুঝি টুটুলকে নিয়ে স্কুল আসাযাওয়া করি না! বাজার হাট, দোকান, ব্যাংক, পোস্টাপিস এগুলো কি উড়ে উড়ে হয়?
হুঁ। …দাদা কাগজটা তুলে নেয়।
কান পেতে শুনি দাদা ফোঁসফোঁস করছে। শুনতে পাই মায়ের বুক ঢিপঢিপ করছে। আস্তে ধীরে ওঠে মা। চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখে। তারপর পেছন দিকের কমলা পরদাটায় কান ধরে দুদিকে সরিয়ে দেয়। ছেলের রাগে মায়ের রাগ, সেই ঝাল ঝাড়ছে মা পর্দার ওপর। পরক্ষণেই বুঝতে পারি শুধু রাগ নয়। গুঢ় উদ্দেশ্য আছে এর পেছনে। কেননা, পর্দা সরাতেই ঝাঁপিয়ে আসে গ্রীষ্ম-সকালের এখনও তপ্ত না-হওয়া দক্ষিণে হাওয়া, অনেক নীচে বিস্তৃত সবুজের মধ্যে কৃষ্ণচূড়ারা ঝলমলে হাসি হাসতে থাকে। এক ঝাঁক টিয়া খিরিশ গাছটার মাথা থেকে সবুজ বিদ্যুতের মতো দাদার চোখের আড়াআড়ি উড়ে যায়। আজ ওদেরও অফিসের বেলা হয়ে গেল।
কেমন স্তিমিত হয়ে যায় দাদার মেজাজ। চুপচাপ। আমি বুঝি কৃষ্ণচূড়ার সিঁদূরে লাল চারদিকের সবুজে মাখামাখি হয়ে সোজা ঢুকে যাচ্ছে ওর বুকের ভেতরে। টিয়াগুলোর বিদ্যুৎগতি ওর রক্তে ভালোলাগার ঝড় তুলেছে, চেয়ারে মাথা কাত করে বাবু বলে ওঠেন, সত্যি মা, এখান থেকে মনেই হয় না এই বদমাশ, ঠগবাজ, অসভ্য, নোংরা দেশটাতে আছি। ইউরোপে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে হাইওয়ের ধারে কাছে রেস্ট হাউসের জানলা দিয়ে তাকালে এইরকমটাই দেখা যায় হয়তো! অন্তত ফটোগুলো তো তাই বলে।
কৃষ্ণচূড়াও?–কেমন চাপা অভিমান মায়ের গলায়।
ওঃ হো হো, মাম্মি ডিয়ার, না কৃষ্ণচূড়া নেই, নেই তোমার ফেভারিট সপ্তপর্ণী। কোনো ফুল-টুল বড়ো বড়ো গাছের মাথায় দেখা যায় বলেও জানি না। ট্রপিক্যাল নয়তো। বেশির ভাগই পাতাঝরা গাছের বন। পাইন আছে, ফার, ওক, বার্চ, মেপল কতরকম। গাছেদের বিউটিও খুব কম নয়।
টুটুল কলকলিয়ে ওঠে, বাবা, ওদের টিয়া আছে? আয়রে আয় টিয়ে, নায়ে ভরা দিয়ে?
মনের দিগন্ত হাতড়ায় দাদা। চুপ করে থাকে। অন্যমনস্ক।
বউদি চায়ের কাপগুলো তুলে নিয়ে যায়। মা ছেলে কাগজের দুটো পাতা মুখের সামনে ধরে বসে থাকে। কী অত পড়ে ওরা? দূর বাবা!
টুটুল তার ট্রাইসাইকেলে চড়ে ঘর থেকে বারান্দা, বারান্দা থেকে ঘর ঘুরে বেড়ায়। স্থূপীকৃত খেলনা-গাড়িগুলোকে ছত্রভঙ্গ করে তার ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে নিয়ে যায়। হাততালি দিয়ে হেসে ওঠে, অ্যাক্সিডেন্ট! অ্যাক্সিডেন্ট!
বাঁকা চোখে ছেলের দিকে তাকায় দাদা। ভেতর থেকে বউদির গলা ভেসে আসে, টুটুল, চান করবে এসো। স্কুলের দেরি হয়ে যাবে-এ-এ।
হঠাৎ দাদা চেঁচিয়ে ওঠে, তিনটে রেপ! দুটো তার মধ্যে গণধর্ষণ, বুঝলে মা?
মা চুপ।
এ কী? এতগুলো অ্যাক্সিডেন্ট একেবারে শহরের মাঝ-মধ্যিখানে? ওনারা একে অন্যকে ওভারটেক করছিলেন। গেছে একটি কলেজ-তরুণী, একটা বাচ্চাছেলে আর তার মা, ছেলেকে স্কুলে দিতে যাচ্ছিল—এই তোমার মিতালি আর টুটুলের মতো।
খোকন!
মা, এটা পড়েছ? গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, এক রাজনৈতিক দল অন্য দলের সমর্থকদের। পুরো গ্রাম পুড়ে ছাই। এক ঠাকুমা আর তার চার বছরের নাতি বেগুনপোড়া–ছবি দিয়েছে ঠিক তুমি আর তোমার নাতির মতন।
মা থরথর করে কেঁপে ওঠে।
একটু চুপচাপ। তারপর দাদা আশ্চর্য হয়ে বলে ওঠে, বালিগঞ্জের বহুতলের নতলার ফ্ল্যাটে দম্পতি খুন? বাইপাসে জলার ধারে আবার জোড়া লাশ? মুণ্ডু নেই মা!
তুই চুপ করবি।-মায়ের মুখ লাল হয়ে গেছে কষ্টে, ভয়ে, হতাশায়।
চুপ করব! চুপ করব কেন? রাস্তায় যেখান সেখান থেকে বাচ্চা, যুবক, প্রৌঢ়, তুলে নিয়ে যাচ্ছে—হয় প্রতিহিংসা নয় যানসম। আরও শোনো-আবার খ্রিস্টান খুন। নেতারা বলছেন—এ গুন্ডা বদমাশের কাজ। গুন্ডা বদমাশ বেছে বেছে খ্রিস্টানই শিকার করছে—অ্যাকর্ডিং টু দেম। হোটেলের ব্যাপারটা পড়লে? মিনিস্টাররা মিনি মাগনা খেয়ে আর খাইয়ে হোটেলটাকে লাটে তুলে দিয়েছে। বিক্রি করতে চাইলে কর্মচারীরা ধর্মঘট করেছে, বলছে—বিক্রি করতে দেব না, কাজ-কাম করব না, বসে বসে খাব—এটাই মানুষের অধিকার।
বলেছে! এই কথা!
বেসরকারিকরণ করতে দিচ্ছে না, সব কটা দলের ট্রেড ইউনিয়ন তাদের পেছনে। এর আর কী মানে দাঁড়ায়?—কাগজটা হাত থেকে ছুড়ে ফেলে দেয় দাদা, যেন এভাবেই এইসব বিশৃঙ্খলা, খুন, দুর্ঘটনার সুরাহা হবে। মুখে তার আক্রোশ।
অন্য দেশও আছে মা। সভ্য, বাধ্য, অবর্বর। মা কেমন গোঁয়ারের মতো বলে, ওখানে স্কুলে বাচ্চারা বন্দুক ছুড়ে ছুড়ে টিচার আর ক্লাসের বন্ধুদের মেরে ফেলছে। শুনিসনি? ভয়ানক নয়?
দাদা যেন শুনতেও পায়নি। বলে, সরকারি হাসপাতালের ক্যাম্পাসে এখন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেআইনি কলোনি। হাসপাতালের তার থেকে হুক করে তাদের আলো, পাখা, হিটার সবই চলছে। রোগীদের খাবার থেকে চুরি করে ডেইলি খাওয়াটাও হয়ে যাচ্ছে মা। বিশাল অঙ্কের ইলেকট্রিক বিল মেটাতে পারছে না কতৃপক্ষ, ওদিকে সদ্যোজাত বাচ্চাকে কুকুরে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, শিশু পাচার হচ্ছে, এক বেডে তিনজন রোগী। ময়লা পরিষ্কার হয় না ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে, সে সময়টা ওয়ার্ডবয়রা অবৈধ প্রেমের রোমাঞ্চ উপভোগ করে। সরকারি হাসপাতালের প্রোফেসর কাম চিকিৎসক স্বয়ংই চিকিৎসা পাননি। খবরট কদিনই…
ওদের মেয়েদের বাবারা পর্যন্ত অ্যাবিউজ করে… মা বলে।
মাইনর-রেপ তো এখানে জলভাত এখন। কেউ অবাক পর্যন্ত হয় না—দাদা বলে।
ওদের বাবা-মা ডিভোর্স হলে বাচ্চাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে যায়—মা।
খেতে দিতে না পেরে এখানে বাবা-মা ছেলে বিক্রি করে দিচ্ছে, নিজের হাতে খুন করছে-দাদা।
ওদের প্রেসিডেন্ট নিজের অফিসে বসে…
একটা ক্রুদ্ধ চিৎকার করে ওঠে দাদা—কী? কী বলতে চাও তবে তুমি! খুঁজে খুঁজে খারাপগুলো বার করছ কেন? মনুষ্যত্বের এই ইতর সর্বাত্মক অপমানের সাফাই গাইছ। মিনিমাম সিকিয়োরিটি নেই, মিনিমাম সততা নেই, মিনিমাম শিক্ষা শৃঙ্খলা নেই। এদের সাফাই! অন্য দেশেও আছে, কিন্তু সেগুলো ব্যতিক্রম। এখানে সেটাই রীতি! তুমি স্বীকার করো, বা না করো।
বউদি ভেজা তোয়ালে হাতে ছুটে আসে।–কী হল! চাঁচাচ্ছ কেন? এ কী মা! তুমি কাঁদছ?
টপ টপ করে জল পড়ছে মায়ের চোখ দিয়ে। ধরা গলায় বলল, এত কথা কেন বলিস? তুই তো জানিস ওরা তোর বাবাকে ফিরিয়ে দেয়নি। গলা বন্ধ হয়ে যায়, আর কথা বলতে পারে না।
দেখো তো কী করলে? বউদি ধমকে ওঠে।
দাদা বলে, সরি মা। এক্সট্রিমলি সরি, কেঁদো না, আমি চানে যাচ্ছি। তোয়ালে কাঁধে পেলে উঠে গেল দাদা।
হ্যাঁ বাবা। বাবার কথা কি আর দাদার মনে আছে? সে তখন কত ছোট্ট! এই টুটুলের থেকে একটু বড়ো হবে হয়তো। মনেও নেই, অভাববোধও নেই আর। মা একাই তো ছেলেকে মানুষ করে তুলল। আর কত অল্প বয়স থেকেই দাদা সংসারের ভার নিতে শিখল। কোথায় গেল বাবা। কত দিন মানুষটাকে দেখি না। শুধু মনের গভীরে বিশ্বাস করি, সে আছে, কোথাও আছে। একদিন না একদিন আসবে। চৌকো কাঠামোর জোয়ান মানুষটা। যেমন বুদ্ধি তেমন জেদ। বিজ্ঞানী ছিল। পরমাণু বিজ্ঞান। মানুষটা ছিল এমনিতে খুব আমুদে, মিশুক। মায়ের সঙ্গে কত মশকরা, দাদার সঙ্গে কত খেলা। যেসব সহকর্মীরা বাড়িতে আসত তাদের সঙ্গেও কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে ঠাট্টা তামাশা চলত। মুখটা আর ভালো করে মনে পড়ে না। চোখ, মুখ, নাক কেমন আবছা হয়ে গেছে। কিন্তু ব্যক্তিত্বটা মনে আছে। ঝকঝকে, ধারালো, কী আত্মবিশ্বাস। জানবার, জয় করবার কী অদম্য ইচ্ছা! জীবনের সব যুদ্ধ যেন জয় করে ফেলবেই।
বাগবাজার থেকে এখানে আসার পেছনেও তো সেই একই জেদ! একই উদ্যম। তা নয়তো তিন পুরুষের সেই বিরাট বাড়ি, তার উঁচু উঁচু ঘর, লম্বা-চওড়া দালানেও তাকে ধরল না কেন? কেন বাবা এখানে চলে এল, ছোটোভাইকে নিজের অংশটা ছেড়ে দিয়ে! এখানে নাকি বাবার একলার স্টাডি, একলার লাইব্রেরি, যতক্ষণ খুশি নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারে। আর ইনস্টিট্যুটের ল্যাবরেটরি। এখান থেকে মাইল খানেকের মধ্যে। আমি জানি, এগুলো বাবার নিজের অর্জন। মুখে চুরুট ঝুলিয়ে বাবা ইনস্টিটুটে বেরিয়ে যাচ্ছে, ছুটির দিনেও কিছু মনে পড়েছে, বেরিয়ে যাচ্ছে—এমন কত দেখেছি। ছোটোখাটো সীমাবদ্ধ কাজ, সীমাবদ্ধ সময় নিয়ে বাবা সন্তুষ্ট থাকতে পারত না। নতুন নতুন জ্ঞান আর নিত্যনতুন উদ্ভাবনের জন্য পৃথিবীর শেষ প্রান্তে যেতেও বাবার আপত্তি ছিল না। তাই, সে ডাক যখন এসে পৌঁছোল, তাকে আর কিছুতেই আটকে রাখা গেল না। মায়ের নিজের বাবা অসুস্থ, মা যেতে পারবে না। দাদা সবে ভালো স্কুলে ভরতির সুযোগ পেয়েছে, তার কথাও ভাবতে হয়। তা ছাড়াও, বাবার কাজের যে ক্ষেত্র সে এক গোপন রণক্ষেত্রবিশেষ। সেখানে দারা-পুত্র-পরিবারের খুব একটা স্থান নেই। তবু বাবা যাবেই।—চার-পাঁচটা বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে—বাবা মাকে বোঝাল। ছেলেকে আদর করল। তারপর চলে গেল। সেই চার-পাঁচ বছর এখন বিশ বছরে দাঁড়িয়েছে। এখন আর তার কোনো খবরই নেই। প্রথম প্রথম ফোন আসত, পিকচার পোস্টকার্ড আসত, আসল ঠিকানা নয় একটা বিশেষ ঠিকানায় চিঠি দিতে হত বাবাকে। বাবার উপায় ছিল না নিজের গোপন ঠিকানা জানাবার। তারপর একদিন সব চিঠি, সব খবর আসা বন্ধ হয়ে গেল। মানুষটা যে কোথায়, কেমন আছে, সেটা আর জানাই গেল না। মা সে সময়ে কাকাকে নিয়ে কনসুলেটে ধরনা দিয়েছে। খরচপত্তর করে পাঠিয়েছে সে মুলুকে। কিন্তু কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। বাবা নাকি সে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে? জানে না, কেউ জানে না।
আস্তে আস্তে মা শান্ত হয়ে গেল। সমস্ত কর্তব্য করে যায় নিখুঁতভাবে। কিন্তু মনটার নাগাল আর কেউ পেল না। এত লোক আসে এত লোক যায়, মায়ের মনে কোনো দাগ পড়ে না। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা বলল, ভুলে যাও তাকে। অনেকে বলল সে নিশ্চয় প্রতিরক্ষার কিছু গোপন ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছে। আর তাকে আসতে দেবে না। একটা বিশাল শক্তিশালী দেশ, নিয়তির মতো। কঠিন দেয়াল এক। সে দেয়ালে মাথা ঠুকেও মা কিছু পেল না। মায়ের এখন একমাত্র দুর্বলতা ছেলে। ছেলেকে নিয়েই বেঁচে আছে মা। আঁকড়ে থাকেনি কোনোদিন। দাদা যেমন ইচ্ছে পড়াশোনা করেছে, চাকরি নিয়েছে, যেমন ইচ্ছে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিশেছে। কিছুতেই বাধা দেওয়া নেই। খালি ওই একটা নিষেধ। বিদেশ যাবে না। ইউরোপ হোক, অস্ট্রেলিয়া হোক, কোথাও না। আর মার্কিন দেশ! নাম শুনলেই মায়ের মুখ ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে যায়।
দাদা বিয়েও তো করল নিজের পছন্দে। এসব নিয়ে সাধারণত কত মনকষাকষি হয়ে থাকে। সেসব কিছু হল না। বউদি মানুষটাও কপালগুণে বুঝদার। তবে হাসিখুশি, উচ্ছল, মায়ের ঠিক উলটো।
প্রথম প্রথম বউদিকে খুব অপ্রতিভ হতে দেখেছি। মার কি আমাকে পছন্দ হয়নি?—দাদাকে জিজ্ঞেস করেছে।
দূর, দাদা বলেছে,–মায়ের কথা তো তোমাকে বলেইছি। তুমি তোমার মতো থাকবে। কিন্তু, বললেই কি আর তা পারা যায়। কোনো কারণে খিলখিল করে হেসে উঠেই বউদি
থতমত খেয়ে চুপ করে যেত। যেন কত অপরাধী!
একদিন মা আর বউদি খেতে বসেছে, মা হঠাৎ বলল, মিতা তোমার কি শরীর খারাপ?
না তো!
তবে মন খারাপ?
না মা।
আমাদের মা-ছেলের সংসারে কোনো সুর ছিল না। রং ছিল না মিতা। তুমি সেই রং আর সুর এনেছ। তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব নেই?
আছে তো!
তো তাদের একদিন ডাকো না, খাওয়াও, আড্ডা জমাও, হাসি-গান হইহল্লা।
মা সেদিন নিজে হাতে খাবারদাবার করল। বউদি ঘর গুছোল, ফুলটুল সাজাল। সেদিন দেখলাম, মা কত সহজে সব করছে। আড়ালেও থাকল না, ওদের মাঝমধ্যিখানেও রইল না, কিন্তু দেখলাম—কিছুই ভোলেনি মা, হাসি, গল্প, গান কিছু না।
বন্ধুরা তো উচ্ছসিত! সবাই চলে যেতে বউদি হঠাৎ মায়ের ঘরে এসে তার কোলে মাথা রাখল, দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল, কোথায় এতদিন লুকিয়েছিলে মা!
বউদির চুলে হাত বুলিয়ে মা বলল, আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলেদেখতে আমি পাইনি…
তারপর ধীরে ধীরে এদের বাড়ির স্বভাবে একটা পরিবর্তন এল। মা-ও যেমন একটু খোলামেলা, হাসিখুশি হল, বউদিও রইল না আর অতটা হুল্লোড়ে। চমৎকার একটা ভারসাম্য আপনা থেকেই এসে গেল সংসারে। আর টুটুল আসতে তো সব কিছুই অন্যরকম। টুটুলের সঙ্গে মায়ের যত খেলা, যত গল্প-বলা, যত গান, যতেক আহ্লাদ। বাবা একেবারে হারিয়ে গেল।
জুন মাসের সেই শুক্রবারটা? উঃ! স্পষ্ট মনে পড়ে। দাদা যেমন বেরিয়ে যায়, গিয়েছিল। বউদি যেমন বাজার-হাট-ছেলের স্কুলের জন্যে বেরোয়, বেরিয়েছিল। অতিরিক্তের মধ্যে মা সেদিন দশটা সাড়ে-দশটা বাজতেই বাইরের পোশাক পরে ফিটফাট হয়ে গেল, ব্যাগের মধ্যে কীসব কাগজপত্র ভরল, থলির মধ্যে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে গেল। মা যে একেবারে বেরোয় না তা নয়। বাজারেও যায়। দরকার হলে টুটুলকে আনতেও যায়। কিন্তু নিয়মিত নয়। সেদিন মা টিপটপ চুল বেঁধে, হাতে ব্যাগ, যেন অফিস যাচ্ছে।
তখন সন্ধে পেরোব পেরোব করছে, মা ফিরল। মুখ-চোখ ক্লান্ত। হতেই পারে, যা গরম! বউদিও তাই বলল, মা তোমার রোদ লেগে যায়নি তো।
মাথা নাড়ল মা। কাপড় বদলাল না। মুখ হাত ধুতে যেন ভুলে গেছে। নিজের ঘরেই বসেই রইল—ভূতের মতো।
বোমটা ফাটল রাত্তিরবেলায়। দাদা অফিস থেকে এসে সোজা মায়ের ঘরে।
এখনও এমনি করে বসে! মা তোমার টাকাটা কি ছিনতাই টিনতাই হয়ে গেল নাকি?
এফ. ডি. টা তুলতেই তো গিয়েছিলে?—বউদি জিজ্ঞেস করল।
মা নিশ্বাস ফেলে ক্লান্ত গলায় বলল, সারা দুপুরটা বড্ড হয়রান হয়েছি রে। একবার বলে আগাম নোটিশ দিতে হবে, দিয়েছি বলে তার কপি দেখালে বলে আমাদের ফাইলে তো পাচ্ছি না, তারপরে বলে হলুদ ফর্ম লাগবে একটা, এখন নেই। পরে আসুন। আবার বলে, ওটা অটোম্যাটিক্যালি আবার ফিক্সড হয়ে গেছে। শেষকালে একজন হঠাৎ বলে উঠল—এতগুলো টাকা তো পাচ্ছেন মাসিমা, সবটা একা খাবেন? বোনপোদের একটু খাওয়াবেন না? তারপর অনেকে মিলে শুরু করল, মাসিমা কত ভালো, কত ধনী, কত উদার, ঈশ্বরের একেবারে কাছের লোক —এই করে হাজার পাঁচেক টাকা নিয়ে নিল।
পাঁচ হাজার। তুমি দিলে?
মা বলল, টাকাটা তো গেলই। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা ভদ্রলোকের ছেলে সব, অমন একটা জায়গায় কাজ করছে যখন শিক্ষা-টিক্ষাও আছে, পরিষ্কার জামাকাপড় পরা স্বাভাবিক দেখতে। কিন্তু আমাকে যখন ঘিরে ধরেছিল, মনে হচ্ছিল একদল নেকড়ে আমার ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে। হিংস্র নখদাঁতগুলো যেন আস্তিনের তলায়, ঠোঁটের পেছনে লুকিয়ে রেখেছিল, ক্রমশই কাছে ঘেঁষে ঘেঁষে আসছিল, মাসিমা-মাসিমা করে। টাকার জন্যে এক্ষুনি যেন আমার গায়ে হাত বুলোতে শুরু করবে। খোকন, ঘেন্নায় আমি যে প্যাকেটটা হাতে উঠেছে দিয়ে এসেছি। আমার কেমন গা ছমছম করছে।
দাদা শান্তভাবে বলল, তোমার আজ করছে। আমার অনেক দিন ধরেই করছে। মা। যে কোনোদিন দেখবে এখানে মাস মাইনেটা নিতে গেলেও ঘুষ দিতে হচ্ছে। হয়তো তুমি ঠিকই বলো। সবাই এমন নয়, কিছু কিছু। কিন্তু এই কিছু কিছু-ই সব কন্ট্রোল করছে।
দাদা যদি প্রচণ্ড রাগারাগি করত, ফেটে পড়ত, সে একরকম হত। কিন্তু আজ দাদা অসহ্য গম্ভীর, যেন একটা অন্ধকার, দুর্ভেদ্য পাহাড়ের মতো। আমার ভেতরটা থরথর করে কেঁপে উঠল। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এইটাই আসল বোঝ। আমি স্পষ্ট বুঝি।
কয়েকদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড ব্যস্ততা। রেজিগনেশন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট, পাসপোর্ট, ভিসা, কেনাকাটা। সে এক হুলুটথুলুট কাণ্ড। এরই মধ্যে মায়েতে ছেলেতে চলেছে দড়ি টানাটানি। মা-ও কিছুতে যাবে না। ছেলেও কিছুতেই তাকে ছাড়বে না। মা বলল, আমি নিজের মতো থাকব পোস্টঅফিসের টাকাটার সুদেই আমার চলে যাবে। হঠাৎ কোনো দমকা খরচ হলে তুই তো রইলিই। আমাকে আর টানাটানি করিস না।
দাদা বলল, আমাদের ছেড়ে, টুটুলকে ছেড়ে তুমি থাকতে পারবে?
খুব কষ্ট হবে, কিন্তু পারব।
খুব কষ্ট হবে! তা সেই খুব কষ্টটা করবে কেন শুধু শুধু? এত জেদ কীসের? এত জেদ ভালো নয় মা। আচ্ছা, তুমি না হয় পারলে। টুটুল! টুটুল পারবে?
এতক্ষণে মায়ের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। শিশুর মায়া বড়ো মায়া! মা ধরা গলায় বলল, বাড়ন্ত বাচ্চা, ভুলতে দেরি হবে না দেখিস!
ভোলবার আগেই যদি মনের কষ্টে ওর কঠিন কিছু হয়?
শিউরে উঠে মা টুটুলকে বুকে টেনে নিল।
আর এই মুহূর্তে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া টুটুলটা তার পাকা কথার ঝুড়িটা নামিয়ে দিল। মাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে উঠল, দিদু, ও দিদু তোমাকে ছেড়ে আমি বাঁচব না!
কোথা থেকে যে এসব কথা শেখে এরা! কিন্তু ও তো শুধু পাকা কথাটা নলেই ক্ষান্ত হয়নি, ফুপিরে ফুঁপিয়ে হৃদয়বিদায়ক কান্নাও কাঁদছে। অতএব মায়েরও পাসপোর্ট, ভিসা, টিকিট হয়, ওদের লাগেজের সঙ্গে মায়ের লাগেজও যোগ হয়। তারপর একদিন রাত নটা নাগাদ শক্ত করে টুটুলের হাত মুঠোয় নিয়ে একখানা টাটা সুমোয় উঠে যায় মা। দাঁতে দাঁত চেপে, ঠোঁটে ঠোঁটে চেপে। একবারও পেছন ফিরে তাকায় না। বউদিই বরং দেখি চোখ মুছছে, আবার জল পড়ছে আবার মুছছে। দাদার মুখটা কঠিন, কিন্তু শোকার্ত। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্লেনটা উড়ে যায়।
চিৎকার করে উঠতে চাই। কিন্তু ওরা কি শুনতে পাবে? মূৰ্ছিত হয়ে পড়ি—ওরা দেখতে পায় না। যাক, তবে চলেই যাক। দেয়ালে দেয়ালে ছাতলা জমুক, মেঝেতে পুরু ধুলোর আস্তরণ। পোকামাকড় আরশোলা ছুঁচো ইঁদুরের নিরঙ্কুশ রাজত্ব হোক ওদের সুখের সংসার।
বারান্দা দিয়ে এখনও দেখতে পাই। রবীন্দ্রসরোবরে স্টেডিয়ামের ট্র্যাকে দৌড়োচ্ছে দলের পর দল খেলাপাগল কিশোর। সবুজের ছাপের ওপর খালি গায়ে ফুটবলে শট মারছে, ধবধবে পোশাকে কেতাদুরস্ত ক্রিকেট শানাচ্ছে। কবাড়ি খেলছে। লেকের জলে গ্রীষ্ম-বিকেলের পড়ন্ত আলোয় শুরু হচ্ছে রোয়িং, ওদের মধ্যে টুটুলকে কোনোদিন দেখতে পাব কি? ঘোর এপ্রিলে লাল হয়ে ফোটে কৃষ্ণচূড়া, রঙ্গন। রাংচিতার পাতায় আলো ঝলকায়, শীতভর ফুটতে থাকে মরশুমি ফুল। রাত জমিয়ে জলসা হয়, দূরের বেতারে ভেসে আসে নতুন গায়কের নতুন গান, পুরোনো গায়কের মন কেমন-করা পুরোনো গান, হয়ে যেতে থাকে বইমেলা, শিল্পপ্রদর্শনী। আর সারাবছর ধরে খিরিশ গাছ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে সবুজ বিদ্যুৎরেখা ঝলসে, আপিসে বেরোয়, আপিস থেকে ফেরে স্বদেশি টিয়ার ঝাঁক। দেখতে পাবে না। শুনতে পাবে না মা, দাদা, বউদি।
ঝুল জমেছে সিলিংয়ের কোণে কোণে। মাকড়সারা অদ্ভুত চতুরালি দেখিয়ে জাল বুনছে, পোকা ধরছে, চুষে ছিবড়ে করে ফেলে দিচ্ছে। শুকনো পোকা আর নধর মাকড়সায় ক্রমে ভরে যায় সারা সংসার। কেউ নেই যে সে ঝুল ঝাড়বে, কেউ নেই যে কীটনাশক ছেটাবে।
তারপরে একদিন গুড়গুড় করে মেঘ ডাকতে থাকে। কালি নীলে ঢেকে যায় আকাশরেখা, প্রলয়ংকর ঝড় ওঠে। দড়াম দড়াম করে আছাড় খেতে থাকে বড়ো বড়ো গাছ। এগারো তলার ওপরেও শুনি সমুদ্রের হুহুংকার। দানব-হাওয়া ধাক্কা দিতে থাকে। দমাদ্দম শিলাবৃষ্টি হয়, আর শিলার ঘায়ে হুড়মুড়হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে থাকে জানলার বারান্দার কাচ। বাস, আর বাধা কী? পরিত্যক্ত বাড়ি। বাইরের ঝড় নির্বিবাদে ঢুকে পড়ে অন্দরে। তাণ্ডব চলতে থাকে। মিছিলের ডাক, লাঠিচার্জ গুলির আওয়াজ উজাড় হয়ে যাচ্ছে নিঃস্ব মানুষ। জলে বিষ, আলো নেই, ভাইরাসের পর ভাইরাস আক্রমণ করতে থাকে লক্ষ লক্ষ মানুষকে, এ. সি ঘরে চিংড়ি মালাইকারি আর রেশমি কাবাব, কুলচা আর কুলপির মিটিং, নতুন নতুন দুর্ঘটনা, নতুন নতুন ক্ষতিপূরণ, নতুন নতুন কর। রাজার তোষাখানার কৃষ্ণগহ্বর মরণটানে টেনে নেয় সব, চিহ্ন রাখে না। শুয়ে থাকি। কাদায়, জলে, রক্তে, ক্লেদে থাবা রেখে শুয়ে থাকি। কত দিন, কত মাস, বছর যায়। মাঝে মাঝে ঝনঝন করে ফোন বেজে ওঠে। ওরা কি ফিরছে? ওরা কি আমার খবর নিচ্ছে? নাঃ, এ রং নাম্বার। তারপরে একদিন দরজার বেল বাজে। কে এসেছ ভুল করে। এ ঠিকানায় কেউ থাকে না। কেন আমাকে বিরক্ত করো? কী আশ্চর্য! দেখি আস্তে আস্তে শব্দ করে খুলে যাচ্ছে দরজা। আমার রোঁয়া ফুলে উঠেছে, গায়ে কাঁটা, বুঝি নির্ভুল আঙুলে সুইচ টিপছে কেউ। বাতি জ্বলে ওঠে, ঝুল-জমা, ঝাপসা আলো। সেই আলোয় দেখি—বিকৃতদেহ দীনহীন ভিখারি এক। ক্লান্ত, বৃদ্ধ, যেন কত দেশান্তর, কত বিপর্যয়ের সমুদ্র পেরিয়ে এল, প্রত্যাশায় আকুল চোখ-ধুলো ময়লা, আবর্জনা সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। একটার পর একটা দরজা খোলে, জানলা খোলে। আমি ফিসফিস করে বলি, বড্ড দেরি করে ফেলেছ বাবা, বড্ড। তোমার যদি এতদিনে সময় হল, এদের সময় ফুরিয়ে গেছে। এখানে আর কেউ তোমায় চিনতে পারবে না। ফিরে যাও যে সমুদ্দুর থেকে এসেছিলে সেইখানে। কিংবা এসো, এই ধবংসস্তূপে, এই সর্বনাশে, তুমি আর আমি, আমি আর তুমি ওতপ্রোত হয়ে শুয়ে থাকি।
একটা ছোটো মেয়ে
লোকে বলে আমি একটা ছোটো মেয়ে। এ তো বাচ্চা! এইভাবে বলে, কিন্তু আমি জানি আমি মোটেই বাচ্চাটাচ্চা নই। বারো ক্লাসে উঠলুম। সতেরো বছর বয়স হল—আবার বাচ্চা কী? আসলে আমি বেঁটে, চায় ফুট সাড়ে দশ ইঞ্চি মোটে হাইট। মোটাসোটা নই। তাই আমাকে ছোটো লাগে। আমার বন্ধু দেবলীনার মা বলছিলেন, হঠাৎ দেখলে তোকে লীনাদের থেকে অনেক ছোটো দেখায়, কিন্তু মুখটা ভালো করে দেখলেই যে কেউ বুঝবে।
দেবলীনা মজা পাওয়া হাসি হাসতে হাসতে বলেছিল, তবে কি ঋতুর মুখটা পাকা-পাকা, মা?
না, পাকা নয়,-ঢাক গিললেন দেবলীনার মা—মানে ওই ম্যাচিয়োর আর কী!
সেই মুখই এখন দেখছি আমি। গালগুলো ফুলো ফুলো। চোখ দুটো গোল মতো। পাতা নেই। নেই মানে কম। ভুরু খুব পাতলা, ঠোঁটের ওপর দিকটা সামান্য উঁচু। হেসে দেখলুম দাঁতগুলো পরিষ্কার, ঝকঝকে, কিন্তু বাঁ দিকের ক্যানাইনটা উঁচু। একটু বড়ো বড়োও দাঁতগুলো। আমার চিবুকে একটা টোল আছে। আমার আর এক বন্ধু রুবিনা বলে, তোর এই টোলটাই তোকে বাঁচাবে ঋতু।
কেন একথা রুবিনা বলল, তার মানে কী, বুঝতে হলে আমার বন্ধুদের কোনো কোনো আলোচনার মধ্যে ঢুকতে হবে।
ভুরু প্লাক করা নিয়ে কথা হচ্ছিল একদিন। দেবলীনার ভুরু খুব সরু, বাঁকানো। বৈশালী বলল, এরকম ভুরু আজকাল আউট অব ফ্যাশন।
রুবিনা বলল, না থাকলে করবেটা কী? যা আছে তার মধ্যেই তো শেপ আনতে হবে। এই যেমন ঋতু। ভুরু বলে জিনিসই নেই, তার প্লাক।
অমনি আলোচনাটা দেবলীনার থেকে আমার দিকে ঘুরে গেল। যেটাকে আমি ভয় করি। এবারে ওরা আমাকে নিয়ে পড়বে।
ঋতুর অ্যাট লিস্ট ব্রণর সমস্যা নেই। বৈশালী বলল।
হ্যাঁ, কালো হলেও ওর স্কিনটা খারাপ না—রুবিনা বলল।
এই ঋতু, স্কিনের জন্যে কী করিস রে?
আমি ক্ষীণ গলার বললুম, তুই কী করিস?
আমি? আমার তো হাজার গন্ডা ব্রণ, কোনো ক্রিম মাখার জো নেই। রেগুলার মুশুর ডাল বাটা আর চন্দন মাখতে হয়। বৈশালী কী করিস রে?
আমার আবার মিস্কড স্কিন, জানিস তো। নাক চকচক করবে, কপাল চকচক করবে, আর গাল দুটো শুকিয়ে বাসি পাউরুটি হয়ে থাকবে। আমার অনেক জ্বালা। কোথাও ভাপ লাগে, কোথাও বরফ। কোথাও মধু, কোথাও চন্দন। সে অনেক ব্যাপার, মা জানে।
তুই একটা মিস সামথিং না হয়েই যাস না। দেবলীনা খ্যাপাল।
তবু মন খুলে মিস ইউনিভার্সটা বলতে পারলি না তো? বৈশালী চোখ ছোট্ট করে হাসছে।
মিস ইউনিভার্স হোস না হোস মিস সেন্ট অ্যানথনিজ তো তুই হয়েই আছিস।
আমি বৈশালীর দিকে তাকালুম। শীতকালে ওর গাল দুটো একটু ফাটে। লালচে ছোপ পড়ে। এমনিতেই একটু লালচে ফরসা রং ওর। মুখটা এত মিষ্টি যে চোখ ফেরানো যায় না। লম্বা, দোহারা, ফুলহাতা লাল সোয়েটার আমাদের স্কুলের ইউনিফর্ম, পরেছে ব্লু স্কার্টের ওপর। ওকে দেখাচ্ছে যেন স্নেহোয়াইটের গল্প থেকে নেমে এসেছে। এখনও মিস সেন্ট অ্যানথনিজ আখ্যা ও পায়নি, কিন্তু টিচাররা ওকে আড়ালে ব্লাডি মেরি বলে ডাকেন। ইতিহাসের ওই কুখ্যাত রানির নামে ওকে ডাকা হয় কেন আমরা ভেবে পেতুম না। দেবলীনাই জ্ঞান দিল। ওটা একটা ককটেলের নাম। ভোদার সঙ্গে টম্যাটো রস পাঞ্চ করে নাকি ব্লাডি মেরি হয়। দারুণ খেতে।
রুবিনা বলল, ঘাবড়া মৎ ঋতু, তোর চিন-এর টোলটাই তোকে বাঁচাবে, মানে কাউকে ডোবাবে। ইটস ভেরি সেক্সি।
আমি এখন আয়নার দিকে তাকিয়ে আমাকে দেখছি। মস্ত বড়ো আয়না। মাঝখানে একটা, দু-পাশে দুটো। তিনটে ছায়া পড়েছে আমার। ভুরু নেই, গোল গোল চোখ, দাঁত উঁচু, বেবি ফেস, বেঁটে, কালো, সোজা সোজা চুল, সুদ্ধ-মাত্র চিবুকের টোল সম্বল। একটা গরম তরল কিছু উঠে আসে ভেতর থেকে। আমি শৌনককে চাই। কবে থেকে চাই। প্রেপ থেকে পড়ছি ওর সঙ্গে। ও আমার খাতা নিয়েছে, আমি ওর খাতা নিয়েছি। এক সঙ্গে বাড়ি ফিরেছি, ওর বাড়ি আমার একটু আগে। একটা বড়ো বড়ো ছায়াঘেরা গলিতে ওকে বেঁকে যেতে হয়। এর ওপর যেন আমার একটা জন্মগত অধিকার জন্মে গেছে। কিন্তু ও সেটা বুঝলে তো? ও আমাদের স্কুলের সেরা অ্যাথলিট। ক্রিকেট টিমের ক্যাপটেন। মিক্সড ডাবলসে ব্যাডমিন্টনে ওর পার্টনার দেবলীনা। শৌনকের চোখ কিন্তু সবসময়ে বৈশালীকে খোঁজে। এসব আমি বুঝতে পারি। খেলাধুলোয় আমি নেই। একটুআধটু টেবিল টেনিস খেলার চেষ্টা করি। ছোটো থেকে নাচ শিখছি, ফুটওয়ার্ক ভালো হওয়া উচিত, কিন্তু রুবিনা আমার চেয়ে অনেক দ্রুত, অনেক চৌখশ। নাচ শিখছি বলে যে স্কুল কনসার্টে হিরোইনের রোল পাই, তা-ও না। সেখানে বৈশালী আমার চেয়ে অনেক খারাপ নেচেও হিরোইন। আমি সখীদের দলে। বৈশালীকে খুঁটিনাটি স্টেপিং শেখাতে আমার প্রাণ বেরিয়ে যায়। বাড়ি ফিরলে মা বলে, কি রে শ্যামার রোলটা পেলি?
না, মা। এই ফিগারে শ্যামা?
সে কী? তবে? বজ্রসেন?
কী যে বল মা, চার ফুট সাড়ে দশ ইঞ্চিতে বসেন হয়?
মা যেন এই প্রথম আমাকে দেখে। ভালো করে তাকায়। চোখের দৃষ্টিতে একটা বিস্ময়। যেন মা বলতে চাইছে, সত্যি? এই ফিগারে হয় না বুঝি? ও তোর হাইট কম বুঝি? তাই তো… তাই তো…
মায়েরা স্নেহান্ধ। নিজের মেয়েকে প্রত্যেকেই হয়ত অপ্সরি ভাবে।
অত ভালো করে ভরতনাট্যমটা শিখলি! কোনো কাজেই… দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে মিলিয়ে যায় শেষ কথাগুলো।
মাকে আমি বুঝতে পারি। আমি একমাত্র মেয়ে, একমাত্র সন্তান। আমার একটা ভাই হয়েছিল। হয়েই মারা যায়। মা বাবা কেউই সেই শোক কাটাতে পারেনি। কেমন বিষণ্ণ, সবসময়ে যেন ভাবিত, মনের মধ্যে কী একটা ভার বইছে। আমাকে নিয়ে মা-বাবার অনেক আশা। ছোট্ট থেকে মা বাড়ির সব কাজ সামলে আমাকে নিয়ে সাঁতার, নাচ, ছবি-আঁকার স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে, আসছে। আমার একটু গা গরম হওয়ার জো নেই। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার, সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারেও ভীষণ সাবধান। ব্যালান্সড ডায়েট, ব্যালান্সড ডায়েট করে দুজনেই পাগল। তা ছাড়াও আমাদের সব কিছু ছকে বাঁধা। মাসে একদিন মামার বাড়ি, দুমাসে একদিন জেঠুর বাড়ি, বছরে একবার বড়ো বেড়ানো, একবার ছোটো বেড়ানো।
মাধ্যমিক পর্যন্ত বাবা-মা মোটামুটি আমার লেখাপড়া দেখিয়ে দিয়েছে। মাধ্যমিক পর্যন্ত আমি বেশ ভালোও করেছি। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক থেকে আর কূল পাচ্ছি না। বাবা-মাও না। তিনজন টিউটর এখন আমার। নশো টাকা আমার টিউটরের পেছনে খরচ, নাচের স্কুলে দেড়শো, এখন স্পেশ্যাল কোচিং নিতে হয়। এ ছাড়াও আছে নাচের পোশাক, নাচের টুপে এখানে-ওখানে যাওয়ার খরচ। আমার মা তো চাকরি করে না, বাবা একা। আমার একেক সময়ে খুব খারাপ লাগে। দেবলীনা বা বৈশালীদের মতো আমরা ধনী তো নই! ওরা আমার বন্ধু বলেই বাবা-মা কয়েক বছর ধরে ভি সি আর, ওয়াশিং মেশিন কিনল, এবছর জন্মদিনে আমাকে একটা নতুন মিউজিক-সিস্টেম কিনে দিয়েছে। সি ডি প্লেয়ার পর্যন্ত আছে। জন্মদিনে বন্ধুরা এসে ওটা দেখে হুশ হাশ করছিল।
দেবলীনা বলল, ইশশ মাসি, আমি যে কেন ওনলি চাইল্ড হলাম না। দাদাটা সব মাটি করল।
আমার মা হাসতে গিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, কত ভাগ্যে একটা দাদা পেয়েছ তা যদি জানতে। ঋতুটা বড়ই একা।
বৈশালী বলল, দাদা তবু স্ট্যান্ড করা যায়, কিন্তু দিদি?
রুবিনা বলল, যা বলেছিস।
শৌনক বৈশালীর দিকে চেয়ে বলল, যাক বাবা, দাদা স্ট্যান্ড করতে পারিস। তাহলে অন্তত তুই ফেমিনিস্ট নোস।
জন্মদিনের উৎসবের শেষে কেমন মনমরা লাগল। মাকে বললাম, কেন যে এত দামি উপহার দাও।
মা বলল, তোকে আরও কত দিতে আমাদের সাধ যায়!
আরও? মা, আর কত দেবে? আমি কী করে তোমাদের এতসব ফেরত দেব?–মনে মনে বলি।
মা একটু দ্বিধা করে বলল, তুই যেন নিজেকে কারও থেকে ছোটো, কারও থেকে কম না ভাবিস।
কিন্তু মা ওয়াশিং মেশিন, ভি সি আর, মিউজিক সিস্টেম এই দিয়েই কি আমি ওদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারব? হতে পারব বৈশালীর মতো সুন্দরী, দেবলীনার মতো খেলোয়াড়, রুবিনার মতো চৌখশ, বিদিশার মতো ব্রিলিয়ান্ট?
অনেক করে বাবা-মাকে বুঝিয়েছিলাম আমি সায়েন্স নেব না, অঙ্ক আমার বাঘ। খেটেখুটে মাধ্যমিকে পাঁচাত্তর পার্সেন্ট পেয়েছি বটে কিন্তু ভয় আমার ঘোচেনি। কেমিস্ট্রি আমি মুখস্থ করতে পারি না, ফিজিক্স আমার মাথায় ঢোকে না, বায়োতে প্র্যাকটিক্যাল করতে আমার ঘেন্না করে। আমি বোঝালাম। বাবা বলল, তুই একটা স্টার পাওয়া মেয়ে। ফিজিক্স-কেমিস্ট্রিতে লেটার পেলি, জিয়োগ্রাফি আর ম্যাথসে সামান্য কয়েক নম্বরের জন্য লেটার মিস করেছিস। তুই সায়েন্স পারবি না? এটা কি একটা কথা হল?
মা বলল, তাহলে কি তোর ভালো লাগে না?
ভালোও লাগে না, কঠিনও লাগে মা, কেন বুঝতে চাইছ না?
কিন্তু আমরা যে কবে থেকে ভেবে রেখেছি, তোকে এঞ্জিনিয়ার করব!
বাবা বলল, জানিস তো, আমি হেলথ পরীক্ষায় পাশ করতে পারিনি বলে এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পারলাম না।
মা স্বপ্ন-ভরা চোখে বলল, নিতু মাসিকে মনে আছে তো? আমার মামাতো বোন? মনে আছে?
হ্যাঁ। এখন তো কানাডায় থাকে।
শুধু থাকে? কত বড়ো এঞ্জিনিয়ার, আমার সমবয়সী বোন, সে মন্ট্রিঅলে বসে বড়ো বড়ো মেশিনের ডিজাইন করছে। আর আমি? আমি বোকার মতো সায়েন্স পড়লুম না, ফিলজফিতে দিগগজ হয়ে এখন দিনগত পাপক্ষয় করে যাচ্ছি।
কিন্তু মা, সায়েন্স পড়লেই যে আমি জয়েন্ট পারব, পারলেও যে নিতু মাসির মতো ব্রিলিয়ান্ট হব, তা কে বলল?
কে বলতে পারে কে কী হবে? মায়ের চোখ যেন শূন্যে স্বপ্নের পাহাড় দেখছে। বাবা বলল, ঠিক আছে ঋতু, তোর যা ভালো লাগে পড়। আমরা কোনো চাপ দেওয়ার ব্যাপারে নেই। তোর যা ইচ্ছে। তবে তুই যে মিথ্যে ভয় পাচ্ছিস এটা আমি তোকে বলতে পারি। ঠিক আছে ডিফিডেন্টলি কিছু করা ঠিক না। ইচ্ছের বিরুদ্ধে চাপাচাপি আমি পছন্দ করি না।
বলল বটে, কিন্তু বাবার মুখে কোনো আলো নেই। মার মুখ করুণ।
তা সে যাইহোক, একবার যখন বাবা-মার মৌখিক অনুমতি আদায় করতে পেয়েছি আমি আর্টসই পড়ব। পাখির মতো উড়ে যাচ্ছি। স্কুলে যাবার পথেই দেবলীনা, তারপর শৌনক। ওরা দুজনেই সায়েন্স। আমি আর্টস নিচ্ছি বলতে দুজনেই থেমে গেল। তারপর শৌনক বলল, ঋতু স্কুলে গিয়ে কাজ নেই। তুই ডাক্তারের কাছে যা, ওই যে ডাক্তার কাঞ্জিলাল।
দূর ওঁর কাছে গিয়ে কী করব? উনি তো…
পাগলের ডাক্তার, তা তুই কি ভেবেছিস তোের মাথাটা ঠিক আছে?
দেবলীনা বলল, হিউম্যানিটিজ নিয়ে পড়ে তুই কী করবি? কেরিয়ার তো একটা তৈরি করতে হবে।
এই সময়ে রুবিনা আর বিদিশা এসে আমাদের সঙ্গে মিশল। রীতেশ আর সৃঞ্জয়ও আসছে দেখলাম।
দেবলীনা বলল, শুনেছিস? ঋতু আর্টস নিয়ে পড়বে। হিস্ট্রি, লজিক, এডুকেশন, পল সায়েন্স…।
বিদিশা বলল, কী ব্যাপার রে ঋতু? আমাদের এবার থেকে অ্যাভয়েড করতে চাইছিস, নাকি? আমার এ পথযতোমার পথের থেকে অনেক দূরে?
বিদিশাটার আসলে আমার ওপর একটু দুর্বলতা আছে। সব সময়ে আমি ওর সঙ্গে সঙ্গে থাকি। বা বলা যায় পেছন পেছনে থাকি। বিদিশা ফার্স্ট গার্ল, সৃঞ্জয় সেকেন্ড, আমি থার্ড আসি, কখনও কখনও ফোর্থও এসে যাই। মাধ্যমিকে সেকেন্ড এসেছি। বিদিশাকে ছুঁতে পারিনি। আমাকে বিদিশা ওর সহচরী বলে মনে করে। ল্যাংবোট আর কি! আমি আশেপাশে থাকলে ওর প্রতিভাটা আরও খোল। মাধ্যমিকে সেকেন্ড এসেও আমার মান বিশেষ বাড়েনি। বিদিশাই বলে, টেন্যাসিটি থাকলে কী না হয়? ঋতুকেই দ্যাখ না।
ঋতুর মতো দিনরাত বইয়ে মুখ গুঁজে থাকা আমার দ্বারা হবে না বাবা— দেবলীনা ঘোষণা করল। বেশি না খেটেও দেবলীনা স্টার পেরেছে।
ফর্ম নিলাম। লিখতে যাচ্ছি, শৌনক একলাফে এগিয়ে এসে আমার হাতদুটো পিছমোড়া করে ফেলল। বিদিশা লিখল, কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স, ম্যাথমেটিক্স। আমার দিকে তাকাল। ফোর্থ সাবজেক্ট কী নিবি বল, এইটা তোর পছন্দমতো দেব।
আমি বললাম, সাইকো।
সই করতে হাত ব্যথা করছিল, এমন জোরে ধরেছিল শৌনক। সই করার আগে শৌনকের দিকে তাকালুম, বিদিশার দিকে তাকালুম, দায়িত্ব কিন্তু তোদের।
ঠিক হ্যায় ভাই। কাঁধ চওড়া আছে। শৌনক ত্যাগ করল।
মা-বাবা বলল, আমরা কিন্তু জোর করিনি ঋতু, নিজের ইচ্ছেয় সায়েন্স নিলি! ভাবিস না। টিউটর, বইপত্র, লাইব্রেরি যা লাগে সব বলবি হয়ে যাবে।
সেই দৃশ্যটার কথা মনে করে আমার চোখ জ্বালা করছিল। আজ এইচ এস শেষ হল। আর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আমাদের চণ্ডীগড়, কুলু-মানালি বেড়াতে যাবার কথা। কিন্তু আমি কি উপভোগ করতে পারব কিছু? ম্যাথস আমার যাচ্ছেতাই হয়েছে। কেমিস্ট্রিতেও বোধহয় অনেক ভুল করেছি। এইচ এস যে এত টাফ হবে, আমি কেন আমার বন্ধুরাও বুঝতে পারেনি। কেউ খুশি না।
শৌনক বলল, আগে থেকেই তাদের গুডবাই জানিয়ে রাখছি।
কেন, কোথায় যাচ্ছিস? স্টেটস? টোয়েফল-এ বসলি নাকি?
খেপেছিস? শৌনক বলল, ড্রপ-আউট। স্কুল ড্রপ-আউট বলে একটা কথা আছে জানতাম। শৌনক বিশ্বাস কথাটা এবার রিয়্যালইজ করতে চলেছে। বাবাকে বলেছি একটা ফোটোকপি মেশিন নিয়ে বসব। কোর্টের পাশে জায়গা দেখুক।
বৈশালী বলল, ভ্যাট, তুই তো স্পোর্টস কোটাতেই যে-কোনো জায়গায় পেয়ে যাবি। আমারই হবে মুশকিল।
শৌনক শুকনো মুখ করে বলল, পাস কোর্সে বি, এসসি পড়ে কী হবে, বল?
সুমিত বলল, আগে থেকে অত ভেঙে পড়ার কী আছে? আমিও তো ফিজিক্সে
গাড্ডু খাব মনে হচ্ছে। তো কী? জয়েন্ট তো আছে এখনও। এ বারে না হয় পরের বছর।
শৌনক বলল, জয়েন্টে তো স্পোর্টস কোটা নেই।
বৈশালী আঙুল চিবোচ্ছিল। বলল, ঋতু তুই কি জয়েন্টে বসছিস?
বসতে তো হবেই। না হলে বাবার মুখ থেকে আলো নিবে যাবে। মায়ের চোখদুটো…না না সে আমি সহ্য করতে পারব না।
আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে সরে এলুম। শুনতে পেলুম বিদিশা বলছে, ঋতুটার পরীক্ষা আসলে খুব ভালো হয়েছে। বুঝলি?
ঠিক সতেরো দিন বাদে জয়েন্ট। শেষ হলেই মনে হল মায়ের গর্ভ থেকেই যেন পরীক্ষা দিতে দিতে আসছি। কবে যে নিবে-আসা দিনের আলোয় পড়িনি, রাত জেগে লেখা প্র্যাক্টিস করিনি, কবে যে টেনশন ছাড়া, প্যানিক ছাড়া দিন কাটিয়েছি, মনে করতে পারছি না। এত দিনে কি শেষ হল? জয়েন্টে যদি এসে যাই, তো চার বছর এঞ্জিনিয়ারিং, সে মেক্যানিক্যাল থেকে আর্কিটেকচার পর্যন্ত যেটা পাই। তারপর ওঁ শান্তি। সার্টিফিকেটটা মা-বাবাকে ধরিয়ে দিয়ে বলব, কী? খুশি তত? খুশি? আর কিছু না। কিছু পারব না। থিসিস না, বিদেশ না, নিতু মাসি দীপু কাকারা নিজেদের মতো থাক, আমিও আমার মতো থাকব। একটা চাকরি তো পেয়ে যাবই। তারপর দুমদাম করে বড়ো হয়ে যাব। টিউটরদের মুখ আর দেখতে হবে না। নাচটাও ছেড়ে দেব। ধু-র ভাল্লাগে না। কী হবে আর?
আজ রেজাল্ট বেরোবে। জয়েন্টরটা আগেই বেরিয়ে গেছে। বেড়ালের ভাগ্যে শিকে আর ছিড়ল কোথায়? বিদিশা, শৌনক দুজনেরই কিন্তু হয়ে গেছে। এত দিন ছিল শৌনক-বৈশালী জুটি। এবার বোধহয় শৌনক-বিদিশা! দুজনেই ওরা বেঙ্গল এঞ্জিনিয়ারিং-এ যাচ্ছে।
এল সিক্সটিন আসছে। এই বাসটা পয়া। চড়ে পড়েছি। স্কুল স্টপে নামতেই সৃঞ্জয় একদিক দিয়ে দেবলীনা আরেক দিক দিয়ে যেন ছিটকে বেরিয়ে গেল।
দেবলীনা! এই লীনা! কী রকম হল?
দেবলীনা কাঁচুমাচু মুখ করে একটা বাসে উঠে পড়ল। লীনার কী ভালো হল না? সেকেন্ড ডিভিশন হয়ে গেল নাকি? সৃঞ্জয়ের দিকে তাকাই। কোথায় সৃঞ্জয়।
ভিড় ঠেলেঠুলে ঢুকতে থাকি। বেশিরভাগ ক্যান্ডিটেটই বাবা কি মা কি আর কাউকে সঙ্গে করে এনেছে। আমার মাও আসতে চেয়েছিল। কদিন মায়ের জ্বর হয়েছে। আমি বারণ করলাম। আজকে জাস্ট রেজাল্ট বেরোচ্ছে, আসল বাঘের খেলা মার্কশিটের দিনে। সে দিন মাকে আনব।
আমাদের নোটিস বোর্ডটা বড্ড উঁচুতে। তার ওপর কাঁচে আলো ঝলকাচ্ছে, কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
বলো, বলো তোমার রোলটা বলো, আমি দেখে দিচ্ছি। বাবা-জাতীয় একজন বললেন।
এফ এইচ এ থ্রি টু সেভেন ওয়ান।
এফ এইচ এ থ্রি টু কী বললে?
সেভেন ওয়ান, ওয়ান, এই তো, সেভেন টু। নাঃ সেভেন ওয়ান তো নেই!
সে কী? এফ এইচ এ থ্রি টু সেভেন ওয়ান! দেখুন না!
আমি সরে যাচ্ছি, মাই গার্ল, তুমি নিজেই দেখো।
আমার পায়ের তলাটা হঠাৎ সমুদ্রের বেলাভূমি হয়ে যাচ্ছে। বালি সরছে, বালি সরছে, আমার রোল নাম্বার নেই, নেই। সত্যিই নেই। এ কী? এরকম হয় নাকি? এ রকম ঘটে? আমার…আমি…আমার ক্ষেত্রে ঘটছে এটা? ঋতুপর্ণা মজুমদার… আমার… রোল নম্বর নেই?
আমার দুপাশ থেকে সমুদ্রের তীরে বালির মতো ভিড় সরে যাচ্ছে। আমি ডান হাত বাড়িয়ে পথ করে নিচ্ছি। কিছু দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু সামনে চলেছি ঠিক। চোখে জল? না, না জল নয়। কেমন একটা ধোঁয়াশা, যা এই সাতসকালে থাকার কথা নয়, বুকের মধ্যেটা কেমন স্তব্ধ। আমার হৃৎপিণ্ডটাও সৃঞ্জয় আর দেবলীনার মতো ছিটকে সরে যাচ্ছে।
রাস্তা, রাস্তা…অনেক পরে খেয়াল হল আমি রাস্তা পার হচ্ছি। যন্ত্রের মতো জেব্রা ক্রসিঙে এসে দাঁড়িয়েছি। যন্ত্রের মতো পার হচ্ছি রাস্তা। আমি কোনদিকে যাচ্ছি? বুঝতে পারছি না। আমাদের গলিটা যেন কেমন? দূর, শরীর যখন আমায় এতদূর টেনে এনেছে বাকিটাও টেনে নিয়ে যাবে। প্রতিবর্ত ক্রিয়া না কি একটা বলে যেন! আমি ভাবব না। ভাবছি না তো! চলছি। চলছি শুধু। আমার হাতে এটা কী? ও এটাকে বোধহয় পার্স বলে। এর ভেতরে কী থাকে? টাকাপয়সা। টাকাপয়সা মানে কী? কত টাকায় কত পয়সা হয়। কত পয়সায় কত টাকা হয়?
আরে! এই বাড়িটা তো আমি চিনি। উঁচু বাড়ি। দশতলা বোধ হয়। তুমি দশ গুনতে জানো ঋতু, যে দশতলা বললে? আচ্ছা গুনে দেখি তো? লিফটে যাব না। আমি গুনতে গুনতে উঠব। সেই কারা যেন কী গুনতে গুনতে গিয়েছিল? দোলা, ছ পণ, হ্যাঁ হ্যাঁ দোলায় আছে ছ পণ কড়ি গুনতে গুনতে যাই।
আস্তে আস্তে উঠছি আমি। এইটাই কি আমার বাড়ি? না তো! এটা বোধহয় আমার বাড়ি না। কিন্তু এটাতে আমি আসি। রোজ আসি না। শনি-মঙ্গলবারে আসি। শনি মঙ্গলবার…এসব কথার মানেই বা কী? এই তো পেতলের নেমপ্লেটঅলা দরজাটা। ওহ, এটা সেই অঙ্ক-ফিজিক্সের স্যারের বাড়ি। এখখুনি দরজাটা খুলে যাবে, স্যার চশমা মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করবেন।…
আমি পড়ি কি মরি করে ওপরের দিকে ছুটতে থাকি। এতক্ষণ পরে আমার দেহে গতি এসেছে। ছুটতে ছুটতে আমি চলে যাই ছাদের শেষপ্রান্তে। তারপর নিজেকে ছুড়ে দিই শূন্যের কোলে। হে শূন্য আমায় কোল দাও।
আর ঠিক সেই সময়ে যখন আর ফেরবার কোনো উপায়ই নেই, তখনই পৃথিবী তার সমস্ত ঐশ্বর্য উজাড় করে দেয় মেয়েটির কাছে। জীবন উজাড় করে দেয় তার সমস্ত নিহিত মানে।
রোদ দেখে সে জীবনে যেন এই প্রথমবার। বুঝতে পারে রোদে এই সেঁকা হওয়া, উলটে পালটে ঘরবাড়ি গাছপালা গোরুছাগল মানুষটানুষ সমেত…এইটাই জরুরি ব্যাপার, পরীক্ষার ফলাফলটা নয়। গাছও দেখে সে। একটা গুলঞ্চ, তিনটে বটল পাম। তার জ্ঞাতি এরা, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এদের সঙ্গে তার, তাদের পারস্পরিক টান। একশো ফুটের কাছাকাছি উচ্চতা থেকে পড়তে পড়তে তার হৃৎপিণ্ডে ফুসফুসে মাধ্যাকর্ষণ ও হাওয়ার অমানুষিক চাপ তবু সে উলটো দিকের এগারো তলা বিল্ডিঙের সাততলার আলসেয় বসা একজোড়া ঘুঘুর গলার চিকন ময়ুরকণ্ঠি রংটা পর্যন্ত দেখতে পায় এবং সঙ্গে সঙ্গে বৈশালী বা শৌনক নয়, নিজেরই মুখের অনন্য সৌন্দর্য আর একবার দেখবার জন্য ব্যস্ত হয় পড়ে।
সমস্তটাই ভগ্নমুহূর্তের একটা ঝলক। একটা বোধ শুধু। এমনই আলোকসামান্য এই বোধ যে এর জন্য জীবন দেওয়াই যায়। কিন্তু মুশকিল এই যে জীবনটা চলে গেলে বোধটারও আর কোনো মানে থাকে না।
ওতুলের প্রতিদ্বন্দ্বী
ওতুল নিজেকে গুঁই বলে না, ইংরেজি বানান অনুযায়ী বলে গুইন। এতে ওতুলের। বাবার আপত্তি আছে যথেষ্ট, কিন্তু গুইন হিসেবে ছেলের দাপট অর্থাৎ সাফল্যে চমৎকৃত হয়ে তিনি এ বিষয়ে আর বিশেষ উচ্চবাচ্য করেন না। কেউ মি, গুইনকে ডাকতে এলে এখন তিনি বেশ গর্বের সঙ্গেই কবুল করেন এই মি. গুইন তাঁরই কুলপ্রদীপ, তিনি দেখছেন সে বাড়ি আছে কি না, ভারি ব্যস্ত মানুষ তো! ওতুল মস্তান নয় কিন্তু। সে নিজেকে বলে মস্তানের বাবা। অর্থাৎ তাদের এলাকার মস্তানরা—খেদা, ন্যাড়া, বীরু এরা ওতুলদার পরামর্শ ছাড়া এক পা চলে না। খেদা-ন্যাড়াদের কবজায় রেখে ওতুল পুরো এলাকাটাকেই কবজায় রেখেছে বলা চলে। এই প্রতিপত্তি অবশ্যই একদিনে হয়নি। এমনি এমনিও হয়নি। প্রথমত, ওতুলের শরীর স্বাস্থ্য ঠিক যে তুলনায় দশাসই, ঠিক সেই তুলনায় মোলায়েম তার গলার স্বর এবং আচার-ব্যবহার। যে পাবলিক রিলেশনস প্রতিভা তার বাপ ঠাকুরদা খদ্দের চরাতে চরাতে বহু জেনারেশন ধরে আয়ত্ত করেছেন, সেই দুর্লভ জনসংযোগক্ষমতা একরকম জন্মসূত্রেই তার হাতের আমলকী। অতি কৈশোর থেকে সে প্রথমে তার পাড়ার, তারপর তাদের এলাকার, তারপরে আরও বৃহৎ এলাকার যাবতীয় ঝগড়া-কাজিয়া মেটানো ইত্যাদি অভিভাবকগিরি করে এসেছে। অত্যন্ত সফলভাবে। প্রথম প্রথম পাড়ার বড়োরা তাকে জ্যাঠা ছেলে বিশেষণে বিশেষিত করতেন। পরে ঠিক তাঁরাই বলতে আরম্ভ করেন, ওতুল বড়ো বিচক্ষণ ছেলে। তাঁদের কারও ছেলে ঘোঁতন, কারও নাতি ট্যাঁপা, কারও মেয়ে কুঁচি এদের কেসগুলো ওতুল সমুদয় জট ছাড়িয়ে একেবারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিত। সুতরাং প্রতিপত্তি ওতুলের হবে না তো কি সুবিকাশ সরখেলের হবে? এর ওপরে ওতুলের একটা সাংস্কৃতিক অ্যাঙ্গল আছে। সে সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট তো বটেই। উপরন্তু গান করতে পারে, বক্তৃতা করতে পারে, এমনকি কলমের জোরও তার আছে। বিশাল কালীপুজো এবং সরস্বতীপুজো হয় তাদের পাড়ায়। দুটি পুজোরই জাঁকজমক এবং পরবর্তী সাংস্কৃতিক উৎসবসূচি আপনার আমার চোখ ট্যারা করে দেবার মতো। বিশ ফুট কালীপ্রতিমা বিসর্জনের সময়ে ওতুল যখন তার প্রকাণ্ড সাদা কপাল তেল-সিঁদুরে চর্চিত করে, সিল্কের পাঞ্জাবির মধ্যে দিয়ে লাল, রোমশ বক্ষপট বিদ্যুচ্চমকের মতো দেখাতে দেখাতে শার্দুলবিকৃত ছন্দে চলে, এবং তাকে কেন্দ্র করে ঘেঁদা, ন্যাড়া, বীরু ও সম্প্রদায় প্রবল বিক্রমে স্ট্যাম্প-মারা বিসর্জনি নাচ নাচতে নাচতে তার সঙ্গ নেয়, তখন বিশফুটি কালীপ্রতিমাই পুজ্য ছিলেন, না হলুদ সিল্কের ওতুলকৃষ্ণই সত্যিকারের পুজ্যপাদ ছিল বোঝা শক্ত হয়ে ওঠে।
তবে কোনো মানুষের পক্ষেই সব মানুষের মন রাখা সম্ভব নয়। জনপ্রিয়তার বত্রিশপাটি হো-হো হাসির মাঝে মধ্যে দু-একটা ফোকলা দাঁতের ফাঁকি থেকেই যায়। কিছু হিংসুটে মানুষ বিসর্জনি মিছিলে সিল্কের বুকখোলা পাঞ্জাবি-পরিহিত ওতুলকৃষ্ণকে পুতুলকৃষ্ণ, বিপুলকৃষ্ণ ইত্যাদি বিকৃত নামে ডেকে নিজেদের মধ্যে মজা পেয়ে থাকে। কিন্তু বেশিরভাগ ঝুলবারান্দা থেকেই সদ্য বয়ঃপ্রাপ্ত নারী-জনতা বাবা-মা, জ্যাঠা-কাকাদের চোখ এড়িয়ে ওতুলদার এই উদ্দণ্ড নৃত্যপর শ্রীচৈতন্যরূপ বা প্রভুপাদরূপ দেখে পুলকিত হয়ে ওঠে। এই সময়টায় জেগে এবং ঘুমিয়ে তারা কতরকম স্বপ্ন দেখে। সেসব কিশোরী তরুণীস্বপ্নের গোপনীয় ডিটেলের মধ্যে আমাদের না যাওয়াই ভালো।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা জলসার সময়ে ঘোষক বা ঘোষিকা অফ বম্বে ফেম থাকে, জনপ্রিয়তম লোকসংগীত গায়ক থাকে, নেচে নেচে গান-গাওয়া বিখ্যাত গায়িকা, সুন্দরী আবৃত্তিশিল্পী, সুকণ্ঠ শ্রুতিনাট্যনট ইত্যাদি যথেষ্ট পরিমাণে আমদানি হয়। সবচেয়ে বড়ো কথা পাড়ার উঠতি প্রতিভাদের ওতুল এই সময়টায় সুযোগ করে দেয়। সুচন্দ্রা সান্যাল যে অবিকল আশা ভোঁসলেকে নকল করতে পারে, ট্যাঁপা ওরফে অরুময়কে যে কুমার অরু নাম দিয়ে অনায়াসে নামকরা আধুনিক গাইয়েদের পাশে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যেতে পারে, ছোট্ট গেনি যে জাত-বাউলদের মতো নাচতে এবং গাইতে পারে এসব ওতুলকৃষ্ণরই আবিষ্কার। সুচন্দ্রা সিনেমায় চান্স পেল বলে, গেনি তো সেই কবেই চিচিংফাঁক-এ ঢুকে বসে আছে। কুমার অরু তরুণদের জন্যর জন্যে শিগগিরই অডিশন দেবে।
এই মরশুমটাতে এনতার প্রেমও হয়। পাড়ার কিশোরী-তরুণীরা পুজোয় বাবার বোনাস ভাঙানো মহার্ঘতম শাড়িটি পরে। রঙে-চঙে সুন্দরতম হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, তারপর পরম অবহেলায় আয়রন-করা চুল দুলিয়ে, পিন-করা আঁচল উড়িয়ে ওতুলদা, ন্যাড়াদা, বীরুদাদের ঝাপটা দিয়ে দিয়ে চলে যায়। মতামতের আদানপ্রদান হয়, জলসার নানা কাজের ভার পায় এরা, আর্টিস্টদের মনোরঞ্জন, খাবারদাবার এগিয়ে দেওয়া, অটোগ্রাফের খাতা দফায় দফায় সই করানো, পেল্লায় দায়িত্ব সেসব। এবং এইসব চলতে চলতে আঙুলে আঙুল ঠেকে, কাঁধে কাঁধ। শাড়ির আঁচল খসে, কোমরের রুমাল থেকে উৎকট সুগন্ধ বার হতে থাকে। পাটভাঙা কাগজের পোশাকের মতো কড়কড়ে পাজামা-পাঞ্জাবি, পেখমধরা, ঘাড়ে কেয়ারি চুল, দু আঙুলের ফাঁকে পৌরুষব্যঞ্জক সিগারেট। ওতুলদা তখন আড়চোখে কার দিকে চাইল রে? রূপার দিকে। ধ্যাত, ও তো সোমালির দিকে। টিঙ্কু কিছু বলছে না। মুখ টিপে টিপে হাসছে। সে, একমাত্র সে-ই জানে ওতুলদা, ন্যাড়াদা, ইত্যাদি কার দিকে চাইল। কার দিকে আর চাইবে? এমন ফিগার, এমন ঠোঁট, এমন কাজলপরা চোখ আর এ শহরে দুটো আছে নাকি? টিঙ্কু আয়নার নিজেকে যতই দেখে ততই নিজে নিজেই মস্ত হয়ে যায়। তাই বলে কি আর পাড়ার সব। ছেলে মেয়েগুলির পাড়ায় মধ্যেই বিলিব্যবস্থা হয়ে যায়? তা হয় না। তা হবারও নয়। এসব হল মরশুমি প্রেম। নতুন শীতের হাওয়ার কারিকুরি। কার সঙ্গে বিয়ে হল? না ন্যাড়া-গুণ্ডার সঙ্গে। মিসেস ন্যাড়া গুণ্ডা! ছ্যাঃ। মেয়েরা আজকাল আগের মতো রাম-বোকা আর নেই।
অনেকদিন খালি পড়েছিল শম্ভ উকিলের জরদগব বাড়িটা। অতবড়ো বাড়িটায় দটি মাত্র মানুষ। খালি পড়ে থাকা ছাড়া একে আর কী বলে? শম্ভ উকিল মারা যাবার পর একতলা বাড়িটাতে রইল সুষ্ঠু শম্ভ উকিলের আইবুড়ো বোন ধিঙ্গি দুগগা, বা দুগগা দিদি, আগেকার দিনে হলে যাকে ইন্দির ঠাকরুনের মতো দুগগা ঠাকরুন বলে ডাকা হত। তো এই দুগগা ওতুলের সঙ্গে লড়ে গেল। অনেকদিনের নজর ছিল ওতুলের বাড়িটার ওপর। অনায়াসে একটা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র খোলা যায়। বিঘেখানেক জমির ওপর একটেরে একতলা। চার পাঁচখানা বড়োসড়ো ঘর। লাইব্রেরি, ইনডোর গেমস, আচ্ছা ও অফিসঘর, সব এক ছাতের তলায় হতে পারবে। ভোলা জমিটা সাফসুফ করে ব্যাডমিন্টন কোর্ট, ব্যায়ামগায়, পাড়ার ছেলেমেয়েদের নিয়ে ড্রিল-টিল, দরকারমতো জলসার আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা সবই এক জায়গায় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কত সুবিধে বলো তো? শম্ভ উকিলের ক্যানসারের যন্ত্রণা যতই বেড়ে ওঠে, ওতুলকৃষ্ণদের হৃদয়ও ততই আশা উদবেল হয়ে উঠতে থাকে। ঠাকুরপুকুরে নিয়ে যাওয়া, শেষমেশ হিন্দুসৎকারের গাড়ি, ঠোঙাভরতি খই-পয়সা, সাদা পদ্মের রিদ সবই ওরা করল। পাড়ায় বিরাট করে শোকসভা হল। কনডোলেন্স। শম্ভ উকিল যে কত বড়ো মহামানব ছিলেন, শ্রীঅরবিন্দ, বিবেকানন্দ, চিত্তরঞ্জনের মতো গুপ্তযোগী, দেশপ্রাণ, মহাপ্রাণ সেসব কথা জ্বালাময়ী ভাষায় ওতুল সবাইকে বুঝিয়ে দিল। অনেকেরই চোখে জল। কারও রুমাল ভিজে সপসপ করছে, কেউ থাকতে না পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলছে, খালি দুগগা মুখ বেঁকিয়ে, পানের পিক ফেলে বললে, ঢ-অ-অ-:ং। বক্তিমে শুনে আর হেঁসে বাঁচিনে। সুতরাং দুগগার হাত থেকে শম্ভু উকিলের বাড়িটা চটপট উদ্ধার করা আর হয়ে উঠল না। শম্ভ উকিলকেও মরণোত্তর পল্লিরত্ন, কি দানবীর উপাধি দেওয়া গেল না।
দুগগা রক্ষিত আবার আরেকটি কম্মো করলে। একঘর ভাড়াটে এনে বসালে। ওতুল কত করে বোঝালে আজকালকার দিনে সব আইন ভাড়াটেদের পক্ষে। ভাড়া-বসানো আর খাল-কেটে কুমির আনার মধ্যে কোনোই তফাত নেই। ওই ভাড়াটে দুগগাদিদি শেষ পর্যন্ত ওঠাতে পারবে না। এই বাজারে লাখ-লাখ টাকার জমি দুগগাদিদির হাতছাড়া হয়ে যাবে। দুগগা রক্ষিতের ওই কথা, তোদের গভভে যাওয়ার চেয়ে বরং ভাড়াটেতেই গিলুক। তোরা আমাকে দূর করে দিবি। ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরুবি। তাস পিটে, টাসা পিটে হল্লা করে নরক গুলজার করে তুলবি। তার চেয়ে ভদ্দরলোক তার পুত-পরিবার নিয়ে শান্তিতে থাকুক। নিজের ঠেয়ে নিজের মতো। অকালকুণ্ডর দল, তোদের তাতে কী? দাদা নেই, আমার এখন নিজের খরচ-খর্চা নিজেরই চালাতে হবে। বুঝলি? যা এবার পালা। ওতুল যাদের দাঁতে কাঁকরের মতো ফুটে থাকে সন্দেহ নেই দুগগা রক্ষিত তাদেরই একজন।
ভাড়া তো হল। ঝাঁকড়া চুল, মোটা চশমা পরা ধারালো চেহারার এক যুবক, তার পেছন পেছন মেরুদণ্ড সিধে এক-বিনুনি-করা এক রোগা যুবতি এবং দুটি প্রায় এক সাইজের ভারী-ভুরি বাচ্চা এক টেম্পো মাল নিয়ে এসে নামল। দু-চার দিনের মধ্যেই শুনতে পাওয়া গেল—এ ভদ্রলোক যে সে নয়। উদীয়মান কবি আর্যশরণ ঘোষ। কবি আর্য ঘোবের আবার প্রধান বৈশিষ্ট্য সে নাকি লড়াকু মানুষ। শুধু পদ্যই লেখে না, নানারকম সমাজসেবামূলক কাজকম্মো করে থাকে। যুবতিটি তার স্ত্রী নয়, বোন। আর্য ঘোষ আসবার কয়েক মাসের মধ্যেই শম্ভ উকিলের বাড়ির সংলগ্ন জমির চেহারা ফিরতে লাগল। ওরা নাকি ফুল ভালোবাসে। মাথাভরতি ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল নিয়ে আর্যশরণ আর তার বোন যখন চুবড়ির মতো ডালিয়া আর চন্দ্রমল্লিকার দেখাশোনা করে, পাঁচ রকমের জবা আর সাতরকমের গোলাপ গাছে সার দেয়, তখন কাছাকাছির ঝুলবারান্দায় উঁকিঝুঁকি চলে। রূপা বলে, ফ্যানটা, বল টিঙ্কু? টিঙ্কু বলে, কোনগুলো? ডালিয়া না ক্রিসেনথিমাম না গ্ল্যাডিয়োলাস? রূপা মুচকি হেসে বলে, তোর মাথা। টিঙ্কু বলে, আই সি। দুজনেই দুজনকে বোঝার মজায় হাসতে হাসতে ভেতরে ঢুকে যায়।
সেবার কালীপুজোয় ফাংশনে সভাপতি করা হল আর্যশরণ ঘোষকে। ওতুলই করল। ওতুল বড়ো উদার চরিত্রের ছেলে। একথা বলতেই হবে। সে গুণের আদর করতে জানে। তা সেই সভার সভাপতির ভাষণ, এলাকাকে কাঁপিয়ে দিল। সে কি কবিতা, না জ্বলন্ত ফুলঝুরির মতো শব্দঝুরি, সে কি উপদেশ না অনুপ্রেরণা পাড়ার লোক ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারল না। কিন্তু তারা একেবারে বোল্ড হয়ে গেল। এমন অপরূপ করে যে কেউ শক্তিপুজোর ব্যাখ্যা করতে পারে, এমন কাব্যময় ভাষায় অনর্গল বলে যেতে পারে কাউকে মুহূর্তের জন্যেও বার না করে, বলবার সময় কারুর চেহারা যে এমন প্রদীপ্ত মশালের মতো হয়ে উঠতে পারে, এলাকার লোকের অভিজ্ঞতার মধ্যে এসব ছিল না। সেবার কালীপুজোর যা হবার হয়ে গিয়েছিল। সরস্বতীপুজো হল একেবারে অন্যরকম। স্থানীয় আর্টিস্ট সুকেশ মিত্তিরকে দিয়ে কাগজের প্রতিমা হল। বাসন্তী রঙের মণ্ডপ হল। পলাশ গাঁদায় ছেয়ে গেল বেদি। আলপনা হল মনে রাখবার মতো। পুস্পাঞ্জলি দিতে এল দফায় দফায় সবাই। সরোদ, সেতার, বাছা বাছা গান, এবং সন্তুর ছাড়া আর কিছু বাজল না, তা-ও মৃদুস্বরে। শ্বেতপদ্মাসনা দেবী স্তোত্র গানের মধ্যে দিয়ে শান্তভাবে ঘটবিসর্জন হয়ে গেল। সবার মনে হল এমন পুজো আর কখনও হয়নি, আবার হবে কি?
পাড়ার সাংস্কৃতিক কমিটির চেয়ারম্যান ওতুলকৃষ্ণ। তাই বলে স্থায়ী নয়। একেবারে গণতান্ত্রিক উপায়ে, সবাইকার মতামত নিয়ে ব্যাপারটা হয়, তবু জানা কথাই ওতুলই প্রেসিডেন্ট হবে। এবার আশ্চর্যের বিষয়, পাড়ার কিছু মাতববর ব্যক্তি বললেন, আর্যকে করা হোক না কেন? ছেলেটার এলেম আছে। ততোধিক আশ্চর্যের বিষয়, ন্যাড়া, মস্তান ন্যাড়া, ওতুলদার ডান হাত ন্যাড়া, যাকে বেপাড়ায় ন্যাড়া গুণ্ডা বলে উল্লেখ করা হয়, সেই ন্যাড়া এতে সায় দিল, সত্যিই তো। ওতুলদা কদ্দিক সামলাবে? তবে হ্যাঁ, ঝামেলা পোয়াতে হয় সেক্রেটারিকে, আর্যদা না হয় সেক্রেটারি হোক, ওতুলদা যেমন প্রেসিডেন্ট ছিল প্রেসিডেন্ট থাক। সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবটি পাস হয়ে গেল। ক্লাবের খাতা-পত্তর, বিল বই, অডিট রিপোর্ট, সুভেনির এভরিথিং চলে গেল আর্যশরণের খপ্পরে।
সমস্ত ঘটনাটার পর ন্যাড়াকে ডেকে রক্তচক্ষে ওতুল বলল, এর পর ফের ওতুলদা আজকে একটু মাল খাওয়াও বলিস, বলতে আসিস।
ন্যাড়া অবাক হয়ে বলল, যাচ্চলে, তুমিই তো প্রেসিডেন্ট, মানে সবেবসব নইলে। আর্যদা খালি খেটে মরবে। আসলে কি জানো, পাবলিক যা চায় মাঝেমধ্যে তা দিতে হয়, নইলে শালা ডেমোক্র্যাসিও মচকে যাবে, পাবলিকও খচে যাবে। রূপা-টিঙ্কুরাও আর্যদাকে চাইছে। দাই না চান্স একবার মাইরি।
মাসখানেকের মধ্যে খাতা-তহবিল সব মিলিয়ে-টিলিয়ে আর্যশরণ একদিন ওতুলকৃষ্ণকে ডেকে পাঠাল। বেশ সুগন্ধি চা খেতে খেতে, খাওয়াতে খাওয়াতে বলল, আচ্ছা ওতুল, তুমি কী করো?
কী করি? মানে? দেখতে পান না কী করি আর কী না করি?
এগজ্যাক্টলি। দেখতে পাই। ওতুল, আজকালকার দিনে কেউ আশা করতে পারে না একটা মানুষ দিবারাত্র আর পাঁচজনের জন্যে বিনামাশুলে খেটে যাবে। দিস ইজ টু মাচ। তুমি ন্যাড়া, খেদা, বীরু এবং আরও যারা ক্লাবের বিভিন্ন কাজ সারাবছর ধরে করে যাও, অথচ যাদের কোনো আয় নেই, তাদের একটা লিস্ট করে ফেলা যাক। জনা ছয় সাতের বেশি হবে না বোধহয়। আমার প্রস্তাব তাদের প্রত্যেককে ক্লাবের হোলটাইমার হিসাবে কিছু মাসোহারা দেবার ব্যবস্থা করা যাক।
ওতুল বলল, দে দ্দেখুন আর্যদা, এটা আমাদের অপমান করা। ন্যাড়া বীরুদের অপমান করা। আমরা যেটা করছি সেটাকে বলে মানবসেবা, কথাটা শুনেছেন?
আর্যদা প্রশান্তমুখে বললেন, শুধু মাসোহারা নয়, পুজো বাবদ সুভেনির ইত্যাদির জন্য যে যত বিজ্ঞাপন আনবে তার কিছুটা পার্সেন্টেজও কমিশন হিসাবে তোমাদের দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হোক। হিসেবের খাতায় যে বিরাট বিরাট গরমিলগুলো রয়েছে সেগুলোকে তোমাদের প্রাপ্য বকেয়া বলে অ্যাডজাস্ট করে নেওয়া হবে। তাহলেই হল। নইলে এইসব খাতাপত্তর, সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকার থেকে ট্যাক্স নিয়ে তৈরি তহবিল, এসব প্রহসন হয়ে যায় ওতুল।
আর্যশরণের পরের চালটা এল আরও সংঘাতিক। সে কালীপুজোর প্রস্তুতিপর্বে বলল, বিশ ফুট প্রতিমা করে প্রতিবছর বিসর্জনের সময় ওভারহেড তারকাটা সে বড়ো বিশ্রী। দশ ফুট প্রতিমা আরও অনেক সুন্দর হবে। কুমোরটুলির নারায়ণচন্দ্র পালকে দিয়ে করাও, অপূর্ব শ্যামামূর্তি করে দেবেন। আর রাস্তা আটক করে লরি, টেম্পো, ট্যাক্সি, প্রাইভেট কার, রিকশা এদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় কোরো না। মানুষকে এভাবে প্রেশারাইজ করা ঠিক না। ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারে না। কিন্তু আমি জানি গতবছর মুদির দোকানের তারাশংকরকে সাড়ে চার হাজার টাকা চাঁদা দিতে বলেছিলে বলে সে বেচারির স্ট্রোক হয়ে যায়। এগুলো ঠিক না।
কালীপুজোর রাতে একটি জমজমাট কারণসভা বসত। সেটাও এবার বসল না।
ওতুল যেমন উদারতায় বশিষ্ঠ, তেমনি বুদ্ধিতেও আবার সত্যি-বৃহস্পতি। সে সাপের লেজে পা পড়ার অপেক্ষাটিতেই ছিল। খ্যাঁদা, বীরু, ন্যাড়ার সঙ্গে তার গোপন বৈঠকগুলো ঘনঘনই বসতে লাগল।
টিক্কর বাবা রতনমণি ঘটক, রূপার বাবা সারদাচরণ সরকারকে ডেকে বললেন, সারদা, এসব কি শুনছি?
সারদাচরণ বললেন, শুনেছ? তুমিও শুনেছ তাহলে? ছোকরা ভদ্দরলোকের মতন থাকে… রতনমণি বললেন, শুনব না মানে? পরস্ত্রী ফুসলিয়ে এনে বোন সাজিয়ে সবার চোখের ওপর বাস করবে, আর শুনব না?
কী কেচ্ছা, কী কেলেঙ্কারি, শেষকালে কি সেই লিভিংটুগেদার না কী বলে, সেসব ব্যভিচার এইখানে, এই পাড়াতেই আরম্ভ হল?
সুচন্দ্রার মা একদিন শম্ভ উকিলের বাড়ির ভেতর গিয়ে কখানা শোবার ঘর দেখে এলেন। রিপোর্ট হল, একটা ডবল বেড়। আর একখানা তক্তপোশ। বেশ লম্বা চওড়া, ইচ্ছে করলে দুজনেও শোয়া যায়।
এক রবিবার সকালে হতভম্ব আর্যশরণ দেখল তার বাড়ির সামনের বাগান তছনছ করতে করতে এগিয়ে আসছে বেশ বড়োসড়ো একটা মারমুখী জনতা। তাদের মুখে অসন্তোষ, ঘৃণা, জিভে অকথ্য গালাগাল। একেবারে সামনে কিছু প্রৌঢ়, গুটিকয় বৃদ্ধ। তাঁরা বললেন, তাঁদের চক্ষুলজ্জা মানসম্ভম ইত্যাদি অনেক কিছুর বালাই আছে। হঠকারিতা তাঁরা প্রাণ গেলেও করতে পারেন না। তাঁরা তাকে কিছুই বলবেন না। শুধু এই ভদ্রলোকের পাড়া ছেড়ে আর্যশরণ অন্যত্র উঠে যাক। যেসব জায়গায় এসব চলে, যাক না সেখানে। সাতদিনের মধ্যে যদি না যায়, তাহলে পরিণামের জন্যে তাঁরা দায়ী থাকবেন না। ছেলেপুলে নিয়ে ভদ্রপাড়ায় ঘর করেন কি না সকলে। ছেলেদের এডুকেশন, মেয়েদের বিয়ে সবই তো তাঁদের ভাবতে হবে। জনতার মধ্যে ওতুল, কিংবা তার শাকরেদরা লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত ছিল।
আর্যশরণ ঘটনার ল্যাজামুড়ো কিছুই বুঝতে পারছিল না। কিন্তু দুগগা এ পাড়ারই মেয়ে। সে ঠিকঠাক বুঝেছিল। ভাঙাবাড়ির ন্যাড়া ছাতে উঠে সে পরিত্রাহি চেঁচিয়ে বলতে লাগল, জানিস, অলপ্পেয়েরা গীতুকে গীতুর শ্বশুরবাড়ি থেকে যতুকের জন্যে পুড়িয়ে মারতে চেষ্টা করেছিল, ওর বাপ-জ্যাঠা অনেক কষ্টে উদ্ধার করে এনেছে, জানিস রাস্তায় দু-দুবার অ্যাসিড-বালব ছুড়েছে, ফসকে গেছে তাই। আর্য ওর পিসির দ্যাওর, যদি বিপদের সময়ে মেয়েটাকে আশ্রয় দিয়ে থাকে তো বেশ করেছে, খুব করেছে, ডাইভোর্স মামলা হয়ে গেলে যদি ওকে বিয়ে করে তো বেশ করবে, খুব করবে। আমার বাড়ির মানুষ, সে কী রকম আমি জানি না তোরা জানবি ঘোড়ার ডিমের দল? এক্ষুনি এখান থেকে বিদায় হ, আমার সম্পত্তির ক্ষেতি করিছিস, আমি শম্ভ উকিলের বোন, হরিহর উকিলের বেটি, তোদের নামে মামলা রুজু করব। ক্ষেতিপূরণ দিতে তোদের ইয়ে বেরিয়ে যাবে।
জনতা আস্তে আস্তে পিছিয়ে গেল। দুগগা তখনও চেঁচিয়ে চলেছে, এসব ওই ওতুল হতচ্ছাড়ার কাণ্ড। কালীপুজোর ফন্ড নিয়ে সোমবচ্ছর নেশাভাঙের ব্যবস্থা চলছিল। আর্য সেটি বন্ধ করেছে কি না…।
পরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। কোনো জনতাকে মারমুখী করে তুললে, সে যদি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় তো আরেকটি লক্ষ্য সে বেছে নেবেই। শক্তিটার খরচ হওয়া চাই তো! জনতার মধ্যে শুধু সারদা-রতনুমণির মতো প্রৌঢ়ই ছিল না, বেশ কিছু তাগড়া জোয়ানও ছিল যারা কুৎসা শোনবার আগে আর্যশরণের ভক্ত হয়ে পড়েছিল। এরা ফিরে গিয়ে চাঁদমারি করে ওতুলকে। আর্য এবং তার বউদির ভাইঝি গীতা মাঝে পড়ে না থামালে ওতুলকে হাসপাতালে যেতে হত? আপাতত সে শুধু নাক-আউট হয়ে ছাড়া পেল।
কিন্তু আর্যশরণ দুগগাদিদির শত অনুরোধেও, পাড়ার মাতববরদের হাজার ক্ষমাপ্রার্থনাতেও ও পাড়ায় আর রইল না। বলল, গীতার ছোটো ছোটো ছেলে দটির পক্ষে অভিজ্ঞতাটা বড়ো মারাত্মক হয়েছে। গীতাও মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে। একদিন সকালে শম্ভু উকিলের শূন্য বাড়ি যেমন হঠাৎ ভরে উঠেছিল চায়ের গন্ধে, ফুলের শোভায়, উৎসুক যুবক-যুবতিদের কলকণ্ঠে, বাচ্চাদের খেলার আওয়াজে, আর একদিন সকালে তেমনি আবার পূর্ণ বাড়ি শূন্য হয়ে গেল। বাগানময় শুধু সটান শুয়ে রইল কিছু মরশুমি ফুলগাছের মৃতদেহ। পা দিয়ে মাড়িয়ে যাওয়া থ্যাঁতলানো টম্যাটো আর বেগুন। ঘরগুলোর মধ্যে দু-চারটে ছেড়া পাতা, ফেলে যাওয়া ক্ষয়টে অ্যালুমিনিয়মের ঢাকনি, খালি শিশি বোতল, ফাটা বল আর ডাঁই করা খবরের কাগজ।
অনেক অনেক দিন হয়ে গেছে। প্রতিভাবান ওতুল তার পাড়াতে আবার আগের প্রতিষ্ঠা ফিরে পেয়েছে। যদিও কালীপুজোর সমারোহের দিন আর কখনোই সেভাবে ফেরেনি। ন্যাড়া, খ্যাঁদা এখন সোজাসুজিই রাজনৈতিক নেতাদের মাসলম্যান। বীরু একটা বহুতলের কেয়ারটেকার। ওতুল তার বাবার গয়নার দোকানে নিয়মিত বেরোচ্ছে। বেশ জমাট প্রতিপত্তিঅলা ভব্যিযুক্ত ধনী ভদ্রলোক। বাবার আমলের রাক্ষুসে তেলখাওয়া অ্যামবাসাডরটাকে বিদায় করে সে একটা ঝাঁ চকচকে তন্বী মারুতী-ভ্যান কিনেছে। ধবধবে সাদা। বর্ধমানের ভেতর দিকে গাঁয়ের চাষবাস দেখতে গিয়েছিল, ফেরবার সময় কাইতির কাছাকাছি একটা মাঠে দেখল প্রচুর ভিড় জমেছে এবং ভিড়ের মধ্যে থেকে ঝাঁকড়া চুলের মধ্যে সাদা সুতোর ছড়াছড়ি এক পরিচিত চেহারার ভদ্রলোক মোটা ফ্রেমের মধ্যে অন্যমনস্ক চোখ নিয়ে বেরিয়ে আসছেন। গাড়ি থামিয়ে ওতুল তার গিলে করা পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নেমে এল। সে ভারি উদার স্বভাবের মানুষ।
আর্যদা না? কেমন আছেন?
হাসি মুখে ভদ্রলোক বললেন, আরে চেনা-চেনা লাগছে খুব, প্লেস করতে পারছি না তো ঠিক…..।
আমি ওতুল! সদর বকশির ওতুলকৃষ্ণ গুইন।
ওতুল! ওতুলকৃষ্ণ? ওহো, সেই লাইব্রেরি করতে তেত্রিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন না? বড়ো বড়ো চোখ করে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন আর্যশরণ। আত্মগত বলতে থাকেন, টাকার অ্যামাউন্টটাই বড়ো কথা নয় ওতুলবাবু, দেবার ইচ্ছের মূল্যটা টাকার মূল্যের থেকে অনেক বেশি। আমি আজকের পথনাটকে এটাকেই আমার থিম করেছিলাম। গ্রামের লোকে বেশ নিল কিন্তু! ভারি এনজয় করল, দেখি আবার আমার ট্রপের ছেলেমেয়েগুলো কোথায় গেল… আসছি।
ওতুল দেখল, আর্যশরণ ঘোষ তাকে এবং তার সঙ্গে জড়িত সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত ঘটনাবলি বেমালুম ভুলে গেছেন!
করুণা তোমার
ঠাকুরমার ঝুলি-র ছোটোরানি আছাড় খাইয়া পড়িলেন-এর মতো দৃশ্যটা। পাপু মেঝের ওপর শুয়ে পড়েছে। উপুড় পিঠটা নিথর। কাঁধের তলায় পিঠের ওপর দুদিকে দুটো ত্রিভুজ। একটু একটু উঠছে নামছে। ছোটো চুল। বব-ছাঁট ছিল। একটু বড়ো হয়ে গেছে। তাই আগাগুলো মেঝেতে লুটোচ্ছে।
পাপুর বাবা ঘরে ঢুকেই অবাক।
একি? পাপুর কী হল? কোথাও কোনো জবাব নেই।
পাপুর বাবার পুনরুক্তি, বলি, হলটা কী?
পাপুর মা অর্থাৎ শ্ৰীলা উল বুনছিল। উলের থলি টেবিলের ওপর রেখে গম্ভীরভাবে বলল, তুমি কি চা পান করবে?
হতভম্ব সুরজিৎ অর্থাৎ শ্রীলার স্বামী ওরফে পাপুর বাবা বলল, চা তো আমি রোজই এ সময়ে পান করে থাকি। হঠাৎ প্রশ্ন? প্রশ্নের জবাব এড়াতেই প্রতি-প্রশ্ন নাকি?
বোঝ তো বেশ। বুদ্ধি ভালোই। আরেকটু বাড়লে যেটা বুঝেছ সেটা মুখে বলে বোকা-বুদ্ধির পরিচয় দিতে না।
বুদ্ধিও বুঝি। বোকাও বুঝি। বোকা বুদ্ধিটা কী?—সুরজিৎ তরল গলায় প্রশ্ন করছে। যদিও চোখ দুটো অনড় পিঠটার ওপর স্থির। মেয়ে সুরজিতের প্রাণ।
ঘরে ঢুকে পড়েছে পাপুর পিঠোপিঠি দাদা পিন্টু।
বাবা জানো, আসলে… পেছন থেকে তার মুখের ওপর হাত চাপা দিয়েছে শীলা।
চা খাওয়া শেষ। চা এর সঙ্গে টা। পিন্টু খেলতে বেরিয়ে গেল। রান্নাঘরে চায়ের বাসন ঠুনঠুন করে ধুচ্ছে বোধ হয় চুনী। শ্রীলা বলল, চুনী, যা ঘুরে আয়। বেশি দেরি করবি না। ঠিক এক ঘন্টার মধ্যে তোর আড্ডা শেষ হওয়া চাই।
কাচের চুড়ির আওয়াজ। চুনী বেরিয়ে যাচ্ছে। অন্য দিন মুখে খই ফোটে। আজকে দিদির মেজাজ খারাপ। অবহাওয়া থমথমে। চুনী তাই চুপচাপ বেরিয়ে গেল।
শ্ৰীলা বলল, মেয়েকে ভালো শিক্ষা দিচ্ছ না।
যা বাব্বা, আমি আবার কখন শিক্ষা দিলুম, ওসব তো তুমি আর তোমার কনভেন্টের মিসের এক্তিয়ার।
না, ইয়ার্কি নয়। পুজোর কেনাকাটা করতে গিয়ে সেদিন পাপুর স্কাই ব্লু রঙের চাইনিজ সিল্কের চুড়িদার সেটটা কিনেছিলুম মনে আছে? সাদা স্যাশের মতো আছে।
তোমরা যে কেনাকাটা করতে গিয়ে কী কেনো, কত কেনো আর কতরকম কেনো…
আচ্ছা, আচ্ছা হয়েছে। দয়া করে পুরোটা শোনো। চুনী সেটা দেখতে পেয়ে গেছে। ধরল ওকেও পুজোয় ঠিক ওই রকমই কিনে দিতে হবে। ওর খুব পছন্দ। ঠিক ওই রং, ওই ডিজাইন। এসব জিনিস তো ডুপ্লিকেট হয় না। দামও অনেক। আজকে ঠিক ওই জিনিসটাই দোকানো ঝুলছে দেখে কী মনে হল কিনে ফেললুম। মেয়েটা তো বরাবর পুরোনো, রং জ্বলা জিনিস নিয়েই তুষ্ট আছে। বড়ো মুখ করে বলল। তা সেই থেকেই তোমার কন্যে অমনি পেছন উলটে শুয়ে আছে।
কেন? সুরজিৎ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
কেন বুঝতে পারছ না তো! যাক, তোমার সম্পর্কে ভাবনা ছিল সেটা অন্তত ঘুচল। বুঝতে পারছ না? তোমার কন্যা চুনীর সঙ্গে একরকম জিনিস পরবে না।
ও হো হো। তা পালটে দিলেই তো হয়। চাইছে না যখন।
বাঃ চমত্তার। মেয়ের জেদ বজায় থাকবে! হৃদয়বৃত্তি কোনোদিন ডেভেলপ করবে না এমন করলে। দয়া করে একটু তলিয়ে বোঝবার চেষ্টা করো।
সুরজিৎ একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, তা হলে একটু টাইম দাও। তলিয়ে বুঝি।
শ্ৰীলা রাগ করে সামনে থেকে উঠে গেল।
পাপুটার সঙ্গে চুনীটার যে কী রেষারেষি! অনেক লোক বদলে বদলে অবশেষে এই মেয়েটাকে পেয়েছে সে। বছর পনেরোর মেয়ে, পাপুর থেকে সামান্য ছোটোই। দেখতে তো ছোট্টখাট্ট। একটু খরখরি। কিন্তু বেশ কাজের। অন্ততপক্ষে কথা বললে শোনে। বেশ চটপটে। মুখে হাসি লেগেই আছে, কথাও আছে সাতকাহন। একটু বড়ো হয়ে গেলেই এরা যেমনি সেয়ানা হয়ে যায়, তেমনি হয় বদমাশ। চুনী এসে শ্রীলার মনে শান্তি এনেছে। যেমন যেমন শেখায়, তেমন তেমন করে মেয়েটা। নিমেষে বুঝে ফেলে। ঘষর ঘষর বাটনা বাটছে, খচখচ আনাজ কুটছে, ফটাফট জামাকাপড় কেচে ফেলছে। কিন্তু কী যে নজর মেয়েটার। পাপুর সঙ্গে সব কিছুতেই ওর পাল্লা দেওয়া চাই। ঠোঁটে রং, নেল পালিশ, জরিঅলা জুতো, চকচকে ঝলমলে জামা—এসব নিয়ে গোড়ায় গোড়ায় খুশি ছিল। এখন আর এ সব মনে ধরে না। পাপুর ফেলে দেওয়া প্লিটেড স্কার্ট, জাম্পার, দর্জি দিয়ে তৈরি করানো সালোয়ার কামিজ এই সব মোটামুটি পায় ও। এইগুলো পরে পরে ওর রুচি ঘুরে যেতে শুরু করেছে। ড্রেসিং-টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পাপুর হেয়ার-ব্যান্ড মাথায় দিয়ে দেখছিল একদিন। পাপুর সেই থেকে ওর ওপর রাগ। শ্ৰীলা পরদিনই ওকে একটা হেয়ার-ব্যান্ড কিনে দিয়েছে। কিন্তু ও ঠিকই বুঝেছে দিদির জিনিসটার মহিমা আলাদা। মুখ গোঁজ করে থাকে। কথায় কথায় পাপুর সঙ্গে ওর লেগে যায়।
দুধে কেন সর রে? পাপু দুধে মুখ দিয়েই মুখ বিকৃত করে ফেলল।
মা তোমাকে কতবার বলেছি তুমি নিজে ঘেঁকে দেবে। এরকম করলে আমি দুধ খাব না।
শ্ৰীলা চেঁচাল, চুনী, দুধ ছাঁকিসনি? এত করে বলি যে…।
চুনীর খ্যানখেনে সরু গলা শোনা যাবে, ছাঁকলুম তো। কতবার ছাঁকব? আধ ঘন্টা আগে দুধ ঠিক করে রেখে এসেছি। আবার সর পড়লে কি করব? দুধ আর ছাঁকনি নিয়েই সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তা হলে… খরখরি বলেই যাবে, বলেই যাবে।
ও কিন্তু ঠিকই বলেছে পাপু, গরম দুধ আলগা থাকলে সর পড়বেই, যখন দেয়, তখন খেয়ে নিলেই পারিস।
ও যখন যা দেবে দয়া করে, ওর হাত থেকে সব নিয়ে নিয়ে খেতে হবে নাকি তক্ষুনি তক্ষুনি!
পাপু ভীষণ রেগে যায়, তুমি, তুমিই ওকে আশকারা দিয়ে দিয়ে এমনি করেছ।
প্রায় কেঁদে ফেলে মেয়ে, আমার একটা কথা থাকবে না। নিজের পছন্দমতো জিনিস কক্ষনো পাব না। খারাপ হলে বলতেও পাব না, যাও আমি খাবই না।
সাধাসাধি করেও মেয়েকে আর খাওয়াতে পারে না শ্রীলা। মহা জ্বালা হয়েছে তার। কোন দিকে যাবে? পাপুর নালিশও ঠিক, পাপুর দিক থেকে। আবার চুনীর সাফাইও কতকটা ঠিকই তো।
পাপু পিন্টু কেউই খাবার দিলে সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসে খায় না। ডেকে ডেকে মুখ ব্যথা হয়ে যায়। কাজের একটা শৃঙ্খলা আছে তো?
সুরজিৎ ডাকল, পাঙ্কু, আঞ্জু উঠে পড়ো।
কাঁধটায় একটু ঝাঁকানি দিল মেয়ে। ওর গড়ন একটু দোহারা। সামান্য এদিক ওদিক হলেই মোটা হয়ে যাবার ধাত। বাবা আম্বু বলে ডাকলে খেপে যায়। খুব একটা সত্যি সত্যি নয় অবশ্য। সুরজিৎ নীচু হয়ে চুলের ঝুঁটি ধরল, উঠে পড়।
হঠাৎ একটা ঝটকা দিয়ে উঠে বসল পাপু।–না বাবা, ইয়ার্কি নয়। মা কী বলতে চায়! একটা কাজের মেয়ে আর আমি এক মায়ের কাছে? আমাকে মা যা দেবে ওকেও ঠিক তাই দেবে! পূজোর সময়ে ও আর আমি একরকম পরে ঠাকুর দেখতে যাব!
সুরজিৎ হেসে ফেলল, বলিস কী রে! একে দাদা তোর ভাগে ভাগ বসিয়ে রেখেছে। আবার আরেক শংকরা?
শ্রীলা বলল, তুমি চুপ কর তো। দাদা ভাগ বসিয়েছে আবার কী? ওকি একবারও বলেছে সে কথা? তুমি তো দেখছি আরও জটিলতা, হিংসেহিংসি সৃষ্টি করছ।
পাপু মুখ তুলে বলল, হ্যাঁ আমি বাচ্চা কি না, বাবা বলল আর অমনি দাদাকে হিংসে করতে শুরু করে দিলাম।
সুরজিৎ বলল, আরে আমিও তো তাই-ই বলতে যাচ্ছিলুম। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করতে চললি, তুই কি একটা বাচ্চা? বেবি!
বেবি হলে এগুলো মনে হত না বাবা। মা লোকজন নিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করে। মা-র সঙ্গে তো আর কিছু করবে না। তোমার সঙ্গেও না। মা মাথায় চাপাচ্ছে। আমাদের মাথায় উঠে নাচবে। তোমরা ফল ভোগও করবে না, বুঝবেও
শ্ৰীলার ভীষণ রাগ হয়ে যায়, সেই সঙ্গে হতাশা। কাজের লোক তো দূরস্থান। অন্য কেউই যে কখনও ছেলেমেয়ের সমান হতে পারে না, তা কী করে ওকে বোঝাবে! সে বলল, একটা, মাত্র একটা পোশাক তোমার মতো দিলেই, তোমার মনে হয়, ও আর তুমি আমার কাছে এক? চমৎকার!
তুমি অন্ধ মা, তুমি বুঝবে না। যেভাবে সবসময়ে ওর হয়ে ওকালতি করো। আমি হাল ছেড়ে দিচ্ছি। তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না।
পিন্টু এসে ঢুকল। হাতে ঝুলছে ব্যাডমিন্টন র্যাকেট। বলল, এখনও তোমাদের সেই এক নীলজামা প্রসঙ্গ চলছে? আরে বাবা এটা বুঝছিস না কেন, তোর মতো জামা পরলেই কি চুনী তুই হয়ে যাবে? চুনী চুনীই থাকবে।
সুরজিৎ যেন হালে পানি পেল, বলল, রাইট। দুজনে এক রকম জামা পরে বেরোলেও, কখনও দুজনকে একরকম দেখাবে না রে পাপু।
পাপু গম্ভীর হয়ে বলল, ঠিক আছে।
সপ্তমীর দিনে চুনী সেজেগুঁজে নীল রঙের চুড়িদার পরে একগাল হেসে শ্রীলাকে প্রণাম করল, বলল, পাপু দিদি, তুমি এই জামাটা কবে পরবে?।
পিন্টু বলল, আরে এ চুনী, তু যে শাঁকচুন্নি বন গিয়া রে!
চুনী বেশ কথার পিঠে কথা শিখেছে বলল, আমার শাঁকচুন্নিই ভালো বাবা, কটা ভূত হয়ে কাজ নেই।
পাপু নীল পোশাকটা আর কোনোদিনই পরল না। অথচ খুব পছন্দ করে নিজে উদ্যোগী হয়ে কিনেছিল জিনিসটা।
জটিলতা এখানেই থেমে থাকল না। একদিন ওর বাতিল করে দেওয়া স্কার্ট ব্লাউজ পরে চুনী পেছন ফিরে কী করছিল ঘরে, সুরজিৎ তাকে পাপু বলে ডেকে ফ্যালে। সেই থেকে পাপু আরও গম্ভীর হয়ে গেছে। ইদানীং ওর পুরনো জামাকাপড়গুলোর শ্রীলা হদিস পাচ্ছে না। নিজের মেয়ের বয়সি কাজের মেয়ে থাকলে জামাকাপড়ের খাতে খরচটা কমে। লোক রাখবার সময়ে এ হিসেবটাও মনে মনে করে নিতে হয়। জামাকাপড়ের খরচ কি কম? দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে, বেড়েই যাচ্ছে। একদিন পাপুর অনুপস্থিতিতে তার আলমারিটা ভালো করে খুঁজে দেখল, তাকের পেছনের দিকে পুরনো তোয়ালে মোড়া বাতিল জামাকাপড় গুছোনো রয়েছে। কাউকে দেবে? না নিজেই কিছু ভেবে রেখে দিয়েছে? মেয়েকে হালকা গলায় জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁরে তোর কালো স্কার্টটা তো আর পরিস না, কোথায় গেল রে?
পাপু উদাস গলায় বলল, কী জানি?
অথচ একটু আগেই শ্রীলা দেখেছে কালো স্কার্ট তোয়ালে-মোড়া সযত্নে রাখা রয়েছে। নিজেই রেখে দিয়েছে, অথচ অনায়াসে বলে দিল কী জানি! মেয়েকে কিছু বলতে আর সাহস পায় না শ্ৰীলা। আসল কথা ওগুলোও চুনীকে দিতে দেবে না। এইভাবে নীরবে ওগুলো সরিয়ে রেখে সে কথাই ও জানাতে চাইছে। এখন শ্ৰীলা কী করে?
অগত্যা আর বছরখানেকের মধ্যে শ্রীলা চুনীকে শাড়ি ধরায়। পাপুকে পারবে না। পাপু এখনও অনেক বয়স পর্যন্ত অনেক রকম পোশাক পরবে। চুনী তো আরও ক্ষয়া চেহারার মেয়ে, স্বাস্থ্য অনেক ভালো হলেও পাপুর কাঠামো সে পাবে কোথায়? অনায়াসেই আরও ক-বছর চালিয়ে দিতে পারা যেত। চুনীর খুব পছন্দ হচ্ছে না ব্যাপারটা, বোঝাই যাচ্ছে। ফ্রক-স্কার্টে বয়সটা বেশ ঢেকে রাখা যায়। সব মেয়েই বাচ্চা থাকতে চায়। শ্রীলাদের ঘরের মেয়েও। চুনীদের ঘরের মেয়েও। শ্ৰীলা নিজের একটা লাল শাড়ি বাছে। লাল রংটা আজকাল আর পরছে না সে। শাড়িটা দিব্যি নতুন।
চুনী, চুনী, দ্যাখ দিকি, এই শাড়িটা পছন্দ হয় কি না।
লাল টাঙ্গাইল শাড়ি, জরিপাড়। এই অসম্ভব প্রাপ্তিতে খুশিতে ঝলমল করতে থাকে চুনী।
এটা আমার, মা?
হ্যাঁ রে তোর, বেশ লম্বা হয়ে গেছিস, শাড়ি ধরে ফ্যাল এবার।
চুনী আমতা আমতা করতে থাকে, মাঝে মাঝে পরব মা। সব সময়ে পরলে কাজের অসুবিধে হবে না?
যেগুলো আছে সেগুলো পরতে থাক। এরপর যখন দরকার হবে শাড়িই দেব। সিদ্ধান্ত নেওয়ার গলায় শ্রীলা বলে। আরেকটা পরিত্যক্ত ছাপা শাড়ি এনে চুনীকে গছায়, সেই সঙ্গে আনুষঙ্গিক সমস্ত। ব্লাউজগুলো একটু ঢলঢলে করে, চুঁচ-সুতো দিয়ে তাকে মেয়ে ছোটো করে নেয় চুনী। কখনও শ্রীলা নিজেই করে দেয়। এইভাবে একরকম হঠাৎই চুনীর ফ্রক-স্কার্ট থেকে শাড়িতে উত্তরণ ঘটে যায়। পাপর সঙ্গে তাকে গুলিয়ে ফেলবার কোনো উপায়ই থাকে না। একজন জিনস টিশার্ট, অন্যজন শাড়ি। একজন লম্বা স্কার্ট, অন্যজন শাড়ি। একজন কাফতান, অন্যজন শাড়ি। শাড়ি এবং শাড়ি এবং শাড়ি।
প্রথম প্রথম কাঠিতে জড়ানো কাপড়ের মতো দেখাত শাড়ি পরিহিত চুনীকে। কিন্তু বেশ কয়েক বছর শ্রীলা সুরজিতের সংসারে থেকে তার কালো রঙে চাকচিক্য এসেছে, চুলে ঔজ্জ্বল্য। এখন শাড়ির আড়ালে হঠাৎ-ই যেন তার শরীর ভরে উঠতে থাকে। পরিচ্ছন্ন পাট পাট করে ধোপদুরস্ত, রং-মিলোনো শাড়ি ব্লাউজ পরে চনী যখন ঘোরে ফেরে দোকানের শো-কেসের কালো মডেল পতলের কথা মনে পড়ে যায় শ্রীলার। কিন্তু খুব শীগগিরই শ্রীলা অস্বস্তির সঙ্গে আবিষ্কার করে চুনী শুধু তার চোখেই নয়, পাড়ার রিকশাঅলা, বহুতলের কেয়ারটেকার, দারোয়ান, চায়ের দোকানের ছেলে, পাড়ার কিছু অকালকুম্মাণ্ড—এদের চোখেও বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। চুনীর বিকেলের ছুটির সময় ক্রমশই বাড়ছে। অন্যান্য বাইরের কাজ, যেমন দুধ আনা, বাজার করা, মিষ্টির দোকান ইত্যদিতেও সে অনেক বেশি সময় নিচ্ছে। এবং সময়টময় নিয়ে যখন বাড়ি ফিরছে তখন সারা শরীরে বেশ একটা হিল্লোল নিয়ে ফিরছে। চোখে মুখে যেন খুশি আয় ধরে রাখতে পারছে না।
একদিন পিন্টু এসে বলল, মা, চুনীটা কি ওস্তাদ হয়েছে জানো, রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে একটা কুলি-কাবাডি লোকের সঙ্গে যাচ্ছে তাই ইয়ার্কি দিচ্ছিল। আমি দেখেও ফেলেছি, শুনেও ফেলেছি।
শ্ৰীলা গৃহসমস্যার সব কথা সুরজিৎকে বলে না। এটা বলল, দিনকাল ভালো। এভাবে চললে বিপদে পড়তে কতক্ষণ?
সুরজিৎ গম্ভীর মুখে বলল, আরও আদর করে শাড়ি পরাও!
কেন, কত দুঃখে শাড়ি ধরিয়েছি জান না নাকি? শ্রীলা রাগ করে বলে। সুরজিৎ হেসে বলল, যে কারণেই পরিয়ে থাক, তোমার হাত থেকে তাস এখন বেরিয়ে গেছে। এবার ট্রাম্পড় হবার জন্য প্রস্তুত থাক।
সত্যিই চুনীকে সামলানো এবার দায় হয়ে উঠল। যখন তখন খিল খিল খিল, চুনী কাজ করছে না তো, ঘরে-দোরে নদী বইছে, এত ঢেউ। চুড়ির রিনিঠিনি, বাহারি টিপের রংচং, চটির ফটাস ফটাস। মাথায় টপ নট। ক্লিপ দিয়ে দুপাশ থেকে চুল তুলে মাথার পেছন দিকে আটকানো, বাকি চুল ছাড়া পেছনে, চুনী কিছুই শিখতে বাকি রাখেনি। লাল শাড়ি পরে এইভাবে ঢেউ কাটতে কাটতে চুনী সুরজিৎকে, পিন্টুকে জলখাবার দেয়। শীলার চোখ করকর করে। নানা ছুতোয় ধমকায় সে মেয়েটাকে।
পিন্টু বলে, কী রে চুনী, আজ যে দেখছি টিকায়াম আগুনম।
চুনী দারুণ চালাক। ঠিক ধরতে পারে, বলে, বাজে বকো না দাদা। যতই অং বং চং বল ফিলিমের আসল হিরোইনরা রেখা শ্রীদেবী সব কালো, কুচকুচে কালো।
সুরজিৎ বলে, তাই নাকি রে?
শ্ৰীলা প্রসঙ্গ থামাতে এক ধমক দেয়, তুমি চুপ কর তো। চুনী চুপচাপ কাজ কর। যত্ত বাজে কথা।
চুনী দাঁত বার করে বলল, হি, আমি সত্যি জানি মা, সববাই তো আর পাপুদিদির মতো গোরে গোরে নয়।
তুই থামবি? শ্রীলা আবার বলল।
পাপু শেষ লুচিটা কোনোমতে মুখে পুরে উঠে গেল।
চুনীকে সোজাসুজি ধমকানোটা আর এড়ানো যাচ্ছে না। হেমন্তের সন্ধে। রবিবার। শ্রীলা ছাড়া কেউ বাড়ি নেই। চুনী আজ্ঞা সেরে বাড়ি ফিরল।
শ্ৰীলা গম্ভীর মুখে বলল, চুনী শোন। চটিটা ছেড়ে এসে এ ঘরে শোন।
চুনী আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে এসে দাঁড়াল।
যত রাজ্যের ছেলের সঙ্গে অত বাজে বকবক করিস কেন রে? সিঁড়ির মোড়ে দাঁড়িয়ে লিফটম্যান জালাল। নীচে দারোয়ান বাহাদুর, রাস্তার হরেকরকমের ছোকরা তাদের সঙ্গে তোর অত কলকলানি কীসের? বিপদে পড়তে চাস না কী?
চুনী আঙুলে শাড়ির আঁচল জড়াতে জড়াতে বলল, দিদি তো করে। দিদির তো অত ছেলে-বন্ধু, তারা বাড়িতে এসে যখন গল্প করে দিদিও তো হেসে হেসে ইয়ার্কি দেয়। তখন তো কিছু বল না। তা ছাড়া আমি তো শুধু রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে একটু গল্প করি, দিদি যে সিনেমায় যায়, পিকনিকে যায়, সেগুলো বুঝি কিছু না।
হাসবে না কাঁদবে শ্রীলা ভেবে পায় না। বলল, ওরা তো সব দিদির কলেজের ক্লাবের বন্ধু, মেয়ে-বন্ধুদের সঙ্গে ওদের কোনো তফাত-ই নেই। তোর কি তাই? তুই যেটা করিস সেটা ভালো দেখায় না তো বটেই, তুই একদিন মহা বিপদে পড়বি। কী বিপদ, কেন বিপদ কিছু কিছু বোঝবার বয়স তোর হয়েছে চুনী।
চুনী গোঁয়ারের মতো বলল, সবাই মোটেই দিদির কলেজের বন্ধু নয়, দিদি তো একজন লম্বা গোঁফ দাড়িঅলা ছেলের সঙ্গেও একা একা ঘোরে। সিনেমা যায়। ইস্টিশানে একদিন ট্রেন থেকে নামল।
তুই কোত্থেকে দেখলি?
আমি জানি।
শ্রীলা স্তম্ভিত।
সেদিন সুরজিৎ ফিরলে তাকে সব খুলে বলে শ্রীলা দৃঢ়কণ্ঠে দাবি জানাল, মেয়ের বিয়ে দিতে হবে।
সুরজিৎ বলল, খেপেছো? সবে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে, পার্ট ওয়ান এসে গেল। এখনই বিয়ে? তুমিই না বলতে মেয়ে তোমার ছেলের সমান। পড়বে, যতদূর ইচ্ছে, ডক্টরেট করবে, চাকরি করবে।
সে আমার ভাগ্য আর আমার মেয়ের ভাগ্য। কপালে যদি না থাকে আমি কি করব বলল, আমার দিক থেকে তো চেষ্টার ত্রুটি ছিল না।
সুরজিৎ বলল, তুমি এখনই অত হতাশ, অদৃষ্টবাদী হয়ে পড়ছ কেন? সে ছেলেটি কে, কার সঙ্গে মিশছে, ব্যাপারটা আদৌ সত্যি কিনা এসব জানো, জানতে চাও। চুনী কি না কি বলল, তুমিও অমনি বিশ্বাস করে বসলে? তা ছাড়া সত্যিই যদি সিরিয়াস কিছু হয় মেয়েকে টেনে এনে বিয়ে দিতে পারবে? না সেটা উচিত হবে? তুমি কোনকালে আছো বল তো?
শ্রীলা গম্ভীরভাবে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমি মা। আমাকে সব সময়ে আগামীকালে থাকলে চলে না। তুমি যত সহজে জানো, জানতে চাই। বললে আমি তা পারব না। উপেদশটা তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। এটা আমার চ্যালেঞ্জ। বাবারা সব সময়ে কথায়বার্তায় সুপার ফাস্ট। কাজেকম্মে মান্ধাতার যুগে। আমি অন্তত এ বিষয়ে এটা চলতে দিতে রাজি নই।
সুরজিৎ বলল, ঠিক আছে। চ্যালেঞ্জটা আমি গ্রহণ করলাম। সুরজিৎ চ্যালেঞ্জ নেবার দিন সাতেকের মাথায় শ্রীলা জানল, গোঁফ-দাড়িঅলা লম্বা একটি বন্ধু সত্যিই পাপুর হয়েছে। ছেলেটি হোস্টেলে থাকে। এম-ই করছে। ইউনিভার্সিটির চত্বরেই আলাপ। পাপুর গ্রুপের সঙ্গেও ওর ভালোই চেনা। তবে হ্যাঁ, পাপু দু-এক দিন ওর সঙ্গে কয়েকটা খুব ভালো ভালো বিদেশি ছবি দেখতে এসপ্লানেড পাড়ায় গিয়েছিল। বালিগঞ্জ স্টেশনে একবার ওরা কয়েকজন বন্ধুকে ট্রেনে তুলে দিচ্ছিল, নিজেরা কোথাও যায়নি। পাপু জানতে চেয়েছে কোথা থেকে সুরজিৎ এত কথা জানতে পারল। সে তো লুকিয়ে কিছু করেনি। অন্যান্য বন্ধুদের মতোই জয়ও একদিন এ বাড়িতে আসতই। ইন ফ্যাক্ট জয় পরের রবিবার নিজেই আসতে চেয়েছে।
ছেলেটি–জয়দীপ—যেদিন বাড়িতে এলো সুরজিৎ, শ্রীলা তো বটেই পিন্টু সুষ্ঠু মুগ্ধ হয়ে গেল। সোজা স্বাস্থ্যবান চেহারা, দাড়ি গোঁফে দারুণ ইনটেলেকচুয়াল দেখায়। অথচ কোনো কৃত্রিমতা, কোনো দম্ভ নেই। এঞ্জিনিয়ার হলে কি হবে, কবিতা এবং ফিলম সম্পর্কে দারুণ আগ্রহ, শুধু পাশ্চাত্য সংগীত সম্পর্কে কথা বলেই সে পিন্টুকে কাত করে দিল। খাবার সময়ে খুব সহজভাবে জয় জানাল সে শিগগিরই এম আই টিতে ডক্টরেট করতে চলে যাবে। বাবা মার ইচ্ছে বিয়ে করে যায়। বউকে শিগগিরই নিয়ে যেতে পারবে। পাপুর সঙ্গে বিয়ে হলে সে খুব আনন্দিত হবে। শ্ৰীলা সুরজিৎ উভয়েই অবাক। এত তাড়াতাড়ি, এভাবে যে এমন প্রস্তাব কেউ করে ফেলতে পারে তারা ভাবতেই পারেনি। পাপুটারও মুখ লাল হয়ে গেছে। সে বোধ হয় এত সব ভাবেনি।
সুরজিৎ বলল, সে কি! তোমার বাড়ি, বাবা-মা?
জয় হাসল, বলল—বাবার বর্ধমানে নার্সিংহোম আছে। ডাক্তার। মা-ও সেসব সামলান। ওঁরা নিশ্চয়ই শিগগিরই এসে দেখা করবেন। তবে বিয়ের ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। পাপুর পার্ট ওয়ানের পরই বিয়েটা হতে পারে। ডিসেম্বর নাগাদ আমি চলে যাব। পাপু পার্ট টু-টা দিক। তারপর আমি এসে নিয়ে যাব। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স ওখানেই করবে। অসুবিধে কি? স্টুডেন্টস ভিসায় বরঞ্চ এটাই যাবার সুবিধে। আমি আমার বায়োডাটা কাল পরশুর মধ্যেই দিয়ে যাব।
জুলাই মাসের এক আশ্চর্য সুন্দর বৃষ্টি-বোয়া অকালবসন্তের হাওয়া-বওয়া দিনে মাত্র উনিশ বছর বয়সে পাপুর বিয়ে হয়ে গেল। এবং জুলাই মাসেরই এক উপঝুরস্ত বাদল দিনে চুনী এসে শ্রীলাকে জানাল, সে কাজ ছেড়ে দিচ্ছে। কারণ সে বিয়ে করছে। বর রাজমিস্ত্রি। সনাতন মিস্ত্রির নাম এ দিকে কে না জানে, ঢালাই বাবদই হাজার হাজার টাকা কামায়। তাকে আর চাকরি করতে দেবে না। বর। বারুইপুরে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে থাকতে হবে। কোনো ঝাট-ঝামেলা নেই। খালি এক শাশুড়ি।
শ্ৰীলা অবাক হয়ে বলল, কবে হবে বিয়ে? কোথায়?
চুনী সলজ্জে জানাল, বিয়ে হয়ে গেছে গত পরশু। কালীঘাটে। চুলের ভেতরে সিঁদুর সে লুকিয়ে রেখেছিল।
শ্রীলা বলল, আগে বললেই পারতিস। তোর বাবা-মা নেই। আমরাই দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিতে পারতুম। একটু খোঁজ-খবর নিতে পারতুম।
চুনী সলজ্জ নতমুখে নখ খুঁটতে খুঁটতে জানাল, তারও দিদির মতোই হুট বলতেই বিয়ে হয়ে গেল।
শ্রীলা মনে মনে খুব খানিকটা হাসল। কে জানে, দিদির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতেই বিয়েটা ও হুট করে করে ফেলল কি না! কিছুই অসম্ভব নয়। সে পাপুর উপহারের শাড়ি থেকে বেছে একটা রংচঙে ভালো সিল্কের শাড়ি চুনীকে দিল। নিজের একটা হালকা রুপোর সেট ছিল, সেটাও দিয়ে দিল। বলল, এতদিন চাকরি করে যা পয়সা জমালি সব পোস্ট অফিসে ভোলা আছে। এই নে পাস বই। সাত বছরে এগারো হাজারের মতো জমেছে সাবধানে রাখিস চুনী। এই এখন তোর সর্বস্ব।
চুনী শ্ৰীলাকে প্রণাম করে ছলছল চোখে বাড়ি ছাড়ল।—বাবার সঙ্গে, দাদার সঙ্গে দেখা হল না মা। পরে এসে নিশ্চয়ই দেখা করে যাব।
আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর শেষ হয়ে গেল। প্রত্যেক মাসে, প্রত্যেকবার যখন পাপু আসে, শ্রীলা অবাক হয়ে দেখে, সে প্রতিদিন আরও সুন্দর, আরও শ্রীময়ী হয়ে উঠছে। বরাবরের গোলগাল ভাবটার ভেতর থেকে কে যেন বাটালি দিয়ে কেটে বার করে আনছে ধারালো চেহারা। গেয়ার, জেদি, রাগি, ভাবটা কোমল ঝলমলে লাবণ্যে কবে মিলিয়ে গেল। সে যে আপাদমস্তক জয়দীপ নামে মানুষটার বিস্ময় দিয়ে মোড়া, এখন বুঝতে পারছে না একটা অপরিমিত আনন্দের ভাণ্ডার তার সামনে কেমন করে খুলে গেল, এ বিস্ময় কেমন করে তার নিজের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল—এ কথা শ্রীলা-সুরজিৎ বুঝতে পারে। নিজেদের মধ্যে সুখের হাসি হাসে। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। ডিসেম্বরে জয়দীপ চলে গেল। এপ্রিলে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে পাপুও যাবে। এ কটা মাস প্রধানত মায়ের কাছেই থাকছে সে। একদিন নিজের পুরোনো আলমারি গোছাতে গোছাতে পাপু একটা প্যাকেট হাতে বলল, মা, একদম নতুন একটা চুড়িদার-কামিজ রয়েছে, দ্যাখো, কী সুন্দর পাউডার ব্ল রংটা।
শ্রীলা মুখ ডুবিয়ে ডাঁই জামায় বোতাম বসাচ্ছিল। মুখ না তুলেই বলল, যা হঠাৎ তোর বিয়ের ঠিক হয়ে গেল, এখনও কত ওরকম নতুন ড্রেস পড়ে রয়েছে দ্যাখ। স্কার্ট-টার্ট নিয়ে যা না ক-টা। বিদেশে পরতে পারবি। নতুন নতুন জিনিসগুলো নষ্ট হবে, খুব গায়ে লাগে রে!
পাপু বলল, না মা, এটা একদম নতুন। কী সুন্দর চওড়া সাদা স্যাশ! শ্রীলা এইবার ফিরে দেখল। চিনতে পারল তিন-চার বছর আগের পুজোয় কিনে দেওয়া সেই চায়না-সিল্কের পোশাক যা পাপু কোনোদিন স্পর্শ করেনি। কেন পরেনি সেটা ও বেমালুম ভুলে গেছে। সে হেসে বলল, পর না পাপু, আজই পর।
পরব? চুল দুলিয়ে পাপু বলল, আজ বিকেলে একটু লাইব্রেরি যাব মা, তখন পরব, হ্যাঁ?
সন্ধে প্রায় হয়ে গেছে। এসব পাড়ায় শাঁখ বাজে না। কিন্তু ধূপ জ্বলে। শ্রীলা ঘরে ঘরে চন্দন-ধূপ জ্বালিয়ে দেয়। ধূপের অনুষঙ্গে শাখের আওয়াজও কেমন মনে এসে যায়, মনের মধ্যে বসে—স্বৰ্গত পূর্বনারীরা শাঁখ বাজান। অমঙ্গল অশুভ দূর হয়ে যাক এই প্রার্থনা বুকে নিয়ে মধ্য কলকাতায় ভীরু কিশোরী সন্ধের শাঁখ। সে সময়ে চারপাশ ঘিরে বাবা-মা-ঠাকুমা-দাদা-দিদিরা থাকা সত্ত্বেও সন্ধের মুখটাতে পৃথিবীটাকে কেমন একটা নাম-না-জানা অপরিচিত রহস্যের জায়গা, দুঃখের জায়গা বলে মনে হত। সেই বিষাদের অনুষঙ্গও ধূপের গন্ধের সঙ্গে সঙ্গে মনে আসে। এই সময়কার নির্জনতাটুকু শ্ৰীলা খুব রোমান্টিকভাবে উপভোগ করে।
বেল বাজল। ছেলে গেছে দিঘা। সুরজিৎ আজ অফিস ফেরত পাইকপাড়ায় যাবে। তার বৃদ্ধ জ্যাঠামশাই খুব অসুস্থ। আসতে দেরি হওয়ার কথা। তবে নিশ্চয় পাপুই। দরজার ফুটোয় চোখ লাগিয়ে কিন্তু সে পাপুকে দেখতে পেল না। আধা অন্ধকারে ল্যান্ডিংটাতে পুঁটলি হাতে করে যেন চুনী দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলে দিয়ে শ্রীলা থমকে দাঁড়াল—চুনীই তো!
কী রে চুনী?
চুনী হঠাৎ ল্যান্ডিংটার ওপরেই বসে পড়ল। হাঁউ মাউ করে কেঁদে উঠে বলল, মা আমার তোমার কাছে আবার কাজ করতে দাও মা। তোমার কাছে আমায় ঠাঁই দাও মা!
আলোটা জ্বেলে দিল শ্রীলা। পেছনে পাপু এসে দাঁড়িয়েছে। হালকা নীল চুড়িদারে দেখছে চুনীকে। চুনীর সেই কালীঘাটের কালীর মতো চকচকে কালো কোথায় গেল? আপাদমস্তক খসখস করছে। এই ক-মাসে সে অমন হাড় জিরজিরেই বা হল কী করে? পরনের শাড়ি ব্লাউজ দুটোই চিট ময়লা। চুলে জট, যেন হাওড়া-শেয়ালদার সারাদিন ধরে বেগুন-ঢ্যাঁড়স-বেচা শহরতলির ফেরিওয়ালি। কিংবা সোজাসুজি ভিখারিনি। কোলে একটা পেট ফুলো, ন্যাংটাপুটো বাচ্চা ধরিয়ে দিলে মানাত।
শ্ৰীলা বলল, কাজ করবি তো বেশ কথা। কাঁদছিস কেন? সনাতনের কী খবর?
ও মিনসের নাম কোরো না মা, এ ক-মাসে চুনীর মুখের ভাষারও অনেক অবনতি ঘটেছে, ঠগ, জোচ্চোর, আমার জমানো টাকাগুলো তুইয়ে বুইয়ে নিয়ে নিয়েছে, শাউড়িতে আর ওতে মিলে মেরে মেরে আমায় উচ্ছন্ন করে দিয়েছে মাগো! এই দ্যাখো। ছেড়া ব্লাউজের ভেতর থেকে কালশিটের দাগ দেখায় চুনী, বলে, তারপর পরশুদিন কোত্থেকে ছেলেপুলে সুদ্ধ একটা বউকে নিয়ে এসে বললে, এই আমার আসল বউ। তুই দূর হয়ে যা—চুনী আবার হাঁউমাউ করে উঠল।
শ্রীলা এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কাঁদিসনি চুনী। ওরা ওইরকমই হয়। তুই তো আমাদের কথা শুনিসনি। ঘরে আয়। কাপড় দিচ্ছি, সাবান দিচ্ছি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নে। সে আবার এসে গোলমাল করবে না তো?
ইস, গোলমাল করলেই হল? নিজেই তো বলল, কালীঘাটের বিয়ে আবার বিয়ে! এই বাড়িতে তোমার কাছে থাকতে পেলে আমি আর কোথাও কখনও যাবো না মা!
শ্রীলার এত দুঃখেও হাসি পেল। তার শাশুড়ি একবার বলেছিলেন, পেটের খিদে মিটে গেলে, গায়ে-গতরে একটু শাঁসজল লাগলেই এদের অন্য খিদে চাগাড় দিয়ে উঠবেই। তখন মিষ্টি কথাই বলো আর টাকাই দাও, কিছু দিয়েই বশ মানাতে পারবে না।
চুনী পুঁটলি খুলে বলল, তোমার দেওয়া সিল্কের শাড়িখানা খালি আনতে পেরেছি মা, গয়নাগুলো সুদ্ধ গা থেকে খুবলে খুবলে নিয়েছে।
ঠিক আছে। তুই এই কাপড়খানা পর। শ্রীলা নিজের ঘরে গিয়ে আলনা থেকে তার ঘরে পরার একখানা শাড়ি আর ব্লাউজ তক্ষুনি এনে দিল।
যা বাথরুমে যা চুনী। এরকম নোংরা হয়ে থাকিসনি। দেখতে পারছি না।
চুনী বাথরুমে ঢুকে গেল। শ্রীলা হালকা মনে পাপুর ঘরে ঢুকল।
ভালোই হল, বুঝলি পাপু। এতদিন ধরে লোক খালি আসছে আর যাচ্ছে। একটাও ভালো…
থমকে গেল শ্ৰীলা। পাপু বিছানার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে। নীল চুড়িদার পরনে। তার পিঠের দুটো তিনকোণা হাড় জামার মধ্যে দিয়ে উঠেছে নামছে। ঝুঁটি বাঁধা চুল পিঠ থেকে কাঁধের ওপর জাপানি পাখার মতো ছড়িয়ে গেছে। ছবিটা কেমন পরিচিত লাগল শ্রীলার। সে ঝুঁকে পড়ে পাপুর পিঠে হাত রাখল। হঠাৎ কী হল?
সে নরম গলায় বলল, পাপু! জয়ের জন্য মন কেমন করছে? আর ক-মাস পরেই তো দেখা হযে, কাঁদছিস কেন?
পাপু তেমনি উপুড় হয়ে ভাঙা ভাঙা বোজা গলায় বলল, মা, চুনীর কী কষ্ট…মা! কেন এমনি হবে? শ্ৰীলা ঝুঁকে ছিল। সোজা হয়ে গেল। খাটের মাথার দিকে শুভ্র দেওয়াল। সেখানে কি কোনো লিখন? অনন্ত-কারুণিক কোনো আশিস-দৃষ্টি? নিদাগ দেয়ালের সেই অলক্ষ্য চাহনির দিকে শ্রীলা তাকিয়ে রইল পরম আনন্দে, বিষাদে। কৃতজ্ঞতায়। পাপু কাঁদছে। নিজের জন্য নয়। চুনীর জন্য।
কাঁটাচুয়া
ডক্টর প্রণব নাথ একজন বছর তেত্রিশের এমবিবিএস ডাক্তার, নিজের বিচারেই তিনি সাধারণ। অল্পস্বল্প প্রাইভেট প্র্যাকটিস আর বেসরকারি হাসপাতালের সহযোগিতায় তাঁর দিনকাল ভালোই কাটে। স্ত্রী এবং চার বছরের মেয়ের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, এক সঙ্গে টিভি দেখা, সময়মতো খাওয়াদাওয়া, আরাম-বিশ্রামের সুযোগ পান। অধিকতর সফল বন্ধুবান্ধব কি দামি ডাক্তাররা যখন পিঠ-চাপড়ানোর ভঙ্গিতে বলেন, তুমিই ভালো আছ প্রণব, একেবারে প্ল্যানড আউট লাইফ অ্যান্ড লাইফস্টাইল, আমাদের দ্যাখো মাঝরাত অবধি দৌড়োচ্ছি, সামাজিকতার তো প্রশ্নই নেই, ফ্যামিলির সঙ্গে টাইম স্পেন্ড করা কোনো অতীতের কথা, যে কোনো দিন বউ ডিভোর্স চাইতে পারে—তখন প্রণবের মনের অবস্থাটা ঠিক কী দাঁড়ায় বলা মুশকিল। বগুলোর ওপর ক্রোধ, না কি হীনম্মন্যতা, না কি বেশ আছি, তোদের রক্তবেচা কালো টাকা আমার দরকার নেই গোছের একটা মনোভাব? কে জানে, তবে সেদিন রাত নটা নাগাদ প্রণব ডাক্তার নিজের চেম্বারে তিরিক্ষি মেজাজে বসেছিলেন। সন্ধে ছ-টা থেকে ঝাঁপ খোলেন। আজ একটিও মক্কেল নেই। গত দু-দিনও প্রায় এই অবস্থাই গেছে। যে ওষুধের দোকানটার লাগোয়া তাঁর চেম্বার, তারা এমনিতেই তাঁর ওপর একটু চটা, কেননা, তিনি সবসময়ে তাদের দোকানে পেশেন্ট পাঠান না, তারা যেসব ব্র্যান্ড রাখে সেগুলোও সবসময়ে রেকমেন্ড করেন না। রোজ বেরোনোর সময়ে তারা চোখ চাওয়াচাওয়ি করে, অন্তত প্রণবের তাই মনে হয়। শীতকাল ন-টায় চেম্বার বন্ধ করার কথা। দূর হোক গে, আর অপেক্ষা করবেন না, এক্ষুনি বন্ধ করে দেবেন। উঠে চেয়ারের পিঠ থেকে কোটটা নিয়ে হাত গলাচ্ছেন, শূন্য ওয়েটিং রুম থেকে কতকগুলো বিধবস্ত, কেমন আতঙ্কিত গলা ভেসে এল।
ডক্টর আছেন?
প্রণব ডাক্তার দাঁড়িয়ে গেলেন। তারপর পেশাদার গলায় বললেন, আসুন।
একটি রক্তাক্ত ছেলেকে ধরাধরি করে আনল আরও দুটি ছেলে, তাদেরও শার্ট প্যান্টে ছোপ।
কী ব্যাপার? অ্যাকসিডেন্ট! হাসপাতালে চলে যান স্ট্রেট।
না, ঠিক অ্যাকসিডেন্ট বলা যায় না স্যার, আগে প্লিজ একটু দেখুন, একটা ফার্স্ট এড যদি…
ছেলেটির বাহারি টিশার্ট, তার তলায় বহু বিজ্ঞাপিত গেঞ্জি একেবারে রক্ত মাখামাখি হয়ে গেছে। আর্তনাদ করছে ছেলেটি। কিন্তু উধ্বাঙ্গের জামাকাপড় তো খুলতে হযেই। খুলে বড়ো আশ্চর্য জিনিস দেখলেন ডাক্তার। ছেলেটির সারা গায়ে সমান দূরত্বে কতকগুলো ফুটো ফুটো ক্ষত। কাঁটার মতো ছোটো নয়, গুলির মতো বড়ো নয়। রক্ত পড়ছে ঝুঁঝিয়ে। বেশ গভীর…..চটপট ডিসইনফেকট্যান্ট দিয়ে ক্ষত পরিষ্কার করে, ওষুধ লাগিয়ে ড্রেসিং করে দিলেন তিনি। প্রেসক্রিপশনের ওপর কলমটা স্থির, একটু গেরেম্ভারি চালে বললেন, কিছু ফুটেছে। কী করে হল?
অন্য দুই তরুণের চোখে হঠাৎ একই সঙ্গে ভয় আর সতর্কতার লালচে-কালচে আলো জ্বলতে দেখলেন তিনি। বললেন, কী করে হল ঠিক করে বলো!
এতক্ষণে তিনি হৃদয়ংগম করেছেন, ছেলেগুলি বাইশ-তেইশের মধ্যে। জামাকাপড়, হেয়ার স্টাইল, মোবাইলের মহার্ঘতা এবং মুখের চেহারা দেখে মনে হয় হয় এরা পয়সাঅলা, কিন্তু নিম্নরুচির পরিবারের ছেলে। যেমন এখন চারদিকে প্রচুর হচ্ছে। হিন্দি সিনেমায় নগ্নিকারা সুইটহার্ট, নায়করা এদের রোল মডেল, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ভোগ্যবস্তুর প্রাচুর্যের দিকে এরা লঙ্গরখানাগামী ভিখারিদের মতোই আদেখলা চোখে ছুটে যায়।
কী করে হল—তিনি আবারও কড়া গলায় বললেন, বাড়িতে কি কোনো বন্যজন্তু পোষা হয়?
সেটাই তো!–একটি ছেলে বলে উঠল, বাইপাসের দিকে বেড়াতে গিয়েছিলাম মানে এই আমরা তিনজন। মেন রাস্তা ছেড়ে একুট পাশের দিকে নেমে, মানে নেচারস কল। আমাদের এই বন্ধু…
নাম কী?
নাম মানে ইয়ে মানে আদিত্য আগরওয়াল…
হ্যাঁ, তারপর বলো…
ও-ই নেমে যায় আগে। কিছুর ওপর ও হুমড়ি খেয়ে পড়ে চিল্লাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে এসেছি।
ইতিমধ্যে আদিত্য আগরওয়াল ছেলেটি নেতিয়ে পড়েছে। প্রণব হঠাৎই বুঝলেন সারা সন্ধে রুগি না আসার পরে একটি মক্কেল পেয়ে অতি উৎসাহে তিনি একটু অসাবধানই হয়ে গিয়েছিলেন। একে অবিলম্বে হাসপাতালে পাঠানো দরকার। এক্ষুনি রক্ত দিতে হবে। নেতিয়ে গেছে রুগি। ছেলেগুলিকে বোঝালেন—কেস খুবই সিরিয়াস। ভয় খেয়ে গেল সব।
ডাক্তারবাবু আপনিই ব্যবস্থা করে দিন।
একটু ভেবে প্রণব ফোন লাগালেন ড. জহর দাশকে।
ড. জহর দাশ প্রণব নাথের মাস্টারমশাই। খুব ভালো ছাত্র না হলেও খাঁটিয়ে বলে ড. দাশ তাঁকে স্নেহ করেন এখনও। জানেন, প্রণবের মধ্যে কোনো ফাঁকি বা চালাকি নেই।
এই সময়টা ড. দাশ একটি নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে ডিউটিতে থাকেন।
কী বললে? —ড. দাশের গলায় একটা বিস্ময়। তা ছাড়াও কিছু একটা আছে প্রণব ঠিক ধরতে পারলেন না।
হ্যাঁ, আমি সব রেডি রাখছি। পাঠিয়ে দাও।
তরুণগুলি সন্ত্রস্ত মুখ করে চলে গেল।
আমি সব রেডি রাখছি, পাঠিয়ে দাও—কথাটা প্রণবের ভেতরে কোথাও একটা ওয়ার্নিং বেল বাজাতে লাগল। কেন, তিনি বুঝতে পারলেন না।
ঘড়িতে দশটা বাজল। অ্যাসিন্ট্যান্ট রবিকে চেম্বার বন্ধ করতে বলে গাড়িতে উঠলেন ড, জহর দাশ। দ্রুত হাত ধুয়েছেন। অ্যাপ্রন টাঙিয়েছেন হুকে, তর সইছে না। কেননা আসছে কাল তাঁর পিতৃহীন ভাইপো অবনীশের বিয়ে। কালকে বিকেলের অ্যাপয়েন্টমেন্ট শিটে একবার চোখ বুলিয়ে রবিকে বললেন সব ক্যানসেল করে দিতে। বাড়ি খুব কাছেই, মহানির্বাণ থেকে একডালিয়া। এই রক্ষা। খোলা দরজা দিয়ে মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন ডাক্তার। স্ত্রী গোপা এসে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ চিৎকার করে বললেন, ও কী?
কী?
পেছনে দ্যাখো।
ডাক্তার পেছন ফিরে দেখলেন সিঁড়ি থেকে প্রতি ধাপে দরজা বরাবর তাঁর জুতোর ছাপ, রক্ত। একটু দাঁড়িয়ে রইলেন। মেয়েও বাবার গলা পেয়ে ছুটে এসেছিল। তিনজনেই দেখল জুতোয় রক্তের ছাপ।
জহর একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, এত ভয় পাবার কী আছে। একটা অ্যাকসিডেন্ট কেস এসেছিল। হসপিটালে পাঠালাম। চেম্বারে দরজার কাছে রক্ত ছিল বোধহয়। খেয়াল করিনি। রবিটাও…জুতো জোড়া খুলে ফেললেন তিনি। মেয়ে হাত বাড়িয়ে নিল। মোজা পরা পায়ে নিজের বাড়ির দোতলায় উঠতে উঠতে ড. দাশ একদম অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। ওপরে উঠে ঘরের দরজা বন্ধ করে বাথরুমে ঢুকে যান তিনি সোজা। মোবাইলটা বার করেন নাইন এইট থ্রি ওয়ান ফাইভ নাইন সেভেন জিরো থ্রি থ্রি। এনগেজড। কুশারীর এখন ব্যস্ত থাকারই কথা। তিনি খুব অস্থির হাতে জামাকাপড়গুলো চেয়ারের পিঠে ছুঁড়ে দিলেন, পড়ে গেল লক্ষ করলেন না। ঠান্ডা-গরম মিলিয়ে শাওয়ার নিলেন একটা। তারপর কোনোক্রমে পায়জামাটা গলিয়েই আবার ফোন করলেন নাইন এইট থ্রি ওয়ান.বাজছে। সারে জঁহা সে আচ্ছা। কুশারী ধারেকাছে আছে তো। এক মিনিট প্রায় তারপরে ওধারের কণ্ঠ বলল, ডা. দাশ! বলুন…
যে কেসটা পাঠিয়েছিলুম…
অনুভব ভট্টাচার্য?
হ্যাঁ
ডেড।
জহর একটু থেমে বললেন, আশঙ্কা করেছিলুম। কিন্তু ব্যাপার কী?
ওরা বলল, ময়দানে এমনি আড্ডা মারতে গিয়েছিল, ঘুরছিল, হঠাৎ এই বন্ধুটি মানে অনুভব কিছুর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। জন্তুটা অন্ধকারে শনাক্ত করা যায়নি। কালো মতো গোল প্রাণী একটা। বেশ বড়ো। পালিয়ে গেল। কিন্তু অনুভবের অবস্থা ওই…
শজারু?
মনে হচ্ছে।
শিওর নও?
ড. দাশ আজকাল কতরকম নতুন নতুন অস্ত্রশস্ত্র বেরোচ্ছে। জাস্ট হোম মেড। ব্লেড, ছুরি, হেঁসো, চপার এসবে আর অ্যাডভেঞ্চার নেই। দুষ্কৃতীরা নতুন নতুন চিজ বার করছে।
তোমার তাই মনে হয়?
বললাম না, শিওর নই। ওদের মুখে মাদকের গন্ধ নিশ্চয়ই নোট করেছিলেন।
তোমার ধারণা ওরাই নিজেদের মধ্যে…
শিওর নই। আমি ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়েছি। কে ঝামেলায় যাবে?
ড. দাশ কিছুক্ষণ স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর আর একটা নম্বর টিপলেন। এটাও বেশ খ্যাতনামা বেসরকারি হাসপাতাল।
হ্যালো জেমস, একটা কেস রেফার করেছিলুম।
ইয়েস ডক্টর-আদিত্য আগরওয়াল, এই কিছুক্ষণ আগে মারা গেল, ন্যাস্টি উন্ডস।
কী মনে হয়?
ওরা তো বলছে রাস্তার ধারে ঝোপে এনসি অ্যাটেন্ড করতে গিয়েছিল। একটা কিছুর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
তোমার কী মনে হয়?
আ অ্যাম থিংকিং…
কী করবে, পুলিশে ইনফর্ম করবে?
স্ট্রেঞ্জ ড. দাশ, আগরওয়ালের বাড়ির লোকেরা চাইছে পুলিশে ইনফর্ম করা হোক, যা-কিছু আপত্তি দেহ কাঁটাছেড়া হবে মর্গে যাবে বলে। কিন্তু সঙ্গী ছেলেগুলো ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। বলছে…
কী বলছে?
পুলিশ মিছিমিছি ওদের জড়াবে। ওরা তো যা করার করেছে বন্ধুর জন্য। দিজ আর মানিড পিপল। ড. য়ু নো হোয়াট আই মিন!
ইয়েস।
মোবাইলটা প্রায় হাত থেকে খসেই পড়ে গেল ড. দাশের। কুশারী আর জেমস দু-জনেই হসপিটালের রুটিন ময়না তদন্ত করে বড়ি ছেড়ে দেবে। পার্টি যথেষ্ট টাকা খরচ করেছে। কিন্তু কেস দুটো কাঁটার মতো ফুটে রয়েছে তাঁর ডাক্তারি বিবেকে। একই রকম কেস একই সন্ধেয় দুটো। নতুন কিছু। ডাক্তার হিসেবে তাঁর কিছু কর্তব্য ছিল। এবং…এবং তার চেয়েও বড়ো কথা—প্রশ্ন। প্রশ্ন জাগছে। জন্তুটা কি ময়দান থেকে উড়ে বাইপাস গেল? না কেউ তাকে গাড়ি-টাড়িতে বহন করে নিয়ে গেল?
ভাইপোর বিয়ের বরকঠাগিরিটা ঠিক মন দিয়ে কয়তে পারলেন না ড, দাশ। বিশেষত নাথ দু-তিনবার ফোন করেছিল বলে। আগরওয়াল ছেলেটি কি মারা গেছে। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট কী? ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি…এই মাঝারি মানের ডাক্তাররা যে-কোনো অস্বাভাবিক কেসের পেছনে এঁটুলির মতো লেগে থাকে। প্রণবকে তিনি ভালোই চেনেন। তার প্রশ্নের সদুত্তর কোনো না কোনো সময়ে তাঁকে দিতেই হবে। আপাতত ভাইপোর বিয়েতে বরযাত্রী যাচ্ছি, বাড়ির বিয়ে… কোন কেস? তাঁর মনে নেই। ও সেইটা? কাঁটা ফুটিয়ে এসেছিল? নাঃ তিনি এখনও খোঁজ করেননি… এসব বলে কাটিয়ে দেওয়া গেছে।
কিন্তু প্রণব নাথ তাঁর প্রশ্নের উত্তর ড, দাশ নয়, অন্য জায়গা থেকে পেয়ে গেলেন। পসারঅলা ডাক্তারদের টিভি দেখবার সময় হয় না, খবরের কাগজ পড়া তো দূরের কথা। কিন্তু প্রণব টিভি দেখবার সময় পান। কতকগুলো অনুষ্ঠান তাঁর বিশেষ প্রিয়। তার মধ্যে একটা হল—অপ্রাকৃত কি এখনও আছে?–এখানেই কোনো মির্যাকল বাবার ভুটিনাশ করেছিল ইলেকট্রনিক মিডিয়া। বাবার চেহারা, তাঁর চরণামৃতর মধ্যে আংটি লুকিয়ে ফেলার কায়দা ইত্যাদি ইত্যাদি সবই তারা ক্যামেরার আওতায় আনে। জাদুকর পি, সি, সরকারের হাত-সাফাই আর বাবা কামেশ্বরের পা-সাফাই বলে খুব পাবলিসিটি পেয়েছিল খবরটা। এ প্রণব তাঁর প্রশ্নের জবাব পেলেন। একে অবশ্য জবাব ঠিক বলা যাবে না। বিজ্ঞানের নিয়ম হচ্ছে দৃষ্টান্ত জোগাড় করা, যত নজির ততই যুক্তির আওতায়। কোনো ল-এর আওতায় আসার সম্ভাবনা তথ্যের বেশি। সেই তথ্য পেয়ে গেলেন প্রণব অপ্রাকৃত অনুষ্ঠানে।
গ্রামের নাম গহরাশোল। পঞ্চাশোর্ধ কামরান আলি ভিন গাঁয়ে কুটুমবাড়ি গিয়েছিলেন। মাঝখানে বিশাল ধানখেত পড়ে। সেই ধানখেতের মধ্যেই কামরানের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে। বুক থেকে নাভি, নাভি বেয়ে নিম্নাঙ্গের দিকেও চলে গেছে ছোটো ছোটো ফুটো, রক্ত জমাট বুকের তলায় ফুটোগুলিও সাক্ষাৎ এক একটি রক্তমুখ। বোঝা যায় স্রেফ রক্তপাতেই মৃত্যু হয়েছে কামরানের। প্রাকৃত এখানেই শেষ হয় না। জামাইডোবা গ্রামে কার্তিক পাল নামে এক ব্যক্তিকে মেলার মাঠের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয়। সে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে কাঁটাচুয়া, কাঁটাচুয়া… বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে যায়, জ্ঞান আর ফেরে না।
মাঠে, খেতে, বাইপাসে ময়দানে একই রকম। কিন্তু যেবার কানাই মাঝির বাড়ির মধ্যে গগন পাড়ইয়ের ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া গেল, সেবার সমস্ত দেশে আতঙ্কের ছায়া নেমে এল। পাড়ইয়ের ক্ষেত্রে মোটামুটি সাক্ষী ছিল কানাই মাঝির বউ রাধা। রাধার জবানবন্দি-সন্ধের পরটায় তখনও কানাই ঘরে ফেরেনি। গগন তার খোঁজে আসে, রাধা তাকে চা দেয়, লেড়ো বিস্কুট দেয়। তারপর সে কুয়োতলার দিকে হাত ধুতে গিয়েছিল। বিকট আর্তনাদ শুনে রাধা ছুটে যায়। দেখে এই কাণ্ড! সে তখনই চ্যাঁচামেচি করে লোক জড়ো করেছিল। জবার পাতা থেঁতো করে গগনের সর্বাঙ্গে লাগায় পাড়াপড়শিরা। কিন্তু গগনকে বাঁচানো যায়নি, সে রাধার দিকে চেয়ে কাঁটাচুয়া, কাঁটাচুয়া… বলতে বলতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কাঁটাচুয়ার খোঁজে পড়শিরা কানাই মাঝির বাড়ি, তার আশপাশ লাঠি দিয়ে পিটিয়ে লন্ডভন্ড করে ফেলেছিল কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ কি না কোনো অজ্ঞাত কারণে স্রেফ শূন্য থেকে এক ধরনের ভয়াবহ শজারু জন্ম নিচ্ছে বা আবির্ভূত হচ্ছে। এবং কোনো একজন ব্যক্তিকে আক্রমণ করে একেবারে খতম করে দিচ্ছে। অপ্রাকৃতর অ্যাংকর বঙ্কিম হেসে তির্যক ভঙ্গিতে বললেন দর্শকদের, আমরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ দেখিয়ে চলেছি, অপ্রাকৃত বা অতিপ্রাকৃত বলে কিছু নেই। আপাতদৃষ্টিতে যা অতিপ্রাকৃত বলে মনে হচ্ছে তা আসলে কোনো শঠের চতুরালি। সাধারণ মানুষ খুব সহজে এতে বশ হয়ে যান—ডাকিনী, মন্ত্র-তন্ত্র, ওঝা, মরা মানুষ বেঁচে ওঠা, ভূতের ঢিল—সবেতেই আম-জনতার অগাধ বিশ্বাস। বিশ্বাস করতে পারলে যেন মানুষ হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। কিছুদিন আগে একটি গ্রাম পুরো খালি হয়ে গিয়েছিল স্রেফ ভূতের ভয়ে। অথচ পরে দেখা গেল রণপা পরে কঙ্কালের মুখোশ পরে কিছু লোক উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভয় দেখাচ্ছিল। এই তথাকথিত শজারু ভূতের রহস্যও সমাধান হয়ে যাবে, যদি মানুষ একটু সহযোগিতা করেন।
বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা শুরু হল, ট্রামে-বাসে, রাস্তার মোড়ে, চায়ের দোকানে, সরকারি অফিসে…। কেউ বললে—যোগসূত্র আছে কি না দেখো। রাজনীতি। কী রাজনীতি করত ওইসব মৃত মানুষেরা? গ্রামের মানুষগুলি কিছু-না কিছু রাজনীতির খাতায় নাম তোলাতে বাধ্য। কিন্তু দেখা গেল মোটেই সব এক পার্টির নয়। শাসক দল, বিরোধী দলকে শায়েস্তা করার নতুন অস্ত্র প্রয়োগ করছে বা বিরোধী দল শাসক দলের সমর্থকদের বেছে বেছে মারছে এমন কোনো তত্ত্ব খাড়া করা গেল না। না, অসবর্ণ বিয়ে নিয়ে রাগারাগি না, কোনো সামান্য সূত্রই পাওয়া গেল না। শহরাঞ্চলে তো ব্যাপার আরও গোলমেলে। তরুণ যুবক, আজকের প্রজন্ম, জিনস আর ছাপ্পা টি শার্ট পরা, পুলিশম্যান খাঁকি উর্দি পরা, আধবুড়ো মাস্টারমশাই ধুতি-শার্ট পরা, লুঙি পরা দোকানদার। রাজনৈতিক সমর্থন, বয়স, কাজ পেশা কোনো সূত্রই খাটছে না।
ডক্টর জহর দাশ একদিন বাড়িতে আলোচনার সময়ে কথাটা বলেই ফেললেন। তিনিই প্রথম ডাক্তার যিনি নাকি শজারু-ফুটো মানুষ রুগি পেয়েছিলেন। স্ত্রী-কন্যার কাছে এ কথাটা বলায় এখন বেশ একটা আত্মপ্রসাদ আছে। কোনো না কোনো একটা বিষয়ে প্রথম হতে কে না চায়?
জহরের কথা শুনে স্ত্রী গোপা তো আতঙ্কিত।
কী সর্বনাশ! শজারু যদি এবার তোমাকে ধরে। ডাক্তার যতই বোঝন শজারুবিদ্ধ মানুষগুলির ডাক্তার বা আত্মীয়স্বজনকেও শজারু তাক করেছে এমন কোনো খবর নেই, ততই গোপা বলে যান, তোমাদের সব কিছুই লাইটলি নেওয়া অভ্যেস। কাল তাক করেনি বলে আজ বা আসছে কাল তাক করবে না তার কোনো গ্যারান্টি আছে? ডাক্তারদের ওপর তো আজকাল সব মানুষের রাগ, কেউ একটা শজারু লেলিয়ে দিলেই হল।
গোপার এখন কাজ হল শোবার আগে বিছানা, খাটের তলা, গাড়িতে ওঠবার আগে সিট খুঁজেপেতে দেখা। পইপই করে স্বামীকে বলে দেন, কোনো রোগীকে অবহেলা করবে না, রোগীর আত্মীয়স্বজনকে রাগাবে না। যথেষ্ট আলোকিত রাস্তা ছাড়া নামবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। ড, দাশ যখন বললেন, এসব মেনে চলা অসম্ভব তখন গোপা এমনকি সাশ্রনয়নে নিজের ও মেয়ের মাথার দিব্যিও দিয়ে ফেললেন।
মাথার দিব্যি? সে আবার কী? ড. দাশ ও তাঁর মেয়ে নন্দনা হেসে খুন।
তোরা কোনো জিনিসই সিরিয়াসলি নিবি না। কাঁদো-কাঁদো মুখে গোপা উঠে গেলেন।
নন্দনা নিজের ঘরে বসে আপন মনে পিনকুশনটা ঘোরাচ্ছিল। সে ভাবছে। খুব ভাবছে। পেশায় নন্দনা সাংবাদিক। তবে ফ্রিলান্স। কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এখনও সে গাঁটছড়া বাঁধেনি। নিজের ইচ্ছেমতো বিষয়ে, কারও আদেশে নয়। কারও দেওয়া কাজ নয়। একদম নিজের পছন্দের বিষয়ে নিজের কায়দায় স্টোরি করে সে। তার টাকার দরকার নেই। বাবা পাঁচ হাজার করে মাসোহারা তার নামে ব্যাঙ্কে জমা করেন। জন্মদিন, পুজো, দোল, রথ যে কোনো উপলক্ষ্যে তাঁর মেয়েকে জিনিসপত্র ছাড়াও টাকা উপহার দেওয়া চাই। তবু নন্দনা কুঁড়ে, বাবা নির্ভর ডাঁটিয়াল হয়ে যায়নি। টাকার অভাব না থাকাটা একটা ঐশ্বরিক আশীর্বাদ এটা সে তাদের কাজের মেয়ে জলি, তার বাবার চেম্বারের রিসেপশনিস্ট অণিমা এবং আরও অনেককে দেখে দেখে বুঝতে শিখেছে। জলি বেচারি গ্রামের হলেও ভদ্র কৃষক ঘরের মেয়ে, মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছিল। কিন্তু গঙ্গার ভাঙনে তাদের গ্রাম তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে জমিজমা, বাড়িঘর, ইস্কুল, বাবা সব। পড়াশোনা বিসর্জন দিয়ে জলি আর তার মা শহরে এসে বাড়ির কাজের লোকের দলে নাম লিখিয়েছে। জলি দেখতেও ঢোটলে। ভারি শান্ত, সশ্রী, কথাবার্তায় কোনো গ্রাম্য টান নেই। অনেক কবিতা মুখস্থ বলতে পারে। হিসেবপত্তরে ওর কখনও ভুল হয় না। খুব সংকোচের সঙ্গে ও নন্দনার কাছ থেকে কবিতার বই, গল্পের বই পড়তে চায়। নন্দনার মা প্রায়ই বলেন জলির অনেক ভাগ্য যে সে তাঁদের মতো ভদ্র বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে। নন্দনার মনে হয়, এর উলটোটাও তো সত্যি, জলির মতো লোক পেয়ে তারাও কি বর্তে যায়নি! জিনিসপত্রের মর্যাদা বোঝে। বই কখনও এদিক-ওদিক করে না। নন্দনার যা-কিছু ফরমাশ হাসিমুখে খাটে। লেখবার সময়ে নন্দনার বারেবারে ফ্রেশ চা চাই। কে এনে দেয় বুঝেসুঝে জলি ছাড়া? একটি ভদ্র ভূসম্পত্তিওলা পরিবারের মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়া চমৎকার মেয়ে কলেজে না গিয়ে নন্দনাদের সুখসুবিধে দেখছে! তাদের জুতো পালিশ, তাদের ঘর গুছোনো, জামাকাপড় কেচে ইস্ত্রি করে যার যার ঘরে রেখে আসা! ভালো মন্দ খাবার তৈরিতেও সে এক্সপার্ট। নন্দনার বন্ধুরা এলে জলিকে বলতে হয় না। প্রথমেই এক দফা কফি দেবে। তারপর বিশেষ ফরমাশটা কী জেনে নেবে। আধ ঘন্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিট বড়ো জোর।
অণিমা মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে। লেখাপড়ায় খুব ভালো না হলেও পাস কোর্সে বিএ পাস করেছে। ওর বাবা কিছুতেই বরপণ জোগাড় করে উঠতে পারেননি। তাই অণিমা ডক্টর দাশের চেম্বারে কাটা চুল ফুলিয়ে, ঠোটে লিপস্টিক, রিসেপশনিস্টের কাজ করে। নন্দনাকে দেখসেই আগে আগে উঠে দাঁড়াত, নন্দনা অনেক বলে বলে সেটা বন্ধ করেছে।
বাবার টাকায় ফুটানি করার মনোবৃত্তি নন্দনার নেই। তাই বলে সে যেমন করে হোক নিজের উপার্জনের জন্যও হন্যে হয়ে ওঠেনি। বাবার সে একমাত্র মেয়ে, টাকার জন্য কোনোদিন তাকে কারও কাছে খেলো হতে হবে না। এটা, ওই যে বললাম, তার কাছে ঐশ্বরিক আশীর্বাদ বলে মনে হয়। তাই সে টাকার জন্যে নয়, নিজের খুশিতে সংবাদ খোঁজে। লেখে, অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠানই তার লেখা প্রায়ই বার করে। নন্দনা লেসবিয়ানদের নিয়ে লিখেছে। ভারতের ক্রিকেট-জ্বর নিয়ে লিখেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা লিখেছে। নন্দনা দাশ অনেকের কাছেই বেশ পরিচিত নাম।
পিনকুশনটা বাঁইবাঁই করে ঘুরছিল। হঠাৎ নন্দনার মনে হল ওই পিনকুশনটাই তার এবারের বিষয়। তার অবচেতন থেকে বিষয়টা উঠে আসছে। পিনকুশনটা প্রতীক। শজারু-বিদ্ধ মানবদেহের।
বেশ কিছুকাল আগে স্টোনম্যান নামে এক আতঙ্ক আবিভূর্ত হয়েছিল কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়। তখন সে বেশ ছোটো। সে সমস্যাটার সমাধান হয়নি। যে বা যারা রাতের আঁধারে ফুটপাতের ঘুমন্ত গরিব মানুষের বা পথচারীদের মাথা পাথরের আঘাতে থেঁতলে দিত, তারা হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিল পুলিশকে বোকা বানিয়ে। শজারু আতঙ্ক এখন চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে ঠিকই, কোথাও বাদ নেই। যেদিন একটা ইংরেজি কাগজের পাতায় শজারুর আবির্ভাবের কথা জানা গেল, সেদিন থেকে তো পাড়ায় পাড়ায় বাড়িতে বাড়িতে আর কোনো আলোচনা নেই। দিল্লিতে শজারুর আক্রমণে মারা গেছে তেইশ জন। শুধু দিল্লি শহরেই। বিহারে সাতাশি জন। লখনউ শহরে তেরোটি, কলকাতায় সরকারিভাবে আটাশ, লোকে বলছে এর উলটোটাও হতে পারে, অর্থাৎ বিরাশিটি। পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম-গঞ্জের কোনও স্ট্যাটিস্টিকস নেই।
যেমন হঠাৎ একদিন আবিভূর্ত হয়েছে তেমনই হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে যাবে শজারু-আতঙ্ক। নিশ্চয় কেউ বা কারা কোনো উপায়ে এই আতঙ্ক তৈরি করেছে। তাদের উদ্দেশ্য কী? শুধু আতঙ্ক ছড়ানো? এক ধরনের টেররিজম? যেন এ জিনিসের কিছু কম আছে এখন পৃথিবীতে! নন্দনা ঠিক করল সে নয়নপুর গ্রামের কানাই মাঝির বউ রাধা মাঝিকে ইন্টারভিউ করবে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। নয়নপুর হুগলি জেলার একটি মোটের ওপর সমৃদ্ধ গ্রাম। ট্রেন থেকে নেমে বাসে যেতে হয় মাইল দশেক। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে যখন কানাই মাঝির ঘরে পৌঁছোল নন্দনা তখন বেলা পড়ে এসেছে। বউটি দাওয়ায় বসে কুলোয় করে চাল ঝাড়ছিল। নন্দনাকে দেখে অবাক হয়ে তাকাল। অজ গাঁয়ে একজন শার্ট-প্যান্ট পরা বব চুল সোমন্থ যুবতি, কাঁধে ক্যামেরা, হাতে ঝোলা ব্যাগ…
কে আপনি?
আমি খবরের কাগজের লোক। আপনাকে ইন্টারভিউ করতে, মানে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।
আজ্ঞে খবরের কাগজ তো ইন্টারভু নিয়ে গেছে।
আমি অন্য কাগজের লোক। আপনাকে একটুও বিরক্ত করব না।
সন্ত্রস্ত গলায় বউটি বলল, আমার সোয়ামি আসার আগে যা করার করুন। সে এসব পছন্দ করে না।
আচ্ছা। গগন পাড়ই আপনার স্বামীর কেমন বন্ধু ছিল?
খুব বন্ধু। মাঝি কখনও স্যাঙাতকে মারবে না, তা বলে দিলুম।
না, না, তা বলছি না আপনার সঙ্গে কীরকম সম্পর্ক ছিল!
মেয়েটি এবার ঝেঝে উঠল, মেয়েছেলে হয়ে কথার ছিরি দ্যাখো। সোয়ামির স্যাঙাত তো আমার কে? আমার কী? এলে বাটি করে চা দেব, দুটো মুড়ি দেব বাস, ফুরিয়ে গেল।
সেদিন গগনকে মুড়ি-চা দিয়েছিলেন?
বিস্কুট দিয়েছিলুম সাধের স্যাঙাতকে।
আহা রাগ করছেন কেন? কুয়োতলার দিকে উনি গেলেন কেন?
সে কি আমাকে বলে গিয়েছিল? ব্যাটাছেলে কোথায় যাচ্ছে না-যাচ্ছে, জিগ্যেস করতে গেলুম আর কি! তারপরে তখন আমার কী গা বিড়োচ্ছে, বাপরে!
গা বিড়োচ্ছে?
হ্যাঁ গো দিদি, হঠাৎ কেমন যেন সব ঘুলিয়ে উঠল। ভীষণ বমি পাচ্ছে, চক্ষে আঁধার দেখছি, শরীরটা কেমন করছে…তখন সে কুয়োয় গেছে, কী মাঠে নেমে গেছে খেয়াল করবার অবোস্তা আমার?
তা কী করে ঠিক হল?
কিছুক্ষণ পর আপনাআপনি ঠিক হয়ে গেল। আমি তো ভেবেছি পেটে এবার কিছু একটা এল বোধ হয়।
তা এসেছে?
বউটি বিমর্ষ মুখ বলল, নাহ। সে ভাগ্যি করে কি এসেছি!
কখন চিৎকার শুনতে পেলেন স্যাঙাতের?
শুনতে পাচ্ছিলুম, মোটে নড়তে পারিনি। তারপর শরীরটা একটু ঠিক হতে যাই, লোকজন ডাকি।
গগন লোকটা কেমন ছিল?
বউটি মুখ বিকৃত করে নিজের কাজে মন দিল।
কেমন আবার?
ক্যামেরা টেপ-রেকর্ডার সব গুটিয়ে নন্দনা স্টেশনের দিকে রওনা হল। সে একটু ভাবিত হয়ে পড়েছে। একটি মাত্র ইন্টারভিউ নেওয়া গেল, তা-ও সন্তোষজনক নয়। অন্য কোনো কেসের প্রত্যক্ষদর্শী বলে কেউ নেই। সাক্ষী-সাবুদ হলে সে কী রিপোর্ট করবে, তদন্তই বা কী, আর স্টোরিই বা কী?
ইতিমধ্যে শজারুর নতুন শিকার, আবার শজারু, ভূতুড়ে শজারু নাম দিয়ে নানা কাগজে নানান সংবাদ বেরিয়েই চলেছে, বেরিয়েই চলেছে।
সেদিন সন্ধেবেলা। শীতের সন্ধে যেন কুটকুটে ভোটকম্বলের মতো নেমে পড়েছে শহরতলিতে, হাওয়া নেই, তাই যত কিছু দূষণ আটকে রয়েছে ভূগোলকের ওপর। মা বললেন, রুণা আজ আর পড়তে যাসনি।
রুণা চুল আঁচড়াচ্ছিল। তার মাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে এসে গেছে। অঙ্ক-সায়েন্স বাঘ। সপ্তাহে তিন দিন পড়তে যায়। একদিন বাদ গেলে স্যার আর একটা দিন বার করতে পারবেন না। কিন্তু মা-র বোধহয় শরীরটা আজও ভালো নেই, সে বলল, মা তুমি চুপচাপ শুয়ে থাক, আমি বেশিক্ষণ পড়ব না। জাস্ট একটা চ্যাপ্টার বুঝে নিয়ে চলে আসব।
ঠিক আসিস কিন্তু। বলে মা চাদর মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
রুণার মনটা হালকা। স্যার ভালো পড়ান। ফিজিক্স, বায়োলজিতে আগের ভয়টা তার আর নেই। কেমিস্ট্রিতে বড্ড মুখস্ত করতে হয়, এটাই মুশকিল। আগে জিয়োমেট্রিক রাইডারগুলো সে বেশিরভাগই পারত না। শশাঙ্ক স্যারের কাছে কোচিং নেবার ছ মাসের মধ্যে এ ব্যাপারেও তার অনেক উন্নতি হয়েছে। আগে তার পড়াশোনাটা একটা দুর্ভেদ্যে দুর্গ বলে মনে হত। শশাঙ্ক স্যারের দৌলতে এখন তার বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সায়েন্স গ্রুপে লেটার মার্কস পাওয়াটাই এখন রুণার লক্ষ্য। বাংলা, ইংরেজি, ভূগোল, ইতিহাসে তার কোনো সমস্যা নেই। ইতিহাসে মেমারির সমস্যা ছিল। সেটাও স্যার কীভাবে কী পদ্ধতি অনুসরণ করে মনে রাখতে হয় শিখিয়ে দিয়েছেন। এগারোশো, বারোশো, তেরশো, চোদ্দশো সব সনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ তারিখগুলো সে লম্বা সারি করে পর পর লিখে রাখে। বাস। জয়েন্ট দেবার ইচ্ছে রুণার নেই। সে পিয়োর সায়েন্স পড়বে, গবেষক হবে। সেদিনই বাবা কাগজে পড়ে বলছিলেন, বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের চর্চা সাংঘাতিক কমে গেছে আমাদের দেশে। বিজ্ঞানের মহা ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। সে বিজ্ঞানী হবে। নানান বিষয়ে কৌতূহল জাগছে তার। বেণি দুলিয়ে, ঝোলা ব্যাগ কাঁধে স্কার্ট পরা রুণা বেশ আত্মমগ্ন হয়ে চলেছে। এই মূহুর্তে তার মায়ের জ্বরের কথা মনে নেই। এ সেই মধ্য-কৈশোর যখন মা-বাবা স্মৃতির পেছন কোঠায় স্থান নিতে থাকে। সামনের কোঠাগুলো দখল করতে থাকে বন্ধুবান্ধব। প্রতিদিনকার উত্তেজক বর্তমান, ভবিষ্যতের হাতছানি, নানারকম উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং নিজে নিজে, যাকে বলে স্বয়ং। রুণার চারদিকের পৃথিবী রঙিন, বাস্তবে তা যতই দূষিত, কৃষ্ণবর্ণ ধূলিধূসর হোক না কেন।
শশাঙ্ক স্যার একটা বাড়ির একতলায় ঘর নিয়েছেন। এখানেই কোচিং করেন। ওপরে থাকেন এক বয়স্ক দম্পতি। তাঁদের সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। দরজাটা খোলাই থাকে। আজ দেড় ঘন্টা তাকে একা সময় দিয়েছেন স্যার মাধ্যমিক এসে গেছে বলে। পরের দেড় ঘন্টা অম্বু অর্থাৎ অম্বুজের। ও এইচএস দেবে। সারাবছর ক্লাস সিস্টেমে পড়া, কিন্তু পরীক্ষার মুখোমুখি সময়ে এইটুকু তাদের জন্যে করেন স্যার, এর জন্য বেশি চার্জ নেন অবশ্য। কিন্তু কী করা যাবে!
দরজা খুলে ঘরে ঢুকল রুণা। কেমন একটা বুনো গন্ধ। জান্তব। রুণা কোনোক্রমে টলতে টলতে ভেতরে ঢুকল। স্যার, স্যার একটা গোঙানির মতো আর্তনাদ তার গলায়, সে চিৎকার করে জ্ঞান হারাল। স্যার কৌচের ওপর ধসে পড়েছেন, শরীর দিয়ে ঝুঝিয়ে রক্ত ঝরছে।
পরে ডাক্তার এসে দেখে বললেন, হিউম্যান পিনকুশন হয়ে গেছেন ইনি। পিনগুলো মিসিং। একটি মাত্র সন্দেহজনক তথ্যের আভাস পাওয়া গেল এক্ষেত্রে।
অম্বু। অম্বুজের দেড় ঘন্টা পরে আসার কথা ছিল। কিন্তু সে দেড় ঘন্টা আগেই এসেছে। রুণার আর্তনাদ শুনে সেই প্রথম ছুটে আসে। কেন?
পুলিশ প্রশ্ন করছে—কেন?–অম্বুর কাছে কোনো সদুত্তর নেই। তাকে তন্নতন্ন করে ঘেঁটে ফেলা হয়েছে—একটা ক্যালকুলাস কষা খাতা, আর একটা এইচএস এর ফিজিস্কের বই ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে যা আশ্চর্য তা হল শশাঙ্ক পুরকায়স্থর চোখের দৃষ্টি, আতঙ্ক যেন ছিটকে আসছে।
এই রুণার কেসটা পড়বার পর নন্দনার নতুন করে আশা জাগল, স্টোরিটা সে করতে পারবে।
একডালিয়া থেকে বারাসত অনেক দূর। তবে বাইপাস দিয়ে হু-হু করে যাওয়াই যায়। ইদানীং বাবা-মার বাইপাসে আতঙ্ক। কলকাতার সবচেয়ে বেশি শজারু-মৃত্যু বাইপাস ও সংলগ্ন অঞ্চলেই হয়েছে। মা বিশেষ করে ভীষণ রাগারাগি করেন, ভয়ও পান খুব। নন্দনা মনে মনে হাসে। সে ঠিক ফাঁক খুঁজে নেবে। প্রতি শুক্রবার মা তাঁর সমাজসেবা কেন্দ্রর কাজে যান। কী সমাজসেবা হয় তার বিশদ বিবরণ নন্দনাকে মাঝেমধ্যেই শুনতে হয়। মা আবার সেক্রেটারি। মাসের একটা অধিবেশনে মাকে রিপোর্ট পেশ করতে হয়। আজ সেই শুক্রবার। নন্দনা ফাইল, টেপ, ক্যামেরা গুছিয়ে নিয়েছে। প্রায় পা টিপেটিপেই বেরিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ মনে পড়ল, ইশ এ শুক্রবার বাবা সকাল সকাল ফিরবেন। মা থাকবেন না, সে থাকবে না। সে জলিকে ডেকে বলে গেল। বাবাকে যেন ঠিকমতো খাবার-টাবার দেওয়া হয়। সাধারণত এ কাজটা মা বাবা সে-ই করে, বাবা অন্যদের হাতে খাবার-টাবার
একেবারে পছন্দ করেন না। ধারেকাছে লোকজন থাকলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, সে যত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নই হোক না কেন।
একটা দিন, বাবা প্লিজ চালিয়ে নাও।
বিশ্বাস করুন আমার মেয়ে কিছু জানো না।–রুণার মা বললেন, আমাদের একটা দিনও স্বস্তিতে কাটছে না। কোনো না কোনো কাগজ, টিভি চ্যানেল থেকে লোক আসছেই। আচ্ছা তুমিই বলো, তোমাকে তুমি বলছি—একটা এই বয়সের মেয়ে এই রকম একটা ক্রাইমের সঙ্গে তাকে জড়িয়ে, কাগজে টিভি-তে তার ছবি প্রচার করলে তার ভবিষ্যৎটা কী হবে! তার ওপর পরীক্ষা মুখের গোড়ায়।
নন্দনা বলল, মাসিমা, আপনাকে মাসিমাই বলছি, এটা তো মানবেন। যে এটা ভয়ানক এক সন্ত্রাস, যার কোনো সূত্র, কোনো প্রমাণ আমরা পাচ্ছি না। সমাধান করতে না পারলে আপনার বাড়ি আমার বাড়িতেই আক্রমণ হবে না, কে বলতে পারে! চিহ্নিত করা দরকার এই শয়তানকে। আমরা কেউ সেফ নই, মাসিমা।
আমরা আর কবে সেফ ছিলাম! বলো, উঠতি বয়সের মেয়েকে নিয়ে যে আমাদের কী ভয়ে ভয়ে দিন কাটে! ঠিক আছে তুমি যদি ছবি তুলবে না, আসল নাম ব্যবহার করবে না কথা দাও—তো ডাকছি।
রুণা মেয়েটি খুব স্মার্ট। কিন্তু শজারুর উল্লেখে তার মুখে আতঙ্কের ছায়া দেখলে যে কোনো মানুষ ভয় পাবে। ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেল রুণার মুখ। নন্দনা যখন বলল, ভালো করে মনে করো কখন ঠিক কীভাবে ওঁকে দেখলে। কেউ ধারেকাছে ছিল কি না। তুমি সন্দেহজনক কিছু দেখেছিলে কি না।
রুণার ভয়ে দাঁতে দাঁত লেগে যেতে থাকল। যেন দৃশ্যটা এখনও তার চোখের সামনে ঘটছে।
অনেকটা সময় দেওয়া সত্ত্বেও রুণার থেকে বিশেষ কিছুই কথা বার করা গেল। সে যে ঘরে একটা বিশ্রী বুনো গন্ধ পেয়েছিল, তার অবিশ্রান্ত মাথা ঘুরছিল। গা বমি করছিল, চোখের সামনে যেন একটা ধূসর কুয়াশার পর্দা ঝুলছিল, সেভাবে সে কিছুই দেখতে পায়নি। ঘোরটা কেটে যেতে দেখে তবে ভয়ানক দৃশ্যটা তার চোখে পড়েছে—এইটুকুই। কোনো জন্তু-জানোয়ার কিছু না।
নন্দনার মনে হল মেয়েটি কিছু যেন একটা চেপে যাচ্ছে। সে বলল, মাসিমা। যদি কিছু মনে না করেন আমাকে একটু চা খাওয়াবেন?
নিশ্চয়ই—ভদ্রমহিলার নন্দনাকে ভালো লেগেছে।
রুণা চটপট বল তো-নন্দনা বেশ হাসি-হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল, অম্বুজকে ধারে-কাছে পাওয়া গেল কেন? তুমি নিশ্চয়ই জানো ও পুলিশের নজরে আছে!
এবার রুণার লাল হয়ে গেল, তারপর ওর চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। সে ফিসফিস করে বলল, আপনাকে বলছি দিদি, প্লিজ আর কাউকে বলবেন না। আমি পনেরো মিনিট আগে বেরোতাম আর অম্বু পনেরো মিনিট আগে পৌঁছে যেত। ওই আধঘন্টা আমরা একটু গল্প করতাম হাঁটতে হাঁটতে।
অম্বুজ তোমার বন্ধু?
আবার লাল হয়ে রুণা বলল, হ্যাঁ, মানে ওই, কাউকে বলবেন না।
না, এ আবার কাউকে বলে না কি? তা ছাড়া এ তো খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তুমি অত লজ্জা পাচ্ছ কেন? আচ্ছা রুণা অম্বুজ ছেলেটি তো সেদিন আরও অনেক আগে চলে এসেছিল…
ম মানে ও ওইরকম করছিল। ওর সইছিল না। সারাক্ষণ পায়চারি করবে।
তার পরে তোমার আর ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে?
না দিদি। আমি তো বেরোই-ই না। মা ফোন পর্যন্ত গার্ড দিয়ে রেখেছে।
আচ্ছা। অম্বুজের ঠিকানাটা আমায় দাও।
রুবি হসপিটালের কাছে নন্দনা পৌঁছে গেল। তখন তার ঘড়িতে আটটা বাজছে।
তার মোবাইলটা ঝনঝন করে বাজছে। এখন ধরার উপায় নেই।
বাইক চালাতে চালাতে মোবাইল সে ধরে না। জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলবার বাসনা তার নেই। থেমে গেছে। কিন্তু আবার বাজছে। বিজন সেতু থেকে নেমে একডালিয়ার মোড়ে বাইকটা এক পাশ করে সে মোবাইলটা তুলল, মিসড কল। এ তো বাড়ির নম্বর! আবার একটা মিসড কল—সেটাও বাড়ির নম্বর। তার মানে মা এসে গেছে। সে তো পৌঁছেই গেল। আর এখন কলের জবাব দেবার দরকার নেই। একডালিয়া ঢোকার মুখে সে দেখল একটা পুলিশের কালো গাড়ি। একটা অ্যাম্বুল্যান্স সাইরেন বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে গেল। ভিড় কাটাতে কাটাতে সে শুধু আশপাশ থেকে কটা টুকরো কথা শুনতে পেল, একেবারে খোদ ডাক্তারের বাড়ি, ভাবতে পারেন দোতলায় উঠল কী বেয়ে? ভয়াবহ।… তা-ও ভরসন্ধেবেলা, মাঝরাত্তির তো নয়। কেউ দেখতে পেল না।
কী ব্যাপার? চোর ডাকাত না কি? ডাক্তার? এখানে আরও ডাক্তার থাকেন। ডক্টর শ্রীমানী, ডক্টর প্রীতি চ্যাটার্জি। তবে একটু এগিয়ে সে বুঝতে পারল ঘটনা যা-ই ঘটে থাকুক, সেটা তাদের বাড়িতেই। লোকে লোকারণ্য। তাকে পথ ছেড়ে দিল সবাই। দু-চার লাফে সিঁড়ি টপকে টপকে সে ওপরে উঠে গেল। কেউ নেই, লোকজনের মধ্যে বাহাদুর নীচে ভ্যাবলার মতো ধপাস করে বসে আছে। আর ওপরে জ্যাঠতুতো দাদা অবনীশ যার সেদিন বিয়ে হল আর কেউ নেই। রাত সাড়ে আটটায় যেন বাড়িতে মাঝরাত নেমে এসেছে।
এত দুশ্চিন্তার মধ্যেও অবুদাকে দেখে নন্দনার মন বিস্বাদ হয়ে উঠেছিল। সে অবনীশকে পছন্দ করে না। ছোটো থেকেই তারা আদায়-কাঁচকলায়। ঝগড়াঝাঁটি নেই। কিন্তু সে অন্তত এই কাজিনটিকে এড়িয়ে যায়। কারণ অনেক।
সে যাই হোক আজ অবনীশকে বিধবস্ত লাগছিল। বলল, তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি? বাড়িতে এত বড় একটা বিপদ হয়ে গেল!
কী হয়েছে? নন্দনার যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে ভয়ে। মা কোথায়? আর সব? বাবা? জলি?
অবনীশ একটু ইতস্তত করল। সময় নিল, তারপর বলল, মনটা শক্ত কর বাচ্চু। শজারু…আমাদের বাড়িতে হানা দিয়েছে। কাকাবাবু… জলি খাবার দিতে গিয়ে দেখে… সে-ও অজ্ঞান। কাকিমা ছিলেন না। পরে এসে দেখেন এই কাণ্ড। এই সময়টা কোনো হেল্প ছিল না। জানি না কী হবে!
নন্দনার ভেতর থেকে একটা ফোঁপানি উঠে আসছে। সে সেটাকে প্রাণপণে চাপা দেবার চেষ্টা করছে। ভেতরে ভেতরে ওইভাবে কাঁদতে কাঁদতে সে বাবার ঘরের দিকে ছুটল। হা-হা করছে দরজা। ভেতরে টাটকা রক্তের স্বাদ। তাড়াতাড়ি করে মুছে নেওয়া হয়েছে মেঝে। ন্যাড়া গদি কামানো মাথার মতো তার দিকে চেয়ে রয়েছে।
কোন হসপিটাল? সে কোনোমতে জিজ্ঞেস করল। তার এক চমকে মনে পড়ে যাচ্ছে মায়ের সাবধানবাণী। মা মাথার দিব্যি দিয়েছিলেন। তারা হেসেছিল। আড়ালে বসে আরও কেউ বোধহয় হেসেছিল।
অবনীশ এবার এগিয়ে এসে তার হাত ধরল, বাচ্চু প্লিজ, তুই এরকম ভেঙে পড়িসনি। তোর এই অবস্থা হলে কাকিমার কী হবে বল তো!
ব্যস, নন্দনার আর আবেগের বাঁধ থাকল না। ঝড়ের সমুদ্রের মতো সে ভেঙে পড়ল বাবার বিছানার গদির ওপর। সে জানে কোনো আশা নেই। একজনও বাঁচেনি। প্রথম দুটো কেসই তো বাবার নিজের। যথেষ্ট মেডিক্যাল হেল্প পেয়েছিল। বাঁচেনি। আর বাবার ক্ষেত্রে কুড়ি মিনিট কি আধঘন্টা কত দেরি হয়েছিল ভগবানই জানেন।
অবনীশ এবার গভীর মমতায় তার কাঁধে হাত রাখল, বাচ্চু তুই একটা শক্ত, বুদ্ধিমতী মেয়ে। তুই এরকম করবি! তোর সেলফ কনট্রোল কোথার গেল? একটু সামলে নে প্লিজ। তোকে নিয়ে যাব বলেই তো আমি অপেক্ষা করছি। কাকিমা বারবার করে বলে গেছেন তোকে যেন একলা না ছাড়ি।
নন্দনা কোনো কথাই বলতে পারছে না। গদিটা আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করছে প্রাণপণে। মুখ দিয়ে গোঙানির মতো আওয়াজ বেরোচ্ছে, বাবা! বাবা!
অবনীশের চোখ ছলছল করছে। সে হঠাৎ নীচু হয়ে ভেঙে পড়া নন্দনাকে জোর করে তুলে ধরল। গাঢ় গলায় বলল, তোর খুব কষ্ট হচ্ছে বাছু? এই টপটা তুই খুলে ফ্যাল।
নন্দনার টপের জিপার চড়াত করে খুলে গেল।
তুই এই জিনসটাও খোল—তার গলা ধরে এসেছে। চোখ ধকধক করছে অস্থির হাত এখন চলে যাচ্ছে প্যান্টের জিপারে। নিবিড়ভাবে তাকে জড়িয়ে ধরেছে অবনীশ। তুই অসহ্য সুন্দর বাচ্চু, শোকে তোকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। তুই আমায় পাগল করে দিস, ওহ—চকিতের মধ্যে তার বুকের ভাঁজে ঢুকে গেল অবনীশের ঠোঁট।
আর তার পরেই সে দেখল তার ঠোঁট জোড়া যেন পেরেকে গেঁথে গেছে। ক্রমশ শোকসন্ধ্যার অন্ধকার আরও দম বন্ধ করা, ক্রমশ এক বুনো জান্তব গন্ধে ভরে যায় ঘর। প্রবল বমি পেতে থাকে নন্দনার। তার বাহ্যসংজ্ঞা লোপ পাচ্ছে। সামনে দুলছে কুয়াশার পর্দা। ভেদ করে কিছু দেখা যায় না। প্রত্যেকটি লোমকূপ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে চকচকে মসৃণ তীক্ষ্ণদৃঢ় শলাকা। শিউরে শিউরে উঠছে গা। হাড়গোড় মানছে না, গুটিয়ে বর্তুলাকার হয়ে যাচ্ছে শরীর। অসহ্য মোচড়াচ্ছে।
দু-চার মিনিটের ব্যাপার। শলাকা ত্বরিতে গুটিয়ে যায় ত্বকের মধ্যে। এত চিকন যে তাতে কোনো ক্লেদ লেগে থাকে না। বর্তুলাকার বদলে সটান হয়ে যায় শরীর। মাথায় ঝিম ধরে আছে, যেন সে নেশাগ্রস্ত। মেঝের ওপর এক হাত এলিয়ে পড়ে থাকে এক অর্ধনগ্ন অর্ধচেতন তরুণী। অদূরে ছিটকে পড়ে থাকে এক যুবকদেহ। বিমুখ রক্তরা সহস্র ছিদ্রপথে বেরিয়ে আসছে। চোখ থেকে ঠিকরে পড়ছে ভয়।
ক্রমে জ্ঞান ফেরে। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায় ডক্টর দাশের উচ্চশিক্ষিত কন্যা। পেশায় সাংবাদিক। এই দৃশ্য সে এই প্রথম দেখল। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে তার। কাঁপা হাতে ঊধ্বাঙ্গের জামা পরে নেয় সে, জিনস কোমরে তোলে, আঠা-আঠা হাতে ফোনের ডায়াল ঘোরায়। প্রথমে অ্যাম্বুল্যান্স, তারপর পুলিশ, তারপরে মা। ম মা-আআ র বাচ্চু বলছি, শ শ জারুটা যায়নি মা, অবনীশদাকে…। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে নন্দনা, অকারণেই হাত বোলায় মসৃণ বাহুতে। কী যেন! কী যেন! তার মনে পড়ে না। সে কিছু জানে না। গিরগিটি যখন রং বদলায়—লাল, হলুদ, সবুজ—সে কি বুঝতে পারে? জানে? প্রকৃতি জানে। গিরগিটি জানে না।
কাকজ্যোৎস্না
এই পাখিটাকে বোধহয় কেউ পছন্দ করে না। কেউ না। পাখি বলে মনেই হয় না। এটাকে। জমাদার পাখি তো জমাদারই। জঞ্জাল সাফ করতেই পয়দা হয়েছে। পাখি এখনও নয়। পাখি শব্দটার মধ্যে কেমন পাখি-পাখি ভাব আছে একটা? আহা-আহা করে মন! আয়রে পাখি ন্যাজঝোলা, খেতে দেব ঝাল ছোলা, খাবি দাবি কলকলাবি খোকনকে নিয়ে বেড়াতে যাবি!
আদর করে প্রতিশ্রুতির বোল বানাও, যেন শিশুও যে, পাখিও সে। শিশুতে পাখিতে, শিশুর আদরে পাখির আদরে এক হয়ে যায়।
পাখি যখন আচমকা উড়ে যায়? ডানার তলায় লুকোনো রঙের সওগাত দিয়ে যায়। যদি কাছের ডালে এসে বসে? ডাল দুলবে আবেশে, আয়েসে, ছন্দে, আনন্দে। মাছরাঙা-টাঙার মতো শাঁ-আঁ-আঁৎ করে যদি এক লপ্তে ঝাঁপ দিয়ে চলে যায় এতটা? তবে রোদ্দুরে নীলা, রোদ্দুরে চুনি, রোদ্দুরে পান্না। তাতা থই থই, তাতা থই থই, তাতা…
পাখি, আহা পাখি-রে!
আয় বেনেবউ, বসন্ত বৌরি…ময়ূর ময়ূরী…পানকৌড়ি!
মরি! মরি!
রূপের বাহার যার নেই তার দ্যাখো নামের বাহার! ভঙ্গির বাহার!
টপাস টপাস করে ডিগবাজি খাচ্ছে ডাহুক জলের ওপর? ব্যাপারটা হল শিকার ধরা। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। কিন্তু কেমন একটা, আস্ত ছেলে-ভুলোনো কমেডি তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কিংবা ছড়া। ছড়ার ছন্দ।
টপাক টপাস
গপাক গপাস।
আর ঘুঘু। কী অসামান্য ওর ধূসর কোমলিমা! ওর মৃদু ময়ূরকণ্ঠী কণ্ঠ, পেলব রেখায় আঁকা সুগোল মুণ্ড, ওর টলটলে ফোঁটা-চোখ!
ডাকটা! ডাকটা! ঘুঘুর ডাক!
তুমি বসে আছ। তোমার ভেতরে ভালো খবর, পানাহারে বেশ তৃপ্ত তুমি, আপনজন পাশে বসে রয়েছে। মুহূর্তে সব লুপ্ত হয়ে যাবে গোধূলি-সন্ধির আবছায়ায়। না না, সে নেই। কোনো দিনও ছিল না। স্বপ্নে ছিল হয়তো। তার বেশি কোথাও নয়। পাওয়া তোমার হয়নি নটরাজ। কোন সুদূর, অনাগত আগামীর দিনে-রাতে পাওয়া তোমার অনাসন্ন হয়ে এলিয়ে আছে।
ক্কঃ! খবঃ!
জানলার পাটের ওপর ছরকুটে পায়ে দাঁড়িয়ে, চোখ টেরিয়ে, ঘাড় বেঁকিয়ে ডাকছে কাকটা।
ওরে কাক, এখানে তোর কাঁটা-পোঁটা-তেল পটকা ওইসব কুৎসিত আমিষগুলো থাকে না, থাকে না। এখানে বই, এখানে খাতা, এখানে কলম। এসব তুমি বুঝবে বাপা!
ওহ, তাই বল। চুরির তালে? এই স্নিগ্ধ স্লিম নীল জটারটার দিকে চোখ পড়েছে তাহলে? না ওই তন্বী শুভ্রা পেপার কাটার? কোনটা তোর নোংরা বাসায় নিয়ে যেতে চাস?
হুশ, হুশ হু-উশ!
বেশ একটা আমেজ এসেছিল, চলে গেল ঝপ করে। ফিউজ। নটরাজ ফিউজ। নটরাজ সিনহা বেকার। তিন বছর হল। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ? হয়েছে হয়েছে, কার্ড হয়েছে। সি. এস. সি.? আবেদন গেছে। খবর নেই। কোনো খবর নেই, দৈনিক কাগজ দেখে বিজ্ঞাপনের জবাব? প্রচুর, প্রচুর। পোস্ট আপিসের ফালাও কারবারটা নটরাজ সিনহার জন্যেই চলছে। সর্ববৃহৎ কাস্টমার, পোস্ট আপিসের।
আত্মীয়-প্রতিবেশীদের মাথায় স্বভাবতই ঝুড়ি। ছোটো বড়ো। রাস্তায় ঘাটে, বাসে ট্রামে দেখা হলেই হন্তদন্ত হয়ে ঝুড়ি নামিয়ে দিচ্ছে। উপদেশের ঝুড়ি, আরে কম্পুটার শেখ, কম্পুটার শেখ। কিছু না হোক হাতখরচাটা উঠে যাবে
কেটারিং। এখন কেটারিং টেকনলজির যুগ। একটু মন দিয়ে লেগে থাক। লাগে তাক না লাগে তুক।
তোর তো বেশ লেখার হাত ছিল নট। একটা ছোটোখাটো কাগজ দিয়ে কেরিয়ার আরম্ভ করতে পারতিস! ছুঁচ হয়ে ঢুকতিস আর ফাল হয়ে বোরোতিস! বুঝলি তো?
উচ্চস্তরের গাম্ভীর্য বিকীর্ণ করতে করতে ওই চলে যাচ্ছে শৌভিক। সদ্য সদ্য চাকরি পেয়েছে। আফটার শেভের গন্ধ ভুরভুর করছে। নটরাজের থেকে দু বছরের জুনিয়র। বাপী! রথতলার বাপী! ইয়ুথ ক্লাবে সবচেয়ে বেশিক্ষণ থাকত, ফাইফরমাশ খাটত! আজকাল আসে না, খাটে না, চলার ছাঁদ বদলে গেছে। ও-ও পেয়ে গেছে। এমনকি রেমির বোন রিয়া, যে সর্বক্ষণ ফেউয়ের মতো পেছনে লেগে থাকত? সে-ও হাত উলটে কবজি ঘড়ি দেখে বলছে, ওহ সময় নেই নটদা, অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। চলি…।
ইতিমধ্যে বাড়ির অভিবাবক দাদা বলছে ক, খ বঃ। অফিসে বেরোতে বলছে অফিস থেকে ফিরে বলছে, চান করে মাথা মুছতে মুছতে, খেয়ে দেয়ে আঁচাতে আঁচাতে, ঘুম পেলে হাই তুলতে তুলতে, চোখ টেরিয়ে, ঘাড় বেঁকিয়ে, ছরকুটে হয়ে দাঁড়িয়ে, গলার ভেতর থেকে অচেনাতর, অচেনাতম গমক বার করে বলছে কঃ বলছে খ বঃ। অর্থাৎ খুব খুব খারাপ। আর দাদার শ্রীমতী বউদি? বউদি মুখ ফুটে কিছু বলছে না অবশ্য। ভাতের পাশে ডাল, ডালের পাশে থোড়, থোড়ের পাশে বড়ি, বাড়ির পাশে খাড়া-অক্লান্ত নিয়মানুগত্যে সাজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে দুবেলা। থালার পাশে এক চিমটি ছাই। দেখতে পাচ্ছে নটরাজ। তৃতীয় চক্ষু দিয়ে। দূর দূর ছেই ছেই, শুনতে পাচ্ছে তৃতীয় কর্ণ দিয়ে। চা-পাউরুটি টোস্ট নিয়ে সকালে সাত তাড়াতাড়ি দরজার পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে বউদি রোজ। কিছু বলছে না। চুপচাপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে সড়সড় করে চলে যাচ্ছে তেঁতুলে বিছে। বলছে না কিছু। কিন্তু তার হয়ে জানলার পাটে বসে থাকা ওই কাক না কাকিনী, শকুনি না গৃধিনীটা বলে দিচ্ছে, খ্যাখ্যা খ্যা খ্যা খ্যা।
সন্ধে। আলো জ্বলে। ওপরেও আলো। নীচেও আলো। জড় আলো, যার ব্যবস্থা মাইকেল ফ্যারাডে করেছিলেন। আর চেতন আলো, যার ব্যবস্থা করেছে বা করেছেন অজ্ঞেয় ঈশ্বর স্বয়ং। বাচ্চাদের মিস। আলো যাচ্ছে ঘরের বাইরের সরু বারান্দা দিয়ে, শুক-শারিকে পড়াতে। দাদার ছেলেমেয়ে। আলো যাচ্ছে, পর্দা তুমি উড়ে যাও, কপাট তুমি খুলে যাও, চশমার লেনস তুমি টেলিস্কোপের লেনস হয়ে যাও। হলুদ ডুবে শাড়ি ঝলকে গেল, চমকে গেল। ক্ষুরধার বারান্দা-পথে বিজুরি আখর।
গেছে, গেছে। পর্দা উড়ে দরজার মাথায় লটকে গেছে, খোলা কপাট। চৌকাঠে আলো। চোখে সোনালি ফ্রেম। পোরো না আলো, ও ফ্রেম পোরো না। নাকের দু পাশে ডোব-ভোব গর্ত হয়ে যাবে। শেল পরো আলো, সাধারণ শেল।
এ কি? এমন করে চুপচাপ বসে আছেন যে?
পা নেই।
পা নেই? কী হল? মচকেছেন?
উদবেগ, স্নেহ, শঙ্কা। বাঃ! এভাবেই হাঁটি হাঁটি পা-পা করে শামুক এগিয়ে যাবে।
হেসে ফেলেছে।—ওহ পা মানে দাঁড়ানোর পা, পারেনও বটে আপনি—তো হবে? শিগগিরই হয়ে যাবে।
বলছেন?
বলব না কেন? সবারই তো হয়!
লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার। সবারই তো হয়! বললেই হল!
হয়ে যায় তো দেখি! অন্তত যাদের হয়, তাদের দলে আপনি।
বাঃ প্রফেসি? না উইশফুল থিংকিং?
দুই-ই।
ধন্যবাদ। সুক্রিয়া। আজকাল হিন্দিটা বেশি চলছে।
চলে যাচ্ছে আলো। আবার সব ফিউজ করে দিয়ে চলে যাচ্ছে। বউদির ঘরে, শুক-শারির পড়ার টেবিলে আলো জ্বালতে চলে যাচ্ছে।
আধা-ফরসা রংটা। ভালো খেতে টেতে পেলে, দু চার টিউব ক্রিম-টিম মাখতে ফাখতে পেলে এই রঙেই মার্বেলের গ্লেজ দেবে। অতএব ক্রিম মাখে আলো। খেতে পায়। জামতাড়ার বাংলোর হাতায় দুটো বেতের চেয়ারে দুজনে বসে থাকে। নীল-গোলাপি ম্যাকসির লেসের পাড় আলোর মার্বেল পায়ের পাতা ছুঁয়ে চুপটি করে শুয়ে আছে। বেয়ারা ফ্রায়েড চিকেন আর চিকিত চিকিত করে কাটা আনারসের চাকতি রেখে গেল। কোথায় যেন এই কম্বিনেশনটার কথা শোনা গেছিল। পালিশ-করা আঙুলে একটাই লাল-কমলা পাথর। কী ওটা? কী আর! পাথর নয়, প্রবাল। সমুদ্রের তলায় থাকে। মাঝে মাঝে উঠে আসে আলোরা সাজবে বলে। ফিগার আঁকড়ে ধরে থাকে, কী যেন বলে ওই শাড়িকে? ধনেখালির মোড়ক ছাড়িয়ে সেই কী যেন বলে শাড়ি স্বপ্নরঙিন নেশায় মেশা সে উন্মত্ততা আলোর অঙ্গে অঙ্গে জড়িয়ে দিচ্ছে নটরাজ। বেগুনি না গোলাপি কী বলে এ রংদের? এরা কোনো চেনা-জানা নামের খাঁচায় ধরা পড়তে চায় না। বনের পাখি এসব রং, এসব শাড়ি, বলে, খাঁচায় ধরা নাহি দিব। বলে, কেবলি বনগান গাব। তাই মোটা কালো বিনোদ বেণি ঢেউ খেলিয়ে খেলিয়ে এলিয়ে যাচ্ছে। কাঁধ পিঠ সমস্ত ঢেকে চেয়ারের আশেপাশে পেছনে সামনে লুটিয়ে যাচ্ছে রাজকন্যের মেঘবরন কেশ। ঝড়ের দোলা লাগল মেয়ের আলুথালু বেশ গো। আলুথালু…। ছুটছে আলো, ছুটছে। ঝড়ই তাকে ছুটিয়ে নিয়ে যায়। দুরন্ত বাসনার ঝড়। কার বাসনা? কার আর? নটরাজের।
আলোর মুখের কাট গ্রিসিয়ান। স্লিম, মডেলমার্কা আজকালকার রমণী নয়। চিরকালের। দীর্ঘ, কিন্তু অতি-দীর্ঘ নয়। সুডৌল। চোখের তারা দুটো সামান্য ওপর দিকে করে দাঁড়াও আলো! হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে। এথিনা, গ্রিক দেবী এথিনা।
এথিনা রান্নাঘরের ফোড়নগন্ধী হঁদুরে অন্ধকারে পিঁড়ি পেতে বসে ডেঙ্গর ডাঁটা চিবোচ্ছে। ভাবা যায়? লুঙ্গি, গামছা, দাঁত মাজনের লাল পাউডার, পোড়া কড়া, পোড়া চাটু, ডাল-ঝোল তেল ব্যাড়বেড়ে হাতা-চামচ, টিনের দরজা, ধরা জল খরচের কিপটে আওয়াজ, ধপাস ধপ ধপাস ধপ, কাঁথাকানি কাচিতং, ধরে গেল, হাফ লিটার সবে ধন মাদার ডেয়ারি ধরে গেল। ধর ধর ছোটো খোকাটাকে ধর, যাঃ মুখে পুরে দিল। জ্যান্ত আরশুলাটাকে মুখের ভেতর…মাগো! খোল। খোল মুখ! ভ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ। ভাবা যায়?
এথিনা, তোমাকে আমি নিয়ে যাব তোমার স্ববেদিতে। আক্রোপোলিস। বেশি নয়, একটি ভক্ত একান্ত থাকবে তোমার। তুমি শুধু বীরাঙ্গনা মুদ্রায় দাঁড়িয়ে প্রেমকরুণ শুভদৃষ্টিটা তার দিকে পাঠিয়ো। আরও থাকবে ভক্ত। মনুষ্য ও দেবগণ। কিন্তু তারা বাহ্য। তারা তোমার ভঙ্গি দেখতে পাবে। অঙ্গ দেখতে পাবে না। দেখতে পাবে ঘুরে ঘুরে চূড়াকার কেশের বাহার, দেখতে পাবে না চোখের নিভৃত নজর।
কিংবা তুমি ওড়ো, আলো ওড়ো। তোমার আমি ওড়ার পোশাক পরিয়ে দিলুম। বেশি দূর উড়ান দিতে হবে না, ময়ুর আমার! বেলেপাথরের স্থাপত্যের পটভূমিটা খুঁজে পেতে যা দেরি। তারপর পেখম মেলে দাঁড়াও। ঝর ঝর ঝর ঝর আওয়াজ তুলে নাচো, ময়ূর নাচো। বাঁচো।
আপনি এখনও ওইভাবেই বসে? পা খুঁজে পাননি?
ধ্যান করছি।
বাঃ ধ্যান খুব ভালো জিনিস। কিন্তু টিউশনি আরও ভালো। হাতে আছে কটা। ভালো টাকা দেবে। করবেন?
তো আপনি করছেন না কেন?
আমি স্পেশালাইজ করেছি বাচ্চাদের লাইনে।
তা এরা কি বাচ্চার বাপ?
উঃ, পারেনও। বাপ না হোক, দাদা-দিদি। বি. এ. হনস, এম. এ. আপনার তো প্রচুর নোটস আছে।
সেসব নোটস আমি একজন ছাড়া কাউকে দেব না।
দিতে যাবেন কেন? ব্যবহার করবেন।
সেই একজন যে কে জিজ্ঞেস করলেন না তো?
জানি। আমার পরীক্ষার পড়া করার সময় নেই। সকালে তিনটে, সন্ধেয় দুটো রোজ। জোড়া জোড়া বাচ্চা সব। কখন পড়ি বলুন? …
হুশ। পাখি উড়ে গেল।
কিন্তু, কী বারতা রেখে গেল ও? বি. এ. অনার্স, এম. এ., ছাত্রছাত্রী? ভালো টাকা? সত্যিই তো? প্রচুর ভালো নোটস আছে। রয়ে গেছে। চাকুরি যখন হচ্ছে না, উপার্জন করতে দোষ কী? এটা কেন এতদিন মাথায় আসেনি?
অতঃপর নটরাজ দিনের পাখি। রাতের পাখি। পুরাতন সাইকেলটা কাজে লাগছে, কাঁহা কাঁহা মুলুকে চলে যাচ্ছে নটরাজ। মাস গেলে পকেটে কড়কড়ে কাঁচা নোট। মাস গেলে বউদির হাতে সেভন হানড্রেড হোক।
দাদা মুখ ধুচ্ছে।—খ খি?
বিশেষ কিছু নয় দাদা, টিউশনি।
বউদি বলল, তা হোক। লক্ষ্মীর আবার জাত কী? মা সদাই মা।
আপন খাঁচায় ফিরে এসে এবার নটরাজের খি-খি করার পালা। হাতের নোটগুলো সাজায় আর হাসে, মা? অ্যাঁ? তোরা শেষ পর্যন্ত মা বনে গেলি? যা ববাবা।
ক্রমশ দশ হাজারি হয়ে তবে দম নেয় নটরাজ। সেবন্তীর বাড়ি জনা দশ একত্রে পড়ে। নিয়াজ হাসানের বাড়ি আরও দশ। রাজিন্দর সরানার ঘরটা আরও বড়ো। ওদের সব ঘরই হলঘর। ওখানে একসঙ্গে বারো জন। আর নটরাজের মাটি ভাপাবার সময় নেই। কে বলল খ, কে বলল খা, শোনার সময় নেই। লাইব্রেরি যাচ্ছে রেগুলার। জিরক্স করছে তাড়া তাড়া। বিতরণ হবে। মোটর সাইকেল কিনেছে, লাল হেলমেট, কোচিং যাবে। ফেল্টপেনের সেট। খাতা কারেকশন করবে। নটরাজ একাই একখানা চলমান ইউনিভার্সিটি।
ভালো উপরিও আছে প্রফেশনে। রেজাল্ট বেরোলে উপহার আসতে থাকে নানান কিসিমের। চিত্রাংশু দিয়ে গেল মিথস অ্যান্ড লেজেন্ডস, সুমনা এনেছে বিদেশি কলম, মাইকেল জ্যাকসন নিয়ে হাজির সুশোভন, মিতারা দশজনে মিলে কিনে এনেছে এনসাইক্লোপিডিয়া ছ-ভলুম। সুরানা রবীন্দ্র রচনাবলী রাজসংস্করণ।
ফুরফুরে চুল সাবধানে আঁচড়ে তাম্রলিপ্ত জিনস আর ক্রিম টি শার্ট পরিধান করে অতএব নটরাজ সেবন্তীর বাবার বাড়ি যায়। শ্রেষ্ঠ উপহারটি তিনিই দেবেন। দশহাজারি টিউটরের লালচে গাল, কালচে চুল, চকচকে খোলনলচে, ধুন্ধুমার মোটর সাইকেল, কথাবার্তায় সাবলীল দখল সেবন্তীর মতো সেবন্তীর বাবাকেও টানে। নামি বিজ্ঞাপন কোম্পানির দামি চাকরি তাঁরই সৌজন্যে হাঁকড়ায় নটরাজ। এবং শেহনাই বাজে।
নটরাজ সিনহা, যে একদিন নিজের পা খুঁজে পাচ্ছিল না, বাম্পার ড্র-এর ফার্স্ট প্রাইজখানাই সে পেয়ে গেছে লটারিতে। সে এখন শ্বশুরপ্রদত্ত সুবিশাল যোধপুরি ফ্ল্যাটে থাকে। মামাশ্বশুর প্রদত্ত কনটেসা হাঁকায়। ঘরে ঘরে অত্যাবশ্যক ভোগ্যপণ্য শীতাতপ নিয়ন্তাগুলি পিসিশাশুড়ি মাসিশাশুড়িরা যুক্তি করে উপহার দিয়েছেন। সেইখানে চিনে মিস্ত্রির তৈরি সেগুন কাঠের ফার্নিচারে অঙ্গ রেখে অফিসান্ত কাজকর্ম সাঙ্গ করেন বাদশাহ। চেহারায় আরও চেকনাই। চুলে আরও গ্লেজ। চলনে আরও উড়ান। বলনে আরও পালিশ।
কোনো কোনো উইক-এন্ডে বাদশা-বেগম সামাজিক হয়ে যান। বেলিয়াঘাটার পুরোনো পাড়ায় যান। পুরোনো বাড়ির চটা ওটা ফাটা-চাতালে দুটি চাতক পক্ষী। চাতক? না গায়ক?
দাদা ডাকেন, কুহুঃ।
বউদি ডাকেন, পিউ কাঁহা।
প্লেটে খাবার সাজাতে সাজাতে ডাকেন, খাবার তুলতে তুলতে ডাকেন, চা করতে করতে ডাকেন, সেই একই বউদি, যিনি অসামান্য প্রতিভায় টাকাকে মা বলেছিলেন। পাড়ার জ্যাঠামশাই এসে যান। এসে চেঁচিয়ে বলেন, তিনি বরাবর জানতেন নট এলেমদার ছেলে। খাটো গলায় আবার বলেন, অন্তত হাজার পাঁচেক যদি…বাড়িটা বড্ড আটকে গেল কি না…।
পাড়ার ঝগড়াটি ধনেশগুলো কী মন্ত্রে সব শিস দেওয়া বুলবুল-দোয়েল হয়ে গেছে। গেরস্থ পায়রাগুলো যারা নিজেদের থাকত, কদাচ গণ্ডির বাইরে পা ফেলত না, তারা সব কুতূহলী শালিখ হয়ে কদম কদম বেঢ়ে আসছে। নটরাজের অভিমুখে।
শুক-শারিকে ব্যাটবল নিয়ে মাঠ থেকে ফিরতে দেখে দপ করে মনে পড়ে গেল।
তোরা আজকাল টিউটরের কাছে পড়িস না?
পড়ি তো! টিউটোরিয়্যাল হোমে।
বউদি বলল, এক-এক সাবজেক্টের এক-এক টিচার রাখবার সংগতি নেই ভাই আমাদের। অগত্যা টিউটোরিয়াল।
কোথাও কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া নেই। কারুর মনে কোনো সন্দেহ, ঘুণাক্ষরেও দানা বাঁধেনি। তবু…তবু জিজ্ঞেস করা গেল না। কেমন বাধো বাধো ঠেকল।
বউদি নিজেই কী ভেবে বলল, তা ছাড়া আলোকে দিয়ে হায়ার ক্লাসটা ঠিক হয় না। ওর তো দাদাটি আবার মারা গিয়ে বসে আছে। বাপের সংসার, দাদার সংসার সমস্ত ওর ঘাড়ে। অগুনতি টিউশনি করে।
দেখা হবার কথা নয়। অগুনতি টিউশনি করে যখন। তবু একদিন দেখা হয়ে গেল। বাই-পাস ধরে এসে বিজন সেতু দিয়ে গড়গড়িয়ে নেমেছে কনটেসাটা, বালিগঞ্জ স্টেশনের মুখে দু নম্বর থেকে নেমে এল আলো। মোটা ফ্রেমের চশমা। পুরু কাচের ওধারে চোখ গলে গেছে। শিটোনো। কেমন কালিঝুলি মাখা। শাড়িটা যেন বড্ডই বড়ো হয়েছে। কাঁধের ওপর দিয়ে সামনে এসে অর্ধেক আলোকে ঢেকে দিয়েছে। কেমন উড়োখুড়ো।
এ কি আলো? এখানে? চিনতে পারো?
চশমাটা বারবার ঠিক করে অবশেষে ঘাড় ঝাঁকিয়ে এক চোখে তাকিয়ে রইল আলো।
বলল–ক্কঃ।
আমি নটরাজ। নটরাজ সিনহা।
ক্কঃ, ক্কঃ, হক্ষ।
এ কী? এত কাশছ? ওষুধ খাও!
খাই তো! চলি, খুব দেরি হয়ে গেছে।
আলো আঁটসাঁট করে বড়ো কাপড়টা জড়িয়ে পরেছে। চটিটাও বোধহয় বড়ো। কেমন ঘষতে ঘষড়াতে চলে গেল।
অনেক রাতে সেবন্তী ঘুমে, বাড়ির কাজের লোকগুলি ঘুমে, সেবন্তীর ছেলে ঘুমে। কা! কা! কা! বিস্মিত, ব্যথিত, বিপন্ন ডাকাডাকি চরাচরে। ঘুম চটে যায় নটরাজের। জানলা থেকে ফিকে জোছনার প্রপাত দৃষ্ট হয়। অগত্যা নিশি ডাকে বারান্দায়। সৌর প্রকৃতির জাদুদণ্ড জোছনার গায়ে ভোরালো আলো-আঁধারি ছুঁইয়ে দিয়েছে। আর, বুঝি দুখনিশি ভোর—এই বিভ্রমে পাগলের মতো ডেকে ডেকে ফিরছে কাকেরা। সেই কাকই তো? ছরকুটে পা…কালিঝুলি…উড়োখুড়ো…?
কা? কা? কা?
কাকের গলায় এমন আর্দ্র, সুদূর, মন-শূন্য করা জিজ্ঞাসা আগে কখনও শোনেনি সে। কাক না ঘুঘু। তফাত করা যায় না।
ক্যালকাটা মকটেল
২০০৩-এর আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় ফোটোগ্রাফটি সর্বদেশীয় বিচারকমণ্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার নাম ক্যালকাটা মকটেল। চিত্রী অম্বুজ শ্রীনিবাসন। কারিগরি আছে ছবিটাতে। কোলাজ, সুপার ইমপোজিশন, নেগেটিভ ইত্যাদি অদ্ভুতভাবে ব্যবহার করে ছবিটি যেন স্টিল ফোটোর সীমা ছাড়িয়ে গেছে। কেউ বললেন স্টিল হয়েও এ চলচ্চিত্র, কেউ বললেন এ কবিতা, কেউ বললেন, এর মধ্যে খুব জটিল ছোটোগল্পের গুণাবলি দেখা যাচ্ছে। মোট কথা, ছবিটি সকলকে আশ্চর্য ও মুগ্ধ করল। বলা বাহুল্য, দেড় লাখ ইউ এস ডলারের প্রথম। পুরস্কারটি শ্রীনিবাসনই পেল। পৃথিবীতে আলোকচিত্র-প্রেমীর অভাব নেই। শ্রীনিবাসনের ফ্যান মেলটি বেশ পুরুষ্টু হতে লাগল। অনেক গুণমুগ্ধ জিজ্ঞেস করতে লাগল—এই অদ্ভুত ছবিটি সে কী ভাবে ভাবল।
দেখুন, শিল্পী মাত্রেই জানেন কত অর্থহীন এই প্রশ্ন এবং কত প্রত্যাশিতও। শিল্পী কি সব সময়ে সত্যিই জানেন কী ভাবে কী ঘটে তাঁর মাথার মধ্যে? কোথাও তিনি মানবসীমা ছাড়িয়ে যান। মিস্টিক, একটা অতীন্দ্রিয়ের হাতছানি তাঁকে নিশি ডাকে ডেকে নিয়ে যায়।
অম্বুজ জানে, অথচ জানে না। সে ফোটো-জার্নালিস্ট। পেশাদার। এর নাড়ি নক্ষত্র তার জানা। কিন্তু এ ছবির আইডিয়াটা একটা হঠাৎ ঝলক, তারপর ক্রমিক ঝলক। যখন কাজটা শেষ হয়ে গেল সে বুঝতে পারল এতক্ষণ সে একটা ঘোরের মধ্যে ছিল।
২.
পশ্চিম জার্মানির এক অটোবানে মারাত্মক গাড়ি দুর্ঘটনায় আমি মুক্তি পাই। মৃত্যু বলে মুক্তি কথাটা কেন বললাম, তার একটা বিশদ কারণ আছে। আমি মাটিল্ডার পাল্লায় পড়েছিলাম।
যা উপার্জন করতাম তাতে বেশ আরামে থেকেও মোটের ওপর চলে যেত। দু বার স্ত্রী বদলে ঘাড়মোড় ভেঙে যার প্রেমে পড়লাম সে পঁয়ত্রিশ। আমি সত্তর। যতই বয়স হয়, ততই কিছু কিছু মানুষ তরুণী-লোভে পাগল হয়। আমিও হয়েছিলাম। চিকনচাকন বাদামি চোখের ধোঁয়াটে চুলের মাটিল্ডা আমাকে চুম্বন টানে টেনে নিয়েছিল। আধা ব্রুনেট ঝলমলে এক কপর্দকহীন ডিভোর্সি। পঁয়ত্রিশ কি পঁচিশ বোঝা শক্ত। সময় কাউকে কাউকে ছোঁয় না। আমার চোখ আর বাকি সব ইন্দ্রিয়ও তো তখন সত্তর পার! তা এই আধাব্রুনেট সুন্দরীটি আমাকে কী কারণে পাত্তা দিল? আসলে মেয়েটা ছিল ডাকসাইটে বেজন্মা। কোন দেশের কোন জাতির কোন ধর্মের রক্ত যে তার ধমনিতে ছিল না, তা জানতে লাইব্রেরি-ভরতি বিজ্ঞান আর সমাজবিদ্যা লাগবে। বিজ্ঞান অবশ্য বলে থাকে এ রকম মিশ্রণে উন্নত ধরনের মগজ তৈরি হয়। কিন্তু এ মেয়েটা অদ্ভুত। নিজেকে নাস্তিক বলে গ্যাদা দেখায় আবার বিপদে পড়লেই বুকে ক্রশ আঁকে, দুষ্টু বুদ্ধির শিরোমণি অথচ কিছু শিখতে পারেনি। ফলে আকাট মুখ, মিথ্যেবাদী আর বিচ্ছিরি রকমের সুযোগসন্ধানী। ব্যালে ও বেলি-ডান্স দুটোই শিখতে গিয়ে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে অবশেষে একটা নাটকের দলে ড্রেসগুছোনির কাজ করছিল। এদিকে আমি এক তীক্ষ্মনাসা, উজ্জ্বল চোখ, গ্রানাইটের তৈরি সন্ত-সন্ত চেহারার অতি স্মার্ট মোটামুটি বিখ্যাত ইনটেলেকচুয়াল, যাকে ঠিক অতটা বৃদ্ধ বলে বোঝা যায় না। আমার মনোযোগে ও অহংকারের সপ্তম স্বর্গ তো পেলই, উপরন্তু আমাকে সমাজে ওঠার একটি সোনার সিঁড়ি ঠাওরাল।
কিছুটা সময় অবশ্যই রূপ-রস-স্পর্শঋদ্ধ এক অবিশ্বাস্য মৈথুন স্বর্গে বাস করি, তারপর মোহভঙ্গ হয়। আরে ধ্যাত্তেরি, আমার আয় অনিয়মিত, বুঝে খরচ করলে যথেষ্টর বেশি, না করলে পপাত। আজ এই ডিজাইনার ড্রেস চাই, কাল ওই মুক্তোর ছড়া চাই, পরশু চাই কমল-হিরের ব্রুচ। সীমাসংখ্যা নেই আবদারের। না রাঁধবে বাড়িতে, না যাবে সস্তার জায়গায় খেতে। তার ওপর মদ্যপ। নির্জলা। হুইস্কিতে হুশ করে পৌঁছে গেল। সন্দেহ হয় বার থেকে, লোকের বাড়ির সেলার থেকে বোতল হাতাত। বাধা দিলে তুলকালাম। গালিগালাজ, জিনিসপত্র ভাঙচুর। পার্টিতে পার্টিতে আমাকে ধরে বিশিষ্ট মানুষদের সঙ্গে পরিচয় করত। প্রথম পাঁচ মিনিটে সম্মোহন, দ্বিতীয় পাঁচ মিনিটে বিদ্যে জাহির। তৃতীয় পাঁচ মিনিটে পরিষ্কার হয়ে যেত ওর মূর্খামি। ওর এই হ্যাংলাপনা, ইতরামি ক্রমে আমার অসহ্য হয়ে উঠতে লাগল। তৃতীয় বিবাহ-বিচ্ছেদের কথা ভাবছি, এমন সময়ে বছর দুইয়ের মাথায় আমার সেরিব্রাল স্ট্রোকটি হল।
গেল মোটর নার্ভগুলো। চিকিৎসা। অজস্র ফিজিয়োথেরাপি। তার পর আস্তে আস্তে হাত-পা নাড়ি। টলে টলে উঠে দাঁড়াই। হাতে ওঠে লাঠি। প্রাণপণ মনের জোরে নিজেকে একটা মোটামুটি কর্মক্ষম অবস্থায় নিয়ে আসি। রোজগারপাতি কমে গেল। মাটিল্ডা উঁচু ডালে মই বাঁধবার চেষ্টা করল কয়েক বার, কিন্তু টিকতে পারল না। দায়ী ওর সেই আকাটমি। শরীর দেখানো, চুরিচামারি আর ঝগড়া করা ছাড়া আর কিছুরই তো চর্চা করেনি। ককেশীয় রক্তের এই একটা সুবিধে। গায়ের রং, উচ্চতা, গঠন, চোখ-মুখের সৌন্দর্য জিনগত ভাবে পেয়ে থাকে। একটু যত্নআত্তি করলে, ফ্যাশান-ট্যাশন জানলে দাসীকে দাসী বলে চেনা যায় না। মা মেরির দিব্যি বড্ডই নীচু স্তরের। মজা হল আমরা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লাম এই সময় থেকেই। পার্ট টাইম বেশ্যাগিরি আর পার্ট টাইম দাসীগিরি করে ও-ই আমার থেকে বেশি রোজগার করত। তার ওপর পেশার প্রয়োজনে একটু না ঘুরলে আমার চলে না। কে গাড়ি চালাবে মাটিল্ডা ছাড়া? ওকে ছাড়া আমার উপায়ও রইল না। হয়ে গেলাম ওর রাখনা। ওর দিক থেকে মাঝে মাঝে এক লপ্তে যখন অনেক টাকা রোজগার করতাম, তাই দিয়ে বড়োমানুষি করবার লোভ ছিল। তা ছাড়া বোধহয় একটা ভদ্রস্থ পরিচয়ের আড়াল ওর খুব দরকার ছিল। সুতরাং বিচ্ছেদটা মুলতুবি হতে হতে তামাদি হয়ে গেলই বলা চলে।
৩.
একটা পত্রিকার অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে পশ্চিম জার্মানিতে যেতে হয়। এয়ারপোর্ট থেকে একটা ঝকঝকে টয়োটা লেক্সাস ভাড়া নিলাম। বেশ কিছু ফোটো তোলা হল। তখন শেষ রাত্তির, মেয়েটা হালকা মাতাল ছিল। হাইওয়ে থেকে নেমে একটা পুরনো ধরনের গ্রামের ছবি তুলছিলাম। স্রেফ গাড়ির কাচ নামিয়ে। এমন সময়ে মাতালে-বুদ্ধিতে মেয়েটা একেবারে বিনি নোটিসে টপ গিয়ারে গাড়িটাকে হাইওয়েতে এনে ফেলল আর সঙ্গে সঙ্গে একটা বিশাল ট্রাকের সঙ্গে রাম-ধাক্কা।
মাটিল্ডার কিমাকার দেহটার দিকে চেয়ে মনে হল যাববাবা, বাঁচা গেল। পরক্ষণেই ভাবলাম, বাঁচবই বা কী করে? কে আর এই বাহাত্তুরে আধা-পঙ্গু ফোটোগ্রাফারের সহধর্মিণী হতে আসবে! আর তা না হলে কে-ই বা গাড়ি চালাবে! তারপর বোধোদয় হল। নিজের থ্যাঁতলানো মাংসপিণ্ডটাকে পরিষ্কার দেখতে পাই। এহেহে, বেচারা বুড়োটা! তবে বেঁচেই বা কী করত? তিলতিল করে মরা বই তো নয়? বড়ো চমকার মৃত্যু! বুঝতেই পারিনি কিছু! আ-হা। কিন্তু আমি তো তা হলে প্রেত! মাটিল্ডাও কি তবে প্রেতিনী! মারাত্মক ভয়ে আমি হাওয়ার সমুদ্র উথালপাতাল ফ্রিস্টাইলে সাঁতরে যাই। ব্রেস্ট স্ট্রোকে ঢু মারি আকাশ পর্দায় এবং এক সময়ে উছলে উঠি মহাকাশে।
অসাধারণ এক দৃশ্য আমার ফোটোগ্রাফার সত্তাকে টেনে বার করে। কোনো প্রেতবোধ, শূন্যতাবোধ আমার থাকে না। ফোটো তুলতে থাকি প্রাণ ভরে। যে দিকে তাকাই শুধু পিণ্ডে পিণ্ডে অগ্ন্যুৎপাত। গ্রহ তারা সৌরমণ্ডল নীহারিকা ছায়াপথ ধূমকেতু লালবামন শ্বেতবামন কৃষ্ণগহবর অ্যাস্টারয়েড। আশ্চর্য! অত্যাশ্চর্য! এই সব ফোটো যদি নেচার-এ পাঠাতে পারতাম একটা যুগান্তকারী ব্যাপার হয়ে যেত। কিন্তু এও অতি আশ্চর্য যে এই অনন্ত চলন, বিরাট গরিমা তার প্রাথমিক জাদু ক্রমশ হারিয়ে ফেলল আমার চিত্রী চোখে। বড়ো একঘেয়ে লাগতে থাকে। খুব লজ্জা পাই এই মহামহিমের সঙ্গ আর আমার টানছে না বলে। কিন্তু সত্যি কথা না বলে তো নির্ভেজাল শিল্পীর উপায়ও নেই। নামতে থাকি এবং খুঁজতে খুঁজতে টুক করে পৃথিবীর আবহমণ্ডলে একটা ওজোন-ফুটো দিয়ে গলে পড়ি।
৪.
গ্লোবটার আলো-অন্ধকার আমার চোখের সামনে ঘুরে যায়। ভালো কথা, চোখ, ক্যামেরা এ সব কথা ব্যবহার করছি বটে, কিন্তু এ সব কিছুই আর নেই আমার। শুধু অভ্যাসটা আছে। সর্বসত্তা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি তবু বলি চোখ। অনুরূপভাবে নাক, কান, মুখ হাত, পা…
আরও নীচে নামি। উত্তাল সমুদ্র, উত্তুঙ্গ পাহাড়, নিচ্ছিদ্র বনানী। নদীনালা, শহর, গ্রাম, মানুষজন। ছবি তুলে যাই কিন্তু বুঝতে পারি এগুলোর সনাতন রূপে কোনো মৌলিকত্ব আনতে পারছি না। ঢেউ উঠছে তত উঠছেই। ভাঙছে তো ভাঙছেই। সব নদী সমুদ্রের দিকে যায়। সব পাখি উড়ান শেষে নেমে পড়ে নীড়ে। মেরু অঞ্চল থেকে ক্রান্তীয় ও ক্রান্তীয় থেকে নিরক্ষীয় অঞ্চল পর্যন্ত ক্যামেরার লেন্স ঘুরে ঘুরে আসে। সোনালি বালু, মাসাই যোদ্ধা, রেন ফরেস্ট, সেকুইয়া ফরেস্ট—এ সব কত বেরিয়েছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর পাতায়। সুতরাং লেন্স ঘুরতে থাকে তৃপ্তিহীন। আর এই ভাবেই এক কৃষ্ণনীলিম রাতে ধরি আলোর ফুটকি দিয়ে আঁকা এক অসম্পূর্ণ গ্রাফিকস! বিন্দুর বিন্যাসে ঢেউ। কিন্তু নিউ ইয়র্ক নয়। গোল গম্বুজ রয়েছে। কিন্তু একাধিক। ওয়াশিংটন নয়। কতকগুলোর চারধারে মিনার, কোনোটার মাথায় পরি। কোনোটার মাথায় নিশান। দৈর্ঘ্যে বড়ো প্রস্থে ছোটো এক মুঠো এক শহর। উড়ালের ডানায় গাড়ির আলোর রেখা, নীচে গাড়ির ভিড়। আশ্চর্য হয়ে দেখি সেই সিগন্যাল সবুজ হয়, সব রকমের গাড়ির মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় কে আগে যাবে। রেস নয়, অথচ ভয়ানক প্রতিযোগিতা। কী আশ্চর্য জাদু জানে এদের চালকরা। এ ওর পাশ কাটিয়ে এতটুকু জায়গা দিয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছে। তিন চাকার এক রকম গাড়ি তো মনে হল সার্কাসি কসরত দেখাতে দেখাতে ছুটছে। নতুন রকম বটে। ক্লিক।
পেভমেন্টে জমাট জনতা। কোনো উৎসব নাকি? মনে তো হচ্ছে না। তা ছাড়া মানুষ ছাপিয়ে জেগে থাকে গম্বুজ, মিনার মন্দির। আরও সব বিল্ডিং-এর উদ্ভাসিত বডি। হালকা কুয়াশায় মোড়া চুমকি বাহার। এই চুমকিস্তান আমার খাসা লাগে। আরও নেমে যাই সুতরাং। দেখি এক কালো গুহা থেকে ছত্রভঙ্গ মানুষ-পিঁপড়ের দল উঠে আসছে। যেন কোনো মহাভয় থেকে পালাচ্ছে। নির্ঘাৎ এখানে কোনো সন্ত্রাসবাদী হানা…ও হো, এটা পাতালরেলের সুড়ঙ্গ! লজ্জা পেয়ে দিক পরিবর্তন করি। রাস্তায় রাস্তায় সুদৃশ্য লম্বা বাড়ি, পাশে ভ্যাটে ছড়ানো পাকার জঞ্জাল। নাক নেই তবু গন্ধ বুঝি। তারপর গন্ধ চিনে চিনে পৌঁছে যাই জঞ্জালক্ষেত্রে। ঘুরে বেড়াচ্ছে অজস্র কীট। না, কীট তো নয়, ময়লা শিশু সব জঞ্জাল খুঁটে খুঁটে কী জানি কী থলিতে পুরছে। পাশ দিয়ে হুশ করে চলে গেল নীল-সাদা বাস, বাস ভরতি চকচকে ঝকঝকে বাচ্চার দল কলকলাচ্ছে। শিশু-কীটগুলি জঞ্জাল খুঁটে খায়। বাস ভরতি শিশুগুলি কলকলিয়ে যায়। বুঝে যাই এখানে আসলে দুটো শহর আছে। গরিব শিশুর শহর আর সচ্ছল শিশুর শহর। আর গরিবরা গরিব হলে কী হবে, তাদের বাচ্চা জন্মানোর কামাই নেই। জন্মানো বাচ্চাগুলোর দেখভাল কিন্তু কেউ করে না। বেশ স্পার্টান ব্যবস্থা। পারলে বাঁচো, নইলে ময়রা!
সর্বনাশ! জঞ্জালের পাহাড়টা যে ওদের ওপর ভেঙে পড়ল? ক্লিক।
৫.
আমার আশেপাশে এখন বেশ কয়েকটি প্রেতশিশু। নিরবয়ব ঠোঁটে হাসি ছড়িয়ে যাচ্ছে।
১ম জন—দমবন্ধের সময়ে এটুখানি কষ্ট হয়েছিল। তোর?
২য় জন-তুই কি ওই বদবুতে নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা বলছিস?
১ম জন—ধেৎ, বদবু আমাদের মা-বাপ, বদবু আমাদের ভাত দেয়, তুইও যেমন!
৩য় জন—না রে, ওই পাহাড়ের ভেতরে একশোটা হাজারটা আধা-খ্যাঁচড়া ব্যাঙাচি মেয়ে আছে। পেট থেকে বের করে টেনে ফেলে দেয় তো? দুর্গন্ধ বলে দুর্গন্ধ?
১ম জন—ওদের বেশ আর জন্মাতে হল না! যাক, আমরাও আর জন্মাচ্ছি না। ময়লা ঘেঁটে ঘেঁটে কাগজ, টিন, বোতলভাঙা বার করো রে, সর্দারকে দাও রে, পিটুনি খাও রে!
৪র্থ জন—এখন থেকে পেট ভরে ভাত খাব। আর মাংস। তারপরে সেই ঝলমলে দোকানটা থেকে সায়েবি জামাকাপড় কিনব, প্লেনে উড়ে চলে যাব অনেক দূরে, সায়েবদের দেশে যেখানে বড়ো বড়ো বাড়ির বড়ো বড়ো ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা চলে যায়!
২য় জন—(হেসে) খাবি যে তোর মুখ, জিভ, দাঁত কই? পরবি যে তোর ধড় কই? দেখছিস না কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। অথচ বুঝতে পারছি তুই খন্তা, আমি পচা, ওটা মকবুল। ভুতো, রাজু, আসগর আর হরিশ উড়ে আসছে দ্যাখ।
এ বার আমার দিকে ওদের চোখ পড়ল, তুমি সায়েব-ভূত না?
ঠিক সাহেব নয়, আমি আমার গায়ের রং আর আদি জন্মস্থানের কথা ভেবে বলি।
সায়েবের মতো, তাই না? ওই যে নীচে একটা জায়গা আছে সেখানে অনেক সায়েবের মতো আছে, দেখবে?
আমি আমার ক্যামেরা রেডি করি। নীচে একটা বিরাট ইনস্টিটিউট বাড়ি থেকে দলে দলে বেরিয়ে আসছে প্রচুর, হ্যাঁ, তরুণ-তরুণীই তো মনে হল। সবাই একই রকম টাইট টপ আর টাইট জিনস পরেছে।
একজন আর একজনকে বলল, হাই ক্রিস, ডিসিশন নিলি?
দ্বিতীয় জন–নারে প্যাটস, আই নিড আ ফিউ ডেজ মোর, মুঝে টাইম দে বাবা, দিজ ওল্ডিজ আর সো বোরিং।
প্রথম জন—হোয়াটস দা গ্রেট প্রবলেম? তুই ক্রিস থাকবি গোমজির সঙ্গে, এর মধ্যে ওল্ড পিপল আসছে কী করে!
দ্বিতীয় জন—আরে বাবা, গোমজ এবার স্টক মার্কেটে কত হেরেছে জানিস? ফিফটিন ল্যাকস, বেবি। ইউ নিড ক্যাপস, বুড়োবুড়ি চট করে দেবে নাকি?
তৃতীয় জন—তো যা, কত লিটার অয়েল লাগবে হিসেব কর। ডিসগাস্টিং! ধরিয়ে দে না পাত্তি পুরিয়া, দিতে পথ পাবে না।
অনেকটা সায়েবের মতো, নয়? খন্তা বলল।
আমি ভাবতে থাকি, ভাবতে থাকি। ঠিক সাহেবদের মতো কি?
আরও দেখাচ্ছি, এসো।
হুশ করে নেমে পড়ি একটা আধা-অন্ধকার ঘরে। আলো জ্বলছে, নিবছে, প্রায় বিবসন তরুণ-তরুণী নাচছে। এঁকেবেঁকে, যেন ঘরময় সাপ কিলবিল করছে। ক্যামেরা সক্রিয় হয়ে ওঠে।
দ্যাখো, ওরা কী খাচ্ছে!
নীলিম আকাশের নীচে নীল সুইমিং পুলের পাশে কাবাব উৎসব হচ্ছে। কাবাব মোগলাই ডিশ। আমার খুব প্রিয়। এলাহি আয়োজন।
রাজু বলল, আরও খানা আছে। পিলা, সফেদ, হর রং। কী খুশবু! আচ্ছা সায়েব ভূত, ওরা সব খেতে পারে না। তবু আমাদের দেয় না কেন বলো তো?
কালু বলল, আসল কথাটা বল না, খালি পিলা-লাল। ও সায়েব-ভূত, সায়েবদের দেশের রাস্তাটা বাতলে দেবে?
অনেক দেশ তো আছে। কী রকমটা চাও?
যেখানে মা-বাবা থাকে। বাবা মাকে ঠ্যাঙায় না। মা বাবাকে খিস্তি করে না। যেখানে সর্দার আমাকে চোর-ঠ্যাঙান ঠ্যাঙায় না। আমাদের নীল-সাদা বাসে করে ইস্কুলে নিয়ে যায়। আর যে দেশে সত্যিবাদী লিটার আছে।
লিটার?
ওই যে গো মানুষের মতো। ওরা মাঝে মাঝে দাঁড়ায় আর বলে ভাত দেব, জল দেব, লাইট দেব, পাকা ঘর দেব, কিন্তু দ্যায় না।
শিশুর দল কলবল কলবল করতে করতে মিলিয়ে যায়। সাহেবদের দেশের কথা ভুলে, জীবন্মুক্তির খুশিতে ভরপুর।
৬.
নিঃসঙ্গ আমার লেন্সে ভেসে ওঠে বাজার।
পাঁচ আঙুলে পাঁচ আংটি ধবধবে পোশক এক চেকনাইঅলা কালো ব্যক্তি টাইগার প্রন-এর ঝাঁকার সামনে দাঁড়িয়ে।
৬০০ টাকা দর কিন্তু।
আরে যা যাঃ, দর দেখাসনি, পাঁচ কেজি তুলে দে। আছে তো? তোপসে দে চার কেজি। একটি রোগা, ভুড়িঅলা নিরীহ চেহারার লোক এসে দাঁড়ায়। পরনে লুঙ্গি। বলে, মিরগেল আজ কত যাচ্ছে?
মাছঅলা তোপসে ওজন করছিল। জবাব দিল না। একরাশ কুচোমাছ একদিকে জড়ো করা ছিল। সেদিকে আঙুল দেখাল।
সসঙ্কোচে কিছু কুচোমাছ কিনে লোকটি চলে যায়। কুচোমাছের খদ্দের আর পাঁচ-ছ কেজির খদ্দেরকে যার যার সওদা সুষ্ঠু ক্যামেরায় ধরে রাখি।
মাছওলা বলল, পেনশন পজ্জন্ত পায়নি, আবার মিরগেলের দর…
চেকনাই বলল, কে ওটা?
যদুগোপাল ইস্কুলের মাস্টার।
তা পেনশন পেল না কেন?
হেডমাস্টার আর পেনশন আপিসের বাবুদের খাওয়ায়নি। আবার কী? ওরা কাগজপত্তর সব গোলমাল করে রেখে দিয়েছিল। পাঁচ বছর জুতোর সুকতলা খুইয়ে এখন বলচে পেনশন হবে না।
বলিস কী রে? তা তুই এত জানলি কী করে?
আমার ছেলে দুটো তো ওই ইস্কুলের। আবার ওই মাস্টারের পাইভেট ছাত্তরও ছিল। বড়োটাকে বি কম পজ্জন্ত পাস করাল। ঢুকিয়ে দিয়েছি সরকারি আপিসে। সিডিউল কাস্টোর খাতায়। ছোটোটা ঘষটে ঘষটে একটা পাস দিয়েছে। ধরেছে প্রোমোটারি করবে।
হাঃ হাঃ বলল কী হে? আমার ভাত মারবে?
সসম্ভমে মাছঅলা বলল, আপনি প্রোমোটার নাকি? এ দিকে তো দেখিনি!
এ বার দেখবে। রূপসায়র-এর বোর্ড দেখেছ তো? জলাটা বুজোতে মেলা। ঝামেলা গেল। পাকাঁপাকি থাকব তেরো তলায়। শিগগির আসছি।
চেকনাই আর মাছঅলার সব কথা আমি ভূত হয়েও ভালো বুঝতে পারিনি। নেহাত কৌতূহলে চেকনাইয়ের পেছু নিয়েছিলাম। তা বেরিয়েই চেকনাই একটা বিরাট মিছিলে আটকে গেল। একটু পরে দেখি লোকটা বিনবিন করে ঘামছে। ইশারায় মুটেটার কাছে জল চাইল। আমার অভিজ্ঞতা আছে, বুঝলাম লোকটার স্ট্রোক হচ্ছে। ধড়াস করে পড়ল। ছুটে এল কিছু লোক।
আধমনি কৈলাশ, আরও কজন লাগবে। এই একটা ট্যাক্সি দ্যাখ তো!
মুটেটা ততক্ষণে মোট সুষ্ঠু হাওয়া হয়ে গেছে।
ট্যাক্সিটা যদি বা পেল, মিছিল পার হতে পারল না। মিছিল যদি বা পেরোল, হাসপাতালে জায়গা হল না। হাসপাতালে যখন জায়গা হল তখন চেকনাই হুশ করে আমার পাশে এসে গেছে। একটার পর একটা এসে যেতে লাগল এর পর। বাচ্চা, ধাড়ি, বউমানুষ, আধবুড়ো… গাদা একেবারে। চেকনাই টক করে হাওয়া হয়ে গেল। বলে গেল টা টা বাই বাই!আবার যেন দেখা পাই। আলাপ করার ইচ্ছে ছিল সাহেব দাদা, দেদার ফাঁকা জমি পড়ে রয়েছে আপনাদের ওদিকে। কিন্তু মিছিল, এই মিছিলকে আমি বড্ড ভয় পাই। এই প্রেতলোকের ছবিটা আমি আগাগোড়া তুলি। এখানে কথা কম। কাজ বেশি। তা ছাড়া আমার আর অসুবিধেই বা কী!
তা যদি বলেন মিছিলে আমারও বড্ড ভয় ধরে গেছে। কোনো যুক্তি নেই, তবু ভয়। পালাতে থাকি।
৭.
ঘোর অন্ধকারে উন্মত্ত কাণ্ডের সামনে পড়ে যাই। একটা মেয়ে আর তাকে ঘিরে তাকে নিয়ে সাত-আটটা লোক, তাদের পরনে ইউনিফর্ম। মেয়েটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় আর গলা দাবিয়ে খুন করে দেয় ওরা। ক্লিক। আলোয় অন্ধকারে এ রকম আরও দৃশ্য দেখি, গাড়ি থামিয়ে টেনে বার করছে। মোটর বাইকের পেছন থেকে টেনে নামাচ্ছে। গলিতে গলিতে ওত পেতে আছে। লাথি মেরে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে নায়কোচিত দর্পের সঙ্গে গালাগাল সহযোগে ধর্ষণ ও খুনের কাজটা সম্পন্ন করছে। পাঁচটা লোক একটা লোককে জ্যান্ত অবস্থায় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কাটছে দেখলাম। বুলেট, ড্যাগার, স্টিক, ক্লিক ক্লিক ক্লিক।
কারা যেন প্রচণ্ড চ্যাঁচায়। এই সমস্ত কার্যকলাপের প্রতিবাদে নিশ্চয়ই। পটকা ফাটছে, রকেট উঠে যাচ্ছে আকাশে। বড়ো বড়ো করে লেখা ব্যানার, ওয়ার্ল্ড কাপ রানার্স জিন্দাবাদ। ওয়ার্ল্ড কাপ রানার্স জিন্দাবাদ। গাঁদা ফুলের পাপড়ি ছড়ানো পথে যাই, দুধারে জনতা উন্মত্তের মতো শিস দিচ্ছে, নাচছে। বাজনা বাজছে। জিতল কে? জিতল কে লাল হলুদ আবার কে? পিলপিল করে ছেলে-বুড়ো মেয়ে-পুরুষ ছুটছে—এ পথ দিয়ে মহাতারকারা যাবেন, বলিউড! বলিউড! সমস্ত উঠে যায় আমার ভূতগ্রস্ত ক্যামেরায়।
অসীম ধৈর্যে ভিড় পার হয়ে একটি মলিন চেহারার ছেলে বাড়ি ফেরে, আজ টিইশনের টাকাটা পেয়েছি মা, রাখো।
এত কম?
ভাইরাল ফিভারে কামাই হয়ে গেল, কেটেছে।
দুটি মেয়ে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভিড় বাসে উঠে গেল। বুটিকটা শুরু করবার টাকা জোগাড় করতে হবে বুঝলি? গোলি মারো কনট্র্যাক্টের চাকরিকে! এবং কোথা থেকে ধোঁয়ার মতো কবিতা ওঠে, গান ওঠে, ঝমঝম করে বাজনা বাজে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। সুন্দর সুন্দর প্রেক্ষাগৃহ। গান হচ্ছে, চটুল গান, গভীর গান। কবিতা হচ্ছে, গল্প হচ্ছে, নাটক হচ্ছে। প্রেমের কবিতা, প্রতিবাদের কবিতা, গ্রামের গপ্পো, শ্রমজীবীদের গপ্পো, ষড়যন্ত্রের নাটক, কিস্তুত নাটক। মেলা দেখি, অজস্র মেলা। আর তার পরেই একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটে। অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানো কুকুররা আমার প্রেত দেখতে পেয়ে যায়। ছুটে আসতে থাকে লক্ষ লক্ষ ঘেয়ো কুকুরের পাল, লম্ফঝম্প, কেউ কেউ, ঘোট ঘোউ। কাকেরা গলা মেলায়। শকুন ঘুরতে থাকে হাসপাতালের আস্তাকুঁড়ে। জিঘাংসায় মৃত, ধর্ষণে হত, দুর্ঘটনায় থ্যাঁতলানো শবরাশির ওপর। ক্রমে এই সমস্ত শব শকুন হত্যা হস্তশিল্প কুকুর ও কবিতা ছাপিয়ে উঠতে থাকে কাকের আওয়াজ, আজানের সুর, গ্রন্থপাঠ, ধর্মগুরুদের স্বস্তিক সদানন্দ মুখনিঃসৃত শিবনেত্র উপদেশামৃতের গমগমে আওয়াজ। মাথা তুলে উঠতে থাকে সুপার মার্কেট, বিশাল বিশাল বিলাসবহুল সব পেয়েছির দোকান। চরম হতাশায় বুঝতে পারি দেখনসুন্দর, মাখনহাসি, গহন-পচা মাটিল্ডার প্রেত এখন বিছিয়ে আছে গোলার্ধের এই অক্ষাংশ এই দ্রাঘিমায়।
আমার সারা জীবন-মরণের সবচেয়ে অ্যাবসার্ড ছবিটি আমি পাঠাতে থাকি তরঙ্গে তরঙ্গে যতক্ষণ না কোনো লেক রোডের কোনো অম্বুজ শ্রীনিবাসন তার অ্যান্টেনায় পুরোটা নির্ভুল ধরতে পারে। কেন না প্রেত হলেও শেষ বিচারে তো আমি শিল্পীই।
প্রকাশ না করে আমার উপায় কী!
ক্যালভেরি
বাজারে জোর গুজব এক নির্দোষ ব্যক্তিকে জেলে বন্দি করে রাখা হয়েছে। কী অপরাধ সন্দেহে তাকে ধরা হয়েছিল, কত বছর সে বন্দি আছে সে খবর কেউ জানে না। এমনকি কোন দেশের জেলে সে পচছে সেটাও ঠিক করে কেউ বলতে পারে না। শুধু বিশ্ব গুজব। গুজব কানাকানিতেই ছড়ায়। তা এখন তো কানাকানি শুধু রামে-শ্যামে, টমে-ডিকে হয় না, হয় ইংল্যান্ডে-আমেরিকায়, চিনে-ফ্রান্সে, ভারতে-রাশিয়ায়…। মিডিয়া যখন খবরটা কবজা করল তখন সেটা প্রায় বাসিই হয়ে গেছে। তবে বিশদ বৃত্তান্ত তো পাবলিক জানে না। এইখানেই কাগুঁজে কেরামতি। মজা হচ্ছে সব দেশের প্রধান কাগজই ভেবেছে এটা তার স্কুপ, শেষ রাত্তিরে কোনোক্রমে পাতা করেছে সব। সকালবেলা গরমাগরম বিকোবে। হায় কপাল! সকাল হতেই সব চক্ষু চড়কগাছ। তবে ওই যে ডিটেল? ডিটেলেই রকমারি মশলা।
হ্যাঁ, ডিটেলে নানান তফাত। বিশ্বের এক অজ্ঞাত জেলে এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি অজ্ঞাত অপরাধে অজ্ঞাতসংখ্যক বছর বন্দি আছে–এরকম তো খবর হয় না। এত অজ্ঞাত দিলে পাবলিক কান মলে দেবে। কাজেই যে যার প্রতিভার পুঁটলি খোলে। কোনো কাগজে বলে লোকটা আছে ইংল্যান্ডের জেলে। কেউ বলে কুখ্যাত সাইবেরিয়ায়, কেউ বলে খোদ আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্র, কেউ বলে করাচির যে জেলে জুলফিকার আলি ভুট্টোকে রাখা হয়েছিল সেখানেই, কেউ আবার বিস্ময় প্রকাশ করল—আমাদের এই ভারতের মহামানবের দেশে, একেবারে নাকের গোড়ায় তিহার জেলেই নাকি লোকটি শুষছে। ফলাও তর্কবিতর্ক, চিঠি কাউন্টার চিঠি চলতে লাগল। টেলিভিশনের সব চ্যানেলে থিকথিক করছে এক নিউজ, এক বিতর্ক। বি.বি.সি এ বাবদে মার্গারেট থ্যাচার, ব্লেয়ারের বিবৃতি নিল, সি. এন. এন নিল দুই বুশ, ক্লিন্টন, কলিন পাওয়েলের, এখানেও সব প্রাইভেট চ্যানেলে জোর যুক্তি-তক্কো-গপ্পো চলতে লাগল।
আপামর বাঙালির (রাজনৈতিক নেতারা বাদে) বিশ্বাস জায়গাটা সাইবেরিয়া এবং বন্দিটি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস। না-ই যদি হবে তো রেনকোজির ভস্মর ডি. এন. এ টেস্ট করালি না কেন? কেউ খুঁতখুঁত করে, সে বললে তো তাঁর বয়স একশোরও অনেক বেশি হয়ে যায়। লোকটি সে রকম বুড়ো-অথর্ব বলেও তো শোনা যাচ্ছে না! নেতাজি-গরবে গরবি বাঙালি জ্বলন্ত চোখে বলল, মহামানবদের ক্ষেত্রে এমনটাই হয়ে থাকে। আবেগের চোটে বাংলা ভুলে বাঙালি স্লোগান দিতে লাগল—আওয়ার নেতাজি অমর রহে, যুগ যুগ জিও সুভাষচন্দর, নেতাজি সুভাষ জিন্দাবাদ, অবিশ্বাসী মুর্দাবাদ।
আপামর আরববাসী, সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক-বাসী (বুশ-ব্লেয়ার বাদে) আনন্দে নৃত্য করতে লাগল, এই হল আসলি মসিহা, ওসামা বিন-লাদেনের স্পিরিচুয়াল গুরু। কেউ বললে, এটা সাদ্দাম, তেল-সংক্রান্ত চুক্তিটা ফাইনাল না করে আমেরিকা ছাড়বে না। ইজরায়েল বাদে মধ্যপ্রাচ্য কট্টর পান-ইসলামিক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে লাগল।
লোকটির নাম নাকি আন্তর্জাতিক অপরাধীর তালিকায় ছিল। দেশ থেকে দেশান্তরে জেল থেকে জেলান্তরে বদলি হয়েছে সে। কিন্তু কী যে তার সম্ভাব্য অপরাধের চরিত্র কেউ বলতে পারে না। যুদ্ধবন্দি? এই তো সেদিন হিন্দি-পাকি ভাই-ভাই-এর আবেগে প্রথম কাশীর যুদ্ধের কিছু ভারতীয় বন্দি ছাড়া পেয়ে বর্ডার পেরোল। যে যুবক ছিল, সে অবশ্য এখন অতি বৃদ্ধ, বেশির ভাগেরই পরিবারের সব মরে-হেজে গেছে। কেউ কেউ যুবক নাতির গলা জড়িয়ে কাঁদবার সৌভাগ্য সুযোগ পেয়েও কাঁদতে পারল না। কান্না শুকিয়ে গেছে। তবে? কনসেনট্রেশন। ক্যাম্পের কোনো ধাঙড়-মুফরাস না কি? না কি রাজনৈতিক অপরাধী–স্তালিনের সময়ে গুইগাঁই করেছিল বলে চালান হয়ে গেছে পোল্যান্ড থেকে পূর্ব জার্মানি, পূর্ব জার্মানি থেকে উত্তর কোরিয়ায়। স্পাই সন্দেহে আটক হয়েছিল, হচ্ছে বহু লোক, তাদের কেউও হতে পারে। কিছু প্রমাণ করা যায়নি। নথিপত্রও সব ব্যাখ্যাতীতভাবে হারিয়ে গেছে।
প্রশাসনের এই অদ্ভুত অবিচারের বিরুদ্ধে সব দেশের জনগণই খেপে উঠল। লোকটিকে মুক্তি দিতে হবে অবিলম্বে। ইংল্যান্ডে কালো পতাকা, ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউজ ঘেরাও, ফ্রান্সে ছাত্র-আন্দোলন, রাশিয়ায় প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা নিচ্ছিদ্র, চিনে তিয়ানানমমেন মেন স্কোয়্যার সিলড। ইরাকে ফটাফট গাড়িবোমা, কিছু মার্কিন ও ভূরি ভূরি ইরাকি ছিন্নভিন্ন। বেশি কথা কি, ভারতেই জেলে জেলে খুনজখমের আসামিরা অনশন ধর্মঘটে শামিল হল। আমাদের আটক রাখো, পরোয়া নেই, নির্দোষী ঠাকুরদাদার মুক্তি চাই। মানবাধিকার কমিশন, অ্যামনেস্টি ইনটারন্যাশনাল, ইউ. এন. ও সব নড়েচড়ে বসল। এরই মধ্যে ইজরায়েল ঘোষণা করল, সব বন্দি ছাড়তে পারি, প্যালেস্টিনীয় ছাড়ব না। সুইজারল্যান্ড বলল, আমরা বিদেশি টাকা ব্যাংকে রাখি, বন্দি রাখি না, স্ক্যান্ডিনেভিয়া বলল, আমরা নোবেল পুরস্কারে পর্যন্ত অবিচার করি না, আর বন্দির বেলায় করব? এই তালে ইন্ডিয়ার যত প্রাক্তন ও অধুনাতন মুখ্য ও প্রধানমন্ত্রীরা জেড প্লাস প্লাস নিরাপত্তা চাইতে লাগল। বিধায়ক, সাংসদরা নিরাপত্তার জন্য ঠেলাঠেলি শুরু করলেন। কে জানে খ্যাপা পাবলিক খ্যাপা মোষের মতো, কখন যে কার ভুঁড়ি ফাসিয়ে দেবে কেউ জানে না। দুগগা, দুগগা! ফলে কোনো থানাতেই আর পুলিশ রইল না। সাংসদ মশাইরা করবা চৌথ-এ স্ত্রীর পুজো পেতে যাচ্ছেন—ব্ল্যাক ক্যাট, অজ গাঁয়ের বিধায়ক মশাই মাঠ সারতে চলেছেন—ব্ল্যাক ক্যাট। চোর-জোচ্চোর বাটপাড়দের মহাফুর্তি। হাই-ফাই অপরাধীরা করুণা করে আই, পি, এসদের সঙ্গে আড্ডা দিতে লাগল। জলকর বসছে না বসছে না, হকার উঠবে কি থাকবে, গঙ্গা মহানন্দার পাড় ভাঙল কি ভাঙল না, জলে আর্সেনিক কমানো হবে কি হবে না, পারমাণবিক বর্জ্য কোথায় জমছে, ওজোন স্তরের ফুটো কতটা বাড়ল, মেরু বরফ কত ইঞ্চি গলল—এসব নিয়ে আর কারও মাথাব্যথা নেই।
অবশেষে চাঞ্চল্যকর খবর বেরোল—লোকটির নামের আদ্যক্ষর জানা গেছে। ভিপি বা ভি-ভি। হিন্দি বেল্ট বলল, এ নির্ঘাৎ আমাদের ভানপ্ৰতাপ ভুয়ালকা সমাজসেবক মানুষ, কী একটা স্ক্যাম নিয়ে চিরুনিতল্লাশির সময়ে উবে গিয়েছিলেন আহা! পূর্বাঞ্চল বলল, এ হল গিয়ে ভবদেব ভট্টাচার্য, আদি নিবাস ভাটপাড়া, শেষের দিকে ত্রিপুরা-আসামে বরো জঙ্গি আলফা জঙ্গিদের অহিংসাধর্মে দীক্ষা দিতেন, জঙ্গি ধরবার সময়ে পুলিশে একেও ভুল করে বদমায়েশি করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কেউ বলল, লোকটা আদৌ ভারতীয় নয়, কোন দেশি কে জানে, ওর নাম ভিভিয়ান পাস্ক্যাল ভারমন্ট। এরকম আরও কত নাম। কে কোন দেশি কেউ বলতে পারে না। রিফিউজি ছড়িয়ে পড়েছে ভুবন জুড়ে! কেউ আর সীমারেখা মানছে না। এ দেশের ভুখা মানুষ ওদেশে, এদেশের শুখা মানুষ এদেশে। যেখানে রুটিরুজি, যেখানে শান্তি, নিরাপত্তা সেখানেই ঠেলে উঠছে মানুষ। পারাপারি করতে গিয়ে মরুভূমিতে, তুষারভূমিতে প্রাণ দিচ্ছে কত মানুষ, যে জাহাজের সাগরে যাওয়ার কাল কবেই শেষ, তাইতে চড়ে মরিয়া মানুষ সলিলসমাধি পাচ্ছে।
তবে এ নিয়ে বেটিং শুরু হয়ে গেছে। বেটিং যে কত অদ্ভুত বিষয় নিয়ে হয় তা তো আমরা জানি না। বুশ জিতবে না কেরি জিতবে, কংগ্রেস সি, পি, এম-এর সঙ্গে আসন-সমঝোতা করবে, না পি. ডি. এফ-এর সঙ্গে, তেণ্ডুলকর আগে ঘুমোতে যান, না সৌরভ গাঙ্গুলি? কে বেশি কেরামতি দেখাতে পারে—আমাদের লাল্লু না ত্রৈলোক্যনাথের লুন্নু? ইলিশের দর এ সিজনে তিনশো থাকবে না চারশো উঠবে? কয়েক হাজার কোটির জুয়ো খেলা। যারা সাদ্দামের ওপর বেট করেছিল সাদ্দাম ধরা পড়তে তাদের কোটি কোটি টাকা লোকসান হল। কয়েকজন বেটসম্যান আত্মহত্যাই করে ফেলল।
পাবলিক এখন তেতে গেছে। তাকে রোখে কারও সাধ্য নেই। সুতরাং নানারকম স্লোগান শুরু হয়ে গেল। আমার নাম তোমার নাম—ভিভিয়ান ভিভিয়ান। ভানপরতাপ ভুয়ালকা জবাব দাও আমেরিকা। ভবদেব ভট্টাচার্য বাংলার আশ্চর্য। ভিভিয়ান ভবদেব ভানপরতাপদের মুক্তি সবাই চাইছে। শ্বেতপত্র দাবি করছে।
বিরাট বিরাট পদযাত্রা, মিছিল দেখে যে যেখানে আছে শামিল হয়ে পড়ল। কাগজকুড়োনি ছেলে, দেহবেচা মেয়ে, জমাদার হাবিলদার সব। কেননা এত বড়ো মিছিল কেউ দেখেনি। ধরুন শুটে আর পুঁটে কাগজ কুড়োচ্ছিল। শুটের মুখে আঙুল। পুঁটের পিঠে বোঝ। হাঁ করে দেখছে, হঠাৎ দেখে আগে লোক পাছে লোক ভিভিয়ান, ভিভিয়ান। তো তারাও বলতে লাগল ভিভিয়ান-ভিভিয়ান। পারুল আর বকুল পাড়া থেকে একটু দূরে খদ্দের খুঁজতে এসেছিল। দেখতে দেখতে একটা লোককে বেশ মালদার মনে হল, পারুল চোখ মারল, বকুল মডেল পোজ দিল। লোকটা দেখতেই পেল না, হাত আকাশে ছুঁড়তে ছুঁড়তে আশ্চর্য আশ্চর্য বলতে বলতে এগিয়ে যেতে থাকল। আরও কাছে এগোতে ভিড়ই বকুল-পারুলকে চুম্বক টানে টেনে নিল। খদ্দের-উদ্দের ভুলে তারাও চ্যাঁচাতে লাগল—ভবদেব ভশচায্যি আশ্চয্যি আশ্চয্যি। মুক্তি দাও মুক্তি চাই, নইলে গদি ছাড়াবই। পৃথিবীর সরকার নিপাত যাক। শেম শেম শেম শেম। জমাদার রামলখন, ছাতুঅলা যুধিষ্ঠির, বুটপালিশ লখিয়া, বাসের খালাসি নন্দলাল সব প্রতিধবনি তুলল—ছেম ছেম।
সব দেশের বিরোধীপক্ষের মহা ফুর্তি। এই সুযোগে শাসকদলকে নাকানিচোকানি খাওয়ানো যাচ্ছে। ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকান, লেবার আর কনজারভেটিভ। কংগ্রেস-বিজেপি-সি.পি.এম যে যেভাবে পারে ব্যাপারটার ফায়দা তুলতে লাগল।
আমাদের এ দেশে যেমন—সরকার পক্ষ বলল, ঘটনাটা ঘটে কংগ্রেস আমলে, অবভিয়াসলি। কংগ্রেস বেকায়দায় পড়ে বলল, ধুত, ও তো ব্রিটিশ আমলের কথা।
এরকম কাজিয়া সব দেশেই পুরোদমে চলতে লাগল। শেষ পর্যন্ত শীর্ষ সম্মেলন ডেকে সবাই ঠিক করল, সত্তর কি তার চেয়ে বেশি বয়সের বন্দি যাদের প্রমাণাভাবে জেলে আটকে রেখে ভুলে যাওয়া হয়েছে, সে রকম সবাইকে খুঁজে পেতে ছেড়ে দেওয়া হবে। রাজবন্দি যুদ্ধবন্দি তো বটেই।
এতে কিন্তু অনেক কয়েদির এবং তাদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কান্নাকাটি পড়ে গেল। এতকাল হয়ে গেছে, জেলে অভ্যস্ত হয়ে গেছে বেচারিরা, নিশ্চিন্ত জীবন, নিশ্চিন্ত ভাত-কাপড়। সে যেমনই হোক না কেন। আত্মীয়স্বজনদের প্রজন্ম পেরিয়ে গেছে, এতদিনের জেল-খাটা দাদুকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে, এ কী সমস্যা? সংসারটা বেশ গুছিয়ে ভোলা গিয়েছিল! যাই হোক, বিশ্ব পাবলিক যেমন একবগ্না, বিশ্ব সরকারও তেমন। দাও ছেড়ে, সরকারের বন্দি পোষার খরচ কমে যাবে। তাই বা কম কী! সুতরাং বহু দিনের অপরাধ-প্রমাণ-না-হওয়া বন্দিরা ছাড়া পেতে লাগল। অবশ্যই সত্তরোর্ধ্ব হতে হবে।
যে দেশে জনতার যাকে পছন্দ হল ফুল-মালা-চন্দন দিয়ে বরণ করে শোভাযাত্রা শুরু করে দিল। বাকি জীবন এদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করবে সরকারগুলো এমন কথা দিয়েছিল। তারা এখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। মূল লোক তো একটি। ঠিক আছে তাকে ঠিকঠাক স্পষ্ট করতে না পেরে না-হয় আরও কয়েকজনকে ছাড়া গেল। কিন্তু এ যে বেরোচ্ছে শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে? এত লোক বিচার ছাড়া এতদিন বন্দি ছিল? এ তো মহা ফাঁপরে পড়া গেল! তা কী করা যাবে। কথা দিলেই যে কথা রাখতে হবে তার তো কোনও মানে নেই। ইন্ডিয়া ঠোঁট উলটে বলল—ছাড়ন তো ও রকম কত কথা নিত্য দিতে হচ্ছে, বন্যা, খরা, বাঁধ…কত রকমে লোক উৎখাত করতে হচ্ছে তা জানেন? সাহায্য-ক্ষতিপূরণ দিতে গেলে তো ফেল করে যাব মশাই। জনগণ যা করছে করতে দিন। লেটস ওয়াচ অ্যান্ড ওয়েট।
এখন জনগণ যাদের পছন্দ করল তাদের কথা বলি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারাল জেল থেকে পাক্কা ত্রিশ বছর পরে মুক্তি পেল অ্যাডাম। সেমিটিক তো বটেই। একেবারে যিশুখ্রিস্টের মতো চেহারা। অ্যাডাম একটি হত্যা-শিল্পী। শুধু খুনের জন্যেই সে একশো একটা খুন করেছে। এত নিপুণভাবে যে, খুন-হতে-থাকা ব্যক্তিটিও বুঝতে পারেনি খুনি কে! চার-পাঁচটি খুন একই পদ্ধতিতে করে ফেলায় অ্যাডাম একটু বেকায়দায় পড়ে। সন্দেহবশত তাকে ধরা হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু কিছুই প্রমাণ করা যায়নি। এবং তা সত্ত্বেও উকিলের পর উকিল, বিচারকের পর বিচারকের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল সে-ই খুনি এবং প্রমাণ পাওয়া যাবেই। এইভাবে তার ফাইল কোথায় ফাইলের পাহাড়ের তলায় চাপা পড়ে গেল। কত বিচারক অবসর নিলেন, কত উকিল-অ্যাডভোকেট সলিসিটর মারা গেলেন। অ্যাডামের কথা সকলে ভুলে গেল। জেলের ব্যবস্থাট্যবস্থা ভালোই, নালিশ করার কিছু নেই। সুতরাং অ্যাডাম ভালোই ছিল। একমাত্র অসুবিধে, সে খুন করতে পারছিল না। জেলের মধ্যে খুন চার-পাঁচটা করাই যায়। কিন্তু ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সুতরাং অনেক কষ্টে আত্মসংবরণ করে সে প্রভু, ইহারা জানে না ইহারা কী করিতেছে—জাতীয় একটা মহাপুরুষোচিত হাবভাব নিয়ে ছিল। তার মুক্তিতে তার কয়েদি-বন্ধুরা পর্যন্ত খুশি হয়ে তাকে ফেয়ারওয়েল দেয়। কেননা সবাইকারই ধারণা ছিল তার মতো নিষ্পাপ উচ্চমার্গের ধ্যানী পুরুষ পৃথিবীতে আর দুটি নেই।
শোভাযাত্রীরা জিজ্ঞেস করতে লাগল, হে অ্যাডাম, তোমাকে কোথায় পৌঁছে দেব?
অ্যাডাম উদাস স্বরে বলল, তিরিশ বছর পরে আর আমি কোথায় যাব? থাকার মধ্যে এক বুড়ো বাপ ছিলেন, কবে মরে হেজে গেছেন। যেখানে হোক আমাকে ছেড়ে দাও, সরকার তো একটা ভাতা দেবেই, যেমন করে হোক চালিয়ে নেব। অনেক ধন্যবাদ, আমার সন্তানসম দেশবাসীগণ!
এখন এখানকার হাওয়া একটু গরম, তুমি বরং তোমার দাড়িগোঁফটা কামিয়ে ফেল–একজন উপদেশ দিল। সত্যিই ওসামার সঙ্গে অ্যাডামের মিল খুব।
তবে এসবে অ্যাডামের মন নেই। তার প্রবল খুন-পিপাসা পাচ্ছে। লেটেস্ট ফ্যাশন অনুযায়ী ন্যাড়ামুণ্ডি হয়ে, দাঁড়িগোঁফ কামিয়ে তার চেহারাটা একেবারে অন্যরকম হয়ে গেল। বয়সটাও যেন কমে গেল এক ধাক্কায়।
শিট! বাবা-মা না থাক তার বউ ছেলেপিলে অবশ্যই ছিল। সেসব ছেলেরা এখন কে পঁয়ত্রিশ কে চল্লিশ, বউও তো বুড়ো হল। বাড়ি তার পশ্চিম-উপকূলে অরভিল নামে একটা ছোট্ট গ্রামে। বউ ছেলেপুলেদের জন্যে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। বুড়ো বয়সে তাদের আদরও সে আ যাবে কোথায়? বিশেষ করে স্যারা, তার বউ, একেবারের জন্যেও বিশ্বাস করেনি সে খুনি। যতদিন পেরেছে উকিলের কড়ি গুনেছে। কান্নাকাটিও করেছে কম নয়। কিন্তু অরভিলে সে স্যারা আর তার দুই ছেলের কোনো খোঁজই পেল না। মার্কিন দেশে লোকে এই বাড়ি কিনছে তো এই আবার বেচে দিচ্ছে। এক জায়গায় খুঁটি গেড়ে বসবার ধাতই নেই কারও। অত বড়ো বড়ো ছেলে, বিয়ে-থা করে সংসারী হয়েছে নিশ্চয়। কোথায় তাদের খুঁজবে? অ্যাডাম ভ্রাম্যমাণ খুনি হয়ে গেল।
বরকত ছিল ধুরন্ধর জালিয়াত। দেখতে নেহাতই দেহাতি ভালোমানুষের মতো। লোকটা এমন জালিয়াতির কারবার ফেঁদেছিল যে পৃথিবীর যেখানে যত শেয়ারবাজার সর্বত্র ধস নেমেছিল। নামটা সে কখনও এক রাখত না। গায়ের রংটা মাজা মাজা, বেঁটে, মাথায় টাক। ইতালীয়, স্প্যানিশ, ভারতীয় যা ইচ্ছে হতে পারে। এই চেহারা এবং ক্ষুরধার বুদ্ধি হাতিয়ার করে সে কাজ-কারবারে নেমে পড়েছিল। কখনও আন্তোনিও, কখনও রামদাস, কখনও বদরউদ্দিন নামে সে চলাফেরা করত। গোটা দশেক ভাষা জানত, তার মধ্যে ছটা ভাষায় মাতৃভাষার মতো দড় ছিল। একটি খাঁটি ভাষাবিদের যা যা গুণ থাকা দরকার সবই তার ছিল। উপরন্তু সই জাল করায় তার জুড়ি ছিল না। পঁচিশ বছর জেলের ভাত খাচ্ছে সে ফ্লোরেন্সের এক জেলখানায় মানুচ্চি নামে। এখনও তার আসল নাম ফাঁসই হয়নি। আসলে সে এবার ফেঁসে গিয়েছিল নেহাতই ছোটোখাটো একটা পাসপোর্টের সই জাল করার ব্যাপারে। কেন যে ছাড়া পায়নি সেটাই এক বিস্ময়। খুব সম্ভব শেষ যাদের জন্যে জালিয়াতি করেছিল, তারা নিজেরাই জালিয়াতির দায়ে ধরা পড়বার ভয়ে মুখ খোলেনি। বরকতও তার এক অঙ্গে অত রূপ ফাঁস হয়ে যাবার ভয়ে ট্যাঁ ফোঁ করেনি। জেলখানাটা সে ভালোই উপভোগ করছিল। নানান কিসিমের অপরাধী আসে জেলে। কত জনের কাছ থেকে কত কী শেখা যায়। শিক্ষক হিসেবে দু-চারজন অন্তরঙ্গ ছাত্রও যে জুটে যায় না তা নয়। মানুচ্চিবেশী বরকত শোভাযাত্রীদের বলল, পঁচাত্তর বছর পার হয়ে গেলে আর কি আত্মীয়পরিজন থাকে ক—তার চোখ ছলছল করছে। সে বলল প্যরিসের একটা টিকিট কেটে তাকে উঠিয়ে দিতে। তারপর কপালে যা আছে, ছেলে সেখানে থাকলেও থাকতে পারে। আসলে কিন্তু বরকতের বাড়ি সুদূর পাকিস্তানের সিন্ধুপ্রদেশে। জালিয়াতির নেশা তার এমন সাংঘাতিক ছিল যে অসুবিধে হবে বলে বিয়ে-থাও করেনি। বরকতের সুইস ও ইতালীয় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বিদ্যমান। প্যারিসের রাস্তায় বরকত টুক করে হারিয়ে গেল।
তৃতীয় যাকে জনতার ভারি পছন্দ হল সে হল এক ধর্ষণিক। গ্রামে-গঞ্জে শহরে-নগরে এ যে কত ধর্ষণ করেছে, কত যে এর অবৈধ সন্তান, কত মেয়ে যে এর জন্যে আত্মহত্যা করেছে, কতজনকে লাইনে নাম লেখাতে হয়েছে, কতজনকে যে এ খুন করে ফেলেছে তার ইয়ত্তা নেই। পাঁচ থেটে পঁয়ষট্টি এর রেঞ্জ। একা পেলেই ধর্ষণ করে ফেলো—এই নীতিতে বড়োই বিশ্বাসী লোকটি। মুখোশ পরা থাকত বলে লোকটিকে চেনা যেত না। কয়েকটি মেয়ে গলা শুনে আন্দাজে একে শনাক্ত করে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কেস প্রমাণ করা যায়নি। তার ওপর কেস চলাকালীন আগুন লেগে নথিপত্র পুড়ে যাওয়ায়, জজ উকিল সাক্ষী সব মারাত্মক আহত হওয়ায় কেসটি স্থগিত হয়ে যায়। তারপরে যা হয়। না হল কিছু প্রমাণ, না কিছু অপ্রমাণ। না পেল বেনিফিট অব ডাউটে মুক্তি না হল কোনো বিশেষ শাস্তি। বছরের পর বছর নিঃশব্দে জেলের ঘানি টানছে। মিষ্টি ব্যবহার, উদাস হাবভাব, এসব দেখে কবেই তাকে সশ্রম থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে। তবু কেন যে খালাস পায়নি। সেসব অজ্ঞাত। এর নাম ট্যাঁপা অথবা বামাকান্ত। চেহারা রাশভারী প্রফেসরের মতো, ট্যাঁপাবাবুই বলা উচিত। কিংবা ট্যাঁপা স্যার। জেলে থাকলেও তাঁর অপরাধের পরিচিতি অনেকদিন হারিয়ে গেছে। কেউ জিজ্ঞেস করলে সে একটা আপনভোলা ঐশ্বরিক হাসি দিত। অত ধর্ষণ করায় ট্যাঁপা সারের ধবজভঙ্গ হয়, তাঁর অপরাধ অপ্রমাণের এ-ও এক কারণ। তবু সেই প্রশাসনিক বিচারবিভাগীয় এবং আধিভৌতিক গাফিলতিতে তিনি জেলে থেকে যান।
ট্যাঁপা ছিলেন ছোটোখাটো ব্যাবসাদার। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর পার্টনার স্বভাবতই ব্যাবসাটি হাত করে নেয়। তাঁর স্ত্রী লজ্জায় ঘেন্নায় তাঁকে ছেড়ে চলে যান। দুটি সন্তান নিয়ে তিনি এখন তাঁর দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে ঘরকন্না করছেন। আলিপুর সেন্ট্রাল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি প্রথমে তাঁর পুরোনো বাড়ি রাজারহাট বিষ্ণুপুরে এলেন। চিনতেই পারেন না। যেখানে তাঁর বাড়ি ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে এক ঝাঁ-চকচকে পেল্লাই কমপ্লেক্স। অর্থাৎ বাড়িটা, তার জমিটা সব কেউ কেঁপে নিয়েছে। তা নিক। সংবর্ধনার গাঁদার মালা খুলে ট্যাঁপাবাবু একটি বটতলায় একটু জিরোলেন। অবশিষ্ট শোভাযাত্রীদের বললেন, আমি ভাই সংসার ত্যাগ করেই গিয়েছিলাম। তিনি কপালে ভোগান্তি লিখেছিলেন। সবই তাঁর ইচ্ছা। সংসার অনিত্য। আমি সুযোগ পেলেই নগরাজ হিমালয়ে চলে যাব। আপনাদের অনেক ধন্যবাদ এত কষ্ট করলেন। তবে জেলে থাকলেই বা কী হিমালয়ে থাকলেই বা কী! পার্থক্য নাই।
শোভাযাত্রীরা কাঁদো কাঁদো মুখে চলে যেতে ট্যাঁপাবাবু গাঁদার মালাগুলো আবার পরে নিলেন। বাজারে গিয়ে কয়েকটি জবার মালাও কিনলেন। কালীমন্দিরে গিয়ে রক্তচন্দনের ফোঁটা পরলেন। তারপর গম্ভীর গলায় ওম কালীত্তারা ব্রহ্মময়ী হাঁকতে হাঁকতে গ্রামে গ্রামান্তরে, গঞ্জ থেকে মফসসল ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। শিষ্যসামন্ত মন্দ হল না, রোজগারপাতি চমৎকার। খালি পুরোনো অভ্যাসটি মাঝে মাঝে চাগাড় দিয়ে ওঠে। অতদিন জেলখানায় থেকে তাঁর ধবজভঙ্গ অনেকদিন সেরে গেছে। কিন্তু চট করে ও পথে পা বাড়ান না। বয়সটাও হল বাহাত্তর। ভালো সুযোগের সন্ধানে থাকেন। বছর দশ থেকে পনেরো-ষোলোর দুটি চারটি হলেই চলবে।
উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে আরও ছাড়া পেলেন উলোলো চুল এক বৈজ্ঞানিক। ইনি সাংঘাতিক সব বিষ তৈরি করছিলেন বলে জনরব। পৃথিবীর তামাম সন্ত্রাসবাদীরা তাঁর খদ্দের। কিন্তু আবারও, তাঁর মামলার নিষ্পত্তি হয়নি, কেউ জানে না কেন তিনি আলাস্কার জেলে পচছেন। শুধুমাত্র বিষবিজ্ঞানী পরিচয়টুকু থাকার জন্যই অনেক দেশের সরকারই তাঁকে সাগ্রহে পুষতে চাইল। তিনি অটাওয়ায় এসে একটি ঠান্ডা পানীয়ের কারখানায় যোগ দিলেন। কাঁচা-পাকা চুল আর গোঁফের মধ্যে দিয়ে চোখ দুটো ঝিকঝিক করছে, যেন এক্ষুনি বলে উঠবেন, কী? কেমন জব্দ?
বলা বাহুল্য, ছাড়া পেলেন অনেক কমিউনিস্ট, অনেক স্তালিনবিরোধী, নানা ধরনের রাজনৈতিক বন্দি। যুদ্ধবন্দি এবং অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিও, যাঁদের কোনো না কোনোভাবে ফাঁসানো হয়েছিল। এঁদের কেউ পছন্দ করল না, তেমন ক্যারিশমা ছিল না নিশ্চয়, জেল থেকে বেরিয়ে এঁরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লেন। সরকারকে কাউকেই ভাতা দিতে হল না। সবাই ভাবলেন—বাপ রে এই বেলা পালিয়ে যাই, আবার কী ছুতোয় আটক করবে কে জানে! অনেকে আপনজন খুঁজে পেলেন, অনেকে পেলেন না, ভিক্ষাবৃত্তি নিলেন কতজন। কতজন মারাই গেলেন। আপদ চুকে গেল। শাঁখ, বিউগল, মালা, বোকে কিছু না, এঁরা মহাপৃথিবীর জনস্রোতে হারিয়ে গেলেন।
এঁদের মতোই বেরিয়ে এসেছিল একটি ছোট্টখাট্টো শুকনো-শাকনা গোছের মানুষ। বয়স কত? গাছপাথর নেই। নাম কী?–মনে নাই। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ইতিউতি চায়। এত মানুষ, এত গাড়ি, এত অট্টালিকা যেন সে কখনও দেখেনি। দু-তিনবার গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। কোথায় ছিল? কেন ছিল? এখন কোথায় এল? কেন এল? প্রশ্নগুলো মানুষটার মনে উঠছে আর লয় পাচ্ছে। এত হাবাগোবাকে কোন দেশ নেবে? গায়ের রং হলদে ঘেঁষা। মাথায় কাফ্রিদের মতো কোঁকড়া চুল পেকে করকর করছে। শরীরের গড়নটা যেন ভারতীয়, নাকটা মাঝখান থেকে খাঁটি ইউরোপীয়দের মতো চড়া।
চারদিকের শহর-ছবি গ্রাম-ছবি মানুষ-ছবি যেন একটা গোলকধাঁধার মতো। তার যেটুকু স্মৃতি আছে, মনে হয় কিছুই যেন তেমন নেই। থাকবেই বা কী করে? গাছপাথর নেই এমনই বয়স। কত যে ঠিক তা সে নিজেও জানে না। কেমন বেভভুল। খালি মনে হয়, হাওয়াটি তো তেমন করে বইছে না। চাঁদের রংটি তো তেমন চাঁপা-চাঁপা নেই। আকাশ এমন ফ্যাকফেকে কেন? কীসের এত দুর্গন্ধ!
খুনখুন করে হাঁটতে থাকে বুড়ো। মাঠ বায়। নৌকো বায়। জাহাজ বায়। বিশ্ব আন্দোলনে জেল থেকে ছাড়া পেরেছে শুনে কেউ তাকে না করে না। মাথা গুঁজে থাকে, চাট্টি খায়। আর সমুদ্দুরের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে। ঢেউ উঠছে, ঢেউ পড়ছে। কালো জলে ফেনার সারি। আকাশ কোথায় সাগরে মিশছে বোঝা যায় না। কেমন যেন চেনা-চেনা। আবার অচেনা-অচেনা। আন্তর্জতিক অপরাধী হিসেবে তাকে ধরা হয়েছিল। ঘুরেছে জেল থেকে জেলান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে। কত কী-ই যে তার চেনা, আধো-চেনা!
কী করেছিলে গো বুড়ো?
সে মাথা নাড়ে—কিছু করি নাই।
ধরেছিল কেন?
মনে নাই।–ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে।
আহা! বিনিদোষে হাজতবাস করতে করতে ম্যাদা মেরে গেছে গো!
এইভাবে ডোভার থেকে এডেন হয়ে মুম্বই বন্দরে ভিড়ল জাহাজ।
এবার নেমে যাও বুড়ো। মাল খালাস করব, তারপর ফিরে যাব। ভাগো এবার।
একজন বললে, একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি এ দেশের সরকারি আপিসে দেখিয়ো। খেতে পরতে থাকতে দেবে। এখন তো বাপু তোমাদের সাত খুন মাফ।
এক খুনই বা কী, আর সাত খুনই বা কী! লোকটা কিছুই বোঝে না।
জেলের মধ্যে বন্ধ থাকতে খুব কষ্ট। কিন্তু একটা নিয়মে থাকা তো! তাই লোকটা বেশ শক্তপোক্ত। সরকার কী খুব আবছাভাবে মনে পড়ছে তার। কিন্তু একে ওকে জিজ্ঞেস করে যদিবা সরকারি অফিসতক পৌঁছোল, দর্শনি দিতে না পারায় দরজা থেকেই হাঁকিয়ে দিল দারোয়ান।
যাই হোক, বুড়ো অথচ শক্তপোক্ত, উপরন্তু কেমন নিষ্পাপ নরম চেহারার কারণে সে একটা কাজ পেল। বাড়ি ঘর সামলাবে, রান্না রসুই করবে, বাচ্চা দেখবে। সে আর এমন কী! জেলে থাকতে এর চেয়েও শক্ত কাজ সে হেলায় করেছে।
এদের নাম দারুওয়ালা। পতি পত্নী দু-জনেরই দুটো ব্যাবসা। বেরোবার বা ফেরবার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। একটি লোক তাই বড়ই দরকার। দারুওয়ালারা প্রথমেই তার ছবি তুললেন। নাম কী?–অনেক চেষ্টা করে তার মনে হল ভিভি-ভিখু। বয়স? দেখেশুনে ওঁরাই বললেন, আনুমানিক সত্তর। নিরপরাধ বলে পৃথিবীময় যাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাদেরই একজন।
নিকটবর্তী থানায় ছবি সমেত পরিচয়পত্রটি জমা দিয়ে দারুওয়ালা দম্পতি ভিখুকে বাড়িতে তুললেন। সে যে খামোখা আটক ছিল তাতে তাঁদের কোনো সন্দেহই নেই।
ভোর থাকতে থাকতে ছোট্ট আড়াই কামরার ফ্ল্যাটটি ঝাড়াপোঁছা করে সে। জল ভরে, বাসন মাজে, প্রাতরাশ তৈরি করে, বছর সাতের মেয়ে আর বছর পাঁচের ছেলেটিকে খেতে দেয়, টিফিন তৈরি করে, রাস্তার মোড়ে তাদের স্কুলবাসে তুলে দিয়ে আসে। বাড়ির তালা খুলে এবার ভেতরে ঢোকে সে। খুব একটা ভালো দৃশ্য নেই। তবু ছোট্ট বারান্দাটাতে কীসের আশায় দাঁড়িয়ে থাকে সে। সময় হলে ছেলেমেয়ে দুটিকে বাস রাস্তা থেকে বাড়ি নিয়ে আসে। খেতে দেয়। তারা ক্লাবে খেলতে যায়। সে বারান্দাতে বসে থাকে। দুর্বল মাথা, প্রাণপণে মনে করতে চেষ্টা করে কী তার নাম, কবে কোথায় প্রথম জেলে নিয়ে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধী…।
রাত আটটায় হয়তো মি. দারুওয়ালা ফিরলেন। মিসেসের ফিরতে আরও দু ঘন্টা। দু-জনে খেতে বসলেন। তাঁর যা যা খান সব শিখিয়ে দিয়েছেন ভিখুকে। সে দিব্যি মাংস বানায়, মোটা মোটা তন্দুরি রুটি, লাচ্ছা পরোটা, আচার কিনে আনে, সবজি বানায়, ডালভাজি কালিড়াল সব শিখে গেছে সে। তার মনিব খুশি। মুম্বইয়ের তুলনায় অনেক কম মাইনেতে পেয়েছেন তাঁরা লোকটিকে। প্রতিবেশীরা ঈর্ষা করে। বাচ্চা দুটিও ভারি খুশি। দু-জনে দাবা খেলে, কমপিউটার গেম খেলে। শান্ত হাত পা কোলে করে ভিখু বসে থাকে। ভেতরে কেমন একটা শান্তি। বয়স হয়ে গেছে, বেশি তো সময় আর নেই, পৃথিবীর মেয়াদ ফুরিয়ে এল। এইরকম একটা খাটা-খোটা নিশ্চিন্ত জীবন ইতিমধ্যে বেঁচে নিতে খারাপ লাগে না তার। রবিবার দিন ওঁরা এক এক সময়ে বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে যান। কোনো কোনো দিন নিজেরা বাড়িতে থেকে তাকেই একটু ঘুরতে পাঠান। এইভাবেই তিন-চার বছর কেটে যায়। দারুওয়ালারা ভাবেন আর কী চাই! ভিখু ভাবে এই তো বেশ।
এক রবিবার বেশ দূরে একটু ঘুরে অনেকক্ষণ ধরে সমুদ্র দেখে হাওয়া-টাওয়া খেয়ে এসে সে অবাক হয়ে দেখে বাড়ির দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকে চক্ষুস্থির। ঘরে রক্তগঙ্গা। চারটি মৃতদেহ পড়ে আছে, মহিলা এবং তাঁর বাচ্চা মেয়েটির গায়ে কাপড় নেই। আলমারিতে চাবি ঝুলছে। একটা গোঙানির মতো আওয়াজ করে জ্ঞান হারিয়ে সেইখানেই পড়ে যায় ভিখু এবং এইভাবেই পুলিশ তাকে আবিষ্কার করে।
অনুসন্ধানে বার হয় সেই দিনই দারুওয়ালারা আঠারো লাখ টাকা বাড়িতে এনেছিলেন, কিছুর একটা পেমেন্ট। যদিও খুনের অস্ত্র বা টাকাটা পাওয়া গেল না। তবু তার ইতিহাস এবং পরিস্থিতি তাকেই খুনি বলে সাব্যস্ত করে। আশপাশে সবাই বলতে লাগল, অত কম টাকায় অত ওস্তাদ নোকর। তখনই আমাদের সন্দেহ হয়েছিল! আসলে কিন্তু মোটেই সন্দেহ হয়নি।
সরকার বনাম ভিখু মামলায় ভিখুর তরফের সরকার-প্রদত্ত দাতব্য উকিল প্রায় সারাক্ষণই মাথা ঝুলিয়ে বসে রইল। সরকারি প্লিডার বললেন, বিশ্ব হুজুগে কোনো কোনো ঘৃণ্য-অপরাধী ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল। এ ব্যক্তিটি তাদেরই একজন। এবার অপরাধের শান্তি দিয়েই ছাড়ব। ধর্ষণ, খুন এবং জালিয়াতিও। কেননা ভিখু বলে পরিচিত সেই লোকটি আসল নাম লন্ডন জেলের আধপচা নথি পত্রের থেকে পাওয়া গেছে। ভগোয়ান পরসাদ। যে ভগোয়ান সে ভিখু সাজে কেন?
সুতরাং একদিন নির্বিঘ্নে ভিখুর ফাঁসি হয়ে গেল। জল্লাদ এই সুযোগে নিজের মজুরি বাড়িয়ে নিল। পুলিশ অফিসারের প্রমোশন হল, দপ্তরের সবাইকে একদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরকারি খরচে ভূরিভোজ খাইয়ে দিলেন। ভিখুর লাশটাতে জল্লাদ সুদ্ধ থুথু ফেলল—বেইমান!!
স্মৃতিভ্রষ্ট বেকুব ভাগোয়ান পরসাদের ফাঁসি হয়ে গেল। কিন্তু প্যান্ডোরার বাক্স থেকে ছাড়া পাওয়া শয়তান-পরসাদগুলি চতুর্থণ প্রতাপে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াতে লাগল।
গন্ধ
দূরে সরে বসলে কেন?
এমনি।
এমনি? আমায় ভয় করো? আমার স্পর্শ বাঁচাচ্ছ? অচ্ছুত আমি?
না তো।
তাহলে কি আমি উঠে যাব?
প্লিজ না।
তাহলে? কাছে এসে বোসো। দেখছ না কী সুন্দর সবুজ জল টলটল করছে, জলের ভেতর পদ্মপাতা, পদ্মপাতার মধ্যে পদ্মের নাল, তার ওপর পদ্ম ফুটেছে, লাল পদ্ম, যাকে বলে কোকনদ!
তার ভেতরে মধু, মধুতে ভোমরা, ভোমরায়…
ঠাট্টা করছ? ঠাট্টা করে আসল কথাটা এড়িয়ে যেতে চাইছ।
আসল কথা আবার কী?
ওই—এমন দিনে কাছে আসা যায়।
আচ্ছা, সঞ্জু তুমি কি সত্যিই জানো না কেন তোমার কাছে বসছি না?
না সত্যিই না, কেন? জিজ্ঞেস করছি তো?
কস্তুরীমৃগ তো শুনেছি আপন গন্ধে পাগল হয়।
হঠাৎ? কস্তুরীমৃগ?
সঞ্জু সঞ্জু। ডোন্ট মাইন্ড, তুমি এই টেরিলিনের শার্ট পর কেন? ভয়ানক দুর্গন্ধ বেরোয় ঘামের। তুমি কি সত্যিই পাও না?
এই কথা? টিভির বিজ্ঞাপন? ঘামের গন্ধ পৌরুষের গন্ধ তা জানো?
তুমি কি তাই ভেবে সান্ত্বনা পাও? ঘাম, রক্ত, স্বেদ, এইসব এইভাবে ভাবো?
আমি কিন্তু ওভাবে ভাবি না। পৌরুষ হল নিজেকে শুদ্ধ সুরভিত করা।
অর্থাৎ আফটার শেভ লোশন। চামড়ায় গন্ধঅলা পারফুম, ও ডি কোলন…
না সঞ্জু, নিজেকে শুদ্ধ সুরভিত করা মানে এই গরমের দিনে অন্তত চারবার অ্যান্টিসেপটিক সাবান দিয়ে চান, সুতির পোশাক পরা, গায়ে কষে প্রিকলি হিট পাউডার…
আবার টিভির বিজ্ঞাপন? স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য রক্ষায় লিভোসিন, ট্রিংলিং।
সঞ্জু, ঘামের গন্ধ মানে কিন্তু সত্যিই ব্যাকটিরিয়ার সংক্রমণ! সত্যিই কিন্তু তার থেকে বাঁচতে হলে চান চাই, সাবান দিয়ে, লেবু-গন্ধ-অলা হলে ভালো হয়।
সামান্য ঘামের গন্ধের জন্যে আমাদের প্রেম আটকে থাকবে?
গন্ধকে তুমি সামান্য বলছ সঞ্জু? রক্তের গন্ধে লেডি ম্যাকবেথ যে পাগল হয়ে গেলেন। বারবার ধুয়েও সে রক্তের গন্ধ তাঁর অন্তঃনাসা থেকে কিছুতে গেল না।
সে তো আসলে রক্তের গন্ধ নয়। পাপের গন্ধ।
ঠিকই। কিন্তু পাপের চেতনা প্রকাশ পাচ্ছিল রক্তের গন্ধের ভেতর দিয়ে। সঞ্জু আমি আজ যাই। …
টিলটিল এত দ্রুত চলে গেল যে সঞ্জু তাকে নিবৃত্ত করবার উদ্যোগই নিতে পারল না। খোলামেলা পার্ক-জাতীয় জায়গায় কারও পশ্চাদ্ধাবন করাটা খুব গণ্ডগোলের দেখাবে—এটা তার খেয়ালে ছিল। কিন্তু মনে মনে সে দৌড়াচ্ছিল। মরিয়ার মতো। ওই টিলটিল চলে যায় টিয়ে রঙের বসন গায়ে। চলার তালে টিলটিলের একটা হাত দুলছে, যেন হাতির দাঁত দিয়ে গড়া। না হাতির দাঁত নয়, সে তো শক্ত ব্যাপার, ময়দা—ধুর সে তো সাদা থ্যাসথেসে। তবে? তবে? তবে? নাঃ পাওয়া গেল না। পেছন থেকে দেখা যাচ্ছে টিলটিলের দোল-খাওয়া চুল। সোজা, প্রপাতের মতো নেমে এসেছে মুসৌরির কেম্পটি ফলস। ধ্যাত কেম্পটি দুটো সরু সরু বিনুনির মতো। টিলটিলের বিধাতা কি অত কৃপণ নাকি? তবে কি উশ্রী? না বাবা উশ্রীর মধ্যে একটা বন্য উদ্দামতা আছে, যাই বলো। এ কেমন কেশ, যাকে কেশ বলে মনে হয় না? ধুনুচির ধোঁয়ার মতো! শীতের ভোরের কুয়াশার মতো! এ যেন টিলটিলের টিলটিলত্বেরই একটা নাটবল্ট।
এমন করে বুঝি টিলটিলকে কখনও দেখেনি সঞ্জীবন। যেন তার জীবনের, তার সমস্ত সত্তার, সমস্ত প্রার্থনার নির্যাস একটি আঁকাবাঁকা টিয়া রঙের রেখা হয়ে চলে যায়। ঝুলির ভেতর থেকে দ্রুত স্কেচবুক বার করে সে, বেছে বেছে একটা দশ! বারো নম্বরের নরম পেন্সিল। ক্ষিপ্র আঙুলে এঁকে ফেলে তার প্রার্থনার প্রস্থানরেখা। দুটো তিনটে স্কেচ করে। তাই টিলটিল যে পুব ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকে দেখল, এক ঝিলিক হাসল, সেটা সে দেখতে পেল না। পেলে হয়তো স্কেচ কয়েকটা বাড়ত। এগুলো বাড়ি গিয়ে জলরং আর ক্রেয়ন মিশিয়ে আঁকতে হবে। ক্রেয়নে জল ধরবে না। কিন্তু ক্রেয়ন আর জল রঙের সম্মিলনই হবে সেই মাধ্যম এ বিষয়ে সে নিশ্চিত হয়ে যায় বাগানের ঘাসের দিকে চেয়ে। কেন না ওই ঘাসগুলোর মধ্যে যেমন একটা খাড়া খাড়া ব্যাপার আছে, গোটা গোটা গোছা-গোছা ব্যাপার আছে, তেমনি আবার আছে একটা দ্রবীভূত ছাপকা ছাপকা ব্যাপার, যেন ব্লটিং পেপারের ওপর কালি ছেপে উঠেছে। টিলটিলের চুল জলরঙের। তার শাড়িটা জলরঙের। দুলন্ত হাতটি ক্রেয়নের কিন্তু হাতের ভঙ্গিতে জলরং কিছু নেমে এসেছে। এই আর কি?
তা এখন তৃতীয়বার সঞ্জু চান করছে। চতুর্থটা শোবার আগে করবে। চান করে সঞ্জু সাদা টার্কিশ তোয়ালে দিয়ে ভালো করে গা মুছে পাউডার ঢালে অকৃপণ হাতে। ঘাড় থেকে পাউডার মুছে নেয় সযতনে। ঘাড়ে-পাউডার-তরুণ সে দেখতে পারে না। খাদির এই পাঞ্জাবিটা নতুন কিনেছে সে, বেশ আলগা আলগা, জিনস, পায়জামা, পপলিনের, নতুন। বউদিকে অনেক খোশামোদ করে এই পোশাকটা জুটেছে, শেষ মাসে পকেটে কিছু বিশেষ ছিল না।
দাড়ি ধুয়েছিস?–বউদি।
হ্যাঁ।
আঁচড়েছিস?
আজ্ঞে।
বউদি ফট করে একটা কী যেন তার সারা গায়ে স্প্রে করে দিল। এত দ্রুত যে সে নিবৃত্ত করবার সময় পেল না।
লাইফটা হেল করে দিলে।
নিজের বুকে হাত দিয়ে বল। হেল-হেল লাগছে না হেভন-হেভন লাগছে?
যাও যাও, বেশি দিক কোরো না।
বড়ো ভালো লাগছে দিনটা আজ। বিকেলটি হবার সঙ্গে সঙ্গেই ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছে। অবিরল—মাইটি ট্রেড উইন্ডস ব্লোয়িং। সেই হাওয়া পাঞ্জাবির ভেতরে ঢুকে সদ্যস্নাত ত্বককে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। এত আরাম যে খলবলিয়ে হেসে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে। একটা সিগারেট ধরায় সঞ্জীবন। প্রচুর মানুষের বিপরীতমুখী স্রোতের উজানে চলে যায় সে স্বেচ্ছায়। ঘাম, স্বেদ, রক্ত, যদিও ঘাম আর স্বেদ একই তবুও কেমন একটা জোর আসে যেন দুটোকে আলাদা আলাদা ব্যবহার করলে, এসব আপাতত তার উলটো দিকে। কে কাকে খিচিয়ে উঠল,
কী দাদা, চোখে দেখতে পান না? পেল্লাই জুতোপরা পা-টা আমার হাঁটুতে তুলে দিলেন! ছি ছি!
দেখে দেখে দিয়েছি বোধহয়? ভিড়টা এমনই যে আপনিও কাজটা করতে পারতেন।
আবার উলটো চাপ দিচ্ছেন…
সঞ্জীবন পেরিয়ে যায়। বাসে সে উঠবে না। রবীন্দ্রসদন চত্বরে সে হেঁটে হেঁটেই যাবে। তারও পা একজন মাড়িয়ে দিল। বেশ লাগল। চটিতে যথেষ্ট ধুলোও। সে শুধু বলল, এ হে হে হে।
আরে দাদা, মাফ করে দিন। বড্ড ভিড়।
সঞ্জীবন পেরিয়ে যায়—পার্কস্ট্রিটের মোড়ে তো লালবাতির জন্যে আধঘন্টা দাঁড়াতে হল। এপারে অপেক্ষারত একটা গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত এক ভদ্রলোক, মানে বেশ টাই পরা ভদ্রলোক, বললেন, শ শালা! চান করেছেন কোন সকালে। বড়ো বড়ো অফিসে তো ভালো টয়লেট থাকে। শাওয়ার থাকে না? চানটা করে বেরোলেই পারতেন ভদ্রলোক, একটা চেঞ্জ রেখে দিতেন অফিসে–চান করে টাটকা জামা-কাপড় পরে এক কাপ চাফি খেয়ে নিয়ে বেরুলে এই ট্রাফিক জ্যামটার মোকাবিলা করতে পারতেন। থিয়েটার রোডের ওখান থেকে রাস্তাট ক্রস করে নিল সঞ্জীবন। ও-ফুট দিয়ে গেলে আর মোড়ে অসুবিধে হবে না। কেমন ইচ্ছে করল চার্চের পাশ দিয়ে, চার্চ নয় ক্যাথিড্রাল, অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস এর পাশ দিয়ে যাবে। একটু ঘুর হবে-টিলটিলকে হয়তো একটু অপেক্ষা করতে হবে। তা হোক। টিলটিল সে সময়টা রাগ-টাগ না করেই কাটিয়ে দেবে এখন। অ্যাকাডেমির পাশ দিয়ে যেতে যেতে সঞ্জীবনের মনে পড়ল বছর তিনেক আগে এখানেই তাদের বিপ্লবী শিল্পী সংঘের প্রদর্শনী হয়েছিল। খুব সফল হয়েছিল সেটা। তার পাঁচটা ছবির একটা সিরিজ ছিল। সব বেনারসের বিভিন্ন ঘাট। সুষ্ঠু রঙের ফুচকি (ফুটকি বেশ গোল একটি বিন্দু, কিন্তু বিন্দুটা যদি সুগোল না হয় ব্লচ মতো হয়, ত্যাড়াব্যাঁকা বা রং ছেটকানো, তাহলে সেটা ফুচকি < সঞ্জীবন) দিয়ে আঁকা দশাশ্বমেধ ঘাটের ছবিটা খুব প্রশংসা পেয়েছিল। বিক্রি হয়েছিল সবারই দু-একটা করে, শুধু অনন্ত ঘড়াইয়ের একটাও বিক্রি হয়নি। ঘড়াই বিড়ি খেত, ভাঁড়ে চা পছন্দ করত, তার গুরু-পাঞ্জাবির কলার সদাই ফাটা। এবং বোতামপটির ফাঁকা লম্বাটে ত্রিভুজ দিয়ে তার আশ্চর্য ঘন নোম বিশিষ্ট সরু বুক এক চিলতে দেখা যেত। সেই থেকে ঘড়াই তাদের বিপ্লবের প্রতীক হয়ে গেল। হাতে চায়ের গনগনে গরম ভাঁড় নিয়ে যে চা না চলকে হা-হা অট্টহাস্য হাসতে পারে, যার পায়জামার বড়ো বড়ো ঘেরের মধ্যে পা কোথায় বোঝা যায় না, অথচ যে না-ঠো কর খেয়ে যেন শূন্যে ভেসে যাওয়ার মতো চলে যেতে পারে, সে নেতা হবে না তো কী? ঘড়াইয়ের ডেরায় ঘাম, স্বেদ, রক্ত, আবার সেই ঘাম স্বেদ, তা ছাড়া গাঁজা-বিড়ির ধোঁয়ায় একটা ক্রিয়েটিভ নরকস্বর্গ কি তৈরি হত না?
বাঃ। তুমি তো এসে গেছ?
গেলাম। কোনো অসুবিধে হল?
না অসুবিধে কী? ফোয়ারা দেখছিলাম।
এখানেই বসব, না কী?
এখানে আধঘন্টা বসেছি, একটু ঘোরা যাক না।
একটু বসা যাক না, সেই ব্লকম্যান স্ট্রিট থেকে এই অবধি হেঁটে এলাম।
সে কী? কেন?
এই সময়ে কি বাসে ওঠা যায়? যা ঠেসাঠেসি! গরম! ঘাম! দুর্গন্ধ!
ও মা, তুমি তো আজ চান করে এসেছ মনে হচ্ছে!
হ্যাঁ কাছে বসতে না পারো, পাশাপাশি হাঁটতে অন্তত পারো। মানে বোধহয়।
ও মা কী সুন্দর চুল পাট করে আঁচড়ানো। দাড়িতে কি শ্যাম্পু দিয়েছ? ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছে, পাঞ্জাবিটা কি নতুন?
ইয়ার্কি হচ্ছে?
ও মা, ইয়ার্কি হবে কেন? জ্যাঠাবাবুর সঙ্গে কেউ ইয়ার্কি করে? দাদু হলেও বা কথা ছিল। তোমার বসা হয়েছে?
নাহ। তবে তোমার যখন হয়ে গেছে তখন আমার হতেই হবে।
এ কথার মানে?
মানে তো বোঝাই যাচ্ছে। কীর ইচ্ছায় কর্ম।
বাবা! বাবা! বসছি। তোমার বিশ্রাম হলে বলবে। ওমা লেবু লেবু গন্ধও তো বেরোচ্ছে? দাঁতও যেন সদ্য সদ্য মাজা।
নখও কাটা। হাতের এবং পায়ের।
যাতে হেমচন্দ্রের মতো লাথি কষালে নখের খোঁচা টোঁচা লেগে গিয়ে টেল-টেল টিট্যানাস না হয়!
টেল-টেল টিট্যানাসটা কী?
আঁচড়ের দাগটাই তো লাথির গল্পটা বলে দেবে, টিট্যানাসের কারণ নির্ণয়ের জন্যে ডাক্তারকে বেশি খোঁচাখুঁচি করতে হবে না। কবে পড়ে গিয়েছিলেন? কোথায় লাগল? কীসে কেটে গিয়েছিল? ইত্যাকার।
অফ অল থিংস হেমচন্দ্রের লাথিটাই মনে পড়ল কেন এ রহস্যটা…
এমনি। ওটা আমৃণালিনী নারীসমাজের মনের মধ্যে এমন একটা ক্ষত সৃষ্টি করে রেখেছে যে প্রেমিক দেখলেই মনে পড়ে।
অ! সঞ্জীবন টিলটিলের প্রেমিক বুঝি?
আমার তো তাই ধারণা!
সেইজন্যেই সঞ্জীবন টিলটিলের ঘনিষ্ঠ হয়ে বসুক এবার।
তা বসুক, কিন্তু দাড়ি-অলা মুখখানা অত এগিয়ে আনবার কী দরকার?
এইজন্যে যে তাক বুঝে টুক করে একটু খেয়ে নেব।
টিফিন এনেছ পকেটে করে? তা খাও না! খেতে আবার লজ্জা কী? মেয়েরাও আজকাল পাবলিকে খেতে লজ্জা করে না।
খাব? খাব?…খাই?
কী খাবে? সর্বনাশ! আমি চললাম।
টিলটিল দিস ইজ ভেরি ভেরি আনফেয়ার।
লোক দেখিয়ে খাবে?
সেটুকু সেন্স আমার আছে, ওই কর্নারটা টার্ন নেবার সময়ে এদিক ওদিক দেখে ছোট্ট একটু।
ওটা একটা সাংস্কৃতিক জায়গা, সেটাকে অশুচি করার কথা তোমার মনে এল? অশুচি? আই বেগ টু ডিফার দিদিমণি। কত সাহিত্য কত গান এই চুম্বন বেজড। সেইসব সাহিত্যের গানের চর্চা হচ্ছে এখানে…
তাই চুম্বন-চর্চাও হবে?
না, তা আমি বলছি না। অতটা বলতে পারা যাবে না। তাহলে আরও অনেক রকম চর্চাও হবে। তা নয়, অশুচি কথাটাতে আমার আপত্তি।
অশুচি কথাটা তুলে নিচ্ছি, আসলে আমি বলতে চেয়েছিলাম অনৈতিক, অসামাজিক।
প্রত্যেকেটা শব্দই বেশ প্রগাঢ় তর্কের মধ্যে এসে যাচ্ছে। ও পথে হেঁটে কাজ নেই। তার চেয়ে বরং চলো তোমায় পৌঁছে দিই। একটি নির্জন ট্যাক্সি করে।
তার চেয়ে চলো একটা হোটেলে ঘর বুক করি।—রাগে, শ্লেষে, ক্ষোভে কষকুটে শোনাচ্ছে টিলটিলের গলা।
দিস ইজ ভেরি ভেরি অনফেয়ার টিলটিল। আমি যদি ওই লোকেদের দলে পড়তুম, তুমি তাহলে অনেক আগেই টের পেতে। আ অ্যাম আ ম্যান অব অনারেবল ইনটেনশনস।
তা হলে চলো ট্যাক্সি করো।
তোমার কাছে কত টাকা আছে টিলটিল?
আমার কাছে? আমার কাছে টাকা থাকবে কেন?
ট্যাক্সির জন্যে।
তুমি আমাকে ট্যাক্সি করে পৌঁছে দেবে, তার জন্যে টাকা দেব আমি? কী বলছ। সঞ্জু? আমার তো…আমার তো মনে হবে তুমি আমার একজন রক্ষিত।
আমি ভাড়া দিলেই তা হলে তুমি রক্ষিতের স্ত্রীলিঙ্গ?
না, কখনোই না, কখনো না। ছেলেদের দায়িত্ব হল মেয়েদের নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া। চিরদিনের সামাজিক দায়, নটউইথস্ট্যান্ডিং নারীমুক্তি। আমি চললাম। বাসে মিনিবাসে। ন্যাচর্যালি।
খুব ক্ষিপ্রপদে টিলটিল চলে যায়। অন্ধকারে তার শাড়ির হলুদ সামান্য চমকায়। রেখা আপাদমস্তক দেখা যায় না যেন একটা ঝিলিক, তারপর অন্ধকার। মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে নন্দন। চারপাশে সংস্কৃতি-সচেতন মানুষের ভিড়। প্রাকৃতিক অন্ধকারের সঙ্গে বৈদ্যুতিক আলোর মেশামেশিতে বেগুনি কুয়াশা।
সঞ্জীবন দৃশ্যটির দিকে মুখ করে স্থাণু থাকে।
রাত।
সিগারেটের টুকরোর পর টুকরো জমে যাচ্ছে। পায়চারি করে করে চটির তলা ক্ষয়ে গেল। অন্ধকারে জ্বলছে নিভছে ও কী? সিগারেটের মুখ? না সঞ্জীবনের চোখের আগুন?
আমি যেমন আমাকে তেমনিই নিতে হবে।
আমি স্বেদে স্বেদে দুর্গন্ধ
রাজপথ ছেড়ে বেছে নিই খানাখন্দ
দাড়িতে দাড়িতে দাড়িয়াল
আমি কাটি না নখর রাখি স্বাক্ষর
কাদাতে মাটিতে মাটিয়াল
আমি চলি না কারুর মতে
হাত বুলোই না নিজেরও হৃদয়ক্ষতে
আমি ধি ক্কার হানি, ধিক! ধিক!
বিদ্রোহী আমি নির্ভীক
আমার দাড়ি ওড়ে ঝোড়ো বাতাসে
আমি পড়েছি এবার সাতাশে
আমি শ্রেণি-সংগ্রাম মানি
পাতিবুর্জুয়া মাস্টারদের ঘোরাবই আমি ঘানি
যাব না তোদের মঞ্চে
আমার ক্যানভাস গ্রামে গঞ্জে
আমি যেমন আমাকে পারলে তেমনই নিক
শত টিলটিল গারদের
আমি পালাব বাঁকায়ে শিক।
একদম শেষরাতে যখন সন্ধ্যাতারা ভোরের শুকতারা হয়ে জানলা দিয়ে উঁকি মারছে তখন ইজেলে ক্যানভাস চড়ায় সঞ্জীবন। টেম্পারায় অন্ধকার। অন্ধকারে বেগুনি আভাস, কেমন আভাসিত অন্ধকার। অন্ধকারে নন্দনের সত্যজিৎকৃত অলংকৃত পাপেন্ডিকুলার। ফ্রস্টেড লাইটের আয়োজন সব যেন ইউফোর মতো ঘুরছে। তাদের ডাঁটি নেই। অন্ধকারে ভূতেদের আনাগোনা, কালোর মধ্যে আরও কালো, কিংবা ছাই-ছাই, কিংবা ধুপছায়া, কিংবা বেগুনির মধ্যে অতিবেগুনি বিন্দু সব। খালি একটা হলুদ বিদ্যুৎ চমকাতে চমকাতে যাচ্ছে। সাত দিনের একটু বেশি লাগল শেষ হতে। সোয়া সাত দিন ধরো। এ কদিনে চৰ্য্য শুধু পাঁউরুটি আর ডিম, চোষ্য শুধু নিজের হাতের আঙুল, লেহ্য সিগারেট, পেয়—চা এবং দিশি।
শেষ হয়ে গেলে চান করে, ভাত খেয়ে, ঘুম।
ঘুমের মধ্যে কোন দূর বিদেশ থেকে যেন আই, এস. ডি এসেছে। বউদি ডাকছে সঞ্জু, সঞ্জু, ফোন, ফোন।
খুনখারাবি চোখ মেলে সঞ্জু বলে—আহ!
কী মুশকিল, ফোনটা তোমার, টিলটিল।
ঘুমের মধ্যে আমরা অতীতে থাকি। কিংবা ভবিষ্যতে। সেই অনাগত বিধাতার দেশ থেকে এক ঝাপটা আকুলতার বৃষ্টির মতো টিলটিল নামটা এল।
আধঘুমন্ত সঞ্জু লাফিয়ে উঠতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে যায়। বউদি উঠতে সাহায্য করে। গা হাত-পা যেন প্যারালাইজড হয়ে ছিল।
কে?
বউদিকে তো বললাম আমি টিলটিল। তোমার গলা এত ভারী কেন? আবার গাঁড়ি খাচ্ছ?
গাঁড়ি হল গাঁজামেশানো বিড়ি।
দুম করে অন্ধকার ভেদ করে টর্চলাইটের মতো বর্তমান ফিরে এল। ফোনটা রেখে দিতেই যাচ্ছিল সঞ্জীবন কিন্তু ওদিক থেকে ভেসে এল, কতদিন তোমায় দেখি না।
ব্যস্ত ছিলাম।
তা তো থাকবেই। নতুন কিছু কাজ হল?
হচ্ছে।
আমাকে একটুও সময় দিতে পারবে না?
সময় চিনেবাদাম বা ঝালমুড়ি নয়।
সে তো জানি। আসলে আমার ভীষণ হিট ফিভার হয়েছিল। এখন জ্বরটা গেছে কিন্তু খুব দুর্বল। তাই।
ব্লাড-প্রেশার কত?
ষাট-একশো।
যাঃ।
অন গড। সুগার সত্তর। পুরো এক মাসের ছুটি নিয়েছি।
আচ্ছা রেস্ট নাও, আসছি। …
বিদ্যুৎ আর নেই। আকাশ থেকে নেমে এসে এখন মাটিতে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। করুণ বিভঙ্গে। মাচা নেই, কোনো বনস্পতি নেই যার খাঁজটাঁজ আশ্রয় করে দাঁড়াবে। আরামচেয়ারে সেই ছিন্নভিন্ন আলোকলতা রক্তহীন, তেজহীন, নিঃস্ব পলকা পড়ে রয়েছে। আরামচেয়ারের হাতলে এক কাপ দুধ।
সঞ্জু তুমি দেখো তো যদি খাওয়াতে পায়। কখন নিয়েছি। এখনও যেমন কে তেমন।-অনাথা লতার দিদি বলছেন।
খেতে কি আমার অসাধ? বমি পায় যে!
একটু একটু করে খাও।–সঞ্জীবন কাপটা মুখের কাছে ধরে।
চুমুক দেবার একটা মৃদু শব্দ হয়। পেটের মধ্যেটা কেমন শিরশির করে সঞ্জীবনের সেই শব্দে। একটু দুধ যে চলকে পড়ল? যাঃ গলার কাছে ছাপা কাফতানের বেশ খানিকটা ভিজে গেল।
ওই যে কুঁজো রয়েছে, গেলাসে করে জল আনো, এখুনি এটা ধুয়ে ফেলি, নইলে চটচট করবে।
জ্বরের ওপর জল?
এ তো হিট ফিভার? জলেই তো নিরাময়।
তুলো নাও, হ্যাঁ তুলোটা ভিজিয়ে দাও। … তুলো ভিজিয়ে সঞ্জীবন নিজেই দুধেভেজা কাফতানের গলা মুছে নেয়।
ওয়ার্ক, ওয়া, ওয়াক—
মুখের ওপর ঝুঁকে পড়েছিল সঞ্জীবন, সোজা হয়ে যায়।
কী হল?
দাও, শিগগিরই।
প্লাস্টিকের একটা গামলা দেখতে পায় সঞ্জীবন। ধরে মুখের কাছে।
হোয়াক, হোয়া হোয়ক।
নাঃ, কোঁতানিই সার, বড়ো ভয় হচ্ছিল দুধটা না বেরিয়ে যায়। তা বেরোল না।
দুধ খেলেই কি তোমার এমন হচ্ছে?
কাঠ-বমির কষ্টে চোখ দুটো ছলছল, টিলটিল বলল, সব সময়ে না। এখন তো নাই-ই।
তবে?
কী জানি, এমনি।—বড্ড দুর্বল গলা। চোখ বুজে আসে টিলটিলের। কিছুক্ষণ পর করুণ চোখের পাতা খুলে যায়। কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে, তুমি কি…তুমি কি গাঁড়ির সঙ্গে তাড়িও— আর বলতে পারে না, চুপ করে যায়, চোখ দুটো আবার বুজে আসে।
আমি কাছে এলেই যদি এত গন্ধ লাগে টিলটিল তাহলে…
টিলটিল চুপ।
কাজ করার সময়ে এগুলো তো আমার খেতেই হবে টিলটিল।
টিলটিল চুপ।
আর খেলে তো গন্ধ আসবেই, যতই চান করি আর পাউডার মাখি আর এলাচ চিবোই।
হোয়াক—একটা তীব্র বমির শব্দ কোনোক্রমে ঠেকায় টিলটিল। তারপর কোনোমতে বলে, সরি সঞ্জু। বমি একটা বিশ্রী ব্যাপার। এই অসুখবিসুখ এসব বিশ্রী, তুমি যাও। তোমার সামনে আমার কেমন লজ্জা করছে।—এতটা কথায় সে হাঁপায়।
আমি কিন্তু বাস্তবকে ঘৃণা করি না টিলটিল। অসুখ আমাদের সবারই করে। অসুখ করলে বমিটমি খারাপ ব্যাপার থাকেই। সেগুলো থেকে পালাবার মুখ ফিরিয়ে থাকবার বিন্দুমাত্র কাপুরুষতা আমার নেই। এগুলো জীবনের মৌলিক কষ্ট। মৌলিক বিপদ।
কিন্তু তোমার গন্ধগুলো তো তোমার মৌলিক গন্ধ নয় সঞ্জু।
আচ্ছা আমি যাচ্ছি।
এবার অন্যরকম প্রস্থানপর্ব। যে সাধারণত প্ৰস্থিত হয় সে শুয়ে আছে, তার অসুখে রোগা সাদা শরীরে একটা আতুর সমর্পণ, একটা ঘুমন্ত জেহাদ, আবার একটা বাধ্যতামূলক আত্মত্যাগের উদ্যোগ। যে যাচ্ছে সে পুরুষ, তার জীবনের প্রয়োজন অপ্রয়োজনগুলোর একটা সঠিক হিসেব-নিকেশ সে এইমাত্র পেশ করেছে। সেই ঔদ্ধত্য, সেই রিলিফ তার চলায় ফেরায়। শুধু একটু ভুল হল। ঘরটা পার হবার পর সঞ্জীবন একবার, একটিবার মাত্র মুখ ফিরিয়ে তাকাল।
টিলটিল তাকিয়ে আছে। তার দিকে। অপলক। দু চোখ দিয়ে সরু ধারা।
আলো জ্বলছে। সারারাত। এ বিলাসিতা তাদের মানায় না। সঞ্জীবন জানে। দাদা কয়েকবার দেখে গেছে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেল শেষবার। বউদি একটা ফ্লাস্ক দিয়ে গেছে তাতে চা।
একটা দীর্ঘ গাঁড়ি ধরাল সঞ্জীবন। ক্যানভাসের দিকে চাইল। অমনি ক্যানভাসের ওপর একজোড়া বোজা চোখ ফুটে উঠল। গাঁড়িটা টিপে নিবিয়ে দিল সঞ্জীবন। জল ঢেলে দিল অ্যাশট্রেতে। ফ্লাস্ক থেকে অস্থির হাতে চা ঢালল। কাঁপছে আঙুলগুলো। ভেতরের কী একটা ছবির আবেগ তাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে, এক চুমুক চা, আর এক চুমুক, গুল পাকানো চায়ের কেমন একটা বদ্ধ ডোবার গন্ধ, তার মধ্যে মাদার ডেয়ারির দুধ ভেসে আছে। না মাদার ডেয়ারি না, বহু চর্চিত বহু বিজ্ঞাপিত এভরি-ডে-টে হবে। তেলে জলে যেমন মিশ খায় না তেমনি। তৃতীয় চুমুকের পর চায়ের কাপটা সরিয়ে রাখল সঞ্জীবন। প্রথম টান—সুদীর্ঘ এক চোখের ওপরপাতা। লাইফ সাইজকে অন্তত দশ গুণ করে দিলে যতটা হয়।
ক্ষীণ অতি ক্ষীণ একটি ঢেউতোলা রেখা। তার ওপর দিকে সেই চোখ বা চোখের পাতা, যার মণি নেই, পাপড়ি নেই, মুখের রেখা নেই, দিগন্ত-ছোঁয়া এক আঁখি শুধু একটি মাত্রই এবং ক্যানভাসের বাকি অংশটা প্রায় সবটাই সাদাটে ধোঁয়াটে এক মুখ যার মধ্যে কোথাও না কোথাও কানের অস্পষ্ট রেখা বোঝা যায় আবার সেগুলো অর্থহীন তালগোল পাকানো রঙের পুঁটলিও। আবার প্যানডোরার বাক্সের মতো তার থেকে বেরিয়ে পড়ে দুধের গ্লাস, চলকে পড়া দুগ্ধ ধারা, ফিনকি দিয়ে যেন সাদা রক্ত বেরোচ্ছে, ওষুধের শিশি, প্ল্যাস্টিকের গামলা…।
ভোর রাতে ওয়াশ করে করে, ওয়াশ করে করে যেন নিজের অস্পষ্ট অনভবকে ধরে রাখতে চাইল সে। তারপর চান, পাটভাঙা জামাকাপড়, কেমন যেন অস্বস্তি লাগে না হলে। বোতলটা আজকে শেলফের এক কোণে পড়ে রয়েছে। মার্জারিন দিয়ে ছ স্লাইস পাঁউরুটি আর দুটো শুটকে কাঁটালি কলা দিয়ে বোতলটা শেষ করে মাতাল হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে।
সঞ্জু সঞ্জু ওঠো। তোমার কাছে লোক এসেছে দেখা করতে। ওঠো। সঞ্জু।
জাহান্নমে যাও…।
প্লীজ সঞ্জু। অনন্ত ঘড়াই আর…
হুড়মুড় করে উঠতে গিয়ে সঞ্জীবন ধপাস করে পড়ে যাচ্ছিল। বউদি ধরল।
এইজন্যে তোমাকে নাম বলতে চাই না। নাম বললেই ধপাস। আশ্চর্য। …
ঘড়াই ঢুকে আসছে।
আর্টিস্টের স্টুডিয়ো আর ব্যাচেলরের ডেন এ দুটোর কোনো প্রাইভেসি নেই বুঝলেন দুনিবাবু।
তক্তাপোশ—তাতে বাসি বিছানা। শূন্য বোতল গড়াগড়ি। অ্যাশট্রে জলে