১. উপক্রমণিকা
প্রথম বারের বিজ্ঞাপন
সংস্কৃত ভাষায় মহাকবি বাণভট্টবিরচিত কাদম্বরী নামে যে মনোহর গদ্য গ্রন্থ প্রসিদ্ধ আছে, তাহা অবলম্বন করিয়া এই পুস্তক লিখিত হইল। ইহা ঐ গ্রন্থের অবিকল অনুবাদ নহে। গল্পটি মাত্র অবিকল পরিগৃহীত হইয়াছে, বর্ণনার অনেক অংশ পরিত্যাগ করা গিয়াছে। সংস্কৃত কাদম্বরী পাঠে অনির্ব্বচনীয় প্রীতি লাভ হইয়া থাকে এবং তাহার বর্ণনা শুনিলে অথবা পাঠ করিলে সাতিশয় চমৎকৃত হইতে হয়। এই বাঙ্গলা অনুবাদ যে সেই রূপ প্রীতিদায়ক ও চমৎকারজনক হইবেক ইহা কোন রূপেই সম্ভাবিত নহে। যাহা হউক, যে সকল মহাশয়েরা বাঙ্গলা ভাষায় অনুরাগ প্রদর্শন করিয়া থাকেন তাঁহারা পরিশ্রম স্বীকার পূর্ব্বক এক এক বার পাঠ করিলেই সমুদায় শ্রম সফল জ্ঞান করিব।
শ্রীতারাশঙ্কর শর্ম্মা
কলিকাতা, সংস্কৃত কালেজ
৩রা আশ্বিন সংবৎ ১৯১১
দ্বিতীয় বারের বিজ্ঞাপন
কাদম্বরী দ্বিতীয় বার মুদ্রিত ও প্রচারিত হইল। এই বারে কোন কোন স্থান পরিত্যক্ত ও কোন কোন স্থান পরিবর্ত্তিত হইয়াছে। যে সকল স্থান অসংলগ্ন অথবা দুরূহ বোধ হইয়াছিল, ঐ সকল স্থান সংলগ্ন ও সহজ করিবার নিমিত্ত প্রয়াস পাইয়াছি; কিন্তু কত দূর পর্য্যন্ত কৃতকার্য্য হইয়াছি বলিতে পারি না।
শ্রীতারাশঙ্কর শর্ম্মা
১৫ বৈশাখ
সংবৎ ১৯১৩
————–
উপক্রমণিকা
শূদ্রকনামে অসাধারণধীশক্তিসম্পন্ন অতিবদান্য মহাবল পরাক্রান্ত প্রবলপ্রতাপ নরপতি ছিলেন। বিদিশানাম্নী নগরী তাঁহার রাজধানী ছিল। যে স্থানে বেত্রবতী নদী বেগবতী হইয়া প্রবাহিত হইতেছে। রাজা নিজ বাহুবলে ও পরাক্রমে ক্রমে ক্রমে অশেষ দেশ জয় করিয়া সসাগরা ধরায় আপন আধিপত্য স্থাপন পূর্ব্বক সুখে ও নিরুদ্বেগচিত্তে সাম্রাজ্য ভোগ করেন। একদা প্রাতঃকালে আপন অমাত্য কুমারপালিত ও অন্যান্য রাজকুমারের সহিত সভামণ্ডপে বসিয়া আছেন, এমন সময়ে প্রতীহারী আসিয়া প্রণাম করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিল মহারাজ! দক্ষিণাপথ হইতে এক চণ্ডালকন্যা আসিয়াছে। তাহার সমভিব্যাহারে এক শুকপক্ষী আছে। কহিল, “মহারাজ সকল রত্নের আকর, এই নিমিত্ত এই পক্ষীরত্ন তদীয় পাদপদ্মে সমর্পণ করিতে আসিয়াছি।” দ্বারে দণ্ডায়মান আছে অনুমতি হইলে আসিয়া পাদপদ্ম দর্শন করে।
রাজা প্রতিহারীর বাক্য শুনিয়া সাতিশয় কৌতুকাবিষ্ট হইলেন এবং সমীপবর্ত্তী সভাসদগণের মুখাবলোকন পূর্ব্বক কহিলেন কি হানি আছে লইয়া আইস। প্রতিহারী যে আজ্ঞা বলিয়া চণ্ডালকন্যাকে সঙ্গে করিয়া আনিল। চণ্ডালকন্যা সভামণ্ডপে প্রবেশিয়া দেখিল উপরে মনোহর চন্দ্রাতপ, চন্দ্রাতপের চতুর্দ্দিকে মুক্তাকলাপ, মালার ন্যায় শোভা পাইতেছে; নিম্নে রাজা স্বর্ণময় অলঙ্কারে ভূষিত হইয়া মণিময় সিংহাসনে বসিয়া আছেন; সমাগত রাজগণ চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিয়া রহিয়াছেন। অন্যান্য পর্ব্বতের মধ্যগত হইলে সুমেরুর যেরূপ শোভা হয়, রাজা সেইরূপ অপূর্ব্ব শ্রী ধারণ করিয়া সভামণ্ডপ উজ্জ্বল করিতেছেন। চণ্ডালকন্যা সভার শোভা দেখিয়া অতিশয় চমৎকৃত হইল এবং নৃপতিকে অনন্যমনা করিবার আশয়ে করস্থিত বেণুযষ্টি দ্বারা সভাকুট্টিমে এক বার আঘাত করিল। তালফল পতিত হইলে অরণ্যচারী হস্তিযূথ যেরূপ সেই দিকে দৃষ্টিপাত করে, বেণুযষ্টির শব্দ শুনিবামাত্র সেইরূপ সকলের চক্ষু রাজার মুখমণ্ডল হইতে অপসৃত হইয়া সেই দিকে ধাবমান হইল।
রাজাও সেই দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেন অগ্রে এক জন বৃদ্ধ, পশ্চাতে পিঞ্জরহস্ত একটী বালক এবং মধ্যে এক পরমসুন্দরী কুমারী আসিতেছে। কন্যার এরূপ রূপ লাবণ্য, যে কোন ক্রমেই তাহাকে চণ্ডালকন্যা বলিয়া বোধ হয় না। রাজা তাহার নিরুপম সৌন্দর্য্য ও অসামান্য সৌকুমার্য্য অনিমিষলোচনে অবলোকন করিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন। ভাবিলেন, বিধাতা বুঝি হীনজাতি বলিয়া ইহাকে স্পর্শ করেন নাই, মনে মনে কল্পনা করিয়াই ইহার রূপ লাবণ্য নির্ম্মাণ করিয়া থাকিবেন। তাহা না হইলে এরূপ রমণীয় কান্তি ও এরূপ অলৌকিক সৌন্দর্য্য কি রূপে হইতে পারে। যাহা হউক, চণ্ডালের গৃহে এরূপ সুন্দরী কুমারীর সমুদ্ভব নিতান্ত অসম্ভব ও আশ্চর্য্যের বিষয়। এইরূপ ভাবিতেছিলেন এমন সময়ে কন্যা সম্মুখে আসিয়া বিনীত ভাবে প্রণাম করিল। বৃদ্ধ পিঞ্জর লইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া বিনয়বচনে নিবেদন করিল মহারাজ! পিঞ্জরস্থিত এই শুক সকল শাস্ত্রের পারদর্শী, রাজনীতিপ্রয়োগ বিষয়ে বিলক্ষণ নিপুণ, সদ্বক্তা, চতুর, সকলকালাভিজ্ঞ; কাব্য নাটক ইতিহাসের মর্ম্মজ্ঞ ও গুণগ্রাহী। যে সকল বিদ্যা মনুষ্যেরাও অবগত নহেন সমুদয় ইহার কণ্ঠস্থ। ইহার নাম বৈশম্পায়ন। ভূমণ্ডলস্থ সমস্ত নরপতি অপেক্ষা আপনি বিদ্বান্ ও গুণগ্রাহী। এই নিমিত্ত আমাদিগের স্বামিদুহিতা আপনকার নিকট এই শুকপক্ষী আনয়ন করিয়াছেন। অনুগ্রহ পূর্ব্বক গ্রহণ করিলে ইনি আপনাকে চরিতার্থ বোধ করেন। এই বলিয়া সম্মুখে পিঞ্জর রাখিয়া কিঞ্চিদ্দূরে দণ্ডায়মান হইল।
পিঞ্জরমধ্যবর্ত্তী শুক দক্ষিণ চরণ উন্নত করিয়া মহারাজের জয় হউক বলিয়া আশীর্ব্বাদ করিল। রাজা শুকের মুখ হইতে অর্থযুক্ত সুস্পষ্ট বাক্য শ্রবণ করিয়া বিস্মিত ও চমৎকৃত হইলেন। অনন্তর কুমারপালিতকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন দেখ অমাত্য! পক্ষিজাতীও সুস্পষ্ট রূপে বর্ণোচ্চারণ করিতে ও মধুরস্বরে কথা কহিতে পারে। আমি জানিতাম পক্ষী ও পশুজাতি কেবল আহার, নিদ্রা, ভয় প্রভৃতিরই পরতন্ত্র, ইহাদিগের বুদ্ধিশক্তি অথবা বাক্শক্তি কিছুই নাই। কিন্তু শুকের এই ব্যাপার দেখিয়া অতি আশ্চর্য্য বোধ হইতেছে। প্রথমতঃ ইহাই আশ্চর্য্য যে, পক্ষী মনুষ্যের মত কথা কহিতে পারে; দ্বিতীয়তঃ আশীর্ব্বাদ প্রয়োগের সময় ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দক্ষিণ হস্ত তুলিয়া আশীর্ব্বাদ করেন, শুক পক্ষীও সেইরূপ দক্ষিণ চরণ উন্নত করিয়া যথাবিহিত আশীর্ব্বাদ করিল। কি আশ্চর্য্য! ইহার বুদ্ধি ও মনোবৃত্তিও মনুষ্যের মত দেখিতেছি।
রাজার কথা শুনিয়া কুমারপালিত কহিলেন মহারাজ! পক্ষিজাতি যে মনুষ্যের ন্যায় কথা কহিতে পারে ইহা আশ্চর্য্যের বিষয় নহে। লোকেরা শুক শারিকা প্রভৃতি পক্ষীদিগকে প্রযত্নাতিশয় সহকারে শিক্ষা দেয় এবং উহারাও পূর্ব্বজন্মার্জ্জিত সংস্কারবশতঃ অনায়াসে শিখিতে পারে। পূর্ব্বে উহারা ঠিক্ মনুষ্যের মত সুস্পষ্ট রূপে কথা কহিতে পারিত; কিন্তু অগ্নির শাপে এক্ষণে উহাদিগের কথার জড়তা জন্মিয়াছে। এই কথা কহিতে কহিতে সভাভঙ্গসূচক মধ্যাহ্নকালীন শঙ্খধ্বনি হইল। স্নানসময় উপস্থিত দেখিয়া নরপতি, সমাগত রাজাদিগকে সম্মানসূচক বাক্য প্রয়োগ দ্বারা সন্তুষ্ট করিয়া বিদায় করিলেন, চণ্ডালকন্যাকে বিশ্রাম করিতে আদেশ দিলেন এবং তাম্বুলকরঙ্কবাহিনীকে কহিলেন তুমি বৈশম্পায়নকে অন্তঃপুরে লইয়া যাও ও স্নান ভোজন করাইয়া দাও।
অনন্তর আপনি সিংহাসন হইতে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক কতিপয় সুহৃৎ সমভিব্যাহারে রাজভবনে প্রবেশ করিলেন। তথায় স্নান, পূজা, আহার প্রভৃতি সমুদায় কর্ম্ম সমাপন করিয়া শয়নাগারে প্রবেশ পূর্ব্বক শয্যায় শয়ন করিয়া বৈশম্পায়নের আনয়নের নিমিত্ত প্রতীহারীকে আদেশ দিলেন। প্রতীহারী আজ্ঞামাত্র বৈশম্পায়নকে শয়নাগারে আনয়ন করিল। রাজা জিজ্ঞাসিলেন বৈশম্পায়ন! তুমি কোন্ দেশে কিরূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছ? তোমার জননী কে? কিরূপে সমস্ত শাস্ত্র অভ্যাস করিলে? তুমি কি জাতিস্মর, অথবা কোন মহাপুরুষ, যোগবলে বিহগবেশ ধারণ করিয়া দেশে দেশে ভ্রমণ করিতেছ, কিম্বা অভীষ্ট দেবতাকে সন্তুষ্ট করিয়া বর প্রাপ্ত হইয়াছ? তুমি পূর্ব্বে কোথায় বাস করিতে? কিরূপেই বা চণ্ডালহস্তগত হইয়া পিঞ্জরবদ্ধ হইলে এই সকল শুনিতে আমার অতিশয় কৌতুক জন্মিয়াছে, অতএব তোমার আদ্যোপান্ত সমুদায় বৃত্তান্ত বর্ণন করিয়া আমার কৌতুকাবিষ্ট চিত্তকে পরিতৃপ্ত কর।
বৈশম্পায়ন রাজার এই কথা শুনিয়া বিনয় বাক্যে কহিল যদি আমার জন্মবৃত্তান্ত শুনিতে মহাশয়ের নিতান্ত কৌতুক জন্মিয়া থাকে শ্রবণ করুন।
ভারতবর্ষের মধ্যস্থলে বিন্ধ্যাচলের নিকটে এক অটবী আছে। উহাকে বিন্ধ্যাটবী কহে। ঐ অটবীর মধ্যে গোদাবরী নদীর তীরে ভগবান্ অগস্ত্যের আশ্রম ছিল। যে স্থানে ত্রেতাবতার ভগবান্ রামচন্দ্র পিতৃ আজ্ঞা প্রতিপালনের নিমিত্ত সীতা ও লক্ষ্মণের সহিত পঞ্চবটীতে পর্ণশালা নির্ম্মাণ করিয়া কিঞ্চিৎ কাল অবস্থিতি করিয়াছিলেন। যে স্থানে দুর্ব্বৃত্ত দশাননপ্রেরিত নিশাচর মারীচ কনকমৃগরূপ ধারণ পূর্ব্বক জানকীর নিকট হইতে রামচন্দ্রকে হরণ করিয়াছিল। যে স্থানে মৈথিলীবিয়োগবিধুর রাম ও লক্ষ্মণ সাশ্রু নয়নে ও গদ্গদ বচনে নানাপ্রকার বিলাপ ও অনুতাপ করিয়া তত্রস্থ পশুপক্ষীদিগকেও দুঃখিত এবং বৃক্ষদিগকেও পরিতাপিত করিয়াছিলেন। ঐ আশ্রমের অনতিদূরে পম্পা নামক সরোবর আছে। ঐ সরোবরের পশ্চিম তীরে ভগবান্ রামচন্দ্র শর দ্বারা যে সপ্ততাল বিদ্ধ করিয়াছিলেন তাহার নিকটে এক প্রকাণ্ড শাল্মলী বৃক্ষ আছে; বৃহৎ এক অজগর সর্প সর্ব্বদা ঐ বৃক্ষের মূলদেশে বেষ্টন করিয়া থাকাতে, বোধ হয় যেন, আলবাল রহিয়াছে। উহার শাখা প্রশাখা সকল এরূপ উন্নত ও বিস্তৃত, বোধ হয় যেন, হস্তপ্রসারণ পূর্ব্বক গগনমণ্ডলের দৈর্ঘ্য পরিমাণ করিতে উঠিতেছে। স্কন্ধদেশ এরূপ উচ্চ, বোধ হয় যেন, একবারে পৃথিবীর চতুর্দ্দিক অবলোকন করিবার আশয়ে মুখ বাড়াইতেছে। ঐ তরুর কোটরে, শাখাগ্রে, স্কন্ধদেশে ও বল্কলবিবরে কুলায় নির্ম্মাণ করিয়া শুক শারিকা প্রভৃতি নানাবিধ পক্ষিগণ সুখে বাস করে। তরু অতিশয় প্রাচীন; সুতরাং বিরলপল্লব হইয়াও পক্ষিশাবকদিগের দিবানিশি অবস্থিতি প্রযুক্ত সর্ব্বদা নিবিড়পল্লবাকীর্ণ বোধ হয়। কোন কোন পক্ষিশাবকের পক্ষোদ্ভেদ হয় নাই তাহাদিগকে ঐ বৃক্ষের ফল বলিয়া ভ্রান্তি জন্মে। পক্ষীরা রাত্রিকালে বৃক্ষকোটরে আপন আপন নীড়ে নিদ্রা যায়। প্রভাত হইলে আহারের অন্বেষণে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া গগনমার্গে উড্ডীন হয়। তৎকালে বোধ হয় যেন, হরিদ্বর্ণ দুর্ব্বাদলপরিপূর্ণ ক্ষেত্র আকাশমার্গ দিয়া চলিয়া যাইতেছে। তাহারা দিগ্দিগন্তে গমন করিয়া আহারদ্রব্য অন্বেষণ পূর্ব্বক আপনারা ভোজন করে এবং শাবকদিগের নিমিত্ত চঞ্চুপুটে করিয়া খাদ্য সামগ্রী আনে ও যত্নপূর্ব্বক আহার করাইয়া দেয়।
সেই মহীরুহের এক জীর্ণ কোটরে আমার পিতা মাতা বাস করিতেন। কালক্রমে মাতা গর্ভবতী হইলেন এবং আমাকে প্রসব করিয়া সূতিকাপীড়ায় অভিভূত হইয়া প্রাণত্যাগ করিলেন। পিতা তৎকালে বৃদ্ধ হইয়াছিলেন, আবার প্রিয়তমা জায়ার বিয়োগশোকে অতিশয় ব্যাকুল ও দুঃখিতচিত্ত হইলেন তথাপি স্নেহবশতঃ আমাকেই অবলম্বন করিয়া আমার লালন পালনে ও রক্ষণাবেক্ষণে যত্নবান্ হইয়া কালক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তাঁহার গমন করিবার কিছুমাত্র শক্তি ছিল না; তথাপি আস্তে আস্তে সেই আবাসতরুতলে নামিয়া পক্ষিকুলায়ভ্রষ্ট যে যৎকিঞ্চিৎ আহারদ্রব্য পাইতেন আমাকে আনিয়া দিতেন, আমার আহারাবশিষ্ট যাহা থাকিত আপনি ভোজন করিয়া যথাকথঞ্চিৎ জীবন ধারণ করিতেন।
একদা প্রভাতকালে চন্দ্রমা অস্তগত হইলে, পক্ষিগণের কলরবে অরণ্যানী কোলাহলময় হইলে, নবোদিত রবির আতপে গগনমণ্ডল লোহিতবর্ণ হইলে, গগনাঙ্গনবিক্ষিপ্ত অন্ধকার রূপ ভস্মরাশি দিনকরের কিরণরূপ সম্মার্জ্জনী দ্বারা দূরীকৃত হইলে, সপ্তর্ষিমণ্ডল অবগাহন মানসে মানসসরোবরতীরে অবতীর্ণ হইলে শাল্মলীবৃক্ষস্থিত পক্ষিগণ আহারের অন্বেষণে অভিমত প্রদেশে প্রস্থান করিল। পক্ষিশাবকেরা নিঃশব্দে কোটরে রহিয়াছে ও আমি পিতার নিকটে বসিয়া আছি এমন সময়ে, ভয়াবহ মৃগয়াকোলাহল শুনিতে পাইলাম। কোন দিকে সিংহ সকল গভীর স্বরে গর্জ্জন করিতে লাগিল; কোন প্রদেশে তুরঙ্গ, কুরঙ্গ, মাতঙ্গ প্রভৃতি বনচর পশু সকল বন আন্দোলন করিয়া বেড়াইতে লাগিল; কোন স্থানে ব্যাঘ্র, ভল্লুক, বরাহ প্রভৃতি ভীষণাকার জন্তু সকল ছুটাছুটী করিতে লাগিল, কোন স্থানে মহিষ, গণ্ডার প্রভৃতি বৃহৎ বৃহৎ জন্তুগণ অতিবেগে দৌড়িতে লাগিল ও তাহাদিগের গাত্রঘর্ষণে বৃক্ষ সকল ভগ্ন হইতে আরম্ভ হইল। মাতঙ্গের চীৎকারে, তুরঙ্গের হেষারবে, সিংহের গর্জ্জনে ও পক্ষীদিগের কলরবে বন আকুল হইয়া উঠিল এবং তরুগণও ভয়ে কাঁপিতে লাগিল। আমি সেই কোলাহল শ্রবণে ভয়বিহ্বল ও কম্পিতকলেবর হইয়া পিতার জীর্ণ পক্ষপুটের অন্তরালে লুকাইলাম। তথা হইতে ব্যাধদিগের ঐ বরাহ যাইতেছে, ঐ হরিণ দৌড়িতেছে, ঐ করভ পলাইতেছে ইত্যাদি নানাপ্রকার কোলাহল শুনিতে লাগিলাম।
মৃগয়াকোলাহল নিবৃত্ত হইলে অরণ্যানী নিস্তব্ধ হইল। তখন আমি পিতার পক্ষপুট হইতে আস্তে আস্তে বিনির্গত হইয়া কোটর হইতে মুখ বাড়াইয়া যে দিকে কোলাহল হইতেছিল সেই দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম। দেখিলাম কৃতান্তের সহোদরের ন্যায়, পাপের সারথির ন্যায়, নরকের দ্বারপালের ন্যায় বিকটমূর্ত্তি এক সেনাপতি সমভিব্যাহারে যমদূতের ন্যায় কতকগুলি কুরূপ ও কদাকার শবরসৈন্য আসিতেছে। তাহাদিগকে দেখিলে ভূতবেষ্টিত ভৈরব ও দূতমধ্যবর্ত্তী কালান্তকের স্মরণ হয়। সেনাপতির নাম মাতঙ্গ পশ্চাৎ অবগত হইলাম। সুরাপানে দুই চক্ষু জবাবর্ণ; সর্ব্বশরীরে বিন্দু বিন্দু রক্তকণিকা লাগিয়াছে; সঙ্গে কতকগুলি বড় বড় শিকারী কুকুর আছে। তাহাকে দেখিয়া বোধ হইল যেন, কোন বিকটাকার অসুর বন্য পশু ধরিয়া খাইতে আসিয়াছে। শবরসৈন্য অবলোকন করিয়া মনে মনে বিবেচনা করিলাম যে, ইহারা কি দুরাচার ও দুষ্কর্ম্মান্বিত। জনশূন্য অরণ্য ইহাদিগের বাসস্থান, মদ্য মাংস আহার, ধনুঃ ধন, কুক্কুর সুহৃৎ, ব্যাঘ্র ভল্লুক প্রভৃতি হিংস্র জন্তুর সহিত একত্র বাস এবং পশুদিগের প্রাণবধ করাই জীবিকা ও ব্যবসায়। অন্তঃকরণে দয়ার লেশ নাই, অধর্ম্মের ভয় নাই ও সদাচারে প্রবৃত্তি নাই। ইহারা সাধুবিগর্হিত পথ অবলম্বন করিয়া সকলের নিকটে নিন্দাস্পদ ও ঘৃণাস্পদ হইতেছে, সন্দেহ নাই। এইরূপ চিন্তা করিতেছিলাম এমন সময়ে মৃগয়াজন্য শ্রান্তি দূর করিবার নিমিত্ত তাহারা আমাদিগের আবাসতরুতলের ছায়ায় আসিয়া উপবিষ্ট হইল। অনতিদূরস্থিত সরোবর হইতে জল ও মৃণাল আনিয়া পিপাসা ও ক্ষুধা শান্তি করিল। শ্রান্তি দূর করিয়া চলিয়া গেল।
শবরসৈন্যের মধ্যে এক বৃদ্ধ সে দিন কিছুই শিকার করিতে পারে নাই ও মাংস প্রভৃতি কিছুই পায় নাই; সে উহাদিগের সঙ্গে না গিয়া তরুতলে দণ্ডায়মান থাকিল। সকলে দৃষ্টিপথের অগোচর হইলে, রক্তবর্ণ দুইচক্ষু দ্বারা সেই তরুর মূল অবধি অগ্রভাগ পর্য্যন্ত এক বার নিরীক্ষণ করিল। তাহার নেত্রপতনমাত্রেই কোটরস্থিত পক্ষিশাবকদিগের প্রাণ উড়িয়া গেল। হায়, নৃশংসের অসাধ্য কি আছে! সোপানশ্রেণীতে পাদক্ষেপ পূর্ব্বক অট্টালিকায় যেরূপ অনায়াসে উঠা যায়, নৃশংস কণ্টকাকীর্ণ দুরারোহ সেই প্রকাণ্ড মহীরুহে সেইরূপ অবলীলাক্রমে আরোহণ করিল এবং কোটরে কর প্রসারিত করিয়া পক্ষিশাবকদিগকে ধরিয়া একে একে বহির্গত করিয়া প্রাণসংহারপূর্ব্বক ভূতলে নিক্ষেপ করিতে লাগিল। পিতার একে বৃদ্ধ বয়স, তাহাতে অকস্মাৎ এ বিষম সঙ্কট উপস্থিত হওয়াতে নিতান্ত ভীত হইলেন। ভয়ে কলেবর দ্বিগুণ কাঁপিতে লাগিল এবং তালুদেশ শুষ্ক হইয়া গেল। ইতস্ততঃ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন কিন্তু প্রতীকারের কোন উপায় না দেখিয়া আমাকে পক্ষপুটে আচ্ছাদন করিলেন ও আপন বক্ষস্থলের নিম্নে লুকাইয়া রাখিলেন। আমাকে যখন পক্ষপুটে আচ্ছাদন করেন তখন দেখিলাম তাঁহার নয়নযুগল হইতে জলধারা পড়িতেছে। নৃশংস, ক্রমে ক্রমে আমাদিগের কুলায়ের সমীপবর্ত্তী হইয়া কালসর্পাকার বামকর কোটরে প্রবেশিত করিয়া পিতাকে ধরিল। তিনি চঞ্চুপুট দ্বারা যথাশক্তি আঘাত ও দংশন করিলেন, কিছুতেই ছাড়িল না। কোটর হইতে বহির্গত করিল, যৎপরোনাস্তি যন্ত্রণা দিল, পরিশেষে প্রাণ বিনষ্ট করিয়া নিম্নে নিক্ষেপ করিল। পিতার পক্ষ দ্বারা আচ্ছাদিত ও ভয় সঙ্কুচিত হইয়াছিলাম বলিয়া আমাকে দেখিতে পাইল না। ঐ তরুতলে শুষ্ক পর্ণরাশি একত্রিত ছিল তাহারই উপর পতিত হইলাম, অধিক আঘাত লাগিল না।
অধিক বয়স না হইলে অন্তঃকরণে স্নেহের সঞ্চার হয় না কিন্তু ভয়ের সঞ্চার জন্মাবধিই হইয়া থাকে। শৈশব প্রযুক্ত আমার অন্তঃকরণে স্নেহসঞ্চার না হওয়াতে কেবল ভয়েরই পরতন্ত্র হইলাম। প্রাণ পরিত্যাগের উপযুক্ত কালেও নিতান্ত নৃশংস ও নির্দ্দয়ের ন্যায় উপরত পিতাকে পরিত্যাগ করিয়া পলাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। অস্থির চরণ ও অসমগ্রোদিত পক্ষপুটের সাহায্যে আস্তে আস্তে গমন করিবার উদ্যোগ করাতে বারংবার ভূতলে পড়িতে ও তথা হইতে উঠিতে লাগিলাম। ভাবিলাম বুঝি এ যাত্রায় কৃতান্তের করাল গ্রাস হইতে পরিত্রাণ হইল। পরিশেষে মন্দ মন্দ গমন করিয়া নিকটস্থিত এক তমাল তরুর মূলদেশে লুকাইলাম। এমন সময়ে সেই নৃশংস চণ্ডাল শাল্মলীবৃক্ষ হইতে নামিয়া পক্ষিশাবকদিগকে একত্রিত ও লতাপাশে বদ্ধ করিল এবং যে পথে শবরসৈন্যেরা গিয়াছিল সেই পথ দিয়া চলিয়া গেল।
দূর হইতে পতিত ও ভয়ে নিতান্ত অভিভূত হওয়াতে আমার কলেবর কম্পিত হইতেছিল; আবার বলবতী পিপাসা কণ্ঠশোষ করিল। এতক্ষণে পিশাচ অনেক দূর গিয়া থাকিবে এই সম্ভাবনা করিয়া মুখ বাড়াইয়া চতুর্দ্দিক অবলোকন করিতে লাগিলাম। কোন দিকে কোন শব্দ শুনিবামাত্র অমনি শঙ্কিত হইয়া পদে পদে বিপদ্ আশঙ্কা করিয়া তমালমূল হইতে নির্গত হইলাম ও আস্তে আস্তে গমন করিবার উদ্যোগ করিতে লাগিলাম। যাইতে যাইতে কখন বা পার্শ্বে কখন বা সম্মুখে পতিত হওয়াতে শরীর ধূলিধূসরিত হইল ও ঘন ঘন নিশ্বাস বহিতে লাগিল। তখন মনে মনে চিন্তা করিলাম, কি আশ্চর্য্য! যত দুর্দ্দশা ও যত কষ্ট সহ্য করিতে হউক না কেন, তথাপি কেহ জীবনতৃষ্ণা পরিত্যাগ করিতে পারে না। আমার সমক্ষে পিতা প্রাণত্যাগ করিলেন, স্বচক্ষে দেখিলাম, আমিও বৃক্ষ হইতে পতিত হইয়া বিকলেন্দ্রিয় ও মৃতপ্রায় হইয়াছি; তথাপি বাঁচিবার বিলক্ষণ বাসনা আছে। হায়, আমার তুল্য নির্দ্দয় কে আছে? মাতা প্রসবসময়ে প্রাণ ত্যাগ করিলে পিতা জায়াশোকে নিতান্ত অভিভূত হইয়াও কেবল আমাকেই অবলম্বন করিয়া আমার লালন পালন করিতেছিলেন এবং অত্যন্ত স্নেহ প্রযুক্ত বৃদ্ধ বয়সেও তাদৃশ বিষম ক্লেশ সহ্য করিয়া আমারই রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু আমি সে সকল একবারে বিস্মৃত হইলাম। আমার পর কৃতঘ্ন আর নাই; আমার মত নৃশংস ও দুরাচার এই ভূমণ্ডলে কাহাকেও দেখিতে পাই না। কি আশ্চর্য্য! সেরূপ অবস্থাতে আমার জল পান করিবার অভিলাষ হইল। দূর হইতে সারস ও কলহংসের অনতিপরিস্ফুট কলরব শুনিয়া অনুমান করিলাম সরোবর দূরে আছে। কি রূপে সরোবরে যাইব, কি রূপে জলপান করিয়া প্রাণ বাঁচাইব, অনবরত এইরূপ ভাবিতে লাগিলাম।
এমন সময়ে মধ্যাহ্নকাল উপস্থিত। গগনমণ্ডলের মধ্যভাগ হইতে দিনমণি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় প্রচণ্ড অংশুসমূহ নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। রৌদ্রের উত্তাপে পথ উত্তপ্ত হইল। পথে পাদক্ষেপ করা কাহার সাধ্য? সেই উত্তপ্ত বালুকায় আমার পা দগ্ধ হইতে লাগিল। কোন প্রকারে মরিবার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু সে সময়ে এরূপ কষ্ট ও যাতনা উপস্থিত হইল যে বিধাতার নিকট বারংবার মরণের প্রার্থনা করিতে হইল। চতুর্দ্দিক অন্ধকার দেখিতে লাগিলাম। পিপাসায় কণ্ঠ শুষ্ক ও অঙ্গ অবশ হইল।
সেই স্থানের অনতিদূরে জাবালি নামে পরম পবিত্র মহাতপা মহর্ষি বাস করিতেন। তাঁহার পুত্ত্র হারীত কতিপয় বয়স্য সমভিব্যাহারে সেই দিক্ দিয়া সরোবরে স্নান করিতে যাইতেছিলেন। তিনি এরূপ তেজস্বী যে, হঠাৎ দেখিলে সাক্ষাৎ সূর্য্যদেবের ন্যায় বোধ হয়। তাঁহার মস্তকে জটাভার, ললাটে ভস্মত্রিপুণ্ড্রক, কর্ণে স্ফটিকমালা, বামকরে কমণ্ডলু, দক্ষিণ হস্তে আষাঢ়দণ্ড, স্কন্ধে কৃষ্ণাজিন ও গলদেশে যজ্ঞোপবীত। তাঁহার প্রশান্ত আকৃতি দেখিবামাত্র বোধ হইল যে, পরমকারুণিক ভূতভাবন ভগবান্ ভবানীপতি আমার রক্ষার নিমিত্ত ভূতলে অবতীর্ণ হইলেন। সাধুদিগের চিত্ত স্বভাবতই দয়ার্দ্র। আমার সেইরূপ দুর্দ্দশা ও যন্ত্রণা দেখিয়া তাঁহার অন্তঃকরণে করুণোদয় হইল এবং আমাকে নির্দ্দেশ করিয়া বয়স্যদিগকে কহিলেন দেখ দেখ একটী শুকশিশু পথে পতিত রহিয়াছে। বোধ হয়, এই শাল্মলীতরুর শিখরদেশ হইতে পতিত হইয়া থাকিবে। ঘন ঘন নিশ্বাস বহিতেছে ও বারংবার চঞ্চুপুট ব্যাদান করিতেছে। বোধ হয়, অতিশয় তৃষ্ণাতুর হইয়া থাকিবে। জল না পাইলে আর অধিকক্ষণ বাঁচিবে না। চল, আমরা ইহাকে সরোবরে লইয়া যাই। জল পান করাইয়া দিলে বাঁচিলেও বাঁচিতে পারে। এই বলিয়া আমাকে ভূতল হইতে তুলিলেন। তাঁহার করস্পর্শে আমার উত্তপ্ত গাত্র কিঞ্চিৎ সুস্থ হইল। অনন্তর সরোবরে লইয়া গিয়া আমার মুখ উন্নত ও চঞ্চুপুট বিস্তৃত করিয়া অঙ্গুলির অগ্রভাগ দ্বারা বিন্দু বিন্দু বারি প্রদান করিলেন। জল পান করিয়া পিপাসাশান্তি হইল। পরে আমাকে স্নান করাইয়া নলিনীপত্রের শীতল ছায়ায় বসাইয়া রাখিলেন। অনন্তর ঋষিকুমারেরা স্নানান্তে অর্ঘ্য প্রদান পূর্ব্বক ভগবান্ ভাস্করকে প্রণাম করিলেন এবং আর্দ্র বস্ত্র পরিত্যাগ ও পবিত্র নূতন বসন পরিধান পূর্ব্বক আমাকে গ্রহণ করিয়া তপোবনাভিমুখে মন্দ মন্দ গমন করিতে লাগিলেন।
তপোবন সন্নিহিত হইলে দেখিলাম, তত্রস্থ তরু ও লতা সকল কুসুমিত, পল্লবিত ও ফলভরে অবনত হইয়া রহিয়াছে। এলা ও লবঙ্গলতার কুসুমগন্ধে দিক্ আমোদিত হইতেছে। মধুকর ঝঙ্কার করিয়া এক পুষ্প হইতে অন্য পুষ্পে বসিয়া মধু পান করিতেছে। অশোক, চম্পক, কিংশুক, সহকার, মল্লিকা, মালতী প্রভৃতি নানাবিধ বৃক্ষ ও লতার সমাবেশে এবং তাহাদিগের শাখা ও পল্লবের পরস্পর সংযোগে মধ্যে মধ্যে রমণীয় গৃহ নির্ম্মিত হইয়াছে। উহার অভ্যন্তরে দিনকরের কিরণ প্রবেশ করিতে পারে না। মহর্ষিগণ মন্ত্রপাঠপূর্ব্বক প্রজ্জ্বলিত অনলে ঘৃতাহুতি প্রদান করিতেছেন এবং প্রদীপ্ত অগ্নিশিখার উত্তাপে বৃক্ষের পল্লব সকল মলিন হইয়া যাইতেছে। গন্ধবহ হোমগন্ধ বিস্তারপূর্ব্বক মন্দ মন্দ বহিতেছে। মুনিকুমারেরা কেহ বা উচ্চৈঃস্বরে বেদ উচ্চারণ, কেহ বা প্রশান্ত ভাবে ধর্ম্মশাস্ত্রের আলোচনা করিতেছেন। মৃগকদম্ব নির্ভয়চিত্তে বনের চতুর্দ্দিকে খেলিয়া বেড়াইতেছে। শুকমুখভ্রষ্ট নীবারকণিকা তরুতলে পতিত রহিয়াছে।
তপোবন দেখিয়া আমার অন্তঃকরণ আহ্লাদে পুলকিত হইল। অভ্যন্তরে প্রবেশিয়া দেখিলাম, রক্তপল্লবশোভিত রক্তাশোকতরুর ছায়ায় পরিষ্কৃত পবিত্র স্থানে বেত্রাসনে ভগবান্ মহাতপা মহর্ষি জাবালি বসিয়া আছেন। অন্যান্য মুনিগণ চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিয়া উপবিষ্ট রহিয়াছেন। মহর্ষি অতি প্রাচীন, জরার প্রভাবে মস্তকের জটাভার ও গাত্রের লোম সকল ধবলবর্ণ, কপালে ত্রিবলি, গণ্ডস্থল নিম্ন, শিরা ও পঞ্জরের অস্থি সকল বহির্গত এবং শ্বেতবর্ণ লোমে কর্ণবিবর আচ্ছাদিত। তাঁহার প্রশান্ত গভীর আকৃতি দেখিবামাত্র বোধ হয় যেন, তিনি করুণরসের প্রবাহ, ক্ষমা ও সন্তোষের আধার, শান্তি লতার মূল, ক্রোধভুজঙ্গের মহামন্ত্র, সৎপথের দর্শক এবং সৎস্বভাবের আশ্রয়। তাঁহাকে দেখিয়া আমার অন্তঃকরণে একদা ভয় ও বিস্ময়ের আবির্ভাব হইল। ভাবিলাম মহর্ষির কি প্রভাব! ইঁহার প্রভাবে তপোবনে হিংসা, দ্বেষ, বৈর, মাৎসর্য্য, কিছুই নাই। ভুজঙ্গেরা আতপতাপিত হইয়া শিখীর শিখাকলাপের ছায়ায় সুখে শয়ন করিয়া আছে। হরিণশাবকেরা সিংহশাবকের সহিত সিংহীর স্তন পান করিতেছে। করভ সকল ক্রীড়া করিতে করিতে শুণ্ড দ্বারা সিংহকে আকর্ষণ করিতেছে। মৃগকুল অব্যাকুলচিত্তে বৃকের সহিত একত্র চরিতেছে। এবং শুষ্ক বৃক্ষও মুকুলিত হইয়াছে। বোধ হয় যেন, সত্যযুগ কলিকালের ভয়ে পলাইয়া তপোবনে আসিয়া অবস্থিতি করিতেছে। অনন্তর ইতস্ততঃ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া দেখিলাম, আশ্রমস্থিত তরুগণের শাখায় মুনিদিগের বল্কল শুখাইতেছে, কমণ্ডলু ও জপমালা ঝুলিতেছে এবং মূলদেশে বসিবার নিমিত্ত বেদি নির্ম্মিত হইয়াছে। বোধ হয় যেন, বৃক্ষ সকলও তপস্বিবেশ ধারণপূর্ব্বক তপস্যা করিতে আরম্ভ করিয়াছে।
এই সকল দেখিতেছিলাম, এমন সময়ে মুনিকুমার হারীত আমাকে সেই রক্তাশোকতরুর ছায়ায় বসাইয়া পিতার চরণারবিন্দ বন্দনা পূর্ব্বক স্বতন্ত্র এক আসনে উপবিষ্ট হইলেন। অন্যান্য মুনিকুমারেরা মদ্দর্শনে সাতিশয় কৌতুকাবিষ্ট ও ব্যগ্র হইয়া হারীতকে জিজ্ঞাসা করিলেন, সখে! এই শুকশিশুটী কোথায় পাইলে? হারীত কহিলেন, স্নান করিতে যাইবার সময় পথিমধ্যে দেখিলাম, এই শুকশিশু আপন কুলায় হইতে পতিত হইয়া ভূতলে বিলুণ্ঠিত হইতেছে। ইহাকে তাদৃশ বিষম দুরবস্থাপন্ন দেখিয়া আমার অন্তঃকরণে করুণোদয় হইল। কিন্তু যে বৃক্ষ হইতে পতিত হইয়াছিল, তাহাতে আরোহণ করা আমাদিগের অসাধ্য বোধ হওয়াতে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিয়াছি। এই স্থানে থাকুক, সকলকে যত্নপূর্ব্বক ইহার রক্ষণাবেক্ষণ করিতে হইবে।
হারীতের এই কথা শুনিয়া ভগবান্ জাবালি কুতূহলাক্রান্ত হইয়া আমার প্রতি চক্ষু নিক্ষেপ করিলেন। তাঁহার প্রশান্ত দৃষ্টিপাত মাত্রেই আমি আপনাকে চরিতার্থ ও পবিত্র জ্ঞান করিলাম। তিনি পরিচিতের ন্যায় আমাকে বারংবার নেত্রগোচর করিয়া কহিলেন, এই পক্ষী আপন দুষ্কর্ম্মের ফল ভোগ করিতেছে। সেই মহর্ষি কালত্রয়দর্শী; তপস্যার প্রভাবে ভূত ভবিষ্যৎ, বর্ত্তমানের ন্যায় দেখেন এবং জ্ঞানচক্ষু দ্বারা সমস্ত জগৎ করতলস্থিত বস্তুর ন্যায় দেখিতে পান; সকলে তাঁহার প্রভাব জানিতেন; তাঁহার কথায় কাহারও অবিশ্বাস হইল না। মুনিকুমারেরা ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এ কি দুষ্কর্ম্ম করিয়াছে, কি রূপেই বা তাহার ফল ভোগ করিতেছে? জন্মান্তরে এ কোন্ জাতি ছিল, কেনই বা পক্ষী হইয়া জন্মগ্রহণ করিল। অনুগ্রহ পূর্ব্বক ইহার দুষ্কর্ম্মবৃত্তান্ত বর্ণন করিয়া আমাদিগের কৌতুকাক্রান্ত চিত্তকে পরিতৃপ্ত করুন।
মহর্ষি কহিলেন, সে কথা বিস্ময়জনক ও কৌতুকাবহ বটে, কিন্তু অতি দীর্ঘ; অল্প ক্ষণের মধ্যে সমাপ্ত হইবেক না। এক্ষণে দিবাবসান হইতেছে, আমাকে স্নান করিতে হইবেক। তোমাদিগেরও দেবার্চ্চনসময় উপস্থিত। আহারাদি সমাপন করিয়া সকলে নিশ্চিন্ত হইয়া বসিলে, আমি ইহার আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণন করিব। আমি বর্ণন করিলেই সমুদায় জন্মান্তরবৃত্তান্ত ইহার স্মৃতিপথারূঢ় হইবেক। মহর্ষি এই কথা কহিলে মুনিকুমারেরা গাত্রোত্থান পূর্ব্বক স্নান, পূজা প্রভৃতি সমুদায় দিবসব্যাপার সম্পন্ন করিতে লাগিলেন।
ক্রমে দিবাবসান হইল। মুনিজনেরা রক্তচন্দনসহিত যে অর্ঘ্য দান করিয়াছিলেন, সেই রক্তচন্দনে অনুলিপ্ত হইয়াই যেন, রবি রক্তবর্ণ হইলেন। রবির কিরণ ধরাতল পরিত্যাগ করিয়া কমলবনে, কমলবন ত্যাগ করিয়া তরুশিখরে এবং তদনন্তর পর্ব্বতশৃঙ্গে আরোহণ করিল। বোধ হইল যেন, পর্ব্বতশিখর সুবর্ণে মণ্ডিত হইতেছে। রবি অস্তগত হইলে সন্ধ্যা উপস্থিত হইল। সন্ধ্যাসমীরণে তরুশাখা সকল সঞ্চালিত হইলে বোধ হইল যেন, তরুগণ বিহগদিগকে নিজ নিজ কুলায়ে আগমন করিবার নিমিত্ত অঙ্গুলীসঙ্কেত দ্বারা আহ্বান করিল। বিহগকুলও কলরব করিয়া যেন তাহার উত্তর প্রদান করিল। মুনিজনেরা ধ্যানে বসিলেন ও বদ্ধাঞ্জলি হইয়া সন্ধ্যার উপাসনা করিতে লাগিলেন। দুহ্যমান হোমধেনুর মনোহর মুগ্ধধারাধ্বনি আশ্রমের চতুর্দ্দিক্ ব্যাপ্ত করিল। হরিদ্বর্ণ কুশদ্বারা অগ্নিহোত্রবেদি আচ্ছাদিত হইল। দিনের বেলায় দিনকরের ভয়ে গিরিগুহার অভ্যন্তরে লুকাইয়া ছিল, এই সময় সময় পাইয়া অন্ধকার তথা হইতে সহসা বহির্গত হইল। সন্ধ্যা ক্ষয় প্রাপ্ত হইলে তাহার শোকে দুঃখিত ও তিমিররূপ মলিন বসনে অবগুণ্ঠিত হইয়া বিভাবরী আগমন করিল। ভাস্করের প্রতাপে গ্রহগণ তস্করের ন্যায় ভয়ে লুকাইয়া ছিল, অন্ধকার পাইয়া অমনি গগনমার্গে বহির্গত হইল। পূর্ব্বদিগ্ভাগে সুধাংশুর অংশু অল্প অল্প দৃষ্টিগোচর হওয়াতে বোধ হইল যেন, প্রিয়সমাগমে আহ্লাদিত হইয়া পূর্ব্ব দিক্ দশনবিকাশ পূর্ব্বক মন্দ মন্দ হাসিতেছে। প্রথমে কলামাত্র, ক্রমে অর্দ্ধমাত্র, ক্রমে ক্রমে সম্পূর্ণমণ্ডল শশধর প্রকাশিত হওয়াতে সমুদায় তিমির বিনষ্ট হইয়া গেল। কুমুদিনী বিকসিত হইল। মন্দ মন্দ সন্ধ্যাসমীরণ সুখাসীন আশ্রমমৃগগণকে আহ্লাদিত করিল। জীবলোক আনন্দময়, কুমুদ গন্ধময় ও তপোবন জ্যোৎস্নাময় হইল। ক্রমে ক্রমে চারি দণ্ড রাত্রি হইল।
হারীত আহারাদি সমাপন করিয়া আমাকে লইয়া ঋষিকুমারদিগের সমভিব্যাহারে পিতার সন্নিধানে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, তিনি বেত্রাসনে বসিয়া আছেন; জালপাদনামা শিষ্য তালবৃন্ত ব্যজন করিতেছেন। হারীত পিতার সম্মুখে কৃতাঞ্জলিপুটে দণ্ডায়মান হইয়া বিনয় বচনে কহিলেন, তাত! আমরা সকলেই এই শুকশিশুর বৃত্তান্ত শুনিতে অতিশয় উৎসুক। আপনি অনুগ্রহ পূর্ব্বক বর্ণন করিলে কৃতার্থ হই।
মুনিকুমারেরা সকলেই কৌতুকাক্রান্ত ও একাগ্রচিত্ত হইয়াছেন দেখিয়া মহর্ষি কথা আরম্ভ করিলেন।
২.০১ কথারম্ভ – অবন্তি দেশে উজ্জয়িনী নামে নগরী
অবন্তি দেশে উজ্জয়িনী নামে নগরী আছে। যে স্থানে ভুবনত্রয়ের সর্গস্থিতিসংহারকারী মহাকালাভিধান ভগবান্ দেবাদিদেব মহাদেব অবস্থিতি করেন। যে স্থানে শিপ্রানদী তরঙ্গরূপ ভ্রুকুটি বিস্তার পূর্ব্বক ভাগীরথীর প্রতি উপহাস করিয়া বেগবতী হইয়া প্রবাহিত হইতেছে। তথায় তারাপীড় নামে মহাযশস্বী তেজস্বী প্রবলপ্রতাপ নরপতি ছিলেন। তিনি অর্জ্জুনের ন্যায় নিজভুজবলে অখণ্ড ভূমণ্ডল জয় ও প্রজাগণের ক্লেশ দূর করিয়া সুখে রাজ্য ভোগ করেন। তাঁহার গুণে বশীভূত হইয়া লক্ষ্মী কমলবন তুচ্ছ করিয়া, নারায়ণবক্ষঃস্থল পরিত্যাগ করিয়া, তাঁহাকেই গাঢ় আলিঙ্গন করিয়াছিলেন; সরস্বতী চতুর্ম্মুখের মুখপরম্পরায় বাস করা ক্লেশকর বোধ করিয়া তাঁহারই রসনামণ্ডলে সুখে অবস্থিতি করিয়াছিলেন। তাঁহার অমাত্যের নাম শুকনাস। শুকনাস ব্রাহ্মণকুলে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি সকল শাস্ত্রের পারদর্শী, নীতিশাস্ত্রপ্রয়োগকুশল, ভূভারধারণক্ষম, অগাধবুদ্ধি, ধীরপ্রকৃতি, সত্যবাদী ও জিতেন্দ্রিয়। তাঁহার পত্নীর নাম মনোরমা। ইন্দ্রের বৃহস্পতি, নলের সুমতি, দশরথের বশিষ্ঠ ও রামচন্দ্রের বিশ্বামিত্র যেরূপ উপদেষ্টা ছিলেন; শুকনাসও সেইরূপ রাজকার্য্য পর্য্যালোচনাবিষয়ে রাজাকে যথার্থ সদুপদেশ দিতেন। মন্ত্রীর বুদ্ধি এরূপ তীক্ষ্ণ যে জটিল ও দুরবগাহ কোন কার্য্যসঙ্কট উপস্থিত হইলেও বিচলিত বা প্রতিহত হইত না। শৈশবাবধি অকৃত্রিম প্রণয় সঞ্চার হওয়াতে রাজা তাঁহাকে কোন বিষয়ে অবিশ্বাস করিতেন না। তিনিও বিশুদ্ধ অন্তঃকরণে নৃপতির হিত কার্য্য অনুষ্ঠানে তৎপর ছিলেন। পৃথিবীতে তুল্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না এবং প্রজাদিগের উৎপাত ও অসুখ আকাশকুসুমের ন্যায় অলীক পদার্থ হইয়াছিল, সুতরাং সকল বিষয়ে নিশ্চিন্ত হইয়া শুকনাসের প্রতি রাজ্যশাসনের ভার সমর্পণ পূর্ব্বক রাজা যৌবনসুখ অনুভব করিতেন। কখন জলবিহার, কখন বনবিহার, কখন বা নৃত্য, গীত, বাদ্যের আমোদে সুখে কাল হরণ করেন। শুকনাস সেই অসীম সাম্রাজ্যকার্য্য অনায়াসে সুশৃঙ্খলরূপে সম্পন্ন করিতেন। তাঁহার অপক্ষপাতিতা ও সদ্বিচারগুণে প্রজারা অত্যন্ত বশীভূত ও অনুরক্ত হইয়াছিল।
তারাপীড় এইরূপে সকল সুখের পার প্রাপ্ত হইয়াও সন্তানমুখাবলোকনরূপ সুখলাভ না হওয়াতে মনে মনে অতিশয় দুঃখিত থাকেন। সন্তান না হওয়াতে সংসারে অরণ্য জ্ঞান, জীবনে বিড়ম্বনা জ্ঞান ও শরীর ভারমাত্র বলিয়া বোধ হইয়াছিল এবং আপনাকে অসহায়, অনাশ্রয় ও হতভাগ্য বিবেচনা করিতেন। ফলতঃ তাঁহার পক্ষে সংসার অসার ও অন্ধকার রূপে প্রতীয়মান হইয়াছিল। নৃপতির বিলাসবতীনাম্নী পরমরূপবতী পত্নী ছিলেন। কন্দর্পের রতি ও শিবের পার্ব্বতী যেরূপ পরমপ্রণয়িনী, বিলাসবতীও সেইরূপ রাজার পরমপ্রণয়াস্পদ ছিলেন। একদা মহিষী অতিশয় দুঃখিত অন্তঃকরণে অন্তঃপুরে বসিয়া আছেন, এমন সময়ে নরপতি তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, মহিষী বামকরতলে কপোলদেশ সংস্থাপিত করিয়া বিষণ্ণ বদনে রোদন করিতেছেন; অঙ্গের ভূষণ অঙ্গ হইতে উন্মোচন করিয়া ফেলিয়া দিয়াছেন; অঙ্গরাগ বা অঙ্গসংস্কার কিছুমাত্র নাই। সখীগণ নিঃশব্দে ও দুঃখিত চিত্তে পার্শ্বে বসিয়া আছে। অন্তঃপুরবৃদ্ধারা অনতিদূরে উপবিষ্ট হইয়া প্রবোধবাক্যে আশ্বাস প্রদান করিতেছে। রাজা গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিলে মহিষী আসন হইতে উঠিয়া সম্ভাষণ করিলেন। রাজাকে দেখিয়া তাঁহার দুঃখ দ্বিগুণতর হইল ও দুই চক্ষু দিয়া অশ্রুধারা পড়িতে লাগিল। মহিষীর আকস্মিক শোক ও রোদনের কারণ কিছু বুঝিতে না পারিয়া নরপতি মনে মনে কত ভাবনা, কত শঙ্কা ও কল্পনা করিতে লাগিলেন। পরে আসনে উপবিষ্ট হইয়া বসন দ্বারা চক্ষুর জল মুছাইয়া দিয়া মধুর বাক্যে জিজ্ঞাসা করিলেন, প্রিয়ে! কি নিমিত্ত বামকরে বামগণ্ড সংস্থাপন করিয়া বিষণ্ণবদনে ও দীননয়নে রোদন করিতেছ? তোমার দুঃখের কারণ কিছু জানিতে না পারিয়া আমার অন্তঃকরণ অতিশয় ব্যাকুল ও বিষণ্ণ হইতেছে। আমি কি কোন অপরাধ করিয়াছি? অথবা অন্য কেহ প্রজ্বলিত অনলশিখায় হস্তক্ষেপ করিয়া থাকিবেক? যাহা হউক শোকের কারণ বর্ণন করিয়া আমার উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দূর কর।
রাজা এত অনুনয় করিলেন, বিলাসবতী কিছুই উত্তর দিলেন না—বরং আরও শোকাকুল হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন। রাজ্ঞীর তাম্বুলকরঙ্কবাহিনী বদ্ধাঞ্জলি হইয়া নিবেদন করিল, মহারাজ! আপনি কোন অপরাধ করেন নাই এবং রাজমহিষীর নিকটে অন্যে অপরাধ করিবে এ কথাও অসম্ভব। মহিষী যে নিমিত্ত রোদন করিতেছেন তাহা শ্রবণ করুন। সন্তানের মুখাবলোকনরূপ সুখ লাভে বঞ্চিত হইয়া রাণী বহুদিবসাবধি শোকাকুল ছিলেন। কিন্তু মহারাজের মনঃপীড়া হইবে বলিয়া এত দিন দুঃখ প্রকাশ করেন নাই; মনের দুঃখ মনেই গোপন করিয়া রাখিয়াছিলেন। অদ্য চতুর্দ্দশী, মহাদেবের পূজা দিতে মহাকালের মন্দিরে গিয়াছিলেন, তথায় মহাভারত পাঠ হইতেছিল, তাহাতেই শুনিলেন সন্তানবিহীন ব্যক্তিদিগের সদ্গতি হয় না; পুত্ত্র না জন্মিলে পুন্নাম নরক হইতে উদ্ধারের উপায়ান্তর নাই, পুত্ত্রহীন ব্যক্তির ইহলোকে সুখ ও পরলোকে পরিত্রাণ পাইবার সম্ভাবনা নাই; তাহার জীবন, ধন, ঐশ্বর্য্য, সকলই নিষ্ফল। মহাভারতের এই কথা শুনিয়া অবধি রাজ্ঞী অতিশয় উন্মনা ও উৎকণ্ঠিতা হইলেন। বাটী আসিলে সকলে নানাপ্রকার প্রবোধ বাক্যে সান্ত্বনা করিল ও আহার করিতে অনুরোধ করিল; কোন ক্রমেই শান্ত হইলেন না ও আহার করিলেন না। সেই অবধি কাহারও কোন কথার উত্তর দেন না, কাহারও সহিত আলাপ করেন না। কেবল বিষণ্ণবদনে অনবরত রোদন করিতেছেন। এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য করুন।
তাম্বুলকরঙ্কবাহিনীর কথা শুনিয়া রাজা ক্ষণকাল নিস্তব্ধ ও নিরুত্তর হইয়া রহিলেন। পরে দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কহিলেন, দেবি! দৈবায়ত্ত বিষয়ে শোক ও অনুতাপ করা কোন ক্রমেই বিধেয় নহে। মনুষ্যেরা যত যত্ন ও যত চেষ্টা করুক না কেন, দৈব অনুকূল না হইলে কোন প্রকারে মনোরথ সফল হয় না। পুত্ত্রের আলিঙ্গনে শরীর শীতল হইবে, মুখারবিন্দদর্শনে নেত্র পবিত্র হইবে, অপরিস্ফুট মধুর বচন শ্রবণে কর্ণ জুড়াইবে এমন কি পুণ্য কর্ম্ম করিয়াছি! জন্মান্তরে কত পাপ করিয়া থাকিব, সেই জন্যে এত মনস্তাপ উপস্থিত হইতেছে। দৈব অনুকূল না হইলে কোন অভীষ্টসিদ্ধির সম্ভাবনা নাই। অতএব দৈব কর্ম্মে অত্যন্ত অনুরক্ত হও। মনোযোগপূর্ব্বক গুরুভক্তি, দেবপূজা ও মহর্ষিদিগের পরিচর্য্যা কর। অবিচলিত ও অকৃত্রিম ভক্তিপূর্ব্বক ধর্ম্মকর্ম্মের অনুষ্ঠান কর। পুরাণে শুনিয়াছি, মগধদেশের রাজা বৃহদ্রথ সন্তানলাভের আশয়ে চণ্ডকৌশিকের আরাধনা করেন এবং তাঁহার বরপ্রভাবে জরাসন্ধনামে প্রবলপরাক্রান্ত এক পুত্ত্র প্রাপ্ত হন। রাজা দশরথ মহর্ষি ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রসন্ন করিয়া রাম, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন নামে মহাবলপরাক্রান্ত চারি পুত্ত্র লাভ করেন। ঋষিগণের আরাধনা কখন বিফল হয় না, অবশ্যই তাহার ফল দর্শে, সন্দেহ নাই। দৃঢ়ব্রত ও একান্ত অনুরক্ত হইয়া ভক্তিসহকারে দেব ও দেবর্ষিদিগের অর্চ্চনা কর তাহাতেই মনোরথ সফল হইবেক। হায়! কত দিনে সেই শুভ দিনের উদয় হইবে, যে দিনে স্নেহময় ও প্রীতিময় সন্তানের সুধাময় মুখচন্দ্র অবলোকন করিয়া জীবন ও নয়ন চরিতার্থ করিব; পরিজনেরা আনন্দে পূর্ণপাত্র গ্রহণ করিবে; নগর উৎসবময় হইয়া নৃত্য, গীত, বাদ্যের কোলাহলে পরিপূর্ণ হইবেক, শশিকলা উদিত হইলে গগনমণ্ডলের যেরূপ শোভা হয়, কত দিনে দেবী পুত্ত্র ক্রোড়ে করিয়া সেইরূপ শোভিত হইবেন; নিরপত্যতা এক্ষণে অতিশয় ক্লেশ দিতেছে। সংসার অরণ্য ও জগৎ শূন্য দেখিতেছি; রাজ্য ও ঐশ্বর্য্য নিষ্ফল বোধ হইতেছে। কিন্তু অপ্রতিবিধেয় বিষয়ে শোক ও দুঃখ করা বৃথা বলিয়াই ধৈর্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক যথাকথঞ্চিৎ সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিতেছি। এইরূপ নানা প্রবোধবাক্যে আশ্বাস দিয়া স্বহস্তে মহিষীর নেত্রজল মোচন করিয়া দিলেন। অনেক ক্ষণ অন্তঃপুরে থাকিয়া পরে বহির্গত হইলেন।
রাজা অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইলে বিলাসবতী প্রবোধবাক্যে কিঞ্চিৎ শান্ত হইয়া স্নান ভোজনাদি সমাপন করিলেন। যে সকল আভরণ ফেলিয়া দিয়াছিলেন তাহা পুনর্ব্বার অঙ্গে ধারণ করিলেন। তদবধি দেবতার আরাধনা, ব্রাহ্মণের সেবা ও গুরু জনের পরিচর্য্যায় অতিশয় অনুরক্ত হইলেন। দৈবকর্ম্মে অনুরক্ত হইয়া চণ্ডিকার গৃহে প্রতিদিন ধূপ গুগ্গুল প্রভৃতি সুগন্ধ দ্রব্যের গন্ধ বিস্তার করেন। দিবসবিশেষে তথায় কুশাসনে শয়ন করিয়া থাকেন। প্রতিদিন প্রাতঃকালে ব্রাহ্মণদিগকে স্বর্ণপাত্র দান করেন। কৃষ্ণপক্ষীয় চতুর্দ্দশী রজনীতে চতুষ্পথে দেবতাদিগকে বলি উপহার দেন। অশ্বত্থ প্রভৃতি বনস্পতিদিগকে প্রদক্ষিণ করেন। ষোড়শোপচারে ষষ্ঠীদেবীর পূজা দেন। ফলতঃ যে যেরূপ ব্রতের অনুষ্ঠান করিতে কহে, অতিশয় ক্লেশসাধ্য হইলেও অপত্যতৃষ্ণায় উহার অনুষ্ঠান করেন, কিছুতেই পরাঙ্মুখ হয়েন না। গণক অথবা সিদ্ধপুরুষ দেখিলে সমাদর পূর্ব্বক সন্তানের গণনা করান। রাত্রিতে যে সকল স্বপ্ন দেখেন, প্রভাতে পুরন্ধ্রীদিগকে তাহার ফলাফল জিজ্ঞাসা করেন।
এই রূপে কিছুদিন অতীত হইলে, একদা রাত্রিশেষে রাজা স্বপ্নে দেখিলেন, বিলাসবতী সৌধশিখরে শয়ন করিয়া আছেন, তাঁহার মুখমণ্ডলে পূর্ণচন্দ্র প্রবেশ করিতেছে। স্বপ্নদর্শনানন্তর অমনি জাগরিত হইয়া শীঘ্র শয্যা হইতে উঠিলেন। অনন্তর শুকনাসকে আহ্বান করিয়া তাঁহার সাক্ষাতে স্বপ্নবৃত্তান্ত বর্ণন করিলেন। শুকনাস শুনিয়া অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন ও প্রীতিপ্রফুল্ল বদনে কহিলেন, মহারাজ! বুঝি অনেক কালের পর আমাদিগের মনোরথ পূর্ণ হইল। অচিরাৎ আপনি পুত্ত্রমুখ নিরীক্ষণ করিয়া আনন্দিত হইবেন, সন্দেহ নাই। আমিও আজি রজনীতে স্বপ্নে প্রশান্তমূর্ত্তি, দিব্যাকৃতি এক ব্রাহ্মণকে মনোরমার উৎসঙ্গে বিকসিত পুণ্ডরীক নিক্ষেপ করিতে দেখিয়াছি। শাস্ত্রকারেরা কহেন, শুভ ফলোদয়ের পূর্ব্বে শুভ লক্ষণ সকল দেখিতে পাওয়া যায়। যদি আমাদিগের চিরপ্রার্থিত মনোরথ সম্পন্ন হয়, তাহা হইলে, ইহা অপেক্ষা আহ্লাদের বিষয় কি আছে? রাত্রিশেষে যে স্বপ্ন দেখা যায় তাহা প্রায় বিফল হয় না। রাজমহিষী বিলাসবতী অচিরাৎ পুত্ত্রসন্তান প্রসব করিবেন, সন্দেহ নাই। রাজা মন্ত্রীর স্বপ্নবৃত্তান্ত শ্রবণে অধিকতর আহ্লাদিত হইলেন এবং তাঁহার হস্তধারণ পূর্ব্বক অন্তঃপুরে প্রবেশিয়া উভয়েই আপন আপন স্বপ্নবৃত্তান্ত বর্ণন দ্বারা রাজমহিষীর আনন্দোৎপাদন করিলেন।
কিছু দিন পরে বিলাসবতী গর্ভবতী হইলেন। শশধরের প্রতিবিম্ব পতিত হইলে সরোবর যেরূপ উজ্জ্বল হয়, পারিজাত কুসুম বিকসিত হইলে নন্দনবনের যেরূপ শোভা হয়, বিলাসবতী গর্ভ ধারণ করিয়া সেইরূপ অপূর্ব্বশ্রী প্রাপ্ত হইলেন। দিন দিন গর্ভের উপচয় হইতে লাগল। সলিলভারাক্রান্ত মেঘমালার ন্যায় বিলাসবতী গর্ভভারে মন্থরগতি হইলেন। মুখে বারংবার জৃম্ভিকা ও জল উঠিতে লাগিল। শরীর অলস ও পাণ্ডুবর্ণ হইল। এই সকল লক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া পরিজনেরা অনায়াসেই বুঝিতে পারিল রাণী গর্ভিণী হইয়াছেন।
একদা প্রদোষ সময়ে শুকনাস ও রাজা রাজভবনে বসিয়া আছেন এমন সময়ে কুলবর্দ্ধনানাম্নী প্রধান পরিচারিকা তথায় উপস্থিত হইয়া রাজার কর্ণে মহিষীর গর্ভসঞ্চারের সংবাদ কহিল। নরপতি শুভ সংবাদ শুনিয়া আনন্দের পরাকাষ্ঠা প্রাপ্ত হইলেন। আহ্লাদে কলেবর রোমাঞ্চিত ও কপোলমূল বিকসিত হইয়া উঠিল। তখন হর্ষোৎফুল্ল লোচনে শুকনাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করাতে তিনি রাজার ও কুলবর্দ্ধনার আকৃতি দেখিয়াই অনুমান করিলেন রাজার অভীষ্ট সিদ্ধ হইয়াছে। তথাপি সন্দেহনিবারণের নিমিত্ত জিজ্ঞাসা করিলেন, মহারাজ! স্বপ্নদর্শন কি সফল হইয়াছে? রাজা কিঞ্চিৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, যদি কুলবর্দ্ধনার কথা মিথ্যা না হয় তাহা হইলে স্বপ্ন সফল বটে। চল, আমরা স্বয়ং গিয়া জানিয়া আসি। এই কথা বলিয়া গাত্র হইতে উন্মোচন করিয়া শুভ সংবাদের পারিতোষিকস্বরূপ বহুমূল্য অলঙ্কার কুলবর্দ্ধনাকে দিয়া বিদায় করিলেন। আপনারাও মহিষীর বাসভবনে চলিলেন। যাইতে যাইতে রাজার দক্ষিণ লোচন স্পন্দিত হইল।
তথায় গিয়া দেখিলেন, মহিষী গর্ভোচিত কোমল শয্যায় শয়ন করিয়া আছেন, গর্ভে সন্তানের উদয় হওয়াতে মেঘাবৃতশশিমণ্ডলশালিনী রজনীর ন্যায় শোভা পাইতেছেন। শিরোভাগে মঙ্গলকলস রহিয়াছে, চতুর্দ্দিকে মণির প্রদীপ জ্বলিতেছে এবং গৃহে শ্বেত সর্ষপ বিকীর্ণ আছে। রাণী রাজাকে দেখিয়া সসম্ভ্রমে শয্যা হইতে উঠিবার চেষ্টা করিতেছিলেন, রাজা বারণ করিয়া কহিলেন, প্রিয়ে! আর কষ্ট পাইবার প্রয়োজন নাই। বিনা অভ্যুত্থানেই যথেষ্ট আদর প্রকাশ হইয়াছে। এই বলিয়া শয্যার এক পার্শ্বে বসিলেন। শুকনাস স্বতন্ত্র এক স্থানে উপবেশন করিলেন। রাজা মহিষীর আকার প্রকার দেখিয়াই গর্ভলক্ষণ জানিতে পারিলেন; তথাপি পরিহাস পূর্ব্বক কহিলেন, প্রিয়ে! শুকনাস জিজ্ঞাসা করিতেছেন, কুলবর্দ্ধনা যাহা কহিয়া আসিল সত্য কি না? মহিষী লজ্জায় নম্রমুখী হইয়া কিঞ্চিৎ হাস্য করিলেন। বারংবার জিজ্ঞাসা ও অনুরোধ করাতে কহিলেন, কেন আর আমাকে লজ্জা দাও, আমি কিছুই জানি না; এই বলিয়া পুনর্ব্বার অধোমুখী হইলেন। এইরূপ অনেক পরিহাসকথার পর শুকনাস আপন আলয়ে প্রস্থান করিলেন।
ক্রমে ক্রমে গর্ভের উপচয় হওয়াতে মহিষীর যে কিছু গর্ভদোহদ হইতে লাগিল রাজা তৎক্ষণাৎ সম্পাদন করিতে লাগিলেন। প্রসবসময় সমাগত হইলে মহিষী শুভ দিনে শুভ লগ্নে এক পুত্ত্র সন্তান প্রসব করিলেন। নরপতির পুত্ত্র হইয়াছে শুনিয়া নগরবাসী লোকের আহ্লাদের পরিসীমা রহিল না। রাজবাটী মহোৎসবময়, নগর আনন্দময় ও পথ কোলাহলময় হইল। গৃহে গৃহে নৃত্য, গীত, বাদ্য, আরম্ভ হইল। নরপতি সানন্দ চিত্তে দীন, দুঃখী, অনাথ প্রভৃতিকে অর্থ দান করিতে লাগিলেন। যে যাহা আকাঙ্ক্ষা করিল তাহাকে তাহাই দিলেন। কারাবদ্ধকে মুক্ত ও ধনহীনকে ঐশ্বর্য্যশালী করিলেন।
গণকেরা গণনা দ্বারা শুভলগ্ন স্থির করিয়া দিলে নরপতি পুত্ত্রমুখ নিরীক্ষণ করিবার নিমিত্ত মন্ত্রীর সহিত গৃহে গমন করিলেন। দেখিলেন, সূতিকাগৃহের দ্বারদেশে দুই পার্শ্বে সলিলপূর্ণ দুই মঙ্গলকলস, স্তম্ভের উপরিভাগে বিচিত্র কুসুমে গ্রথিত মঙ্গলমালা। পুরন্ধ্রীবর্গ কেহ বা ষষ্ঠীদেবীর পূজা করিতেছে, কেহ বা মাতৃকাগণের বিচিত্র মূর্ত্তি চিত্রপটে লিখিতেছে। ব্রাহ্মণেরা মন্ত্র পাঠ পূর্ব্বক সূতিকাগৃহের অভ্যন্তরে শান্তিজল নিক্ষেপ করিতেছেন। পুরোহিতেরা নারায়ণের সহস্র নাম পাঠ করিয়া শুভ স্বস্ত্যয়ন করিতেছেন। রাজা জল ও অনল স্পর্শ পূর্ব্বক সূতিকাগৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, রাজকুমার মহিষীর অঙ্কে শয়ন করিয়া সূতিকাগৃহ উজ্জ্বল করিয়া রহিয়াছেন। দেহপ্রভায় দীপপ্রভা তিরোহিত হইয়াছে। এরূপ অঙ্গসৌষ্ঠব ও রূপলাবণ্য, যে হঠাৎ দেখিলে বোধ হয় যেন, সাক্ষাৎ কুমার রাজকুমাররূপে অবতীর্ণ হইয়াছেন। রাজা নিমেষশূন্য লোচনে বারংবার দেখিতে লাগিলেন, কিন্তু অন্তঃকরণ তৃপ্ত হইল না। যত বার দেখেন অদৃষ্টপূর্ব্ব ও অভিনব বোধ হয়। সস্পৃহ ও প্রীতিবিস্ফারিত নেত্র দ্বারা পুনঃপুনঃ অবলোকন করিয়া নব নব আনন্দ অনুভব করিতে লাগিলেন এবং আপনাকে চরিতার্থ ও পরমসৌভাগ্যশালী জ্ঞান করিলেন। শুকনাস সতর্কতা পূর্ব্বক বিস্ময়বিকসিত নয়নে রাজকুমারের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিলক্ষণ রূপে পরীক্ষা করিয়া কহিলেন, মহারাজ! দেখুন, কুমারের অঙ্গে চক্রবর্ত্তী ভূপতির লক্ষণ সকল লক্ষিত হইতেছে। করতলে শঙ্খচক্ররেখা, চরণতলে পতাকারেখা, প্রশস্ত ললাট, দীর্ঘ লোচন, উন্নত নাসিকা, লোহিত অধর এই সকল চিহ্ন দ্বারা মহাপুরুষলক্ষণ প্রকাশ পাইতেছে।
মন্ত্রী রাজকুমারের এইরূপ রূপ বর্ণনা করিতেছেন এমন সময়ে মঙ্গলকনামা এক পুরুষ প্রবেশিয়া রাজাকে নমস্কার করিল ও হর্ষোৎফুল্ললোচনে কহিল, মহারাজ! মনোরমার গর্ভে শুকনাসের এক পুত্ত্র সন্তান জন্মিয়াছে। নরপতি এই শুভ সংবাদ শ্রবণ করিয়া অমৃতবৃষ্টিতে অভিষিক্ত হইলেন এবং আহ্লাদিত চিত্তে কহিলেন, আজি কি শুভ দিন, কি শুভ সংবাদ শুনিলাম! বিপদ্ বিপদের ও সম্পদ সম্পদের অনুসরণ করে এই জনপ্রবাদ কখন মিথ্যা নহে। এই বলিয়া প্রীতিবিকসিত মুখে হাসিতে হাসিতে সমাগত পুরুষকে শুভ সংবাদের অনুরূপ পারিতোষিক দিয়া বিদায় করিলেন। পরে নর্ত্তক, বাদক ও গায়কগণ সমভিব্যাহারে শুকনাসের মন্দিরে গমন করিয়া মহামহোৎসবে প্রবৃত্ত হইলেন। দশম দিবসে পবিত্র মুহূর্ত্তে কোটি কোটি গাভী ও সুবর্ণ ব্রাহ্মণসাৎ করিয়া ও দীন দুঃখীকে অনেক ধন দিয়া নরপতি পুত্ত্রের নামকরণ করিলেন। স্বপ্নে দেখিয়াছিলেন, পূর্ণচন্দ্র রাজ্ঞীর মুখমণ্ডলে প্রবেশ করিতেছে, সেই নিমিত্ত পুত্ত্রের নাম চন্দ্রাপীড় রাখিলেন। মন্ত্রীও আপন ব্রাহ্মণোচিত সমস্ত ক্রিয়া সম্পাদন পূর্ব্বক রাজার অভিমতে আপন পুত্ত্রের নাম বৈশম্পায়ন রাখিলেন। ক্রমে চূড়াকরণ প্রভৃতি সমুদায় সংস্কার সম্পন্ন হইল।
২.০২ কুমারের ক্রীড়ায় কালক্ষেপ
কুমারের ক্রীড়ায় কালক্ষেপ না হয় এই নিমিত্ত রাজা নগরের প্রান্তে শিপ্রানদীর তীরে এক বিদ্যামন্দির প্রস্তুত করাইলেন। বিদ্যামন্দিরের এক পার্শ্বে অশ্বশালা ও নিম্নে ব্যায়ামশালা প্রস্তুত হইল; চতুর্দ্দিক্ উন্নত প্রাচীর দ্বারা পরিবৃত হইল। অশেষবিদ্যাপারদর্শী মহামহোপাধ্যায় অধ্যাপকগণ অতিযত্নে আনীত ও শিক্ষাপ্রদানে নিয়োজিত হইলেন। নরপতি শুভ দিনে স্বপুত্ত্র চন্দ্রাপীড় ও মন্ত্রিপুত্ত্র বৈশম্পায়নকে তাঁহাদিগের নিকটে সমর্পণ করিলেন। প্রতিদিন মহিষীর সহিত স্বয়ং বিদ্যামন্দিরে উপস্থিত হইয়া তত্ত্বাবধান করিতে লাগিলেন। রাজকুমার এরূপ বুদ্ধিমান্ ও চতুর ছিলেন যে, অধ্যাপকগণ তাঁহার নব নব বুদ্ধি-কৌশল দর্শনে চমৎকৃত ও উৎসাহিত হইয়া সমধিক পরিশ্রম স্বীকার পূর্ব্বক শিক্ষা দিতে লাগিলেন। তিনিও অনন্যমনা ও ক্রীড়াসক্তিরহিত হইয়া ক্রমে ক্রমে সমস্ত বিদ্যা অধ্যয়ন করিলেন। তাঁহার হৃদয়দর্পণে সমুদায় কলা সংক্রান্ত হইল। অল্পকালের মধ্যেই শব্দশাস্ত্র, বিজ্ঞানশাস্ত্র, রাজনীতি, ব্যায়ামকৌশল, অস্ত্র ও সঙ্গীত বিদ্যা, সর্ব্বদেশভাষা এবং কাব্য, নাটক, ইতিহাস প্রভৃতি সমুদায় শিখিলেন। ব্যায়ামপ্রভাবে শরীর এরূপ বলিষ্ঠ হইল যে, করভ সকল সিংহ দ্বারা আক্রান্ত হইলে যেরূপ নড়িতে পারে না, সেইরূপ তিনি ধরিলেও এক পা চলিতে পারিত না। ফলতঃ এরূপ পরাক্রান্ত ও শক্তিশালী হইলেন যে, দশজন বলবান্ পুরুষ যে মুদ্গর তুলিতে পারেন না, তিনি অবলীলাক্রমে সেই মুদ্গর ধারণ পূর্ব্বক ব্যায়াম করিতেন।
ব্যায়াম ব্যতিরেকে আর সকল বিদ্যায় বৈশম্পায়ন চন্দ্রাপীড়ের অনুরূপ হইলেন। শৈশবাবধি একত্র বিদ্যাভ্যাস প্রযুক্ত পরস্পরের অকৃত্রিম প্রণয় ও অকপট মিত্রতা জন্মিল। বৈশম্পায়ন ব্যতিরেকে রাজকুমার একমুহূর্ত্তও একাকী থাকিতে পারিতেন না। বৈশম্পায়ন সর্ব্বদা রাজকুমারের নিকটবর্ত্তী থাকিতেন। এই রূপে বিদ্যালয়ে বিদ্যাভ্যাস করিতে করিতে শৈশবকাল অতীত ও যৌবনকাল সমাগত হইল। চন্দ্রোদয়ে প্রদোষের যেরূপ রমণীয়তা হয়, গগনমণ্ডলে ইন্দ্রধনু উদিত হইলে বর্ষাকালের যেরূপ শোভা হয়, কুসুমোদ্গমে কল্পপাদপের যেরূপ শ্রী হয়, যৌবনারম্ভে রাজকুমার সেইরূপ পরমরমণীয়তা ধারণ করিলেন। বক্ষঃস্থল বিশাল, ঊরুযুগল মাংসল, মধ্যভাগ ক্ষীণ, ভুজদ্বয় দীর্ঘ, স্কন্ধদেশ স্থূল এবং স্বর গম্ভীর হইল।
উত্তম রূপে বিদ্যাশিক্ষা হইলে আচার্য্যেরা বিদ্যালয় হইতে গৃহে যাইবার অনুমতি দিলেন। তদনুসারে রাজা চন্দ্রাপীড়কে বাটীতে আনাইবার নিমিত্ত শুভ দিনে অনেক তুরঙ্গ, মাতঙ্গ, পদাতি সৈন্য, সমভিব্যাহারে দিয়া সেনাধ্যক্ষ বলাহককে বিদ্যামন্দিরে পাঠাইয়া দিলেন। সমাগত অন্যান্য রাজগণও চন্দ্রাপীড়ের দর্শনলালসায় বিদ্যালয়ে গমন করিলেন। বলাহক বিদ্যামন্দিরে প্রবেশিয়া রাজকুমারকে প্রণাম করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিল, কুমার! মহারাজ কহিলেন, “আমাদিগের মনোরথ পূর্ণ হইয়াছে। তুমি সমস্ত শাস্ত্র, সকল কলা ও সমুদায় আয়ুধবিদ্যা অভ্যাস করিয়াছ। এক্ষণে আচার্য্যেরা বাটী আসিতে অনুমতি দিয়াছেন। প্রজারা ও পরিজনেরা দেখিতে অতিশয় উৎসুক হইয়াছে। অতএব আমার অভিলাষ, তুমি অবিলম্বে বাটী আসিয়া দর্শনোৎসুক পরিজনদিগকে দর্শন দিয়া পরিতৃপ্ত কর এবং ব্রাহ্মণদিগের সমাদর, মানিলোকের মানরক্ষা, সন্তানের ন্যায় প্রজাদিগের প্রতিপালন ও বন্ধুবর্গের আনন্দোৎপাদন পূর্ব্বক পরম সুখে রাজ্য সম্ভোগ কর।” আপনার আরোহণের নিমিত্ত মহরাজ ত্রিভুবনের এক অমূল্য রত্নস্বরূপ, বায়ু ও গরুড়ের ন্যায় অতিবেগগামী, ইন্দ্রায়ুধনামা অপূর্ব্ব ঘোটক প্রেরণ করিয়াছেন। ঐ ঘোটক সাগরের প্রবাহমধ্য হইতে উত্থিত হয়, পারস্যদেশের অধিপতি মহারত্ন ও আশ্চর্য্য পদার্থ বলিয়া উহা মহারাজকে উপহার দেন। অনেক অশ্বলক্ষণবিৎ পণ্ডিতেরা কহিয়াছেন, উচ্চৈঃশ্রবার যে সকল সুলক্ষণ শুনিতে পাওয়া যায়, উহারও সেই সকল সুলক্ষণ আছে। ফলতঃ ইন্দ্রায়ুধ সামান্য ঘোটক নয়। আমরা ঐরূপ ঘোটক কখন দেখি নাই। দ্বারদেশে বদ্ধ আছে, অনুমতি হইলে আনয়ন করা যায়। দর্শনাভিলাষী রাজারাও সাক্ষাৎ করিতে আসিয়া বাহিরে আপনার প্রতীক্ষা করিতেছেন।
বলাহক এই কথা কহিলে চন্দ্রাপীড় গম্ভীর স্বরে আদেশ করিলেন, ইন্দ্রায়ুধকে এই স্থানে লইয়া আইস। আজ্ঞামাত্র, অতি বৃহৎ, স্থূলকায়, মহাতেজস্বী, প্রচণ্ডবেগশালী, বলবান্ ইন্দ্রায়ুধ আনীত হইল। ঐ ঘোটক এরূপ বলিষ্ঠ ও তেজস্বী যে দুই বীর পুরুষ উভয় পার্শ্বে মুখের বল্গা ধরিয়াও উন্নমনের সময় মুখ নিম্ন করিয়া রাখিতে পারেন না, এরূপ উচ্চ যে, উন্নত পুরুষেরাও কর প্রসারিত করিয়া পৃষ্ঠদেশ স্পর্শ করিতে পারে না। চন্দ্রাপীড় সুলক্ষণসম্পন্ন অদ্ভুত অশ্ব অবলোকন করিয়া অতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইলেন। মনে মনে চিন্তা করিলেন, অসুর ও দেবগণ সাগর মন্থন করিয়া কি রত্ন লাভ করিয়াছেন? দেবরাজ ইন্দ্র ইহার পৃষ্ঠে আরোহণ করেন নাই তাঁহার ত্রৈলোক্যাধিপত্যই বিফল। জলনিধি তাঁহাকে সামান্য উচ্চৈঃশ্রবা ঘোটক প্রদান করিয়া প্রতারণা করিয়াছেন। দেবাদিদেব নারায়ণ যদি ইহাকে একবার নেত্রগোচর করেন, বোধ হয় পক্ষিরাজ গরুড়ের পৃষ্ঠে আরোহণ জন্য তাঁহার আর অহঙ্কার থাকে না। পিতার কি আধিপত্য! ত্রিভুবনদুর্লভ এতাদৃশ রত্ন সকলও তিনি সংগ্রহ করিয়াছেন। ইহার আকার ও লক্ষণ দেখিয়া বোধ হইতেছে, এ প্রকৃত ঘোটক নয়। কোন মহাত্মা শাপগ্রস্ত হইয়া অশ্বরূপে অবতীর্ণ হইয়া থাকিবেন।
এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে আসন হইতে গাত্রোত্থান করিলেন। অশ্বের নিকট উপস্থিত হইয়া মনে মনে নমস্কার ও আরোহণজন্য অপরাধের ক্ষমা প্রার্থনা পূর্ব্বক পৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন ও বিদ্যালয় হইতে বহির্গত হইলেন। বহিঃস্থিত অশ্বারূঢ় নৃপতিগণ চন্দ্রাপীড়কে দেখিবামাত্র আপনাদিগকে কৃতার্থ বোধ করিলেন এবং সাক্ষাৎকারলালসায় ক্রমে ক্রমে সকলেই সম্মুখে আসিতে লাগিলেন। বলাহক একে একে সকলের নাম ও বংশের নির্দ্দেশ পূর্ব্বক পরিচয় দিয়া দিল। রাজকুমার মিষ্ট সম্ভাষণ দ্বারা যথোচিত সমাদর করিলেন। তাঁহাদিগের সহিত নানাপ্রকার সদালাপ করিতে করিতে সুখে নগরাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। বন্দিগণ উচ্চৈঃস্বরে সুললিত মধুর প্রবন্ধে স্তুতিপাঠ করিতে লাগিল। ভৃত্যেরা চামর ব্যজন ও মস্তকে ছত্রধারণ করিল। বৈশম্পায়নও অন্য এক তুরঙ্গমে আরোহণ করিয়া রাজকুমারের পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন।
চন্দ্রাপীড় ক্রমে ক্রমে নগরের মধ্যবর্ত্তী পথে সমাগত হইলেন। নগরবাসীরা সমস্ত কার্য্য পরিত্যাগ পূর্ব্বক রাজকুমারের সুকুমার আকার অবলোকন করিতে লাগিল। নগরস্থ সমস্ত বাটীর দ্বার উদ্ঘাটিত হওয়াতে বোধ হইল যেন, নগরী, চন্দ্রাপীড়কে দেখিবার নিমিত্ত একেবারে সহস্র সহস্র নেত্র উন্মীলন করিল। চন্দ্রাপীড় নগরে আসিতেছেন শুনিয়া রমণীগণ অতিশয় উৎসুক হইল এবং আপন আপন আরদ্ধ কর্ম্ম সমাপন না করিয়াই কেহ বা অলক্তক পরিতে পরিতে, কেহ বা কেশ বাঁধিতে বাঁধিতে বাটীর বহির্গত হইয়া, কেহ বা প্রাসাদোপরি আরোহণ করিয়া এক দৃষ্টিতে পথ পানে চাহিয়া রহিল। একবারে সোপানপরম্পরায় শত শত কামিনীজনের অসম্ভ্রমে পাদনিঃক্ষেপ করায় প্রাসাদমধ্যে একপ্রকার অভূতপূর্ব্ব ও অশ্রুতপূর্ব্ব ভূষণশব্দ সমুৎপন্ন হইল। গবাক্ষজালের নিকটে কামিনীগণের মুখপরম্পরা বিকসিত কমলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। স্ত্রীগণের চরণ হইতে আর্দ্র অলক্তক পতিত হওয়াতে ক্ষিতিতল পল্লবময় বোধ হইল। তাহাদিগের অঙ্গশোভায় নগর লাবণ্যময়, অলঙ্কারপ্রভায় দিগ্বলয় ইন্দ্রায়ুধময়, মুখমণ্ডলে ও লোচনপরম্পরায় গগনমণ্ডল চন্দ্রময়, পথ নীলোৎপলময় বোধ হইতে লাগিল। রাজকুমারের মোহিনী মূর্ত্তি দেখিয়া বিলাসিনীগণ চমৎকৃত ও মোহিত হইয়া পরস্পর পরিহাস পূর্ব্বক কহিতে লাগিল সখি! এই পৃথিবীতে সেই ধন্য ও সৌভাগ্যবতী, এই পুরুষরত্ন যাহার কর গ্রহণ করিবেন। আহা! এরূপ পরমসুন্দর পুরুষ ত কখন দেখি নাই। বিধি বুঝি পুরুষনিধি করিয়া ইঁহার সৃষ্টি করিয়া থাকিবেন। যাহা হউক, আজি আমরা অঙ্গবিশিষ্ট অনঙ্গকে প্রত্যক্ষ করিলাম। ফলতঃ নির্ম্মল জলে ও স্বচ্ছ স্ফটিকে যেরূপ প্রতিবিম্ব পতিত হয়, সেইরূপ কামিনীগণের হৃদয়দর্পণে চন্দ্রাপীড়ের মোহিনী মূর্ত্তি প্রতিবিম্বিত হইল। রাজকুমার ক্ষণকাল পরে তাহাদিগের দৃষ্টির অগোচর হইলেন, হৃদয়ের অগোচর কোন কালেই হইতে পারিলেন না। রাজকুমার রাজবাটীর সমীপবর্ত্তী হইলে পৌরাঙ্গণারা পুষ্পবৃষ্টির ন্যায় তাঁহার মস্তকে মঙ্গললাজাঞ্জলি বর্ষণ করিল।
ক্রমে দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া ঘোটক হইতে অবতীর্ণ হইলেন। বলাহক অগ্রে অগ্রে পথ দেখাইয়া চলিল। রাজকুমার বৈশম্পায়নের হস্তধারণপূর্ব্বক রাজভবনে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, শত শত বলবান দ্বারপাল অস্ত্র শস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া দ্বারে দণ্ডায়মান আছে। দ্বারদেশ অতিক্রম করিয়া দেখিলেন, কোন স্থানে ধনু, বাণ, তরবারি প্রভৃতি নানাবিধ অস্ত্র শস্ত্রে পরিপূর্ণ অস্ত্রশালা; কোন স্থানে সিংহ, গণ্ডার, করী, করভ, ব্যাঘ্র ভল্লূক প্রভৃতি ভয়ঙ্করপশুসমাকীর্ণ পশুশালা; কোন স্থানে নানা দেশীয়, সুলক্ষণসম্পন্ন, নানাপ্রকার অশ্বে বেষ্টিত মন্দুরা; কোন স্থানে কুররী, কোকিল, রাজহংস, চাতক, শিখণ্ডী, শুক, শারিকা প্রভৃতি পক্ষিগণের মধুর কোলাহলে পরিপূর্ণ পক্ষিশালা; কোন স্থানে বেণু, বীণা, মুরজ, মৃদঙ্গ প্রভৃতি নানাবিধ বাদ্যযন্ত্রে বিভূষিত সঙ্গীতশালা; কোন স্থানে বিচিত্রচিত্রশোভিত চিত্রশালিকা শোভা পাইতেছে। কৃত্রিম ক্রীড়াপর্ব্বত, মনোহর সরোবর, সুরম্য জলযন্ত্র, রমণীয় উপবন স্থানে স্থানে রহিয়াছে। অশেষদেশভাষাজ্ঞ নীতিপরায়ণ ধার্ম্মিক পুরুষেরা ধর্ম্মাধিকরণমন্দিরে উপবেশন পূর্ব্বক ধর্ম্মশাস্ত্রের মর্ম্মানুসারে বিচার করিতেছেন। সমাগত পুরুষেরা বিবিধরত্নাসনভূষিত সভামণ্ডপে বসিয়া আছেন। কোন স্থানে নর্ত্তকীরা নৃত্য, গায়কেরা সঙ্গীত ও বন্দিগণ স্তুতিপাঠ করিতেছে। জলচর পক্ষী সকল কেলি করিয়া বেড়াইতেছে। বালকবালিকাগণ ময়ূর ও ময়ূরীর সহিত ক্রীড়া করিতেছে। হরিণ ও হরিণীগণ মানুষসমাগমে ত্রস্ত হইয়া ভয়চকিতলোচনে বাটীর চতুর্দ্দিকে দৌড়িতেছে।
অনন্তর ছয় প্রকোষ্ঠ অতিক্রম করিয়া সপ্তম প্রকোষ্ঠের অভ্যন্তরে প্রবেশিয়া মহারাজের আবাসগৃহের নিকটবর্ত্তী হইলেন। অন্তঃপুরপুরন্ধ্রীরা রাজকুমারকে দেখিবামাত্র আনন্দিত মনে মঙ্গলাচরণ করিতে লাগিল। মহারাজ পরিষ্কৃত শয্যামণ্ডিত পর্য্যঙ্কে নিষণ্ণ আছেন, শরীররক্ষাধিকৃত অস্ত্রধারী দ্বারপালেরা সতর্কতা পূর্ব্বক প্রহরীর কার্য্য করিতেছে; এমন সময়ে চন্দ্রাপীড় পিতার নিকটে উপস্থিত হইলেন। “মহারাজ! অবলোকন করুন” দ্বারপাল এই কথা কহিলে, রাজা দৃষ্টিপাত পূর্ব্বক বৈশম্পায়ন সমভিব্যাহারী চন্দ্রাপীড়কে সমাগত দেখিয়া সাতিশয় আনন্দিত হইলেন। করপ্রসারণ পূর্ব্বক প্রণত পুত্ত্রকে আলিঙ্গন করিলেন। তাঁহার স্নেহবিকসিত লোচন হইতে আনন্দাশ্রু নির্গত হইতে লাগিল। বৈশম্পায়নকেও সমাদরে আলিঙ্গন করিয়া আসনে উপবেশন করিতে কহিলেন। ক্ষণকাল তথায় বসিয়া রাজকুমার জননীর নিকট গমন করিলেন। পুত্ত্রবৎসলা বিলাসবতী স্নিগ্ধ ও প্রীতিপ্রফুল্ল নয়নে পুত্ত্রকে পুনঃ পুনঃ নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহার মস্তক আঘ্রাণ ও হস্ত দ্বারা গাত্রস্পর্শ পূর্ব্বক আপন উৎসঙ্গ দেশে বসাইলেন ও স্নেহসংবলিত মধুর বচনে বলিলেন, বৎস! তোমাকে নানা বিদ্যায় বিভূষিত দেখিয়া নয়ন ও মন পরিতৃপ্ত হইল। এক্ষণে বধূসহচারী দেখিলে সকল মনোরথ পূর্ণ হয়। এই কথা কহিয়া লজ্জাবনত পুত্ত্রের কপোলদেশে চুম্বন করিতে লাগিলেন।
রাজকুমার এই রূপে সমস্ত অন্তঃপুরবাসিনীদিগকে দর্শন দিয়া আহ্লাদিত করিলেন। পরিশেষে শুকনাসের ভবনে উপস্থিত হইলেন। অমাত্যের ভবনও এরূপ সমৃদ্ধিসম্পন্ন যে, রাজবাটী হইতে বিভিন্ন বোধ হয় না। শুকনাস সভামণ্ডপে বসিয়া আছেন। সমাগত সামন্ত ও ভূপতিগণ চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিয়া রহিয়াছেন, এমন সময়ে চন্দ্রাপীড় ও বৈশম্পায়ন তথায় প্রবেশিলেন। সকলে সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক সমাদরে সম্ভাষণ করিল। শুকনাস প্রণত পুত্ত্র ও রাজকুমারকে যুগপৎ আলিঙ্গন করিয়া পরম পরিতুষ্ট হইলেন। পরে রাজনন্দনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, বৎস চন্দ্রাপীড়! অদ্য তোমাকে কৃতবিদ্য দেখিয়া মহারাজ যেরূপ সন্তুষ্ট হইয়াছেন, শত শত সাম্রাজ্যলাভেও তাদৃশ সন্তোষের সম্ভাবনা নাই। আজি গুরুজনের আশীর্ব্বাদ ও মহারাজের পূর্ব্বজন্মার্জ্জিত সুকৃতি ফলিল। আজি কুলদেবতা প্রসন্ন হইলেন। প্রজাগণ কি ধন্য ও পুণ্যবান্! যাহাদিগের প্রতিপালনের নিমিত্ত তুমি ভূমণ্ডলে অবতীর্ণ হইয়াছ। বসুমতী কি সৌভাগ্যবতী! যিনি পতিভাবে তোমার আরাধনা করিবেন। ভগবান্ যেরূপ নানা অবতার হইয়া ভূভার বহন করিয়া থাকেন, তুমিও সেইরূপ যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়া ভূভার বহন ও প্রজাদিগের প্রতিপালন কর। রাজকুমার শুকনাসের সভায় ক্ষণকাল অবস্থিতি করিয়া মনোরমার নিকট গমন ও ভক্তিপূর্ব্বক তাঁহাকে নমস্কার করিলেন। তথা হইতে বাটী আসিয়া স্নান ভোজন প্রভৃতি সমুদায় কর্ম্ম সম্পন্ন করিয়া মহারাজের আজ্ঞানুসারে শ্রীমণ্ডপনামক প্রাসাদে গিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। শ্রীমণ্ডপের নিকটে ইন্দ্রায়ুধের বাসস্থান নির্দ্দিষ্ট হইল।
দিবাবসানে দিঙ্মণ্ডল লোহিত বর্ণ হইল। সন্ধ্যারাগে রক্তবর্ণ হইয়া চক্রবাকমিথুন ভিন্ন ভিন্ন দিকে উৎপতিত হওয়াতে বোধ হইল যেন, বিরহবেদনা স্মৃতিপথারূঢ় হওয়াতে তাহাদিগের হৃদয় বিদীর্ণ হইয়াছে ও গাত্র হইতে রক্তধারা পড়িতেছে। সম্মানিত ব্যক্তিরা বিপদ্কালেও নীচ পদবীতে পদার্পণ করেন না, ইহাই জানাইবার নিমিত্ত রবি অস্তগমনকালেও পশ্চিমাচলের উন্নত শিখর আশ্রয় করিলেন। দিনকর অস্তগত হইলেন, কিন্তু রজনী সমাগতা হয় নাই। এই সময়ে তাপের বিগম ও অন্ধকারের অনুদয় প্রযুক্ত লোকের অন্তঃকরণ আনন্দে প্রফুল্ল হইল। সূর্য্যরূপ সিংহ অস্তাচলের গুহাশায়ী হইলে ধ্বান্তরূপ দন্তিযূথ নির্ভয়ে জগৎ আক্রমণ করিল। নলিনী দিনমণির বিরহে অলিরূপ অশ্রুজল পরিত্যাগ পূর্ব্বক কমলরূপ নেত্র নিমীলন করিল। বিহঙ্গমকুল কোলাহল করিয়া উঠিল। অনন্তর প্রজ্বলিত প্রদীপশিখা ও উজ্জ্বল মণির আলোকে রাজবাটীর তিমির নিরস্ত হইয়া গেল। চন্দ্রাপীড় পিতা মাতার নিকটে নানা কথা প্রসঙ্গে ক্ষণকাল ক্ষেপ করিয়া আহারাদি করিলেন। পরে আপন প্রাসাদে আগমন পূর্ব্বক কোমলশয্যামণ্ডিত পর্য্যঙ্কে সুখে নিদ্রা গেলেন।
প্রভাত হইলে পিতার অনুমতি লইয়া শিকারী কুক্কুর, শিক্ষিত হস্তী, বেগগামী অশ্ব ও অসংখ্য অস্ত্রধারী বীরপুরুষ সমভিব্যাহারে করিয়া মৃগয়ার্থ বনে প্রবেশিলেন। দেখিলেন, উদারস্বভাব সিংহ সম্রাটের ন্যায় নির্ভয়ে গিরিগুহায় শয়ন করিয়া আছে। হিংস্র শার্দ্দূল ভয়ঙ্কর আকার স্বীকার পূর্ব্বক পশুদিগকে আক্রমণ করিতেছে। মৃগকুল ত্রস্ত ও শশব্যস্ত হইয়া ত্বরিত বেগে ইতস্ততঃ দৌড়িতেছে। বন্য হস্তী দলবদ্ধ হইয়া চলিতেছে। মহিষকুল রক্তবর্ণ চক্ষু দ্বারা ভয় প্রদর্শন করিয়া নির্ভয়ে বেড়াইতেছে। বরাহ, ভল্লূক, গণ্ডার প্রভৃতির ভীষণ আকার দেখিলে ও চীৎকার শব্দ শুনিলে কলেবর কম্পিত হয়। নিবিড় বন, তথায় সূর্য্যের কিরণ প্রায় প্রবেশ করিতে পারে না। রাজকুমার এতাদৃশ ভীষণ গহনে প্রবেশিয়া ভল্ল ও নারাচ দ্বারা ভল্লূক, সারঙ্গ, শূকর প্রভৃতি বহুবিধ বন্য পশু মারিয়া ফেলিলেন। কোন কোন পশুকে আঘাত না করিয়া কেবল কৌশলক্রমে ধরিলেন। মৃগয়াবিষয়ে এরূপ সুশিক্ষিত ছিলেন যে, উড্ডীন বিহগাবলীকেও অবলীলাক্রমে বাণবিদ্ধ করিতে লাগিলেন।
বেলা দুই প্রহর হইল। সূর্য্যমণ্ডল ঠিক্ মস্তকের উপরিভাগ হইতে অগ্নিময় কিরণ বিস্তার করিল। সূর্য্যের আতপে ও মৃগয়াজন্য শ্রমে একান্ত ক্লান্ত হওয়াতে রাজকুমারের সর্ব্বাঙ্গ ঘর্ম্মবারিতে পরিপ্লুত হইল। স্বেদার্দ্র শরীরে কুসুমরেণু পতিত হওয়াতে ও বিন্দু বিন্দু রক্ত লাগাতে যেন অঙ্গে অঙ্গরাগ ও রক্তচন্দন লেপন করিয়াছেন, বোধ হইল। ইন্দ্রায়ুধের মুখে ফেনপুঞ্জ ও শরীরে স্বেদজল বহির্গত হইল। সেই রৌদ্রে স্বহস্তে নব পল্লবের ছত্র ধরিয়া সমভিব্যাহারী রাজগণের সহিত মৃগয়ার কথা কহিতে কহিতে বাটী প্রত্যাগমন করিলেন। দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া তুরঙ্গ হইতে অবতীর্ণ হইলেন। তথায় মৃগয়াবেশ পরিত্যাগ ও ক্ষণকাল বিশ্রামের পর স্নান করিয়া অঙ্গে অঙ্গরাগলেপন ও পট্টবসন পরিধান পূর্ব্বক আহারমণ্ডপে গমন করিলেন। আপনি আহার করিয়া স্বহস্তে ইন্দ্রায়ুধের ভোজনসামগ্রী আনিয়া দিলেন। সে দিন এইরূপে অতিবাহিত হইল।
পর দিন প্রাতঃকালে আপন প্রাসাদে বসিয়া আছেন এমন সময়ে কৈলাসনামক কঞ্চুকী স্বর্ণালঙ্কারভূষিতা এক সুন্দরী কুমারীকে সঙ্গে করিয়া তথায় উপস্থিত হইল, বিনীত বচনে কহিল, কুমার দেবী আদেশ করিলেন, এই কন্যাকে আপনার তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী করুন। ইনি কুলুতদেশীয় রাজার দুহিতা, নাম পত্রলেখা। মহারাজ কুলুতরাজধানী জয় করিয়া এই কন্যাকে বন্দী করিয়া আনেন ও অন্তঃপুরপরিচারিকার মধ্যে নিবেশিত করেন। রাণী পরিচয় পাইয়া আপন কন্যার ন্যায় লালন পালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করিয়াছেন এবং অতিশয় ভাল বাসিয়া থাকেন, ইহাকে সামান্য পরিচারিকার ন্যায় জ্ঞান করিবেন না। সখী ও শিষ্যার ন্যায় বিশ্বাস করিবেন। রাজকন্যার সমুচিত সমাদর করিবেন। ইনি অতিশয় সুশীল ও সরলস্বভাব এবং এরূপ গুণবতী যে আপনাকে ইঁহার গুণে অবশ্য বশীভূত হইতে হইবেক। আপাততঃ ইঁহার কুল শীলের বিষয় কিছুই জানেন না বলিয়া কিঞ্চিৎ পরিচয় দিলাম। কঞ্চুকীর মুখে জননীর আজ্ঞা শুনিয়া নিমেষশূন্য লোচনে পত্রলেখাকে দেখিতে লাগিলেন। তাহার আকার দেখিয়াই বুঝিলেন ঐ কন্যা সামান্য কন্যা নহে। অনন্তর জননীর আদেশ গ্রহণ করিলাম বলিয়া কঞ্চুকীকে বিদায় দিলেন। পত্রলেখা তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী হইয়া ছায়ার ন্যায় রাজকুমারের অনুবর্ত্তিনী হইল। রাজকুমারও তাহার গুণে প্রীত ও প্রসন্ন হইয়া দিন দিন নব নব অনুরাগ প্রকাশ করিতে লাগিলেন।
২.০৩ রাজা চন্দ্রাপীড়কে যৌবরাজ্যে অভিষেক
কিছু দিন পরে রাজা চন্দ্রাপীড়কে যৌবরাজ্যে অভিষেক করিতে অভিলাষ করিলেন। রাজকুমার যুবরাজ হইবেন এই ঘোষণা সর্ব্বত্র প্রচারিত হইল। রাজবাটী মহোৎসবময় ও নগর আনন্দকোলাহলে পরিপূর্ণ হইল। অভিষেকের সামগ্রীসম্ভার সংগ্রহের নিমিত্ত লোক সকল দিগ্দিগন্তে গমন করিল।
একদা কার্য্যক্রমে চন্দ্রাপীড় অমাত্যের বাটীতে গিয়াছেন; তথায় শুকনাস তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া মধুর বচনে কহিলেন, কুমার! তুমি সমস্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন ও সমুদায় বিদ্যা অভ্যাস করিয়াছ, সকল কলা শিখিয়াছ, ভূমণ্ডলে জন্মগ্রহণ করিয়া যাহা জ্ঞাতব্য সমুদায় জানিয়াছ। তোমার অজ্ঞাত ও উপদেষ্টব্য কিছুই নাই। তুমি যুবা, মহারাজ তোমাকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত ও ধনসম্পত্তির অধিকারী করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন। সুতরাং যৌবন, ধনসম্পত্তি, প্রভুত্ব, তিনেরই অধিকারী হইলে। কিন্তু যৌবন অতি বিষম কাল। যৌবনরূপ বনে প্রবেশিলে বন্য জন্তুর ন্যায় ব্যবহার হয়। যুবা পুরুষেরা কাম, ক্রোধ, লোভ প্রভৃতি পশুধর্ম্মকে সুখের হেতু ও স্বর্গের সেতু জ্ঞান করে। যৌবনপ্রভাবে মনে একপ্রকার তমঃ উপস্থিত হয়, উহা কিছুতেই নিরস্ত হয় না। যৌবনের আরম্ভে অতি নির্ম্মল বুদ্ধিও বর্ষাকালীন নদীর ন্যায় কলুষিতা হয়। বিষয়তৃষ্ণা ইন্দ্রিয়দিগকে আক্রমণ করে। তখন অতিগর্হিত অসৎ কর্ম্মকেও দুষ্কর্ম্ম বলিয়া বোধ হয় না। তখন লোকের প্রতি অত্যাচার করিয়া স্বার্থসম্পাদন করিতেও লজ্জা বোধ হয় না। সুরাপান না করিলে ও চক্ষুর দোষ না থাকিলেও ধনমদে মত্ততা ও অন্ধতা জন্মে। ধনমদে উন্মত্ত হইলে হিতাহিত বা সদসদ্বিবেচনা থাকে না। অহঙ্কার ধনের অনুগামী। অহঙ্কৃত পুরুষেরা মানুষকে মানুষ জ্ঞান করে না। আপনাকেই সর্ব্বাপেক্ষা গুণবান্, বিদ্বান্, ও প্রধান বলিয়া ভাবে; অন্যের নিকটেও সেইরূপ প্রকাশ করে। তাহার স্বভাব এরূপ উদ্ধত হয় যে, আপনার মতের বিপরীত কথা শুনিলে তৎক্ষণাৎ খড়্গহস্ত হইয়া উঠে। প্রভুত্বরূপ হলাহলের ঔষধ নাই। প্রভুজনেরা অধীন লোকদিগকে দাসের ন্যায় জ্ঞান করে। আপন সুখে সন্তুষ্ট থাকিয়া পরের দুঃখ সন্তাপ কিছুই দেখিতে পায় না। তাহারা প্রায় স্বার্থপর ও অন্যের অনিষ্টকারক হইয়া উঠে। যৌবরাজ্যে, যৌবন, প্রভুত্ব ও অতুল ঐশ্বর্য্য, এ সকল কেবল অনর্থপরম্পরা। অসামান্যধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরাই ইহার তরঙ্গ হইতে উত্তীর্ণ হইতে পারেন। তীক্ষ্ণবুদ্ধিরূপ দৃঢ় নৌকা না থাকিলে উহার প্রবল প্রবাহে মগ্ন হইতে হয়। একবার মগ্ন হইলে আর উঠিবার সামর্থ্য থাকে না।
সদ্বংশে জন্মিলেই যে, সৎ ও বিনীত হয় একথা অগ্রাহ্য। উর্ব্বরা ভূমিতে কি কণ্টকবৃক্ষ জন্মে না? চন্দনকাষ্ঠের ঘর্ষণে যে অগ্নি নির্গত হয় উহার কি দাহশক্তি থাকে না? ভবাদৃশ বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিরাই উপদেশের যথার্থ পাত্র। মূর্খকে উপদেশ দিলে কোন ফল হয় না। দিবাকরের কিরণ কি স্ফটিকমণির ন্যায় মৃৎপিণ্ডে প্রতিফলিত হইতে পারে? সদুপদেশ অমূল্য ও অসমুদ্রসম্ভূত রত্ন। উহা শরীরের বৈরূপ্য প্রভৃতি জরার কার্য্য প্রকাশ না করিয়াও বৃদ্ধত্ব সম্পাদন করে। ঐশ্বর্য্যশালীকে উপদেশ দেয় এমন লোক অতি বিরল। যেমন গিরিগুহার নিকটে শব্দ করিলে প্রতিশব্দ হয়, সেইরূপ পার্শ্ববর্ত্তী লোকের মুখে প্রভুবাক্যের প্রতিধ্বনি হইতে থাকে; অর্থাৎ প্রভু যাহা কহেন, পারিষদেরা তাহাই যুক্তিযুক্ত বলিয়া অঙ্গীকার করে। প্রভুর নিতান্ত অসঙ্গত ও অন্যায় কথাও পারিষদদিগের নিকট সুসঙ্গত ও ন্যায়ানুগত হয় এবং সেই কথার পুনঃপুনঃ উল্লেখ করিয়া তাহারা প্রভুর কতই প্রশংসা করিতে থাকে। তাঁহার কথার বিপরীত কথা বলিতে কাহারও সাহস হয় না। যদি কোন সাহসিক পুরুষ ভয় পরিত্যাগ করিয়া তাঁহার কথা অন্যায় ও অযুক্ত বলিয়া বুঝাইয়া দেন, তথাপি তাহা গ্রাহ্য হয় না। প্রভু সে সময় বধির হন অথবা ক্রোধান্ধ হইয়া আত্মমতের বিপরীতবাদীর অপমান করেন। অর্থ অনর্থের মূল। মিথ্যা অভিমান, অকিঞ্চিৎকর অহঙ্কার ও বৃথা ঔদ্ধত্য প্রায় অর্থ হইতে উৎপন্ন হয়।
প্রথমতঃ লক্ষ্মীর প্রকৃতি বিবেচনা করিয়া দেখ। ইনি অতিদুঃখে লব্ধ ও অতিযত্নে রক্ষিত হইলেও কখন একস্থানে স্থির হইয়া থাকেন না। রূপ, গুণ, বৈদগ্ধ, কুল, শীল কিছুই বিবেচনা করেন না। রূপবান্, গুণবান্, বিদ্বান্, সদ্বংশজাত, সুশীল ব্যক্তিকেও পরিত্যাগ করিয়া জঘন্য পুরুষাধমের আশ্রয় লন। দুরাচার লক্ষ্মী যাহাকে আশ্রয় করে, সে স্বার্থনিষ্পাদনপর ও লুব্ধপ্রকৃতি হইয়া দ্যূতক্রীড়াকে বিনোদ, পশুধর্ম্মকে রসিকতা, যথেষ্টাচারকে প্রভুত্ব ও মৃগয়াকে ব্যায়াম বলিয়া গণনা করে। মিথ্যা স্তুতিবাদ করিতে না পারিলে ধনিদিগের নিকট জীবিকালাভ করা কঠিন। যাহারা অন্যকার্য্যপরাঙ্মুখ ও কার্য্যাকার্য্যবিবেকশূন্য হয় এবং সর্ব্বদা বদ্ধাঞ্জলি হইয়া ধনেশ্বরকে জগদীশ্বর বলিয়া বর্ণনা করে, তাহারাই ধনিগণের সন্নিধানে বসিতে পায় ও প্রশংসাভাজন হয়। প্রভু স্তুতিবাদককে যথার্থবাদী বলিয়া জ্ঞান করেন, তাহার সহিতই আলাপ করেন, তাহাকেই সদ্বিবেচক ও বুদ্ধিমান্ বলিয়া ভাবেন, তাহার পরামর্শক্রমেই কার্য্য করিয়া থাকেন। স্পষ্টবক্তা উপদেষ্টাকে নিন্দুক বলিয়া অবজ্ঞা করেন, নিকটেও বসিতে দেন না। তুমি দুরবগাহ নীতিপ্রয়োগ ও দুর্ব্বোধ রাজ্যতন্ত্রের ভারগ্রহণে প্রবৃত্ত হইয়াছ; সাবধান, যেন সাধুদিগের উপহাসাস্পদ ও চাটুকারের প্রতারণাস্পদ হইও না। চাটুকারের প্রিয় বচনে তোমার যেন ভ্রান্তি জন্মে না। যথার্থবাদীকে নিন্দুক বলিয়া যেন অবজ্ঞা করিও না। রাজারা আপন চক্ষে কিছুই দেখিতে পান না এবং এরূপ হতভাগ্য লোক দ্বারা পরিবৃত থাকেন, প্রতারণা করাই যাহাদিগের সম্পূর্ণ মানস। তাহারা প্রভুকে প্রতারণা করিয়া আপন অভিপ্রায় সিদ্ধ করিতে পারিলেই চরিতার্থ হয় ও সর্ব্বদা উহারই চেষ্টা পায়। বাহ্য ভক্তি প্রদর্শন পূর্ব্বক আপনাদিগের দুষ্ট অভিপ্রায় গোপন করিয়া রাখে, সময় পাইলেই চাটুবচনে প্রভুকে প্রতারিত করিয়া লোকের সর্ব্বনাশ করে। তুমি স্বভাবতঃ ধীর; তথাপি তোমাকে বারংবার উপদেশ দিতেছি, সাবধান, যেন ধন ও যৌবনমদে উন্মত্ত হইয়া কর্ত্তব্য কর্ম্মের অনুষ্ঠানে পরাঙ্মুখ ও অসদাচরণে প্রবৃত্ত হইও না। এক্ষণে মহারাজের ইচ্ছাক্রমে অভিনব যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়া কুলক্রমাগত ভূভার বহন কর, অরাতিমণ্ডলের মস্তক অবনত কর, এবং সমুদায় দেশ জয় করিয়া অখণ্ড ভূমণ্ডলে আপন আধিপত্য স্থাপন পূর্ব্বক প্রজাদিগের প্রতিপালন কর। এইরূপ উপদেশ দিয়া অমাত্য ক্ষান্ত হইলেন। চন্দ্রাপীড় শুকনাসের গভীর অর্থযুক্ত উপদেশবাক্য শ্রবণ করিয়া মনে মনে উহারই আন্দোলন করিতে করিতে বাটী গমন করিলেন।
অভিষেকসামগ্রী সমাহৃত হইলে, অমাত্য ও পুরোহিতের সহিত রাজা শুভ দিনে ও শুভ লগ্নে তীর্থ, নদী ও সাগর হইতে আনীত মন্ত্রপূত বারি দ্বারা রাজকুমারের অভিষেক করিলেন। লতা যেরূপ এক বৃক্ষ হইতে শাখা দ্বারা বৃক্ষান্তর আশ্রয় করে, সেরূপ রাজসংক্রান্ত রাজলক্ষ্মী অংশক্রমে যুবরাজকে অবলম্বন করিলেন। পবিত্র তীর্থজলে স্নান করিয়া রাজকুমার উজ্জ্বল শ্রী প্রাপ্ত হইলেন। অভিষেকানন্তর ধবল বসন, উজ্জ্বল ভূষণ ও মনোহর মাল্য ধারণ পূর্ব্বক অঙ্গে সুগন্ধি গন্ধদ্রব্য লেপন করিলেন। অনন্তর সভামণ্ডপে প্রবেশপূর্ব্বক শশধর যেরূপ সুমেরুশৃঙ্গে আরোহণ করিলে শোভা হয়, যুবরাজ সেইরূপ রত্নসিংহাসনে উপবেশন করিয়া সভার পরম শোভা সম্পাদন করিলেন। নব নব উপায় দ্বারা প্রজাদিগের সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি ও রাজ্যের সুনিয়ম সংস্থাপন করিয়া পরম সুখে যৌবরাজ্য সম্ভোগ করিতে লাগিলেন। রাজাও পুত্ত্রকে রাজ্যভার সমর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন।
২.০৪ যুবরাজ দিগ্বিজয়ের নিমিত্ত যাত্রা করিলেন
কিছু দিনের পর যুবরাজ দিগ্বিজয়ের নিমিত্ত যাত্রা করিলেন। ঘনঘটার ঘোর ঘর্ঘর ঘোষের ন্যায় দুন্দুভিধ্বনি হইল। সৈন্যগণের কলরবে চতুর্দ্দিক্ ব্যাপ্ত হইল। রাজকুমার স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত করেণুকায় আরোহণ করিলেন। পত্রলেখাও ঐ হস্তিনীর উপর উঠিয়া বসিল। বৈশম্পায়ন আর এক করিণীপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া রাজকুমারের পার্শ্ববর্ত্তী হইলেন। ক্ষণ কালের মধ্যে মহীতল তুরঙ্গময়, দিঙ্মণ্ডল মাতঙ্গময়, অন্তরীক্ষ আতপত্রময়, সমীরণ মদগন্ধময়, পথ সৈন্যময় ও নগর জয়শব্দময় হইল। সেনাগণ সুসজ্জিত হইয়া বহির্গত হইলে তাহাদিগের পাদবিক্ষেপে মেদিনী কাঁপিতে লাগিল। শাণিত অস্ত্র শস্ত্রে দিনকরের করপ্রভা প্রতিবিম্বিত হওয়াতে বোধ হইল যেন, শিখিকুল গগনমণ্ডলে শিখাকলাপ বিস্তীর্ণ করিয়া রহিয়াছে, সৌদামিনী প্রকাশ পাইতেছে, ইন্দ্রধনু উদিত হইয়াছে। করীদিগের বৃংহিত, অশ্বদিগের হেষারব, দুন্দুভির ভীষণ শব্দ, সৈন্যদিগের কলরবে বোধ হইল যেন, প্রলয়কাল উপস্থিত। ধূলি উত্থিত হইয়া গগনমণ্ডল অন্ধকারাবৃত করিল। আকাশ ও ভূমির কিছুই বিশেষ রহিল না। বোধ হইল যেন, সৈন্যভার সহ্য করিতে না পারিয়া ধরা উপরে উঠিতেছে। এক এক বার এরূপ কলরব হয় যে কিছুই শুনা যায় না।
কতক দূর যাইয়া সন্ধ্যার পূর্ব্বে যুবরাজ এক রমণীয় প্রদেশে উপস্থিত হইলেন। সেই দিন তথায় বাসস্থান নিরূপিত হইল! সেনাগণ আহারাদি করিয়া পটগৃহে নিদ্রা গেল। রাজকুমারও শয়ন করিলেন। প্রত্যূষে সেনাগণ পুনর্ব্বার শ্রেণীবদ্ধ হইয়া চলিল। যাইতে যাইতে বৈশম্পায়ন রাজকুমারকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, যুবরাজ! মহারাজ যে দেশ জয় করেন নাই, যে দুর্গ আক্রমণ করেন নাই এরূপ দেশ ও দুর্গই দেখিতে পাই না। আমরা যে দিকে যাইতেছি, দেখিতেছি সকলই তাঁহার রাজ্যের অন্তর্গত। মহারাজের বিক্রম ও ঐশ্বর্য্য দেখিয়া আশ্চর্য্য বোধ হইতেছে। তিনি সমুদায় দেশ জয় করিয়াছেন, সকল রাজাকে আপন অধীনে রাখিয়াছেন, সমুদায় রত্ন সংগ্রহ করিয়াছেন।
অনন্তর যুবরাজ পরাক্রান্ত ও বলশালী সৈন্য দ্বারা পূর্ব্ব, দক্ষিণ, পশ্চিম, উত্তর ক্রমে ক্রমে অবশিষ্ট সকল দেশ জয় করিয়া কৈলাসপর্ব্বতের নিকটবর্ত্তী হেমজটনামক কিরাতদিগের সুবর্ণপুরনাম্নী নগরীতে উপস্থিত হইলেন। সংগ্রামে কিরাতদিগকে পরাজিত করিয়া পরিশ্রান্ত ও একান্ত ক্লান্ত সেনাগণকে কিঞ্চিৎ কাল বিশ্রাম করিতে আদেশ দিলেন। আপনিও তথায় আরাম করিতে লাগিলেন।
একদা তথা হইতে মৃগয়ার্থ নির্গত হইয়া একটী কিন্নর ও একটী কিন্নরী বনে ভ্রমণ করিতেছে দেখিলেন। অদৃষ্টপূর্ব্ব কিন্নরমিথুন দর্শনে অত্যন্ত কৌতুকাক্রান্ত হইয়া ধরিবার আশয়ে সেই দিকে অশ্ব চালনা করিলেন। অশ্ব বায়ুবেগে ধাবিত হইল। কিন্নরমিথুনও মানুষ দর্শনে ভীত হইয়া দ্রুত বেগে পলায়ন করিতে লাগিল। শীঘ্র গমনে কেহই অপারগ নহে। ঘোটক এরূপ দ্রুতবেগে দৌড়িল যে, কিন্নরমিথুন এই ধরিলাম বলিয়া রাজকুমারের ক্ষণে ক্ষণে বোধ হইতে লাগিল। এ দিকে কিন্নরমিথুনও প্রাণপণে দৌড়িয়া গিয়া এক পর্ব্বতের উপরি আরোহণ করিল। ঘোটক তথায় উঠিতে পারিল না। রাজকুমার পর্ব্বতের উপত্যকা হইতে ঊর্দ্ধ দৃষ্টে দেখিতে লাগিলেন। উহারা পর্ব্বতের শৃঙ্গে আরোহণ পূর্ব্বক ক্রমে ক্রমে দৃষ্টিপথের অগোচর হইল।
কিন্নরমিথুনগ্রহণে হতাশ হইয়া মনে মনে কহিলেন, কি দুষ্কর্ম্ম করিয়াছি; কিন্নরমিথুন কিরূপে ধরিব, ধরিয়াই বা কি হইবে, একবারও বিবেচনা হয় নাই। বোধ হয় সেনানিবেশ হইতে অধিক দূর আসিয়াছি। এক্ষণে কি করি, কিরূপে পুনর্ব্বার তথায় যাই। এ দিকে কখন আসি নাই, কোন্ পথ দিয়া যাইতে হয় কিছুই জানি না। এই নির্জ্জন গহনে মানবের সমাগম নাই। কোন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিয়া যে, পথের নিদর্শন পাইব তাহারও উপায় নাই। শুনিয়াছি সুবর্ণপুরের উত্তরে নিবিড় বন, বন পার হইলেই কৈলাসপর্ব্বত। কিন্নরমিথুন যে পর্ব্বতে আরোহণ করিল বোধ হয়, উহা কৈলাসপর্ব্বত। দক্ষিণ দিকে ক্রমাগত প্রতিগমন করিলে স্কন্ধাবারে পঁহুছিবার সম্ভাবনা। অদৃষ্টে কত কষ্ট আছে বলিতে পারি না। আপনি কুকর্ম্ম করিয়াছি, কাহার দোষ দিব? কেই বা ইহার ফলভোগ করিবে, যে রূপে হউক যাইতে হইবেক। এই স্থির করিয়া ঘোটককে দক্ষিণ দিকে ফিরাইলেন। তখন বেলা দুই প্রহর। দিনকর গগনমণ্ডলের মধ্যবর্ত্তী হইয়া অতিশয় উত্তাপ দিতেছেন। পক্ষিগণ নীরব, বন নিস্তব্ধ, ঘোটক অতিশয় পরিশ্রান্ত ও ঘর্ম্মাক্তকলেবর। আপনিও তৃষ্ণাতুর হইয়াছেন দেখিয়া তরুতলের ছায়ায় অশ্ব বাঁধিলেন এবং হরিদ্বর্ণ দুর্ব্বাদলের আসনে উপবেশন পূর্ব্বক ক্ষণকাল বিশ্রামের পর জলপ্রাপ্তির আশয়ে ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। এক পথে হস্তীর পদচিহ্ন ও মদচিহ্ন রহিয়াছে এবং কুমুদ, কহ্লার ও মৃণাল ছিন্ন ভিন্ন হইয়া পতিত আছে দেখিয়া স্থির করিলেন, গিরিচর করিযূথ এই পথে জলপান করিতে যায়, সন্দেহ নাই। এই পথ দিয়া যাইলে অবশ্য জলাশয় পাইতে পারিব।
অনন্তর সেই পথে চলিলেন। পথের ধারে উন্নত পাদপ সকল বিস্তৃত শাখা প্রশাখা দ্বারা গগন আকীর্ণ করিয়া রহিয়াছে। বোধ হয় যেন, বাহু প্রসারণ পূর্ব্বক অঙ্গুলি সঙ্কেত দ্বারা তৃষ্ণার্ত্ত পথিকদিগকে জল পান করিবার নিমিত্ত ডাকিতেছে। স্থানে স্থানে কুঞ্জবন ও লতামণ্ডপ, মধ্যে মধ্যে মসৃণ ও উজ্জ্বলশিলা পতিত রহিয়াছে। নানাবিধ রমণীয় প্রদেশ ও বিচিত্র উপবন দেখিতে দেখিতে কতক দূর যাইয়া বারিশীকরসম্পৃক্ত সুশীতল সমীরণস্পর্শে বিগতক্লম হইলেন। বোধ হইল যেন, তুষারে অবগাহন করিতেছেন। সরোবর নিকটবর্ত্তী হওয়াতে মনে মনে অতিশয় আহ্লাদ জন্মিল। অনন্তর মধুপানমত্ত মধুকর ও কেলিপর কলহংসের কোলাহলে আহূত হইয়া সরোবরের সমীপবর্ত্তী হইলেন। চতুর্দ্দিকে শ্রেণীবদ্ধ তরুমধ্যে ত্রৈলোক্যলক্ষ্মীর দর্পণস্বরূপ বসুন্ধরাদেবীর স্ফটিকগৃহস্বরূপ, অচ্ছোদননামক সরোবর নেত্রগোচর করিলেন। সরোবরের জল অতি নির্ম্মল। জলে কমল, কুমুদ, কহ্লার প্রভৃতি নানাবিধ কুসুম বিকসিত হইয়াছে। মধুকর গুন্ গুন্ ধ্বনি করিয়া এক পুষ্প হইতে অন্য পুষ্পে বসিয়া মধুপান করিতেছে। কলহংস সকল কলরব করিয়া কেলি করিতেছে। কুসুমের সুরভিরেণু হরণ করিয়া শীতল সমীরণ নানা দিকে সুগন্ধ বিস্তার করিতেছে। সরোবরের শোভা দেখিয়া মনে মনে চিন্তা করিলেন, কিন্নরমিথুনের অনুসরণ নিষ্ফল হইলেও এই মনোহর সরোবর দেখিয়া আমার নেত্রযুগল সফল ও চিত্ত সফল হইল। এতাদৃশ রমণীয় বস্তু কখন দেখিও নাই, দেখিবও না; বোধ হয়, ভগবান্ ভবানীপতি এই সরোবরের শোভায় মোহিত হইয়া কৈলাসনিবাস পরিত্যাগ করিতে পারেন না। অনন্তর সরোবরের দক্ষিণ তীরে উপস্থিত হইয়া অশ্ব হইতে অবতীর্ণ হইলেন। পৃষ্ঠ হইতে পর্য্যাণ উপনীত হইলে ইন্দ্রায়ুধ এক বার ক্ষিতিতলে বিলুণ্ঠিত হইল। পরে ইচ্ছাক্রমে স্নান ও জলপান করিয়া তীরে উঠিলে রাজকুমার উহার পশ্চাদ্ভাগের পদদ্বয় পাশ দ্বারা আবদ্ধ করিয়া দিলেন। সে তীরপ্ররূঢ় নবীন দূর্ব্বা ভক্ষণ করিতে লাগিল। রাজকুমারও সরোবরে অবগাহন পূর্ব্বক মৃণাল ভক্ষণ ও জল পান করিয়া তীরে উঠিলেন। এক লতামণ্ডপমধ্যবর্ত্তী শিলাতলে নলিনীপত্রের শয্যা ও উত্তরীয় বস্ত্রের উপাধান প্রস্তুত করিয়া শয়ন করিলেন।
ক্ষণ কাল বিশ্রামের পর সরসীর উত্তর তীরে বীণাতন্ত্রীঝঙ্কারমিশ্রিত সঙ্গীত শুনিলেন। ইন্দ্রায়ুধ শব্দ শুনিবামাত্র কবল পরিত্যাগ পূর্ব্বক সেই দিকে কর্ণপাত করিল। এই জনশূন্য অরণ্যে কোথায় সঙ্গীত হইতেছে জানিবার নিমিত্ত রাজকুমার যে দিকে শব্দ হইতেছিল সেই দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন, কিন্তু কিছুই দেখিতে পাইলেন না। কেবল অস্ফুট মধুর শব্দ কর্ণকুহরে অমৃত বর্ষণ করিতে লাগিল। সঙ্গীতশ্রবণে কুতূহলাক্রান্ত হইয়া ইন্দ্রায়ুধে আরোহণ পূর্ব্বক সরসীর পশ্চিম তীর দিয়া শব্দানুসারে গমন করিতে আরম্ভ করিলেন। কতক দূর গিয়া, চতুর্দ্দিকে পরমরমণীয় উপবনমধ্যে কৈলাসাচলের এক প্রত্যন্ত পর্ব্বত দেখিতে পাইলেন। ঐ পর্ব্বতের নাম চন্দ্রপ্রভা; উহার নিম্নে এক মন্দিরের অভ্যন্তরে চরাচরগুরু ভগবান্ শূলপাণির প্রতিমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত আছে। ঐ প্রতিমার সম্মুখে পাশুপতব্রতধারিণী নির্ম্মমা, নিরহঙ্কারা, নির্ম্মৎসরা অমানুষাকৃতি, অষ্টাদশবর্ষদেশীয়া এক কন্যা বীণাবাদন পূর্ব্বক তানলয়বিশুদ্ধ মধুরস্বরে মহাদেবের স্তুতিবাদ করিয়া গান করিতেছেন। কন্যার দেহপ্রভায় উপবন উজ্জ্বল ও মন্দির আলোকময় হইয়াছে। তাঁহার স্কন্ধে জটাভার, গলে রুদ্রাক্ষমালা ও গাত্রে ভস্মলেপ। দেখিবামাত্র বোধ হয় যেন, পার্ব্বতী শিবের আরাধনায় ভক্তিমতী হইয়াছেন।
রাজকুমার তরুশাখায় ঘোটক বাঁধিয়া ভক্তিপূর্ব্বক ভগবান্ ত্রিলোচনকে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিলেন। নিমেষশূন্য লোচনে সেই অঙ্গনাকে নিরীক্ষণ করিয়া মনে মনে ভাবিলেন, কি আশ্চর্য্য? কত অসম্ভাবিত ও অচিন্তিত বিষয় স্বপ্নকল্পিতের ন্যায় সহসা উপস্থিত হয়, তাহা নিরূপণ করা যায় না। আমি মৃগয়ায় নির্গত ও যদৃচ্ছাক্রমে কিন্নরমিথুনের অনুসরণে প্রবৃত্ত হইয়া কত ভয়ঙ্কর ও কত রমণীয় প্রদেশ দেখিলাম। পরিশেষে গীতধ্বনিরব অনুসারে এই স্থানে উপস্থিত হইয়া এই এক অদ্ভুত ব্যাপার দেখিতেছি। কন্যার যেরূপ মনোহর আকার ও মধুর স্বর, তাহাতে কোন ক্রমে মানুষী বোধ হয় না, দেবকন্যা সন্দেহ নাই। ধরণীতলে কি সৌদামিনীর উদ্ভব হইতে পারে? যাহা হউক, যদি আমার দর্শনপথ হইতে সহসা অন্তর্হিত না হন, যদি কৈলাসশিখরে অথবা গগনমণ্ডলে হঠাৎ আরোহণ না করেন, তাহা হইলে, আমি ইঁহার নাম, ধাম ও তপস্যায় অভিনিবেশের কারণ, সমুদায় জিজ্ঞাসা করিয়া জানিব। এই স্থির করিয়া সেই মন্দিরের এক পার্শ্বে উপবেশন পূর্ব্বক সঙ্গীতসমাপ্তির অবসর প্রতীক্ষা করিয়া রহিলেন।
সঙ্গীত সমাপ্ত হইলে বীণা নিস্তব্ধ হইল। কন্যা গাত্রোত্থান পূর্ব্বক ভক্তিভাবে ভগবান্ ত্রিলোচনকে প্রদক্ষিণ করিয়া প্রণাম করিলেন। অনন্তর পবিত্র নেত্রপাত দ্বারা রাজকুমারকে পরিতৃপ্ত করিয়া সাদর সম্ভাষণে স্বাগত জিজ্ঞাসা করিলেন ও বিনীত ভাবে কহিলেন, মহাশয়! আশ্রমে চলুন ও অতিথিসৎকার গ্রহণ করিয়া চরিতার্থ করুন। রাজকুমার সম্ভাষণমাত্রেই আপনাকে পরিগৃহীত ও চরিতার্থ বোধ করিয়া ভক্তি পূর্ব্বক তাপসীকে প্রণাম করিলেন ও শিষ্যের ন্যায় তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। যাইতে যাইতে চিন্তা করিলেন, তাপসী আমাকে দেখিয়া অন্তর্হিত হইলেন না; প্রত্যুত দাক্ষিণ্য প্রকাশ করিয়া অতিথিসৎকার গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিলেন। বোধ হয়, জিজ্ঞাসা করিলে আত্মবৃত্তান্তও বলিতে পারেন।
কতক দূর যাইয়া এক গিরিগুহা দেখিলেন। উহার পুরোভাগ তমালবনে আবৃত, তথায় দিনমণি দৃষ্টিগোচর হয় না। পার্শ্বে নির্ঝরবারি ঝর্ঝর শব্দে পতিত হইতেছে। দূর হইতে উহার শব্দ কি মনোহর! অভ্যন্তরে বল্কল, কমণ্ডলু ও ভিক্ষাকপাল রহিয়াছে। দেখিবামাত্র মনে শান্তিরসের সঞ্চার হয়। তাপসী তথায় প্রবেশিয়া অর্ঘ্যসামগ্রী আহরণ পূর্ব্বক অর্ঘ্য আনয়ন করিলেন। রাজকুমার মৃদু মধুর সম্ভাষণে কহিলেন, ভগবতি! প্রসন্ন হউন, আপনকার দর্শনমাত্রেই আমি পবিত্র হইয়াছি এবং অর্ঘ্যও প্রদত্ত হইয়াছে। অত্যাদর প্রকাশ করার প্রয়োজন নাই। আপনি উপবেশন করুন। পরিশেষে তাপসীর অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া রাজকুমার যথাবিহিত অর্ঘ্য গ্রহণ করিলেন। দুই জন শিলাতলে উপবিষ্ট হইলেন। তাপসী রাজকুমারের পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি আপনার নাম, ধাম ও দিগ্বিজয়ের কথা বিশেষ করিয়া কহিলেন এবং কিন্নরমিথুনের অনুসরণক্রমে আপন আগমনবৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত বর্ণনা করিলেন।
অনন্তর তাপসী ভিক্ষাকপাল গ্রহণ করিয়া আশ্রমস্থিত তরুতলে ভ্রমণ করাতে তাঁহার ভিক্ষাভাজন, বৃক্ষ হইতে পতিত নানাবিধ সুস্বাদু ফলে পরিপূর্ণ হইল। চন্দ্রাপীড়কে সেই সকল ফল ভক্ষণ করিতে অনুরোধ করিলেন। চন্দ্রাপীড় ফল ভক্ষণ করিবেন কি, এই আশ্চর্য্য ব্যাপার দেখিয়া তাঁহার অতিশয় বিস্ময় জন্মিল। মনে মনে চিন্তা করিলেন, কি আশ্চর্য্য! এরূপ বিস্ময়কর ব্যাপার ত কখন দেখি নাই। অথবা তপস্যার অসাধ্য কি আছে! তপস্যাপ্রভাবে বশীভূত হইয়া অচেতনেরাও কামনা সফল করে, সন্দেহ নাই। অনন্তর তাপসীর অনুরোধে সুস্বাদু নানাবিধ ফল ভক্ষণ ও শীতল জল পান করিয়া পরিতৃপ্ত হইলেন। তাপসীও আহার করিলেন ও সন্ধ্যাকাল উপস্থিত হইলে যথাবিধ সন্ধ্যার উপাসনা করিয়া এক শিলাতলে উপবেশন পূর্ব্বক বিশ্রাম করিতে লাগিলেন।
চন্দ্রাপীড় অবসর বুঝিয়া বিনয় বাক্যে কহিলেন, ভগবতি! মানুষদিগের প্রকৃতি অতি চঞ্চল, প্রভুর কিঞ্চিৎ প্রসন্নতা দেখিলেই অমনি অধীর ও গর্ব্বিত হইয়া উঠে। আপনার অনুগ্রহ ও প্রসন্নতা দর্শনে উৎসাহিত হইয়া আমার অন্তঃকরণ কিছু জিজ্ঞাসা করিতে অভিলাষ করিতেছে। যদি আপনার ক্লেশকর না হয়, তাহা হইলে, আত্মবৃত্তান্ত বর্ণন দ্বারা আমার কৌতুকাক্রান্ত চিত্তকে পরিতৃপ্ত করুন। কি দেবতাদিগের কুল, কি মহর্ষিদিগের কুল, কি গন্ধর্ব্বদিগের কুল, কি অপ্সরাদিগের কুল—আপনি জন্মপরিগ্রহ দ্বারা কোন্ কুল উজ্জ্বল করিয়াছেন? কি নিমিত্ত কুসুমসুকুমার নবীন বয়সে আয়াসসাধ্য তপস্যায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন? কি নিমিত্তই বা দিব্য আশ্রম পরিত্যাগ করিয়া এই নির্জ্জন বনে একাকিনী অবস্থিতি করিতেছেন? তাপসী কিঞ্চিৎ কাল নিস্তব্ধ থাকিয়া পরে দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক রোদন করিতে আরম্ভ করিলেন। চন্দ্রাপীড় তাঁহাকে অশ্রুমুখী দেখিয়া মনে মনে চিন্তা করিলেন, এ আবার কি! শোক, তাপ কি সকল শরীরকেই আশ্রয় করিয়াছে? যাহা হউক, ইঁহার বাস্পসলিলপাতে আমার আরও কৌতুক জন্মিল। বোধ হয়, শোকের কোন মহৎ কারণ থাকিবেক। সামান্য শোক এতাদৃশ পবিত্র মূর্ত্তিকে কখন কলুষিত ও অভিভূত করিতে পারে না। বায়ুর আঘাতে কি বসুধা চালিত হয়? চন্দ্রাপীড় আপনাকে শোকোদ্দীপনহেতু ও তজ্জন্য অপরাধী বোধ করিয়া মুখপ্রক্ষালনের নিমিত্ত প্রস্রবণ হইতে জল আনিয়া দিলেন ও সান্ত্বনাবাক্যে নানাপ্রকার বুঝাইলেন। তাপসী চন্দ্রাপীড়ের সান্ত্বনাবাক্যে রোদনে ক্ষান্ত হইয়া মুখপ্রক্ষালন পূর্ব্বক কহিলেন, রাজপুত্ত্র! এই পাপীয়সী হতভাগিনীর অশ্রোতব্য বৈরাগ্যবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া কি হইবে? উহা কেবল শোকানল ও দুঃখার্ণব। যদি শুনিতে নিতান্ত অভিলাষ হইয়া থাকে, শ্রবণ করুন।
২.০৫ দেবলোকে অপ্সরাগণ বাস করে
দেবলোকে অপ্সরাগণ বাস করে শুনিয়া থাকিবেন। ইহাদিগের চতুর্দ্দশ কুল। ভগবান্ কমলযোনির মানস হইতে এক কুল উৎপন্ন হয়। দেব, অনল, জল, ভূতল, পবন, সূর্য্যরশ্মি, চন্দ্রকিরণ, সৌদামিনী, মৃত্যু ও মকরকেতু এই একাদশ হইতে একাদশ কুল। দক্ষপ্রজাপতির কন্যা মুনি ও অরিষ্টার সহিত গন্ধর্ব্বদিগের সমাগমে আর দুই কুল উৎপন্ন হয়। এই সমুদায়ে চতুর্দ্দশ কুল। মুনির গর্ভে চিত্ররথ জন্মগ্রহণ করেন। দেবরাজ ইন্দ্র আপন সুহৃন্মধ্যে পরিগণিত করিয়া প্রভাব ও কীর্ত্তিবর্দ্ধন পূর্ব্বক তাঁহাকে গন্ধর্ব্বলোকের অধিপতি করিয়া দেন। ভারতবর্ষের উত্তরে কিম্পুরুষবর্ষে হেমকূট নামে বর্ষপর্ব্বত তাঁহার বাসস্থান। তথায় তাঁহার অধীনে সহস্র সহস্র গন্ধর্ব্বলোক বাস করে। তিনিই চৈত্ররথ নামে এই রমণীয় কানন, অচ্ছোদননামক ঐ সরোবর ও ভবানীপতির এই প্রতিমূর্ত্তি প্রস্তুত করিয়াছেন। অরিষ্টার গর্ভে হংস নামে জগদ্বিখ্যাত গন্ধর্ব্ব জন্মগ্রহণ করেন। গন্ধর্ব্বরাজ চৈত্ররথ ঔদার্য্য ও মহত্ত্ব প্রকাশ পূর্ব্বক আপন রাজ্যের কিঞ্চিৎ অংশ প্রদান করিয়া তাঁহাকে রাজ্যাভিষিক্ত করেন। তাঁহার বাসস্থান হেমকূট। গৌরী নামে এক পরম সুন্দরী অপ্সরা তাঁহার সহধর্ম্মিণী! এই হতভাগিনী ও চিরদুঃখিনী তাঁহাদিগের একমাত্র কন্যা। আমার নাম মহাশ্বেতা। পিতা মাতার অন্য সন্তান সন্ততি ছিল না। আমিই একমাত্র অবলম্বন ছিলাম। শৈশবকালে বীণার ন্যায় এক অঙ্ক হইতে অঙ্কান্তরে যাইতাম ও অপরিস্ফুট মধুর বচনে সকলের মন হরণ করিতাম। সকলের স্নেহপাত্র হইয়া পরমপবিত্র বাল্যকাল বাল্যক্রীড়ায় অতিক্রান্ত হইল। যেরূপ বসন্তকালে নব পল্লবের ও নব পল্লবে কুসুমের উদয় হয় সেইরূপ আমার শরীরে যৌবনের উদয় হইল।
একদা মধুমাসের সমাগমে কমলবন বিকসিত হইলে, চূতকলিকা অঙ্কুরিত হইলে, মলয়মারুতের মন্দ মন্দ হিল্লোলে আহ্লাদিত হইয়া কোকিল সহকারশাখায় উপবেশন পূর্ব্বক সুস্বরে কুহুরব করিলে, অশোক কিংশুক প্রস্ফুটিত হইলে, আমি মাতার সহিত এই আচ্ছোদ সরোবরে স্নান করিতে আসিয়াছিলাম! এখানে আসিয়া মনোহর তীর, বিচিত্র তরু ও রমণীয় লতাকুঞ্জ অবলোকন করিয়া ভ্রমণ করিতে ছিলাম। ভ্রমণ করিতে করিতে সহসা বনানিলের সহিত সমাগত অতি সুরভি পরিমল আঘ্রাণ করিলাম; মধুকরের ন্যায় সেই সুরভি গন্ধে অন্ধ হইয়া তদনুসরণ ক্রমে কিঞ্চিৎ দূর গমন করিয়া দেখিলাম, অতি তেজস্বী, পরমরূপবান, সুকুমার, এক মুনিকুমার সরোবরে স্নান করিতে আসিতেছেন। তাঁহার সমভিব্যাহারে আর এক জন তাপসকুমার আছেন। উভয়েরই এরূপ সৌন্দর্য্য ও সৌকুমার্য্য বোধ হইল যেন, রতিপতি প্রিয় সহচর বসন্তের সহিত মিলিত হইয়া ক্রোধান্ধ চন্দ্রশেখরকে প্রসন্ন করিবার নিমিত্ত তপস্বিবেশ ধারণ করিয়াছেন। প্রথম মুনিকুমারের কর্ণে অমৃতনিস্যন্দিনী ও পরিমলবাহিনী এক কুসুমমঞ্জরী ছিল। ঐরূপ আশ্চর্য্য কুসুমমঞ্জরী কেহ কখন দেখে নাই। উহার গন্ধ আঘ্রাণ করিয়া স্থির করিলাম, উহার গন্ধে বন আমোদিত হইয়াছে। অনন্তর অনিমিষ লোচনে মুনিকুমারের মোহিনী মূর্ত্তি নেত্রগোচর করিয়া বিস্মিত হইলাম। ভাবিলাম, বিধাতা বুঝি কমল ও চন্দ্রমণ্ডল সৃষ্টি করিয়া ইঁহার বদনারবিন্দ নির্ম্মাণের কৌশল অভ্যাস করিয়া থাকিবেন। ঊরু ও বাহুযুগ সৃষ্টি করিবার পূর্ব্বে রম্ভাতরু ও মৃণালের সৃষ্টি করিয়া নির্ম্মাণকৌশল শিখিয়া থাকিবেন। নতুবা সমানাকার দুই তিন বস্তু সৃষ্টি করিবার প্রয়োজন কি? ফলতঃ মুনিকুমারের রূপ যতবার দেখি তত বারই অভিনব বোধ হয়। এইরূপ তাঁহার রমণীয় রূপের পক্ষপাতিনী হইয়া ক্রমে ক্রমে কুসুমশরের শরসন্ধানের পথবর্ত্তিনী হইলাম। কি মুনিকুমারের রূপসম্পত্তি, কি যৌবনকাল, কি বসন্তকাল, কি সেই সেই প্রদেশ, কি অনুরাগ, জানি না কে আমাকে উন্মাদিনী করিল। বারংবার মুনিকুমারকে সস্পৃহ লোচনে দেখিতে লাগিলাম। বোধ হইল যেন, আমার হৃদয়কে রজ্জুবদ্ধ করিয়া কেহ আকর্ষণ করিতেছে।
অনন্তর স্বেদসলিলের সহিত লজ্জা গলিত হইল। মকরধ্বজের নিশিত শরপাতভয়ে ভীত হইয়াই যেন, কলেবর কম্পিত হইল। মুনিকুমারকে আলিঙ্গন করিবার আশয়েই যেন, শরীর রোমাঞ্চরূপ কর প্রসারণ করিল। তখন মনে মনে চিন্তা করিলাম, শান্তপ্রকৃতি তাপসজনের প্রতি আমাকে অনুরাগিণী করিয়া দুরাত্মা মন্মথ কি বিসদৃশ কর্ম্ম করিল। অঙ্গনাজনের অন্তঃকরণ কি বিমূঢ়! অনুরাগের পাত্রাপাত্র কিছুই বিবেচনা করিতে পারে না। তেজঃপুঞ্জ তপোরাশি, মুনিকুমারই বা কোথায়? সামান্য জনসুলভ চিত্তবিকারই বা কোথায়? বোধ হয় ইনি আমার ভাবভঙ্গি দেখিয়া মনে মনে কত উপহাস করিয়াছেন। কি আশ্চর্য্য! চিত্ত বিকৃত হইয়াছে বুঝিতে পারিয়াও বিকার নিবারণ করিতে সমর্থ হইতেছি না। দুরাত্মা কন্দর্পের কি প্রভাব! ইহার প্রভাবে কত শত কন্যা লজ্জা ও কুলে জলাঞ্জলি দিয়া স্বয়ং প্রিয়তমের অনুগামিনী হয়। অনঙ্গ কেবল আমাকেই এইরূপ করিতেছে এমন নহে, কত শত কুলবালাকে এইরূপ অপথে পদার্পণ করায়। যাহা হউক, মদনদুশ্চেষ্টিত পরিস্ফুটরূপে প্রকাশ না হইতে হইতে এখান হইতে প্রস্থান করাই শ্রেয়ঃ। কি জানি পাছে ইনি কুপিত হইয়া শাপ দেন। শুনিয়াছি মুনিজনের প্রকৃতি অতিশয় রোষপরবশ। সামান্য অপরাধেও তাঁহারা ক্রোধান্বিত হইয়া উঠেন ও অভিসম্পাত করেন। অতএব এখানে আর আমার থাকা বিধেয় নয়। এই স্থির করিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিবার অভিপ্রায় করিলাম। মুনিজনেরা সকলের পূজনীয় ও নমস্য বিবেচনা করিয়া প্রণাম করিলাম। আমি প্রণাম করিলে পর কুসুমশরশাসনের অলঙ্ঘ্যতা, বসন্ত কালের ও সেই সেই প্রদেশের রমণীয়তা, ইন্দ্রিয়গণের অবাধ্যতা, সেই সেই ঘটনার ভবিতব্যতা এবং আমার ঈদৃশ ক্লেশ ও দৌর্ভাগ্যের অবশ্যম্ভাবিতা প্রযুক্ত আমার ন্যায় সেই মুনিকুমারও মোহিত ও অভিভূত হইলেন। স্তম্ভ, স্বেদ, রোমাঞ্চ, বেপথু প্রভৃতি সাত্ত্বিক ভাবের লক্ষণ সকল তাঁহার শরীরে স্পষ্ট রূপে প্রকাশ পাইল। তাঁহার অন্তঃকরণের তদানীন্তন ভাব বুঝিতে পারিয়া তাঁহার সহচর দ্বিতীয় ঋষিকুমারের নিকট গমন ও ভক্তিভাবে প্রণাম করিয়া জিজ্ঞাসিলাম, ভগবন! ইঁহার নাম কি? ইনি কোন্ তপোধনের পুত্ত্র? ইঁহার কর্ণে যে কুসুমমঞ্জরী দেখিতেছি উহা কোন্ তরুর সম্পত্তি। আহা উহার কি সৌরভ! আমি কখন ঐরূপ সৌরভ আঘ্রাণ করি নাই। আমার কথায় তিনি ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, বালে! তোমার উহা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন কি? যদি শুনিতে নিতান্ত কৌতুক জন্মিয়া থাকে শ্রবণ কর।
শ্বেতকেতু নামে মহাতপা মহর্ষি দিব্য লোকে বাস করেন। তাঁহার রূপ জগদ্বিখ্যাত। তিনি একদা দেবার্চ্চনার নিমিত্ত কমল কুসুম তুলিতে মন্দাকিনীপ্রবাহে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। কমলাসনা লক্ষ্মী তাঁহার রূপ লাবণ্য দেখিয়া মোহিত হন। তথায় পরস্পর সমাগমে এক কুমার জন্মে। ইনি তোমার পুত্ত্র হইলেন গ্রহণ কর বলিয়া লক্ষ্মী শ্বেতকেতুকে সেই পুত্ত্র সন্তান সমর্পণ করেন। মহর্ষি পুত্ত্রের সমুদায় সংস্কার সম্পন্ন করিয়া পুণ্ডরীকে জন্মিয়াছিলেন বলিয়া পুণ্ডরীক নাম রাখেন। যাঁহার কথা জিজ্ঞাসা করিতেছ, ইনি সেই পুণ্ডরীক। পূর্ব্বে অসুর ও সুরগণ যখন ক্ষীরসাগর মন্থন করেন, তৎকালে পারিজাত বৃক্ষ তথা হইতে উদ্গত হয়। এই কুসুমমঞ্জরী সেই পারিজাত বৃক্ষের সম্পত্তি। ইহা যেরূপে ইঁহার শ্রবণগত হইয়াছে তাহাও শ্রবণ কর। অদ্য চতুর্দ্দশী, ইনি ও আমি ভগবান্ ভবানীপতির অর্চ্চনার নিমিত্ত নন্দনবনের নিকট দিয়া কৈলাসপর্ব্বতে আসিতেছিলাম। পথিমধ্যে নন্দনবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা এই পারিজাতকুসুমমঞ্জরী হস্তে লইয়া আমাদের নিকটবর্ত্তিনী হইলেন; প্রণাম করিয়া ইঁহাকে বিনীত বচনে কহিলেন, ভগবন্! আপনার যেরূপ আকার তাহার সদৃশ এই অলঙ্কার, আপনি এই কুসুমমঞ্জরীকে শ্রবণমণ্ডলে স্থান দান করিলে আমি চরিতার্থ হই। বনদেবতার কথায় অনাদর করিয়া ইনি চলিয়া যাইতেছিলেন, আমি তাঁহার হস্ত হইতে মঞ্জরী লইয়া কহিলাম, সখে! দোষ কি! বনদেবতার প্রণয় পরিগ্রহ করা উচিত, এই বলিয়া ইঁহার কর্ণে পরাইয়া দিলাম।
তিনি এইরূপ পরিচয় দিতেছিলেন এমন সময়ে সেই তপোধনযুবা কিঞ্চিৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, অয়ি কুতূহলাক্রান্তে! তোমার এত অনুসন্ধানে প্রয়োজন কি? যদি কুসুমমঞ্জরী লইবার বাসনা হইয়া থাকে, গ্রহণ কর এই বলিয়া আমার নিকটবর্ত্তী হইলেন এবং আপনার কর্ণদেশ হইতে উন্মোচন করিয়া আমার শ্রবণপুটে পরাইয়া দিলেন। আমার গণ্ডস্থলে তাঁহার হস্তস্পর্শ হইবামাত্র অন্তঃকরণে কোন অনির্ব্বচনীয় ভাবোদয় হওয়াতে তিনি অবশেন্দ্রিয় হইলেন। করতলস্থিত অক্ষমালা হৃদয়স্থিত লজ্জার সহিত গলিত হইল জানিতে পারিলেন না। অক্ষমালা তাঁহার পাণিতল হইতে ভূতলে পড়িতে না পড়িতেই আমি ধরিলাম ও আপন কণ্ঠের আভরণ করিলাম। এই সময়ে ছত্রধারিণী আসিয়া বলিল, ভর্ত্তৃদারিকে! দেবী স্নান করিয়া তোমার অপেক্ষা করিতেছেন, তোমার আর বিলম্ব করা বিধেয় নয়। নবধৃতা করিণী অঙ্কুশের আঘাতে যেরূপ কুপিত ও বিরক্ত হয়, আমি সেই দাসীর বাক্যে বিরক্ত হইয়া, কি করি, মাতা অপেক্ষা করিতেছেন শুনিয়া, সেই যুবা পুরুষের মুখমণ্ডল হইতে অতিকষ্টে আপনার অনুরাগাকৃষ্ট নেত্রযুগল আকর্ষণ করিয়া স্নানার্থ গমন করিলাম।
কিঞ্চিৎ দূর গমন করিলে দ্বিতীয় ঋষিকুমার সেই তপোধনযুবার এরূপ চিত্তবিকার দেখিয়া প্রণয়কোপ প্রকাশ পূর্ব্বক কহিলেন, সখে পুণ্ডরীক! এ কি! তোমার অন্তঃকরণ এরূপ বিকৃত হইল কেন? ইন্দ্রিয়পরতন্ত্র লোকেরাই অপথে পদার্পণ করে। নির্ব্বোধেরাই সদসদ্বিবেচনা করিতে পারে না। মূঢ় ব্যক্তিরাই চঞ্চল চিত্তকে স্থির করিতে অসমর্থ। তুমি কি তাহাদিগের ন্যায় বিবেচনাশূন্য হইয়া দুষ্কর্ম্মে অনুরক্ত হইলে? তোমার আজি অভূতপূর্ব্ব এরূপ ইন্দ্রিয়বিকার কেন হইল? ধৈর্য্য, গাম্ভীর্য্য, বিনয়, লজ্জা, জিতেন্দ্রিয়তা প্রভৃতি তোমার স্বাভাবিক সদ্গুণ সকল কোথায় গেল? কুলক্রমাগত ব্রহ্মচর্য্য, বিষয়বৈরাগ্য, গুরুদিগের উপদেশ, তপস্যায় অভিনিবেশ, শাস্ত্রের আলোচনা, যৌবনের শাসন, মনের বশীকরণ, সমুদায় একেবারে বিস্মৃত হইলে? তোমার বুদ্ধি কি এইরূপে পরিণত হইল? ধর্ম্মশাস্ত্রাভ্যাসের কি এই গুণ দর্শিল? গুরুজনের উপদেশে কি উপকার হইল? এত দিনে বুঝিলাম বিবেকশক্তি ও নীতিশিক্ষা নিষ্ফল, জ্ঞানাভ্যাস ও সদুপদেশে কোন ফল নাই, জিতেন্দ্রিয়তা কেবল কথামাত্র, যেহেতুক ভবাদৃশ ব্যক্তিকেও অনুরাগে কলুষিত ও অজ্ঞানে অভিভূত দেখিতেছি। তোমার অক্ষমালা কোথায়? উহা করতল হইতে গলিত ও অপহৃত হইয়াছে দেখিতে পাও নাই? কি আশ্চর্য্য! একেবারে জ্ঞানশূন্য ও চৈতন্যশূন্য হইয়াছ! ঐ অনার্য্যা বালা অক্ষমালা হরণ করিয়া পলায়ন করিতেছে এবং মন হরণ করিবার উদ্যোগে আছে এই বেলা সাবধান হও। তপোধনযুবা কিঞ্চিৎ লজ্জিত হইয়া, সখে! কি হেতু আমাকে অন্যরূপ সম্ভাবনা করিতেছ? আমি ঐ দুর্ব্বিনীত কন্যার অক্ষমালাহরণাপরাধ ক্ষমা করিব না বলিয়া ভ্রূকুটিভঙ্গি দ্বারা অলীক কোপ প্রকাশ পূর্ব্বক আমাকে কহিলেন, চপলে! আমার অক্ষমালা না দিয়া এখান হইতে যাইতে পাইবে না। আমি তাঁহার নিরূপম রূপলাবণ্যের অনুরাগিণী ও ভাবভঙ্গির পক্ষপাতিনী হইয়া এরূপ শূন্যহৃদয় হইয়াছিলাম যে, অক্ষমালা ভ্রমে কণ্ঠ হইতে উন্মোচন করিয়া আমার একাবলীমালা তাঁহার করে প্রদান করিলাম। তিনিও এরূপ অন্যমনস্ক হইয়া আমার মুখপানে চাহিয়াছিলেন যে উহা অক্ষমালা বলিয়াই গ্রহণ করিলেন। মুনিকুমারের সন্নিধানে স্বেদজলে বারংবার স্নান করিয়া পরে সরোবরে স্নান করিতে গেলাম। স্নানানন্তর মুনিকুমারের মনোহারিণী মূর্ত্তি মনে মনে চিন্তা করিতে করিতে বাটী গমন করিলাম।
অন্তঃপুরে প্রবেশিয়া যে দিকে নেত্রপাত করি, পুণ্ডরীকের মুখপুণ্ডরীক ভিন্ন আর কিছুই দেখিতে পাই না। মুনিকুমারের অদর্শনে এরূপ অধীর হইলাম যে, তৎকালে জাগরিত কি নিদ্রিত, একাকিনী কি অনেকের নিকটবর্ত্তিনী ছিলাম, সুখের অবস্থা কি দুঃখের দশা ঘটিয়াছিল, উৎকণ্ঠা কি ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হইয়াছিলাম, কিছুই বুঝিতে পারি নাই। ফলতঃ কোন জ্ঞান ছিল না। একবারে চৈতন্যশূন্য হইয়াছিলাম। তৎকালে কি কর্ত্তব্য কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, কেহ যেন আমার নিকট না যায়, পরিচারিকাদিগকে এইমাত্র আদেশ দিয়া, প্রাসাদের উপরিভাগে উঠিলাম। যে স্থানে সেই ঋষিকুমারের সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছিল সেই প্রদেশকে মহারত্নাধিষ্ঠিত, অমৃতরসাভিষিক্ত, চন্দ্রোদয়ালঙ্কৃত বোধ করিয়া বারংবার দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলাম। দেখিতে দেখিতে এরূপ উন্মত্ত ও ভ্রান্ত হইলাম যে, সেই দিক্ হইতে যে অনিল ও পক্ষী সকল আসিতেছিল তাহাদিগকেও প্রিয়তমের সংবাদ জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা জন্মিল। আমার অন্তঃকরণ তাঁহার প্রতি এরূপ অনুরক্ত হইল যে, তিনি যে যে কর্ম্ম করিতেন, তাহাতেও পক্ষপাতী হইয়া উঠিল। তিনি তপস্বী ছিলেন বলিয়া তপস্যায় আর বিদ্বেষ থাকিল না। তিনি মুনিবেশ ধারণ করিতেন সুতরাং মুনিবেশে আর গ্রাম্যতা রহিল না। পারিজাতকুসুম তাঁহার কর্ণে ছিল বলিয়াই মনোহর হইল। সুরলোক তাঁহার বাসস্থান বলিয়াই রমণীয় বোধ হইতে লাগিল। ফলতঃ নলিনী যেরূপ রবির পক্ষপাতিনী, আমিও সেইরূপ ঋষিকুমারের পক্ষপাতিনী হইয়া নিমেষশূন্য দৃষ্টিতে সেই দিক্ দেখিতে লাগিলাম।
আমার তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী তরলিকাও স্নান করিতে গিয়াছিল। সে অনেক ক্ষণের পর বাটী আসিয়া আমাকে কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! আমরা সরোবরের তীরে যে দুই জন তাপসকুমার দেখিয়াছিলাম, তাঁহাদিগের এক জন, যিনি তোমার কর্ণে কল্পপাদপের কুসুমমঞ্জরী পরাইয়া দেন, তিনি গুপ্ত ভাবে আমার নিকটে আসিয়া সুমধুর বচনে জিজ্ঞাসা করিলেন, বালে! যাঁহার কর্ণে আমি পুষ্প মঞ্জরী পরাইয়া দিলাম ইনি কে? ইঁহার নাম কি? কাহার অপত্য? কোথায় বা গমন করিলেন? আমি বিনীত বচনে কহিলাম, ভগবন্! ইনি গন্ধর্ব্বের অধিপতি হংসের দুহিতা, নাম মহাশ্বেতা। হেমকূট পর্ব্বতে গন্ধর্ব্বলোকে বাস করেন, তথায় গমন করিলেন। অনন্তর অনিমিষ লোচনে ক্ষণ কাল অনুধ্যান করিয়া পুনর্ব্বার বলিলেন, ভদ্রে! তুমি বালিকা বট; কিন্তু তোমার আকৃতি দেখিয়া বোধ হইতেছে চঞ্চলপ্রকৃতি নও। একটী কথা বলি শুন। আমি কৃতাঞ্জলিপুটে দণ্ডায়মান হইয়া সমাদর প্রদর্শন পূর্ব্বক সবিনয়ে নিবেদন করিলাম, মহাভাগ! আদেশ দ্বারা এই ক্ষুদ্র জনের প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করিবেন ইহার পর আর সৌভাগ্য কি? ভবাদৃশ মহাত্মারা মদ্বিধ ক্ষুদ্র জনের প্রতি কটাক্ষপাত করিলেই তাহারা চরিতার্থ হয়। আপনি বিশ্বাস পূর্ব্বক কোন বিষয়ে আদেশ করিলে আমি চিরক্রীত ও অনুগৃহীত হইব, সন্দেহ নাই। আমার বিনয়গর্ভ বাক্য শুনিয়া সখীর ন্যায়, উপকারিণীর ন্যায় ও প্রাণদায়িনীর ন্যায় আমাকে জ্ঞান করিলেন। স্নিগ্ধ দৃষ্টি দ্বারা প্রসন্নতা প্রকাশ পূর্ব্বক নিকটবর্ত্তী এক তমালতরুর পল্লব গ্রহণ করিয়া পল্লবের রসে আপন পরিধেয় বল্কলের এক খণ্ডে নখ দ্বারা এই পত্রিকা লিখিয়া আমাকে দিলেন। কহিলেন, আর কেহ যেন জানিতে না পারে, মহাশ্বেতা যখন একাকিনী থাকিবেন তাঁহার করে সমর্পণ করিও।
আমি হর্ষোৎফুল্ল লোচনে তরলিকার হস্ত হইতে পত্রিকা গ্রহণ করিলাম। তাহাতে লিখিত ছিল, হংস যেমন মুক্তামালায় মৃণালভ্রমে প্রতারিত হয়, তেমনি আমার মন মুক্তাময় একাবলীমালায় প্রতারিত হইয়া তোমার প্রতি সাতিশয় অনুরক্ত হইয়াছে। পথভ্রান্ত পথিকের দিগ্ভ্রম, মূকের জিহ্বাচ্ছেদ, অসম্বদ্ধভাষীর জ্বরপ্রলাপ, নাস্তিকের চার্ব্বাকশাস্ত্র, উন্মত্তের সুরাপান যেরূপ ভয়ঙ্কর, পত্রিকাও আমার পক্ষে সেইরূপ ভয়ঙ্কর বোধ হইল। পত্রিকা পাঠ করিয়া উন্মত্ত ও অবশেন্দ্রিয় হইলাম। পুনঃ পুনঃ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, তরলিকে! তুমি তাঁহাকে কোথায় কি রূপে দেখিলে? তিনি কি কহিলেন? তুমি তথায় কতক্ষণ ছিলে? তিনি আমাদের অনুসরণে প্রবৃত্ত হইয়া কত দূর পর্য্যন্ত আসিয়াছিলেন? প্রিয়জনসম্বদ্ধ এক কথাও বারংবার বলিতে ও শুনিতে ভাল লাগে। আমি পরিজনদিগকে তথা হইতে বিদায় করিয়া কেবল তরলিকার সহিত মুনিকুমারসম্বদ্ধ কথায় দিবসক্ষেপ করিলাম।
২.০৬ দিবাবসানে দিবাকরের বিরহে
দিবাবসানে দিবাকরের বিরহে পূর্ব্ব দিক্ আমার ন্যায় মলিন হইল। মদীয় হৃদয়ের ন্যায় পশ্চিম দিকের রাগ বৃদ্ধি হইতে লাগিল। দুই এক দণ্ড বেলা আছে এমন সময়ে ছত্রধারিণী আসিয়া কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! আমরা স্নান করিতে গিয়া যে দুই জন মুনিকুমার দেখিয়াছিলাম, তাঁহাদের এক জন দ্বারে দণ্ডায়মান আছেন। বলিলেন, অক্ষমালা লইতে আসিয়াছি। মুনিকুমার, এই শব্দ শ্রবণমাত্র অতিমাত্র ব্যস্ত হইয়া কহিলাম, শীঘ্র সঙ্গে করিয়া লইয়া আইস। যেরূপ রূপের সহায় যৌবন, যৌবনের সহায় মকরকেতন, মকরকেতনের সহায় বসন্তকাল, বসন্তকালের সহায় মলয়পবন, সেইরূপ তিনি পুণ্ডরীকের সখা, নাম কপিঞ্জল, দেখিবামাত্র চিনিলাম। তাঁহার বিষণ্ণ আকার দেখিয়া বোধ হইল যেন, কোন অভিপ্রায়ে আমাকে কিছু বলিতে আসিয়াছেন। আমি উঠিয়া প্রণাম করিয়া সমাদরে আসন প্রদান করিলাম। আসনে উপবেশন করিলে চরণ ধৌত করিয়া দিলাম। অনন্তর কিছু বলিতে ইচ্ছা করিয়া আমার নিকটে উপবিষ্ট তরলিকার প্রতি দৃষ্টিপাত করাতে আমি তাঁহার দৃষ্টিতেই অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া বিনয়বাক্যে কহিলাম, ভগবন্! আমা হইতে ইহাকে ভিন্ন ভাবিবেন না। যাহা আদেশ করিতে অভিলাষ হয় অশঙ্কিত ও অসঙ্কুচিত চিত্তে আজ্ঞা করুন।
কপিঞ্জল কহিলেন, রাজপুত্ত্রি! কি কহিব, লজ্জায় বাক্যস্ফূর্ত্তি হইতেছে না। কন্দমূলফলাশী বনবাসীর মনে অনঙ্গবিলাস সঞ্চারিত হইবে ইহা স্বপ্নের অগোচর। শান্তস্বভাব তাপসকে প্রণয়পরবশ করিয়া বিধি কি বিড়ম্বনা করিলেন! দগ্ধ মন্মথ অনায়াসেই লোকদিগকে উপহাসাস্পদ ও অবজ্ঞাস্পদ করিতে পারে। অন্তঃকরণে একবার অনঙ্গবিলাস সঞ্চারিত হইলে আর ভদ্রতা নাই। তখন প্রগাঢ় ধীশক্তিসম্পন্ন লোকেরাও নিতান্ত অসার ও অপদার্থ হইয়া যান। তখন আর লজ্জা, ধৈর্য্য, বিনয়, গাম্ভীর্য্য কিছুই থাকে না। বন্ধু যে পথে পদার্পণ করিতে উদ্যত হইয়াছেন, জানি না, উহা কি বল্কলধারণের উপযুক্ত, কি জটাধারণের সমুচিত, কি তপস্যার অনুরূপ, কি ধর্ম্মের অঙ্গ, কি অপবর্গ লাভের উপায়! কি দৈবদুর্ব্বিপাক উপস্থিত! না বলিলে চলে না, উপায়ান্তর ও শরণান্তরও দেখি না, কি করি বলিতে হইল। শাস্ত্রকারেরা লিখিয়াছেন, স্বীয় প্রাণবিনাশেও যদি সুহৃদের প্রাণরক্ষা হয় তথাপি তাহা কর্ত্তব্য; সুতরাং আমাকে লজ্জায় জলাঞ্জলি দিতে হইল।
তোমার সমক্ষে রোষ ও অসন্তোষ প্রকাশ পূর্ব্বক বন্ধুরে সেই প্রকার তিরস্কার করিয়া আমি তথা হইতে প্রস্থান করিলাম। স্নানানন্তর সরোবর হইতে উঠিয়া তুমি বাটী আসিলে ভাবিলাম, বন্ধু এক্ষণে একাকী কি করিতেছেন গুপ্ত ভাবে এক বার দেখিয়া আসি। অনন্তর আস্তে আস্তে আসিয়া বৃক্ষের অন্তরাল হইতে দৃষ্টিপাত করিলাম; কিন্তু তাঁহাকে দেখিতে পাইলাম না। তৎকালে আমার অন্তঃকরণে কত বিতর্ক, কত সন্দেহ ও কতই বা ভয় উপস্থিত হইল। একবার ভাবিলাম, অনঙ্গের মোহন শরে মুগ্ধ হইয়া বন্ধু বুঝি, সেই কামিনীর অনুগামী হইয়া থাকিবেন। আবার মনে করিলাম সেই সুন্দরীর গমনের পর চৈতন্যোদয় হওয়াতে লজ্জায় আমাকে মুখ দেখাইতে না পারিয়া বুঝি কোন স্থানে লুকাইয়া আছেন; কি আমি ভর্ৎসনা করিয়াছি বলিয়া ক্রুদ্ধ হইয়া কোন স্থানে প্রস্থান করিয়াছেন; কিংবা আমাকেই অন্বেষণ করিতেছেন। আমরা দুই জনে চিরকাল একত্র ছিলাম; কখন পরস্পর বিরহদুঃখ সহ্য করিতে হয় নাই। সুতরাং বন্ধুকে না দেখিয়া যে কত ভাবনা উপস্থিত হইল তাহা বাক্য দ্বারা ব্যক্ত করা যায় না। পুনর্ব্বার চিন্তা করিলাম, বন্ধু আমার সমক্ষে সেই রূপ অধীরতা প্রকাশ করিয়া অতিশয় লজ্জিত হইয়া থাকিবেন। লজ্জায় কে কি না করে। কত লোক লজ্জার হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইবার নিমিত্ত কত অসদুপায় অবলম্বন করে। জলে, অনলে ও উদ্বন্ধনেও প্রাণত্যাগ করিয়া থাকে; যাহা হউক, নিশ্চিন্ত থাকা হইবে না অন্বেষণ করি। ক্রমে তরুলতাগহন, চন্দনবীথিকা, লতামণ্ডপ, সরোবরের কূল সর্ব্বত্র অন্বেষণ করিলাম, কুত্রাপি দেখিতে পাইলাম না; তখন স্নেহকাতর মনে অনিষ্ট শঙ্কাই প্রবল হইয়া উঠিল।
পুনর্ব্বার সতর্কতা পূর্ব্বক ইতস্ততঃ অন্বেষণ করিতে করিতে দেখিলাম সরোবরের তীরে নানাবিধলতাবেষ্টিত নিভৃত এক লতাগহনের অভ্যন্তরবর্ত্তী শিলাতলে বসিয়া বাম করে বাম গণ্ড সংস্থাপন পূর্ব্বক চিন্তা করিতেছেন। দুই চক্ষু মুদ্রিত, নেত্রজলে কপোলযুগল ভাসিতেছে। ঘন ঘন নিশ্বাস বহিতেছে। শরীর স্পন্দরহিত, কান্তিশূন্য ও পাণ্ডুবর্ণ। হঠাৎ দেখিলে চিত্রিতের ন্যায় বোধ হয়; এরূপ জ্ঞানশূন্য যে, কল্পপাদপের কুসুমমঞ্জরীর অবশিষ্টরেণুগন্ধলোভে ভ্রমর ঝঙ্কার পূর্ব্বক বারংবার কর্ণে বসিতেছে এবং লতা হইতে কুসুম ও কুসুমরেণু গাত্রে পড়িতেছে তথাপি সংজ্ঞা নাই, কলেবর এরূপ শীর্ণ যে সহসা চিনিতে পারা যায় না। তদবস্থাপন্ন তাঁহাকে ক্ষণকাল নিরীক্ষণ করিয়া অতিশয় বিষণ্ণ হইলাম। উদ্বিগ্ন চিত্তে চিন্তা করিলাম মকরকেতুর কি প্রভাব! যে ব্যক্তি উহার শরসন্ধানের পথবর্ত্তী হয় নাই সেই ধন্য ও নিরুদ্বেগে সংসারযাত্রা সংবরণ করিয়া থাকে। এক বার উহার বাণপাতের সম্মুখবর্ত্তী হইলে আর কোন জ্ঞান থাকে না। কি আশ্চর্য্য! ক্ষণকালের মধ্যে এরূপ জ্ঞানরাশি ঈদৃশ অবস্থান্তর প্রাপ্ত হইয়াছেন। ইনি শৈশবাবধি ধীর ও শান্তপ্রকৃতি ছিলেন। সকলে আদর্শস্বরূপ জ্ঞান করিয়া ইঁহার স্বভাবের অনুকরণ করিতে চেষ্টা করিত ও গুণের কথা উল্লেখ করিয়া যথেষ্ট প্রশংসা করিত। আজি কি রূপে বিবেকশক্তি ও তপঃপ্রভাবের পরাভব করিয়া এবং গাম্ভীর্য্যের উন্মূলন ও ধৈর্য্যের সমূলচ্ছেদ করিয়া দগ্ধ মন্মথ এই অসামান্য সৎস্বভাবসম্পন্ন মহাত্মাকে ইতর জনের ন্যায় অভিভূত ও উন্মত্ত করিল! শাস্ত্রকারেরা কহেন, নির্দ্দোষ ও নিষ্কলঙ্ক রূপে যৌবনকাল অতিবাহিত করা অতি কঠিন কর্ম্ম। ইঁহার অবস্থা শাস্ত্রকারদিগের কথাই সপ্রমাণ করিতেছে। এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে নিকটবর্ত্তী হইলাম এবং শিলাতলের এক পার্শ্বে উপবেশন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, সখে! তোমাকে এরূপ দেখিতেছি কেন? বল আজি তোমার কি ঘটিয়াছে?
তিনি অনেক ক্ষণের পর নয়ন উন্মীলন ও দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক, সখে! তুমি আদ্যোপান্ত সমুদায় বৃত্তান্ত অবগত হইয়াও অজ্ঞের ন্যায় কি জিজ্ঞাসা করিতেছ! এই মাত্র উত্তর দিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। তাঁহার সেইরূপ অবস্থা ও আকার দেখিয়া স্থির করিলাম, এক্ষণে উপদেশ দ্বারা ইঁহার কোন প্রতিকার হওয়া সম্ভব নহে। কিন্তু অসন্মার্গপ্রবৃত্ত সুহৃদ্কে কুপথ হইতে নিবৃত্ত করা সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য কর্ম্ম। যাহা হউক, আর কিছু উপদেশ দিই। এই স্থির করিয়া তাঁহাকে বলিলাম, সখে! হাঁ আমি সকলই অবগত হইয়াছি; কিন্তু ইহাই জিজ্ঞাসা করি, তুমি যে পদবীতে পদার্পণ করিয়াছ উহা কি সাধুসঙ্গত? কি ধর্ম্মশাস্ত্রোপদিষ্ট পথ? কি তপস্যার অঙ্গ? কি স্বর্গ ও অপবর্গ লাভের উপায়? এই বিগর্হিত পথ অবলম্বন করা দূরে থাকুক এরূপ সঙ্কল্পকেও মনে স্থান দেওয়া উচিত নয়। মূঢ়েরাই অনঙ্গপীড়ায় অধীর হয়। নির্ব্বোধেরাই হিতাহিত বিবেচনা করিতে পারে না। তুমিও কি তাহাদিগের ন্যায় অসৎ পথে প্রবৃত্ত হইয়া সাধুদিগের নিকট উপহাসাস্পদ হইবে? সাধুবিগর্হিত পথ অবলম্বন করিয়া সুখাভিলাষ কি? পরিণামবিরস বিষয়ভোগে যাহারা সুখ প্রাপ্তির আশা করে, ধর্ম্মবুদ্ধিতে বিষলতাবনে তাহাদিগের জলসেক করা হয়, তাহারা কুবলয়মালা বলিয়া অসিলতা গলে দেয়, মহারত্ন বলিয়া জ্বলন্ত অঙ্গার স্পর্শ করে, মৃণাল বলিয়া মত্ত হস্তীর দন্ত উৎপাটন করিতে যায়, রজ্জু বলিয়া কালসর্প ধরে। দিবাকরের ন্যায় জ্যোতি ধারণ করিয়াও খদ্যোতের ন্যায় আপনাকে দেখাইতেছ কেন? সাগরের ন্যায় গম্ভীরস্বভাব হইয়াও উন্মার্গপ্রস্থিত ও উদ্বেল ইন্দ্রিয়স্রোতের সংযম করিতেছ না কেন? এক্ষণে আমার কথা রাখ, ক্ষুভিতচিত্তকে সংযত কর, ধৈর্য্য ও গাম্ভীর্য্য অবলম্বন করিয়া চিত্তবিকার দূর করিয়া দেও।
এইরূপ উপদেশ দিতেছি এমন সময়ে ধারাবাহী অশ্রুবারি তাঁহার নেত্রযুগল হইতে গলিত হইল। আমার হস্ত ধারণ পূর্ব্বক বলিলেন, সখে! অধিক কি বলিব, আশীবিষবিষের ন্যায় বিষম কুসুমশরের শরসন্ধানে পতিত হও নাই, সুখে উপদেশ দিতেছ! যাহার ইন্দ্রিয় আছে, মন আছে, দেখিতে পায়, শুনিতে পায়, হিতাহিত বিবেচনা করিতে পারে, সেই উপদেশের পাত্র। আমার তাহা কিছুই নাই। আমার নিকটে ধৈর্য্য, গাম্ভীর্য্য, বিবেচনা এ সকল কথাও অস্তগত হইয়াছে। এ সময় উপদেশের সময় নয়; যাবৎ জীবিত থাকি এই অচিকিৎসনীয় রোগের প্রতীকারের চেষ্টা পাও। আমার অঙ্গ দগ্ধ ও হৃদয় জর্জ্জরিত হইতেছে। এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য কর, এই বলিয়া নিস্তব্ধ হইলেন।
যখন উপদেশবাক্যের কোন ফল দর্শিল না এবং দেখিলাম তাঁহার হৃদয়ে অনুরাগ এরূপ দৃঢ় রূপে বদ্ধমূল হইয়াছে যে, তাহা উন্মূলিত করা নিতান্ত অসাধ্য, তখন প্রাণরক্ষার নিমিত্ত সরোবরের সরস মৃণাল, শীতল কমলিনীদল ও স্নিগ্ধ শৈবাল তুলিয়া শয্যা করিয়া দিলাম এবং তথায় শয়ন করাইয়া কদলীপত্র দ্বারা বীজন করিতে লাগিলাম। তৎকালে মনে হইল, দুরাত্মা দগ্ধ মদনের কিছুই অসাধ্য নাই। কোথায় বা বনবাসী তপস্বী, কোথায় বা বিলাসরাশি গন্ধর্ব্বকুমারী। ইহাদিগের মনে পরস্পর অনুরাগ সঞ্চার হইবে ইহা স্বপ্নের অগোচর। শুষ্ক তরু মঞ্জরিত হইবে এবং মাধবীলতা তাহাকে অবলম্বন করিয়া উঠিবে ইহা কাহার মনে বিশ্বাস ছিল? চেতনের কথা কি, অচেতন তরু লতা প্রভৃতিও উহার আজ্ঞার অধীন। দেবতারাও উহার শাসন উল্লঙ্ঘন করিতে পারেন না। কি আশ্চর্য্য! দুরাত্মা এই অগাধ গাম্ভীর্য্যসাগরকেও ক্ষণ কালের মধ্যে তৃণের ন্যায় অসার ও অপদার্থ করিয়া ফেলিল। এক্ষণে কি করি, কোন্ দিকে যাই, কি উপায়ে বান্ধবের প্রাণরক্ষা হয়। দেখিতেছি মহাশ্বেতা ভিন্ন আর কোন উপায় নাই। বন্ধু স্বভাবতঃ ধীর, প্রগল্ভতা অবলম্বন করিয়া আপনি কদাচ তাহার নিকট যাইতে পারিবেন না। শাস্ত্রকারেরা গর্হিত অকার্য্য দ্বারা সুহৃদের প্রাণরক্ষা কর্ত্তব্য বলিয়া থাকেন; সুতরাং অতি লজ্জাকর ও মানহানির কর্ম্মও আমার কর্ত্তব্যপক্ষে পরিগণিত হইল। ভাবিলাম, যদি বন্ধুকে বলি যে, তোমার মনোরথ সফল করিবার জন্য মহাশ্বেতার নিকট চলিলাম, তাহা হইলে, পাছে লজ্জাক্রমে বারণ করেন এই নিমিত্ত তাঁহাকে কিছু না বলিয়া ছলক্রমে তোমার নিকট আসিয়াছি। এই সময়ের সমুচিত, সেইরূপ অনুরাগের সমুচিত ও আমার আগমনের সমুচিত যাহা হয় কর, বলিয়া কি উত্তর দি শুনিবার আশয়ে আমার মুখ পানে চাহিয়া রহিলেন।
আমি তাঁহার সেই কথা শুনিয়া সুখময় হ্রদে, অমৃতময় সরোবরে নিমগ্ন হইলাম। লজ্জা ও হর্ষ একদা আমার মুখমণ্ডলে আপন আপন ভাব প্রকাশ করিতে লাগিল। ভাবিলাম, অনঙ্গ সৌভাগ্যক্রমে আমার ন্যায় তাঁহাকেও সন্তাপ দিতেছে। শান্তস্বভাব তপস্বী কপিঞ্জল স্বপ্নেও মিথ্যা কহেন না; ইনি সত্যই কহিতেছেন, সন্দেহ নাই। এক্ষণে আমার কি কর্ত্তব্য ও কি বক্তব্য এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময়ে প্রতিহারী আসিয়া কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! তোমার শরীর অসুস্থ হইয়াছে শুনিয়া মহাদেবী দেখিতে আসিতেছেন। কপিঞ্জল এই কথা শুনিয়া সত্বরে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক কহিলেন, রাজপুত্ত্রি! ভগবান্ ভুবনত্রয়চূড়ামণি দিনমণি অস্তগমনের উপক্রম করিতেছেন। আর আমি অপেক্ষা করিতে পারি না; যাহা কর্ত্তব্য করিও, বলিয়া আমার উত্তরবাক্য না শুনিয়াই শীঘ্র প্রস্থান করিলেন। তিনি প্রস্থান করিলে, এরূপ অন্যমনস্ক হইয়াছিলাম যে, জননী আসিয়া কি বলিলেন, কি করিলেন, কিছুই জানিতে পারি নাই। কেবল এইমাত্র স্মরণ হয়, তিনি অনেকক্ষণ আমার নিকটে ছিলেন।
তিনি আপন আলয়ে প্রস্থান করিলে ঊর্দ্ধে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া দেখিলাম, দিনমণি অস্তগত হইয়াছেন। চতুর্দ্দিক্ অন্ধকারে আচ্ছন্ন; তরলিকাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তরলিকে! তুমি দেখিতেছ না আমার হৃদয় আকুল হইতেছে ও ইন্দ্রিয় বিকল হইয়া যাইতেছে? কি কর্ত্তব্য কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। কপিঞ্জল যাহা বলিয়া গেলেন, স্বকর্ণে শুনিলে। এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য উপদেশ দাও। যদি ইতর কন্যার ন্যায় লজ্জা, ধৈর্য্য, বিনয় ও কুলে জলাঞ্জলি দিয়া, জনাপবাদ অবহেলন ও সদাচার উল্লঙ্ঘন করিয়া, পিতা মাতা কর্ত্তৃক অননুজ্ঞাত হইয়া স্বয়ং অভিসারিকাবৃত্তি অবলম্বন করি, তাহা হইলে, গুরুজনের অতিক্রম ও কুলমর্য্যাদার উল্লঙ্ঘন জন্য অধর্ম্ম হয়। যদি কুলধর্ম্মের অনুরোধে মৃত্যু অঙ্গীকার করি তাহা হইলে প্রথমপরিচিত, স্বয়মাগত, কপিঞ্জলের প্রণয়ভঙ্গজন্য পাপ এবং আশাভঙ্গ দ্বারা সেই তপোধনযুবার কোন অনিষ্ট ঘটিলে ব্রহ্মহত্যা ও তপস্বিহত্যা জন্য মহাপাতকে লিপ্ত হইতে হয়।